গাধা (১)

0
1492

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
————————————————-
গাধা (১)

:পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গাধা পাওয়া যায় কোন দেশে, বলতে পারেন?

: জানি নাতো! বাংলাদেশে?

:ইথিওপিয়াতে। তবে আপনার উত্তর যে একেবারে ভুল, তা কিন্তু বলা যাবে না। বাংলাদেশে প্রচুর গাধা মানুষের বেশ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাহাহা। এরা হচ্ছে গাধা-মানব , যেমন আমার ছোট ভাই মিজান, হাহাহা।

: আপনার ছোট ভাই গাধা-মানব ? মানে কী ? সে বোকা? সেজন্য আপনি এভাবে হাসছেন?

: সরি সরি। আসলে ওকে নিয়ে ছোটবেলার একটা মজার মেমোরি মনে পড়ে গেলো তো, তাই হেসেছি। অন্য কোন কারণে না।

: কী মেমোরি?

:সেটা বলতে গেলে তো একদম শুরু থেকে বলতে হবে, আপনার কি সময় হবে?

:সেটা ডিপেন্ড করছে আপনার গল্পের ওপর। গল্প ইন্টারেস্টিং হলে সময় করে শুনবো, না হলে মাঝ পথে দি এন্ড করে বিদায় নেবো।

:হাহাহা, আচ্ছা ঠিক আছে, বলতে শুরু করি, দেখা যাক আপনার ভালো লাগে কিনা। মিজান আমার যমজ ভাই। ছোট বলেছি এই কারণে যে ও আমার পরে জন্ম নিয়েছে। জন্মের পরেই দেখা গিয়েছিলো ও অপুষ্ট। কাঁদতেও নাকি দেরি করেছিলো। মফস্বলে থাকতাম আমরা, বাবা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বাড়িতেই আমাদের জন্ম হয়েছিলো।

জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মিজানকে সঙ্গী হিসেবে দেখছি। ও দেখতে আমার মতোই, একটু হ্যাংলা পাতলা সবসময়, আর একটু বেঁটে। ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে পারলাম মিজানের বুদ্ধির ধার কম। কম মানে হচ্ছে ও নিরেট বোকা।

:বোকা বলে তাকে গাধা বলছেন? খুব অন্যায়।

:আগে শুনুন না পুরোটা। এখনই আমাকে জাজ করবেন না।

:আচ্ছা ঠিক আছে বলুন।

:আমরা একসাথে বেড়ে উঠলেও ওর সাথে ঠিক বন্ধুত্ব হয়নি আমার। আমি যে ধরণের খেলা কিংবা দুষ্টুমি কর্মকান্ড করতে চাইতাম, মিজান সেসব বুঝতেই পারতো না। গাধার মতো হা করে দেখতো শুধু। বিরক্ত হয়ে ওর সাথে খেলা বন্ধই কর দিলাম। চার পাঁচ বছর বয়সে আমরা যখন অক্ষরজ্ঞান নিতে শুরু করলাম তখন দেখা গেলো মিজান কিছুই পারছে না। প্রথমে মনে হলো পড়ালেখায় তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ধীরে ধীরে বোঝা গেলো ও অক্ষরজ্ঞান লাভ করতে অক্ষম। পাঁচ বছর বয়সে আমরা স্কুলে ভর্তি হলাম কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মিজানের স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হলো। সে স্কুলে থাকতেই চাইতো না। চিৎকার, কান্না, ছোটাছুটি, মারামারি করে সবাইকে অতিষ্ট করে তুলেছিলো। শিক্ষকরা পরামর্শ দিলেন ও আরো বছর খানেক পরে আসুক, ততোদিনে আরেকটু বুঝতে শিখবে। কিন্তু বাবা মা বুঝে ফেলেছেন, তাদের এই পুত্রের মানসিক ভারসাম্য স্বাভাবিক না। তাকে অন্য দশজন ছেলের সাথে তুলনা করে লাভ নেই। তাই সমস্ত ভালোবাসা আর মনোযোগ মিজানকে ঢেলে দিলেন।

মিজান বাসায় থাকলো। আমি স্কুলে যেতাম। প্রচুর বন্ধুবান্ধব হলো, পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করলাম। শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র হয়ে অন্যদের চেয়ে নিজেকে বিশেষ কিছু ভেবে সেই বয়সেই নিজের ভেতরে এক ধরণের দূষিত অহংকার তৈরি হলো। আমি যখন ক্লাস ফোরে তখন স্কুলে ভর্তি হলো মিজান। আমার সাজানো স্কুল জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।

:আপনার প্রতিবন্ধী ভাইকে সহ্য করতে পারছিলেন না ?

:শিশুরা কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর হয়, জানেন? ওর মতো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছোট ভাইয়ের কথা স্কুলে কখনো কাউকে বলিনি। মিজান প্রথম যেদিন স্কুলে আমার দিকে অস্বাভাবিক ভাবে হাসতে হাসতে ছুটে এলো , আমি দারুন অপ্রস্তুত হয়েছিলাম। সবাই অবাক হয়ে আমাদের দেখছিলো। যতই ওকে এড়াতে চাই, ও খালি আমার কাছাকাছি থাকতে চায়। নতুন পরিবেশে আমিই ছিলাম ওর একমাত্র ভরসার জায়গা। কিন্তু আমি ওকে বারবার সরিয়ে দিচ্ছিলাম। ওর ভিন্ন রকম আচার আচরণ দেখে অন্যরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলো। মিজানকে গাধা বলে ডাকতে শুরু করলো সবাই।

:আপনি কী করলেন? ভাইকে রক্ষা করলেন না?

:ওইযে বললাম, শিশুরা কোনো কোনো সময় খুবই নিষ্ঠুর হয়। যখন ওর ভাই হিসেবে আমাকে নিয়েও হাসাহাসি শুরু হলো, তখন খুব রাগ হলো মিজানের উপর । মিজান এইধরণের নিষ্ঠুরতার সাথে পরিচিত ছিলো না। ও আরো এলেমেলো আচরণ করতে শুরু করলো। একসময় চিৎকার করে কান্না শুরু করলো। ওকে দেখে মায়া হলো না, প্রচন্ড বিরক্তি আর রাগ উথলে উঠলো। ওর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে শুরু করলাম, যাতে সবার সামনে ‘ভাইয়া’ বলে আমাকে জড়িয়ে না ধরে। ওর চোখে মুখে প্রবল আকুতি উপেক্ষা করে আমি আগের মতো সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সেটা হলো না।

:কেনো?

:মিজান ধীরে ধীরে সবার উপেক্ষা আর নিষ্ঠুরতার সাথে অদ্ভুতভাবে মানিয়ে গেলো। ওর তোতলামি নিয়ে সবাই যখন ব্যঙ্গ করতো, ও হাসতো। টিফিনের সময়ে সবাই ওকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ওর সাথে ঠাট্টা তামাশা করাটাই সবার মূল আকর্ষণ হয়ে উঠলো। অবশ্য দু বছর পর আবার ওর থেকে দূরে সরে যাওয়ার সুযোগ পেলাম।

:কিভাবে?

:হাই স্কুলে চলে গেলাম। সেখানে আবার নিজের কৃতিত্ব দিয়ে ভালো ছাত্র আর ভালো খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলাম। যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আবার মিজান চলে এলো স্কুলে। প্রতিবন্ধী ভাইকে নিয়ে আবার অস্বস্তিতে পড়লাম। মনে মনে স্বান্তনা ছিলো- আর মাত্র দুবছর পরেই ঢাকায় কলেজে চলে গেলে মিজানের গন্ডি থেকে আমি দূরে সরে যাবো। মিজান ততদিনে বুঝে গিয়েছিলো আমার কাছে সে প্রত্যাশিত নয়। তবুও ছায়ার মতো আমাকে ফলো করতো। বুঝতাম, ও আমার আশেপাশেই আছে, স্কুলে আর বাসায়। আমি যখন টেবিলে বসে পড়তাম , ও দূর থেকে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতো। পরে দেখতাম, টেবিলে ঠিক আমার ভঙ্গিতে বসে পড়ার ভাণ করছে আর মিটিমিটি হাসছে। সেটা না হয় মানা যায় কিন্তু আমার বইয়ের ভেতর আঁকাআঁকি করে রাখা একদম সহ্য করতে পারতাম না। সুযোগ পেলে চড় বসিয়ে দিতাম। মিজান হাসতো। ওর হাসি দেখলে আমার আরও রাগ লাগতো। আমি যতই ভালো রেজাল্ট করি, ফুটবল খেলে যতই ট্রফি নিয়ে আসি, বাবার কাছে মিজানের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। মিজান একটা কাগজে দু চারটা লাইন এঁকে নিয়ে এলেও বাবা মা প্রশংসায় অস্থির হয়ে যেতেন। অথচ আমি ফুটবল খেলে মেডেল নিয়ে এলে ঠিক মতো দেখতেন না।

:বুঝলাম। সিবলিং রাইভালরি।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


:হুম, তাই। আমি মেধাবী হয়েও মিজানের কারণে আড়ালে ঢাকা পরে যেতাম বারবার । স্কুলেও আমার বন্ধুরা মিজানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই ভালোবাসতো। মিজান কিছু অদ্ভুত ব্যাপার করতে পারতো। যেমন, যে কোন ছোটোখাটো হারিয়ে যাওয়া জিনিস ও খুঁজে বের করতে পারতো। একবার মায়ের নাকফুল হারিয়ে গেলো, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে কেউ পেলাম না অথচ মিজান কোত্থেকে যেন কুড়িয়ে নিয়ে এলো। টুকিটাকি জিনিস কুড়িয়ে এনে আজব সব খেলনা বানাতো মিজান । একবার ম্যাচের বাক্স কুড়িয়ে এনে জোড়া লাগিয়ে পুতুলের মতো একটা কী যেন বানালো, তার মুখে দিলো নায়িকা শাবানার মুখ! তার পর সেটাকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচাতে লাগলো। টিফিন পিরিয়ডে পুরো স্কুল তার আজব আবিষ্কার দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।

:মানুষ আজব জিনিস দেখতে ভালোবাসে, এটাই তো স্বাভাবিক।

:সে বয়সে বিষয়টা আমার স্বাভাবিক মনে হয়নি। মিজানের আধ পাকা মস্তিষ্ক থেকে যেসব আজব বুদ্ধি বের হতো, আমি সেগুলোকে হিংসা করতে শুরু করলাম। একদিন সেটার বহিঃপ্রকাশ হয়ে গেলো। স্কুলের পরে ফুটবল ম্যাচ চলছিলো। মিজান যথারীতি বেশ দূরে একটা জারুল গাছের নিচে পাকা বেদীতে বসে আমাদের খেলা দেখছিলো। আমি সেন্টার মিডফিল্ডে একটা খুব দারুন পাস্ খেলছি। হটাৎ মিজান কোত্থেকে চিলের মতো উড়ে এসে ফুটবল হাতে নিয়ে ভোঁ দৌড়! তার মুখে খিলখিল হাসি। আমি হতভম্ব! মিজান এমন করে না কখনো। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে প্রচন্ড রাগ চেপে বসলো। আমি মিজানের পেছনে ছুটে গেলাম।

খেলাধুলো করে আমার শরীর তখন বেশ পোক্ত, মিজান আমার সাথে দৌড়ে পারলো না। আমি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেললাম ওকে তারপর ধুমসে এলোপাথাড়ি মারলাম। কিছুক্ষন পর সবাই ছুটে এসে আমাকে টেনে সরালো। জানিনা কি জেদ কাজ করছিলো মাথার ভেতর। হুশ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

:খুব খারাপ কাজ করেছেন।

:হুম, বুঝতে পেরেছিলাম ক্ষনিকের উত্তেজনায় খুব খারাপ কাজ করেছি। মিজানের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিলো, এক চোখে কালশিটে।

:তারপর কী হলো?

:বাবা ভীষণ রাগ করলেন। মা কাঁদলেন। মিজানকে ডাক্তারের কাছ থেকে প্লাস্টার করে আনা হলো, ওর হাত মচকেছিলো। রাতে মিজান আমার ঘরে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, ‘ভাইয়া তুই বল নিয়ে এত ছোটাছুটি করছিলি কেন? বলটা পায়ে লাথি দেয়ার চেয়ে হাতে নিয়ে দৌড় দিলে খেলাটা তাড়াতড়ি শেষ হয়।’

:দিস ইজ সো স্যাড!

:হুম, কিন্তু তখন স্যাড মনে হয়নি। মনে হয়েছে, আমি তো একটা স্বাভাবিক ভাই পেতে পারতাম, আমার ভাগ্যেই কেন এমন হলো? অবশ্য এর পরে বাবা আমাকে ঢাকায় ফুপুর বাসায় পাঠিয়ে দিলেন । ফুপুর বাসার পাশের স্কুলে আবার ক্লাস নাইন থেকে শুরু করলাম। বাবা মায়ের কাছ থেকে দূরে আসা, নতুন পরিবেশ আর স্কুলের প্রতিকূলতা- এসব কিছুর জন্য মিজানকেই দায়ী মনে হতে লাগলো।

:আপনি তো ভীষণ অমানবিক!

:হ্যা, তা বলতে পারেন। আমার অভিমান এতই গভীর ছিল যে পরের দুই বছর ঈদেও বাড়ি যায়নি। নামকরা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাড়ি গেলাম।

:ততদিনে রাগ কমেছে?

:হ্যা, কিছুটা। একটু বিবেক বুদ্ধি হয়েছিলো। মিজানকে এতদিন পর জড়িয়ে ধরলাম। অবাক হবেন শুনলে, জন্মের সময় আমার চেয়ে অপুষ্ট ছেলেটা তখন আমার চেয়ে লম্বা, সুদর্শন। শুধু চোখ দুটোতে ভোঁতা নির্বুদ্ধিতা স্পষ্ট। হাসির অস্বাভিকতাও লুকাতে পারেনি, তোতলামিও যায়নি। যে কেউ এক নজর দেখলেই বুঝবে, ও প্রতিবন্ধী। দুবার মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেনি। বাবা মা ওর পড়ালেখার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

এতদিন পর বাড়ি ফেরার পর মায়ের হাতের রান্না খেতে বসলাম যখন, মিজান মাছের মাথাটার আবদার করলো। মিথ্যা বলবো না, চেপে রাখা ক্ষোভ যেনো বুকের ভেতরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম এই ভেবে যে , আমি যে অবস্থানে আছি, মিজান কখনোই আসতে পারবে না।

:সত্যি কি তাই হয়েছিলো ?

:হ্যা। আমি ইন্টারমিডিয়েটে খুব ভালো রেজাল্ট করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স করার সুযোগ পেলাম। আর মিজান বাড়িতেই থাকতো, বাবা মায়ের ফাইফরমাশ খাটা আর ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তার বিশেষ কোনো কাজ ছিলো না। বাড়ি ফিরলে ও আমাকে দেখে উচ্ছসিত হতো, বাজার করে আনতো। আমার সাথে বিশেষ কোনো আলাপ করতো না। ওর আলাপের বিষয় সেই ছোট্ট মফস্বলের গন্ডির ভেতর আটকে থাকতো আর আমি তখন শেক্সপিয়ার, জন কিট্স্, রবার্ট ফ্রস্ট, জেন অস্টেন কপচাচ্ছি।

দুবছর পরে একদিন বাবা ফোনে জানালেন নিজের পরিচিতির জোরে মিজানকে রাশিয়াতে কোন একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। দু’সপ্তাহ পরেই মিজান চলে যাবে। আমি পারলে যেন ওকে বিদায় দিতে আসি। খবরটা শুনে যথেষ্ট চমকে গেছি। যে প্রতিবন্ধী ছেলে যে ছোট্ট মফস্বলের বাইরে কখনো পা রাখেনি, সে রাশিয়া গিয়ে কী করবে?

বাবা বললেন, “ছেলেটার একটা গতি তো করতে হবে, আমার বয়স হয়েছে। কোনদিন ঠুস করে মরে যাই তখন ও কী করবে? তোর ঘাড়ে চড়বে? তুই যে সেটা কখনোই হতে দিবি না, আমি জানি। তাই ওর একটা ব্যবস্থা করছি। রাশিয়ার ইয়াকুশিয়া নাম একটা জায়গায় মীর বলে একটা ডায়মন্ড খনিতে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের কিছু শ্রমিক নেয়া হচ্ছে। মিজানকে ঢুকিয়ে দিলাম। এটা জানার পর থেকে তোর মা বিছানায় পড়ে কাঁদছে। তোর মা বলছে, মিজানের খুব কষ্ট হবে, কী খাবে, কোথায় থাকবে, হয়তো কাঁদবে, ফিরে আসতে চাইবে,,,,,,,,,,” বাবার কণ্ঠ বুজে আসে, আমি বুঝতে পারি, বাবাও কাঁদছে।

আমার ইয়ার ফাইনাল। বলে দিলাম, আসতে পারবো না। পারিবারিক ড্রামা দেখার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না। পূর্ণ মনোযোগ তখন পড়ালেখায়। মিজান চলে যাওয়ার পর বাবা আগের চেয়ে বেশি ফোন করতেন আমাকে, ঘুরে ফিরে সেই মিজানের গল্প। ওখানে গিয়ে কী করছে, কেমন কষ্ট হচ্ছে -সব বলতেন। অর্ধেক শুনতাম, অর্ধেক শোনার ভান করতাম। ঢাকায় একা একা আমি কিভাবে জীবন যাপন করছি, দুইটা টিউশনি থেকে কেমন করে খরচ চালাচ্ছি, কী খাচ্ছি, ফুপুর বাসায় কত অপমানের মুখোমুখি হচ্ছি, কিছুই নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না।

মিজান রাশিয়া যাওয়ার এক বছর পরেই বাবা মারা গেলেন। আমি তখন মাস্টার্স শুরু করেছি মাত্র। অনার্স দারুন রেজাল্ট ছিলো, মাস্টার্সেও ভালো করবো বলে বিশ্বাস। মাকে দেখতে প্রায়ই বাড়ি যেতাম। মিজানের খবর শুনতাম মায়ের কাছ থেকে। ও নাকি ভালোই কাজ করছে। মানিয়ে নিয়েছে রাশিয়ার ভয়াল শৈত্যের সাথে। বাবার মৃত্যু সংবাদ তাকে দেয়া হয়নি। এতই বোকা সে এতদিন বাবার সাথে ফোনে কথা হয়না ওর অথচ কিছুই সন্দেহ করেনি!

: মিজান নেই, বাড়িতে আপনি মায়ের মনোযোগের একমাত্র মানুষ। বিষয়টা নিশ্চই ইনজয় করতেন।

:হ্যা , তা করতাম। অবশ্য ততদিনে ম্যাচিউরিটি এসেছে। আগের ব্যবহারের জন্য মাঝে মাঝে লজ্জিত বোধও করতাম। ঠিক করলাম, এবার মিজান ফিরলে ওর সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করবো, ওর সাথে ভাব করবো।

:বাহ্! খুব ভালো চিন্তা।

:চিন্তা তো ভালো। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। মাস্টার্স করে ইউনিভার্সিটিতেই জুনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগ দিলাম। নিজের জন্য কোয়ার্টার পেলাম। যখন মনে হলো অনেক কিছু অর্জন করে ফেলেছি ঠিক তখন মিজান ফিরলো।

: কী হলো? ভাইয়ের সাথে ভাব হলো না?

:মিজান আসার কিছুদিন পরেই দূর্গা পুজোর ছুটিতে বাড়ি গেলাম। মিজানকে দেখে ধাক্কার মতো অনুভব করলাম। অসম্ভব সুদর্শন একজন যুবক আমার সামনে! গায়ে দামি শার্ট, ভুরভুর করে আসছে দামি পারফিউমের গন্ধ। হাল ফ্যাশনে চুল কাটা, হাতে দামি ঘড়ি। আমাকে দেখে আগের মতোই জড়িয়ে ধরলো। আন্তরিক ভাবে বললো, “কেমন আছিস ভাইয়া? বাবা মরে গেছে, জানিস?”

ওর তোতলামি নেই! বেশ একটা চটপটে আবরণে আগের বোকা বোকা চেহারা হারিয়ে গেছে। খুব ভালো করে না লক্ষ্য না করলে ওর প্রতিবন্ধী রূপটা দেখা যায় না। আমি সদ্য ইউনিভার্সিটির চাকরিতে যোগ দেয়া ছাপোষা চেহারার মানুষ, আর গাধা মিজান কেমন বিদেশী ছেলের মতো চেহারা নিয়ে আমার সামনে বসে আছে।

বিস্ময় কাটিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, “এতো বদলে গেলি কী করে? তোকে তো চেনাই যায় না।”

মিজান মিটমিট হেসে বললো, “তোকে বলবো, সব বলবো। আমি একটা আশ্চর্য জিনিস খুঁজে পেয়েছি, ম্যাজিক, ম্যাজিক।”

(চলবে)

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share