খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
440

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

গীতের প্রতিধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছে। মেহেভীনকে গোসল করিয়ে দেওয়ার জন্য বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বজনরা গীত গাইছে আর মেহেভীনের মস্তকে পানি ঢালছে। সমস্ত কায়াতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে মেহেভীনরে। হলুদের কার্যক্রম শেষ হতেই মেহেভীনকে কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। মেহেভীন কক্ষে এসে গোসল করে মেরুন রঙের শাড়ি পরিধান করে নিল। কক্ষের কবাট খুলে বাহিরে যাবে, এমন সময় মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে মুনতাসিমের নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোনটা কর্ণে ধরতেই মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এল,

–কালকে কিন্তু শাড়ি পড়তে হবে।

–যদি না পড়ি তাহলে কি করবেন?

–আমি গিয়ে পড়িয়ে দিয়ে আসব। আমার বউকে আমার মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে আসব।

–আর যদি না সাজি?

–বললাম তো আমি গিয়ে সাজিয়ে দিব।

–সাহস আছে?

–আমার সাহস দেখতে চান?

–হুম চাই।

–আমি জানি আপনি আমার মনের মতো করেই সাজবেন৷ কাল কেও বলেছিলেন কাঁচা ফুল দিয়ে সাজবেন না। তাহলে আজ সেজে ছিলেন কেন?

–আমার মন চেয়েছিল তাই।

–মিথ্যা কথা বলছেন?

–আমি আপনাকে ভয় পাই? যে মিথ্যা কথা বলব!

–আমি তো দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমাকে ভয় পান।

–কালকে আমি লেহেঙ্গা পড়ব।

–না শাড়ি পড়বেন। মেহেভীন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না৷ তখনই কেউ কবাটে কড়া নাড়ে খেতে যাবার জন্য। মেহেভীন মুনতাসিমের থেকে বিদায় নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।

আরিয়ান আর মিরাজুল তৈরি হয়ে নিয়েছে। আরিয়ান আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ব্যাগে তুলে নিল। দু’জনেই কালো পোশাক পরিধান করেছে। খুব কাছে থেকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে, কেউ বুঝতে পারবে না তারা দু’জন আরিয়ান আর মিরাজুল। আরিয়ান চরণে জুতা পড়তে পড়তে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আমাদের লোকরা কোথায়?

–ছয়টা গাড়ি নিয়ে তারা আগে বেড়িয়ে পড়েছে। আমরা তো তাদের থেকে অনেকটা দুরত্বে আছি। আমাদের সেখানে পৌঁছে যেতে গোটা একটা দিন লাগবে।

–আমরা সেখানে গিয়ে কার কাছে থাকব? আরিয়ানের কথায় মিরাজুলের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে রাগান্বিত হয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। আরিয়ান বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে তার যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মিরাজুলের এমন গা-ছাড়া ভাব আরিয়ানকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মেহেভীনের আগেই না আবার মিরাজুলকে সে খু’ন করে বসে। মিরাজুল হাতের ব’ন্দু’ক’টা নিজের মধ্যে আড়াল করে নিয়ে, তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

–এই জন্যই তোমাকে মেহেভীন বিয়ে করেনি। মস্তক ভর্তি শুধু ক্রোধ আর গোবর আছে। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে মিরাজুলের শার্টের কলার পাকড়ে ধরল। তাকে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,

–নিজেকে তুমি কি মনে করো? তুমি ভুলে যেও না এই যে এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছো। সেটা কার জন্য? অবশ্যই আমার জন্য। আমি চাইলে তোমার যাত্রা এখানেই থামিয়ে দিতে পারি। আরিয়ানের কথায় মিরাজুলের মুখশ্রীতে বিরক্তি ফুটে উঠল। ক্রোধে সমস্ত কায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিরাজুল ঝাড়ি দিয়ে আরিয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

–এই শক্তির প্রয়োগ আমার কাছে না করে, যদি মেহেভীনের সাথে করতে! তাহলে আজ তুমি মেহেভীনের অর্ধাঙ্গ হয়ে যেতে। মস্তক তো একদমই ফাঁকা তাই তোমার ফলাফল গুলোও ফাঁকা। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবে নাকি আমার সাথে যাবে? মিরাজুলের কথায় হুস আসলো আরিয়ানের এই কয়দিনে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে দু’জনের। তবে মিরাজুল আরিয়ানের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান হওয়ায় আরিয়ান তার সাথে পেরে ওঠে না। দু’জন আর বিলম্ব করল না নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিল।

অন্ধকার কক্ষে নিস্তেজ অবস্থায় বাঁধা ছিল যুবকটি। তখনই কক্ষের মধ্যে এক রমণী প্রবেশ করে। রমনী দেখে গার্ড গুলো বিস্ময় নয়নে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রাণ প্রিয় ভাইয়ের এমন করুন অবস্থা দেখে, রমনীর বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। সে অস্থির হয়ে ভাইয়ের কাছে এসে অবস্থান করল। নিজের কোমল হাতের ছোঁয়ায় ভাইয়ের গাল স্পর্শ করল। কারো আদুরে স্পর্শ কায়াতে পড়তেই অসহায়ত্ব আঁখিযুগল দৃষ্টি মেতে তাকালো। সামনে অবস্থান করা মানুষ টিকে দেখে অধরের কোণে হাসি ফুটে উঠল। মলিনতার ছোঁয়ায় মাখা হাসিটা বেশ দারুন দেখালো রমনীর কাছে। সে হুংকার ছেড়ে বলল,

–তোমাদের সাহস কি করে হয়? আমার ভাইকে আহত করে এই অবস্থায় ফেলে রাখার! দ্রুত আমার ভাইয়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হোক৷ রমনীর কথায় গার্ডদের মধ্যে একজন বলল,

–আপনার সাহস কি করে হয় এখানে আসার! স্যার জানতে পারলে, তার সাথে আপনার মস্তকটাও কাটা যাবে। রমনী বস্ত্রের ভেতর থেকে ব’ন্দু’ক বের করে গার্ড হাত বরাবর মা’র’ল। গার্ডটা হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তখনই কেউ রমনীর মুখশ্রী পেছনে থেকে চেপে ধরলো। রমণীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছ। তা দেখে বিধস্ত যুবকটি বজ্র কণ্ঠে বলল,

–আমার বোনকে ছেড়ে দে জা’নো’য়া’র। আমি মুক্ত হলে তোকে আর তোর মুনতাসিমকে কে’টে টুকরো টুকরো করে কুকুরের খাদ্য বানাব। আমার বোনের কায়াতে একটা ফুলের টোকা পড়লে। আমি তোকে শেয়াল শকুনের মতো ছিঁ’ড়ে ছিঁ’ড়ে খাব। যুবকের কথায় পরিবর্তন আসলো না সামনে থাকা মানুষটার। সে আগের ন্যায় রমণীকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। বিধস্ত যুবকটি নিরুপায় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলো। তার জন্য তার বোনের করুন অবস্থাটা। ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। মন বজ্রকণ্ঠে হুংকার ছেড়ে বলছে। প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে মুনতাসিম ফুয়াদ।

আনন্দ উল্লাস করে কে’টে দিল রজনী কে’টে গেল আস্ত একটা দিন। বিবাহের অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় শুরু হবে। সূর্য মামা বিদায় জানিয়ে আঁধারকে আমন্ত্রণ করল ধরনীর বুকে আসার জন্য। সূর্য মামা বিলুপ্ত হবার সাথে সাথে, আঁধার ধরনীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। রাইমা বেগম বরযাত্রীর জন্য খাবার সাজাচ্ছিলেন। তখনই কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল।

–কি রে রাইমা বিয়ের সময় তো হয়ে এল। কিন্তু ফরিদ তো এখনো এসে পৌঁছাল না। তুই ফরিদের নাম্বারটা আমাকে দে। আমি ফরিদকে ফোন দিয়ে দেখি সে কোথায় আসতে কতক্ষণ দেরি হবে?

–সে আসবে না আম্মা। আমার মায়ের অবস্থা ভালো না হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সেখানে কেউ নেই যার ফলে মেহেভীনের বাবাকে আবার ঘুরে যেতে হয়েছে। মেহেভীনের বিয়ে হয়ে গেলে আমিও চলে যাব। মেহেভীনকে এ কথা বলবেন না। সে চিন্তা করবে। বৃদ্ধার বয়স্ক দৃষ্টি রাইমা বেগমের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। সে এক কান দুই কান করতে করতে পাঁচ কান পর্যন্ত পৌঁছে দিল তথ্যটা। সবাই কানাঘুষা করছে তবে সামনে বলার সাহস কেউ পাচ্ছে না। এরমধ্যেই হৈচৈ শোনা গেল বর চলে এসেছে। সবাই বরকে বরন করার জন্য চলে গেল। এলাকার বাচ্চারা বরের গেট ধরেছে। তারা অনেক কষ্ট করে বরের গেট সাজিয়েছে। ফুল সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বরের জন্য মালা বানিয়েছে৷ এত কষ্ট কিছুতেই বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। তার মধ্যে একটা ফর্সা বাচ্চা ছেলেকে দেখে শেহনাজ বলল,

–আমরা তোদের টাকা দিতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্তে আছে। তোদের সাথে কালো শার্ট পড়া ছেলে টাকে আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। তোরা যদি এই কালো শার্ট পড়া ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে দিস। তাহলে আমি তোদের এক হাজার টাকার বদলে পুরো পাঁচ হাজার টাকা দিব৷ শিশু মস্তিষ্ক শেহনাজের এমন কথায় লজ্জায় মস্তক নুইয়ে নিল। অন্যান্য বাচ্চারা তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে শুরু করল। আনন্দ উচ্ছাসে বর বরন হয়ে গেল। এবার খাওয়া দাওয়ার পালা সবাইকে খেতে বসানো হয়েছে। তখনই মুনতাসিমের দিকে ব’ন্দু’ক তাক করা হয়। যখন শু’ট করতে যাবে তখনই পেছনে থেকে মিরাজুলের মুখশ্রী চেপে ধরা হয়৷ মিরাজুল যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। ছাড়া পাবার জন্য শত রকমের কৌশল ব্যবহার করে-ও মানুষটার হাত থেকে ছাড়া পেতে সে ব্যর্থ হয়৷ দু’জন ধস্তাধস্তি করতে করতে মিরাজুল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখনই মানুষটা মিরাজুলকে অজ্ঞান করে ফেলে। মিরাজুলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,

–আমার ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকা কেঁড়ে নেওয়ার অধিকার আমি তোদের দেইনি। যেখানে আমি নিজেই নিজের মনকে বুঝিয়েছি মানিয়েছি। সেখানে তোদের সাহস হয় কি করে! তাদের সুখের দিকে নজর দেওয়ার? তোদের এতটা দূরে পাঠাব যতটা দূরে গেলে ফিরে আসতে পারবি না। কথা গুলো বলেই উন্মাদের মতো উচ্চ হাসিতে মেতে উঠল।

মেহেভীনকে লাল টকটকে রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। সমস্ত কায়া জুড়ে সোনার অলঙ্কার পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেয়েটার ভেতরে এতটা সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তা মেয়েটার বিয়ে না হলে জানতেই পারতো না। সবাই মনে মনে আফসোস করতে শুরু করল। কেউ কেউ ঈর্ষা করছে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। এত ভীড় এত কোলাহল আঁখিযুগল মাকে খুঁজতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই কাজী সাহেব চলে আসলো বিয়ে পড়ানোর জন্য। মুহূর্তের মধ্যে পুরো কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিছু মেয়ে মেহেভীনের মস্তকে বড় করে ঘোমটা টেনে দিল। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিল। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের ভেতরে ভয় কাজ করছে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। নিজেকে যতই স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মানসিক ভাবে সে ততই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অনবরত অশ্রু বিবর্জন দিয়েই যাচ্ছে। তবুও মুখশ্রী দিয়ে কবুল শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় নিয়ে কবুল বলতে সক্ষম হলো মেহভীন। সবাই মোনাজাত ধরল। বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হতেই সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করা হলো। মেহেভীনকে বিদায়ের জন্য বাহিরে নিয়ে আসা হলো। মুনতাসিমের দৃষ্টি মেহেভীনের দিকে যেতে ডান হাতটা আপনা-আপনি বুকের পা পাশে চলে গেল।

–আমি শেষ এই মেয়ে আমাকে একদম শেষ করে দিয়েছে। নিজের অস্তিত্ব বলতে যতটুকু ছিল আজ সবটুকু নিজের মধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে। বেহায়া আঁখিযুগল চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। আজ আঁখিযুগল তাকিয়ে থাকতেও দ্বিধাবোধ করছে না। আজ থেকে এই মানুষটা একান্তই তার নিজের, এই মানুষটার প্রতি একান্তই তার অধিকার থাকবে। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু সে বিচরণ করবে। তাইয়ান নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারল না। উৎসুক কণ্ঠে বলল,

–এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবেন না স্যার। এখানো পুষ্প শয্যার রাত বাকি। একবার বিয়ে না করে-ও সন্তানের বাপ হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন। এখন বিয়ে করে বাপ না হতেই পটল তুলবেন? কথা গুলো বলেই তাইয়ান মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সাথে সাথে তার জান উড়ে যাবার জোগাড়। সে শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। ভয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে মলিন গলায় বলল,

–স্যরি স্যার সবাই কত আনন্দ করছে। আপনাদের নিয়ে কত মজার মজার কথা বলছে। আমিও বলে ফেলছি ছোট ভাই মনে করে মাফ করে দেন। মুনতাসিম কিছু বলল না। সে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। সে জানে সে ঠিক কতটা প্রিয় মুনতাসিমের। মুনতাসিম মুখে যাই বলুক না কেন, সে কোনোদিন তাইয়ানের কিছুই করবে না। মুনতাসিমের রক্তিম দৃষ্টিকে ভয় পাওয়া যেন তার প্রতিদিনের অভ্যাস। সে ভয়কে দূরে সরিয়ে দিয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল।

–আজকালকার যুগে বিয়ের দিন মেয়েরা কাঁদতেই ভুলে গিয়েছে। নিজের বিয়েতে নিজেই নাইচা গাইয়া উল্টায়া দেয়। আমাদের মেহেভীন সোনার টুকরো একটা মেয়ে। ছোট বেলা থেকে কোনো বাজে রিপোর্ট নাই। এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। দোয়া করি মা স্বামীর সংসারে তুমি সুখী হও। হাতের মেহেদীর রঙও দেখি ভিষণ গাঢ় হয়েছে। শুনেছি যার হাতের মেহেদীর রঙ যত বেশি গাঢ় হয়। সে স্বামীর সোহাগ তত বেশি পায়। মহিলাটির কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই সবাই উচ্চ শব্দে হেসে উঠল। মেহেভীন শক্ত করে মায়ের হাত ধরে আছে। মুনতাসিমকে মেহেভীনের পাশে নিয়ে এসে দাঁড় করানো হলো। মাশরাফি শেহনাজকে বলল,

–বিয়ে করার সাথে সাথে ভাইয়ার ক্ষমতা কি আরো বেড়ে গেল নাকি আপু? কবুল বলার সময় এত দ্রুত বলল যেন ভাবি পালিয়ে যাচ্ছে। এখন ভাবির পাশে এসে দাঁড়াতে বলতে না বলতেই ঝড়ের গতিতে এসে দাঁড়াল।

–ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। যেদিন বড় হবি সেদিন বুঝতে পারবি। কথা গুলো বলেই শেহনাজ মুনতাসিমের পাশে এসে দাঁড়াল।
মুনতাসিম দুধ কলা খাইয়ে দেওয়া হলো৷ সেটার আংশিক অবশিষ্ট ছিল। বাকিটা মেহেভীনকে খাইয়ে দিল রাইমা বেগম। মেহেভীনের হাত মুনতাসিমের হাতে তুলে দিয়ে বলল,

–নিজের জান তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি কখনো মনে হয়। সে তোমার সাথে সংসার করার যোগ্য না। নিজ দায়িত্বে আমার কাছে দিয়ে যাবে। আমার বুকের জিনিস আমি আবার বুকে আগলে নিব৷ আমি তোমাকে ভরসা করেছি। তাই এই ভরসার হাতে আমার কলিজার টুকরাকে তুলে দিলাম। কখনো কষ্ট পেতে দিও না। তার অশ্রু গুলো মাটিতে পড়ার আগেই তুলে আমার মেয়েসহ সেটা দিয়ে যেও। আমি আমার মেয়ের ভালো থাকার আশায় তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। যেদিন আমার মেয়ের ভালো থাকাটা হারিয়ে যাবে। সেদিন আমার মেয়েকে দুঃখ দেওয়া মানুষটাও আর ধরনীর বুকে থাকবে না। এই মেয়ের জন্য আমি সমস্ত ধরনীর মানুষের সাথে যুদ্ধ করেছি। তাকে দুঃখ দিলে আঘাতটা আমার কলিজাতে লাগবে। আমি তোমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি। আমার ভরসার মূল্য দিও। আমার বিশ্বাস বিফলে যেতে দিও না বাবা। মুনতাসিম মেহেভীনের হাত শক্ত করে ধরে জবাব দিল,

–আজ থেকে তার সব দুঃখ আর বিপদ আমার। যেদিন আপনার ভরসার মূল্য ভেঙে যাবে। সেদিনই হবে আমার জীবনের শেষ দিন। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। আমাকে ভরসা করেই দেখুন না আন্টি। সময়ের সাথে প্রমাণ আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন। মুনতাসিম কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। মুনতাসিমের কথা শুনে রাইমা বেগমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। মেহেভীন মাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছে। সবাই শক্তি প্রয়োগ করেও মেহেভীনকে ছাড়াতে পারছে না। মাকে না ছাড়ার পণ করেছে সে। রাইমা বেগম সবাইকে দূরে যেতে বলল। সে মেহেভীনের মস্তক তুলে বলল,

–বাচ্চাদের মতো আচরন করছিস কেন মেহেভীন?

–তুমি আমার সাথে চলো।

–লোক হাসাতে চাস। আমি এতটাও দুর্বল নই। নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করিস না। চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে বসবি। মেহেভীনের অবস্থা দেখে মুনতাসিমের ভিষণ খারাপ লাগছে। সে রাইমা বেগমকে বলল,

–আন্টি আপনি আমাদের সাথে চলুন।

–এটা দৃষ্টিকটু দেখায় বাবা। তোমরা সামনের দিকে এগোনোর প্রস্তুতি নাও। আমি মেহেভীনকে নিয়ে আসছি। তখনই সবাই হৈহৈ করে উঠল নতুন বউ কেন হেঁটে যাবে? আশেপাশে তেমন কেউ নেই যে তাকে বলবে। মেহেভীনকে সে গাড়ি পর্যন্ত কোলে তুলে নিয়ে যাক। তখনই নজরে আসে আয়মান সবাই আয়মানকে ধরল। আয়মান রাজিও হয়ে গেল তবে মেহেভীনের মাঝে একরাশ অস্বস্তি ঘিরে ধরল। যাকে বিয়ে করবে না বলে পালিয়েছে! তার কোলে সে কিভাবে উঠবে?মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই কারো গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।

–আমার কি হাত নেই? নাকি আমি প্রতিবন্ধী যে, আমি থাকার পরেও আমার বউকে অন্য কেউ কোলে নিবে! আমার বউকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে হলে, আমিই নিয়ে যাব। তবুও কোনো পরপুরুষকে আমার বউয়ের কাছে আসতে দিব না। যারা অন্যকের বউকে কোলে নিতে বলে আর যারা অন্যের বউকে কোলে তুলে নিতে আসে। তাদের মতো মেরুদণ্ডহীন মানুষ ধরনীর বুকে দুটো নেই। কথা গুলো বলেই মেহেভীনকে কোলে তুলে নিল মুনতাসিম। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমকে দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের কান্ড দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে। মুনতাসিমের সাথে তাল মিলিয়ে সবাই গাড়ির কাছে চলে গেল। মেহেভীনকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে সে-ও মেহেভীনের পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,”আজকে যতখুশি পারুন কান্না করে নিন। আজকের পর থেকে আর কোনোদিন কান্না করতে দিব না। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত ভাবে আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। মনের অজান্তেই ভেতরটা খালি খালি লাগছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

গাছের আড়ালে মস্তক লুকিয়ে দক্ষ ভাবে মেহেভীনের দিকে ব’ন্দু’ক তাক করা হলো। ক্রোধ সমস্ত কায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে আরিয়ানের। মিরাজুল মুখে অনেক বড় বড় কথা বলেছিল। কিন্তু কাজের বেলায় শূন্য! এই যে বিয়ে হয়ে গেল। এখন মেহেভীনের বিদায়ের পালা চলে আসলো। তবুও তার দেখা মিলছে না! ক্রোধের মাত্রা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রকোপ হতে লাগলো। সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। সে বিলম্ব করল না। দ্রুত গু’লি করার জন্য প্রস্তুত হতেই মিরাজুলের মতো কেউ তাকে পেছনে থেকে চেপে ধরলো। দু’জন মানুষের হাতাহাতির মাঝেই আরিয়ান জ্ঞান হারালো। সেই সাথে অন্ধকার আচ্ছন্নে ঢেকে গেল কারো চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয়ে। ভেতরটা ভিষণ বাজে ভাবে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। মানুষটা অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ বারের মতো প্রেয়সীকে দেখে নিল। ভেতর জুড়ে আজ শুধুই হাহাকারের বসবাস। তারে এত করে চাইলো। তবুও মানুষটারে নিজের করে পেল না। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করেছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ভেতরে থেকে দুমড়ে মুচড়ে যাবে। নিজের প্রেয়সীকে অন্য কারো হতে দেখার সহ্য ক্ষমতা সবার থাকে না। তবে বিধাতা তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। তবে ক্ষমতাটা বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পেল না। মনের সাথে সাথে কায়ার সমস্ত শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করল। সে মলিনতায় ছোঁয়ায় মাখা কণ্ঠে বলল, “ভালো থেকো আমার না হওয়া প্রিয় মানুষ। পরের বার জন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে আমি অবশ্যই মুনতাসিম হয়ে জন্মাম। খুব সংগোপনে তোমার ভালোবাসা লুফে নিব। আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের সাথে তোমার যায় না। মুনতাসিমের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষই তোমার যোগ্য, আমার মতো অমানুষ কখনোই তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা রাখে না৷ পরপরে দেখা হলে একজন ভালো মানুষ হয়ে, আল্লাহর কাছে তোমারে চাইব। তখন আমায় ফিরিয়ে দিও না। আমার না হওয়া প্রিয় মানুষ। তুমি ভালো থেকো সুখে থেকো। তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা রইল গুড বাই ডার্লিং। ” বাক্য গুলো শেষ করেই আঁধারের সাথে মিলিয়ে গেল মানুষটা।

রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল গৃহের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা৷ মুনতাসিম আগে নেমে মেহেভীনের হাত ধরে মেহেভীনকে নামালো। সে মেহেভীনের হাত শক্ত করে ধরে প্রবেশ দারে এসে স্থির হলো। সাহেলা চৌধুরী দু’জনকে বরন করে নিল। দূরের স্বজনরা বউ দেখতে ভিড় জমিয়েছে। এত এত ভিড়ের মাঝে হঠাৎ মুনতাসিমের আঁখিযুগল অস্থির হয়ে যায়। বিদায়ের মুহুর্ত থেকে তাইয়ানের উপস্থিতি সে অনুভব করছে না। ছেলেটা তো তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত কোথাও যায় না। তবে আজ তার কি হলো? যে মুনতাসিমের আশেপাশে ও তাকে দেখা যাচ্ছে না! মুনতাসিমের ললাটে চিন্তার ভাজ পড়লো। তাইয়ানের জন্য ভিষণ চিন্তা হচ্ছে তার। সবাই মেহেভীনকে ঘিরে ধরে বসে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে বলল,

–আপনি এখানে সবার সাথে বসে গল্প করেন। আমি পাঁচ মিনিটে আসছি। মেহেভীন কোনো উত্তর দিল না। নতুন মানুষদের ভিড়ে ভিষণ অস্বস্তি লাগছে তার। মুখ ফুটে সে কথা বলতেও পারছে না সে। সবাই তাকে প্রশ্ন করছে সে হ্যাঁ না উত্তর দিচ্ছে। সবাই অনেক প্রশংসা করল মেহেভীনের। এত ভিড়ের মধ্যে সে তাইয়ানকে কোথায় পাবে? চিন্তায় মস্তক ঝনঝন করে উঠল। মুনতাসিম সমস্ত গৃহ হন্যে হয়ে খুঁজে চলছে। অবশেষে গৃহের পেছনে মুনতাসিমের ফলের বাগানে তাইয়ানের দেখা মিলল। তাইয়ানের কাঁধে স্পর্শ করতেই তাইয়ান চমকে উঠল! তড়িঘড়ি করে আঁখিযুগলের অশ্রুকণা গুলো মুছে নিল। মুনতাসিম গম্ভীর দৃষ্টিতে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের সমস্ত মুখশ্রীতে মলিনতা ছেয়ে গিয়েছে। আঁখিযুগল ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তাইয়ান অপরাধীর ন্যায় বলল,

–স্যরি স্যার আমি আসলে ভেবেছিলাম। এত মানুষ আছে সমস্যা হবে না। তাই আপনার থেকে কিছুটা দূরত্বে চলে এসেছি। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে কোনো পরিবর্তন এল না৷ সে আগের ন্যায় গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–সত্যি কথা বলো।

–কিসের সত্যি কথা স্যার?

–এক কথা দু’বার বলা পছন্দ করি না।

–কিছু হয়নি স্যার চলুন ভেতর যাই। সবাই আপনাকে খুঁজবে।

–কাঁদছিলে কেন?

–আপনার আজ কত বড় সুখের দিন স্যার। আপনাকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখেছি। কিন্তু আপনার আনন্দ কোনোদিন দেখিনি। আজ আপনার আনন্দ দেখে আমার এতটা আনন্দ হচ্ছে, যে আঁখিযুগলের কার্ণিশে অশ্রুকণা এসে জমা হচ্ছে।

–অভিনয়ে তুমি ভিষণ কাঁচা তাইয়ান। পাকাপোক্ত হয়ে তারপর আমার সাথে অভিনয়ের খেলা খেলতে আসবে। আমি তোমাকে জাস্ট দশ সেকেন্ড সময় দিলাম। সত্যি কথা ছাড়া একটা অযথা বাক্য যেন মুখ দিয়ে উচ্চারিত না হয়। আমার কথা গুলো মস্তকে রেখে বলা শুরু করো।

–স্যার আমার বাবা মারা গিয়েছে। কথা গুলো বলতে গিয়েও তাইয়ানের কণ্ঠনালি কাঁপছিল। ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মানুষটাকে এতদিন অবহেলা করে এসেছে সে। যে মানুষ টাকে এতদিন ঘৃণা করতো আজ সেই মানুষটার জন্য ভেতরটা হাহাকার করছে। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে কিছুটা বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–তুমি না বলেছিলে তোমার কেউ নেই!

–মিথ্যা কথা বলেছিলাম স্যার। আমি আসলে আমার বাবাকে ঘৃণা করতাম। যদি-ও ঘৃণার মাত্রা এতটাও প্রকোপ ছিল না। আমার মা কালো ছিল বলে আমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে নেন। তারপর আর আমাদের কোনো খোঁজ খবর তিনি রাখনেনি। মা আমাকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করিয়েছে। আমি নিজেও মায়ের সাথে কাজ করেছি। আমার মা রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতো। মায়ের কান্না আমার বুকে ভিষণ ব্যথা দিতো। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। আমার মাকে সুখে রাখার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না৷ তবে মনে মনে শপথ করে ছিলাম। মাকে আমি রাজরানীর মতো করে সাজাব। তখন আমার মা ছিল কিন্তু ক্ষমতা ছিল না। এখন আমার ক্ষমতা আছে কিন্তু মা নেই। যে মানুষটার জন্য আমার মা তিলে তিলে শেষ হয়ে গেল। সেই মানুষকে কিভাবে ভালোবাসব বলেন স্যার। আমার মা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। বাবা তার দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক বছর পর ফিরে আসেন। মাকে বলেন মায়ের মতো করে কেউ তাকে ভালোবাসতে পারবে না। বাবার কান্নায় মায়ের নরম মন গলে গিয়েছিল। মা বাবাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু আমি মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারিনি৷ সেদিন মায়ের ওপরে ভিষণ অভিমান হয়েছিল। পকেটে এক হাজার চারশো টাকা নিয়ে গৃহে ত্যাগ করেছিলাম। শহরে আসি কাজ করি। তখন আমি নতুন কলেজে উঠেছি। দীর্ঘ তিন মাস বাসায় যোগাযোগ রাখিনি। বাবা আমাকে অনেক মানানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঘৃণা নামক জিনিস আমার বাবার প্রতি এসে গিয়েছিল। তারপর একদিন যোগাযোগ করলাম। মা আমাকে প্রতি মাসে পড়াশোনার খবর পাঠানো শুরু করল। জীবনটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। আমি খুব আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। আমি বাসায় ফিরে আমার মায়ের জীবিত মুখটা দেখতে পারিনি স্যার। বাবা নামক মানুষ টার ওপরে যতটুকু ভালোবাসা এসেছিল। সেদিনের পর সেটুকুও মুছে গেল। আমার মনে হলো মায়ের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। সে তিলে তিলে আমার মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু আমার ধারোনাটা ভুল ছিল তাই না বলেন স্যার? আমি কোনোভাবেই সন্তান হবার যোগ্যতা রাখি না। না পারলাম মায়ের স্বপ্ন পূর্ণ করতে। আর না পারলাম বাবার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আপনিই বলুন স্যার আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন? যে বয়সে এসে আমার বাবার ভালোবাসা পাবার কথা ছিল। সে বয়সে এসে বাবার ভালোবাসা কি তা কেমন হয়? সেটাই আমি জানতাম না। তিনি ঠিকিই তার ভুল বুঝতে পেরে আমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। তাহলে আমি কেন তার সাথে মানিয়ে নিতে পারলাম না?

–তোমাকে কিছু কথা বলি তাইয়ান। আমরা হচ্ছে মানুষ আর প্রতিটি মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। চলার পথে আমরা না চাইতেও ভুল করে বসি। তোমার বাবাও একটা ভুল করে ফেলছে। ভুল বললে ভুল হবে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। একজন অপরাধী যখন অপরাধ করার পর অনুতপ্ত হয়। তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। ক্ষমা হচ্ছে মানুষের মহৎ গুন। যে ক্ষমা করতে জানে সে অনেক সুখে থাকে জানো। ক্ষমা করার মধ্যেও আলাদা একটা শান্তি আছে। যা রাগ আর ঘৃণার মধ্যে নেই। রাগ আর ঘৃণা মানুষের মস্তিষ্কে বিকৃত করে দেয়। একটা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। ধীরে ধীরে ধংসের দিকে ঠেলে দেয়। তোমার দোষ আমি দিব না তাইয়ান। তোমার হৃদয়ের ব্যথাটা আংশিক হলে-ও অনুভব করতে পারছি। আমাদের জীবনটা অনেক ছোট তাইয়ান। তুমি চাইলে কয়টা দিন তোমার বাবা-মায়ের সাথে সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপভোগ করতে পারতে। কিন্তু তুমি জীবন টাকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়েছ। আমি যদি আগে জানতাম তোমার বাবা বেঁচে ছিল। তাহলে অবশ্যই আমার কাছে নিয়ে এসে রাখতাম। যে মানুষটা প্রতি মাসে তোমাকে দেখতে আসতো, তিনিই তোমার বাবা? আর এতদিন যে টাকা গুলো তুমি পাঠাতে সেগুলো তোমার বাবার কাছে?

–জি স্যার বাবা অনেক অসুস্থ ছিল। প্রতিদিন অনেক টাকার ঔষধ লাগতো। আমি সেগুলো বাবার চিকিৎসার জন্য পাঠাতাম। আমাদের এলাকার একজনকে বাবার দেখাশোনার জন্যও রেখেছিলাম।

–তোমার বাবা জানতো তুমি টাকা পাঠাতে?

–জানতো স্যার।

–তিনজন মানুষ তিনজনকে এতটা ভালোবাসলে অথচ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হলে তাইয়ান! তোমাদের জেদের কাছে হেরে গেল ভালোবাসা। তা কি ঠিক করলে বাবাকে দেখতে যাবে না।

–যাব না স্যার।

–কেন?

–না সে বাবার মতো বাবা হতে পেরেছে। আর না আমি সন্তানের মতো সন্তান হতে পেরেছি। আমাদের জীবনের ছন্দ বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছে। আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

–এই যে এখানে এসে বসেছিলে?

–কাছেই তো ছিলাম স্যার।

–যার তৈরি হয়ে নাও।

–আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না৷

–বেশ তবে আমিও যাব তোমার সাথে চলো।

–আজকে আপনার জীবনের একটা বিশেষ দিন স্যার! আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের জন্য এত সুন্দর মুহুর্ত নষ্ট করবেন না। কিছু সময় জীবনে বারবার আসে না।

–আমি আর মেহেভীন বেঁচে থাকলে এমন হাজারটা মুহুর্ত কাটাতে পারব। কিন্তু তোমার বাবা পরপারে গমন করেছে! আজকের পর তুমি চাইলেও আর তোমার বাবাকে দেখতে পারবে না৷ আমি থাকতে তোমাকে এই আক্ষেপ নিয়ে বাঁচতে দিব না। তুমি তৈরি হয়ে না আমি গাড়ি বের করতে বলছি।

–আমি কোথাও যাব না স্যার।

–তোমার থেকে অনুমতি চাইছি না তাইয়ান।

–এখন গেলে কখন ফিরব?

–তোমার বাবা কখন মা-রা গিয়েছে?

–আপনাদের বিদায়ের সময় ফোন দিয়ে জানিয়েছে বাবা আর নেই।

–তাহলে কাল সকালে আসব।

–আপনি আজ আমার সাথে গেলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। তাইয়ানের আরো কিছু বলার ছিল। কিন্তু কথাগুলো কণ্ঠনালিতে এসে আঁটকে গেল।
মুনতাসিমের রাগান্বিত দৃষ্টি উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই। মুনতাসিম মেহেভীন আর রিয়াদ চৌধুরীকে জানিয়ে তাইয়ানকে নিয়ে চলে গেল। মেহেভীনকে মুনতাসিমের কক্ষে রেখে গেল শেহনাজ। সবকিছু দেখিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল। তাইয়ানের বাবার জন্য ভিষণ খারাপ লাগছে মেহভীনের। তাইয়ান বড় ভাইয়ের মতো সব সময় মেহেভীনকে সাপোর্ট করে গিয়েছে। অদ্ভুত ভাবে তাইয়ানের জন্য মনের গহীনে সফট কর্ণার কাজ করছে। মেহেভীন পুরো কক্ষে চোখ বুলিয়ে নিল। সমস্ত কক্ষ জুড়ে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুবাস মস্তিষ্ককে মাতাল করে তুলছে। মেহেভীন আস্তরনের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ ফুলের সুবাস নিল। ব্যাগ থেকে বস্ত্র বের করে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

কোলাহলের মাত্রা সময়ের সাথে প্রকোপ হতে শুরু করেছে। সারাদিন গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। তবুও তাইয়ান আর মুনতাসিমের দেখা মিলেনি চৌধুরী গৃহে। দু’জনকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। কাল থেকে মেহেভীনের মনটা স্বাভাবিক থাকলে-ও সময়ের সাথে মনের মধ্যে ভয় জেঁকে বসছে। মনের সুখ গুলোকে আঁধারে ঢেকে নিয়েছে আতঙ্কের কালো ছায়া। মানুষটাকে এক নজর দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে৷ মানুষটাকে ছাড়া আজকাল নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে মেহেভীনের। বিষাদের ভরপুর হয়ে উঠল মন, মস্তিষ্ক। কারো সাথে সুসম্পর্ক না থাকায় মুখ ফুটে বলতেও পারছে না। তখনই মেহেভীনের কর্ণকুহরে এসে কিছু বাক্য পৌঁছল।

–মুনতাসিম কি এই বিয়েতে রাজি ছিল না? রিয়াদ কি তার ছেলেকে জোর করে বিয়ে দিল? যার কারনে বিয়ের রাতে বউ রেখে কাউকে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে গেল! আজকাল কার বাবা-মা গুলোও হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়েতে মত থাকে না। জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় আর ছেলে মেয়েরা বিয়ের পরে প্রেমিক, প্রেমিকার লগে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। কথা গুলো মাটিতে পড়ার আগেই জ্বলে ওঠা কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।

–আমি নিশ্চয়ই আপনার মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়েছিলাম। তা না হলে আপনি কিভাবে জানলেন? আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না! আবার আমার প্রেমিকা ও আছে! কাইন্ড ইওর ইনফরমেশন বিয়েটা আমার পছন্দেই হয়েছে। আমাকে জোর করে কোনো কিছু করানোর ক্ষমতা কারো নেই। কারো সম্পর্কে কোনো কিছু মন্তব্য করার আগে, সবকিছু জেনে তারপর মন্তব্য করবেন৷ যারা না জেনে শুনে অন্যের নামে কটু কথা রটায়। আমি তাদেরকে ভয়ংকর রকমের ঘৃণা করি। আপনি বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছেন। আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য আসেন নি। যে কাজে এসেছেন সে কাজ করুন। মুনতাসিম ব্যক্তিগত জিনিস ব্যক্তিগত রাখতে পছন্দ করে। আপনি যদি আমার বিষয়ে আর একটা বাজে কথা বলেছেন। তাহলে আমি ভুলে যাব আপনি আমার গুরুজন। এই সময়ে মুনতাসিমের উপস্থিতি একদমই আশা করেনি মহিলাটি৷ সে মেহেভীনকে আঘাত করার জন্য সুযোগ বুঝে কথা গুলো বলেছে। মুনতাসিমকে দেখে ভয়ে চুপসে গেল সে। ভীরু দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের উত্তপ্ত মস্তিষ্ক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যস্ত। মুহুর্তের মধ্যে আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে করে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। মুনতাসিমকে দেখে মেহেভীনের জানে পানি আসলো। সে খুব সংগোপনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় উথাল পাথাল করা হৃদয়টা মুহুর্তের মধ্যে শান্ত নদী হয়ে গেল। মুনতাসিমের পাশেই বিধস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তাইয়ান। ছেলেটার সমস্ত মুখশ্রীতে মলিনতা ছেয়ে গিয়েছে। খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, যে কারো বুক কেঁপে উঠবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মহিলাটি বলল,

–আমার ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আমি না বুঝেই তোমার মন্তব্য করে ফেলছি। সবকিছু না জেনেশুনে আমার এভাবে মন্তব্য করা উচিৎ হয়নি।

–এরপর থেকে কারো সম্পর্কে কোনো কিছু বলার আগে বুঝে শুনে বলবেন। কথা গুলো বলেই তাইয়ানের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো মুনতাসিম। মহিলাটি আড়দৃষ্টিতে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। মুনতাসিম তাইয়ানের হাত ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন তাইয়ান। তুমি কক্ষ গিয়ে ঘুমিয়ে নাও। আমি সবাইকে বলে দিব৷ তোমার কক্ষের কাছে কেউ যেন কোলাহল না করে।

–আমি ঠিক আছি স্যার, সমস্যা নেই।

–তোমার থেকে কোনো কথা শুনতে চেয়েছি। আমার চোখের সামনে থেকে যাও। মুনতাসিমের কড়া কণ্ঠে বলা কথা গুলো তাইয়ানের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। সেই সাথে অভিমান এসে ভিড় জমালো মনে। মনের গহীনে থেকে ভিষণ করে বলতে ইচ্ছে করছে, “আপনি এত পাষাণ কেন স্যার? সব সময় কঠিন কঠিন কথা বলেন। আজকে অন্তত একটু নরম হতে পারতেন। আপনি আমার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মৃত্যু আগ পর্যন্ত আপনার পাশে ছায়ার মতো লেগে থাকব৷ আপনার রাগের মধ্যে, গম্ভীর কণ্ঠ স্বরের মধ্যে এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা খুঁজে পাই। এত ভালোবাসা পাবার পরে কিভাবে আপনার সাথে বেইমানি করব স্যার? আপনি আমার সব পথ বন্ধ করে দিলেন। আপনার মতো মানুষের সাথে বেইমানি করার আগেই আমার মৃত্যু আসুক। তবুও বেইমানি না আসুক। তাইয়ান বিলম্ব করল না দ্রুত পায়ের কক্ষে চলে গেল।

পার্লারের মেয়েরা চলে এসেছে। সন্ধ্যায় আজকে চৌধুরী গৃহে অনুষ্ঠান করবে। শেহনাজ মেহেভীনকে নিয়ে সাজতে যাচ্ছিল। তখনই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–মেহেভীনকে আমার কক্ষে আসতে বল।

–কিন্তু ভাই পার্লারের মেয়েরা চলে এসেছে। সাজাতে সময় লাগবে। সন্ধ্যা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে। আপনি ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিন। মুনতাসিম কোনো উত্তর করল না। ক্লান্ত মস্তিষ্ক নিয়ে কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।

চারিদিক আঁধারে আচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। রাইমা বেগমের সাথে কয়েকজন স্বজন এসেছে মেহেভীনকে নিয়ে যেতে। মেহেভীনকে মেরুন রঙের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে। সমস্ত কায়া ভর্তি বাহারি রকমের অলঙ্কার পড়ানো হয়েছে। মেহেভীনের এমন রাজরানীর মতো রুপ দেখে মায়ের চক্ষু শীতল হয়ে গেল। অজানা অনুভূতিতে ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠছে। রাইমা বেগম মেয়ের পাশে বসলেন। আজ খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে। তার মেয়েটা কেমন আছে? নিজের ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–কেমন আছিস মা?

–আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি মা। তুমি ভরসা করে আমায় পাঠিয়েছ। আমি কি খারাপ থাকতে পারি? তোমার রাতে একা থাকতে কোনো সমস্যা হয়নি তো আবার? প্রাপ্তি আপুর আম্মু তোমাকে কোনো কথা শুনিয়েছে? আমার কাছে কিছু লুকাবে না বলে দিলাম।

–আমার গৃহ ভর্তি এত মানুষ ছিল। ক্ষতি করার সাহস কার আছে শুনি? তা আমাকে দেখে কাঁদছিস না যে!

–তুমি তো কালকে বললে আমি বাচ্চাদের মতো আচরণ করছি।

–তাই এক রাতে বড় হয়ে গেলি?

–হয়তো!

–মায়ের ওপরে অভিমান হয়েছে?

–না।

–তোর ভালোর জন্যই আমাকে শক্ত হতে হয়েছে মা। আমার কথা মনে রেখে কষ্ট পাস না। তোর সাথে যদি আমিও কান্না করতাম। তাহলে পরিস্থিতি খারাপ দিকে চলে যেতো। কালকে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। কালকে জীবনের প্রথম আমি এত কেঁদেছি জানিস! তুই চলে আসার পর আমার বুকটা খালি খালি লাগছিল। আমার ইচ্ছে করছিল ছুটে চলে আসি তোর কাছে। মায়ের নরম কণ্ঠে বলা কথা গুলো মুহূর্তের মধ্যে মেহেভীনের মন গলিয়ে ফেলল। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই মাকে জড়িয়ে ধরল। মেহেভীনের মা পরম যত্নে মেয়ের ললাটে চুমু খেল। তখনই মুনতাসিম এসে সেখানে উপস্থিত হলো। মুনতাসিম রাইমা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করে সেখানে বসলো। রাইমা বেগম বললেন,

–আজকে মেহেভীনকে নিয়ে যেতে দিবে না বাবা?

–না, আমি কালকে গিয়ে আপনার কাছে রেখে আসব।

–তাহলে দেরি না করি চলে যাব।

–আপনাকেও যেতে দিব না। আপনি যদি আজ চলে যান। তাহলে আমি ভিষণ রাগ করব।

–মেহেভীনের নানির বাড়ি থেকে অনেক স্বজন এসেছে। আমি তাদের রেখে কিভাবে থাকি বলো বাবা? আমাকে আজ যেতে হবে। পরে না হয় মেহেভীনের সাথে এসে থাকব।

–কথা দিন।

–কথা দিলাম। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। রাইমা বেগম অদ্ভুত ভাবে দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মায়ের দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারছে না মেহেভীন। তার মা তো কোনোদিন তাকে এভাবে দেখেনি। তবে আজ এভাবে দেখছে কেন? অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো শব্দও উচ্চারিত হচ্ছে না। ভেতর অনেক কথা কিন্তু তা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে মেহেভীন।

আস্তে আস্তে সমস্ত গৃহ ফাঁকা হতে শুরু করেছে। রাত যত গভীর হচ্ছে কোলাহল ততই কমছে। অর্ধেক বাসা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। কালকের ন্যায় আজ-ও মুনতাসিমের কক্ষটা সাজানো হয়েছে। মেহেভীন আস্তরণে বসে ছিল। তখনই মুনতাসিম আসে। মুনতাসিমের রাগ সম্পর্কে সবাই অবগত রয়েছে। সেজন্য কবাটে টাকার নেওয়ার ঝামেলা কেউ করেনি। মুনতাসিম এসে মেহেভীনের পাশে বসলো।

–আপনি কি রাগ করেছেন? আমি কালকে ওভাবে তাইয়ানের সাথে চলে যাওয়াতে?

–আমি হচ্ছে একজন মানুষ। আর একজন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে যেটা বেশি থাকা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে মনুষ্যত্ব যা আমার আছে। আমি এতটা বিবেকহীন হয়ে যাইনি যে, এমন হৃদয়ভাঙা খবর শুনেও রাগ করব! আপনাকে প্রচুর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।

–আপনাকেও ভিষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এসব ভারি অলঙ্কার আর লেহেঙ্গা বদলে রেগুলার ইউজ করার বস্ত্র পরিধান করুন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন শান্তি অনুভব করল। সে দ্রুত উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরিধান করে বের হলো মেহেভীন। মেহেভীন বের হতেই মুনতাসিম ফ্রেশ হতে চলে গেল। মেহেভীনের ভেতরে ভিষণ অস্বস্তি কাজ করছে। অদ্ভুত ভাবে সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। এতক্ষণ তো স্বাভাবিকই ছিল সবকিছু। কিন্তু এখন অস্বাভাবিক ভাবে ভয় লাগছে কেন তার! ওয়াশরুমের কবাট খুলার শব্দে চমকে উঠল মেহেভীন। দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা চলছে।

–আপনি কি ভয় পাচ্ছেন ম্যাডাম?

–না।

–আমি তো দেখতে পাচ্ছি। আপনি ভয় পাচ্ছেন৷ আপনি ভয় পাবেন না ম্যাডাম। আপনার আঁখিযুগলে আমার প্রতি ভয় নয় ভরসা দেখতে চাই। আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার ছায়ার ওপর দিয়েও আমি হাঁটব না। মুনতাসিমের পুরোটাই ভালোবাসাময় চাই। সেখানে এতটুকু ভালোবাসার কমতি থাকবে, সেটা আমার চাই না।

–আমি কি আপনাকে সে কথা একবারও বলেছি?

–তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঘুমিয়ে পড়ুন। কি অদ্ভুত! মেহেভীনের বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে এসে আঁটকে যাচ্ছে। সে দৃষ্টি লুকিয়ে আস্তরণে গিয়ে উঠে বসলো। ভয়ে সমস্ত কায়া অবশ বয়ে আসছে। এই ভয়ের সমীকরন মিলছে না মেহেভীনের। এর আগেও সে কত সুন্দর সময় মুনতাসিমের সাথে কাটিয়েছে। তখন তো ভয় লাগেনি। তবে আজ কেন ভয় লাগছে? মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। হয়তো মেহেভীনের ভয় আর অস্থিরতা তার মনটাকে পোড়াচ্ছে। মেহেভীন মুনতাসিমের সরে যাওয়ার কারন উপলব্ধি করতে পেরে আড়দৃষ্টিতে তাকালো৷ সে তো স্বাভাবিক হতেই চাইছে। কিন্তু তার অনুভূতিরা তার সাথে ছলনা করছে। কিছুতেই স্নিগ্ধ অনুভূতিতে এসে ধরা দিচ্ছে না৷ মেহেভীন উঠে মুনতাসিমের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মুনতাসিম আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,

–না ঘুমিয়ে উঠে আসলেন যে?

–আপনি এখানে আসলেন কেন? আপনাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি দু’টো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। এভাবে রাতে ঘুম না হলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

–আমার অভ্যাস আছে। একটু আগে কি বলেছি শুনতে পাননি। আমাকে দেখে আপনার ভেতর ভয় বা জড়তা কাজ করুক এটা আমি চাই না। আমার জন্য আপনার মধ্যে ভয় দেখলে ভেতরটা আমার পুড়বে। মেহেভীন নিশ্চুপ হয়ে গেল। সে তার অনুভূতিটা কিভাবে মুনতাসিমকে বোঝাবে। অনুভূতি এমন একটা জিনিস যা সহ্য করা যায়৷ আর না কাউকে বোঝানো যায়।

–আসলে প্রথবার বিয়ে করেছি। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে গিয়েও অনুভূতির কাছে ব্যর্থ হয়ে, অস্বাভাবিক হয়ে উঠছি।

–আর আমার এটা চার নাম্বার বিয়ে তো তাই আমি স্বাভাবিক আছি। মুহুর্তের মাঝে মেহেভীনের মন মস্তিষ্ক জ্বলে উঠল। সাথে নিজের বলা বোকা বোকা কথা গুলোর জন্য নিজের ওপরেই বিরক্ত হলো মেহেভীন। সে রক্তিম চোখে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিম আড়দৃষ্টিতে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেহেভীনের মুখশ্রী দেখে ভিষণ হাসি পাচ্ছে তার৷ মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কি বললেন আরেকবার বলেন?

–আজকে আপনাকে ভিষণ সুন্দর লাগছিল৷ আপনার রুপের সৌন্দর্যকে ভেদ করে, আপনার ভেতরে বিলীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। আপনার মতো সুন্দর নারী আমি আমার জীবনে দু’টো দেখিনি। আমার অস্তিত্ব বলতে যতটুকু ছিল। আপনাকে দেখার পরে আপনি তা গ্রাস করে ফেলছেন।

–এসব মন গলানো কথা বলে লাভ নেই। বাজে লোক একটা! খুব শখ তাই না চার টা বিয়ে করার?

–এটা প্রতিটি পুরুষের স্বপ্ন আমি ছাড়া। কারন আমার বউ আছে। মেহেভীন রেগে মুনতাসিমের হাত ধরে কক্ষ নিয়ে আসতে যাবে। তখনই মুনতাসিম হাত সরিয়ে মেহেভীনের দিকে ঘুরবে, এমন সময় মেহেভীনের হাত মুনতাসিমের হাত স্পর্শ করতে পারে না। মেহেভীন শান্ত গলায় বলল,

–আমাকে স্পর্শ করবেন না। আপনার হাত নোংরা হয়ে যাবেন। কথা গুলো বলেই কক্ষের দিকে অগ্রসর হতেই মুনতাসিম মেহেভীনের হাত ধরে ফেলল।

–এটা আপনি কেমন কথা বললেন ম্যাডাম? কখনও কখনও আপনার স্পর্শ পাবার তৃষ্ণা এতটা প্রকট হয় যে, মনে হয় আপনি যে পথ দিয়ে হেঁটে যান। সেই পথের ধুলাবালি হয়ে যাই।

–তাহলে হাত সরিয়ে নিলেন কেন?

–হাত সরিয়ে নেইনি। আপনার দিকে ঘুরতে যাচ্ছিলাম। তখনই আপনি হাত বাড়িয়েছেন৷ সেজন্য আপনার হাত আমাকে ছুঁতে পারেনি। যেদিন আমার অধিকার নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াব। সেদিন আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন না। মুনতাসিমের শীতল কণ্ঠে বলা কথা গুলো মেহেভীনের মুখের ভাষা কেঁড়ে নিল। সে ধীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার কায়াতে শীতের বস্ত্র নেই। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লাগবে। কক্ষ চলুন ঘুমাব। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে মুনতাসিম মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরল। আচমকা জড়িয়ে ধরাতে কেঁপে উঠল মেহেভীনের সর্বাঙ্গ। মুনতাসিম মেহেভীনের কর্ণের কাছে গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, শীতল কায়াকে উত্তপ্ত করে নিতে জানি ম্যাডাম। উস্কে দেওয়া মূলক কথা কম বলবেন। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের ললাটে চুমু খেল। মেহেভীনের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। ধীর গতিতে কাঁপছে সে। শক্তি গুলো ক্ষয় হতে শুরু করেছে। সে আদুরে বিড়ালের মতো মুনতাসিমের বুকে লেপ্টে আছে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে