গানের ওপারে তুমি পর্ব-০৪

0
555

“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
এর দুদিন পরই রিপ্তিকে আবার দেখেছিলো মেইন রোডে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে। এখান থেকে বাসে কিংবা টেম্পোতে করে প্রতিষ্ঠানে যায় সে। মিহির গাড়ি নিয়ে অফিস যাওয়ার সময় ছোট রোড থেকে বেরিয়ে মেইন রোডে উঠতেই গ্লাস খোলা থাকায় রিপ্তি তাকে দেখে ডাকলো,
“সুপারস্টার! সুপারস্টার!!”
মিহির একবার তাকিয়েও নিজের পথে যেতে শুরু করেছে। মেইন রোড ঘেঁষে কোনো দোকানপাট নেই। যা আছে সব ভেতরের রাস্তায়। পানি পিপাসা পেয়েছিলো, কিন্তু গাড়িতে উঠার সময় পানি নিতে মনে নেই। কিছুটা এগিয়ে সে পানি নিয়ে আবার রওনা হলো। অফিসে গিয়ে কিছুটা সময় গানের প্রাকটিস করে বাকিটা সময় আড্ডাই দিলো৷ প্যারিস যাওয়ার প্ল্যান চলছে। শুটিংয়ের প্ল্যান নিয়েও মিটিং করছে। বাসায় ফেরার পথে আবার পুরনো অভাবটা নাড়া দিলো। কতদিন হয় ইয়ানাতের সাথে কথা হয় না। আগে তো দু-তিন মাস পরপর হলেও কথা হতো। এখন বছর পার হয়ে যাচ্ছে প্রায়, জানে তারা। কথা হবেই না। তবুও মিহিরের অন্তস্থলে একটু অপেক্ষা। ভাবনার বাইরে ফেলেও ফেলতে পারে না আবার। পুনরায় ভাবতে বসে যায়, কেন এমন করলো ইয়ানাত? ব্যক্তিগত কোনো বিপদ চলে এলো কি হঠাৎ? নয়তো এমন পরিবর্তন কিভাবে আসে একটা মানুষের মধ্যে? সে তো একটু বুঝিয়ে বললেও পারতো তার সমস্যাটা। একটা কারণ সামনে তুলে রেখেই পিছু ফিরতে পারতো। হঠাৎ করে মানসিকতা পরিবর্তন করে ব্যক্তিত্বের বিসর্জন দিলো কেন এভাবে? তার বিরহ এখন কাটে না যে কোনো ক্ষণে! কি মায়ায় জড়িয়ে গেলো সেই শুরু থেকে? এখন চেয়েও সরাতে পারে না আবার তাকে। মিহিরের কি সর্বোচ্চ চেষ্টায় তাকে ভুলে নিজের জীবনে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন? কিন্তু এই জীবনের অগ্রগতি যার জন্য হলো, তাকে ভুলবে কি করে সে? যতই অভিমান হোক না কেন, যতই সাফল্যের জীবন নিয়ে এগিয়ে যাক। ভুলে যাওয়া তো সম্ভব হবে না তার। হয়তো ভালোবাসাটুকু নিংড়ে ফেলা যাবে, কিন্তু যতদিন এই স্মৃতিবোধ বেঁচে আছে ভুলে যাওয়াটাও অসম্ভব হয়েই বেঁচে থাকবে।
বাড়ি ফিরতেই দেখলো তার বাল্যকালের বন্ধু, শাফিন বাসায় আড্ডা জমিয়েছে মায়ের সাথে। মিহিরকে দেখেই হাসিমুখে বলে,
“ফেরার সময় হলো তোর। অপেক্ষা করছিলাম তোর জন্যই। আন্টির সাথে গল্পও হলো। আন্টি চাইছে যখন, বিয়ে করে নিচ্ছিস না কেন? বললে তো মেয়ে দেখতে পারি।”
“নিজের বিয়েটাই আগে কর।”
“সে হয়েই যাচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। দাওয়াত করতে এলাম৷ যাবি কিন্তু আন্টিকে সাথে নিয়ে। শ্যালিকারও অভাব নেই। টুপ করে একটা পছন্দ করে নিলেও ব্যবস্থা করা যাবে।”
রসিকতা ঢেলে শাফিন নিজেই হাসি জুড়ে দিলো। মিহির কিঞ্চিৎ হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে তার বিপরীতে। পরক্ষণে বিয়ের কার্ড এগিয়ে দিয়ে একটা মৌখিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে নেয়, বিয়েতে উপস্থিত হওয়ার।
শাফিনের বিয়ের দাওয়াত পাওয়া মাত্র এদিকে মায়ের মুখে আবারও ঘরে ছেলের বউ আনার গীত! ছেলে বললেই তিনি মেয়ে খুঁজতে লেগে পড়েন। আর কত অপেক্ষা? মায়ের স্বগতোক্তি শুনে ধীর নিশ্বাস বেরিয়ে আসে মিহিরের। বিষণ্ণতার নালায় কাতরানো ইয়ানাতকে মনে করে করে তার রাতের ঘুমটাও হলো না ঠিকঠাক। মন বলছে আরেকবার রশীদ স্যারের কাছে যেতে। আরেকটু চেষ্টা করে দেখতে, ইয়ানাত পর্যন্ত পৌঁছানো যায় কি না। সকাল হতেই সে আবার ছুটে গেলো রশীদ স্যারের বাড়ি। তখন তিনি ঘরে ছিলেন না। ভোরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ফিরেননি এখনো। মিহির কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। স্যারের পুত্রবধূ তাকে নাস্তা দিলো। মিহির নাস্তা করতে ইচ্ছুক নয়। তবে বসে বসে মিউজিক নিয়েই একটু গল্প করলো স্যারের ছেলের সাথে। একটু পরেই রশীদ স্যার ফিরলে এতোক্ষণ সঙ্গ দেওয়া ছেলে উঠে গেলো তাদের কথার সুযোগ দিয়ে।
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কি অবস্থা মিহির? কেমন চলছে সব? ভালোই কনসার্ট, প্রোগ্রামে দেখা যায় তোমাকে। প্রচেষ্টার ফলাফল অতি সুন্দর হয়।”
প্রশংসাবাণীতে মিহির মুচকি হেসে বললো,
“এইতো স্যার, আপনাদের সহযোগিতা আর দোয়ায় আজ আমি এই পর্যায়ে। কিন্তু একটা অপূর্ণতা ঠিক রয়েই গেলো, স্যার। যার সূত্র ধরে আমার এ পর্যন্ত আসার সুযোগ হওয়া, তাকেই সামনে থেকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেওয়া হলো না।”
“নাস্তা করো না কেন? খেতে খেতে কথা বলো।”
“না, স্যার। এখন কিছু খাবো না। আপনি প্লিজ, আমাকে ইয়ানাতের ঠিকানাটা দিবেন?”
“দেখো, তুমি যা ভাবছো ব্যাপারটা ঠিক সেটা না। তার সাথে সচরাচর যোগাযোগ হয় না আমার। তার সম্পর্কে আমি ততোটাও জানি না। আর যতটুকুই জানি, তোমাকে জানাতে পারছি না বলে ভারি দুঃখ হচ্ছে আমারও। কিন্তু বাবা, যে নিজ থেকে চাইছে না তুমি কেন অযথা তার পিছু ছুটছো? সেটাই আমার বুঝে আসছে না।”
“সে যে কি কারণে হঠাৎ লুকিয়ে গেলো, সেই কারণটাই জানতে চাই শুধু। একরকম মানসিক অসুস্থতায় ভুগছি ব্যাপারটা নিয়ে।”
“তোমার এই অসুস্থতার কারণ তো তুমি নিজে। এমন তো নয়, সে তোমাকে কোনো দিক থেকে অপরাধী ভেবে রেগে আছে। আবার এমনও নয় যে, সে তোমার উপর কোনোরকম দায় রেখেছে। এখন অযথা নিজেকে অসুস্থ করে রাখলে এখানে কার দায়, বলো? তুমি যে আমার কাছে এমন অনুরোধ রাখো, আমি এখন তোমাকে একটা কথা বলি। আমি তোমার কাছে একটা কিছু আমানত রাখলাম। তুমি কি সেই আমানতটা গচ্ছিত রাখবে, না ছুঁড়ে ফেলে দিবে? বলো?”
মলিন কণ্ঠেই মিহির জবাব দিলো,
“গচ্ছিত রাখবো।”
“তবে এবার বলো, যে মেয়েটা আমাকে এই একটা কথা কখনো প্রকাশ করতে নিষেধ করেছে। তোমার বারবার অনুরোধে আমি কিভাবে সেই কথা বলে দিতে পারি? এটাও তো একটা আমানতই। কি চাও তুমি এখন? আমি সেই আমানতের কথা বরখেলাপ করি?”
দুদিকে মাথা নাড়লো মিহির। স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়ে এক রাশ হতাশা নিয়ে বেরিয়ে এলো। মন থেকে ইয়ানাতের প্রত্যাশাটুকু যেন এই হতাশার সাথেই মুছে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হলো বাড়ি ফিরতে ফিরতে। সিএনজি না পাওয়ায় মাস্ক পরে লোকাল বাসেই উঠে পড়েছে সে। তবুও বাসে থাকা দুজন যুবক পাশে এসে দাঁড়িয়ে সেল্ফি তুলে গেলো। বাকিরা হয়তো আধুনিক গানের জগতের সাথে জড়িত না, তাই দেখলেও চিনেনি। জানার আগ্রহও বোধ করেনি। মিহিরের মানসিকতাও চাঙা নয় জনস্রোতের মুখে মুখে ভাসতে। একরকম নির্লিপ্ততা তাকে তিক্ততার সাথে গ্রাস করে রেখেছে। এতোটাই চিন্তামগ্ন ছিলো যে, চলিত রাস্তাতেও খেয়াল ছিলো না। বাসের হেল্পারের চেঁচানিতে ধ্যানভঙ্গ হয়েছে। ছোট রাস্তার সন্নিকটে এসে বাস থেকে নেমেই পড়েছে আরেক ঝামেলায়। রিপ্তি মাত্রই এ পর্যন্ত এসেছে হেঁটে। এখন গাড়ির জন্য দাঁড়াবে এখানে। তন্মধ্যে সামনাসামনি হয়ে গেলো মিহিরের। মিহির দেখলেও থামলো না। রিপ্তি যেন দেখা পেতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠে। কি ভাগ্য তার! ভাবতেও পারেনি মিহিরকে দেখবে এসময়। তা-ও আবার লোকাল বাস থেকে নেমেছে! রিপ্তি দ্রুত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে ডায়রি আর কলমটা হাতে নিয়ে মিহিরের চলতি পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। সাথে একটা ছোট গিফট বক্সও বের করেছে।
“সুপারস্টার, সুপারস্টার। একটা অটোগ্রাফ প্লিজ।”
হতাশাগ্রস্ত মন থেকে মিহির এক টুকরো ত্যক্ত বাক্য জুড়লো অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
“সুপারস্টার কাকে বলে, তুমি জানো?”
“যাকেই বলুক। আপনি আমার সুপারস্টার। আর কিছু জানতে হবে না।”
“দেখা হলেই প্রতিদিন অটোগ্রাফ দিতে হয় না। সরো।”
“না, না। প্লিজ। একটা অটোগ্রাফ দিয়ে যান। আপনাকে একটা গিফট দিবো বলে দুদিন যাবত সাথে নিয়ে ঘুরছি। কিন্তু সুযোগই হচ্ছে না দেওয়ার।”
সামনে ডায়েরি খুলে ধরলো রিপ্তি। মনমেজাজ ভালো না এমনিতেই। তারউপর খোলা ডায়েরিতে চোখে পড়লো,
“আই লাভ মাই সুপারস্টার, মিহির খাঁন।”
ভক্তদের এই মিষ্টিবাক্য হয়তো অন্যসময় ভালোই লাগতো। কিন্তু মানসিকতা তীক্ষ্ণ হলে মিষ্টিকেও মিঠা মনে হয় না। সে ডায়েরিটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
“এই, মেয়ে। নিষেধ করেছি না? দেখলেই কি পাগলামো করো এগুলো? ভক্ত হওয়া ভালো। অতিভক্তি ভালো না। আমার কোনো গিফটও লাগবে না। যাও!”
বিরক্তি নিয়ে ডায়েরি সরিয়ে দেওয়ায় যেন পাগলও ক্ষেপে গেলো।
“একটুখানি লিখতে এতো ভাব? আমার কলম আর আমার খাতায়ই তো লিখবেন, আবার ভাব দেখান! গতকাল চিল্লানি দিয়ে ডাকলাম, শুনলেন না কেন? এতো কিসের অহংকার আপনার? আপনার গাড়ি আছে বলে খুব ভাব দেখান? টাকা হলে গাড়ি একদিন আমিও কিনবো। আপনার গাড়ির সামনে এসে তখন আমার গাড়ি রেখে দিবো। দেখবো তখন এই রাস্তায় কিভাবে গাড়ি চালান আপনি।”
“আযব তো!”
“কিসের আবার আযব? একটু পাত্তা দেই দেখেই নিজেকে খুব বড় মনে করেন, না? আমরা সাধারণ মানুষ না থাকলে আপনার মতো সেলিব্রিটি কিছুই না। আবার ভাব দেখাতে আসে! কিসের এতো ভাব শুনি? আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দিতে বলেছিলাম, দেননি কেন? আবার আযব, আযব করেন!”
মিহিরের বিরক্তি ক্রমশই বাড়তে লাগলো। এই মেয়ের উল্টাপাল্টা বলার কারণে এবার চোখ রাঙিয়ে উঁচু গলায় একটা ধমক দিয়ে বসলো সে।
“একটা থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো, বেয়াদব! আর একদিনও তুমি আমার সামনে আসবে না বলে দিলাম। আস্কারা পেয়ে মাথায় চড়তে শুরু করেছে একেবারে। মেন্টাল কোথাকার! যাও! আবার দাঁড়িয়ে আছে!”
কিছুটা জোরে ধমক দেওয়াতে রিপ্তি আৎকে উঠেছে। ভয় পাওয়ায় চোখদুটো যেন হালকা ভিজে এসেছে। আশেপাশে আবার তাকিয়ে দেখে, কোনো মানুষ দেখেছে কি না মিহির যে ধমক দিয়েছে। দেখেছে তো অবশ্যই। ওই মেইন রোডে হেঁটে হেঁটে ভ্যান ঠেলে নেওয়া এক অপরিচিত লোক দেখেছে। এছাড়া আর কারো নজর এদিকে স্থির রয়নি। অবশ্য এদিকে কড়া রোদে কোনো জনমানুষও নেই। আর দোকানপাট তো সব ভেতরের রাস্তায়ই। রিপ্তির বড্ড মনখারাপ হলো। বিড়বিড় করে বকতে বকতে সরে এপাশে এলো গাড়ির জন্য দাঁড়াতে। রাগান্বিত মিহির চোখ গরম রেখে ভ্রু কুচকেই তাকিয়ে রইলো। বিড়বিড় করতে করতে ডায়েরি থেকে কয়েকটি পৃষ্ঠাও ফাঁতফাঁত ছিঁড়ে ফেলেছে রিপ্তি। গিফট বক্সও হাতের মুঠোর চাপে মুড়ে ফেলেছে। পরপরই ত্যক্ত মেজাজ মাথায় চেপে মিহির নিজ পথে চলে গেলো আবার।

.
এইচ এ রশীদ স্যারের কথাকে মাথায় রেখে সেদিনের পর থেকে ইয়ানাতকে মন থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। কেন অনুশোচনায় আর থাকবে? ঠিকই তো, ইয়ানাত তো কোনো দায় রাখেনি তার প্রতি। বরং কৃতজ্ঞতা স্বীকার সবসময় বহাল থাকবে তার দ্বারা। তাতে ইয়ানাতের কোনো লাভ হোক বা না হোক। সেই সম্মানটুকু ঠিক থেকে যাবে তার মনে। ভালোবাসাটুকু নাহয় ফিরিয়েই নিলো। ভাবতে প্রস্তুত হওয়া যাক অন্য কাউকে নিয়ে। কাজকে ভালোবেসেছে, ভালোবেসেই যাবে। মনমানসিকতাও বদলে স্বাভাবিকতার ছোঁয়া পেয়েছে এই এক সপ্তাহে। বিয়ের ব্যাপারে মাকে মতামত জানানো দরকার। দেখুক মেয়ে, মায়ের পছন্দ মতো করেই।
মিহির বিয়েতে মত দিলেই জিনিয়া তাবাসসুম যেন খুশি হয়ে মেয়ে দেখা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। নিজেদের ভবনেরই এক ভাড়াটিয়া এসেছিলো বছর খানেক আগে একটা মেয়ের সমন্ধে বলতে। তখন তিনি ছেলের অনিহার ভিত্তিতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। এখন যখন আবার নিজেই তার খবর নিতে গেলেন, ভাড়াটিয়া জানালেন সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আরও অনেক আগে। তবে জিনিয়া তাবাসসুম বললে তিনি অন্যান্য মেয়েদের খোঁজ করতে পারেন। আর তাই তিনি খোঁজ করতে বলে দিলেন। প্রতিবেশী এক ঘটককেও ভালো মেয়ে খুঁজে দেওয়ার জন্য বলে এলেন পরের দিনই।

[চলবে।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে