ক্যাকটাস ?
পর্ব-১৮
Writer Taniya Sheikh- Tanishq
দীর্ঘ পথ জার্নি শেষে খাওয়া দাওয়া করে অনেকেই নিদ্রা আচ্ছন্ন। অনেকে আবার বৈদ্যুতিক আলোয় যতোটুকু দেখা যায় তাতেই কটেজের আশপাশটা দর্শনে ব্যস্ত। নীরা,আমরিন এবং তাদেরই আরেক সহকর্মী খাদিজা কটেজের একটি কামরায় থাকবে। আরমান সহ বাকি আরও তিনজন ছেলে থাকবে অন্য একটি কামরায়। এছাড়াও বাকি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জন্য আলাদা কামরা ভাড়া করা হয়েছে। নীরা বেশ রাত অব্দি জেগেছিল। ওর রুমের জানালা দিয়ে অন্ধকার দূর পাহাড় অস্পষ্ট দেখছিল সে। আশেপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার গুনগুন শব্দ মনে বিশেষ এক অনুভূতি জাগায় নীরার। এখনও মাথায় দুঃস্বপ্নটার রেশ বিদ্যমান। নীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্বপ্নটাকে ভুলতে কিন্তু পারছেই না। আমরিন কম্বল সরিয়ে মুখ তুলে ঘুমাতে বলার পরই নীরা বিছানায় শুয়ে পড়ে। দু’টো বেড পাশাপাশি। একটাতে আমরিন শুয়েছে অপরটাতে সে আর খাদিজা। নীরার সমস্যা হলো না তাতে কোনো। অচেনা স্থানে ঘুম তেমন ভালো হলো না। ভোরে উঠে ওযু শেষে নামাজ পড়ে নিল নীরা। সকলে মিলে কটেজেই ব্রেকফাস্ট খেতে বসে। খাওয়া শেষে অফিসের গাড়ি করে চলে এলো মেলার স্থানে। তেমন জমজমাট না হলেও বেশ আমেজ পরিলক্ষিত মেলায়। ভীরও যথেষ্ট। ম্যানেজার বললো ক্রমে ক্রমে আরও ভীর হবে। নীরা সকল ধ্যান জ্ঞান লাগিয়ে কাজে মনোযোগ দেয়। অদূরে দাঁড়িয়ে সবকিছুই লক্ষ্য রাখছিল ম্যানেজার। আমরিন ঘুরে ঘুরে সেলসকর্মীদের বুঝিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন বিষয়। দু’টো দিনই তাদের এভাবে কাজের মধ্যে ব্যস্ত গেল। ম্যানেজার মিনহাজ কাজের ফাঁকে প্রিয়তমা আমরিনকে যতোটা পারছে সময় দিচ্ছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিছু দুষ্টু মিষ্টি কথা কিংবা অদূর দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বিনিময়ে তাদের প্রেম বুঝি রোমান্টিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। নীরাকে একটা প্রডাক্ট সম্পর্কে বুঝিয়ে মিনহাজের দিকে এগিয়ে এলো হাসিমুখে আমরিন। মিনহাজ ঠোঁট কামড়ে ভ্রু নাচাতেই লজ্জায় লাল হয়ে ইশারায় শাসায় আমরিন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চঞ্চল চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে মিনহাজ বলে,
” আজ রাতে রুমে আসতে পারবে?”
” কী!” আমরিন চোখ পাকাতেই মিনহাজ হেঁসে দেয়। বলে,
” হায়রে নেগেটিভিটি তোমার মধ্যে। তিনবছরে এই চিনেছ আমাকে তুমি? থাক আসা লাগবে না তোমার।”
” রাগ করলে?”
” না! আনন্দিত হয়েছি।” মিনহাজ মুখ কালো করে ফেলে। আমরিন এক হাত কানে আলতো ধরে বলে,
” স্যরি!”
মিনহাজ বললো,” স্যরি কেন? যা ভেবেছ ঠিকই আছে।”
” বাব্বাহ! রাগে নাক ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। আচ্ছা যাও আসব।”
” প্রয়োজন নেই।” মিনহাজ গম্ভীরমুখে বললো
” মিনহাজ! স্যরি বলেছি তো। প্লীজ রাগ করো না। প্লীজ! প্লীজ!” আমরিন ঠোঁট উল্টে ফেলতেই মুচকি হাসে মিনহাজ। বলে,
” হুমম!”
” হুমম কী?” আমরিন বলে।
” তোমার মুন্ডু। রাতে সময় মতো চলে এসো। এদিকটা খেয়াল রেখো আমি আসছি।”
” যাচ্ছ কই?”
” চেয়ারম্যান স্যারের সাথে দেখা করতে। কেন যাচ্ছি এসে বলবো। বাই!’ আমরিনের গাল টেনে মুচকি হেঁসে প্রস্থান করে মিনহাজ। আমরিন গাল ডলতে ডলতে সেদিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসে। নীরা আমরিনকে লক্ষ্য করতে গিয়ে ম্যানেজার ও আমরিনের খুনসুটি স্টলে দাঁড়িয়ে দেখল। অন্য কারো অবশ্য সেদিকে খেয়াল নাই। সবাই ব্যস্ত তাদের প্রয়োজনে। নীরার মনে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে ওদের প্রেম দেখার পর। একটা শূন্যতা অনুভব করলো তাতেই যেন। একাকিত্বটা বড়োই অসহনীয়। একটা তুমি নামক কেউ একজন যদি হতো তার? ধুর! এই ভাঙাচোরা জীবনে তেমন কারো স্বপ্ন দেখা মানা। ভালোবাসাটা বুঝি কোনোদিনই হয়ে উঠবে না কাওকে নীরার। জীবনে পছন্দ, ভালোবাসা বলতে আদৌ কী কেউ ছিল তার? তখনই মনের আকাশে অনেক পছন্দের নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে লুব্ধক হয়ে ভেসে উঠলো রাফসান। রাফসান! নীরার হঠাৎ রাফসানকে প্রথম দেখা সেই দিনের কথা মনে পড়ল। ছি! কী সব ভাবছে সে? তাকে কেন পছন্দ হবে নীরার? সে তো আহনাফের ভাই। আহনাফের মতো না হোক তবুও তার আত্মীয়। নীরা নিজের ভাবনাকে ধিক্কার দিয়ে কাজে মনোনিবেশ করে। বহুদিনের চাপা অনুভূতি আজ কী করে বাইরে এলো? আমমিন মিনহাজকে দেখে? নীরার অস্বস্তি হচ্ছে এতোবছর পর রাফসানকে নিয়ে ভাবায়। নিজেকে খুব করে তিরস্কৃত করলো মনে মনে সে।
রাতে কটেজে ফিরে ডিনার শেষে ম্যানেজার মিনহাজ তাদেরকে জানাল তারা আরও একদিন থাকবে এখানে৷ তাদের সেল যথেষ্ট ভালো হওয়ায় কতৃপক্ষের তরফ থেকে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে আগামীকাল। সবাই মিলে আগামীকাল ঘুরতে বেরুবে এবং পরদিনই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। সবাইকে বেশ আনন্দিত দেখাল এই খবরে। এই তিনদিনে তারা শুধু কাজই করে গেছে। ঘুরাঘুরি হয়নি কারো। নীরার মনে অবশ্য সবার মতো এতো এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে না। সে ঢাকা ফিরতে পারলেই যেন খুশি হয়। আমরিন কামরায় ছিল না। খাদিজা বেশ আনন্দ নিয়ে বয়ফ্রেন্ডকে আগামীকালের ভ্রমণ সম্পর্কে বলছিল। নীরা চাদর মুড়ি দিয়ে বেতের চেয়ারটা পা গুটিয়ে বসে বসে বাইরেটা দেখায় মগ্ন। বয়ফ্রেন্ডের সাথে খাদিজা হাস্যরসাত্মক কথাগুলো শুনে নীরার মনের বীণাতে টান দেয়। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বিরবির করে,
” সবার সবাই আছে। কেবল আমারই কেউ নেই। কী নিঃসঙ্গতা! চারিদিকে হাসির ঢেউ। আমার বেলায় শুধু ভাটা।”
আমরিন বেশ রাত করে কামরায় ফিরল। খাদিজা ঘুমিয়ে গেলেও নীরা তখনও নির্ঘুম। নীরা কম্বলের ফাঁকে অন্ধকারে চেয়ে দেখল আমরিনকে। বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে অনামিকার জ্বলজ্বলে আংটিটা বার বার নাড়িয়ে দেখছিল সে। নীরার মনে পড়ল বিকেলের কথা। আরেকবার ভালো করে তাকাল নীরা আমরিনের দিকে। পুরো পৃথিবীর আনন্দ যেন তারই চোখে মুখে উপচে পড়ছে। হাসলে আমরিনকে বেশ লাগে দেখতে। নীরার ঘুম না আসা অব্দি তাকিয়ে দেখল আমরিনের আংটি নিয়ে খেলা। স্বপ্ন পূরণ হলে বুঝি এমনই খুশি হয় মানুষ৷
আজ সারাদিন ঘুরবে বলে কটেজ থেকে বেরিয়েছে ম্যানেজার মিনহাজ, আমরিন,নীরা, খাদিজা, আরমান এবং তাদেরই দু’জন সহকর্মী। বাকিরা কটেজে আছে৷ মিনহাজ ওদের কক্সবাজার সি বিচ ঘুরিয়ে নিয়ে এলো হিমছড়ি ঝর্ণা দেখাতে। পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরাম ঝরে পড়ছে পানির ধারা। নীরা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হয়ে। এই উদার প্রকৃতির বুকে আসলেই মানুষ ভেতরের জ্বালা যন্ত্রণা খুব সহজে ভুলতে পারে। ঝর্ণার জলের ছোঁয়া দু’হাত, দু’পা সিক্ত করলো নীরা। স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে চক্ষু জুড়িয়ে গেল ওর। আরমান এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললো,
” ঝর্ণা দেখেই টাসকি খেয়ে গেলি। পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখলে তো অজ্ঞান হয়ে যাবি রে তুই।” শব্দ করে হেঁসে উঠলো আরমান। সবাই তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে বুঝল আবার বুঝল না। তাতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ কারো মধ্যে নেই। তারা এসেছে প্রকৃতির রূপ দর্শনে। অন্য কিছু ভেবে সময় কিংবা মনোযোগ নষ্ট করতে চাইলো না কেউ। বিকেলে দিকে চলে এলো হিমছড়ি পাহাড়ের নিচে। দু’পাশে নানা জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে আছে স্থানীয় দোকানীরা। নীরা শারমিন, মেহের এবং শিলার জন্য পছন্দ মতো জিনিস কিনে নিল। নিজের পছন্দের একটা শালও নিল সে। বার্মিজ শাল। বেশ দেখতে। পুরোনোটা ব্যাগে ভরে নতুনটার ভাঁজ ভেঙে গায়ে জড়িয়ে নিল। নিজের পয়সায় শখের জিনিস কিনে খুশি তার মুখে ঝলমল করে। মিনহাজ তাড়া দিল উপরে উঠবে বলে। নীরা বাকি কেনাটাকা নেমে এসে করবে ভাবল। সবার পিছু পিছু এসে দাঁড়াল পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ির কাছে। আরমান বললো এটা নাকি তিনশ ফিটের মতো দীর্ঘ। সবাই উঠার আগেই আআ,, করে উঠল। এতো দীর্ঘ সিঁড়ি উঠতে পারবে কীনা মিনহাজ জিজ্ঞেস করলো আমরিনকে। মিনহাজের কথাতে ছিল ব্যঙ্গ। আরমিন খুব বুঝল সেটা। গলা উঁচু করে বললো অবশ্যই যাবে সে। নীরা খাদিজার দিকে তাকাতেই ওরা ম্লান হাসি দিয়ে সম্মতি জানাল। শুরু হলো পাহাড়ের গায়ে তৈরি সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে ওঠা। মূল উচ্চতায় উঠতে দুই ধাপে সিঁড়ি ডিঙাতে হয়। এক ধাপ ডিঙিয়েই সবার অবস্থা কাহিল। নীরা এমনিতেও হ্যাংলা পাতলা। সিঁড়ি মাড়াতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। যতো উপরে উঠছিল শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হচ্ছিল খুব। তবে সেই কষ্ট ছাপিয়ে সবার মাঝে আনন্দ বিরাজ করছে আরমান এবং ম্যানেজার মিনহাজের হাস্যকর কথাবার্তায়। আজ যেন কেউ সিনিয়র জুনিয়র নয়। সবাই হাসি ঠাট্টা করতে করতে উঠে এলো সর্বোচ্চ চূড়ায়। সকল কষ্ট এই ক্ষনে কমে গেল তাদের। একপাশে কক্সবাজার সমুদ্রের একাংশ অন্যপাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সৌন্দর্য্য। নীরা পাশের বেঞ্চিটায় বসে শ্বাস ছেড়ে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করছে। স্বর্গ সম্পর্কে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাড়াতেই বুঝি স্রষ্টা পৃথিবীতে এতো সুন্দর নয়নাভিরাম দর্শনীয় স্থান সৃষ্টি করেছে। এই সৌন্দর্যের কোলে আসলেই মানুষের ভাবনা চিন্তা পরিবর্তন হতে বাধ্য। সবকিছু জুড়েই কেবল রয়ে যায় সৌন্দর্য্যের রেশ। সবাই এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। নীরা পাহাড়ের এককোনে দাঁড়িয়ে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল যতোদূর দৃষ্টি যায়। হঠাৎ সামনে দিকের পায়ে তৈরি রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা ঝোপের মধ্যে একটা খরগোশ দেখল সে। নীরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই কান খাড়া করে তাকাল খরগোশটা। নীরাকে এগিয়ে আসতে দেখে ছুটে পালিয়ে গেল সামনে। নীরাও সেটার পিছু নিল। তার খেয়ালই নেই সে লোকজনের ভীর ছেড়ে নেমে এসেছে নির্জন পাহাড়ের নিচে। আবার সামনে খরগোশ দেখে নীরা ছুটে গেল সেটা ধরতে। এবারও পারল না। একদম গভীরে নেমে এলো জঙ্গলের। হাঁটুসমান ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে গেল টিপটিপে পায়ে। তার ধ্যান জ্ঞান যেন ঐ খরগোশেই নিবদ্ধ।
অস্তাচল সূর্যকে দেখছে সবাই। একটু একটু করে ডুবে গেল সূর্য। আকাশে রয়ে গেল রক্তিম আভা। চারপাশে ম্লান আলো ফুটতেই সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল নিচে নামার জন্য। মিনহাজ সবাইকে নিয়ে নিচে নামছিল হঠাৎ আরমান বলে উঠল,
” স্যার নীরা কই?”
” নীরা কই মানে কী? একটু আগেই না দেখলাম ওকে।”
” আমিও তো তাই দেখেছিলাম। খাদিজা নীরা কই?” আরমান চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে।
খাদিজা কিছুই বলতে পারল না। নীরা যখন খরগোশটার পেছনে পেছনে নেমে গিয়েছিল, তখন খাদিজা মোবাইল ব্যস্ত ছিল। তার সেটা মনে পড়তেই বললো সে। মিনহাজ, আরমান দৌড়ে গেল সেখানে। কোনো মানুষের চিহ্নও নেই সেই স্থানে। অনেকে গন্তব্য স্থলে ফিরতে নিচে নামছে আর যারা আছে তারা উপরের দিকেই আছে। ছুটাছুটি শুরু করল নীরাকে খুঁজতে সবাই। আরমান বেশ খানিকটা ঐ পথে খুঁজেও নীরার কোনো চিহ্ন পেল না। ভয়ে চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। অনেক খুঁজেও যখন নীরাকে পাওয়া গেল না হতাশ হয়ে বসে রইল সবাই। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। এখানে নিখোঁজ হওয়ার ঘটার সম্ভাবনা তেমন নেই। তবুও পুলিশ বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নিল। যতোদূর খোঁজার খুজল তারা। কিছুই পেল না। নীরার বোনকে জানানো হলো। শারমিন মোবাইল কানে নিয়ে চিৎকার করে ওঠে খবর শুনে। তাকে কোনোভাবেই শান্ত করতে না পেরে পুলিশ অফিসার কল কাট করল। শারমিনের হাত পা কাঁপছে। কী করবে কিছুই বুঝে উঠল না সে। বহুকষ্টে নিজেকে একটু শান্ত করে মেহেরকে জানাল। মেহের শারমিকে সান্ত্বনা কী দেবে? সে নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়ল এমন ঘটনায়। শোয়েব পুলিশ অফিসারের সাথে যোগাযোগ করে জানাল তারা শীঘ্রই সেখানে আসছে। শোয়েবের অনুরোধে মেহের নীরার মিসিং হওয়ার কথাটা জানাতে মোবাইল করল রাফসানকে। রাফসান সবেমাত্র বাসায় ফিরে কাপড় পাল্টে বিছানায় বসেছিল। মেহেরের কল পেয়ে চমকিত হলো সে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে কল রিসিভ করতেই যা শুনলো, তাতে তার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। একটা কথারও জবাব রাফসান দিতে পারল না। মেহের বার বার ডাকল, রাফসান! রাফসান!” রাফসান নির্বাক, অনুভূতিশূন্য মানুষের ন্যায় বসে রইল। রাফসানের এমন আচরনে অবাক হলো মেহের। কল কেটে দিল রাফসানের সাড়াশব্দ না পেয়ে। রাফসানের চোখে ভেসে উঠল নীরার মুখখানি। মুহূর্তে চাদর গায়ে জড়িয়ে ছুটে নেমে এলো নিচে। রাহেলা ডায়নিং এ বসা ছিল।ছেলেকে এমন পাগলের মতো ছুটতে দেখে দৌড়ে দরজার কাছে গেলেন তিনি। রাফসান কোনোদিকে খেয়াল না করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। সে জানে না কোথায় যাচ্ছে। শুধু জানে তাকে নীরার কাছে যেতে হবে। সেটা কোথায়! কিছুই জানা নেই। সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসছে। চোখের জলে চশমার গ্লাস ভিজে ঝাপসা লাগছে সামনের সব। গাড়ি এলোমেলো ড্রাইভ করছে রাফসান। মাথায় শুধু একটা বিষয়ই আছে।তাকে যতোদ্রুত সম্ভব কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে।
নীরা যখন বুঝল সে পথ হারিয়ে পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, তখন দিশেহারা হয়ে পড়ল। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই মনে পড়ল সেই দুঃস্বপ্নের কথা। এমনই কোনো গহীন জঙ্গল ছিল। নীরার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছে। কোনপথে এগোবে ঠাহর করে উঠতে পারলো না। চোখের সামনে ঝোপঝাড় আর ঘাস। কোনো মানুষের চিহ্নই সেখানে নেই। নীরা মনে মনে সাহস জুগিয়ে সামনের পথে ভীরু পায়ে এগোচ্ছে। না এ পথ তার চেনা নয়। নীরা ঘুরতেই হাতির ডাক শুনতে পেল। দিকবিদিক শূন্য হয়ে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ছুটতে লাগলো ভয়ে ভয়ে। পথ তো পেলই না উল্টো অন্ধকার ঘন জঙ্গলে এসে থামল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক সেই স্বপ্নের মতো। নীরা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গায়ের কামিজের কোনা মুঠ করে। শ্বাস ছাড়তেও তার ভয় করছে। বিস্ফোরিত চোখে অন্ধকারে চোখ ঘুরাতে লাগল। হঠাৎ খ্যাচখ্যাচ পায়ের আওয়াজ শোনা গেল একটু দূরে। নীরা কান খাড়া করে শুনছে। চোখের সামনে সবটাই আঁধার এই মুহূর্তে। নীরা কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে একইভাবে। আওয়াজটা ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসছে তার। এই অন্ধকারে কোথায় যাবে সে? চোখ খিচে বন্ধ করে রইল।যখন দেখল কিছু ঘটল না। চোখ টিপ টিপ করে তাকাল। তখনই মাথায় ভারি কিছুর আঘাত পড়ায় ছিঁটকে পড়ল ঘাসের উপর। ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠতেই আঁধার ফুঁড়ে সম্মুখে দপ করে জ্বলে উঠলো মৃদু আলোর টচ। নীরা আতঙ্কিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। কালো চাদরে ঢাকা দীর্ঘদেহি মানবমূর্তি এসে দাঁড়াল নীরার সামনে। ভারী গলায় ব্যঙ্গ করে টেনে বললো,
” বউ মা-আ!” নীরার দিকে ঝুঁকে মুখ থেকে চাদর সরাতেই নীরা ভয়ে জমে গেল। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল সামনে ঝুঁকে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখামাত্র। মানুষটা সবগুলো হলদেটে দাঁত কেলিয়ে বিদঘুটে ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,
” চিনছ আমারে? বাবলু চাচা! তোমার শ্বশুরের খাস লোক।”
নীরা আর কিছুই ভাবতে পারল না। ভয়ে, আতঙ্কে জ্ঞান হারায় সাথে সাথে।
চলবে,,,