#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
“আমি এই খ্যাত মেয়েকে বিয়ে করবো না আব্বা। আগে যদি জানতাম আপনারা এই গাইয়া মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করছেন। তাহলে কোনোদিন এই বিয়েতে রাজি হতাম না। আমি তো ভেবে ছিলাম। মেহভীনের চাচাতো বোন প্রাপ্তির সাথে, আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। প্রাপ্তিকে কল্পনা করেই এই বিয়ে বাড়িতে আসছি। বিয়ে করলে আমি প্রাপ্তিকেই করবো।” আয়মানের কথায় পুরো বিয়ে বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেল। কোলাহলে পরিপূর্ণ পরিবেশটা মুহুর্তের মধ্যে শীতল হয়ে উঠলো। সবাই আয়মানের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। বধু সাজে মেহেভীন আঁখি জোড়া ছোট করে আয়মানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। শেষ মুহুর্তে এসে মানুষটা কি বলছে! মেহভীনের ভাবনার মাঝেই আয়মানের বাবা আমান চৌধুরী বজ্রকণ্ঠে বললেন,
” তোর সাহসের তারিফ করতে হয়! তুই বিয়ে করতে এসেছিস। কাকে বিয়ে করতে এসেছিস? সেটা তুই জানিস না! আমাদের সাথে মজা করছিস। আমার কথার ওপরে কথা বললে, তোর দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দিব। প্রাপ্তিকে নয় মেহেভীন কেই তোকে বিয়ে করতে হবে। আমার কথাই শেষ কথা। আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। ” বাবার কথা কর্ণকুহরে আসতেই জ্বলে উঠলো আয়মান। সে রাগান্বিত হয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি আমাকে চিনেন না আব্বা। আপনার ছেলে একবার যেটা চায়। সেটা না পেলে সবকিছু ধংস করে দেয়। আমি প্রাপ্তিকে ভালোবাসি প্রাপ্তি ও আমাকে ভালোবাসে। আপনারা সবাই মিলে আমাদের পথের কাটা হলেন কেনো? প্রাপ্তিকে রেখে মেহেভীন কে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ” আয়মানের কথা শেষ হবার সাথে সাথে প্রাপ্তি এসে ক’ষে আয়ামের গালে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। আকষ্মিক ঘটনায় সবার চক্ষু চরগাছে। আয়মান মুগ্ধ নয়নে প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেয়েটা এতটা সুন্দর যে তাকে দেখলেই আয়মানের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। অনুভূতিরা আনন্দে মেরে উঠে। পুরো শরীর শীতল হয়ে আসে। আয়মান গালে হাত দিয়ে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে প্রাপ্তিকে দু’নয়ন ভরে দেখছে। আয়মানের মুগ্ধতার মাঝে প্রাপ্তি ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলল,
“আপনার সাহস হয় কি করে? আপনি আমার নামে মিথ্যা কথা বলছেন! আমি কবে বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি? আপনি আমার ছোট বোনের হবু স্বামী। সেখানে আপনাকে ভালোবাসা তো দূর আপনাকে নিয়ে কল্পনা করা-ও পাপ। আমি জেনেশুনে কেনো পাপ কাজ করতে যাব! ” প্রাপ্তি অসম্ভব ভাবে রেগে গিয়েছে। মেয়েটা সত্যি কথা বলতে ভালোবাসে মিথ্যার সাথে কোনোদিন আপস করেনি। আজকে ও মিথ্যার সাথে আপস করবে না বলে, প্রতিবাদ করতে শুরু করে দিল। আয়মান প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টিপাত করেই বলল,
“তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবে না প্রাপ্তি। আমি তোমাকে ভালোবাসবো তাহলেই হবে। আমি তোমাকে এতটা ভালোবাসা দিব যে, তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা ও করতে পারবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে, আমাকে তোমার বিয়ে করতেই হবে। আমাকে বিয়ে না করলে তোমার পরিনতি কি ভয়াবহ হবে। তা তুমি কল্পনা ও করতে পারছো না। আমার সোজা কথায় রাজি হয়ে যাও। না হলে আমি বাঁকা পথে হাঁটতে বাধ্য হব। ” আয়মানের কথায় প্রাপ্তির মস্তিষ্ক ঘৃণার রি রি করে উঠলো। প্রাপ্তি আয়মানকে প্রহার করতে যাবে। তার আগেই আয়মানের বাবা আয়মানকে লোহার রোড দিয়ে মা’র’তে শুরু করল। আয়মান মা’র খেতে খেতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তবুও তার মুখে একটাই কথা আমি প্রাপ্তিকে বিয়ে করবো। প্রাপ্তি ছাড়া আমার শহরে অন্য কোনো নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। আয়মানের নাক দিয়ে গলগল করে র’ক্ত ঝাড়ছে। আমান চৌধুরী হুংকার ছেড়ে বলল,
“কু’লা’ঙ্গা’র আমি তোকে জন্ম দিয়েছি। এসব দিন দেখার জন্য! আমার মান-সন্মান বলতে কিছু রাখবি না। ফরিদ ভাইকে এখন আমি কি জবাব দিব? তোর জন্য এত গুলো মানুষের মুখের হাসি নিমিষেই বিষাদে পরিনত হবে। ” আমান চৌধুরীর কথায় আয়মান গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“আমি কাকে বিয়ে করতে চাই। সেটা তোমরা আমার থেকে জেনে নাওনি। এটা কি আমার দোষ অবশ্যই তোমাদের দোষ। তোমরা না জেনেশুনে কেনো মেহোভীনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলে? ” আয়মানের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আমান চৌধুরী আয়ামের বুকের ওপর লা’থি দিয়ে বলল,
“তোমাকে বারবার করে বলেছি। আমরা তোর বিয়ে ফরিদ ভাইয়ের মেয়ের সাথে ঠিক করেছি। তোর মনে যদি প্রাপ্তিই ছিল। তাহলে তখন কেনো বলিসনি কু’লা’ঙ্গা’র?” আয়মানের সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। সে নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
“আমি তো ভেবেছিলাম ফরিদ চাচার মেয়েই প্রাপ্তি। তাই খুশিতে কিছু বলি নাই। নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাবার মতো সুন্দর অনুভূতি দু’টো নেই। আমার অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছিল। তাই জানার সুযোগ পায়নি প্রাপ্তি আসলে কার মেয়ে। আজকে বিয়ের আসরে জানতে পারলাম প্রাপ্তি মেহভীনের বড় চাচার মেয়ে। এখানে আমার দোষ কোথায় আব্বা? আয়মানের কথায় ফরিদ রহমান এগিয়ে আসলেন। গম্ভীর মুখশ্রী করে বললেন,
” তুমি কাকে ভালোবাসো সে কার মেয়ে সেটা তুমি জানো না। আবার বলছো তোমার দোষ কোথায়? তুমি সবকিছু না জেনেশুনে কেনো বিয়ে করতে আসছো? তুমি কি ছোট বাচ্চা তোমাকে জোর করে বিয়ে করাতে নিয়ে আসছে। কাকে তুমি গ্রামের খ্যাত মেয়ে বলো! আমার মেয়ের পায়ের নখের যোগ্যতা-ও তোমার নেই। সেই ছেলের মুখে এমন কথা মানায় না। আমার মেয়ের যে সন্মান নষ্ট হলো তা আপনারা ফিরিয়ে দিতে পারবেন? যে ছেলের বাবার বিরুদ্ধে কথা বলে, এমন কা’পু’রু’ষে’র সাথে, আমিও আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই না। তবে রহিম ভাই যদি চায়। তাহলে তোমার মতো কু’লা’ঙ্গা’রের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন। ” ফরিদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে রহিম রহমান ফরিদের দিকে এগিয়ে আসলেন। ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে ভাইকে রেগে যেতে নিষেধ করলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়া’লা উত্তম পরিকল্পনা কারী। তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন। হয়তো আয়মানের সাথে বিয়ে হলে, মেহভীন সুখী হতে পারতো না। তাই আল্লাহ তায়ালা নিজ দায়িত্বে বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছেন। রহিম রহমান একটু ধর্মীয় ধরনের মানুষ। তিনি সবকিছু ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দেন। তিনি বিশ্বাস করেন আল্লাহ যা কেঁড়ে নিয়েছেন। তার থেকে দিগুণ অতি শীঘ্রই ফিরিয়ে দিবেন। রহিম রহমানের ভাবনার মাঝেই প্রাপ্তি বলে উঠলো,
“যে ছেলের মাথায় সামান্য বুদ্ধিটুকু নেই। ঢাকা শহর থেকে পড়াশোনা করে এসে এত অহংকার দেখায়। সেই ছেলের হাতে আমাদের পরিবারের কোনো মেয়েকে তুলে দেওয়া হবে না। ” মেহেভীন পুতুলের ন্যায় বসে আছে। আজকে সত্যিই মেহেভীনকে পুতুলের মতো লাগছে। ফর্সা শরীর টায় মেরুন রঙের লেহেঙ্গা টা দারুণ মানিয়েছে। গা ভর্তি সোনার অলঙ্কার যা মেহেভীনের সুন্দর্য দিগুন বাড়িয়ে তুলেছে। মেহেভীন বাবা-মায়ের ওপরে একটা কথা বলতে পারে না। বলতে গেলে একটু বোকা ধরনের মেয়ে মেহেভীন। তবে আজকের পরে কি আদৌও বোকা থাকবে মেহেভীন। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই প্রাপ্তি এসে মেহেভীনের পাশে বসে মেহেভীনের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখ মেহেভীন তোর বিসিএস পরীক্ষার মেসেজ এসেছে। কালকে তোর পরীক্ষা তোর না অনেক স্বপ্ন ছিল। তুই একদিন ম্যাজিস্ট্রেট হবি। তোর স্বপ্ন পূরণের সময় এসে গিয়েছে। আমি জানি তুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবি। তোর যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া আছে। এই ছেলেকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না। আমান চৌধুরী এত বোকা নয়। ঠিক কৌশলে ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলবে। তুই এই বিয়ে করলে কোনোদিন সুখী হতে পারবি না৷ একজনকে মনে রেখে অন্য জনের সাথে সংসার করা যায় না রে। ” প্রাপ্তির কথায় মেহভীন অসহায় দৃষ্টিতে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। সে যদি বিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। তাহলে তার পরিবারের সম্মানের কি হবে? সমাজ যে তার বাবাকে কটু কথা শোনাবে। পরিবারের অসন্মান যে সে সহ্য করতে পারবে না। আজকে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে মেহেভীনের। এক চোখে পরিবার অন্য চোখে নিজের এত বছরের স্বপ্ন। ভেতর থেকে ভিষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে মেহেভীন। আঁখি জোড়া ভিজে আসছে। পুতুলের ন্যায় চেহারায় মলিনতা এসে ধরা দিয়েছে। মেভীনের ভাবনার মাঝেই মেহেভীনের মা রাইমা বেগম বললেন,
“যে ছেলে ভরা লোকজনের সামনে আমার মেয়েকে ছোট করতে পারে। সেই ছেলে বিয়ের পরে আমার মেয়ের কি অবস্থা করবে। সেটা আমাদের ভালো করে জানা হয়ে গিয়েছে। আমার মেয়ে তো ফেলে দেওয়ার জিনিস নয়। যে যার তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাব। আপনার ছেলে যাকে পছন্দ করে, তার সাথেই আপনার ছেলের বিয়ে দিন। ” রাইমা বেগমের কথা শুনে আমান চৌধুরী নরম কণ্ঠে বললেন,
“আমার মেহেভীনকে পছন্দ। আমার বাড়ির বউ হলে মেহেভীনই হবে। আয়মানকে বিয়ের জন্য রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আমিও দেখবো আয়মান কিভাবে মেহেভীনকে বিয়ে না করে। ” আমান চৌধুরীর কথায় জ্বলে উঠলো ফরিদ রহমান। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
“আপনার ছেলের সাথে জোর করে আমার মেয়ের বিয়ে দিবেন। আর বিয়ের পরে আপনার ছেলে আমার মেয়ের ওপরে অত্যাচার করবে। এটা আমাদের দেখতে হবে। সেটা যদি ভেবে থাকেন। তাহলে আপনার ধারনা ভুল। ” ফরিদ রহমানকে আশ্বস্ত করে আমান চৌধুরী বললেন,
“আপনার মেয়ের ভালো থাকার দায়িত্ব আমি নিলাম। বিয়ের পরে আমার ছেলে যদি আপনার মেয়ের শরীরে একটা ফুলের টোকা দেয়। তাহলে আপনি আমাকে যা শাস্তি দিবেন। আমি আপনার সব শাস্তি মাথা পেতে নিব। ” আমান চৌধুরীর কথায় পরিবেশে প্রাণ ফিরে এলো। আয়মান প্রাপ্তিকে ছাড়া কাউকে বিয়ের করতে চাইছে না। তবুও জোর করে বিয়ে ব্যবস্থা করা হলো। বিয়ের জন্য পাত্রীকে নিয়ে আসার জন্য বলা হলে, কক্ষে গিয়ে কেউ মেহেভীনকে পায় না। মেয়েটা তো বিয়ের আসরেই ছিল৷ তাহলে মুহুর্তের মধ্যে কোথায় গেল। মেহেভীনের কক্ষ ভালো করে দেখতে গিয়ে বিছানার ওপরে বিয়ের সব শাড়ি গহনা দেখতে পেল রাইমা বেগম। শাড়ির ওপরে একটা চিঠি রাইমা বেগম চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল,
“প্রথমেই আমি তোমাদের থেকে মাফ চেয়ে নিচ্ছি আব্বু আম্মু। তোমরা আমার সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ে করেছো। যে আমাকে সন্মান দিতে জানে না। আমি জানি আমি ভিষণ বোকা। তবে এতটাও আত্মসম্মান হীন না যে আমাকে সন্মান করে না। তাকে আমার বিয়ে করতে হবে। জীবনে কখনো তোমাদের কথার বাহিরে যাই নাই। বলতে পারো পরিবারের মধ্যে আমি একমাত্র বাধ্য মেয়ে ছিলাম। তোমাদের বাধ্য মেয়েটা ও আজ ভিষণ অবাধ্য হয়ে গিয়েছে আম্মু। বাবার সামনে কথা গুলো বলার সাহস ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে চিঠি লিখলাম। চিঠটা যেই পাক না কেনো আশা করি সে আমার বাবা-মা পর্যন্ত চিঠিটা পৌঁছে দিবে। নিজেকে এতটা নিতে নামাতে পারলাম না। আমার পক্ষে এই বিয়েটা করা সম্ভব নয়। অনেক তো হলো অন্যের ইচ্ছে কে প্রাধান্য দেওয়া। এবার না হয় নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিলাম। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চলে গেলাম। কেউ আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করবে না। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে। যে নিজের অজান্তেই হারিয়ে যায়। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে নিজ থেকে হারিয়ে যায়। তাকে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। ” (ইতি মেহেভীন)
চিঠিটা পড়ে রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো। সে খুব সাবধানে চিঠিটা লুকিয়ে ফেলল। মুহুর্তের মধ্যে বাসার মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল।
চলবে….