গৃহযুদ্ধ পর্ব-১২

0
1313

#গৃহযুদ্ধ পর্ব ১২
_______________
__________________

ব্যাগে কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে সুপ্তির সাথে সন্ধ্যায় আমার বাসায় উপস্থিত হয় রেশমিও।
বেশ অনেকদিন পর সুপ্তি বাসায় ফিরলো। কিন্তু ও এসে ওর রুমে দরজা আটকে বসে ছিলো। রেশমি ওকে কি বুঝিয়ে এনেছে জানি না। তবে বাসায় ঢোকার পর সুপ্তির চোখের পানি যেন বাঁধ মানে না৷ কলিংবেল বাজার পরে আমি দরজা খুলতেই সুপ্তি এক দৌড়ে আমাদের বেডরুমে চলে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়৷
গিয়ে বেশ কিছুক্ষন দরজা ধাক্কা ধাক্কি করি আমরা দুজনেই। কিন্তু সুপ্তির হেঁচকি দিয়ে কান্না করার আওয়াজ ছাড়া আর তেমন কোন সাড়া-শব্দ পেলাম না।
মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ভীষন অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে আছে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়না।
অদ্ভুত এক পৃথিবী! দোষ না করেও কেন যেন দোষী! ঠিক গাছে ফুটে থাকা সবথেকে সুন্দর ফুলের মত।
সুন্দর হওয়ার অপরাধে মানুষ সেটা ছিড়ে নেয়৷ প্রকৃতি মাঝে মাঝে কিছু কিছু মানুষের সাথে ঘোর অন্যায় করে ফেলে।
সোফায় বসে দু হাত মাথার পেছনে দিয়ে কথাগুলো ভাবছিলো রোহান। এর ভেতরে কলিংবেল বেজে ওঠে হঠাৎ।
দরজা খুলতেই,ভেতরে মণিকা ভাবির আগমন৷
– রোহান! তোমার বাসায় গেস্ট এসেছে?
– হুম আপনাকে বলেছিলাম না! সুপ্তি ওর বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গেছে। আজ সুপ্তি এবং ওর সেই বান্ধবী এসেছে।
– ভেতরে আসতে পারি!
– অবশ্যই।
ভেতরে ঢুকে মণিকা ভাবী। শাড়ির আচল ডান হাতে ধরে আভিজাত্যের ভাব নিয়ে হেঁটে সোফায় এসে বসে সে।
রেশমির দিকে তাকিয়ে বলে,
– হাই, আমি মণিকা৷ এ বাড়ির মালিক।
– আসসালামু আলাইকুম, ভাবী,
আমি রেশমি।সুপ্তির বান্ধবী।

পরিচিত হওয়ার পরে, রেশমির সাথে টুকটাক কথাবার্তা চালিয়ে যায় মণিকা ভাবী।আমি দুজনকে বসতে বলে চা বানাতে ভেতরে গেলাম।
মণিকা ভাবী যেখানেই থাকুক, ঘুরে ফিরে তার কথার ভেতরে রান্নার বিষয়টা চলে আসে।
মণিক ভাবী হুট করেই রান্না বান্নার বিষয়ে আলাপ শুরু করলো। বিশাল এক বক্তব্য দিলো।রেশমি হয়ত বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু কিছু মুখ ফুটে কিছু বলছেনা৷
আমি চা নিয়ে এলাম। বেশি করে কনডেন্সড মিল্ক আর হালকা চিনি দিয়ে।
চায়ে চুমুক দিয়েই মণিকা ভাবী গড়গড় করে বলে দিলো চায়ে ক’চামচ চিনি এবং ক’চামচ দুধ দিয়েছি।বিষয়টায় আমিও খুব অবাক হলাম।
রেশমির দিকে তাকিয়ে মণিকা ভাবী হাসতে হাসতে বললো, সুপ্তি তো রান্না বান্নায় একদম অকর্মার ঢেঁকি।
ওর রান্নার হাত একদম ই ভালো না।
রেশমি কথাটা শুনেই চা খাওয়া বাদ দি মণিকা ভাবীর দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। এরপর অবজ্ঞার গলায় বললো,
সুপ্তির রান্নার হাত ভালো না, আর আপনার তো চেহারা-ই ভালো না।
সরাসরি এমন একটা কথা শুনে মণিকা ভাবী বেশ অপমান বোধ করলেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার কপাল ঘেমে গেছে, নাকের উপরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। চায়ের কাপটা হাত থেকে টি টেবিলে রেখে তিনি উঠে হন হন করে বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। ঠিক প্রথমদিন সুপ্তিকে রান্না নিয়ে অপমান করে যেমন ভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমন ভাবে।
তবে পার্থক্যটা এটুকুতেই যে!
সেদিন অপমান করে বের হয়ে গেছিলেন আজ অপমানিত হয়ে বের হয়ে গেছেন।
.
.
.
কিছু বাজার সদয় করার জন্য বাসা থেকে বের হলাম।
বাসা থেকে নামতেই প্রথমে চোখ গেলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা দুটো ছেলের উপর।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হলো এরা মিরাতের লোক। হয়ত রেশমি যে আমাদের বাসায় সেটা জেনে গেছে৷
কিন্তু কিছুক্ষন পরখ করার পরে দেখলাম ভিন্ন কিছু৷ দুজনের ভেতরের একজন একটু চাপ দাঁড়িওয়ালা, ফতুয়া এবং জিন্স পড়া৷ ওর দৃষ্টি আমার বাসার বারান্দায়। বারান্দার ওপাশে কে আছে ঠিক বুঝছি না, সুপ্তি বা রেশমি হবে কেউ একজন। তবে রেশমি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷ সুপ্তিকে তো ওর নিজের রুমে ঢুকেই কান্না করতে দেখে এলাম।
ছেলেটা বারান্দার দিকে তাকিয়ে মোবাইলে কথা বলে যাচ্ছে। চেহারাটা ভালোভাবে মনে আয়ত্ত করে চলে গেলাম বাজারের দিকে।
.
.
.
মিরাতের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে কাব্য৷ একটা ছোট কাজ দেয়া হয়েছিলো তাকে সেটা করতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।
মিরাত একটা ছবি বের করে কাব্যর হাতে দিলো।
বললো
– স্যার এই মিশনে আমাদের বেশ ক’য়েকজন লোক খুন হয়েছে।
আমরা এসবের পেছনে এই ছেলেটাকে সন্দেহ করছি৷ আমাদের সন্দেহ যদি পাকাপোক্ত হয়, তবে সবার আগে এটাকে মারবো। কাব্য উত্তরে বলে পাকাপোক্ত হওয়ার কি আছে! যদি এমন কিছু হয়, তবে ওর মাথাটা স্নাইপার দিয়ে কদবেলের মত উড়িয়ে দাও৷ আমি আমার কাজ তাড়াতাড়ি হওয়া চাই৷
টাকা তো তোমাকে এডভান্স দেয়া-ই হয়েছে।
মিরাত মাথা চুলকাতে চুলকাতে কাব্যর অফিস থেকে উঠে যায়৷
.
.
.
বাজার নিয়ে বাসায় ফেরার সময় পথ আগলে দাঁড়ায় মণিকা ভাবী৷
রোহানকে বলে,
আরে বাজার করে এসে একদম ঘেমে গেছো যে!
আমার বাসায় বসে একটু এসিতে ঠান্ডা হয়ে নাও, পানি খেয়ে নাও, তারপর বাসায় যেও৷
– না ভাবি, আমার তাড়া আছে একটু।
– আহা, তোমার সাথে আমার জরুরী কথাও আছে। আসো আসো ভেতরে আসো।
রোহান ব্যাগগুলো মণিকা ভাবীর বাসার সামনে রেখে তার সাথে বাসার ভেতরে ঢুকে।
রোহানকে এক গ্লাস লাচ্চি খেতে দিয়ে মণিকা ভাবি বলেন,
রোহান তুমি বরং আমাকে তুমি করেই বলো আর মণিকা ভাবী নয়। শুধু মণিকা ডাকবে৷ আজ সুপ্তিকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় রাতে তিনজন ই খেতে আসবে।
রোহান, জ্বী আচ্ছা বলে রাজী হয়ে গেলো।
মণিকা ভাবীকে আজ একটু অন্যরকম লাগছে৷
তার চেহারায় থাকা দাগগুলো বোঝা যাচ্ছেনা। ত্বক আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
রোহান একটা কথা বুঝে উঠতে পারছেনা। রেশমি কোন হিসেবে বললো মণিকা ভাবীর চেহারা খারাপ! বরং রেশমি এবং সুপ্তির চেয়ে মণিকা ভাবী বেশি ই সুশ্রী! তাহলে রেশমী বললো কেন যে সে দেখতে ভালোনা!
কথাটা রেশমীকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
বাজার হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
রেশমী এবং সুপ্তি সোফায় বসা। আমাকে দেখেই সুপ্তি চোখ ফ্লোরে নামিয়ে ফেললো। লজ্জা পেলো নাকি কষ্ট পেলো বুঝলাম না। মনে হলো শুধু আমি হয়ত খুব অপরিচিত কেউ, এবং সে আমার বিয়ে করা একদম নতুন বউ৷
নতুন বউ যেমন বর দেখলে লজ্জা পায় কাচুমাচু করে সুপ্তিও এখন সে কাজটাই করছে।
শুধু পার্থক্য হলো নতুন বউ যা করে লজ্জা থেকে করে, সুপ্তি করছে নিজের ভেতর অপরাধ বোধ থেকে।
বাসায় ঢুকে বললাম রাতে মণিকা তার বাসায় আমাদের খেতে দাওয়াত দিয়েছে।
মণিকা ভাবীকে নাম ধরে মণিকা বলায় সুপ্তি আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। আবার পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে ফেললো।
সুপ্তির সামনেই রেশমিকে জিজ্ঞেস করলাম,
মণিকা ভাবী তো দেখতে ভালো ই, তাহলে তাকে বললে যে, সে দেখতে ভালো না! ব্যপারটা কি বলো তো রেশমি!
– ব্যপার কিছুনা। সুন্দর মানুষকে অসুন্দর বললে তাদের গায়ে বেশি লাগে।
– সুপ্তি রেশমির দিকে তাকিয়ে বলে, একজন আমাকে বলেছিলো আমি তার কাছে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী। এখন আর আমাকে সুন্দর লাগেনা। মণিকা ভাবীকে তার সুন্দর লাগে। আমার কপালটাই পোড়া।
আমি কিছু বললাম না। শুধু হাসলাম।
সুপ্তি
তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে,
একটু পর রুমে এসো।
বলে বাজারগুলো কিচেনে রেখে আমি চলে গেলাম আমাদের রুমে।
সুপ্তি হয়ত আসতে চাচ্ছিলো না।
রেশমি মনে হলো সুপ্তিকে কিছু একটা বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলো আমার কাছে।
ও রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো, আমার কাছে না এসে দরজার সামনে দুপা একসাথে মিশিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
– এদিকে এসো।
– বলো কি বলবে।
– দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
– এমনি।
– রেশমি আমাকে বলেছে সব। ওগুলো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এখন কাছে এসে বসো। জরুরী আলাপ আছে।
বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও আমার কাছে আসেনা সুপ্তি।
– এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
বলে হালকা ধমক দেই ওকে।
দরজার পাশে থাকা লাইটের সুইচ টিপে লাইট বন্ধ করে দেয়।
এরপর দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলে,
জানো রোহান ওরা আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছে।
অনেক বেশি। আমি অনেক ব্যাথা পেয়েছি পুরো শরীরে। আমাকে অনেক মেরেছে।
কথাগুলো শুনে আমার চোখ থেকে অজান্তেই পানির ফোঁটা টপটপ করে ঝড়ে পড়তে লাগলো। ওকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার শক্তিও চলে গেছে। মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছি।
.
.
.
চলবে…..

লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে