#গৃহযুদ্ধ পর্ব ১৪
________________
সোফার উপরে রেশমির ঘুমন্ত দেহ নিথর হয়ে পরে আছে।
সুপ্তিও ডুবে গেছে গভীর ঘুমে।
বাসার লাইট নিভিয়ে আমি ড্রয়িং রুমে এপাশ-ওপাশ হাঁটাহাঁটি করে চলেছি। মাথায় অগোছালো কিছু চিন্তাভাবনা ঘূর্ণিঝড় তুলেছে। আবছা অন্ধকারের পরিবেশটা ধূমায়িত করে তুলে,তারপর জটিল সব চিন্তাভাবনায় ডুব দিতে হবে। ম্যাচের কাঠিতে ঘষা দিতেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো। সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম।
“রেশমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে ছেলেটার সাথে কথা বলে, সে যদি সম্পর্কে রেশমির কিছু হয়েও থাকে, কিংবা রেশমি যদি পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে রফিক সাহেবের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে, তাতে আমার কি!!
এটা রেশমির একান্তই ব্যক্তিগত ব্যপার।আমি নাক গলানোর প্রয়োজনবোধ করিনা।
তবে আমার সমস্যাটা অন্য জায়গায়! এসবের মাঝে সুপ্তি কেনো!
রেশমি আমাকে যখন সুপ্তি এবং রফিকের ইন্সিডেন্ট এর কথা বলেছিলো, তখন কথায় কথায় বলে ফেলেছিলো,
” রফিক, সুপ্তির রুমে ঢোকার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কি কি হয়েছিলো সব কিছুই আমার কাছে সংগ্রহিত আছে। আমি সব ভিডিও করে রেখেছি।”
রেশমির এ কথাদুটো আমার মস্তিষ্ককে ভাবিয়ে তুলে আছাড় মারে।
কিছুক্ষন পরে জটিল কোন কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমনটা যখন মানুষ শতভাগ শিওর থাকে, তখন ই কেবল ভিডিও ক্যামেরা অন করে তা রেকর্ড করার চিন্তাভাবনা করে।যদি রেশমির পূর্ব পরিকল্পনা না থাকত, তবে নিশ্চয় ই রফিক সাহেবের ঘটনাটা পুরোপুরিভাবে সে রেকর্ড করতে পারতো না। রেকর্ড করা তো দূরে থাক,সবকিছু যদি রেশমির বর্ননা মতো স্বাভাবিক থাকতো,।তবে রফিক সাহেব সুপ্তির ঘরের দিকে পা বাড়াতে দেখলেই রেশমি জিজ্ঞেস করতো, ওদিকে কেনো যাচ্ছো! কোন প্রয়োজন কিনা!”
যাই হোক!
যেহেতু পুরো বিষয়টার সাথে সুপ্তি জড়িয়ে গেছে, তাই রেশমির পারসোনাল জীবনে একটু তো ঘাটাঘাটি করতেই হয়।
সিগারেট শেষ হয়ে এসেছে৷ তবে পুরো শেষ হয়নি। সিগারেটের থেকে রহস্য আমাকে বেশি টানে।
বাকি যেটুকু ছিলো তা অ্যাশট্রেতে ফেলে উঠে গেলাম।
আমার সামনেই রেশমি। রাতের নিস্তব্ধতায় ওর নিঃশ্বাসের শব্দটাও কানে এসে লাগছে।
মাথার কাছ থেকে রেশমির ফোনটা নিলাম। ওর ফিংগারপ্রিন্ট ইউজ করে ফোনের লক খুললাম। একজন মানুষের ব্যক্তিগত মোবাইল হাতে পাওয়া মানে তার সবকিছুই পেয়ে যাওয়া, কন্টাক্ট লিস্ট সহ সবকিছু ধীরে ধীরে চেক করতে থাকি, আস্তে আস্তে বের হতে থাকে ভয়ানক সব তথ্য।
সবচেয়ে বেশি শকড হই যখন আমি রেশমির গ্যালারিতে ঢুকি। একটু নিচের দিকে স্ক্রল করতেই দেখতে পাই সুপ্তির ছবি।
রেশমির ফোনের গ্যালারিতে সুপ্তির ছবি থাকবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না৷ কিন্তু ছবি গুলো কোনো স্বাভাবিক ছিলোনা। জামাকাপড় বিহীন পুরো নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে সুপ্তি, ঘুমন্ত অবস্থায় আছে ও।
পাশে একই অবস্থায় শুয়ে আছে রেশমিও,কিন্ত ও ঘুমন্ত না। ছবি তোলার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, রেশমি এক হাত দিয়ে সুপ্তির সাথে এমন ছবি তুলেছে।
কিন্তু এটার উদ্দেশ্য কি হতে পারে!
