গানের ওপারে তুমি পর্ব-১২

0
553

“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
“ইয়ানাতের সাথে দেখা হলো সন্ধ্যায়।”
ঘাড় ঘুরিয়ে মুখপানে তাকিয়ে জবাব দেয় মিহির। জবাব পাওয়ার সাথে সাথেই রিপ্তির ভ্রু মাঝে হালকা পরিবর্তন চলে আসে। ইয়ানাতের সাথে কখনো দেখা হয়নি মিহিরের, তা জেনেছে রিপ্তি। আজ হঠাৎ ইয়ানাত! কিভাবে কি? মুখে বর্ণযোগে ফুটাতে হয় না প্রশ্ন। তার মুখভঙ্গিতে ভেসে উঠা প্রশ্নের উত্তরই মিহির দিয়ে দেয়।
“সকালের বড় কেকটাও ইয়ানাত পাঠিয়েছে। তখন থেকেই মনটা একটু খারাপ ছিলো। আজ এতো বছর পর যে এই সন্ধ্যায় তার সাথে দেখাও হয়ে যাবে, ভাবিনি।”
“সিরিয়াসলি!”
“হুম।”
“কোথায় দেখা হলো?”
“ফ্যানক্লাবে।”
“ফ্যানক্লাবে কেন? উনি কি আপনার ফ্যান?”
মলিন মুখেও স্মিত হাসি ফুটতে চায় মিহিরের।
“বললোও যেন তা-ই। সে নাকি শুনেছে আমি আজ ফ্যানক্লাবে যাচ্ছি। আর তাই সন্ধ্যালগ্নে ক্লাবে হাজির সারপ্রাইজ দিতে। অথচ দেখো, এক কালে বলতে গেলে আমিই তার ফ্যান ছিলাম। কি হাস্যকর ব্যাপার, তাই না?”
জবাব দেয় না রিপ্তি। তার চোখেমুখে ভর করেছে অজানা অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা। মিহির প্রত্যুত্তর না পাওয়া জানতে চাইলো,
“কি ভাবছো?”
“হুম? না। কিছু না। ভালোই তো গল্পসল্প হলো এতো কাঙ্ক্ষিত দেখা সাক্ষাতের। তাই না?”
“গল্পসল্প তো হলো। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই। সেদিন চাইলেও আজ তো চাইনি দেখা হোক। তবুও হয়ে গেলো।”
“কি বললো?”
“কি আর? এ-ই, দিনকাল কেমন কাটছে। গানের কাজকর্ম কেমন চলছে।”
“আপনার সাথে কেন সে এমন করলো, জিজ্ঞেস করেননি?”
কিছুটা থমকানো দৃষ্টিতে তাকায় মিহির।
“ফ্যানক্লাবে বসে আমি এসব কথা বলবো? সে কথা তুললেও তো এমন কিছু বলার ইচ্ছে আমার হতো না। ওসব মনে করে এখন কি হবে? যেই দিন যাওয়ার, সেই দিন চলে গেছে। পিছু টানলেই শান্তির ছুটি। যার যার জীবন তার তার প্রত্যাশিত গতিতে এগিয়ে যাওয়া ভালো।”
“উনি বিয়ে করে নিয়েছেন?”
রিপ্তির এই ধরণের প্রশ্নগুলো যেন বারবারই বিস্ময়ধারায় ফেলে দিচ্ছে মিহিরকে। এতো চাপ নিচ্ছে কেন ইয়ানাতের ব্যাপারে? এতো উৎসুকভাব কেন তার চোখেমুখে? তবুও মিহির জবাব দেয়,
“জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কিন্তু তুমি এতো এক্সাইটেড হয়ে উঠছো কেন তার ব্যাপারে? বেশি ভাবছো মনে হচ্ছে? আমি তো মন খারাপের ব্যাপারটা শেয়ার করলাম মাত্র একটু হালকা হতে। এখন মনে হচ্ছে তোমাকেই আরও প্রেশারে ফেলে দিলাম।”
“না, তেমন কিছু না। এমনি জানতে চাইলাম। এতোদিন পর দেখা, তাই…”
হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠলো মিহিরের। পকেট হতে ফোন হাতে নিতেই দুজনের চোখেই ভেসে উঠে ইয়ানাতের নামটা! রিপ্তির ভেতরটা যেন আরও ধুক করে উঠে! সে চাপ নিচ্ছে বলে মিহির হয়তো চেয়েছিলো রুমে গিয়ে রিসিভ করতে, পরক্ষণে এক কদম এগিয়েও কি ভেবে আবার একই জায়গায় অবস্থান করলো। ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ইয়ানাত বলছিলাম। চিনতে পেরেছেন?”
“হ্যাঁ, বলো।”
“ব্যস্ত সময়ে বিরক্ত করলাম নাকি?”
“না। তেমন কিছু না।”
“একটা কথা বলার ছিলো। ভাবলাম ফোন নম্বর নিয়ে এসেছি যখন, ফোনেই বলি।”
“হুম, শিওর।”
“স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়ে সেদিন জানতে পারলাম আপনি নাকি আমার এড্রেস চাইছিলেন। আজ দেখা হলো অথচ ইনভাইট করতে ভুলে গিয়েছিলাম কথায় কথায়। একদিন আসেন বাসায়। আমি মিরপুর দুইয়ে থাকি। বের করা যায় কিছু সময়? এজ অ্যা ফ্রেন্ড?”
“এখন তো…”
“একদম এড়িয়ে যাবেন না বলছি। আমি কিন্তু জানি, আপনি আপনার ফ্রেন্ডদের সাথে বেশ অবসর কাটান। একটা সময়ের জন্য কি এই ফ্যান প্লাস ফ্রেন্ডের বাসায় দাওয়াতে আসা যায় না? প্লিজ, প্লিজ।”
“না, তা ঠিক আছে। আমি বলছিলাম যে এখন একটু ব্যস্ততা যাচ্ছে। অবসরে একদিন আসবো, ইনশাআল্লাহ।”
“আন্টিকে সাথে নিয়ে আসবেন।”
“জ্বি।”
“ওকে, গুড নাইট। এতোটা সময় আমি মিহির খাঁনের সঙ্গে কথা বলতে পারবো, ভাবিনি। ভেবেছি ব্যস্ত পাবো। থ্যাংক ইউ সো মাচ। নেক্সট টাইম দেখা হলে আরও অনেক কথা হবে ইনশাআল্লাহ।”
মৃদুস্বরে হাসে ইয়ানাত। যার শব্দ দুজনের কানেই ভাসে। বিপরীতে কোনোরকম প্রত্যুত্তর করে না মিহির। হয়তো রিপ্তির কথাটাই ভাবছে যে, রিপ্তি কি না কি ভাবছে ইয়ানাত নিয়ে। কেমন চিন্তার রেশ মুখ জুড়ে। মিহিরের মনটা ভালো না, তবুও রিপ্তির কাছে সৌজন্যতায় হাসতে চায় সে।
“বাসায় ইনভাইট করতে কল দিলো ইয়ানাত।”
“তিনি বোধহয় জানেন না, আপনি ম্যারিড।”
“জানবে না কেন? সে যদি আমার সব খবর রেখে থাকে, তবে এ-ও জানে। আমি নিজেই তো আমার হাতে তোমার মেহেদী রাঙা হাতের ছবি আপলোড করে অফিসিয়াল পেজে জানালাম আমাদের বৈবাহিক জীবনের সূচনা সম্পর্কে। সো, সব ফ্যানদেরই জানার কথা অন্তত অনলাইনের সুবাদে।”
“তবুও হতে পারে না, তিনি হয়তো লক্ষ্য করেননি। নয়তো কি আর শুধু আন্টিকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে?”
“ও…হাউ ফানি! তবে ভাবতে গেলে সিরিয়াস। আসলেই কি জানে না? বললো না কেন তবে! প্রব্লেম নেই। যখন যাবো, তোমাকে সাথে নিয়েই সারপ্রাইজ করে দিবো। যদি না জানলো তো।”
“আর যদি জানে?”
“পরিচিত করাবো।”
ঠোঁটের ধারে মৃদু হাসি ফুটায় রিপ্তি। বলতে গেলে জোরপূর্বকই। হাসি আসছে না ভেতর থেকে। ভারি দুশ্চিন্তা চেপেছে মুখে। মিহির কাঁধে হাত ভর করে তাকে সাথে নিয়ে রুমে যেত যেতে বলে,
“সারাদিনে রেস্ট নাওনি একদমই। চেহারার হালটা একবার দেখেছো আয়নাতে? নিজেই নিজের এমন অযত্ন করলে সুস্থ হবে কিভাবে?”
রিপ্তির রাতের ঘুম অর্ধেক খেয়ে দিয়েছে ইয়ানাত। কেমন এক অজানা ভয় বিরাজ করছে মনের আঙিনায়। মন খুব চাইছে, ওই মেয়েটার সাথে দেখা করুক। নিজের পরিচয়টা হারে হারে টিপে মুখুস্ত করিয়ে দিয়ে আসুক। উল্টাপাল্টা কাণ্ড ঘটিয়ে না আবার তার সুন্দর সংসারটা অসুন্দর করে ফেলে! একদিন কি যাওয়া যায় তার সাক্ষাতে? কিন্তু কিভাবে! সে তো চেনে না তাকে!
সকালে আবারও কথা বলতে শুনলো ইয়ানাতের সাথে। কি শুরু করেছে এসব! বছর ঘুরে না আসা কেউ হঠাৎ দিন রাত ফোন দিয়ে খবর নিতে ব্যস্ত হয়েছে যেন! এ পর্যায়ে রিপ্তিকে নিয়েও কথা বলতে শুনলো রিপ্তি। কি কথা হচ্ছে, স্পষ্ট জানে না সে। কিছুটা দূরেই আছে। দুজন রুমের ভেতর ও বাইরে। মিহির অফিস যাওয়ার প্রস্তুতিমূলক ব্যস্ততায় জড়িয়ে ছিলো এবার৷ তবুও ইয়ানাতের ফোনটা রিসিভ করে নিলো। ব্যস্ততায় ফোন রিসিভ করতে খুব কমই দেখা যায় তাকে। সাধারণত কোনো কাজরত অবস্থায় ফোন এলে ঝটপট কাজটা শেষ করে তারপরই কল রিসিভ কিংবা ব্যাক করে সে। যা এখন ভারি সন্দিহান করে তোলে রিপ্তিকে। সম্ভবত স্ত্রীর পরিচয় তুলে ধরতেই ‘রিপ্তি’ শব্দটা উল্লেখ করেছে মিহির। হয়তো ওই মেয়েটাই জিজ্ঞেস করছে, নয়তো মিহিরই ইচ্ছাকৃত বলছে। কথা তা নয়, কথা হচ্ছে এতো গুরুত্ব কেন দিচ্ছে মিহির! রিপ্তির ভয় যে বড্ড বাড়িয়ে তুলছে এতে করে! সারাদিন তার এই ভয় আর দুশ্চিন্তার ঘোরেই কেটে যাচ্ছে। মানসিক চাপে থাকলেও শারীরিক সুস্থতার নির্ভরতায় ক্লাসে উপস্থিত থাকার চিন্তা করছে পরবর্তী দিন থেকে। বেশ কয়েকটি ক্লাস মিস হলো যে ক’দিন যাবত। পরবর্তী সকালে ক্লাসে যাওয়ার কথা বলতেই আগে শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলো স্বামী এবং শ্বাশুড়ি উভয়েই। শরীর সুস্থ না থাকলে ক্লাসের প্রয়োজন নেই তাদের মতে। রিপ্তি আজ ভালো অনুভব করছে জানালে মিহির বললো,
“আজকের দিনটা বাসায় কাটিয়েই দেখো। যদি মনে হয় সারাদিনই বেশ ভালো আছো, তবে আগামীকাল হতে যাওয়ার চিন্তা করো। শরীর মন ভালো না থাকলে, পড়াশোনাও ভালো হয় না।”
রিপ্তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। তবে তার মনের জবাব উতরায়, “মন তো ভালো নেই! মনের ভীষণ কড়া অসুখ করেছে জনাব! আপনি কাউকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে বোধ করছি যে!”
নাস্তার কিছুক্ষণ পর বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে দেখা যায় মিহিরকে। গোসলে যাওয়ার সময়টায় রিপ্তি তার ফোন হাতে তুলে নেয় বিশাল রকমের দ্বিধায়। ইয়ানাত নামে যে নম্বরটা ফোনে সংরক্ষণ করা, তা লুফে নেয় গোপনে গোপনে। প্রয়োজন হতে পারে যেকোনো সময়ে। সুযোগ পেলে সাক্ষাতের হাল ছাড়বে না সে। এরইমধ্যে নামে ঝড়ো বৃষ্টি। সকাল থেকেই আবহাওয়া গুমোট। বাইরে বের হতে গেলেও মনে করে ছাতা নেওয়া যেখানে বাধ্যতামূলক। ছলছল ধারা এদিকে বয়েই গেলো অবশেষে। রিপ্তি ফোন রেখে ঝটপট যায় বারান্দা হতে কাপড়চোপড় নিয়ে আসতে। পিছু পিছু দৌড়ায় তার ম্যাওছানা। ফিরে এসে কাপড়চোপড় রেখেই নজর যায় পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকা ম্যাওছানার দিকে। এইতো, সাথে দৌড়ে গিয়ে আধোভেজা হয়ে এলো। ম্যাও ছানার ছোট গামছা নিয়ে গা মুছে দেয় রিপ্তি। ঝড়ো হাওয়াটা যেন কমে এসেছে। তবে ক্রমশই বেড়েছে বৃষ্টি পড়ার গতি। ম্যাও ছানা কোলে তুলে ফের বারান্দায় যায় সে। মনের মেঘ কিছুটা ধুয়ে দিতে চায় এই অঝোর ধারায়। ভাবে, কতদিন যেন হয় হাসে না সে। শারীরিক অসুস্থতা তাকে হাসতে মানা করেছে একেবারে। এখন আবার চাপ পড়েছে মানসিক দিক থেকেও। সে কি আর হাসবে না তবে ওভাবে? ওই দুষ্টুমি আর দুষ্টুমাখা হাসি আসে না কেন ভেতর থেকে?
গোসল সেরে বেরিয়ে এসে বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা বদলে ফেলে মিহির। একে তো খুব জরুরী না যাওয়াটা। এমনি একটু অফিসে গিয়ে সবার সাথে বসতো। অন্যথায় এই আবহাওয়ায় বের হলে আবার গোসল সেরে ফিরতে হতে পারে। গাড়িটাও অহেতুক কাদামাক্ত করার কোনোই প্রয়োজন নেই। মাথার ভেজা চুল ঝেরে ট্যাপা পায়ে সে-ও বারান্দায় চলে আসে রিপ্তিকে অনুসরণ করে। বিড়াল কোলে নিয়ে আদর করছে ওই কোমল হাত। অথচ ধ্যান গাঁথা অজানায়। মিহির কাঁধে হাত রাখতেই ধ্যানভঙ্গ হয় রিপ্তি।
“কি ভাবছো?”
“কোথায়? কিছু না।”
“দেখেছো, কেমন বৃষ্টি নেমেছে? ইউনিভার্সিটি যেতে নিষেধ করে ভালো করেছি না?”
“তখন তো বৃষ্টি ছিলো না। এসময় আমি ক্লাসে থাকতাম। ক্লাসের ছাদ তো আর ফুটো নয়, যে অতি বৃষ্টিতে ভিজে যাবো।”
মিহির মৃদু হেসে বলে,
“তাইতো! তবে আসার সময় বেকায়দায় পড়তে।”
“আসার সময় হলেও যে বৃষ্টি থেকে যাবে, এমনটাও তো এখনই বলা যাচ্ছে না।”
“কাদা তো আর উড়ে যাবে না পথঘাট থেকে। এই ধরো ইনস্টিটিউটের বাইরে এলে, আর তুমি কাদায় পিছলে…”
দুষ্টুমি জুড়তে গিয়েও থমকে যায় মিহির। তৎক্ষনাৎ গম্ভীরতা ধারণ করে বলে,
“রিপ্তি! এই অবস্থায় তুমি ভুলেও বাইরে বের হতে যেয়ো না। জাস্ট সী, যা হয় ভালোই হয়। তখন নিষেধ করে শুধু ভালোই না, খুব ভালো করেছি আমি। বৃষ্টির দিনে বাইরে যাওয়া তোমার টোটাল অফ। দরকার নেই আমার কোনো ক্লাসের। ওয়ান ইয়ার লস করে ক্লাস পরেও হবে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে। কিন্তু শারীরিক একটা সমস্যা বাঁধিয়ে ফেললে সারাজীবনের ক্ষতি। শুধু ক্লাস কেন, তুমি এবাড়ি ওবাড়িও করো না এমন দিনে। শুকনো দিনেও সাবধানে চলো। কেমন?”
“এতো ভয় পায়িয়ে দিলে আমি এইটুকু একটা মেয়ে জানে বাঁচবো?”
“তুমি এইটুকু? তুমি তো আমার চেয়েও বড়।”
“কোন দিক থেকে এই যুক্তি?”
“তোমার বার্থডে কিন্তু প্রতি বছরই আমার বার্থডের আগে আসে। সো, তুমিই বড়।”
কিছুটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে রিপ্তি। মাথায় মাথা ঠুকে দেয় মিহির। জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুটা সময়। রিপ্তির কোলে ঠাঁই নেওয়া ম্যাও ছানার তুলতুলে গায়েও হাত বুলায়। আগে বিড়াল পোষাটা ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগতো না মিহিরের। এখন পরম যত্নে রিপ্তিকে লালন করতে দেখে তারও একটু একটু আসক্তি এসে যাচ্ছে বিড়াল পোষণে। মাঝে মাঝে বিছানায় তার পাশে এসে বসে থাকলেও বিরক্ত হয় না মোটেও। কান টেনে নাহয় গাল ছুঁয়ে আদর করে দেয় হালকাভাবে।
বৃষ্টিময়ী দুপুরে ভালো একটা ঘুম হয় মিহিরের। ঘুম থেকে উঠে যখন বৃষ্টি পরবর্তী সোনালী আলোর দেখা পায়, তখন বেরিয়ে পড়ে ড্রাইভিংয়ে। যখন বাড়ি ফিরে, মুখে লেপ্টে থাকতে দেখা যায় সুন্দর হাসি। ট্যাপে প্যাচানো একত্রিত তিনটি গোলাপ হাতে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে। রিপ্তি কলিং বেলের শব্দে এগিয়ে এসে দরজা খোলার পরপরই সে ভেতরে পা রেখে গোলাপ তিনটি গুজে দেয় রিপ্তির এলো প্যাচানো খোপায়।
“ফুল তবে নারীর খোপায়ই ভালো মানায়।”
রিপ্তি স্মিত হেসে বলে,
“তাই?”
“একদম।”
“হঠাৎ ফুল আনতে মন চায়?”
“ইয়ানাত দিলো। তোমার জন্যই দিলো। বললো, ‘ওয়াইফকে নিয়ে দিবেন। খুশি হয়ে যাবে।’ হওনি?”
“হুম।”
নিষ্প্রাণ শব্দে উত্তর আসে তার। ইয়ানাতের নাম শুনতেই মুখের সেই হাসিটা বিলীন হতে ব্যস্ত হয়েছিলো যেন। মিহির জুতো জোড়া হাতে নিয়ে নির্দিষ্ট তাকে তুলে রাখতে রাখতে বলে,
“সারাদিন কেমন ফিল করেছো?”
“ভালো।”
“মনে হয়, ক্লাস করতে পারবে ঠিকঠাক?”
“হুম।”
“আমার তো কেমন অসুস্থই মনে হয় তোমার চেহারায় তাকালে। যাইহোক, তোমার ভালো তুমিই ভালো বুঝো। আগামীকাল হতে তবে ক্লাসের জন্য নিয়ে যেতে বলে দিবো তারিকুল ভাইকে।”
হালকা করে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় রিপ্তি। জানালার আয়নায় চোখ পড়তেই নজরে আসে খোপায় গাঁথা ফুল। মলিনতার সাথে আস্তেধীরে নামিয়ে সেটি রেখে দেয় ট্রলির উপর। শূলহীন গোলাপও যেন মগজে শূল ফুটালো। এতোটাই অস্থিরতায় ভুগছে সে।
পরবর্তী সকালে ড্রাইভার তাকে ইন্সটিটিউটে নামিয়ে দিয়ে এলেই ক্লাসে যাওয়ার আগে গোপনে সংগৃহীত নম্বরটায় ডায়াল করে বসে রিপ্তি। পরে কি হবে, জানে না সে। তবে এখন এটিই ভীষণ জরুরী মনে হলো তার কাছে। ইয়ানাতের সাথে কথা বলতেই হবে তাকে। প্রথমবার রিসিভ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার ডায়াল করলো। প্রায় শেষ পর্যায়ে রিসিভ হলো। গলা খাঁকারি দিয়ে সালাম দিলো রিপ্তি। ওপাশ থেকে সালামের জবাব দেয় মেয়েলি কণ্ঠ।
“আপনি কি ইয়ানাত বলছেন?”
“কে আপনি?”
“আপনি আমাকে চিনবেন না হয়তো।”
“নাম?”
“জ্বি, আমি রিপ্তি বলছি।”
“কোন রিপ্তি? আর কি কারণে কল করা?”
“অ্যাকচুয়ালি, আপু আমি মিহির খাঁনের ওয়াইফ বলছি।”
“অও! সিরিয়াসলি!”
“হুম। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।”
“শিওর, বলুন।”
“না মানে, আপু একটু জরুরী কথা ছিলো আরকি। সামনাসামনি বললে ভালো হয়। যদি একটু সময় করে মিট করা যেতো। হবে কি আপনার একটু সময়?”
ওপাশ থেকে হাসির সঙ্গে জবাব আসে,
“নিশ্চয়ই, আপনার বাসায় চলে আসি তবে?”
“বাসায় অন্য সময় আসা যায়। বাট, আমি চাইছিলাম বাইরে কোথাও বসতে। কোনো কফিশপে?”
“ওকে। এটা তো খুবই ভালো প্রস্তাব বলে মনে হচ্ছে। মিহির খাঁনের ওয়াইফের সাথে মিট করছি ফার্স্ট টাইম। আজই হবে নাকি?”
“চাইলে হয়।”
“তো বলুন, কখন কোথায় আমাদের দেখা হচ্ছে?”
“আপনিই বলুন, কখন আপনার সময় হয়। এখন থেকে বিকেলের আগে হলে ভালো হয় আমার জন্য। আমি একটু বাইরে এসেছিলাম, একেবারে আপনার সাথে মিট করেই ফিরতে পারবো তবে।”
“আমি এখন ফ্রিই আছি। কিন্তু আপনি কোথায় আছেন, তা তো আমি জানি না। এড্রেসটা আমায় দিলে আমি হয়তো সুবিধামতো জানাতে পারতাম।”
“আমরা মিরপুরেই দেখা করি এগারোটার দিকে? রঙ্গমালা ক্যাফেতে?”
“ওকে। মিহির খাঁন আসছেন তো সাথে?”
“না। আসলে, উনি জানেন না এই ব্যাপারে কিছু। আমি একাই, পার্সোনালি একটু কথা বলতে চাইছি। আশাকরি, বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা।”
“ওকে। নো প্রব্লেম। আমি এগারোটায় পৌঁছেই আপনাকে কল করবো।”
“জ্বি। ধন্যবাদ আপু।”
“হ্যাভ অ্যা গুড ডে।”
কল কাটতেই রিপ্তির গা ঝিমঝিম করে উঠে। আসুক না আজ উম্মে ইয়ানাত! তার একাডেমিক ক্লাসের চেয়েও বিশেষ জরুরী ক্লাস নিয়ে ছাড়বে এই উম্মে ইয়ানাতের।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে