গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ০৫!
লেখক: তানভীর তুহিন!
মিছিল আজ তাড়াহুড়ো করেই তাড়াতাড়ি ভার্সিটি এসেছে। কেনো এসেছে তা সে জানে না। কিন্তু আজ কেনো যেনো একটু তাড়াতাড়ি’ই আসতে ইচ্ছে করছিলো তার। খুব ইচ্ছে করছিলো, অথচ সে কিন্তু ক্লাস শুরু হবে হবে সে মুহুর্তে ভার্সিটিতে ঢোকে।
মিছিল স্কুটারটা ধীর গতিতে চালিয়ে পার্কিং অবধি যাচ্ছে। চোখদুটো শুধুই মুবিন মুবিন করছে। কেনো করছে তা সে জানে না। বুকটাও ধুম্মুর-ধাম্মুর করে লাফানোর জন্য মুবিনটাকে চাইছে। কারন মুবিনকে না দেখে মিছিলের বুক ওভাবে উন্মাদ হতে পারে না। মাত্র একদিনে যে মুবিন ছেলেটা তাকে কী জাদু করলো, কে জানে?
২৫ মিনিট যাবৎ মিছিল ভার্সিটিতে এসেছে। ক্লাসে বসে সবার সাথে টুকটাক কথা বলছে। গতকাল মুবিন বলছিলো না মিছিল ক্লাসে কেমন চুপচাপ থাকে। আসলেই মিছিল চুপ করেই থাকতো ক্লাসে। তার কারন হলো মিছিল ভর্তির তিন মাস পরে ভার্সিটিতে এসেছে। সবাই কেমন যেনো একদম মিলেমিশে গেছে একে অপরের সাথে। অথচ সে? সে তো কাউকে চেনেই না! তাই মিছিল একপ্রকার বাধ্য হয়েই একা বসে থাকতো। মিছিল ভেবে নিয়েছিলো সবার সাথে ধীরেসুস্থে ভাব জমাবে সে। কারন মিছিল মোটেই বন্ধুবান্ধব ছাড়া থাকতে পছন্দ করে না। কিন্তু গতকাল মুবিনের কথা শুনে সে বুঝেছে যে ক্লাসের মেয়েরা সবাই’ই তার সাথে কথা বলতে আগ্রহি। অথচ তারা কেউ কথাই বলেনি। তাই আজ মিছিলই সবার সাথে কথা বলে নিয়েছে। মিছিলের চোখ দুটো মুবিনকে খুজতে খুজতে এক প্রকার ক্লান্ত হয়ে গেছে। এতোক্ষনে তো এসে যাবার কথা। শাওন-সীমান্ত’ও তো আজ আসেনি। তাহলে কী আজ আসবে না? মিছিলের যে কী পরিমান অস্থির লাগছে তা শুধু মিছিলের অন্তরাত্মাই ভালো জানে। মনে হচ্ছে কেউ পিস্তলের নলের সামনে মাথা ঠেকিয়ে ট্রিগারে নিজেরই আঙুল বেধে দিয়েছে। মিছিলের সব অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে মুবিন ক্লাসে ঢুকছে। মিছিলের এখন ইচ্ছে করছে উঠে দাঁড়িয়ে মুবিনের কলার চেপে জিজ্ঞেস করতে, ” এই হারামাজাদা এতোক্ষন কই ছিলি? ” কিন্তু সে কেনই বা জিজ্ঞেস করবে? কে হয় মুবিন তার? একদিনেই কীভাবে সে মুবিনের প্রেমে পড়ে যেতে পারে? সে তো একটা মেয়ে তাইনা? আর মেয়েরা তো একটু রয়েসয়ে তারপর প্রেমে পড়বে, এটাই তো নিয়ম! মিছিল মাথাটা খানিক বাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে এসব নিয়ে ধ্যান করছিলো। মুবিনের তুড়ির শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় মিছিলের। মিছিল ভ্রু কুচকে তাকায় মুবিনের দিকে। কীরকম একটা জ্যাকেটের মতো পড়ে এসেছে যার প্রায় পুরোটাই ছেড়া সেটারই পকেটে হাত দিয়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মিছিলের দিকে। মিছিল মিথ্যে বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুবিন বলে, ” এখানে বসছো কেনো মিছিল মনি? এখানে বসলে আমি তোমায় পেছন থেকে দেখবো কীভাবে? চলো পেছনে আসো! ”
মিছিলের কোনোপ্রকার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মুবিন মিছিলের ব্যাগ নিয়ে পেছনে চলে যায়। মিছিল বেয়াক্কেলের মতো বসে আছে। এই ছেলে এতো ড্যামকেয়ার কেনো? পুরো ক্লাসের সামনে এভাবে ব্যাগ নিয়ে গেলো যেনো আমি ওর বিয়ে করা বউ? আর ও এভাবে পুরো ক্লাসের সামনে মিছিল মনি বলেই বা ডাকবে কেনো? ও কী বুঝিয়ে গেলো যে আমি একদিনেই পটে গেছি? মিছিলের রক্তে রাগ দৌড়ানো শুরু করেছে। মিছিল উঠে হনহনিয়ে পিছনে গিয়ে মুবিনের সামনে দাড়ালো।
– ” আমার ব্যাগ দে। আমি সামনে বসবো! ”
– ” উহু তুমি পেছনে বসবে মিছিল মনি। আর আজকে না, তুমি প্রতিদিনই পেছনে বসবে! ”
– ” কে রে তুই? আমি তোর কথা কেনো শুনবো? আমার ব্যাগ দে আমি সামনে বসবো! ”
মুবিন একটু ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে, ” আরে আশ্চর্য! তুমি এখন সামনে গিয়ে বসলে আমি তোমায় দেখবো কীভাবে? আর তোমার কানের নিচে ঐ ছোট মিষ্টি তিলটাই বা দেখবো কীভাবে? ”
মিছিল একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো। কই তার কানের নিচে যে তিল আছে সেটা তো সে জানে না। এতো বছর যাবৎ আয়নায় নিজেকে দেখছে কই কখনও তো এই তিলের সন্ধান সে পেলো না। তাহলে কী আয়নার দৃষ্টি ঐ যায়গাটায় পৌছায় না? আর মুবিন কিনা কয়েকদিন তাকে দেখেই তার সে অজানা তিলের সন্ধান দিয়ে দিলো। মিছিল চোখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে এসব ভাবছিলো।
মুবিন একটু স্পষ্ট হেসে বলে, ” আরে মিছিল মনি তোমার কানের নিচে কোনো তিলই নেই। আসলে তুমি কনফিউজড হলে তোমায় কেমন দেখায় সেটাই দেখার ছিলো আমার। দেখে নিয়েছি, ড্যাম কিউট লাগে! বিশ্বাস করো। এরপর থেকে জেনেবুঝে তোমায় কনফিউজড করে দিবো! ”
মিছিল এখনও কনফিউজড। সে কী এই মাত্রই আবারও মুবিনের কথায় পা পিছলে মুবিনের প্রেমে পড়ে গেলো? এ ব্যাপার নিয়ে তার সন্দেহ আছে। প্রেমে না পড়লে তার বুক এরকম লাফালাফি করছে কেনো?
ক্লাসে প্রফেসর চলে এসেছে। মিছিল আর কী করবে? মিছিল বাধ্যহয়েই বসে পড়ে মুবিনের পাশে। মিছিল লেকচারে মনযোগ দেবার চেষ্টা করছে। আর মুবিন মিছিলে মনযোগ দিচ্ছে। এভাবে কেউ একধ্যানে তাকিয়ে থাকলে স্বস্তিতে থাকা যায় নাকি? মারাত্মক অস্বস্তি বোধ হয়! একদম মারাত্মক। আর সেই মারাত্মক অস্বস্তিকর অবস্থাতেই পড়েছে মিছিল। মিছিল মুবিনকে বলে, ” এভাবে তাকিয়ে না থেকে লেকচারে মনযোগ দাও না! ”
মুবিন মিছিলের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে, ” এই তোমার গায়ের ঘ্রানটা এত্তো মাতাল মাতাল কেনো? কী মাখো গায়ে? ”
মিছিলের একদমই এরকম পুরোনো ছবির ডায়লগ ভালো লাগে না। মিছিল মুবিনের দিকে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলে, ” বিড়ির ছাই মাখি। তুই মাখবি? ”
মুবিন একটু লাফিয়ে ওঠে। সে চরম অবাক হয়েছে, মুবিন নিজের মধ্যে স্বাভাবিকতা আনতে আনতে বলে, ” আমিতো সারাদিন সিগারেট খাই। কই আমার থেকে তো এমন ঘ্রান আসে না! ”
মিছিল বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুবিনের দিকে। এই দৃষ্টির মানে হলো, ” তুই এখন চুপ থাক। আমায় লেকচার শুনতে দে! ”
মুবিন মিছিলের দৃষ্টিতে থাকা বার্তাকে তোয়াক্কা না করে বলে, ” একদিন পুরো সারাদিন তোমার গায়ের ঘ্রান শুকবো। একদম তোমার গায়ের ঘ্রান নিজের গায়ে টেনে নিয়ে আসবো। ঠিক আছে? ”
মিছিলের কিছুই বলার ইচ্ছে ছিলো না। সে চুপ থাকতে চাচ্ছিলো। কিন্তু কী না কী ভেবে মিছিল বললো, ” কীভাবে ঘ্রান নেবে? কীভাবে টানবে? আমার গায়ের ঘ্রান কী লোহার, যে তুমি চুম্বক দিয়ে টানবে? ”
মিছিলের কথায় মুবিন ক্যাবলা হাসে। হেসে হেসে একদম গদগদ হয়ে যায়। মিছিল মুবিনের বাহুতে একটা আলতো থাপ্পড় মেরে বলে, ” এ্যাই! একদম ছ্যাবলামি করবি না। লেকচার শুনতে দে! ”
মুবিনও আর কিছু না বলে লেকচারে মনযোগ দেয়।
ভার্সিটি ছুটির পর মিছিল লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে। মুবিনও পাশে হাটছে। মিছিল হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। মুবিনও এক মুহুর্তও দেরি না করে দাঁড়িয়ে পড়লো। এমনভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো যেনো সে মিছিলের রোবট, আর মিছিল দাড়িয়েছে বলে সেও দাঁড়িয়ে গেছে। মিছিল মুবিনকে বলে,
– ” আচ্ছা তুমি এভাবে ঘুরঘুর করছো কেনো? তুমি যতো যাই করো আমি তোমার প্রেমে পড়বো না! ”
– ” ধুর! তুমি এতো তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়ে যাবা ভাবিনি। মাত্র তো একদিনই হলো। আমি ভেবেছিলাম কয়েকমাস ঘুরবো, কিন্তু তুমি তো একদিনেই প্রেমে পড়ে গেছো! ”
মিছিলের হুশ উড়ে গেছে। মিছিল যে মুবিনের প্রেমে পড়তে শুরু করেছে এটা মুবিন জানলো কীভাবে? এই ছেলে কী আসলেই যাদুটোনা জানে নাকি? না না যত যাই হোক, মুখে স্বীকার করা যাবে না যে সে মুবিনের প্রেমে পড়েছে। কারন সে বড়মুখ করে বলেছে সে পটবেই না। এখন যে একদিনেই সে কাবু হয়ে গেছে এটা মুবিনের কাছে স্বীকার করলে তার মান-ইজ্জ্বত’ই থাকবে না।
মিছিল থতমত খেয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, ” কী আবোলতাবোল বলছো? আমি প্রেমে পড়বো? তাও আবার তোমার? ”
– ” প্রেমে না পড়লে তোমার আমার প্রতি এতো মায়া আসছে কেনো? আমি তোমার পেছনে ঘুরঘুর করে ক্লান্ত হচ্ছি এটাতে তুমি কষ্ট পাচ্ছো কেনো? ”
মিছিল হা হয়ে যায়। এই ছেলের সাথে কথায় পেড়ে ওঠা মুশকিল। এই ছেলে কথার মারপ্যাঁচে ওস্তাদ একদম। তাই মিছিল কিছু না বলেই সামনে হাটা ধরে। মুবিনও সামনের হাটা শুরু করে মিছিলের পাশাপাশি, মিছিলের সাথে তাল মিলিয়ে।
হঠাৎ করেই মুবিন বলে, ” আই লাভ ইউ মিছিল মনি! ”
মুবিনের মুখে ‘আই লাভ ইউ’ কথাটা শুনে মিছিলের বুক ধক করে ওঠে। মিছিল সঙ্গে সঙ্গে বলে, ” আই লাভ ইউ বলছো কেনো? চলে যাবা নাকি এখন? ”
মুবিন কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ” আমি কী তোমায় রেখে চলে যাবো নাকি? আর আমি কী তোমায় অকারনে আই লাভ ইউ বলতে পারি না? অদ্ভুত! ”
মিছিল ফিক করে হেসে ফেলে। কেনো হেসেছে তা জানে না। তবে মুবিন যখন কথাগুলো বলছিলো মুবিনকে একদম ছোটবাচ্চা লাগছিলো। হয়তো মিছিলের ফিক করে হেসে ফেলার কারন এটাই। মিছিল মুখে হাসি বজায় রেখে বলে, ” ভার্সিটিতে পড়ো তুমি মুবিন। তারপরেও একটা মেয়ের পেছনে এভাবে ঘুরছো লজ্বা করে না? নিজেকে ইম্যাচিউড লাগে না? ”
মুবিন এবার একটু সিরিয়াস ভাবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মুবিন বলে, ” সব জায়গায় ম্যাচিউরিটি দেখালে হয় না। কিছু কিছু যায়গায় জেনেবুঝেও ইম্যাচিউড হতে হয়। আর বিশ্বাস করো মিছিল মনি আমি কখনই তোমার সাথে ম্যাচিউড ব্যাবহার করবো না। একদম বুড়ো বয়সেও আমি তোমার কাছে ইম্যাচিউড’ই থাকবো! ” কথাগুলো বলেই মুবিন তাচ্ছিল্যেরর হাসিটা গায়েব করে ক্যাবলা বোকা হাসে। মিছিলও আড়চোখে মুবিনকে দেখে খানিক মিটিমিটি হেসে বলে, ” ইউ আর সাচ এ্যা ফ্ল্যার্ট মুবিন! মানে মেয়ে পটানোর জন্য যা ইচ্ছা তাই বলবা নাকি? ”
মুবিন নিজের বোকা হাসিমাখা মুখটা গুটিয়ে নিয়ে কপাল কুচকে বলে, ” আরে সত্যি কথা বলছি। যেখানে দুজনই ম্যাচিউড হয় সেখানে সম্পর্ক ঠিক ভালোভাবে এগোয় না। যেমন আমার বাপ-মা! আইটেম দুইটাই ওভার ম্যাচিউড ছিলো। ব্যাস সংসার টিকলো না! ”
মিছিল থমকে যায়। মুবিন ড্যামকেয়ার প্রকৃতির ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে নিজের বাবা-মা স্বমন্ধ্যে এভাবে বলবে? মিছিলের এর কারন জানা প্রয়োজন। মিছিল কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” সংসার টিকলো না মানে? ”
মুবিন চওড়া হেসে ভ্রু কুচকে মিছিলের দিকে এগিয়ে বলে, ” বলবো তবে একটা শর্ত আছে। ”
চলবে!
#thetanvirtuhin