গৃহযুদ্ধ পর্ব-১৭

0
1391

#গৃহযুদ্ধ
পর্ব ১৭
_______________
গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সুপ্তির চড় দেয়ার কারণ এবং মণিকা ভাবীর কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
সুপ্তি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
মণিকা ভাবী আমাকে বললো! রোহান ফুলীকে পাচ্ছিনা।
জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে খুলে বলুন।
‘ আমি কিছুই জানিনা। বেশ কয়েকঘন্টা আগে ফুলী বারান্দার গাছগুলোয় পানি দিচ্ছিলো। আমি একটা গান ছেড়ে চা খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম ভাংগে। উঠে দেখি ফুলী নেই৷ প্রায় দু ঘন্টা পার হতে চললো ওকে কোথাও খুঁজে পাইনি।
– ও কি বাইরে গেছিলো বা এমন কিছু?
– না বাইরে গেলে ও বাসার পোশাক পরে যায়না৷ ওর বাইরে যাওয়ার সব পোশাক ই গোছালো আছে। মনে হয়না এমন কিছু৷
– তাহলে আপনার কি মনে হয়?
বুঝতে পারছিনা।
– ছাদে খুঁজেছেন?
– হ্যাঁ। গিয়েছিলা।
ছাদে রেশমিকে দেখলাম বৃষ্টি বিলাসে ঘুমাচ্ছে। ফুলীকে পাইনি।
– রবিন তো আপনার বাসাতেই থাকে প্রায়শ। ও কোথায় আজ আপনার বাসায় যায়নি?
– না রবিন বাসায় যায়নি।
ওকে গিয়েও একটু জিজ্ঞেস করে দেখুন তো!
আমার ও মণিকা ভাবীর কথোপকথন শুনে সুপ্তি আবারো দরজার কাছে আসে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি চোখগুলোতে আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে।এমন পরিস্থিতি যেন মনে মনে ভাবছে মণিকা ভাবী সামনে থেকে একবার সরুক! তোর একদিন কি আমার একদিন।
গরম ভাত চুলো থেকে নামিয়ে রেখে দিলে যেমন আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায়, রাগের ব্যপারটাও তেমন।সময় আস্তে আস্তে কেটে গেলে তীব্র রাগও হালকা হয়ে আসে। সুপ্তির হাত থেকে বাঁচতে মণিকা ভাবীকে বললাম, চলুন ভাবী আপনার সাথে আমিও ফুলীকে একটু খুঁজি। রবিন ভাইয়ের কাছে এ বিষয়ে একটু খোঁজ খবর নেই চলুন। মণিকা ভাবী বললো- আচ্ছা চলো। সাথে সুপ্তিকেও ডাকলো।
সুপ্তি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাসা থেকে বের হলো।
রবিনের বাসার সামনে গিয়ে বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজালাম।
কেউ দরজা খুললো না।
মণিকা ভাবীর চোখে আতংক, উৎকন্ঠা।
সুপ্তির মাথায় রাগ জমে আছে। নিচে দিয়ে বেয়ে আসা রক্তের ফোয়ারা কেউ খেয়াল করলো না। কি মনে করে যেনো দরয়ার উপর হাত দিয়ে ধাক্কা দিলাম।
ক্যাচ-ক্যাচ শব্দ করে ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেলো৷
এরপরের দৃশ্যটা খুবই ভয়াবহ।
ফুলীর একটা কাটা হাত পড়ে আছে দরজার কাছে।
বাকি দেহটা বিছানার উপরে৷ গায়ে জামাকাপড় নেই। উদোম নাকমুখ সহ পুরো দেহে খামচির দাগ, গালের একপাশ থেকে মাংস উঠে দাঁত বের হয়ে গেছে।
সবথেকে বিভৎস দৃশ্য যেটা, ফুলীর নিম্নাংগে প্রবেশ করানো হয়েছে একটা মদের কাঁচের বোতল।
রবিন নেই কোথাও। ধপাস করে শব্দ হলো৷ পেছনে ফিরে দেখলাম সুপ্তি পড়ে গেছে। মনীকা ভাবী কান দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে একটা চিৎকার দিলেন। ভয়ানক চিৎকার। চিৎকার শুনে দৌড়ে আসলো রেশমি।
এসে বাসার ভেতরে একপলক তাকিয়েই ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরলো সে। ফোন দিলো নিকটস্থ পুলিশ অফিসে।
.
.

পুলিশদের আমার বরাবর বিরক্ত লাগে।
সুপ্তির জ্ঞান ফেরেনি। ওকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। আমাকে অনেক প্রশ্ন করলো তারা। মণিকা ভাবীর কাছে রবিনের ডকুমেন্টস চাইলো। বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার ডকুমেন্টস রাখা খুব জরুরি। মণিকা ভাবী ডকুমেন্টস দিলো। পুলিশ সেগুলো নিয়ে চলে গেলো৷ ফুলীর লাশও নেয়া হলো পুলিশি হেফাজতে, ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করতে।
পুলিশ যাওয়ার কয়েকঘন্টা পরে মণিকা ভাবী টের পেলো তার আলমারিতে রাখা সোনা গহনা নগদ অর্থ যা ছিলো, একদম কিছুই নেই। সব শূন্য।
যদিও বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ করেন নি তিনি। টাকাপয়সা অনেক আছে তার। রেশমি ছাড়া আমরা কেউ ই এখন আর স্বাভাবিক মন মানসিকতায় নেই। ফুলী মেয়েটার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। এমন ফুটফুটে একটা মেয়ে চোখের সামনে শুভ্র খরগোশের মত আনন্দে লাফালাফি করতো! তার কি অবস্থা দেখতে হলো নিজের চোখে৷
ফুলীকে আমি কখনো কান্না করতে বা মন খারাপ করতে দেখিনি। সবসময় হাসিখুশি দেখেছি!ওকে যখন অত্যাচার করা হয়েছিলো তখন ওর কান্না মাখা মুখটা কেমন ছিলো তাও কল্পনা করতে পারছিনা।
কিছুই ভালো লাগছেনা। মণিকা ভাবীর পুরো বিল্ডিং জুড়ে বিষন্নতা। সোফায় আমার পাশে বসে আছে রেশমি। ডিম লাইটের আলোয় রেশমি লাইটার খুঁজে সিগারেট ধরালো।। আহ, কি বিষাক্ত জীবন!
সুপ্তির চড় মারার কারণ বুঝে উঠতে পারলাম না।
ওর ফোন ধরে ঘাটাঘাটি করতে করতে মেসেঞ্জারে ঢুকলাম৷ সর্বশেষ যে মেসেজটি এসেছে, তা একটা ফেক একাউন্ট থেকে।
রেশমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এমন একটি ছবি ওকে পাঠানো হয়েছে।
বৃষ্টির সাথে ছবিটার ক্যাপচার দেখে খুব রোমান্টিক কাপল বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু ওই এটা তো একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।
কে করলো এই কাজ! রবিন? নাকি মণিকা ভাবি? এ দুজন ছাড়া ছাদে যাওয়ার তো কথা না কারো।
এ ছবিটা দেখেই হয়ত রাগে ফুলে ছিলো সুপ্তি।
জীবনটা আর সহজ নেই। বিষময় হয়ে উঠেছে। এ বাসায় আর থাকা যাবেনা। সিদ্ধান্ত নিলাম বাসা ছেড়ে দিব। রেশমিকে বলবো,নিজের ঠিকানা খুঁজে নিতে।
.
.
.
সুপ্তির জ্ঞান ফিরেছে।
তবে ও ভালো নেই। ওকে সুস্থ বলা যাচ্ছে না। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই ও প্রলাপ বকছে। গালি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে একা একাই হাসছে। আমি ওর কাছে গেলে ও কিছুক্ষনের জন্য চুপ থাকে৷ এরপর কান্না করে৷ পরক্ষনেই আবার হাসে। রেশমি এবং মণিকা ভাবীর ভাষায় সুপ্তি পাগল হয়ে গেছে।
ওকে ডাক্তার দেখাতে হবে। মণিকা ভাবী তার পরিচিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছেন।
ব্যয়বহুল চিকিৎসা, তবে খরচ নিয়ে আমাকে ভাবতে হবেনা। মণিকা ভাবী বলেছেন খরচ উনি দিবেন। ভাবী বাসায় একা থাকতে ভয় পায়। রেশমিকে তিনি সাথে রাখেন। আমার বাসায় থাকি আমি আর সুপ্তি। সুপ্তির থালা বাসন ছুড়ে ফেলা,আমাকে মারধর করা খামচি দেয়া, মাঝ রাতে দরজা খুলে হঠাৎ বাইরে বের হয়ে যাওয়া, এসবে আমার মোটেও বিরক্ত লাগেনা। কিন্তু খুব কষ্ট হয়। মেয়েটার কাছে এই পৃথিবীটা এখন কেমন? ভাবতে খারাপ লাগে।
আচ্ছা পাগলদের কাছে পৃথিবীটা কেমন হয়?
তারা হাসে, আবার পরক্ষনেই কাঁদে কেনো!
তাদের অনুভূতি গুলো এত মিশ্র কেনো!
সুপ্তি দিনশেষে ঘুমায়।
আমার কোলের ভেতরে ঢুকে বিড়ালের মত কাচুমাচু করে ঘুমায়। নিজেকে খুব পরিপূর্ণ লাগে তখন।
বেশ অনেকদিন,
সুপ্তির সাথে আমার কোন প্রকারের শারিরীক সম্পর্ক নেই। অথচ এ বিষয়টি আমার চিন্তায় ও আসে না। বরং অবুঝ সুপ্তির কপালে চুমু এঁকে দিতে আমার খুব ভালো লাগে। কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সুপ্তির রান্না করতে হয়না। রান্না করে মণিকা ভাবী। সুপ্তিকে মাঝে মাঝে নিজ হাতেও খাইয়ে দেয়। আমাদের দুজনার জন্য উনি নিজ হাতে রান্না করেন।মণিকা ভাবী একদিন সুপ্তিকে খাইয়ে দেয়ার সময় বললেন, রোহান, আসো তোমাকেও দু লোকমা খাইয়ে দেই। বলে তিনি নিজেই খাবার নিয়ে আমার কাছে আসলেন। আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন। এরপর সুপ্তিকে যখন আবার খাওয়াতে গেলেন সুপ্তি মনিকা ভাবীর হাত থেকে খাবারের প্লেট ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর বাচ্চাদের মত হাসতে লাগলো।
পাগলদের কি নির্দিষ্ট কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মে?
.
.
.
মণিকা ভাবী এবং রেশমির খুব বেশি ভাব হয়ে যায়। তারা একে অপরের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকে সব সময়। রেশমি এর মাঝে আরেকটি ছেলের সাথে রিলেশনে জড়ায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করে নিবে। মণিকা ভাবী নিজের বাসার ছাদে বিয়ের আয়োজন করে।
আমি মণিকা ভাবীকে আগেই জানিয়ে রাখি,
এলাকার ছোট খাটো সব ছেলেমেয়েদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি রাজি হন। সিদ্ধান্ত নেই সুপ্তিকে একটা আসমানী রঙ এর শাড়ি পড়িয়ে ছাদে নিয়ে যাবো৷
অবশেষে রেশমির কাঙ্ক্ষিত দিন আসে। ছোট ছোট পথশিশুরা আগেই এসে হই হুল্লোড় শুরু করছে। সেই সাথে এসেছে মাথায় লম্বা চুল গায়ে ছেডা জামা ও প্যান্ট পড়া একটা মধ্যবয়সী পাগল।
দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে বুঝলাম, পাগল লোকটি রেশমির প্রাক্তন হাজবেন্ড রফিক সাহেব।
পুরো বাড়িতে কেমন একটা আনন্দ আনন্দ ভাব। রেশমি ফোনে কথা বলছে।আমি কখন ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি তা খেয়াল করেনি রেশমি। ফোনের ওপাশের মানুষটার কাছে বলতে শুনলাম,
” মণিকা ভাবী! উনি তো অন্তঃসত্ত্বা। আমার মনে হয় রোহান কিছু করেছে। মণিকা ভাবী আমাকে সেটাই বললো। ”
রেশমির কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম আমি।
.
.
চলবে…
লেখকঃ Hasibul Islam Fahad

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে