গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব-১৮
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
শিহরণ চেয়ার থেকে উঠে ধীর পায়ে চলে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর আবার তার ড্যাডির পাশের চেয়ারটাতে গিয়ে বসল। আবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল । তারপর ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টিতে ।
সাব্বির আহমেদ ছেলের কার্যবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি সবটা বুঝতে পারছেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে ছেলে তার বন্ধুর নাম করে নিজের সম্পর্কেই প্রশ্ন করেছে । তিনিও ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। তাই এখানে আসলে না বুঝার তো কিছু নেই। শিহরণ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল বহ্নি ব্যাডমিন্টন খেলছে তার বন্ধুদের সাথে। রিয়া, সাইমা এই দুইবোন শিহরণদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে । সাইমা বহ্নির সমবয়সী। রিয়া এবার ক্লাস ফাইভে পড়ছে। নিচ থেকেই শিহরণকে দেখেই বহ্নি গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,’ব্রো, কাম ফাস্ট। ইউ উইল লাভ ইট।’
বহ্নির বলা বাক্যের মধ্যে শিহরণ একটা শব্দই পিক করেছে। আর সেটা হলো ‘লাভ’। ভালোবাসা কী? শিহরণ জানে না। এর অর্থ শিহরণের কাছে পুরোই অজ্ঞাত । শিহরণ আবার বাবার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। সাব্বির আহমেদ পূর্ণব্যাদিত নেত্রে তাকালেন শিহরণের দিকে। সহাস্যে প্রশ্ন করলেন,’তুমি কি আরো কিছু জানতে চাইছ?’
শিহরণ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,’ড্যাডি, ভালোবাসা কী?’ তারপর আবার নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল,’ মানে আমার বন্ধু এটার মানেটাও জানতে চেয়েছে!’
সাব্বির আহমেদ মুচকি হাসলেন। যে হাসির পিছনে সমস্ত ঘটনা বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান লুকিয়ে আছে। তিনি সহসা বললেন,’ ভালোবাসা হলো একটা অনুভূতি। যার সমস্তটা জুড়ে ভালোলাগা থাকে। আর এই ভালোলাগার সামনে ভালোবাসার মানুষের সমস্ত ত্রুটি, বিচ্যুতি ফিকে হয়ে যায় । কেমন করে যেন ভালোবাসার মানুষটার দোষগুলোকেও ভালো লাগতে শুরু করে। আর সব থেকে বড় যে ব্যাপার সেটা হলো, ভালোবাসার ওই নির্দিষ্ট মানুষটাকে দেখলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। আর হৃদয়ে বইতে থাকে প্রশান্তির এক অমিয় ধারা। যার খোঁজ চাইলেই পাওয়া যায় না। সেটা হৃদয় দিয়ে অর্জন করতে হয়।’
বাবার কাছ থেকে ভালোবাসার সংজ্ঞার্থ জানার পর শিহরণের ব্যকুলতা আরো বেড়ে গেছে। সে এই বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে অনেক। সে এখন বুঝতে পারছে সে ছোঁয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর এটাই ভালোবাসা। অন্ততপক্ষে তার বাবার দেওয়া সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী তো এটাই।
কিন্তু সে ছোঁয়াকে ভালোবাসতে পারে না। তাই সে এভাবে তার প্রতি দুর্বল ও হতে পারে না। কারণ সে জানে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু অতল ছোঁয়াকে ভালোবাসে। তাই সে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল সে ছোঁয়াকে ইগনোর করবে। কিন্তু এই মেয়েটাকে কাছ থেকে জানার পর আসলে ইগনোর করাটাও মুশকিল। আর শিহরণ এই মেয়েটার জন্য কষ্ট পায় । বুকের মধ্যে কোথায় যেন চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে! যে ব্যথা তাকে দুর্বল করে দেয় । তাই সে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল সে ছোঁয়াকে শুধুই বন্ধু ভাববে। তার বেশি কিছু নয়। বন্ধু হিসেবে পাশে থাকবে। কিন্তু এই বন্ধু ভাবতে পারাটা তার জন্য ভয়ংকর রকমের কঠিন। কারণ সে তার বাবার কাছ থেকে ভালোবাসার মানে বুঝে নিয়েছে । অন্তর দিয়ে অনুভব করেছে সেই অনুভূতিগুলো। তারমানে এখন তার কাছে স্পষ্ট যে সেও ভালোবাসে ছোঁয়াকে। কিন্তু ছোঁয়া কি তাকে ভালোবাসে? নাহ্, ছোঁয়া ভালোবাসলেও সে তাকে ভালোবাসবে না। আবার ভালো না বাসলেও ভালোবাসবে না। কারণ এতে অতল কষ্ট পাবে।
শিহরণ ভাবছে অতলের প্রস্তাবে যদি ছোঁয়া রাজী হয় তাতে শিহরণ কষ্ট পাবে না। একদম না। ছোঁয়ার প্রতি তার অনুভূতিগুলোকে সে আর পাত্তা দিবে না। দূর থেকেও তো ভালোবাসা যায় । শিহরণ না হয় বড়জোর সেটাই করবে। তবে সে শতভাগ সন্দিহান–এই কঠিন কাজটি তার দ্বারা সম্ভব হবে কি না সে বিষয়ে । কারণ সে ভালোবাসা নিয়ে ভীষণ পজেজিভ। সে ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কাউকে সহ্যই করতে পারে না। অতলের মতো সহনশক্তি তার নেই। সে অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে। প্রটেকটিভ মাইন্ডের হলে যা হয় আরকি! নিজেকে কন্ট্রোল করা হয়ে পড়ে দুর্বিসহ। শিহরণ এমনই এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন ।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
ছোঁয়ার অবস্থা ভালো না। তার শরীরটা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। হাত, বাহু আর সমস্ত পিঠ জুড়ে বেতের আঘাতের মোটা মোটা দাগ হয়ে আছে। পিঠের আঘাত গুলো সে দেখতে পাচ্ছে না । কিন্তু হাতের সেই রক্তাক্ত মোটা দাগগুলো দেখলেই সে কেঁপে উঠে। ভিতর থেকে কান্নারা গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে যায় । তার গায়ের রং ফর্সা না হওয়া সত্ত্বেও তার শরীরের ক্ষত স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে ।
আজ দুদিন ধরে সে স্কুলে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেতেও পারবে না। ছোঁয়া স্কুলে না যাওয়ার ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না তিনজন মানুষ। অতল, শিহরণ আর মায়া। অতলের তো কিছু করার নেই। সে ছোঁয়ার বাসা চিনে না। আর বাসা চিনলেই বা কী? অতলের বাবা আর মা দুজনেই হয়তো মনে করে সে একটা রোবট। অন্ততপক্ষে অতলের তাই মনে হয়। যার কাজ হলো শুধু পড়াশুনা করা। আর চার্জ ফুরিয়ে গেলে চার্জ করে নেওয়া। প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে প্রথমেই সে দৃষ্টির শূন্যতায় ছোঁয়াকে খুঁজে । ছোঁয়া আসেনি। আসবে না।তারপরেও খুঁজতে থাকে। হয়তো এটাই ভালোবাসা। তবে সব ভালোবাসা কি পূর্ণতা পায়? কিছু ভালোবাসা, ভালোবাসা না হয়েও পূর্ণতা পায়। বস্তুত তা মোহের এক অনন্য রূপ । আর মোহ ফুরালেই সমস্ত আকর্ষণ শেষ হয়ে যায় । তারপর যা আপাতদৃষ্টিতে পূর্ণতার এক অনন্য রূপ ভেবেছিল আশেপাশের মানুষ । তাদের চোখের সামনে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় পূর্ণতার ছলে মোহের ছড়াছড়ির। তখন সকলে মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেই ঘটনার রটনা প্রস্তুত করতে। এটাই মানব সমাজ! এমনই হয়ে থাকে সমাজের অধিকাংশ মানুষের বৈশিষ্ট্য ! আর কিছু থাকে প্রকৃত ভালোবাসা। যেই ভালোবাসার কোনো অংশ জুড়ে নেই কোনো মোহ। আছে শুধু বিশুদ্ধতম ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবেশ। তবুও তা পূর্ণতা পায় না। তাই পূর্ণতা দিয়ে ভালোবাসা মাপা যায় না। কিছু মানুষ দূর থেকেও ভালোবাসতে পারে। সেই মানুষগুলোর ভালোবাসার জোর বর্ণনাতীত। আর কিছু মানুষের ভালোবাসায় যেমন থাকে বিশুদ্ধতা ঠিক তেমনি তা পূর্ণতা ও পায়। আর তাদের ভালোবাসায় কখনো খামতি লক্ষ্য করা যায় না। তাদের ভালোবাসা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে।
ছোঁয়া যে দুদিন আসেনি তার প্রত্যেকদিন ছোঁয়ার জন্য কিছু ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল শিহরণ। ছোঁয়া আসেনি তাই তার নিজেরও খাওয়া হয়নি। তবে স্যারের দেয়া কাজ সে কোনো প্রকার বিরক্তি ব্যতিরেকে করেছে। কারণ সে তার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। বন্ধু হিসেবে যতটুকু পারা যায় ততটুকু সাহায্য, সহযোগিতা সে করতেই পারে।
বিকেলের দিকে মায়া ছোঁয়াকে দেখতে এলো। তখনো ছোঁয়া কিচেনে কাজ করছিল। ফাহমিদা বেগম, অহনা আর হিয়া বেরিয়েছে কোনো একটা ইনভাইটেশন এটেন্ড করতে। তাই আজ পুরো ঘর খালি। তবুও ছোঁয়ার অবকাশ নেই। আজ ওরা বাইরে থেকেই খেয়ে আসবে। কিন্তু ছোঁয়াকে বাসায়’ই খেতে হবে । তাই নিজের জন্য হালকা কিছু খাবার বানাচ্ছিল। আর অন্যান্য কাজ করছিল। মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে কয়েকবার বেল বাজাল। ছোঁয়া প্রথম বেলটাই শুনতে পেয়েছে। কিন্তু খুব দ্রুত দৌঁড়ে আসবে এমন শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। তাই সে খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে । আর এদিকে মায়ার খুব টেনশন তো হচ্ছেই। পাশাপাশি রাগ ও হচ্ছে। কারো ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর কাজগুলোর মধ্যে একটি।
খট করে দরজা খুলাতে মায়া মুখ তুলে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। আর তাকাতেই সে ভীষণভাবে আহত হল। কী বিধ্বস্ত চেহারা, কী জীর্ণ শরীর হয়ে গিয়েছে তার! মায়ার মনে হলো ছোঁয়া এখনই পড়ে যাবে। সে দ্রুত ধরলো তাকে। তারপর সোফায় নিয়ে গিয়ে বসাল। মায়ার চোখে মুখে প্রচণ্ড ক্রোধ, চোখগুলো থেকে যেন আগুন ঝড়ে পড়ছে। সে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,’তোকে কী আবার মেরেছে, ওই জল্লাদ মহিলাটা?’
ছোঁয়ার চোখ ছলছল করে উঠল। একটু ভরসা করা যায় এমন মানুষগুলো যখন কষ্টের কথা জিজ্ঞেস করে তখন মন আবেগী হয়ে উঠে আর চোখের বাঁধ ভাঙ্গে। ছোঁয়ার ক্ষেত্রে তেমনটাই হচ্ছে। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু ফোটা অশ্রু।
তারপরেও ছোঁয়া সে বিষয়ে তেমন কিছু বলল না। সে অসহায় মুখ করে বলল,’আমার একটা কাজ করতে পারবি?’
‘কি কাজ? বল।’ মায়া সতর্কতার সাথে বলল।
‘একটা চিঠি পৌঁছে দিতে হবে অতলকে। পারবি?’ ছোঁয়া কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল ।
মায়া বিরক্তির সুরে বলল,’এসব এখন না ভাবলে হচ্ছে না তোর?’
‘দেখ, আমি চাইনা অতল কষ্ট পাক। অন্তত আমার জন্য কষ্ট পাক সেটা আমি চাইনা। এখন তুই কি পারবি দিতে?’ ছোঁয়ার কণ্ঠে অনুনয় ।
মায়া বিরস মুখে বলল,’পারব। এখানে না পারার তো কিছু নেই। কাল স্কুলে গিয়েই দিয়ে দেব।’
‘আর এমনিতেই এক সপ্তাহ পর থেকে তো সামার ভ্যাকেশন শুরু হচ্ছে । তুই কি এর মধ্যে আর স্কুলে যাবি না?’ মায়া প্রশ্ন করল ।
‘যেতে পারব না বোধহয় । অনেক কাজ করতে হবে রে আমায়। ওরা সবাই বাইরে বেড়াতে চলে যাবে। আমাকে সবকিছু গোছগাছ করে দিতে হবে। নয়তো….!’ ছোঁয়া তার কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
চলবে…..ইন শা আল্লাহ্