#গৃহযুদ্ধ পর্ব ৮
______________
স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগে আমার।
মানতেই কষ্ট হচ্ছে,
সুপ্তির নামের পেছনে এখন ধর্ষিতা ট্যাগ লাগানো! সবকিছু শোনার পরে মনে হচ্ছিলো রাগে আমার কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
সেদিন যখন মণিকা ভাবী এক্সিডেন্ট করলো, আমি যেতে চেয়েছিলাম ভাবির সাথে৷ কিন্তু সেখানে বেশি বুঝে আমাকে যেতে না দিয়ে ও বের হয়ে গেছে৷ ওর তো কোন দরকার ছিলো না অত রাতে বের হওয়ার। সেফটির একটা বিষয় আছে। নিজে যদি সাবধান হয়ে না চলে, বিপদে পরে তাহলে কার ই বা কি করার আছে।
কথা গুলো ভাবার সাথে সাথে রেশমিকেও বলে ফেললাম।
রেশমি উত্তরে জানালো, কেউ কি ইচ্ছা করে ধর্ষিত হয় রোহান? উলটা কথা কেন বলছো! ঠিক ই করেছে সুপ্তি তোমার কাছে যায়নি। গেলে এসব কথা শুনতে হতো, ওর যেখানে এখন সাপোর্ট দরকার, সেখানে উলটো আরো আঘাত পেত৷ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত সহজে মেনে নেয়া যায়না।
– সুপ্তি জানে যে আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি। নিজেকে হেফাযতে রাখার দায়িত্বটাও তাই ওর নিজেরই ছিলো।আমাকে কিছু বুঝাতে এসো না।
ছয় সাতজন ছেলের কাছে ভোগ হওয়া শরীরের প্রতি আমার আর রুচি আসবেনা।
বলেই চেয়ার ধাক্কা মেরে ফেলে উঠে আসলাম।
এবার আর কোন হাঁটাহাঁটি নেই। একটা পাঠাও রাইড ভাড়া করে চলে আসলাম বাসায়।
এসে জামাকাপড় খুলে সব ফ্লোরে ফেলে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম।
চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরানো কিছু স্মৃতি।
সুপ্তির সাথে আমার এক বছরের প্রেমের সম্পর্ক। তারপর বিয়ে।
রিলেশনের শুরু থেকেই ও আমার প্রতি শতভাগ ডেডিকেটেড ছিলো।
কেউ যদি আমাকে এসে বলতো, যে সুপ্তির সাথে ফোনে কথা হয়েছে, হোক ছেলে কিংবা মেয়ে, আমি বিশ্বাস করতাম না। কারণ সুপ্তি যে কারো সাথেই কথা বলুক না কেন, আমাকে নিজ থেকেই জানাতো।
ও আমাকে রেখে তো কখনো এক গ্লাস পানিও খেত না।
খুব মনে পড়ছে আগের দিনের কথাগুলো। অফিস থেকে এসে যখন ও রান্না করতো, আমি বারবার ও ক্লান্ত চেহারার, ঘর্মাক্ত দেহের প্রেমে পড়তাম। আদরে আদরে আমাদের ছোট্ট কিচেনটাকে স্বর্গতুল্য করে তুলতাম। সকালে আমার ঘুম ভাঙতো সুপ্তির চুমো খেয়ে।খুব অল্পতে তৃপ্ত ছিলো মেয়েটা। পথের পাশে পরে থাকা ফুল তুলেও যদি ওর হাতে দিতাম, প্রচন্ড খুশি হত ও। মনে হত পুরো পৃথিবীটা হাতে পেয়েছে।
রান্না ভালো না পারা সত্তেও অফডে তে টুকটাক পিঠা বা ভিন্ন কিছু বানিয়ে আমাকে খাওয়াতে চেষ্টা করতো। আমাদের ভালোবাসার কমতিটাই বা ছিলো কোথায়!!তবে সবকিছু হঠাৎ করেই কেন এমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল?
না চাইতেও অসীম ভালোবাসার মাঝে সৃষ্টি হলো অসীম দূরত্ব।
সুপ্তির কথা মনে পড়লে আগে হাজারো মন খারাপের মাঝে আমার মন ভালো হয়ে যেত।
আর এখন ওর কথা মনে পড়লে রাগে আমার হাত পা কেঁপে উঠছে।
কিন্তু নিজেকেও সর্বহারা মনে হচ্ছে,
কি নেই এখন আমার!
