খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
397

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

পরিবেশের সাথে থমকে গিয়েছে মেহেভীনের মস্তিষ্ক। ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মরন করতেই আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। নতুন করে মানুষটাকে জানছে মেহেভীন। মানুষটার মধ্যে তার জন্য কতটা অধিকারবোধ! সে কি কোনো ভাবে মেহেভীনকে নিজের দখলে করে নিতে চাইছে! সমস্ত ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে মনের শহরে বিষাদ খেলা করতে লাগল। সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। মুনতাসিম তার সাথে এতটা রাগান্বিত হয়ে কথা বলবে। সে নিজেই তো মুনতাসিমের অন্য রুপের সাথে পরিচিত হতে চেয়েছিল। কিন্তু তা এত তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। তা মেহভীনের ভাবনার বাহিরে ছিল।

জারিফ নিজের কক্ষে বসে ছিল। একটু পরে অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তখনই তার বোন আর্শিয়া আসে। ধরণীর বুকে এই মানুষটা নিয়ম করে তার খোঁজ খবর নেয়। মানুষটাকে যখন তার বাবা-মা বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল। তখন এই ছোট বোনটাই তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছিল। তার ভাই টা যেন কয়টা দিন ভালো থাকতে পারে। আর্শিয়া ভাইয়ের মুখশ্রীর দিকে নিষ্পলক চাহনিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। মানুষটা একটা মেয়েকে ভালোবেসে, নিজের গোটা জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিল। নিজের নাম খারাপ করল। নিজের শরীরে লাগিয়ে দিল ধ’র্ষ’ক উপাধি। তবুও মেয়েটাকে পাবার আশা ছাড়ল না। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে, একটা মেয়েটা পাবার জন্য এতটা নিকৃষ্ট হতে পারে! সমাজের দৃষ্টিতে এই ছেলেটা ভিষণ খারাপ। কিন্তু আর্শিয়ার চোখে সে একজন উন্মাদ প্রেমিক। যে কি-না নিজের প্রেয়সীকে পাবার জন্য জঘন্যতম কাজ করে বসল। হয়তো নিজের ভাই বলেই সে ভাইয়ের অন্যায় টা চোখে দেখছে না। ভালোবাসা কি জোর করে পাওয়া যায়। ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়। ভালোবাসা একটা স্নিগ্ধ পবিত্র জিনিস। জারিফ সেই পবিত্রতায় কলঙ্ক লাগাতে চেয়েছে। শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। সে পেয়েছে শাস্তি। কয়েকবছর আগে না থাকার শূন্যতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আজ সবকিছু থেকে-ও সে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। জারিফ তৈরি হয়ে মেহেভীনের ছবির সামনে গেল,

–দেখেছ মেহেভীন আমি প্রতিদিন নতুন ভাবে পুড়ছি। জানো আমার ভেতরটা পুড়তে পুড়তে ছারখার হয়ে গিয়েছে। আমার ভেতরটায় আমার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তোমার বিচরণ। তুমি আমার শিরা-উপশিরায় বসবাস কর। তুমি এভাবে আমাকে জ্বালিয়ে না দিলেও পারতে। জ্বালতে তো সবাই পারে। কিন্তু প্রেম দিতে সবাই পারে না। আমাকে প্রেম দিলে কি তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যেত। আমিও দেখতে চাই। আমি থাকতে তোমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করে। তোমার শরীরে কলঙ্ক লাগিয়ে হলে-ও আমি তোমাকে আমার করে নিব। একবার কলঙ্ক লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। এবার আর ব্যর্থ হবার কোনো সম্ভবনা রাখব না।

–ভালোবাসা একটি পবিত্র জিনিস ভাইয়া। তুমি যাকে জোর খাটিয়ে আঁকড়ে ধরতে যাবে। সে ততই তোমার থেকে দূরে সরে যাবে। তোমাদের মধ্যে তৈরি হবে গভীর দুরত্ব। আর তুমি যাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চাইবে। সে ততই আদুরে বিড়ালের মতো তোমার হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে পড়বে। শত চেষ্টা করে-ও কেউ তাকে বের করতে পারবে না। মেয়ে মানুষ অল্পতেই খুশি। তাদের বেশি কিছু লাগে না ভালোবাসা পেলে হয়ে যায় অবুঝ বাচ্চা। আর অবহেলা পেলে হয়ে যায় পাথরের ন্যায় কঠিন। একটা মেয়ের কাছে শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার সন্মান। তুমি মেহেভীন আপুর সন্মানের দিকে নজর দিয়েছিলে ভাইয়া। যে পুরুষ একটা নারীকে কলঙ্কিত করতে চায়। সেই পুরুষ অন্তত অর্ধাঙ্গ হবার যোগ্যতা রাখে না। একটা নারী একটা পুরুষকে তখনই ভালোবাসে, যখন নারীটি সেই পুরুষের কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। তুমি তো আগেই মেহেভীন আপুর সমস্ত বিশ্বাস চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছ। তারপরেও কোন বিবেকে আশা কর সে তোমার হবে।

–তাকে আমার হতেই হবে। জারিফ এতকিছু বুঝে না। মেহেভীনকে আমার ভালোবাসতে হবে না। আমি তো মেহেভীনকে ভালোবাসি। এর থেকে বড় পাওয়া মেহেভীনের কাছে কি হতে পারে। কয়েক বছর আগে আমার কিছু ছিল না। আজ আমার সব হয়েছে অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা। কি নেই আমার! সবকিছু আছে এবার আমি এবার মেহেভীনের সামনে যাব। জোর করে নিয়ে করব সংসার ও করব।

–ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চাচ্ছ! তুমি তোমার অতীত ভুলে যেও না ভাইয়া। তার আশা তুমি ছেড়ে দাও। আমি বাবা-মাকে বুঝিয়েছি। তুমি বাসায় ফিরে চলো। আর এসব বাজে কার্ম ছেড়ে দাও। আমাদের জীবনটা ভিষণ সংলিপ্ত ভাইয়া। এসব রেষারেষি বাদ দিয়ে, এই ছোট্ট জীবনটাকে আমরা সুন্দর ভাবে উপভোগ করতে পারি না ভাইয়া।

–আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা তুই। তোর জায়গায় অন্য করেই হলে, এতক্ষণে মাটির নিচে থাকত। ভাইয়াকে জ্বালাস না। বাসায় ফিরে যা আমার কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কথা গুলো বলেই জারিফ স্থান ত্যাগ করল। আর্শিয়া ভাইয়ের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? হতাশ হলো আর্শিয়া। বিষণ্ণ মন নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

প্রভাতের আলো ফুটতেই মুনতাসিমের নিদ্রা ভেঙে যায়। কাল রাতের কথা স্মরন করতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ক্রোধের বশে মেহেভীনকে সে আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। এই যন্ত্রনা সে সহ্য করবে কি করে। মুহুর্তের মধ্যে মন জুড়ে হাহাকার নেমে এল। হালকা শীতের মাঝে-ও সমস্ত শরীর ঘামছে। মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। সেই চরিত্রে আঘাত আসলে মুনতাসিম কেন জানি সহ্য করতে পারে না। এখানে মেহেভীনের কোনো দোষ নেই। দোষ তো তার নিজের সে নিজেই অন্য মেয়ের কথা মেহেভীনের সামনে বলছে। মেহেভীনের তাকে চরিত্রহীন ভাবাটা স্বাভাবিক নয় কি! অপরাধবোধ মুনতাসিম কে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। নিজের ওপরে ভিষণ রাগ হচ্ছে তার। সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নিজের হাতে প্রহার করল। আজকে উঠতেও দেরি হয়ে গিয়েছে। সে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে, না খেয়েই বাহিরে বের হলো। আজকেও মেহেভীনের বাসায় থাকার কথা। প্রতিদিন সকালে মেহেভীন হাঁটতে বের হয়। সে মেহেভীনের জন্য অপেক্ষা করছে। মেহেভীন মুনতাসিমকে দেখেই গৃহে চলে গেল। সে মনে মনে পণ করল। সে মুনতাসিমের সামনে যাবে না। মানুষটা তাকে বুঝিয়ে বললেই সে বুঝত। আচমকা এমন বিশ্রী ব্যবহার করার কি দরকার ছিল! মানুষটাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়ে গিয়েছে। সেজন্য মানুষটা মস্তকে উঠে গিয়েছে। তাকে কিভাবে মস্তক থেকে নামাতে হয়৷ সেটা আমার ভালো মতোই জানা আছে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। সূর্যমামা তার কিরণ চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রৌদ্রের প্রখরতা বেড়ে চলেছে। উত্তপ্ত হতে শুরু করে মস্তক। মুনতাসিম হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল নয়টা বাজে। সে ধরেই নিল মেহেভীন আজ আসবে না৷ হতাশ হয়ে ফিরে গেল নিজ গৃহে। মুনতাসিম বের হতেই মেহেভীন তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেল। আজকে তার অফিসের অনেক কাজ আছে। প্রচুর দলিল এসে জমা হয়েছে। নিজের কাছেই নিজেকে বিরক্ত লাগছে মেহেভীনের৷ সে একটা পুরুষ মানুষের জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে, চোরের মতো গৃহ থেকে বের হচ্ছে। কেন করছে সে এসব? তার মন কি চায়। মানুষটা আবার আসুক। তার রাগ আবার ভাঙাক! মানুষটার কিসের এত দায় পড়েছে। যে সে রাগ করবে আর মানুষটা বেহায়ার মতো তার কাছে এসে আত্নসমর্পণ করবে। মানুষটার নিজস্ব অভিমান বলতে কিছু নেই। আমাকে নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। এই আমি তার সম্পর্কে না জেনে, তাকে চরিত্রহীন উপাধি দিলাম। আমার জন্য কেন তার মনে ক্ষোভ জমল না। মানুষটার বন্ধুত্বের বন্ধন কি তার থেকে গাঢ়! সেজন্য মেহেভীন তার কাছে হেরে যাচ্ছে। মানুষটা তাকে একটু বেশিই মূল্য দেয়! এতটা মহামূল্যবান সে নয়। সে তার মনের কথা আমায় বলবে। না হয় সবকিছু এখানেই স্থগিত হয়ে যাবে। এভাবে দু-টানায় ভুগতে ভালো লাগে না।

মুনতাসিম রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে আসছিল। তখনই আঁখিযুগল স্থির হয়ে গেল। মুখশ্রীতে ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট। মিরাজুল মেহেভীনের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে গম্ভীর মুখশ্রী করে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। মনটা বিষাদে ভরপুর হয়ে গেল। সমস্ত ফুলগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল। কারো দিকে দৃষ্টিপাত না করেই চলে গেল। মিরাজুল ডাকলেও তাকে ইগনোর করে চলে গেল। মিরাজুল মেহেভীনের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে এসেছিল। তাই নিজের বাবার জমিকে নিজের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করল। মেহেভীনের সাথে কথা বলে ভিষণ আনন্দ লাগছে তার। মেহেভীন তাকে সাহায্য করবে বলছে। প্রয়োজনের বাহিরে একটা কথাও বলেনি মেহেভীন। মিরাজুল চলে যেতেই মেহেভীন ফুলগুলো হাতে তুলে নিয়ে বাসার মধ্যে চলে গেল। মুনতাসিমে ওভাবে যেতে দেখে, মেহেভীনের মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেল। মানুষটা কি তাকে ভুল বুঝল!

হঠাৎ করে আকাশটা মেঘলা হয়ে আসলো। মেঘেরাও কি জেনে গিয়েছে। দুটি মানুষের মন ভিষণ খারাপ। তাদের সঙ্গ দিতেই সে চলে এসেছে। মেহেভীন বেলকনিতে এসেছেই খোলা জানালার দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করল। তখনই আঁখিযুগলের সামনে ভেসে উঠল একটা জোড়া বিধস্ত আঁখিযুগল। মানুষটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো সে মেহেভীনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেহেভীন দ্রুত নিজের কক্ষে যেতে চাইল। কিন্তু মুনতাসিম আঁটকে দিল।

–কালকের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত ম্যাডাম। রাগের বশে আপনার সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলছি। আপনাকে আঘাত করে ফেলছি। আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি। আপনাকে আঘাত করা মানে, নিজেকে আঘাত করা। কোনো মানুষ নিশ্চই নিজেকে আঘাত করতে চাইবে না। মেহেভীনের অভিমানের পাল্লা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। মেহেভীন গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। সে মানুষটার প্রতি ভিষণ ভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। মানুষটার নাম করে যে কেউ তাকে কাবু করতে পারবে। মেহেভীন নিরুত্তর রইল। এর মাঝেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। অসময়ে বৃষ্টি আসার কারন জানে না মুনতাসিম। তবে এই বৃষ্টিটা তার ভিষণ ভালো লাগছে। তার মনের গহীনে জমানো কষ্ট গুলো বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়েমুছে যাক। প্রকৃতির মতো তার হৃদয়টাও ঝকঝকে হয়ে উঠুক। মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–নিজের কক্ষে যান। অসময়ে বৃষ্টির পানিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে। খুব সহজে শরীর সুস্থ হতে চাইবে না। প্রেয়সীর বিষাদে ভরা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আহত হলো মুনতাসিম। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রেয়সীকে বুকের মধ্যে নিয়ে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করছে। দু’জনে একাকার হয়ে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আপনি কষ্ট পাবেন না ম্যাডাম। আপনি কষ্ট পেলে আমার পুরো দুনিয়ায় এলোমেলো হয়ে যায়। আমার ভেতরে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যায়। আমার হৃদয়টা অশান্ত নদীর মতো উথাল-পাতাল ঢেউ খেলতে থাকে। বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রনা করে। আমি মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকি। আপনার মন খারাপ থাকলে, আমার পুরো পৃথিবীর মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ করার আগে, একটা বার আমার কথা অন্তত ভাবুন মেহেভীন। মনের কথা গুলো আড়াল করে মুনতাসিম বলল,

–আপনি আমাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না। হে আকাশ তুমি আল্লাহ তায়ালার হুমুকে সারারাত বৃষ্টি দাও। আমি তোমার ছোঁয়ায় ভিজে একাকার হতে চাই। তোমার এতটুকু উপকারে আমার প্রেয়সীর মন গলে যাক। তাহলে নিজের জান কুরবান করতেও রাজি আছি। হে আল্লাহ তুমি নারাজ হইও না৷ কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। নিজের জীবন অন্য কারো নষ্ট করতে হয় না। তবুও আমরা আবেগের বশে বলে ফেলি। আমি ছাড়া তোমার বান্দার অভাব নেই। কিন্তু তুমি ছাড়া আমার কোনো রব নেই। আমার ভুল গুলো তুমি ক্ষমা করে দিও। কথা গুলো বলেই বিলম্ব করল না। কক্ষ থেকে বের হয়ে বাহিরে এসে মেহেভীনের জানালার কাছে দাঁড়াল। তখন কথা গুলো ধীরে বলায় মেহেভীন শুনতে পাইনি। মুনতাসিম বলল,

–আমাকে ক্ষমা করবেন কি না ম্যাডাম। আপনার উত্তর যদি না আসে। তাহলে আমি আজ সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে পার করে দিব। হাতে সময় বেশি নেই। উত্তর দিয়ে নিজের কক্ষে চলে যান। এই বৃষ্টির পানি আপনাকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করছে। আমার ভিষণ হিংসে হচ্ছে। একে তো মনটাকে ভিষণ বাজে ভাবে পোড়াচ্ছেন। এখন আবার হিংসের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েন না। আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না। বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে এল মেহেভীনের। এত বড় মানুষের এমন পাগলামি শোভা পায়! সে বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে বলল, আপনি সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে পার করে দিন। তাতে আমার কোনো যায় আসে না। কথা গুলো বলেই মেহেভীন নিজের কক্ষে চলে গেল। মনের অজান্তেই ভেতরে অসহনীয় যন্ত্রনা অনুভব করল মুনতাসিম। সে মলিন মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জেদ যেন তার সবকিছুকে কাবু করে ফেলছে। সে দেখবে তার কষ্টে মেহেভীনের কষ্ট হয় নাকি। মুহুর্তের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল মুনতাসিমের।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

হালকা হাওয়ায় গাছের ডালপালা হেলেদুলে পড়ছে। শীতে সমস্ত শরীর জমে আসছে। মুনতাসিমের সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বাজে। মেহেভীন জানালার কাছে আসতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটার এত কিসের জেদ! মেহেভীনের ভিষণ খারাপ লাগতে লাগলো। সে ছাতা হাতে নিয়ে নিচে চলে গেল। মুনতাসিম আঁখিযুগল বন্ধ করে কাঁপছিল। তখনই অনুভব করল বৃষ্টি তাকে স্পর্শ করছে না। আহত দৃষ্টিতে আঁখিযুগল উপরে দৃষ্টিপাত করল। পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করল। মানুষটাকে চিনতে এক সেকেন্ড সময় নিল না মুনতাসিম। আঁখিযুগল অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,

–এখানে কেন এসেছেন? বৃষ্টির পানি আপনার শরীরে সইবে না। ঠান্ডা লেগে যাবে।

–আপনি নিজ গৃহে ফিরে যান।

–আমি যাব না আপনার সমস্যা কোথায়?

–আমার সমস্যা আছে। একটা মানুষ আমার জন্য নিজেকে কষ্ট দিবে। সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। আমার ভিষণ খারাপ লাগবে। আমার কথা শুনুন গৃহে ফিরে চলুন।

–আপনার কথা কেন শুনব!

মেহেভীন জবাব দিল না। মুহূর্তের মধ্যে শীতল পরিবেশটা উত্তপ্ত হয়ে গেল। মেহেভীন ছাতাটা নিজের হাত থেকে ফেলে দিল। বৃষ্টির পানিগুলো মেহেভীনকে ভিজিয়ে দিতে শুরু করছে। মুনতাসিম হতভম্ব হয়ে গেল! যেখানে রাগ দেখানোর কথা তার। সেখানে মেহেভীন ক্ষমা করে তার অভিমান ভাঙিয়ে দিবে। মেয়ে তা না করে উল্টো রাগ করে বসল! দু’টি প্রেমিক হৃদয় বৃষ্টির পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। হৃদয় বলছে কাছে টেনে নাও। শরীর যেন দু’টি প্রেমিক হৃদয়ের মাঝে বাঁধা সাধছে। দু’জনকে এক না করার শপথ গ্রহণ করেছে। মেহেভীন ঠান্ডায় কাবু হয়ে আসছে। পুরো শরীর পাথরের ন্যায় অবশ হয়ে আসছে। সে মলিন কণ্ঠে জবাব দিল,

–আমি আপনাকে ক্ষমা করেছি। এবার গৃহে ফিরে চলুন। ঠান্ডায় বোধহয় জমে মা’রা যাব। আমি আপনার জেদের কাছে হার মেনে নিয়েছি।

–এত অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন ম্যাডাম? আপনার মনের জোড় এত স্বল্প! এভাবে কাউকে ধরে রাখতে পারবেন না। ভেতর থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠুন। না হলে সবাই আপনাকে ভিষণ বাজে ভাবে আঘাত করবে। এত সহজে আমি যাব না। ঠান্ডায় এতক্ষণ কষ্ট করলাম। এত পরিশ্রম করলাম। সেই পরিশ্রমের ফল না নিয়ে কিভাবে যাব বলুন? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের হৃদয় ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। বৃষ্টির জন্য একটা কাক পাখিও দেখা যাচ্ছে না। ফল স্বরুপ মুনতাসিম কি চাইছে তার কাছে? যদি কোনো নিষিদ্ধ কিছু চেয়ে বসে। ভয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়ছে মেহেভীন। মেহেভীনের মনের কথা বুঝতে পেরে মুনতাসিম ইচ্ছে করে, মেহেভীনের কাছে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন একটু দূরে সরে গেল। মুনতাসিমের ভিষণ হাসি পাচ্ছে। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শীতল কণ্ঠে বলল,

–আপনি চুপ করে গেলেন যে ম্যাডাম। আমাকে আমার পরিশ্রমের ফল দিবেন না। মুনতাসিমের শীতল কণ্ঠে বলা কথা গুলো মেহেভীনের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। ভেতরে অস্থিরতার ঝড় বইতে শুরু করল। মস্তিষ্কে এসে হানা দিয়েছে এক ঝাঁক ভয়। পানির শব্দ ছাড়া আশেপাশে কোনো শব্দ কর্ণকুহরে আসছে না। মেহেভীন মুখশ্রী মলিন করে বলল,

–কি চাই আপনার? কথা গুলো বলার সময় গলা ধরে আসছিল। শব্দগুলোও যেন আজ ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের ভিষণ ঠান্ডা লাগছিল। আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় সেন্সলেস হয়ে যাবে। সে আর বেশি কথা বলতে পারল না। হাসোজ্জল মুখশ্রী করে জবাব দিল,

–এই আমাকে এত শাস্তি দিলেন। তার বিনিময়ে আমাকে এখন খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করে খাওয়াবেন। এই বৃষ্টির সময় খিচুড়ি আর গরুর মাংস জমে যাবে। সাথে আপনি থাকলে কোনো কথাই নেই। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন আঁখিযুগল মেলে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মানুষটার প্রতি আরো একবার মুগ্ধ হলো সে। যতদিন যাচ্ছে মানুষটার প্রতি মুগ্ধতা ততই বেড়ে যাচ্ছে। একটা মানুষ এতটা অসাধারণ কিভাবে হতে পারে! মুনতাসিমের দৃষ্টি অন্য দিকে বিদ্যমান। বৃষ্টির পানিতে ভিজে মেহেভীনের জামা শরীরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের জায়গায় অন্য কেউ হলে, নিশ্চই এত সুন্দর সুযোগ হাতছাড়া করত না।

–চোখ দিয়ে আমাকে পরে খাবেন। আগে আমাকে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ান। ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছি। শুনেছি মেয়েদের আইসক্রিম নাকি খুব প্রিয়। আমাকে জমিয়ে বরফ বানিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি। যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে সেই ইচ্ছে টাকে ঝেড়ে ফেলে দিন। আমাকে খিচুড়ি খাওয়ার সুযোগ করে দিন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন ভিষণ লজ্জা পেল। মানুষটা কিভাবে বুঝল সে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে! সব সময় মানুষ টাকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় সে । মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত গৃহের মধ্যে চলে গেল। মুনতাসিম ও মেহেভীনের পেছনে পেছনে চলে আসলো। কক্ষে এসে ফ্রেশ হয়ে কম্বলের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে নিল। তবুও শীত যেন কমতে চাইছে না। তখন জেদ করে হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে, এখন শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। জ্বর ভালো মতোই আসবে মনে হচ্ছে। তাতে মুনতাসিমের কোনো যায় আসে না। নিজের প্রেয়সী রাগ ভাঙাতে সক্ষম হয়েছে। এখানেই তার সকল কষ্ট সার্থক হয়েছে। মুনতাসিম একটু পরে মেহেভীনের গৃহের কাছে এসে কলিং বেল দিল। মেহেভীন দরজা খুলে বলল,

–আমি খিচুড়ি রান্না করতে পারি না। আমার বাসায় গরুর মাংস ও নেই। কালকে আসার সময় আপনার জন্য খিচুড়ি নিয়ে আসব। এবার নিজের গৃহে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

–আপনি কিন্তু আমাকে ঠকাচ্ছেন ম্যাডাম। আপনার সাথে আমার এমন কথা ছিল না। আপনি যদি আমাকে এখন খিচুড়ি রান্না করে না খাওয়ান। তাহলে আমি সারারাত আপনার দরজা বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকব। আপনার বাসায় মাংস নেই। সে কথা আপনি আমাকে আগে বলবেন না। আমার বাসায় গরুর মাংস আছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই নিয়ে আসছি। মেহেভীন আহত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে এত রাতে রান্না করতে চাইছে না। সেজন্য মুনতাসিমকে মিথ্যা কথা বলল। কিন্তু মুনতাসিম তো নাছোড়বান্দা জোঁকের মতো আঁটকে ধরেছে। মেহেভীন ফিসফিস করে বলল,

–আস্তে কথা বলুন চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না। মানুষ শুনলে কি বলবে। আমরা বাসায় দু’জন মেয়ে মানুষ থাকি। কেউ দেখে ফেললে আমাদের খারাপ ভাববে। আপনি কাল সকালে আসবেন। আমি আপনাকে রান্না করে খাওয়াব।

–আপনি সকালে অফিসে চলে যান। সারাদিনে আপনার দেখা মিলে না। আপনি দরজা খোলা রাখুন। আমি বেশি সময় নিব না। খেয়েই চলে যাব। আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। আপনাকে কথা দিলাম। আজকের পর দীর্ঘসময় আপনাকে বিরক্ত করব না। তখন আপনি শান্তিতে থাকবেন। কথা গুলো কর্ণে আসতেই মেহেভীনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। হঠাৎ করে মানুষটা এমন কথা বলল কেন! মেহেভীন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে মুনতাসিমকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলল। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে বিশ্ব জয়ের হাসি। মেহেভীন রুপাকে ডেকে নিল। রুপা মেহেভীনের সাথে সাহায্য করছে। এই ছেলেটার সবকিছু রুপার অসহ্য লাগে। শুধু মাত্র মেহেভীনের জন্য কিছু বলতে পারছে না।

ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটা বেজে পনেরো মিনিট। মেহেভীন নিজ হাতে মুনতাসিমের প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আজ রান্না করতে গিয়ে মেহেভীনের ভিষণ আনন্দ লাগছে। সে আগেও কত রান্না করেছে। কই আগে তো এমন আনন্দ অনুভব করেনি। বেশ যত্ন নিয়ে রান্নাটা করেছে সে। রান্না করে ভিষণ তৃপ্তিও পেয়েছে মেহেভীন। আচমকা মুনতাসিমের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে আসতে শুরু করেছে। কতদিন পরে এতটা যত্ন নিয়ে কেউ তাকে খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছে। তার মা চলে যাবার পরে, সে কবে এতটা যত্নে খাবার গ্রহণ করেছে। তা তার জানা নেই। মুনতাসিম আহত কণ্ঠে বলল,

–আপনি আমার পাশে একটু বসবেন ম্যাডাম। এতটুকুও বিরক্ত করব না। আপনি শুধু আমার পাশে বসে খাবেন। কথা গুলো মাদকের মতো শোনালো। মেহেভীন নাকচ করার সাহস পেল না। নিঃশব্দে মুনতাসিমের পাশে বসলো। রুপা গিয়ে মেহেভীনের পায়ে বসলো। মুনতাসিম খাবার মুখ দিল। মেহেভীন অধীর আগ্রহে মুনতাসিমের দিকে চেয়ে আছে। খাবার কেমন হয়েছে জানার জন্য উতলা হয়ে আছে। মুনতাসিম খেয়ে মুখশ্রী কুঁচকে নিল। তা দেখে মেহেভীনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মুনতাসিম গভীর ভাবে মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বলল,

–সত্যি করে বলুন তো খাবারটা কি আপনি রান্না করেছেন? নাকি বাহিরে থেকে অর্ডার করে নিয়ে আসছেন। মুনতাসিমের কথায় বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে এল মেহেভীনের। সে তার জন্য এত কষ্ট করে রান্না করল। আর মুনতাসিম তার রান্না নিয়ে মজা করছে। অভিমানে মুখশ্রী ঘুরিয়ে নিল। রাগান্বিত হয়ে জবাব দিল,

–আপনি রাত করে আমার সাথে মজা করছেন। এই মধ্যরাতে আমার জন্য কে দোকান খুলে বসে আছে? তার ওপরে হয়েছে বৃষ্টি। চারদিকে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। আপনি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিজ গৃহে ফিরে যান।

–আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনার রান্না ভিষণ সুন্দর হয়েছে। সব খিচুড়ি আর মাংস আমি একাই খাব। আপনারা এতটুকুও খাবেন না। খাবার টেবিলে থেকে দূরে সরুন।

–আপনার পেটে কি দানব ধরেছে। এতগুলো খাবার সব একা খাবেন।

–আপনার চোখে কি দানব ধরেছে। এতবড় মানুষকে চোখ দিয়ে একা খিলে খান। মেহেভীন স্তব্ধ হয়ে গেল। বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টি করে আছে। রুপার সামনে তাকে ছোট না করলেই হতো না। মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। পরিবেশ জুড়ে নিস্তব্ধতা রাজত্ব করছে। মুনতাসিম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

–আমার শেষ একটা কথা রাখবেন ম্যাডাম। আমি আপনাকে একবার নিজ হাতে খাইয়ে দিতে চাই। আপনি না করবেন না। দু’লোকমা খাবার আমার হাতে থেকে আহার করুন। আমি ভিষণ আনন্দিত হব। এক সেকেন্ডের জন্য বিরক্ত করব না।

–ভেতরে প্রবেশ করার আগে কি বলেছিলেন মনে আছে?

–বিড়াল যদি বলে আমি মাছ খাব না। আপনি বিশ্বাস করবেন?

–না।

–কেনো?

–কারন এটা বিশ্বাস করা কখনোই সম্ভব না।

–তাহলে আমি আপনাকে বললাম। আমি আপনাকে বিরক্ত করব না। এটা কেনো বিশ্বাস করলেন? মেহেভীন একরাশ হতাশা ভরা দৃষ্টি নিয়ে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে। রুপা দু’জনের কান্ড দেখে মুখ চেপে হাসছে। মুনতাসিম মেহেভীনের সামনে খাবার ধরল। মেহেভীন বিনাবাক্য খেয়ে নিল। কি অপরুপ সেই মুহূর্ত! যার পুরুষ যত যত্নশীল তার নারী ততই ভাগ্যবান। এই মুহূর্তে এই কথাটাই মেহেভীনের মস্তিষ্কে বিচরন করছে। মুনতাসিম খেয়ে চলে গেল। যাবার আগে মেহেভীনের সাথে ভালো করে কথাও বলল না। শুধু এতটুকু বলে গেল। ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আপনি মানুষটা আমার ভিষণ শখের। আপনার কিছু হয়ে গেলে, আমি ভিষণ বাজে ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হব। কথা গুলো বলে বিলম্ব করেনি। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করেছে। শেষের কথা গুলো মেহেভীনের হৃদয় ছিদ্র করে বের হয়ে যাচ্ছিল। অজানা কারনে ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। মনটা বিষাদে ছেয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ গ্রাস করে ফেলছে তাকে। বুকটা ভারি হয়ে আসছিল। এই বুঝি মানুষটাকে আর দেখা হবে না। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কক্ষে চলে গেল মেহেভীন।

মুনতাসিম নেই আর পাঁচ দিন হলো। মানুষটাকে দেখার জন্য হৃদয়টা ভিষণ ভাবে অস্থির হয়ে আছে। সুযোগ পেলেই মানুষ টাকে সে খুঁজেছে। শহরের অলি-গলিও বাদ রাখেনি। মানুষটা বোধহয় এই শহরে নেই। প্রতিদিন দিনের মতো নিয়ম করে খোলা জানালার দক্ষিণের পাশে আঁখিযুগল স্থির হয়ে থাকে। এই বুঝে কেউ এসে বলবে। এভাবে চোখ দিয়ে আমার সর্বশান করবেন না ম্যাডাম। আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারব না। প্রতিদিন সকালে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে না। এতদিন যার জ্বালাতন সহ্য করতে না পেরে, তাকে দূরে যেতে বলতো। আজ সেই মানুষটা তার ছায়ার পাশেও আসে না। মানুষটাকে ছাড়া ভিষণ অসহায় বোধ করছে মেহেভীন। ভেতরটা শূন্যতায় ভরে উঠেছে। অশ্রুকণা গুলো চোখের কার্নিশে এসেও থেমে যাচ্ছে। আজকাল বুকের ব্যথাটা ভিষণ বেড়েছে। সে কি অসহনীয় যন্ত্রনা করে। বুকটা খাঁ খাঁ করছে। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে মানুষটার কাছে। গভীরভাবে আলিঙ্গন করে বলতে ইচ্ছে করছে। আমাকে এত মায়ায় বেঁধে কোথায় পালিয়েছিলেন। আপনাকে ছাড়া ভিষণ অসহায় আমি। আপনার শূন্যতা আমাকে ভিষণ ভাবে পোড়াচ্ছে। আপনি ফিরে আসুন আমার না হওয়া মহারাজ। আমাকে প্রতিটি প্রহরে প্রহরে বিরক্ত করুন। আমি আপনাকে কিছু বলব না। আমার আপনি হলেই হবে। আমার আর কিছু চাই না। আপনি ফিরে আসুন।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_১৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

দিন যায়, রাত যায়, প্রহের পর প্রহর চলে যায়। তবুও নির্দিষ্ট মানুষের দেখা মিলে না। কেটে গিয়েছে দু’টো মাস। মানুষটা যেন হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল। সাথে তৈরি করে দিয়ে গেল একরাশ হতাশা। মনটা তীব্র ব্যথায় ছটফট করে। ভেতরটা শক্তিহীনতায় ভুগছে। এই যে সে মানুষটার জন্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মানুষটার কি তার কথা একটি বারের জন্য স্মরন হচ্ছে না। মানুষ এতটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে! মনটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না তার। সবকিছু বিষাদ গ্রাস করে ফেলছে। যত দিন যায় মেয়েটা তত ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে রাইমা বেগম মেয়ের বাসায় এসে সাতদিন থেকে গিয়েছে। তার প্রাণবন্ত মেয়েটা হঠাৎ করে শান্ত নদীর মতো থম মে’রে গেল কেন? সেটাই তার সরল মস্তিষ্কে ঢুকছে না। মানুষ একটা বয়সে এসে একাকিত্বে ভূগে, একাকিত্ব মানুষকে ভয়ংকর ভাবে ধংস করে দেয়। মেয়েটার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। মেয়েটাকে একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। তাকে হাজার বার বলা হয়েছে। কাকে বিয়ে করেছিস। সে একটাই জবাব দেয় সে বিয়ে করেনি। সবকিছু দেখে সবাই মেনেই নিল মেহেভীন বিয়ে করেনি। শরীর অসুস্থ হলে শরীরে ডক্টর দেখালে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু হৃদয়ে যে হুটহাট রক্তক্ষরণ হয়। মনটা বাজে ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, বিধাতা মনের ডক্টর কেন তৈরি করেনি। ভেতরটা যে যন্ত্রনায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। এই উত্তপ্ত হৃদয়কে কিভাবে সে শীতল করবে।

“রাতে সূর্য থাকে না। তবুও মানুষ কেনো দিনের চেয়ে রাতে বেশি পুড়ে! আকাশ পানে চেয়ে নির্বিকার প্রশ্ন মেহেভীনের। সে তো এমন ছিল না। একটা ছলনাময়ী পুরুষ তার হৃদয় হরণ করে পালিয়েছে। তাকে করে দিয়েছে উন্মাদ ছন্নছাড়া। তার গভীর আঁখিযুগলের মায়ায় করেছে আসক্ত। শুনেছি হাত ধরলে মানুষ ছেড়ে চলে যায়। তাই সে আমার মনে ধরেছিল। আমি তাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। কথাগুলো ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসলো। আজকাল অশ্রুকণা গুলো খুব সহজে চোখ ভেজাতে চায় না। নির্জন কোনো স্থানে গিয়ে ইচ্ছে মতো অশ্রু বির্সজন দিতে ইচ্ছে করে। কাউকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে বলতে ইচ্ছে করে। আমি ভালো নেই। সবাই তো ভালোবাসার দায়িত্ব নেয়। তুমি না হয় আমার ভালো থাকার দায়িত্বটা নাও। কথা গুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহেভীন। সব কষ্টের সমাধান একটাই দীর্ঘশ্বাস। যার মধ্য দিয়ে হৃদয়ের সব দুঃখকষ্ট গুলো উঠিয়ে দেওয়া যায়।

প্রভাতের আলো চারদিক চকচক করছে। ভোরের মৃদু হাওয়া শরীর, মন, মস্তিষ্ক শীতল করে দিয়ে যাচ্ছে। ফরিদ রহমান শরীরে চাদর মুড়িয়ে দু-হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছে। প্রতি সপ্তাহে হাটের দিন বাজার করেন তিনি। আরিয়ান বাবার সাথে আসছিল। ফরিদ রহমানকে এতগুলো বাজার নিয়ে হিমশিম খেতে দেখে ছুটে আসলো। খপ করে বাজারের ব্যাগ দু’টো নিজের হাতে নিল। ফরিদ রহমানের গম্ভীর আঁখিযুগল আরিয়ানকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এসব কেমন ধরনের ভদ্রতা আরিয়ান! আমার অনুমতি না নিয়ে, তুমি কেন আমার হাত থেকে ব্যাগ কেঁড়ে নিলে?

–আপনি আমাকে নিজের ছেলে মনে করতে না পারেন চাচা। আমি আপনাকে নিজের বাবা মনে করি। আমি যে অন্যায় করেছি। তার জন্য যদি আপনি আমাকে খু’ন করে ফেলেন। আমি মুখ দিয়ে দু’টো বাক্য উচ্চারণ করব না। আপনি মুখে যতই বলুন আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আসলে আপনি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারেননি। এভাবে আমাকে পোড়াবেন না চাচা। আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন না হয় আমাকে ভাতের সাথে বি’ষ দিয়ে মে’রে ফেলুন। আমি যে আর অপরাধের যন্ত্রনা সহ্য করতে পারছি না। তখনই পাশে থেকে কেউ একজন বলে উঠল,

–কি দরকার ভাই অন্যের জন্য অপেক্ষা করার। আমি আপনাকে বি’ষ এনে দিব। এখনই খেয়ে ম’রে যান৷ আপনাকে আর যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে না। জারিফকে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এল আরিয়ানের। এতদিন পরে জারিফ কোথায় থেকে এল। শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করল আরিয়ান। জারিফ আরিয়ানের থেকে বাজারের ব্যাগ গুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কোমল কণ্ঠে ফরিদ রহমানকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কথা জানাল জারিফ। জারিফকে ফরিদ রহমান মতো ভাবে চিনেন। বহুদিন পরে ছেলেটাকে দেখে ভিষণ আনন্দ লাগছে ফরিদ রহমানের। সে জারিফের সাথে পায়ে পা ফেলে চলতে লাগলো।

জারিফকে দেখকেই রাইমা বেগমের সমস্ত শরীরে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। নিজের চরণের জুতা খুলে জারিফকে প্রহার করতে শুরু করল। ফরিদ রহমান কিছু বুঝতে পারল না। বিস্ময় নয়নে অর্ধাঙ্গিনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। তার শীতল মস্তিষ্কের অর্ধাঙ্গিনী এমন রণচন্ডী রূপ ধারণ করল কেন! রাইমা বেগম সহজে রেগে যাওয়ার মানুষ নন। সে জারিফের থেকে রাইমা বেগমকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসলো। জারিফ নিয়ে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না৷ সে নিজের লুকায়িত অস্ত্র বের করতে যাবে। তখনই জারিফের মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল। ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠছে। তীরে এসে নৌকা ডুবিয়ে দিস না জারিফ। অপেক্ষার প্রহর গুলো খুব দীর্ঘায়িত হয়। এত সহজে হেরে গেলে চলবে না। ঘন ঘন গাঢ় শ্বাস নিচ্ছে জারিফ। সে বিলম্ব করল না দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। রাইমা বেগম অস্থির হয়ে উঠেছে। ঝড়ের গতিতে শ্বাসকষ্ট এসে জানান দিচ্ছে সে চলে এসেছে। রাইমা বেগম কেমন ছটফট করতে লাগলো। আরিয়ান চিৎকার শুনে মেহেভীনদের বাসায় এসেছিল। রাইমা বেগমকে অসুস্থ হতে দেখে দ্রুত ঔষধ খাওয়ালেন। কোনো কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না। অবশেষে হসপিটালে নেওয়া হলো রাইমা বেগমকে।

তাহিয়ার সামনে বসে আছে প্রাপ্তি। মুখশ্রীতে তার অন্য রকম আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে, কাঙ্খিত মানুষটার দেখা মিলেছে। সে যতগুলো আঘাত পেয়েছে। সবগুলো গুনে গুনে ফেরত দিবে। কালো জিন্স, টপ, সানগ্লাস পড়া মর্ডান মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে প্রাপ্তি। এত সুন্দর মেয়ে সে আগে কখনো দেখেনি। বিদেশের মাটিতে বড় হয়েছে বলে কথা, সুন্দর্য না থাকলে বিদেশে থাকাই তার জন্য বৃথা ছিল। তাহিয়া বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে ফেলল। তেজী কণ্ঠে বলল,

–তোমাদের দেশে এতগুলো ধুলো বালি কেন? এজন্য বাংলাদেশ আসতে ইচ্ছে করে না। শুধুমাত্র মুনতাসিম ভাইয়ের জন্য আসি। আল্লাহ এত মানুষের মাথায় সুবুদ্ধি দিয়েছে। মুনতাসিম ভাইয়ার মাথায় কেন দেয়নি। তাকে কত করে বলি। দেশের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমাও। তার এক কথা দেশে থাকবে। দেশের মানুষের সেবা করবে। জনগণের সেবা করে তার কি লাভ হচ্ছে। আমি তার ক্রোধের কাছে দমে যাই। সেজন্য কিছু বলতে পারি না। তুমি তো সে বাড়ির বউ তুমি মামাদের কিছু বলতে পার না।

–আমি চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে এসব কথা কিভাবে বলব বল। সেজন্য তোমাকে দেশে আসতে বলেছি। তোমার ভাই একজন মন্ত্রী মানুষ। তার ক্ষমতাই আলাদা। তাকে একটা বাক্য উচ্চ শব্দে বলা যায় না। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে মুনতাসিম ভাইয়ের এলোমেলো জীবনটা গুছিয়ে দিতে। তোমাকে আমার বড় জা হিসেবে দেখতে চাই। মানুষটা প্রচুর অনিয়ম করে চলাফেরা করে। আমি তাই তুমি তাকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে চলে আসো। তোমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। মুনতাসিম ভাইয়ের বউ হবার জন্য প্রস্তুত তো তাহিয়া। প্রাপ্তির কথায় লজ্জায় মুখশ্রী লাল হয়ে আসলো তাহিয়ার। সে মুখে অনেক বড় বড় কথা বললেও, মুনতাসিমের বউ হবার কথা শুনলেই ভিষণ লজ্জা পায়। মেয়েটা বাহির থেকে কঠিন হলে-ও ভেতর থেকে ভিষণ বোকা। কেউ তার প্রশংসা করলে সে গলে যায়। আর অপর পাশের মানুষটাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে শুরু করে।

–আমি তোমার জা-ই আমাদের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। কথা গুলো বলেই লজ্জা লতা গাছের ন্যায় মিইয়ে গেল তাহিয়া। প্রাপ্তি বিস্ময় নয়নে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি মানুষের মধ্যে কেমন জানি রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রাপ্তি চৌধুরী বাড়ির মানুষের হিসেবে মিলাতে পারে না। মাথা কেমন জানি ঘুরছে। সে সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে গিয়ে নিজেই নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়ে গেল। মুনতাসিমকে আঘাত করার শেষ উপায় টাও জলে চলে গেল।

চারদিকে আঁধারে আচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। গ্রামের পরিবেশ নিস্তব্ধ হতে শুরু করেছে। বাচ্চারা নিদ্রা দেশে পাড়ি জমিয়েছে। রাত আটটা বাজার সাথে সাথে পুরো গ্রাম মরুভূমিতে পরিনত হলো। এই আঁধারের অপেক্ষায় ছিল মুনতাসিম। শহর থেকে একটু দূরে গ্রামের মধ্যে আঁকাবাকা নদীর তীরে বসে আছে সে। বিশাল নদীর সাথেই একটা বিশাল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছটা তার মতো ভিষণ একা। সেজন্য এই গাছটাকে সে ভিষণ ভালোবাসে। মৃদু চিৎকার কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিম অস্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠল। পানিতে ভিজিয়ে রাখা চরণ দু’টো তুলে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে গভীর অরণ্যের মাঝে প্রবেশ করতে লাগলো। দিনের বেলায় এই অরণ্যে আসলে মানুষের শরীর শীতল হয়ে আসে। কিন্তু মনুতাসিমের ভয়ডর বলতে কিছু নেই! সে নিশ্চিন্তে গভীর অরণ্যের মধ্যে চলে যাচ্ছে। ছোট একটা বাড়ির দেখা মিলল। সেখানে মিরাজুল কে উল্টো ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মিরাজুলকে দেখে মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে রাগান্বিত হয়ে চেয়ারে বসলো। হুংকার ছেড়ে বলল,

–এই দুই মাসে একশো ছাপ্পান্ন বার পিছু নিয়েছিস। বারোবার কুনজর দিয়েছিস। সাতবার খারাপ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিস। চারবার তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিস। তোকে নিষেধ করেছিলাম। তার পেছনে থেকে সরে যা। আমার কথা শুনিসনি। উল্টো আমার না থাকার সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিস। তুই কি ভুলে গিয়েছিস। তুই কার সাথে লাগছিস। তোকে কি মনে করিয়ে দিতে হবে।

–তুই নিজেকে কি মনে করিস মুনতাসিম। মেহেভীন তোর সবকিছু জানার পরে তোকে পছন্দ করবে। তোর মুখে থু’তু ফেলবে। চৌধুরী পরিবারকে মেহেভীন ভিষণ ভাবে ঘৃণা করে। ঘৃণা করে মিথ্যা বলা পুরুষ জাতিকে। আমি মেহেভীনকে ভালোবাসি। মেহেভীনকে যেকোনো নজরে দেখার অধিকার আমার আছে। তুই চাইলেও আমাদের আলাদা করতে পারবি না। মুনতাসিম চেয়ার থেকে উঠে বসলো। হাত দিয়ে ইশারা করতেই একজন গার্ড এসে চা’কু, লবন, ম’রি’চ দিয়ে গেল। মুনতাসিমের কখন কি চাই গার্ডগুলোর যেন সবকিছু মুখস্থ করা। মুখ দেখলেই বুঝে যায় মানুষটার এখন কি লাগবে। মুনতাসিম মিরাজুলের দিকে এগিয়ে গেল। মুনতাসিম অদ্ভুত ভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মুনতাসিমের এমন রুপ থেকে মিরাজুলের আত্মা গলায় উঠে আসছে। শান্ত মস্তিষ্কে মিরাজুলের কাছে গিয়ে অবস্থান করল মুনতাসিম। মিরাজুলের অধর যুগল মুহুর্তের মধ্যে ফালা ফালা করে দিল। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে মিরাজুলের হৃদয়বিদারক চিৎকারের প্রতিধ্বনিতে পুরো কক্ষ কেঁপে উঠল। মুনতাসিম লবন আর ম’রি’চ ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিল। সমস্ত যন্ত্রণা যেন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। মিরাজুল জ্ঞান হারালো। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে প্রশান্তির হাসি।

–সে সজাগ হলে এক পা আর এক হাত ভেঙে দিবে। বাহিরে বের হয়ে অন্যের ফুলের দিকে কুনজর দেওয়ার সাহস যেন না পায়। সে যদি পালিয়ে যায়। তাহলে তোমাদের কে’টে কু’টি কু’টি করে লবন আর ম’রি’চ দিয়ে মাখিয়ে রোদে শুকোতে দিব। মুনতাসিমের কথার ব্যাখ্যা বুঝতে গিয়ে প্রতিটি গার্ডের হৃদয় কেঁপে উঠল। তারা ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে। সামনে ভিষণ রকমের খারাপ কিছু হতে চলছে। তাইয়ান ভয়ে জমে গিয়েছে। শরীর টা যেন টানছে না। এতগুলো বছর মানুষটার সাথে থেকেও মানুষটাকে বুঝতে পারল না সে। মুনতাসিমের এমন পাষণ্ড রুপ দেখলে তার কান্না করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীতে সে-ই একমাত্র ছেলে। যে কি-না ভয় পেলেই মেয়েদের মতো কান্না করে দেয়। এতে মুনতাসিম তাইয়ানের প্রতি বেশ বিরক্ত। কেন যে তাইয়ানের মতো বোকা ছেলেকে তার ব্যক্তিগত গার্ড হিসেবে রাখা হয়েছে।

–স্যার আপনি আমার মাথাটা কবে কা’টবেন? মুনতাসিমের মেজাজ এমনিতেই প্রচন্ড খারাপ ছিল। তাইয়ানের কথায় সে বিলম্ব করল না। দ্রুত তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমের আঁখিযুগলের দিকে তাকিয়েই তাইয়ান শেষ। মুনতাসিম এক পা ফেলার আগেই তাইয়ান হওয়ার মতো মিলিয়ে মুনতাসিমের পায়ের নিচে চলে আসলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে