গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব ১৩

0
1080

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব ১৩
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

আমি যখন সিরিয়াস ট্রমাতে ছিলাম তখন বলতে গেলে কল্পের দেখাশুনা করতেই পারিনি। কল্পের সমস্ত দেখাশুনা, ঠিকমতো লালন-পালন সবটাই করেছে রাহাত ভাই আর খালামণি। প্রায় ছয় মাস যাবৎ ট্রমাতে ছিলাম আমি। আর তখন আমাকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাওয়াসহ আমার দেখাশুনা করতে গিয়ে রাহাত ভাইকে অনেক ধকল পোহাতে হয়েছে। তার উপর আমি কোনোভাবেই মেনটালি স্ট্যাবল থাকতে পারতাম না। ঘুমাতে গেলে চিৎকার দিয়ে উঠে পড়তাম মাঝরাতে। তাছাড়া কয়েকবার সুইসাইড এটেম্পটও করেছিলাম। প্রতিবারই রাহাত ভাই ছিলেন। এখনও আছেন আমাকে দেখাশুনা করার জন্য, আমার কল্পকে দেখাশুনা করার জন্য । মাঝখানে কিছুই মনে রাখতে পারতাম না। শুধু ভুলে যেতাম। এইসব কিছুই আমার আবছা মনে পড়ে। পুরোপুরি মনে করতে পারি না। সবটা জেনেছি মৌনতার কাছে। কিছুটা সুস্থ হবার পর থেকে মৌন আমার কাছে একটু একটু করে গল্প করত আমার ওই দুঃসময়ের। বলত কীভাবে রাহাত ভাই একই সাথে তার নিজের জব আর আমাকে সামলিয়েছেন। ছুটিও নিতে হয়েছে প্রচুর। রাহাত ভাই একজন কার্ডিওলজিস্ট। নিজের কজের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। সেই সুবাদেও অনেক সুবিধা পাওয়া গেছে। যেমন যে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে আমাকে দেখিয়েছেন রাহাত ভাই; তিনি হচ্ছেন রাহাত ভাইয়ের বন্ধু । তাই বলতে গেলে আমাকে পেশেন্ট নয় বরং ফ্যামিলি মেম্বারদের মতোই ট্রিট করেছেন।

রাহাত ভাইয়ের বলা কথাটা পুরো বিকেল ধরে ভাবলাম। উনার বলা একটা কথাও তো মিথ্যে নয় । বরং প্রতিটি কথাতেই যুক্তি আছে। কারও জন্য কারও জীবন সত্যিই থেমে থাকে না। জীবন চলতেই থাকে নিজস্ব গতিতে, নিজ ছন্দে। তাই ভাবলাম চেষ্টা করি একবার অন্ততপক্ষে নিজেকে সহজ স্বাভাবিক করার। আজ থেকেই না হয় তা শুরু হোক।

সন্ধ্যার দিকে বাসার সবার জন্য নাশতা তৈরী করতে কিচেনে গেলাম। কল্প খালামণির সাথেই আছে। এতদিন তো আমাকে কিছুই করতে হয়নি। আমি নিজের মধ্যে নিজেই ছিলাম না। সবাই মিলে আমার দেখাশুনা করত। এরপর একটু সুস্থ হতেই আমি কাজ করতে চাইলেও খালামণি তো কোনোভাবেই আমাকে কোনো কাজ করতে দেননি। তবে এ নিয়ে প্রচুর কানাঘুষো হয়েছে। আমি বুঝতে পারি। এতদিন খুব একটা পাত্তা দিইনি। কিন্তু আজ রাহাত ভাইয়ের কথাগুলো নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাসার কাজগুলো অন্ততপক্ষে নিজে করার চেষ্টা করব। খালামণি না করলেও আমি জোর করেই করব। সবার জন্য কিছু হালকা নাশতা তৈরী করেছি। আর রাতের খাবারটাও তৈরী করে নিলাম।

‘ভাবি! তুমি নাশতা তৈরী করছ আজ?’ মৌনতা কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশস্ত হেসে প্রশ্ন করল।

আমি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। সে কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘স্মৃতিপু! চিকেন রোল বানিয়েছ? আমার ফেভরেট। কিন্তু মা তো তোমাকে রান্না ঘরে দেখলেই বকা দিবে।’

‘দিলে দিবে। খালামণি আমাকে খুব ভালোবাসে তাই বকা দিতেই পারে। এতে আপসেট হওয়ার মতো কিছু নেই।’

‘ঢং দেখে আর বাঁচি না! মৌন তুই তো কখনো আমি রান্না করার সময় তো এত চিন্তিত হোসনি?’ রাইমা ভাবি অনেকটা মুখ ভেংচিয়ে প্রশ্ন করল।

‘ভাবি! তুমি তো খুব একটা রান্না ঘরে আসোই না। তবে আমি কীভাবে তোমার প্রতি কনসার্ন হবো বলো?’

‘হুম। আমি বুঝেছি। ও তোর খালাতো বোন তাই এত দরদ উথলে পড়ছে। আম্মাও তো খুব দরদ দেখায়। কোনো কাজ করতে দেয় না।’

আমি বুঝতে পারি না রাইমা ভাবি আমাকে কেন সহ্য করতে পারেন না! আমি কখনোই তার কোনো কাজে অনধিকার চর্চা করিনি। কল্প হবার পর থেকেই একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছি। যার পুরো অবদান রাহাত ভাইয়ের । কী পরিমাণ কষ্ট করেছে এই মানুষটা আমার জন্য তা হয়তো নিজের চোখে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতে পারতাম না। শুধু আমার দেখাশুনা নয়; আমার কল্পের দেখাশুনাও রাহাত ভাই করেছে। এর জন্যেও রাইমা ভাবি রাহাত ভাইকে কত কথা শুনিয়েছে। তাও রাহাত ভাই নিজের দায়িত্ব থেকে এক চুল পরিমাণও বিরত হননি।

মৌন আর রাইমা ভাবির ঝগড়ার শব্দে আমার ভাবনাতে ছেদ পড়লো। আমি শান্ত স্বরে রাইমা ভাবিকে বললাম, ‘ভাবি, ও ছোটো মানুষ না বুঝে বলে ফেলেছে। তুমি প্লিজ রাগ করো না।’

আমার কথা শুনে ভাবি এমনভাবে তাকালেন যেন আমাকে গিলে খাবেন। তাতেও যদি তার রাগ মেটে! রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘তোমার এসব ন্যাকামো আমাকে দেখাইতে এসো না। তোমাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। যত্তসব নাম কুড়ানোর ধান্দা!’

আমি ভাবির কথায় প্রচণ্ড অবাক হলাম। বললাম, ‘আমি নাম কুড়ানোর ধান্দা করছি কে বলল ?’

রাইমা ভাবি যেন আমার প্রশ্ন শুনে আরও বেশি তেঁতে উঠলেন। বললেন, ‘এই যে তুমি সংসারে কিছুই করো না। রাহাত পারলে চব্বিশ ঘন্টা তোমার সেবা করত, আম্মার কথা আর কি বলব! সবাই তোমার জন্য আর তোমার ছেলের জন্য করে অথচ তারপরেও তোমার প্রশংসা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করে ফেলে সবাই।’

আমি হতাশ কণ্ঠে বললাম, ‘এতে আমার কি দোষ ভাবি?’

‘তোমার দোষ নেই? তুমি এই বাড়িতে আসার পর থেকেই যত্তসব ন্যাকামো শুরু হয়েছে এইখানে।’

আমি ভেবে পেলাম না , আমার দোষটা কোথায়! রাইমা ভাবি যে আমাকে সহ্য করতে পারে না, আমাকে যে সে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চায় তা আমি খুব ভালো করেই জানি। তবে কেন? এর পেছনে কারণটা কি তা ঠিক বুঝতে পারছি না!

‘কী হয়েছে? এমন চেঁচামেচি শুরু করেছ কেন তুমি রাইমা?’ খালামণি হন্তদন্ত হয়ে এসেই প্রশ্ন করলেন রাইমা ভাবিকে।

রাইমা ভাবি খালামণির প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। সে ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে পড়ল।

মৌনতা বলল, ‘আম্মু! তুমি যে কি দেখে রাইমা ভাবিকে সাজিদ ভাইয়ের বউ হিসেবে পছন্দ করলে আমি এখনো বুঝতে পারি না! এত উগ্র কেন ভাবি!’

আমি মৌনতাকে বললাম, ‘বড়দের সম্পর্কে এভাবে বলতে নেই , মৌন। ভাবি নিশ্চয়ই কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট।’

‘তোমাকে এত কথা বলে গেল আর তুমি তারপরেও উনার পক্ষে কথা বলছ?’

খালামণি মৌনকে একটা ধমক দিলেন। বললেন, ‘ মৌন! তুই তোর রুমে যা। স্মৃতির সাথে আমি কথা বলছি ।’

মৌন বার কয়েক আমার আর খালামণির দিকে তাকাল। তারপর মুখ ভার করে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল।

খালামণি আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তুই চাইলে রাহাতের সাথে কোয়ার্টারে উঠতে পারিস। প্রতিদিনের এসব ঘ্যানর ঘ্যানর তোর নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। আমার বোনটা তো আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট হবে রে, তোর এখানে এসেও কোনো শান্তি হচ্ছে না। অথচ আমি তোর বাবাকে কথা দিয়েছিলাম যে তোর কোনো কষ্ট হতে দিব না। আজ রাহাত বাসায় ফিরলেই বলব যাতে তোরা আলাদা থাকিস। প্রতিদিনের এসব যন্ত্রণা আমার আর সহ্য হয় না।’ এটুকু বলেই খালামণি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। খালামণির মুখে বাবার কথা শুনে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে । চোখের দেয়ালে তৎক্ষনাত অশ্রুরা ভিড় করল। মুহূর্ত অপেক্ষা গড়িয়ে পড়ার। এতদিন আমার মা ছিল না আর এখন তো বাবাও নেই। বাবাও পাড়ি জমিয়েছেন এক অনন্ত অসীম ঠিকানায় । অথচ বাবার সাথের স্মৃতিগুলো এখনো কী জীবন্ত মনে হয়! আমি খুব তাড়াতাড়ি আমার প্রিয় দুজন মানুষকে হারিয়ে ফেললাম । এই কষ্ট কি এত সহজে ভুলা যায়! আমি পারিনি, এমনকি এখনও পারছি না।

চলবে… ইন শা আল্লাহ্

আগের পর্বের লিংক:

https://m.facebook.com/groups/884724498624937?view=permalink&id=951141515316568

বি.দ্র. আমি খুব অসুস্থ তাই গল্প দিতে ইরেগুলার হয়ে গেলাম। এই পর্ব লিখতে খুব কষ্ট হয়েছে। পরের পর্ব লেখা হলে তবেই দিব।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে