গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ০১!
লেখক: তানভীর তুহিন!
– ” একটা রাতেরই তো ব্যাপার। আমি শুধু তোমার সাথে একটা রাত কাটাতে চাই! ”
কথাটা মিছিলের কানে পৌছাতেই মিছিল গত দুদিনের মতো আজও মুবিনের গালে একটা থাপ্পড় মারে। থাপ্পড় টা মোটেই বেশি জোরে ছিলো না। কিঞ্চিত ‘ঠাস’ শব্দ হয়েছে আর মুবিনের গালেও কিঞ্চিত ঝিম ধরে গেছে। এখন মিছিলের গায়ে শক্তি নেই নাকি সে ইচ্ছে করেই মুবিনকে আস্তে থাপ্পড় মেরেছে সেটা বোঝা মুশকিল। সে ইচ্ছে করেই মুবিনের ফর্সা খোচা দাড়িওয়ালা গালে দাগ বসাতে চায়নি নাকি মুবিনকে ভয় পেয়েই আস্তে থাপ্পড় মারলো সেটাও বোঝা দুঃসাধ্য। গত দুদিনের মতো মুবিন আজও থাপ্পড় খাবার পর একটু ফ্ল্যার্টি মুডে মুচকি হেসে তাকায় মিছিলের দিকে। মিছিল দাত খিটিমিটি দিয়ে আঙুল নাচিয়ে মুবিনকে বলে, ” দেখো মুবিন তুমি আমায় যে ধরনের মেয়ে মনে করছো আমি মোটেই ওই ধরনের মেয়ে না। হতে পারো তুমি পুরো ভার্সিটির ক্রাশ ম্যাটেরিয়াল। কিন্তু আমার তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। সো প্লিজ স্টে এওয়ে ফ্রম মী! ”
মুবিন মুচকি হাসে। সামনের দাতগুলো দিয়ে ঠোটে কামড় দিয়ে একটু চওড়া হাসে। তারপর বলে, ” তোমার কী মনে হয়? আমি তোমায় কেমন মেয়ে মনে করি? ”
– ” মুবিন প্লিজ! তুমি আমার ক্লাসমেট। আমাদের বহুদিন একই ক্লাসে দেখা হবে। তাই এমন ব্যাবহার প্লিজ বর্জন করো! ”
– ” প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো? বলো না। তোমার মতে আমি তোমায় কেমন মেয়ে মনে করি? ”
মিছিলের চোখের আগুনে যেনো এই কথা বলে খানিক কেরোসিন ঢেলে দিলো মুবিন। মিছিল আগ্নিচোখে তাকিয়ে আছে মুবিনের দিকে। মনে হচ্ছে এই চোখ দিয়েই ঝলসে দেবে মুবিনকে। মিছিলের চোখের জ্বলন্ত আগুনে মুবিনের কিছু যাচ্ছে আসছে বলে মোটেই মনে হচ্ছে না। মিছিল আর পারছে মুবিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। এই অমানুষের সামনে সে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না। মিছিল হনহনিয়ে বেড়িয়ে যায় লাইব্রেরি থেকে।
মুবিন আর মিছিলের মধ্যকার এসব কথোপকথন লাইব্রেরিতে কারো চোখেই পড়ে না। শুধু শাওন আর সীমান্ত ছাড়া। শাওন আর সীমান্ত দুজনে জমজ ভাই। চেহারার প্রায় ৯৮ শতাংশ মিলে যায় একজনের সাথে আরেকজনের। এদের শুধু চেহারারই নয় বরং মন-মানসিকতা সবই এক। আর এরা দুজনেই মুবিনের বন্ধু, বন্ধু বললে কম হবে বেষ্টফ্রেন্ড, বেষ্টফ্রেন্ড বললে ভুল হবে ভাই, হয়তো ভ্রাতৃত্বেরও উর্ধ্বে। সেই প্রাইমারি থেকে পরিচয় এদের তিনজনের। মিছিল বেরিয়ে যাবার পরপরই বুকশেলফ এর আড়াল থেকে বের হয় শাওন আর সীমান্ত। সীমান্ত এসেই মুবিনের কাধে হাত রেখে বলে, ” এই মেয়ে পটার মতো মাল না মামা! ”
মুবিন নিজের নাকটা দু-আঙুল দিয়ে ডলে বলে, ” এখনও একদিন আছে। চিল্ম্যান, কালকে শিওর কনভেইন্সড হয়ে যাবে ”
পাশ থেকে শাওন অবাক ভঙ্গিতে বলে, ” তিনদিন টানা থাপ্পড় খেয়েও। কাল আবার অফার করতে যাবি? ”
মুবিন হেসে বলে, ” থাপ্পড়? এটাকে থাপ্পড় কীভাবে বলিস তোরা? এই মেয়ের শরীরে তো কোনো শক্তিই নেই। শুধু দেখতেই সুন্দর, হট আর সেক্সি। থাপ্পড় মারে নাকি গাল ছুয়ে আদর করে বোঝা মুশকিল! ”
শাওন শব্দ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, ” কালকেই লাষ্ট ডেট। যদি মেয়ে পাত্তা দেয় বা রাজি হয় তাহলে তো হইলোই। আর নাহয় এই মেয়ের পিছু নেওয়া ছেড়ে দিবো আমরা! ”
মুবিন আর সীমান্ত একত্রে ‘হু’ আওয়াজ করে। তারপর শাওন বলে, ” লাইব্রেরির কাজ শেষ। চল এবার ক্যাম্পাসে যাই। ”
সীমান্ত ফোনে টাইম দেখতে দেখতে বলে, ” মুবিন আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। আড্ডা তেমন দিবো না। আর রাতেও বের হবো না আজ। আব্বু-আম্মুর বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আছে! ”
পাশ থেকে শাওন দাত দিয়ে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে, ” উফ ভুলেই গেছিলাম! ”
সীমান্ত শাওনের পেটে একটা হালকা ঘুষি মেরে বলে, ” তোর মনেও থাকবে না শালা। চল! ”
শাওন আর সীমান্ত চলে গেলে মুবিনও আর বেশিক্ষন ক্যাম্পাসে থাকে না। নিজের ফ্ল্যাটে চলে আসে।
সন্ধ্যা সাতটা ছুঁইছুঁই। মুবিন কিচেনে নুডুলস রান্না করছে। বহুদিন হয় নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করে না সে। তাই আজ খুব শখ হলো নিজের হাতে রান্না করা বিস্বাদ নুডুলস খেতে। মুবিন নুডুলস রান্না করছে আর গান শুনছে। মিউজিক সিস্টেমে ‘সিং মী টু স্লিপ’ গানটা বাজছে। মুবিনও গানের তালে তালে ঠোট মেলাচ্ছে। বেশ চাঙ্গা মেজাজে রয়েছে সে। হঠাৎ করেই মুবিনের মনে হলো একটা সিগারেট ফুঁকলে মন্দ হয় না। তাই আর দেরী না করে ঝটপট একটা সিগারেটের আগায় আগুন ধরিয়ে নিলো। এখন এটা টানার জন্য প্রস্তুত। সিগারেটটা দুই ঠোটের মাঝখানে রেখে একটানে প্রায় অর্ধেক সিগারেটের ধোয়া বুকে টেনে নিলো। তারপর সিগারেটের আগাটা থেতলে আগুন নিভিয়ে সিগারেটটাকে ফ্লোরে ফেলে দিলো মুবিন। এবার সে একটু একটু করে ধোয়ার স্বাদ নেবে আর একটু একটু করে ধোয়া ছাড়বে। আহ! শান্তি। মুবিন খুবই প্রানবন্ত প্রকৃতির মানুষ। জীবনকে যাপন নয় বরং উপভোগে বিশ্বাসি সে। মুবিনের মতে জীবনকে উপভোগ করার জন্য তিন জিনিসের প্রয়োজন। তাহলো টাকা,ছন্নছাড়াপনা,মাটির মন। যে তিনটাই তার কাছে রয়েছে। তাই সে জীবনকে যাপন না বরং উপভোগই করে।
নুডুলস রান্না শেষ। মুবিন নুডুলস নিয়ে গিয়ে টিভির রিমোট’টা হাতে নেয়। নুডুলস খেতে খেতে একটু টিভি দেখলে মন্দ হবে না। টিভিটা ছাড়বে ঠিক তখনই দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনে মুবিন। টিভি না ছেড়েই রিমোট আর নুডুলসের বাটি’টা সোফার সামনের টি-টেবিলের ওপরে রেখে দরজা খুলতে চলে যায় মুবিন। দরজা খুলতেই মুবিনের মেজাজ তেতে যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের দুজন মানুষের একজন এসেছে তারসাথে দেখা করতে। মুবিন কপালে বিরক্তির ভাজ নিয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি এখানে? ”
সামনে দাঁড়ানো মানুষটি কোনো উত্তর না দিয়েই মুবিনকে ঠেলে ভেতরে চলে যায়। তারপর টি-টেবিলের ওপর রাখা নুডুলসের বাটি থেকে এক চামচ পরিমান নুডুলস মুখে দেয়। তারপর কিছুক্ষন নুডুলস মুখে নাড়িয়ে সে ফ্রিজের দিকে দৌড় লাগায়। সেখান থেকে একটা ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে এক চুমুক পানি খেয়ে মুবিনকে বলে, ” নুডুলসে কেউ এতো ঝাল খায় নাকি? ”
মুবিন মুচকি হেসে বলে, ” যার যার টেষ্ট চয়েস যেরকম আরকি! ”
আহাদ শেখ পানির বোতলটা ফ্রিজে রাখতে গিয়ে লক্ষ্য করে পুরো ফ্রিজ ভর্তি মদ আর বিয়ারের বোতল। আহাদ শেখ নিজের ছেলেকে বলে, ” বাবা তুই বড় হয়েছিস। এক-আধটু ড্রিংকস করবি ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে নিজের ফ্ল্যাটের ফ্রিজকে পুরো মদের দোকান বানিয়ে ফেলবি? ”
মুবিন তীক্ষ্ণ মেজাজ দেখিয়ে কপাল কুচকে বলে, ” কল মী মুবিন, মিস্টার শেখ। আমি আপনার বা আপনি আমার বাবা-টাবা নন! ”
আহাদ শেখ মুবিনের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলে, ” আমি আর পারছি না রে। এবার তোর সাম্রাজ্য তুই বুঝে নে। এবার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন আমার। ব্যাবসাটা আমি তোকে হ্যান্ডওভার করতে চাই! ”
– ” আই ডোন্ট ওয়ান্ট দিস ফাকিং শীট! ”
মুবিনের বলা ইংরেজি কথাটার বাংলা বোঝেন আহাদ শেখ। আর বাংলাটা বোঝেন বলেই আহাদ শেখ তেতে গিয়ে বলেন, ” বিহ্যাভ ইওর সেলফ মুবিন। আ’ম ইওর ড্যাড নট ইওর বাডি অর ফ্রেন্ড! ”
মুবিন এবার একটু চওড়া হাসে আহাদ শেখের কথা শুনে। মুবিনের মেজাজ আরো উত্তপ্ত হয়ে যায়। সে দেখতেই পারে না এই মানুষটাকে। একদমই দেখতে পারে না। মুবিন চওড়া হেসে অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ” বিহ্যাভিয়ার? কোন ব্যাবহারটা ভালো লাগছে না আপনার? আমি ব্যাবসার দ্বায়ভার নিতে চাচ্ছি না সেটা? নাকি আমি আপনার সামনে ‘ফাক’ বলেছি সেটা? ”
আহাদ শেখের রাগ মাথায় উঠে গেছে। আহাদ শেখ চেচিয়ে বলে, ” ইউ আর ক্রসিং ইওর লিমিট মুবিন! ”
মুবিন আহাদ শেখের চেয়েও জোরে চিৎকার দিয়ে সামনে থাকা সিঙ্গেল সোফাটায় সজোরে লাথি মেরে বলে, ” নো আ’ম নট। আ’ম নট ক্রসিং মাই লিমিট। একচুয়ালি ইউ আর ক্রসিং ইওর লিমিট। হু দ্যা ফাক আর ইউ টু ডিসাইড মাই লিমিট? ”
– ” আ’ম ইওর ফাদার! ”
– ” নো ইউ আর নট। শুধু জন্ম দিলেই বাবা হয় না। আর দায়িত্ব পালনের নামে টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট ভর্তি করে দিলেই বাবা হয় না। আমার বাবা হবার জন্য আপনার যে যোগ্যতার প্রয়োজন সে যোগ্যতা নেই আপনার মধ্যে। আর কী শুনে আপনার ইগো হার্ট হচ্ছে? দিস ওয়ার্ড? দিস ফাকিং ওয়ার্ড ‘ফাক’? না এটা শুনে তো আপনার ইগো হার্ট হবার কথা না। যে মানুষ তিন তিনটে বিয়ে করতে পারে সে মানুষের ‘ফাক’ শুনলে ইগো হার্ট হবে কেনো? শুনুন মিস্টার আহাদ শেখ আমি আপনার সাথে কথা বলে নিজের সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না, নিজের মেজাজও গরম করতে চাচ্ছিনা। সো প্লিজ লীভ! দেখতে এসেছিলেন তো? দেখা হয়ে গেছে? নাউ প্লিজ লীভ! ”
– ” বাবা আমার কথাটা শোন। তুই ভুল বুঝছিস আমায়! ”
– ” গেট দ্যা ফাক আউট অফ হিয়ার, জাস্ট গেট আউট। ”
নিজের ছেলের কাছে আর অপমানিত হবার ইচ্ছে খুজে পায় না আহাদ শেখ। হনহনিয়ে বেড়িয়ে যায় মুবিনের ফ্ল্যাট থেকে। আহাদ শেখ বেড়িয়ে যেতেই মুবিন চোখ বন্ধ করে একটা বড় শ্বাস নেয়। তারপর ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের বোতল বের করে। নুডুলস আর বিয়ার খেতে খেতে টিভি দেখায় মনযোগ দেয় মুবিন।
একটু আগে যে মানুষটার সাথে চিল্লা-পাল্লা করছিলো মুবিন সে মানুষটা মুবিনের বাবা। ‘দ্যা শেখ মাল্টিন্যাশনালস’ এর বর্তমান মালিক ‘দ্যা আহাদ শেখ’। আহাদ শেখের ছেলে মুবিন শেখ। আহাদ শেখের ছেলে একটা হলেও তার বউ তিনটা। যদিও দুইটার সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন আহাদ শেখ নিজের থেকে এগারো বছরের ছোট একটা মেয়ের সাথে সংসার করছে। মুবিন আহাদ শেখকে নিজের বাবা হিসেবে মানে না। আর আলেয়া শিকদারকেও নিজের মা হিসেবে মানে না। কারন মুবিনের কাছে মুবিনের মা-বাবা হবার জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন সে যোগ্যতা আহাদ শেখ বা আলেয়া শিকদার কারো মধ্যেই নেই। মুবিন যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন আহাদ শেখ আর আলেয়া শিকদারের ডিভোর্স হয়ে যায়। মিউচুয়াল ডিভোর্স ছিলো। মানে তাদের দুজনের ইচ্ছাতেই ডিভোর্স হয়েছিলো। ক্লাস ফোর থেকে সেভেন অবধি মুবিন আলেয়া শিকদারের কাছেই ছিলো আহাদ শেখ প্রত্যেক সপ্তাহে দেখা করতে যেতো শুধু। মুবিনের জীবন দিনদিন অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে। তার নিজের মা আলেয়া শিকদার তার সামনেই অন্য একজনের সাথে মেলামেশা করতো। মুবিন যখন ক্লাস ফাইভে তখন আলেয়া শিকদার আবার বিয়ে করে। আহাদ শেখ আলেয়া শিকদারের বিয়ের কিছুদিন আগেই বিয়ে করে আরেকজনকে। মুবিন বাইরে ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে পারতো না, স্কুলে কারো সাথে মিশতে পারতো না, কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারতো সবাই ওকে ওর বাবা-মায়ের বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে খোটা দিতো, ক্ষ্যাপাতো। সবাই বলতো তোর তো মা’ই নেই তোর মা আরেকটা বিয়ে করেছে। আবার সেই সবাই’ই বলতো তোর তো বাবা’ও নেই তোর বাবাও তো আরেকটা বিয়ে করেছে। তোর তো বাবা-মা থেকেও নেই। তুই তো একটা এতিম রে। এসব কথার জন্য মুবিনের শৈশব টা জাস্ট জাহান্নাম হয়ে যায়। কৈশরটাও ভালো যায় নী মুবিনের। সবার এরকম খোটা শুনতে শুনতেই মুবিনের হাইস্কুলের অর্ধেক চলে যায়। মুবিন ঠিক করে সে আহাদ শেখের কাছে থাকবে। কারন তার মা তার সামনেই অন্যকারো সাথে মিশিতো এটা দেখে খুব কষ্ট হতো তার। আলেয়া শিকদারকে মা বলতেই কেমন যেনো ঘৃনা লাগতো মুবিনের। তাই সে আহাদ শেখের কাছে থাকা শুরু করে। সেখানের পরিস্থিতিও এক। মুবিনের বুক ফেটে যেতো এসব দেখে। মুবিন জীবনে শুধু একটা স্বাভাবিকতা খুজছিলো, একটু স্বাভাবিকতার জন্য হাতরে মরছিলো মুবিন। কিন্তু সে জীবনে স্বাভাবিক আমেজটা খুজেই পায়নি। একটু স্বাভাবিক আর একটু ভালো থাকার জন্য মুবিন ঠিক করে সে হোস্টেলে থাকবে। না থাকবে বাবা, না থাকবে মা, না থাকবে এই অস্বাভাবিক জীবন আর না থাকবে এই অসহনীয় বুকে ব্যাথা। হোস্টেলে গিয়েও মুবিনের শান্তি নেই। সবাই মুবিনকে সেই একই কথা নিয়ে ক্ষ্যাপাতে থাকে। ‘ তোর বাবা নেই, তোর মা নেই! ‘। মুবিন একদম ক্লান্ত হয়ে গেছিলো এসব শুনতে শুনতে। এরপর মুবিন চিন্তা করে ওরা কেউ তো ভুল কিছু বলছে না। আসলেই কী আমার বাবা-মা আছে? ওনারা কী বাবা-মা হিসেবে আমার কোনো দায়িত্ব পালন করেছে? ওনারা কী বাবা-মায়ের কাতারে পড়ে? ব্যাস মুবিন নিজেই মেনে নেয় যে তার বাবা-মা বেচে থাকতেও সে এতিম। এরপর থেকে যে মুবিনকে বলতো, ” তোর তো মা-বাবা নেই! ” মুবিন তাকেই, ‘ হ্যা আমার বাবা-মা নেই তা নিয়ে তোর এতো জ্বলছে কেনো? ‘ বলেই সোজা নাক ফাটিয়ে দিতো। হাইস্কুলের হোস্টেল লাইফের শেষ দুই বছরে তুমুল মারা-মারি করেছে মুবিন। আর সেসব মারামারিতে তার লেফট হ্যান্ড আর রাইট হ্যান্ড ছিলো শাওন আর সীমান্ত। হাইস্কুলে তো ওরা নিজেদের গ্যাং’ও বানিয়ে নিয়েছিলো। ‘ দ্যা এসএমএস স্কোয়াড’ নামে। এসএমএস এর মানে হলো শাওন,মুবিন,সীমান্ত। এসএসসি পাশের পর মুবিন ডিপ্লোমায় ভর্তি হয়ে যায়। ডিপ্লোমার শুরু থেকেই মুবিন নিজের ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে। মুবিনের কখনই কোনোপ্রকার আর্থিক অভাব হয়নি। উনিশ বছর বয়সেই মুবিন নিজের গাড়ি পেয়েছে, থাকার জন্য নিজের ফ্ল্যাট পেয়েছে, ব্যাংক একাউন্ট ভর্তি টাকা পেয়েছে, বাচার জন্য পেয়েছে পূর্ন স্বাধিনতা। আর কী লাগে? মুবিন এসবের মধ্যেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। এসবের মধ্যেই নিজেকে ভালো রেখে, জীবন উপভোগ করছে। মুবিন এতো ধাক্কা খেয়েছে জীবনে, এতো অবহেলা পেয়েছে জীবনে তবুও অমানুষ হয়ে যায়নি। নিজেই নিজেকে মানুষ করেছে মুবিন। নিজেই নিজেকে ভালো-মন্দের জ্ঞান দিয়েছে মুবিন। তার আজ কিছুরই অভাব নেই। প্রত্যেক মাসে তার মা আলেয়া শিকদার, তার বাবা আহাদ শেখ তার ব্যাংক একাউন্ট একদম ভরিয়ে দেয়। আর মুবিন সারামাস শুধু টাকা উড়ায়। আলেয়া শিকদার নিজেও প্রতিষ্ঠিত। আলেয়া শিকদার একটা ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলের মালিক। মুবিনের একদম কিছুর অভাব পড়ে না। যখন যা চায় তাই পেয়ে যায়। মুবিনের আবার একদমই অভাব নেই সেটাও নয়। তার একটা জিনিসের অভাব আছে, সেটা হলো একটা মেয়ে। মেয়েটাকে খুব বেশি ভালোবাসে সে। কিন্তু এ অবধি মেয়েটাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার, শুধু মেয়েটার কথাই শুনেছে সে। বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটা। আর মেয়েটার কন্ঠটা একদমই অন্যরকম যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে এই কন্ঠে। সে কন্ঠের প্রেমেই পড়েছে মুবিন, সেই কন্ঠেই বারংবার মুগ্ধ হয়েছে মুবিন…!
চলবে!