#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১৪
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
রাত ১০ টা বেজে গেল। অথচ এখনও রাহাত ভাইয়ের কোনো হদিস নেই। কল্প বিছানায় ঘুমুচ্ছে। খুব নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তাকে। হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে। পিচ্চি পিচ্চি হাত! তিন বছর পূর্ণ হয়েছে আমার পিচ্চিটার।
সবাই খাওয়ার সময় খাবার গরম করেছিলাম। খালামণি পইপই করে বললেন যে তিনিই করবেন। আগে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নিই; তারপর না হয় খালামণি একেবারে বিশ্রাম নিবেন। আমি শুনলাম না। অবশ্য খাবার সময় ও যে আমাকে তীর্যক মন্তব্য শুনতে হয়নি তা কিন্তু নয়! রাইমা ভাবি বলেছিলেন যে আমি না-কি এসব লোক দেখানো কাজ করি। তিনি নিজে না-কি এর চাইতেও অনেক বেশি কাজ করেছেন, অনেক বেশি খেটেছেন। রাইমা ভাবির এসব কথা শুনে খালামণি বলেছিলেন যে কে মন থেকে কাজ করে আর কে লোক দেখানো কাজ করে তা তিনি খুব ভালো করে জানেন। অবশ্য তা শুনেও যদি তিনি শান্ত হতেন! সাজিদ ভাইয়া শেষমেশ এসব সহ্য করতে না পেরে খাবার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। রাইমা ভাবিও তার পর পরই চলে গেলেন। তবে খাবার শেষ করে।
হঠাৎ ভয়ংকর বজ্রপাতের শব্দে আমি আঁতকে উঠলাম। প্রবলভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। জানলার কপাটগুলো প্রচণ্ড শব্দ করে বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। আর তাতেই হুস হুস করে বাতাস ঘরের ভিতরে প্রবেশ করছে। বিদ্যুতের চমকে হঠাৎ হঠাৎ ঘর আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। আমি খুব সন্তর্পণে জানলার পাশে গিয়ে কপাটগুলো আটকে দিয়ে পর্দা টেনে দিলাম।
রাহাত ভাই এখনও ফিরছেন না। আমি মোবাইলটা নিয়ে তার নাম্বারে ডায়াল করলাম । নাম্বার বন্ধ। আমার খুব চিন্তা হতে লাগল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি । আর এখনও রাহাত ভাই আসছে না।
আবার কল করলাম। নাম্বার বন্ধ । তারপরেও কল করতে থাকলাম। আসলে দুশ্চিন্তায় পড়লে মানুষ কী করে সে নিজেও জানে না! আমিও হয়তো তেমনই করছি!
খালামণি কিছুক্ষণ আগে এক ফাঁকে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে গেলেন রাহাত ভাই ফিরেছেন কি না! আমি বললাম কাজ আছে তাই ফিরতে আজ অনেক দেরি হবে। যদিও রাহাত ভাই আমাকে কিছুই বলে যাননি। তার উপর আমার উপর রাগ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু খালামণিকে এসব বললাম না। উনি দুঃশ্চিন্তা করবেন। তারপর আবার অসুখে পড়বেন । এমনিতেও কত অশান্তিই না এই ঘরে চলছে। তাই অগত্যা আমাকে মিথ্যা বলতে হলো ।
দরজার করাঘাত শুনতেই আমি সচকিত হলাম। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ১১ টা বেজে গেছে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। দরজা খুলতেই দেখলাম রাহাত ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। তবে কেমন যেন লাগছে তাকে। একেবারে কাক ভেজা হয়ে এসেছেন। আমি দরজা খুলতেই আমাকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেলেন। আমি মেইন দরজা আটকিয়ে দ্রুত পায়ে তাকে অনুসরণ করলাম। কাবার্ড থেকে তার কাপড় চোপড় বের করে রাখলাম। ততক্ষণে অবশ্য রাহাত ভাই তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছেন।
ফ্রেশ হয়ে মাত্রই বিছানায় বসে প্রথমে কল্পের কপালে একটা চুমু খেলেন। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরেই শুয়ে পড়লেন। আমার সাথে একটা কথাও বললেন না। আমি নিজে থেকেই বললাম, ‘আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?’
রাহাত ভাই আমার দিকে তাকালেনও না। তিনি শুয়ে রইলেন। আমি আবার বললাম, ‘ কথা বলছেন না কেন?’
এবার রাহাত ভাই উঠে বসলেন। বললেন, ‘তুমি আমার সাথে কথা বলতে পছন্দ করো না। তাই এখন থেকে কথা না বলার অভ্যাস করছি।’
আমি অবাক হয়ে অবিশ্বাসের সুরে বললাম, ‘ আমি আপনার সাথে কথা বলতে পছন্দ করি না। সেটা কে বলল?’
‘কাউকে বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বুঝতে পারি। এই সামান্য বিষয় বুঝার জন্য অভিজ্ঞ হতে হয় না।’ রাহাত ভাই নির্বিকারভাবে বললেন।
আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমার সাথে কথা বলতে হবে না। খাবার খেতে আসেন। আমি খাবার গরম করে দিচ্ছি।’
‘কোনো দরকার নেই। আমি খাবার খেয়ে এসেছি। আমার জন্য তোমার কোনো কিছু করার প্রয়োজন নেই। আর এখন থেকে আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। যদিও আমি জানি তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো না। তারপরেও বললাম। তুমি তোমার অতীত থেকে মুক্তি পেলে তো তবে কিছু করবে!’
আমি ভীষণ অবাক হলাম রাহাত ভাইয়ের কথায় । আমার খুব রাগও হলো। আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। এটা আমার ব্যর্থতা । তার জন্য আমি কি চেষ্টা করছি না! আমি তো চেষ্ঠা করছি। তারপরেও পারছি না। মানুষ কি মুহূর্তেই নিজেকে বদলাতে পারে? পারে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়।
রাহাত ভাই ঘুমাচ্ছেন কল্পকে জড়িয়ে ধরে। আমি টেবিলের ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা নিয়ে ব্যালকনিতে রাখা বেতের চেয়ারটাতে বসলাম। ডায়েরিটা এই পর্যন্ত অনেকবার খুলার চেষ্টা করেছি। পারিনি। প্রতিবার উপরের লেখাটাতে চোখ আটকে যেত আর মস্তিষ্কে দাপিয়ে বেড়ায় অতীতের স্মৃতি । ডায়েরির উপরে গোটা গোটা কালো অক্ষরে লেখা “বিস্মৃতির অন্তরালে”। এটা নিশানের ডায়েরি । খুব যত্ন করে রেখে দিয়ছিল সে। আমি আবারও ডায়েরির উপরের লেখাটাতে হাত বুলালাম।
অনেক অনেক স্মৃতির কথা লেখা আছে এই ডায়েরির বুকের মাঝে। আমি জানি সেটা। ডায়েরিটা হাতে নিলেই নিশানের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু মনে পড়লেই বা কী! সে তো আমার কাছ থেকে বহুদূরে সরে গেছে। হঠাৎ আমার প্রচণ্ড কান্না পেল। প্রচণ্ড! বোধহয় তা আটকেই রাখতে পারব না। তাই কি আর করার! চোখ থেকে অশ্রুধারা টপ টপ করে ঝরতে লাগল।
_____________________
‘স্মৃতি , জলদি রেডি হয়ে নাও।’ রাহাত ভাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন।
আমি তখন কল্পকে খাবার খাওয়াচ্ছিলাম। বললাম, ‘ কোথায় যাব?’
‘গেলেই দেখতে পাবে। এখন কোনো প্রশ্ন না। দশ মিনিট দিলাম তোমাকে। এর মধ্যেই ঝটপট রেডি হয়ে নিবে।’
‘পাপা, আমিও যাব ।’ কল্প আহ্লাদি গলায় বলল।
‘রাহাত ভাই বললেন, ‘তুমি গেলে তো দাদু একা হয়ে যাবে । দাদুর কাছ থেকে গল্প ও শুনতে পারবে না।’ কল্পকে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, রাহাত ভাই।
কল্প ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ‘ গল্প পরে শুনব পাপা। আমি বেড়াতে যাব।’
‘আমরা তো বেড়াতে যাচ্ছি না, কল্প। আমরা যাচ্ছি ডাক্তারের কাছে। তাই তো তোমাকে নিচ্ছি না।’
‘ডাক্তার!’ কল্প চোখে বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘ তাহলে আমি যাব না।’
‘কেন? একটু আগেই তো তুমি যাবে বলছিলে। এখন কেন যাবে না বলছ?’
‘ডাক্তারকে ভালো লাগে না পাপা।’ কল্প বিরক্তি নিয়ে বলল।
‘কী!’ রাহাত ভাই অবাক হয়ে বললেন, ‘ডাক্তারকে ভালো লাগে না তোমার?’
‘হ্যাঁ, পাপা। ভালো লাগে না তো।’
আমি বললাম, ‘তাহলে তোমার পাপাকেও কি ভালো লাগে না?’
‘পাপাকে ভালো লাগবে না কেন!’ অবাক হয়ে জানতে চাইল কল্প।
‘তোমার পাপাও তো ডাক্তার।’ আমি কল্পকে জড়িয়ে ধরে বললাম।
কল্প কপালে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে মনে করার ভঙ্গিতে কী যেন ভাবল । তারপর বলল, ‘ পাপা তো ভালো ডাক্তার। তাই ভালো লাগে।’
সাথে সাথেই বিমর্ষ কণ্ঠে বলল, ‘তবে পাপা যখন চকলেট খেতে দেয় না তখন ভালো লাগে না।’
আমি আর রাহাত ভাই দুইজনই প্রায় সমস্বরে বললাম, ‘ওওও!’
কল্পকে খালামণির কাছে দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। রাহাত ভাই তার বাইক না নিয়ে রিকশা নিল। আমি এবার বুঝতে পারছি কোথায় যাচ্ছি আমরা ।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্
আগের পর্বের লিংক:
https://m.facebook.com/groups/884724498624937?view=permalink&id=953926298371423