গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব: ০২
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
পরের দিন সকালবেলা…
ছোঁয়া ভোর সাড়ে চারটায় উঠে বাসার সমস্ত কাজ শেষ করে সাড়ে সাতটার দিকে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। আধ ঘন্টা হেঁটে তাকে স্কুলে পৌঁছাতে হয়। তাই মাঝেমধ্যেই তার দেরি হয়ে যায় । তাছাড়া ঘুম থেকে উঠে বাসার সবার জন্য নাশতা বানাতে হয়, হাড়ি পাতিল পরিষ্কার করতে হয়, ঘরদোর ঝাড়ু দিতে হয়। আরো নানান কাজ তো থাকেই। ছোঁয়া তো মাঝেমধ্যেই কাজ করতে করতে দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে চুলগুলো পর্যন্ত আঁচড়াতে পারে না। তখন হাতের আঙ্গুলকে চিরুনি বানিয়ে উপর থেকে চুলগুলোকে একটু পরিপাটি করার ব্যর্থ প্রয়াস করেই স্কুলে চলে যায় ।
আজ থেকে একটা মাস পর্যন্ত তাকে এভাবেই সাড়ে চারটার দিকে উঠতে হবে। এমনিতেই এতদিন প্রায় সময় দেরি হয়ে যেতো। ঘরের কাজ না করলে যে তার মা তাকে খাবার’ই দিবে না। পড়ালেখার খরচের অর্ধেকটা তাকেই যোগাড় করতে হয়। সে বিভিন্ন ধরনের ডেজার্ট তৈরি করে নিজ হাতে। তারপর সেগুলো বিভিন্ন দোকানে নিজেই সেল করে। ওখান থেকে যে টাকাটা পায় সবটাই সে পড়ালেখায় খরচ করে। মাঝে মধ্যে অবশ্য কিছু টাকা বেঁচে যায় । আর বেঁচে যাওয়া টাকাগুলো তার মাটির ব্যাংকে জমা রাখে। যাতে প্রয়োজনের সময় কাজে লাগাতে পারে।
এই ডেজার্ট তৈরীর নিয়মটা সে তার মায়ের লেখা নাশতার রেসিপির ডায়েরি থেকে শিখেছিল। তার মা খুব ভালো রাঁধুনি তো ছিলই পাশাপাশি বিভিন্ন ডেজার্ট ও নানা ধরনের কুকিজও তৈরী করতে পারত। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ছিল তার মা সব ধরনের রান্না, কুকিজ ও ডেজার্টের রেসিপি দুই তিনটা ডায়েরিতে লিখে রেখেছে। যখন তার সৎ মা তাকে দিয়ে বাসার সমস্ত কাজ করাতো আর সে স্কুল ফি দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল তখন সে ভাবলো যে, এইসব রেসিপি নিজে আয়ত্ত করে যদি বাজারে সেল দিতে পারে তবে তার আর্থিক সংকট অনেকটাই কমে যাবে। ব্যাস, সেই থেকে শুরু।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
মা মারা যাবার পর পরই বাবা একজন মহিলাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। বাবা তাকে ভালোই বাসতো। বাবার সামনে তাকে নতুন মা আদর করতো। কিন্তু বাবা ব্যবসার কাজে বাইরে গেলেই ছোঁয়া দেখতো তার নতুন মায়ের নতুন রূপ ! যা দেখে ছোঁয়ার বিস্ময়ের সীমা থাকতো না। ছোটো থেকেই সে বুঝে গিয়েছিল মানুষের থাকে নানান রূপ। আর প্রতিটা রূপের উপর থাকে এক একটা মুখোশ। প্রয়োজনের সময় শুধু মুখোশটা খুলে ফেলে। আর তখনই খালি চোখে ধরা পরে মুখোশের অন্তরালে লুকানো সেই রূপ। ছোঁয়ার এখন এসব সয়ে গেছে । প্রথম প্রথম সে শুধু বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করতো। বালিজ ভিজে যেত সেই কান্নার পানিতে। এখন আর চোখ দিয়ে খুব একটা পানি আসেই না। অন্ততপক্ষে সৎ মায়ের অত্যাচারের কারণে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে না।
তাকে প্রায় সময় মারধর করতো। তার উপর তাকে ভয় দেখাত যাতে সে এ ব্যাপারে তার বাবাকে কিছু না বলে। আর এখন তো তার সৎ মায়ের সেটাও করতে হয় না। কারণ ছোঁয়ার বাবা দুবছর আগেই মারা গেছেন। আর এখন সে পুরোদস্তুর কাজের লোকের মতোই খাঁটে। কিন্তু এতে ছোঁয়ার কোনো আক্ষেপ নেই। তার একটাই ইচ্ছা নিজের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা। তবে তার পাশাপাশি সে ডেজার্টের দোকান দেবার পরিকল্পনাও করছে। তবে সেজন্য অনেক টাকার প্রয়োজন । তাই আপাতত সে ভাবছে ছোট পরিসরে তার কুকিজ ও ডেজার্টের সেল চালু রাখবে। পরবর্তীতে যখন তার পর্যাপ্ত পরিমানে টাকা হবে তখন সে নিজের দোকান দিবে। আর তখন সে নিজের জন্য কাজ করবে, কাজ করবে কিছু অসহায় মানুষের অসহায়ত্ব ঘুচানোর জন্য।
খুব ভোরে উঠার কারণে ছোঁয়ার চোখে মুখে এখনো ঘুমের রেশ লেগে আছে। তারপরেও সে হাঁটছে । স্কুল গ্রাউন্ড পরিষ্কার করতে হবে। নয়তো এই ডিটেনশন আরো বাড়বে! তবে হঠাৎ ছোঁয়ার মনে দোলা দিয়ে গেলো শিহরণ। শিহরণের নামটার মধ্যেই অদ্ভুত এক শিহরণ আছে। মেরুদণ্ড দিয়ে সেই স্রোত বয়ে যায়! ছোঁয়া এতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত শিহরণকে। আজ থেকে এক মাস তাকে সামনে থেকে , খুব কাছ থেকে দেখতে পাবে। ভাবা যায়! এক মাস! ছোঁয়া মনে মনে জাঁদরেল স্যারকে ধন্যবাদ দিলো। অসংখ্য ধন্যবাদ । পারলে সে পৃথিবী সমান ধন্যবাদ দিবে স্যারকে।
ছোঁয়া স্কুল গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছাল ঠিক আটটার সময়। এখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। পুরো স্কুল খালি। মাঝে মধ্যে নাম না জানা কতক পাখির কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাছের চিকন ডালগুলো বাতাসে মৃদু দুলছে, কতক পাতা ঝরে পড়ছে। অদ্ভুতভাবে সবকিছু সুন্দর লাগছে তার কাছে। ছোঁয়া মনে মনে ভাবলো শিহরণ কি আসবে না? আবার ভাবলো হয়তো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। ছোঁয়া যেন নিজেকে প্রবোধ দিলো।
তারপর সে বিড়বিড় করে বলল,’তারচেয়ে বরং আমি নিজেই কাজ শুরু করে দিই।’
যেই ভাবা সেই কাজ। পুরো মাঠের এক কোণা থেকে সে কাজ শুরু করে দিয়েছে। দেখতে দেখতে পুরো মাঠটাই পরিষ্কার করে ফেলল। মাথার উপরে সূর্যটা থালার মতো দাঁড়িয়ে কিরণ দিচ্ছে । প্রখর রোদ। আর দরদর করে ঘামছে ছোঁয়া । তার স্কুল ড্রেসটা কয়েক জায়গায় ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছে । কপাল থেকে বেয়ে বেয়ে পড়ছে ঘাম। কোমড়টাও বেশ ব্যথা করছে তার। কাজ শেষে সে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। তার দৃষ্টি, তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির ন্যায় শিহরণকে খুঁজছিল। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হলো। কোথাও নেই শিহরণ। কয়েকজন ছেলেমেয়ে স্কুল গেইট দিয়ে প্রবেশ করছে। তাকে এরকম ঘেমে নেয়ে একাকার দেখে অবাক চোখে তাকাচ্ছে। ছোঁয়ার অবশ্য সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। তার চোখ শুধুই শিহরণকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
ক্লাস শেষে মোসাদ্দেক স্যার ডেকে পাঠালেন ছোঁয়া আর শিহরণকে। দু’জন স্যার এর সামনে সটান দাঁড়িয়ে আছে। স্যার গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন,’কাজ করেছ কি?’
শিহরণ ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,’জি স্যার, আমরা আপনার দেয়া কাজ খুব সুন্দরভাবে শেষ করেছি।’
ছোঁয়া তৎক্ষনাত অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো শিহরণের দিকে। কী সুন্দর করে মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে ছেলেটা! ছোঁয়া মনে মনে খুব আহত হলো। তবে মুখে কিছুই বললো না। স্যার তাদের দুজনকে যাবার অনুমতি দিয়ে বললেন যাতে তারা বাকি দিনগুলোতেও ঠিকভাবে কাজ সম্পন্ন করে নয়তো শাস্তির পরিমাণ আরো ভয়ংকর ও দ্বিগুণ হবে।
স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে শিহরণ লম্বা পা ফেলে দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। পেছন থেকে ছোঁয়া কয়েকবার ডাকলো। অথচ শিহরণ শুনেও শুনেনি। ছোঁয়াকে পাত্তাই দিলো না। ছোঁয়া বিষণ্ণ মন নিয়ে ঘরে চলে এলো।
এভাবেই পুরো এক সপ্তাহ চলে গেলো। ছোঁয়া একাই সমস্ত কাজ করেছে। শিহরণ আসেনি একটি বারের জন্যেও। কিন্তু স্যারের সামনে সুন্দর করে মিথ্যে কথা বলে। ছোঁয়ার খুব রাগ হলো শিহরণের উপর।
সপ্তম দিনের দিন ভীতু ছোঁয়া একটু সাহসিকতার পরিচয় দিলো। সে শিহরণকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল এর পর থেকে যদি শিহরণ না আসে তবে সে স্যারকে সত্যি কথাটা বলে দিবে। শিহরণ তার কথা পাত্তা দিলো না। বরঞ্চ ছোঁয়াকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সাতদিন ধরে জমতে থাকা সমস্ত অভিমানের পাহাড় খুব শক্তপোক্তভাবে নিজেদের স্থান গড়ে নিয়েছে তার মনে । সে তার কথায় অনড় থেকে দৃঢ় কণ্ঠে শিহরণকে বলল যে সত্যিটা স্যারকে এখনই বলবে। সেই মুহূর্তে শিহরণের টনক নড়লো। চকিতে সে ছোঁয়ার হাত ধরে ফেলল। তারপর অনুনয়ের সুরে বলল যে সে পরের দিন থেকে ঠিক সময়ে চলে আসবে।
পরের দিন ছোঁয়ার কাজ কম থাকায় সে চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে নিলো। চুলগুলো ঘাড়ের এক পাশে রাখল। আর ডান কাঁধে ব্যাগ। কাপালের সামনে কয়েকটা ছোটো ছোটো চুল। আজ তাকে একদম প্রিন্সেস লাগছে তবে প্রিন্সেসের পোশাকটা মিসিং। প্রিন্সেসের পোশাক পড়লেই খামতিটা মিস হয়ে যেতো।
ছোঁয়া হাঁটছে । শিহরণ তাদের গাড়িতে করেই স্কুলে যায় । তবে সাথে ড্রাইভার থাকে। সে কার চালাতে পারলেও তার মাম্মি ড্যাডি তাকে কার চালানোর অনুমতি দেয়নি। তাই সে চালাতে পারে না। তাছাড়া তার তো লাইসেন্স ও নেই। তাই ড্রাইভার থাকে সবসময় । শিহরণ কাঁচের জানালা দিয়ে খেয়াল করলো ছোঁয়াকে। আজ তাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। পাগলাটে ভাবটা আজ নেই। শিহরণ খেয়াল করলো ছোঁয়া কেমন যেনো টলছে। আবার খানিক বাদে হালকা দৌঁড়াচ্ছে। শিহরণের কাছে আবারো তাকে পাগল মনে হলো । পরক্ষণেই সে বুঝতে পারলো যে স্কুলে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্যই মেয়েটা দৌঁড়াচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার ছোয়ার কথা ভেবে খারাপ লাগলো। কিন্তু সে ছোঁয়াকে তার গাড়িতে উঠালো না। তার ছোঁয়াকে সাহায্য করা উচিত বলে মনের মধ্যে কথাটা এলেও তা খুব স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী ছিল। শিহরণ ছোঁয়ার দিক থেকে মন ডাইভার্ট করে নিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে লাগলো।
শিহরণ জানে তার মাম্মি এই মুহূর্তে মেয়েটাকে দেখলেই প্রশংসাই পঞ্চমুখ হয়ে যেতো। তাই সে রিলিফ ফিল করলো যে মাম্মি তার সাথে নেই।
চলবে….ইনশাল্লাহ্