গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৫
ভার্সিটির লাস্ট সেমিস্টার পরিক্ষার শেষ দিন ছিলো আজ,পরিক্ষা শেষে সবাই নিজ নিজভাবে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। রুশি ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো, প্রেগন্যান্সির ছয় মাস চলে বর্তমানে কিন্তু এক্সাম মিস করতে চায়নি তাই এসেছে ভার্সিটিতে! সায়ানকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে, এমনকি সায়ান নিজে ওকে ভার্সিটি পৌঁছে দেয় আর গাড়িতে ওর জন্য ওয়েট করে! সায়ান ভেতরে সিটে বসিয়ে দিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু রুশি কোন প্রকার সমালোচনা চায়না এমনকি এটাও শুনতে চায়না যে সায়ানের মাধ্যমে এক্সামে ভালো করেছে!
প্রেগন্যান্সির মাত্র ছয়মাস চলে বিদায় পেট বেশি উঁচু হয়নি এখনো তাই এখনো অতটা বুঝা যায় না আর শীতকালের গরম স্যুয়েটার পরার কারণেও আরো বুঝতে পারে না। সায়ান যদিও বডিগার্ড পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু রুশি তাতেও রাজি হয়নি,খামোকা লাইমলাইট নিয়ে কি লাভ?সায়ান গাড়িতে বসে এসবই ভাবছিলো, এই মেয়েটা তার কোন কথা শুনেনা। ডক্টর বলেছে সাবধানে থাকতে আর ওর সেসব যেনো মাথায়ই নেই।সায়ান চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে গেটের দিকে, একে একে সবাই গেট দিয়ে বের হচ্ছে কিন্তু রুশির নাম নিশানা দেখছে না তাই সায়ান গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো!
এদিকে রুশি চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে,কিছুক্ষণ পুর্বে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিজের ড্রেসের সাথে বেঝে পড়ে যাচ্ছিলো কিন্তু একটা ছেলে ওর হাত ধরে ফেলে যাতে ও বেঁচে যায়। আজ পড়ে গেলে কি হতো তাই ভেবে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো ওর!আরো কয়েক সিঁড়ি বাকি ছিলো তাই ভয়টা আরো বেড়ে গেলো, সেইদিনের সিঁড়ির ঘটনা এখনো মনে পড়লে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় ও। রুশি ঠিক হয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটি কোন প্রকার কথা না বলে হাঁটা শুরু করলো, রুশি তার পেছনে ছুটলো। তার কিছুটা পেছনে থেকেই বললো
“একটু দাঁড়াবেন? আপনার সাথে ম্যাচ করে হাটতে পারছিনা”
ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়লো আর পেছনে ফিরে রুশির দিকে তাকালো। রুশি তার কাছে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলো তারপর হাপাতে হাপাতে বললো
“থ্যাংকস আজকে আমাকে বাঁচানোর জন্য, আপনি না থাকলে আসলে কি হতো আমি জানিনা”
ছেলেটি মাথা নেড়ে চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে পেছনে ফিরে বললো
“এই অবস্থায় এভাবে চলাফেরা না করলেই তো পারেন। আপনার হাজবেন্ড কি কিছু বলে না আপনাকে?হাউ ইরেস্পন্সিবল!সবসময় আপনাকে বাচানোর কেউ থাকবে না তাই চলতে না পারলে বাসা থেকে বের হবেন না প্লিজ!”
রুশি মাথা নিচু করে ফেললো,আশ্চর্যের বিষয় হলো ছেলেটার টোনে কোন প্রকার তাচ্ছিল্য ছিলো না বরং কন্সার্ন ছিলো! রুশি মুচকি হেসে বললো
“ওকে!আপনি কি এখানেই পড়েন?”
“হুম এবার সেকেন্ড ইয়ারে উঠবো, আজ এক্সাম শেষ হলো।”
“ওহ আমরা একই ইয়ার! কোন ডিপার্টমেন্ট?”
“ভেটেনারি ডিপার্টমেন্ট যেটা আপনারও”
“আপনি মানে তুমি আমার ক্লাসের? আর আমি কখনো নোটিসই করিনি!”
“মেয়েদের নোটিস করোনা আর তো ছেলে!”
“ওহ হয়তো! তাহলে থ্যাংকস হিসেবে এক কাপ কফি তো খাওয়াই যায় তাও আমার ট্রিটে!”
“খেতে পারি তবে যদি আপনার হাজবেন্ড রাজি হয়!”
বলেই অন্যদিকে ইশারা করলো, রুশি সেদিকে তাকিয়ে সায়ানকে দেখতে পেলো। ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো কিন্তু সায়ান এসেই সেই ছেলেটিকে হুট করে ঘুষি মারলো। আচকমা ঘটনায় রুশি থমকে গেলো, সায়ানকে থামানোর কথা ভুলে গেলো মুহুর্তের জন্য। সায়ান ছেলেটিকে মারলেও ছেলেটি উল্টা মারলো না এমনকি ডিফেন্স পর্যন্ত করলো না। তার ঠোঁটের কোনে হাসি লেগেই আছে। রুশি গিয়ে সায়নকে থামাতে লাগলো কিন্তু থামাতে পারছে না। রুশি চিল্লিয়ে বললো
“সায়ান প্লিজ স্টপ!ও একটু আগে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে সো প্লিজ স্টপ!”
সায়ান কিছু সময়ের জন্য থেমে গেলো তারপর আরো জোরে মারতে শুরু করলো আর বললো
“হাউ ডেয়ার ইউ!তুমি ওকে টাচ করলে কি করে?ওর দিকে নজর দিলে কি করে তুমি?ও শুধু আমার!তোমাকে ওই চন্দ্রিকা পাঠিয়েছে তাইনা?আবার নতুন করে কোন প্লট করছো তোমরা! এবার যদি ওর দিকে এতোটুকু আঁচ আসে না জিন্দা পুতে ফেলবো তোমাদের দুজনকে বলে দিলাম!”
রুশি এতোক্ষনে বুঝতে পারলো সায়ানের রেগে যাওয়ার মানে, এই ছেলের চন্দ্রিকার সাথে কোন কানেকশন আছে নিশ্চই! রুশি সায়ানকে ছাড়িয়ে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া ধরলো আর সেই ছেলেকে ঠোঁটের ইশারায় স্যরি বললো যা দেখে সে হাসলো তারপর চিল্লিয়ে বলতে লাগলো
“মিস.রুশি! কফির অফার মনে রাখবেন কিন্তু আর হ্যা আমার নাম শাহেদ… শাহেদ নওয়াজ!ডোন্ট ফরগেট দেট!”
সায়ান তেড়ে আসতে চাইলেও রুশি দিলো না, দ্রুত গাড়িতে নিয়ে বসালো। সায়ান জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো হয়তো রাগ থামানোর চেষ্টা করছে। সায়ানের যতই রাগ থাকুক সেটা রুশির সামনে কখনো ও প্রকাশ করেনা কারণ একসময় ওকে কেউ একজন বলেছিলো “নারীরা ফুলের মতো,তাদের উপর জোর প্রয়োগ করলে নষ্ট হয়ে যাবে”
তাই সায়ান নিজের জেন্টেল সাইড সমসময় রুশিকে দেখায়,সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো
“তুমি আর ওই ছেলের সাথে কখনো মিশবে না, চন্দ্রিকার ছায়াও তোমাদের উপর পড়ুক সেটা আমি চাইনা। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”
রুশি মাথা নাড়লো, যদিও ছেলেটিকে খারাপ মনে হয়নি তবুও সায়ানের কথায় যুক্তি আছে, আর যাইহোক চোখের দেখা ভুলও হতে পারে।
_______________________
হাই স্পিডে হাইওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছে শাহেদ! ঠোঁটের কোনে রক্ত জমে আছে, শরীর এমনকি চেহারার অনেক জায়গাও জখম হয়ে আছে! ওর ঠোটের কোনে মৃদু হাসি!আজকে সায়ানের রিয়াকশন দেখে অনেক খুশি ও। সেই রাগ, সেই জেলাসি দেখেছে ও সায়ানের চোখে যেটা একদিন ওর চোখে বিরাজ করতো!গাড়ির স্টেয়ারিং চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো
“নিজের স্ত্রীর সাথে অন্যকেউকে দেখে জ্বলেছে তাইনা সায়ান? আমারো জলতো যখন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটি তোমার কাছে থাকতো আর তোমাকে নিয়ে ভাবতো। তোমাকে পেতে চাইতো, আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে অন্য ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে দেখলে কতোটা খারাপ লাগে!”
শাহেদ নিজের ফ্লাটে পৌঁছে চাবি দিয়ে দরজা খুললো আর চন্দ্রিকাকে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখলো।চন্দ্রিকা ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো তারপর এগিয়ে এসে বললো
“এই অবস্থা হলো কি করে?কোন এক্সিডেন্ট করেছেন নাকি?”
“নাহ তোমার সায়ান আমার এই হাল করেছে।”
“সায়ান হঠাৎ এমন করবে কেনো?কি হয়েছে আপনাদের মাঝে?সায়ান হুট করে এমন মারামারি করার মানুষ তো না!”
শাহেদ কথাটা হজম করতে পারলো না,চন্দ্রিকার হাত চেপে ধরে নিজের কাছে এনে বললো
“নিজের সায়ানের প্রতি এতো বিশ্বাস অথচ সে তোমাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। আর শুনো আমি ডিফেন্স করিনি পর্যন্ত, নিজের বউয়ের সাথে কথা বলা দেখে সহ্য হয়নি তার!”
কথার মাঝেই চন্দ্রিকা হুট করে ঠোঁটের কাটা জায়গায় চাপ দিলো
“আহহহহ পাগল নাকি?”
“ওহ আপনি ব্যাথাও পান?”
“কেনো আমাকে মানুষ মনে হয়না?”
“তা না আসলে আপনি ডিফেন্স করেননি যেহেতু তার মানে ব্যাথা পাননা। যাইহোক আপনি এইটুকুন একটা ছেলে হয়ে সায়ানের সাথে পেরে উঠতেন না। ”
“ওহ হ্যালো! কারাঠে চ্যাম্পিয়ন আমি। তোমার আমার সাথে জীবনেও পারতো না যদি আমি লড়তাম। আর এইটুকুন ছেলে মানে কি?তোমার থেকে বড় আমি, হ্যাভ সাম রেস্পেক্ট!”
“হাহ আমাকে আপনার থেকে আর কতো বড়ো?দেখতে তো আমার ছোটই মনে হয়, বাইরে গেলে বলবে আপনি আমার ছোট ভাই!”
“আমি তোমার ছোট ভাই!এই তুমি সাইজ দেখছো তোমার?এইটুকুন মেয়ে!আবার আমাকে ছোট বলো, আমাকে মোটেও ছোট মনে হয় না বরং আমাকে বড়ই দেখা যায়।বাজে বকবা না”
“শুনুন যতই বড়ো দাবি করুন নিজেকে আমার কাছে ছোটই লাগে আপনাকে। তাইতো আপনার সাথে একই ফ্লাটে থাকতে হেজিটেশন ফিল হয়না কারণ আপনি ছোট ভা…”
চন্দ্রিকার কথার মাঝেই শাহেদ একদম কাছে এগিয়ে গেলো, ওদের ঠোঁটের মাঝে হয়তো কয়েক ইঞ্চি পার্থক্য। শাহেদ চন্দ্রিকার কানের সামনে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো
“আরেকটু কাছে আসলে কিন্তু আমাকে আর ছোট মনে হবে না, বেশি ছোট ছোট বললে বড়দের মতো কিছু করতে ইচ্ছে। তাই আমাকে অযথা ক্ষেপিও না, নাহয় আমি কিন্তু মানুষটা ভালো নই!”
বলেই চন্দ্রিকাকে ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলো আর চন্দ্রিকা জোরেজোরে শ্বাস নিতে লাগলো। নিজের হার্টবিট যেনো নিজেই শুনতে পাচ্ছে এমন অবস্থা, আগে যদিও শাহেদ ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো কিন্তু আজকে অন্যরকম ছিলো! কেনো এমন লাগছে নিজেও বুঝতে পারছে না তবে আজকে শাহেদের কাছে আসা খারাপ লাগে নি ওর। ও হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলো!
#চলবে
গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৬
“ আমি যার শিয়রে রোদ্দুর এনে দেবো
বলে কথা দিয়েছিলাম
সে আঁধার ভালোবেসে রাত্রি হয়েছে ।
এখন তার কৃষ্ণ পক্ষে ইচ্ছের মেঘ
জোনাকির আলোতে স্নান করে,
অথচ আমি তাকে তাজা
রোদ্দুর দিতে চেয়েছিলাম ”
~রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ~
আকাশ জুড়ে তারাদের বিশাল মেলা বসেছে, জ্বলজ্বল করে উঠছে সারা আকাশ জুড়ে যেনো আকাশের মনে কতো সুখ!হয়তো কাউকে পাওয়ার খুশিতে কিংবা কারো স্মরণে!রুশিও আজ হঠাৎ কারো স্মরণে মশগুল,আকাশের তারা গুনার বৃথা খেলায় মেতে আছে, একপাশ থেকে কিছু গুনে অপরপাশে গেলেই যেনো সব গুলিয়ে যায় তবুও বিরক্তির রেশ মাত্র নেই তার মাঝে যেনো অদ্ভুত এক মজার খেলায় মত্ত সে!
সায়ান ধীর পায়ে রুশির কাছে দাঁড়ালো, তারপর হুট করে কাঁধে হাত রাখলো। রুশি কিছুটা হচকিত হয়ে কেঁপে উঠলো কিন্তু পরক্ষনেই বুঝতে পেরে স্বাভাবিক হয়ে গেলো।সায়ান রুশির কাঁধে নিজের থুতনি রেখে নিজের শরীরের কিছুটা ভার ছেড়ে দিলো, কানের কাছে ফিসফিস করে বললো
“মিসেস খান এতো মনোযোগ সহকারে কি দেখে?”
সায়ানের এই মৃদু আওয়াজে রুশি কেঁপে উঠলো, সারা শরীর জুড়ে আলাদা শিহরণ বইছে। ও চোখমুখ খিচে বললো
“কিছুই করছিলাম না,ব্যাস আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম”
“তারা গুনছিলে?”
“ওই বৃথা চেষ্টা আরকি!তবে এতে বিশেষ মজা পাওয়া যায় জানেন।কারণ আপনি এর শেষ পরিণতি জানেন যে যতই চেষ্টা করুন না কেনো তারা গুনা সম্ভব নয় তবুও গুনা আরকি!”
“যেটা পারবে না তাতে বৃথা চেষ্টা করে কি লাভ?”
“ওইযে বললাম মজা পাওয়া যায়, অদ্ভুত এক শান্তি। নিজেকে বলা যায় আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু! জানেন এই আকাশ দেখলে আমার একজনের কথা মনে পড়ে, খুব বেশি মনে পড়ে। আগে রোজ তার সাথে কথা বলতাম কিন্তু এখন বলি না তবে তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগে। যেনো তাকে ফিল করি।তবে মজার বিষয় হচ্ছে আমার তার চেহারা পর্যন্ত মনে নাই, আর না তার সাথে কাটানোর কোন স্মৃতি! তবুও আমি তাকে যেনো ফিল করি, মনে হয় সে খুব কাছের কেউ।কিন্তু তাকে কিছুতেই মনে করতে পারিনা,কিছুতেই না!”
সায়ান রুশিকে ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, যদিও জানে সেই মানুষটি রুশির জীবনে নেই আর আসবেও না তবুও ও জেলাস না হয়ে পারছেনা, একটা মানুষ রুশির অনেক প্রিয় এটাই যেনো মানতে পারছে না। ও গম্ভীর গলায় বললো
“এখন তারাদের সাথে কথা বলো না কেনো?”
“আমি আসলে তারাদের সাথে কথা বলতাম না বরং তারাদের মাধ্যমে তার সাথে কথা বলতাম।নিজের প্রতিদিন করা সবকিছু শেয়ার করতাম। কিন্তু কেনো যেনো মনে হয় আমার কথাগুলো তার কাছে যায়না, তার কোন সময়ই নেই আমার পেছনে ব্যয় করার আর না আমার আছে আমার জমানো কথা শুনার সময়! আমিই শুধু মরীচিকার পেছনে ছুটছি। তাই আমার বড্ড অভিমান হয়েছে! আমি আর তার সাথে কথা বলতে চাইনা”
রুশির মুখ জুড়ে হঠাৎ করেই কালো ছায়া নেমে আসলো,খুব বেশি অভিমানে তারাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো যা সায়ানের চোখ এড়ালো না, ও শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো
“তাকে খুব বেশি মনে করতে চাও?”
“হুম অনেক বেশি করে চাই! আমক শুধু একটাবার দেখতে চাই সে কেমন দেখতে,তার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই!”
সায়ান আর কিছু ভাবতে পারলো না, মনে হলো আজ যদি ও নিজের মনের কথা রুশিকে না বলে তাহলে তাকে হারিয়ে ফেলবে!রুশিকে নিজের দিকে ফিরালো তারপর ওর হাত নিজের বক্ষপিঞ্জরের বাঁ পাশে রেখে বললো
“এভাবে আমার সামনে অন্যের প্রতি নিজের অনুভুতি জাহির করোনা মিসেস খান, এই বাঁ পাশটায় বড্ড কষ্ট হয়। আমি জানি আমি হয়তো বড্ড অহেতুক কাজ করছি কিন্তু ওই অদৃশ্য মানবের প্রতি আমি জেলাস না হয়ে পারছিনা। আমি মেনে নিতে পারছিনা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটি অন্যকাউকে এতোটা মিস করছে বা তাকে দেখতে চাইছে!আমি সত্যিই মানতে পারছেনা কারণ আমি তার মনের এইটুকু ভাগও অন্যকাউকে দিতে চাইনা, আমি কি বড্ড সেল্ফিশ হয়ে যাচ্ছি রুশি?”
“সায়ান আপনি ভুল ভাবছেন, আমি তাকে সেভাবে দেখি না জাস্ট…”
সায়ান রুশির ঠোঁটে আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে বললো
“হুশশশ আমাকে শেষ করতে দাও! জানিনা আবার সাহস জুগিয়ে বলতে পারবো না তাই আজ বাঁধা দিও না। রুশির আমার জীবনে সামু আর মাম্মাম ব্যতীত আমি কোন নারীর সাথে ক্লোজ ছিলাম না, চন্দ্রিকার সাথেও না। ও আমার জীবনে নিতান্ত দায়িত্ব ছাড়া আর কিছুই ছিলো, আমি তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগের দিন পর্যন্তও সেই দায়িত্ব পালনে মশগুল ছিলাম। কিন্তু তুমি এসে আমার জীবনের সবকিছু বদলে দিয়েছো, আমাকে বুঝিয়েছো ভালোবাসা আর দায়িত্বের মাঝে পার্থক্য কোথায়? আমি অন্যকাউকে কখনো এতোটা মিস করিনি যতোটা তোমাকে ওইসময় প্রতিটা দিন করতাম,বুকের ভিতরের চিনচিন ব্যাথা করতো তোমায় আশেপাশে না দেখলে। তাই তোমার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি কিন্তু এক সপ্তাহও পারিনি, ওই একসপ্তাহ আমার আমার কাছে একযুগ মনে হয়েছিলো! লাভ এট ফার্স সাইট এ বিশ্বাস করো? আমিও করতাম না যদিনা সেইদিন অফিসে তোমাকে দেখতাম, হুট করেই মনে হয়েছিলো আমার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে প্রচণ্ড! নিজের বুকের মাঝের থপথপ শব্দ নিজেই যেনো শুনছিলাম, তারপর প্রথম কোন নারীকে কোন হেজিটেশন ছাড়াই জড়িয়ে ধরেছিলাম সেদিন! নিজেকে যেনো নিজেই চিনতে পারছিলাম না। যদি তোমার ভাষায় বলি তবে বলবো প্রথম দেখায় তোমার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম,বন্ধু হিসেবে নয় প্রেমিক হিসেবে!প্রচণ্ড ভালোবাসি তোমায়, বিনিময়ে বেশিনা এইটুকু ভালোবাসা কি পেতে পারি?”
রুশির চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো, ঠোঁটের কোনে যেনো বিশ্বজয়ের হাসি ঝুলছে। সায়ানের এগিয়ে এসে হুট করেই ওর বুকে কিল বসাতে শুরু করলো আর বলতে লাগলো
“না পেতে পারেন না, এতো দেরি করলেন কেনো বলতে?কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছি জানেন?”
“স্যরি আসলে আগে বলার সাহস পাইনি,আমার কার এক্সিডেন্টের পুর্বে আমি এটাই বলতে এসেছিলাম যে আমি তোমাকে চাই, আমাদের বেবিকে একসাথে বড় হতে দেখতে চাই কিন্তু তার পুর্বেই তুমি ডিভোর্সের কথা বললে আর আমারও বলা হলো না তোমাকে!”
“ইশশশ মিস করে ফেললাম তাইনা?স্যরি!আচ্ছা ওয়েট এটা কি প্রোপোজ ছিলো?কেমন নিরামিষ আপনি!প্রোপোজ করার সময় একটা ফুলও দিলেন না?হুহ এক্সেপ্ট করতে কষ্ট হচ্ছে!”
সায়ান হুট করে বারান্দা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো আর রুশি থমকে গেলো। রুশি কি বেশি বলে ফেলেছে?সায়ান কি রাগ করেছে ওর কথা শুনে! ভাবনার মাঝেই সায়ান হুট করে এসে হাটু গেড়ে বসে পড়লো আর হাতে কতোগুলো তাজা বেলিফুল! হয়তো মাত্রই গাছ থেকে ছিড়ে এনেছে, রুশি হাল্কা হাসলো তা দেখে সায়ান বলে উঠলো
“আমাদের সন্তান আসার পর উইল ইউ মেরি মি এগেইন?”
রুশি মাথা নেড়ে বুঝালো ওর রাজি তাতেই সায়ান নিঃশব্দে হাসলো আর নিজের থাকা ফুলগুলো রুশির হাতে দিলো, রুশি সেগুলো নাকের কাছে ঘ্রাণ নিলো! একসময় বেলিফুল খুব পছন্দের ছিলো ওর কিন্তু সেটা কেমন যেনো বিলীন হয়ে গেছে! আজ আবার নতুন করে এই ফুলের প্রেমে পড়ে গেলো সাথে সামনের মানুষটির উপরও! রুশির ভাবনার মাঝে সায়ান আলতো করে ওর অনামিকা আঙ্গুলে একটা রিং পরিয়ে দিলো খুব সাবধানে যাতে ফুল গুলো না পড়ে যায়, রুশি অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সায়ান তা দেখে কিছু বললো না বরং নিজের হাত এগিয়ে দিলো আর রুশি ফুলগুলো পাশের চেয়ারের উপর রেখে সেটা পরিয়ে দিলো আর নিজের হাতের রিং দেখতে লাগলো, এটা প্লাটিনামের রিং যাতে হার্ট খোদাই করা! রুশির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে সায়ান বললো
“এই রিংটার নাম হচ্ছে ‘কিস এঞ্জেল’ যেটা লং লাস্টিং ভালোবাসার প্রতীক! লন্ডন থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম এটা তাও তোমাকে ভেবে কিন্তু কখনো দেয়া হয়নি। প্রোপোজ করার দিন ভেবেছিলাম দিবো কিন্তু হয়ে উঠেনি তাই আজ দিলাম। উই আর অফিশিয়ালি এংগেজড মিসেস খান!”
“এটা রিংটা অনেক দামী কিন্তু ভালোবাসার মানুষের উপহার তাই ফেরত দেয়া যাবে না। আমি এটা সবসময় পরে থাকবো কিন্তু আমার কাছে এই শুভ্র বেলিফুলগুলো এই রিং থেকেও অনেক দামী!আর বেলিফুল কিন্তু শুদ্ধ ভালোবাসার প্রতীক তাই এগুলো আমি ভালোবাসার শাক্ষি হিসেবে রেখে দিবো সবসময়!”
রুশির মাথায় হুট করে দুষ্টু বুদ্ধি আসলো, ও সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো
“এইযে আপনি যে আমার প্রতি কমিটেড হয়ে গেলেন এতে অন্যরা অনেক বেশি জ্বলবে না?মানে অন্য মেয়েরা যারা আপনার রুপের ফ্যান! কারণ কৃষ্ণা যেখানে থাকে গপিদের তো অভাব হয়না”
সায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো
“গপিরা থাকলে কি হয়েছে কৃষ্ণা তো শুধু রাধাকে ভালোবাসতো তাইনা?”
“সেটাইতো সমস্যা মিস্টার খান!আমি তো আর রাধা নই রুকমানি”
“শুনো আমার লাইফের রাধা হচ্ছো তুমি আর আমি কৃষ্ণের মতো নই। আমি রাধাকে একদম বিয়ে করে ঘরে তুলেছি দরকার হয় আবার বিয়ে করবো!”
“কৃষ্ণা শুনলে হার্ট এটাক করতো তার প্রেমগাঁথার সাতয়ানাশ করে দিয়েছে কেউ!বেচারা প্রেমের মানে কতো সুন্দর করে বুঝালো আর আপনি কিনা কি ভুলভাল বকছেন!
“একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করা ভারী অন্যায়,এতে রুকমানিকে অসম্মান করা হয়েছে কারণ সে স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সম্মান পায়নি কারণ মানুষ রাধাকৃষ্ণ রাধাকৃষ্ণই করে,স্ত্রী হিসেবে এটা যেমন কষ্টের তেমনি অসম্মানের! হয় রাধা বিয়ে করে স্ত্রীর সম্মান দেয়া হতো নাহয় রুকমানিকে প্রেয়সী হিসেবে মেনে নিতো!এখানে দুজন নারী কিন্তু সমান কষ্টই পেয়েছে, কেউ সম্মান পায়নি আর কেউ সম্মান পেয়েও ভালোবাসা পায়নি।”
“আমি রাধা হলে আমার কৃষ্ণকে অন্যকাউকে বিয়ে করতে দিতাম না, বরং তাকে আচলে বেঁধে জোর করে বিয়ে করতাম”
সায়ান হাসলো রুশির কথা শুনে,ও হলেও হয়তো এমনটাই করতো!
রুশি সায়ানকে জড়িয়ে ধরতে নিয়ে পকেটে কিছু একটা অনুভুত হলো, ও ভেতরে হাত দিয়ে একটা চেইন পেলো সাথে লকেট। ও সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো আর সায়ান বললো
“এটা পরীর চেইন! ছোটবেলায় নাকি ওর সাথে এটা ছিলো। মিনু খালা বলেছে!”
“মিনু খালা?”
“আরে মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারের মেইন ছিলেন তিনি, পরীকে খুজতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় হয়েছিলো।তারপর এটা এই শার্টের পকেটে রেকে দিয়েছিলাম, আজ এতো মাস পরও এটা এইশার্টে আছে। হয়তো ওয়াশ করার সময় কেউ খেয়াল করেনি আর আমিও তো এই শার্ট পরিনি আর”
রুশি মনোযোগ সহকারে এটা দেখছে, খুব সুন্দর একটা চেইন আর লকেটটাও খুব আকর্ষণীয়!ও ছোট্ট করে বললো
“আমি লকেটটা নিজের কাছে রাখি?পরীকে পেলে তখন দিয়ে দিবো”
“আচ্ছা রাখো, আমার থেকে বেশি এটা তোমার কাছে সাবধানে থাকবে!”
এইটুকু পরেই কুঞ্জন পরের পেজ উল্টালো আর তাতে পুরোনো হয়ে যাওয়া ফুল দেখতে পেলো যার পাশে সুন্দর করে লিখা “প্রিয় মানুষটির সেরা উপহার”।
হয়তো এটা সেই ফুল যা সায়ান রুশিকে দিয়েছিলো সেদিন, কুঞ্জন সেই ফুলের ঘ্রাণ যেনো এখনো পাচ্ছে!ও আলতো করে হাত বুলালো তাতে।
আরো পরার ইচ্ছে থাকলেও নিজের ইচ্ছেকে সায় দিলো না, রাত প্রায় দুটো বাজে!মায়ের কাছে ধরা পড়লে খবর আছে ওর বারোটা বেজে যাবে,কিন্তু ওর ছোট্ট মনে এই প্রশ্নটিই বারবার উঁকি দিচ্ছে রুশি কি তাহলে সায়ানের ছোট্ট পরী ছিলো? আর যদি ছিলোও তবে সায়ান কি জানতে পেরেছিলো সেটা!কি হয়েছিলো এরপর?
সাবধানে ডায়রীটি লুকিয়ে রেখে ও সেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো, এই রুমে সবার ঢুকা নিষেধ কিন্তু ওর তের বছরের কৌতুহলী মনকে দমাতে পারেনি। ঠিকই সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর এখানে ঢুকে পড়েছিলো আর ভাগ্যবশত এই ডায়রীটি পেয়েছে! প্রথম পাতাতেই অনেকটা গল্পের মতো করে লিখা ছিলো
“মিস রুশানি! আপনি মা হতে চলেছেন”
যাতে ও বেশ অবাক হয় আর সামনে পড়া শুরু করে, আর পড়তে পড়তে এডিক্টেড হয়ে গেছে। ওর মনে প্রত্যকটা দৃশ্য ও নিজের চোখের সামনে দেখছে!রাত বারোটায় এখানে আসে আর দুটোয় ফিরে যায় তাও সাবধানে!ও ধীর পায়ে নিজের রুমে যায়, এরপর কি হয়েছে তা জানার জন্য মন কেমন যেনো খুঁতখুঁত করছে!
#চলবে
গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৭
খাবার টেবিলে মাথানিচু করে ব্রেকফাস্ট করছে কুঞ্জন, ওর ঠিক বরাবর ওর বাবা গম্ভীর মুখে আছে। বাবাকে ছোট থেকে প্রচণ্ড ভয় পায় ও আবার প্রচণ্ড ভালোও বাসে। বাবাকে গম্ভীর মুখে দেখা মানে ওর কাঁপাকাঁপি শুরু! কুঞ্জন কোনরকম ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠে যাবে এমন সময় ওর বাবা বলে উঠলো
“কুঞ্জন! সোফার রুমে অপেক্ষা করো আমার জন্য”
ব্যাস এতোটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো ওকে ভয় দেখানোর জন্য,নিজের মনের ভিতর নানা জল্পনা কল্পনা শুরু করে দিয়েছে ও। নিজের করা ভুল গুলো ইতোমধ্যে খুঁজতে শুরু করেছে, কিন্তু কিছুতেই বড়ো কোন দোষ খুঁজে পেলো না। তাতে যেনো বড্ড হতাশ হলো,ভাবতে শুরু করলো তাহলে ও নিজের অজান্তেই বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছে?কুঞ্জনের ভাবনার মাঝেই ওর বাবা এসে সোফায় বসলো আর সামনের সোফায় বসতে ইশারা করলো।
ও কোন সময় নষ্ট না করেই বসে পড়লো, আর বাবার কথা শুনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে রইলো। ওর বাবা অবশেষে মুখ খুললো আর বললো
“আমি আজ দুপুরের ফ্লাইটে লন্ডন যাচ্ছি,দুদিন পর ফিরবো। তুমি বাসায় গুড বয় হয়ে থাকবে ঠিক আছে!আর আনবো তোমার জন্য?”
“কিছু লাগবে না পাপা! তুমি শুধু ঠিকমতো আমার কাছে ফেরত চলে এসো তাহলেই হবে”
কুঞ্জনের বাবা হাসলো তারপর বললো
“তুমি একদম তোমার মায়ের মতো হয়েছো, সেও এমনই। আচ্ছা যাইহোক তুমি নাকি আজকাল ক্লাসে ঘুমাও? টিচার কমপ্লেইন দিয়েছে!রাতে ঠিকমতো ঘুমোবে ঠিকাছে!”
“স্যরি পাপা আর হবে না এমনটা,আমি ঠিকমতো মনোযোগী হবো”
কুঞ্জনের বাবা মাথা নাড়লো আর নিজের খেয়াল রেখো বলে বেরিয়ে গেলো কোম্পানির উদ্দ্যেশ্যে!
কুঞ্জন স্বাভাবিক হয়ে বসলো,তারপর ধীর পায়ে উপরে গেলো। বাবা নেই মানে আর কোন ভয় নেই, চুপিচুপি সেই রুমে ঢুকলে কেউ খেয়াল করবে না। ও রুমে ঢুকেই কোন শব্দ ছাড়া সেই ডায়েরীটি বের করলো আর এরপর পড়া শুরু করলো!
সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার, আকাশটা হাল্কা মেঘলা থাকলেও ভ্যাবসা গরম ছিলো সেদিন। রুশির প্রেগন্যান্সির তখন সাড়ে আট মাস চলে, পেট বেশ উঁচু হয়ে গেছে আর হাটতেও কষ্ট হতো তখন। কিন্তু এই সবকিছু তার অদম্য ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, সত্যকে জানার ইচ্ছে! সায়ান খুব জরুরী কাজে অফিসে গিয়েছে, সেই ফাঁকে ও বেরিয়ে পড়েছে। বডিগার্ড বাঁধা দিতে গেলে বলেছে সায়ান ওকে যেতে অনুমতি দিয়েছে তাই তারা আর বাঁধা দেয়নি। সাথে আসতে চাইলেও রুশি নিয়ে আসেনি বরং গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে উদ্দেশ্য হাসপাতাল!
কাল রাতে সায়ান থেকে সেই কথা শুনার পর থেকেই মন উস্কোখুস্কো করছে, ওর মিনু খালার সাথে দেখা করা প্রয়োজন! খুব বেশি কারণ ওর সত্য জানতে হবে সাথে ওর বাবাকেও আসতে বলেছে যদিও ও বলেনি কেনো ডেকেছে। ও সত্যিটা খুব করে জানতে চায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর নিজের বাবাকে সেই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুশি এগিয়ে গেলো। ওর বাবা ওকে দেখেই জিজ্ঞাস করলো
“কোন দরকার ছিলো তোর মা?তোর কি শরীর খারাপ!সায়ান বাবা জানে? তাকে জানিয়েছিস?হঠাৎ এখানে ডেকেছিস কেনো আমায়?”
“বাবা আমি সম্পুর্ণ ঠিক আছি, আমার কিছুই হয়নি।তুমি আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও, আমাকে যখন চাইল্ড কেয়ার থেকে নিয়ে এসেছিলে তখন কি আমার নাম রুশিই ছিলো নাকি তুমি আমার নাম পাল্টিয়েছো?”
রুশির বাবা একটু ঘাবড়ে গেলো তারপর নিজেকে সামলে বললো
“হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি যে মা?”
“কিছুনা বাবা, জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম আরকি চেঞ্জ করেছো কিনা! চলো ভিতরে চলো”
রুশি অত:পর ভেতরে গেলো ওর বাবার সাথে আর ভিআইপি ওয়ার্ডে গেলো। সেখানে গিয়ে একজন নারীকে বেডে শুয়ে থাকতে দেখে ও ভেতরে ঢুকলো। যতোটুকু জানে তাতে এটা নিশ্চিত ইনিই মিনু খালা, মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারের একসময়কার মালিক!রুশি আর কিছু না জানলেও এতটুকু জানে ও মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারে বড় হয়েছে আর ওকে সেখান থেকেও ওর বর্তমান বাবা নিয়ে এসেছিলো। সাথে মিনু খালা নামটাও খুব পরিচিত ওর কাছে যদিও চেহারা বা কন্ঠ কিছুই মনে নেই ওর।
ও ধীর পায়ে সেইদিকে এগিয়ে গেলো সাথে ওর বাবাও! রুশির বাবা ভেতরে ঢুকেই থমকে গেলো, এতো সেই মহিলা।উনি হঠাৎ ভয় পেলো আর বেরিয়ে যেতে নিলে রুশি হাত চেপে ধরলো আর মাথা নেড়ে যেতে না করলো। উনি মাথা নিচু করে ভেতরে দাঁড়িয়ে রইলো আর কিছুই বললো না। তাদের দেখেই মিনু খালা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আর তাকিয়েই থাকলো। হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো
“আ্ আপনি তো সেই লোক! আপনি ওই যে ছোট মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্ কি যেনো নাম মেয়েটির উফফফ মনে পড়ছে না।”
উনি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করলেন, রুশি নিজের ব্যাগ থেকে সেই চেইনসহ লকেটটা বের করলো আর তাকে দেখিয়ে বললো
“এই চেইনের মালিক?যার এই চেইন সেই মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিলো?”
“হ্ হ্যাঁ! তুমি কোথায় পেলে এই চেইন?এটা আমি সায়ান জামিল খানকে দিয়েছি!”
রুশি কোন জবাব দিলো না বরং নিজের বাবার দিকে তাকালো,ও ইতোমধ্যে কান্না করছে। কান্নার কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
“বাবা তোমার মেয়ে হিসেবে জিজ্ঞেস করছি! প্লিজ বলো আমার নাম কি পরী ছিলো?আমি কি সায়ানের ছোট্ট পরী?আমার জন্য এটা জানা খুব জরুরি। প্লিজ বলো না বাবা!”
রুশির বাবা মেয়ের দিকে তাকালেন তারপর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। অনেক পাপ করেছেন জীবনে আরো পাপের ভাগিদার হতে চায়না ও। যা হবার হবে আপাদত রুশির সত্যি জানার অধিকার আছে, উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক জবাব দিলেন। আর রুশি কান্নার মাঝেও হেসে ফেললো তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো
“আগে বলোনি কেনো আমায়?কেনো বলোনি!”
“প্রয়োজন ছিলো তাই বলিনি, সব বলার সময় নেই শুধু এইটুকু মনে রেখো এই খবর যাতে বাইরে না যায়।”
রুশির কানে বাকি কথা পৌঁছালো কিনা কে জানে?ওর মাথায় শুধু এইটুকু খেলে যাচ্ছে ও সায়ানের ছোট্ট পরী!আজ সব ওর কাছে পরিষ্কার মনে হচ্ছে। ও যেই ছেলেটির স্বপ্ন দেখতো সেটা আর কেউ না সায়ান ছিলো আর তারাদের দিকে তাকিয়ে যার সাথে কথা বলতো সেও সায়ান ছিলো। ও আগুনকে ভয় পায় কারণ ওর জানা মতে ও আগুনে ঝাপ দিয়ে কাউকে বের করে আনার চেষ্টা করছিলো কিন্তু নিজে সেই আগুনের মাঝে পড়ে যায় যদিও সব ঝাপসা ছিলো। কিন্তু সেটাও সায়ান ছিলো, ওর কল্পনা জুড়ে শুধু সায়ানের বসবাস ছিলো অথচ এতো কাছে থেকেও ও বুঝতে পারেনি?এক মুহুর্তেই যেনো সকল স্মৃতি তাজা হয়ে গেলো!
ও খুব দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লো,কারো ডাক যেনো কানে যাচ্ছেনা ওর।হুট করেই ওর হাতে লেগে কিছু একটা জিনিস পড়ে যায়, গায়ে তরল জাতীয় কিছু ফিল হয় কিন্তু তাতে ওর মাথা ব্যাথা নেই। শুধু একটা জিনিসই মাথায় কাজ করছে সায়ানকে বলতে হবে, বলতে হবে এই চেইনের মালিককে আর খুঁজতে হবে না ওর বরং সে তার পাশেই আছে, তার স্ত্রী হিসেবে। তার ছোট্ট পরী!রুশি গাড়িতে উঠে দ্রুত গাড়ি চালাতে বললো, রাস্তায় যতো গাড়ি এগোচ্ছে রুশির উত্তেজনা তত বাড়ছে! ও যেনো আর সইতে পারছে না এই দুরত্ব। একেকটা মুহুর্ত ঘন্টার সমান মনে হচ্ছে, রাস্তা যেনো শেষই হচ্ছে না।
প্রায় আধঘণ্টা পর রুশি নিজের পায়ে তরল জাতীয় কিছু ফিল করলো, ও হাত দিয়ে সেটা ধরে বুঝতে পারলো এটা রক্ত।ও চমকে উঠলো, ড্রাইভারকে কোন মতো বললো আমাকে হসপিটাল নিয়ে চলো। ও দ্রুত সায়ানকে ফোন দিলো, চোখ যেনো বুঝে আসছে!সায়ান ধরতেই বলে উঠলো
“আ্ আমার মনে হচ্ছে আমি আর তোমায় দেখবো না সায়ান!আমাদের বেবিকে আমি বাঁচাতে পারিনি হয়তো, ত্ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আ্ আমার তোমাকে কিছু ব্ বলার ছিলো, সায়ান আ্…”
আর কিছু বলার পুর্বেই রুশি সিটে হেলে পড়লো, শ্বাস যেনো নিতে পারছেনা এমন কষ্ট হচ্ছে। বারবার দোয়া করছে ও মরে গেলেও ওর বেবিটা যাতে বেঁচে যায়!সায়ান দেখার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে ওর,ওকে বলাই হলো না ও যে সায়ানের ছোট্ট পরী!রুশি সেখানেই জ্ঞান হারালো,,,
#চলবে