রেশমি কি সমকামী!
ছবিগুলো আমার ডিভাইসে শেয়ার করে নিয়ে ডিলেট দিয়ে দিলাম।
ফোন ঘাটাঘাটি করে বের হয়ে এলো আরো চমকপ্রদ তথ্য।এখন ইচ্ছে করছে রেশমিকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে চেয়ার সমেত উলটো করে ফ্যানে ঝুলিতে রাখতে। কিন্তু এটা করা আমার জন্য খুব বোকামির কাজ হবে।
রেশমিকে ওর কাজ সামনে এগিয়ে নিতে দিলেই বরং আমার লাভ। একটা পুঁটিমাছ যদি হুট করে বিশাল সমুদ্রে এসে পরে তবে কেমন লাগবে!
আমার কাছে ঠিক তেমনটাই লাগছে।
রেশমির ফোন থেকে বেশ কিছু ডকুমেন্টস ও আমি আমার নিজের ডিভাইসে ফরোয়ার্ড করে নিলাম।।
সাথে ছিলো রফিক সাহেবে যে সুপ্তির রুমে প্রবেশ করেছিলো সে ভিডিওটাও।
বারান্দায় বসে ভিডিওটা কমপক্ষে বিশ বারের উপরে দেখলাম এবং একটা দারুণ বিষয় আবিষ্কার করলাম ঐ সময়ে রেশমির বাসায় শুধুমাত্র রফিক সাহেব সুপ্তি রেশিমি এবং কাজের মেয়ে বাদেও তৃতীয় আরেকজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলো। মাত্র কয়েকসেকেন্ডের জন্য যার আবছা একটা ছায়ার প্রতিফলন দেখা গেছে।
আমি যদি ভুল না করি ফুলদানি দিয়ে জোড়ালো আঘাতটাও তৃতীয় কোন ব্যক্তি করেছে রেশমি না। ক্যামেরার এংগেলে সেটা বোঝা না গেলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে আমি ধারণা করে নিলাম।
রফিক সাহেবের সাথে আমার কথা বলাটা খুবই জরুরি।
শরীরের সব জামাকাপড় খুলে নিলাম।
অন্ধকারের চাঁদর ছাড়া আমার গায়ে আর কিছু নেই।
রকিং চেয়ারে বসে হাত পা ছড়িয়ে একটু রিলাক্স হওয়ার চেষ্টা করলাম। মাথায় চিন্তার প্রেসার বেশি থাকলে উদোম গায়ে চিন্তাভাবনা করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসাটা সহজ হয়ে পরে।
নিজেকে অনেকটা হালকা ও ফুরফুরে লাগে।
ঠান্ডা মাথায় ভেবে চলেছি, চারপাশের অবস্থা খুব জটিল হয়ে গেছে। সুপ্তিকে নিয়ে অচিন কোন জায়গায় পাড়ি জমবো কিনা!
যেখানে আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করার কেউ থাকবেনা! নতুন একটা জীবন শুরু হবে আমাদের!
নাকি যে ঝামেলা গুলো জট পাকিয়ে আছে তার প্যাঁচ আস্তে আস্তে খোলার চেষ্টা করবো!
দুটো রাস্তায় আবার ফলাফলটাও ভিন্ন।
সুপ্তিকে নিয়ে দূরে চলে গেলে আমাদের চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়বে।
খাওয়াদাওয়ার নিশ্চয়তা থাকবেনা।
ভালোবাসাপূর্ণ হলেও জীবন হয়ে উঠবে কঠিন।
পরবর্তী রাস্তায়,
জটে জটে রিএওয়ার্ড, একটা জট খুলে ফেলা মানে বড় অংকের টাকাপয়সা নিজের পকেটে আসা। তবে রিস্ক ও কম নয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলার রিস্ক আছে,চিরতরে।
.
.
.
ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে এলো কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। কি অনিশ্চিত আমাদের জীবন। বাথরুমে প্রবেশ করে ঝর্ণা ছেড়ে দিলাম।
নিজেকে ছোট বাচ্চাদের মত লাগছে। ছোট বাচ্চারাই শরীরে কিছু না জড়িয়ে ঘরের এদিক সেদিক দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। আমিও সেটাই করছি।
বেশ অনেক্ষন ধরে গোসল করলাম। ঝর্ণায় ভিজলাম। টাওয়েল আনতে মনে নেই। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বেডরুমে গিয়ে টাওয়েল নিলাম। মেঝের অনেক জায়গা শরীরের পানিতে ভিজে গেলো।
বেডরুম থেকে টাওয়েল নিয়ে এসে আবার বাথরুমে ঢোকার ঠিক আগ মুহুর্তে চোখ গেলো বাসার দরজার পাশের জানালার উপরে। চোখ পড়তেই দেখলাম কেউ একজন দ্রুত সরে গেলো। আমি ভুল না করলে ওটা মণিকা ভাবি ছিলো। লাফ মেরে বাথরুমে ঢুকলাম।গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে নিলাম। দরজার ফাঁকা দিয়ে হাত বের করে বাথরুমের লাইট অফ করে দিলাম। পরক্ষনেই হুঁশ হলো! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে এখন এগুলো করে কি লাভ! লজ্জায় বাথরুমের ফ্লোরে বসেছিলাম অনেক্ষন।
.
.
.
সন্ধ্যার দিকে ঘুম ভাংগে সুপ্তি এবং রেশমির।
ওদের জন্য খাবার রেডি করা ছিলো। আমি গরম করে টেবিলে খাবার খেতে ডাকি। দুজনের কেউ ই তেমন কিছু টের পায়নি। ভেবেছে স্বাভাবিকভাবে একটু বেশি ঘুম হয়েছে সবার। ওদের সাথে আমিও এমন ভাব করেছি,
যেন আমার ঘুম ও একটু আগেই ভেংগেছে।
খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হওয়ার পরে রেশমী সোজা বাথরুমে চলে গেলো। বাথরুম থেকে
শ্যাম্পুর বোতল এবং এক মগ পানি নিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো আমার ফ্লাট থেকে। ওর পিছু নিলাম আমি এবং সুপ্তি। দেখলা। মণিকা ভাবির দরজার সামনে রেশমি শ্যাম্পু এবং পানির মিশ্রন তৈরি করে খুব সুন্দরভাবে লেপন করছে। ওর কার্যক্রম দেখে আমার রাগ লাগলো। মণিকা ভাবী একবার আছাড় খেয়ে পরে বেশ কয়েকদিন অসুস্থ ছিলো, এখন রেশমি যেটা করছে সেটা একদম ই ঠিক করছে না। আমি অনেক সিরিয়াস মুডে রেশমিকে নিষেধ করলাম, বললাম যে কাজটা করেছো, ঠিক করোনি৷ বিষয়টাকে তুমি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছ রেশমি।
রেশমি আমার দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি হেসে বললো! বালাবালি! কিসেল বালাবালি! আমাল জীভ যে পুলিয়ে দিলো,এখন আমি থিকমতো কথাও বলতে পালিনা! বালাবালি তো মণিকা ই কলেছে। এল শেষ আমি দেখে ছালবো।
রেশমির কথা শুনে সিরিয়াস মুহুর্তে অনেক হাসি আসলো। পেটে হাসি চাপিয়ে রেশমিকে বললাম,
মণিকা ভাবীর বাসায় ফুলীও থাকে। ওর কোন বিপদ হয়ে যেতে পারে। তুমি যাই করো ভেবেচিন্তে করবে৷
আমাদের কথাবার্তার শব্দ শুনে দরজা খুলে বের হলো মণিকা ভাবি। এক পা সামনে দিতেই শ্যাম্পু পানির দ্রবনে পা পিছলে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। পাশে আমি দাঁড়ানো ছিলাম। আছড়ে পরে যাওয়ার আগেই ধরে ফেললাম তাকে।
মণিকা ভাবি তার দু হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো! এটা একটু বাড়াবাড়ি। উনি এমনটা না করলেও পারতেন। টুপ করে ওনাকে ছেড়ে দিলাম আবার। উনি হয়ত এটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ফ্লোরের উপর আছড়ে পড়লেন।বড় ধরণের কোন ক্ষতি না হলেও পুরো ব্যাপারটায় উনি ভীষন অপমানিত হলেন।
রেশমি তো হেসেই খুন!
তোতলাতে তোতলাতে বললো!
ডিয়াল ভাবী মণিকা,
যতই বুদ্ধী খাতাও পাঁকা,
আমি আংগুল কললে বাকা,
আপনাল হয়ে যাবে থব ফাঁকা!
সুপ্তি গিয়ে মণিকা ভাবীকে ফ্লোর থেকে তুলে নিলো এবং রেশমির পক্ষ হয়ে ক্ষমা চাইলো।
মণিকা ভাবী কিছুই বললেন না। চুপচাপ উঠে খোড়াতে খোড়াতে ভেতরে চলে গেলেন। দরজা আটকে দিলেন।
মনে মনে ভাবলাম! এই বুঝি বাড়ি ছাড়ার নোটিশ আসবে!
তিনজন বাসায় ফিরে এলাম।
আমার মাথা কিছুতেই স্বাভাবিক রাখতে পারছিলাম না।
রেশমিকে সহ্য হচ্ছেনা।
চাপ দাঁড়িওয়ালা ছেলেটার সাথে রেশমির একটা সম্পর্ক রয়েছে, রফিক সাহেবকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পর,ঐ ছেলের সাথে চ্যাট, মেসেজ এবং ছবি আদান প্রদানের কোন কিছুই সে ডিলেট করেনি৷ কিন্তু তার আগের সবকিছুই রেশমির ফোন থেকে ডিলেট করা। এর একটাই মানে হতে পারে। রফিক সাহেব হয়ত রেশমির ফোন নিয়মিত চেক করতেন। এজন্যই রেশমি সবকিছু ডিলেট করে রেখেছিলো। আমার সিক্সথ সেন্স যা বলছে,
তা হলো,
সুপ্তির দেহের প্রতি রফিক সাহেবের যাতে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, এজন্য রেশমি তার নিজের ফোনে সুপ্তির এসব ছবি তুলে রেখেছিলো। রফিক সাহেব যখন রেশমির ফোন চেক করতেন, তখন সুপ্তির এরকম ছবি দেখে তার মাথায় বাজে চিন্তা ভর করেছিলো!
তবে এটা আমার ধারণা মাত্র।
আপাতত নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে।
আন্ডারগ্রাউন্ড বস দের কাছে, এখন আমি টপ টার্গেটের একজন। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসেনা। ওরা যে ব্যক্তিকে খুন করার জন্য টার্গেট করেছে সেটা আমার ছদ্মবেশ।
সাধারণ জীবনে আমি নিতান্তই ভদ্র একজন মানুষ।কয়েকঘন্টার ভেতরে
রেশমির ব্যবহার হুট করে পরিবর্তন হয়ে গেলো।
রেশমি অপরাধ বোধ নিয়ে আমার দিকে এবং সুপ্তির দিকে তাকাচ্ছে।
আমাদের দুজনকেই এড়িয়ে চলছে।
ছবিগুলো ডিলেট করে দিয়েছি ওর ফোন থেকে সেটা ও টের পেয়েছে হয়ত এতক্ষনে।
ওর ফোনে একটা বার্তা ড্রাফট বক্সে সেভ করে রেখেছিলাম,
” আমি ভাবতেও পারছিনা এমন কিছু ছবি এ ফোনে খুঁজে। যাই হোক আমি ওকে এ বিষয়ে কিছু বলবো না। শুধু ওকে না কাউকেই কিছু বলবোনা। ”
বেচারি যদি মেসেজটা পড়ে থাকে তবে কনফিউশান এ পড়ে যাবে, আমি নাকি সুপ্তি কার কাছে ও ধরা পরে গেছে!
মানুষের মনের ভেতরে এরকম প্রেসার সৃষ্টি করে রাখার চেয়ে বড় মাপের শাস্তি আর হয়না। তবে এর থেকেও ভয়ানক শাস্তি,অপেক্ষা করছে রেশমির জন্য,এবং অবশ্যই সেটা শারিরীক।
.
.
চলবে..
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