বাসায় খাবার আছে, পকেটে টাকা আছে, রুমে সুন্দর করে সাজানো ফার্নিচার আছে।
কিন্তু মনে সুখ নেই। ভালোবাসার মানুষটা নেই। ভালোবাসার মত কেউ নেই।
ফোনটা হাতে নিয়ে হাসপাতালে কল করলাম, মণিকা ভাবি কেমন আছে আপডেট নিলাম।
তার শারিরীক অবস্থা এখন উন্নতির দিকে।
মণিকা ভাবী তার জীবনে অনেকটাই একা।
ঠিক সুপ্তির মত।
সুপ্তি বড় হয়েছে ওর মামার বাসায়। ওর ছোট ভাই পলাশের বয়স যখন পাঁচ, তখন একটা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ওর মা বাবা, এরপর ওদের দুজনের জীবন হয়ে যায় জলে ভাসা পদ্মপাতার মত। সুপ্তিকে যে আমি বিয়ে করেছি এটা ওর মামার বাসার লোকেরা জানে, বিয়ের আগেই জানানো হয়েছিলো।
” বিয়ে করবি? আচ্ছা করে নে। ছেলে ভালো তো? ”
এ কথাগুলো বাদে আর কিছুই বলা হয়নি বা করা হয়নি সুপ্তির জন্য।
ওকে বিয়ে করেছিলাম খুব সাধারণ ভাবে, একটা কাজী অফিসে গিয়ে। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত ওর মামার বাড়ি থেকে একটা ফোনকলও আসেনি।পলাশ একটা আবাসিক স্কুলে লেখাপড়া করছে।
ছুটি পেলে মাঝে মাঝে বাসায় আসে।
পলাশ আর আমাকে ঘিরেই সুপ্তির পুরো পৃথিবীটা।
কিন্তু কিছু কিছু মানুষের কপালে আল্লাহ হয়ত সুখ লিখে রাখেন না। সুপ্তির বেলায় ও তাই। ভালোবাসায় টইটুম্বুর আমাদের চার মাসের সংসারে দুঃখ কি সুপ্তি তা কখনো অনুভব ই করেনি। আমি করতে দেইনি। কিন্তু সেদিন মণিকা ভাবি যখন খাবার ফেলে উঠে চলে গেছিলো,
ও প্রচুর কষ্ট পেয়েছিলো। শুরুটা হয়ত তখন থেকেই৷
নিজের মনের বিরুদ্ধে কি কিছু করা যায়?
এইযে এখন আমি মন থেকে সুপ্তিকে মেনে নিতে পারছিনা! কি করব এখন! কি ই বা করার আছে আমার।
ছয় সাতজন ছেলে মিলে একটা মেয়ের দেহের উপর হামলে পড়লে, আর কি ই বা বাকি থাকে!!
শোয়া থেকে উঠে বসলাম গায়ে জামা চাপিয়ে চলে গেলাম মণিকা ভাবির বাসায়।
নক করতেই দরজা খুলে দিলো ফুলি।
জিজ্ঞেস করলাম, রান্না করেছিস, খেয়েছিস?
ফুলি বলল, জ্বী ভাইয়া করছি।
বললাম, রাত থেকে আমার জন্য ও করিস। আজ থেকে তোদের এখানে খাবো।
মাস শেষে বিল দিয়ে দিব।
ফুলি আমার কথা শুনে এক হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসলো।
জিজ্ঞেস করলাম, কিরে হাসিস কেনো?
ফুলি বললো- আফায় আপনের কাছ থেকে খাওনের টাকা নিবে না ভাইয়া৷ আপনে এখানে খাওয়াদাওয়া করবেন এইটা আফায় শুনলে অনেক খুশি হইবে।
– রান্নাবান্না কি সবসময় তুই ই করিস?
– না রান্না বাদে বাকি কাজ-কাম আমি করি। কিন্তু রান্না করে মণিকা আফায়। উনি আমারে হাত দিতে দেয়না।
– আচ্ছা। আমি বারান্দায় বসছি। তুই চা নিয়ে আয়৷
ফুলি চা আনতে চলে গেল। আমি বারান্দায় গেলাম।
গাছের পাতাগুলো লালচে হয়ে গেছে। মেয়েটা বোধহয় ঠিকভাবে গাছে পানি দেয়না। পাশেই গাছে পানি দেয়ার জন্য একটা পাইপ লাগানো ছিলো।
ওটা হাতে নিয়ে সব গাছগুলোতে পানি দিতে লাগলাম৷
বাগান করা আমার সব সময়ের শখ ছিলো।
সুপ্তির ও অনেক ইচ্ছে ছিলো আমাদের বারান্দা হবে সবুজ গাছে পরিপূর্ণ। ইচ্ছে থাকলেও টাকা ছিলো না। টাকা পয়সার সমস্যা দূর করতেই সুপ্তি চাকরিতে যোগ দেয়। দিন রাত অফিসে পরে থেকে পরিশ্রম শুরু করে। যখন ই অভাব দূর হয়ে গেলো। শখ গুলো পূরণ করার সময় এলো তখন ই ও আর নেই।
ওর হাড়ভাংগা খাটুনিও বৃথা! সবার কপালে সবকিছু থাকেনা। অথচ আমি তেমন পরিশ্রম না করেও সবুজে ঘেরা বারান্দার সৌন্দর্য, শান্তি উপভোগ করতে পারছি।
এজন্য অবশ্য মণিকা ভাবিকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার।
চা চলে আসলো কিছুক্ষনের মধ্যেই, রকিং চেয়ারর শুয়ে সেন্টার টেবিলের উপরে পা উঠিয়ে দিয়ে আয়েশ করে একটা চুমুক দিলাম,
মনে হলো,আহ, জীবন হয় সুন্দর।
এখন অবশ্য মণিকা ভাবি থাকলে তাকে বলতাম আবৃত্তি করে দুটো কবিতা শোনান।
.
.
রেশমির বিছানার উপরে একটা কোলবালিশ কোলে দিয়ে বসে আছে সুপ্তি।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে চলেছে বেশ অনেক্ষন ধরেই।
রেশমি এসে সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, বলে সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন দেখিস। রোহান যে রেশমির সাথে দেখা করেছিলো খুব সাবধানে সে কথা সুপ্তির কাছে গোপন করে রাখে রেশমি।
সুপ্তি রেশমিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে,
জানিস, আমার মত রোহানেরও কেউ নেই। ওর কষ্টটা বরং আমার চেয়ে বেশি। বাসায় সৎ মায়ের কাছ থেকে কখনো কোন ভালোবাসা পায়নি ও। আমি চেয়েছিলাম ওর ভালোবাসাহীন জীবনটা ভালোবাসা দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতে। কিন্তু আমার কোন ইচ্ছা সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় পূরণ করবেন না।
কোন মুখে আমি ওর সামনে দাঁড়াবো! এখন জানিওনা ও খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে থেকে আমার জন্য কান্না করছে, কথাটা বলেই হু হু করে আরো জোড়ে কান্না করে দেয় সুপ্তি।
রেশমি সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
রোহান একদিন নিজেই তোকে খুঁজে বের করে নিয়ে যাবে দেখিস। সুপ্তি শব্দ করে কান্না করা থামিয়ে দেয়। তবুও নিরব কিছু অশ্রু চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে সুপ্তির।
.
.
মাঝ রাতে হঠাৎ করেই একটা দুঃস্বপ্নে সুপ্তির ঘুম ভেংগে যায়।
রেশমির বাসাটা তিন রুমের। একটা ওদের নিজেদের রুম, আরেকটা স্টোর রুম। সুপ্তি যেটায় থাকে সেটা গেস্ট রুম। গেস্ট রুমে একটা সুন্দর বারান্দা আছে। সুপ্তি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় চলে যায়।
খুব সুন্দর ফুরফুরে বাতাস এসে চুলগুলোকে দোলা দিয়ে যায় সুপ্তির। কিছু মুহুর্তের জন্য সুপ্তি ভুলে যেতে চায়, যে ওর সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। ও একটা বাচ্চার মতই নিষ্পাপ। সবকিছু আগের মত আছে।এই বারান্দার মৃদু বাতাস,হালকা চাঁদের আলো এবং রাতের নিরবতায়, ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওর দ্বিতীয় অস্তিত্ব, রোহান।
রোহানকে প্রচন্ডভাবে মিস করতে থাকে সুপ্তি।
রোহানকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো হয়না কতদিন! আর কোনদিন হবে কিনা তাও জানেনা সে।সুপ্তির চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।
হঠাৎ কোমড়ের কাছে আলতো একটা স্পর্শ অনুভব করে সুপ্তি। ওর পুরো শরীর কেঁপে উঠে। পুরুষালি হাতের ছোয়া!!
রোহান এসে ওকে সারপ্রাইজ দিলো নাকি! কথাটা ভেবে পেছনে ফিরতেই সুপ্তির চোখ বড় বড় হয়ে যায়৷ মুখে বিশ্রী একটা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেশমির হাজবেন্ড রফিক সাহেব।
” পরিবেশটা খুব সুন্দর তাইনা? ”
বলেই সুপ্তির নরম কোমড়ে শক্ত হাতের চাপ বাড়িয়ে দেয় সে।
চলবে….
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