ক্যাকটাস? পর্ব-১৯

0
1891

ক্যাকটাস?
পর্ব-১৯
Writer Taniya Sheikh-Tanishq

মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন দুটো রাস্তা তার সামনে খোলা থাকে। এক. বাঁধা হয়ে থাকা দেয়াল ভেঙে ফেলা।দুই. নিজের পিঠ অর্থাৎ মেরুদণ্ড ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা আমৃত্যু। নীরার সম্মুখে এখন তেমনই সিচুয়েশান। হয় মরো নয় মারো। মারবে! এতো সাহস কী এই তুচ্ছ ভীরু রমণীর আছে? ওর মতো ভীরু মেয়েদের পদে পদে মরতে হয়৷ আচ্ছা নীরা! এমন জীবন রেখে লাভ ই কী আছে তোর? মরে যা! সকল ঝামেলার অবসান হোক। নীরার মতোই মেয়েটি ধিক্কার দিতে দিতে হাত বাড়িয়ে গলা চেপে ধরলো। নীরা গোঙানি করতে করতে দূর্বল চোখের পাতা মেলে। দুঃস্বপ্ন ছিল মেয়েটি। সে মরে নি বেঁচে আছে৷ আরও একবার নিজেকে জীবিত আবিষ্কার করে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঘাসের মধ্যে মুখ থুবরে পড়ে আছে নীরা। নড়নচড়নের খুব একটা শক্তি তার মধ্যে নেই এখন৷ কাটা ঘায়ে মরিচ লাগলে কিংবা শরীর পুড়লে যেমন জ্বলে তেমনি করে জ্বলছে পিঠটা। ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে সেখানে। ক্রমশ জমে যাচ্ছে অনুভূতি। নীরা থুতনি ঠেকিয়ে মুখ তুললো। একটু দূরে সামনে কাঠ-খড় জ্বালিয়ে বসে আছে বাবলু। মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি মোচ, হাতে সেই খরগোশটা। নীরার দিকে যখন তাকাল বাবলু বড়ো ভয়ানক দেখাল তার মুখশ্রী। কাঠ-খড়ের লেলিহান শিখায় চোখ দু’টো হিংস্র হায়েনার মতো জ্বলছে। নীরাকে মুখ তুলতে দেখে পাগলাটে হাসি হাসলেন। ভ্রু তুলে বললেন,

” এইডা ধরবার চাইছিলা বউমা? ধরো!” খরগোশটা এগিয়ে ধরলো বাবলু। নীরা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। বাবলুর হাতে বসা খরগোশটাও ভীত চোখে টালুমালু করে তাকাচ্ছে কর্ণ উচিয়ে। নীরা মায়াভরা দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিটি মানুষের কিছু শখ থাকে। কৈশোরে নীরার শখ ছিল খরগোশ পালার। ওদের পাশের বাসার ইফতির অনেকগুলো খরগোশ ছিল। সাদা তুলতুলে লোমশওয়ালা খরগোশ। নীরা ওদের বাসায় এই খরগোশ দেখতেই যেত বেশি। তার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সেগুলো। ইফতি তাকে কথা দিয়েছিল একটা খরগোশ দেবার। সেকথা ইফতি পরে আর রাখে নি। ইফতির বাবা বদলি হতেই ওরা চলে গেল। যাওয়ার সময় এমন একটা ভাব করল যেন নীরাকে সে চেনেই না। খুব কষ্ট পেয়েছিল নীরা সেদিন। ভেবেছিল টিউশনি করে কিনবে একটা,সেটাও হয়নি৷ দেড় রুমের ভাড়া বাসায় তাদেরই ঠিকমতো জায়গা হতো না, সেখানে অন্য জীব এনে কী করে রাখবে? নীরার বাবা দিলই না অনুমতি৷ নীরার সেই আক্ষেপ আজও ঘোচে নি। আজ যখন এই খরগোশটা সামনে এলো। নিজের অতীত আকাঙ্ক্ষা পুনরায় জেগে ওঠে। একটা খরগোশই তো চেয়েছে সে? তাতে কী খুব বেশি লোভ করে ফেলেছিল? নীরা ডুকরে কেঁদে ওঠে খরগোশটার দিকে তাকিয়ে। নীরাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল বাবলু। করুন মুখে বললেন,

” ওকি! কান্দো ক্যা? খরগোশ পছন্দ হয়নাই? হয়নাই পছন্দ? ” মাথা নাড়িয়ে কথা শেষ করেই হাতের খরগোশটা ছেড়ে দেয় নিচে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের উপর খরগোশটা দাপাদাপি করে বেরিয়ে এলো আগুন গায়ে। তাতে লাভ আর হলো না। ততোক্ষণে লোমশ পুড়ে চামড়ায় আগুন ধরে গেছে। কিছুক্ষণ কাতরাতে কাতরাতে দম ছাড়ল খরগোশটা। নীরা অশ্রুসিক্ত বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইল প্রাণহীন আধাপোড়া খরগোশটার দিকে। তার নেত্র পল্লব স্থির,স্ক্লেরা এবং টেয়ার ডাক্ট রক্তিম। নীরা কতোক্ষন এভাবে ছিল তার মনে নেই। বাবলু নীরার চুলের মুঠি ধরে টেনে ওঠায়। একটা গাছের দিকে ছুঁড়ে মেরে গলা চেপে ধরে। হুঙ্কার দিয়ে বলে,

” ভাবছিলি বাইচ্যা যাবি তুই? আমি বাবলু! সারাটা জীবন গোলাম হয়ে থাকছি রইস চৌধুরীর। তার জন্য কতো খুনখারাবি করছি,মানুষ পিটাইছি। তার অপরাধে নিজে জেল খাটছি। কেন এতো কিছু করছি জানোস? সে আমার মালিক! আমি তার গোলাম। আর আমি বাইচ্যা থাকতে তারে তোরা মিইল্যা পাগল বানাইছস? পয়লা তোরে মারমু। কেমনে মারমু জানোস? গলা কাইট্যা! এক্কারে আহনাফ বাবারে যেমনে তোরা মারছোস ওমনে। তারপর ঐ উকিল আর সাংবাদিকরে মারুম। তোগোরে মাইরা আমি আমার মালিকের কাছে যাইয়া সব কমু। আমার মালিক ভালা হইয়্যা যাইব হেরপর!” বাবলু দাঁত বের করে হাসছে। ভয়ংকর সে হাসি। গলা চেপে ধরায় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে নীরার। তবুও অস্ফুটে বললো,

” চাচা বিশ্বাস করেন আমি আহনাফকে মারি নাই। আমি তো ওর স্ত্রী ছিলাম চাচা। আমি কী করে মারতে পারি বলেন?”

” চুপ! নাটক করবি না। ইসত্রি ছিলি না তুই ওর। তোরে তো নিরুপায় হয়ে বিয়া করছিল বাবায়। তোর ভাগ্য ভালো ছিল, নয়ত আমি তহন বাইরে থাকলে তুই আজ জিন্দা থাকতি না। তগো ফুসলানিতেই জরিনা ওরে মারছে। সব দোষ তগো। তোরে তো মরতে হইবোই। কেউ বাঁচাইতেই পারত না তোরে।” বাবলু চাদর সরিয়ে কোমর থেকে ধারালো ছুরি বের করে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন শান দেওয়া ছুরি। নীরা মৃত্যুকে দেখছে সন্নিকটে। চোখ খিচে বন্ধ করে আছে। বুকের ভেতটা ঢিপঢিপ করছে প্রচন্ড বেগে। দু’চোখে অবাধে ঝরছে নোনাজল।

দীর্ঘ দিন খুনখারাবি করে বাবলুর মধ্যে একধরনের পৈশাচিকতা কাজ করে। এখন সহজে মানুষ মারে না সে। একটু জ্বালা যন্ত্রণা দিয়ে দাপাদাপি করিয়ে মজা নেয় প্রথমে। তারপর মারে। আজও তাই করল। নীরার দু বাহুতে ছুরির সূক্ষ্ণ কোনা লাগিয়ে টান দেয়। নীরা ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে, দু’হাত রক্তে রঞ্জিত। মাথা ঝুঁকে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে নীরা। বাবলু হো হো করে হাসছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সে হাসির রোল পাহাড়ে পাহাড়ে বারি খেয়ে ভূতুরে শব্দের সৃষ্টি হয়। বাবলু একহাতে নীরার গলা ধরে আছে অন্য হাতে ছুরি দিয়ে গলার নিচ বরাবর টানতে টানতে পেটের কাছে এসে থামল। নীরা অর্ধ বিবস্ত্র হয়ে পড়েছিল প্রায়। নিজের লজ্জা ঢাকতে সকল ব্যথা ভুলে বাবলুর তলপেট বরাবর কষিয়ে লাথি মারে সে। বাবলু দূর্বল নয়। বয়স বায়ান্ন হলেও হাট্টা খাট্টা শরীর তার। নীরার দূর্বল লাথিতে একটু দূরে সরে গেল কেবল। নীরা ব্যথায় রক্তাক্ত অবশ প্রায় হাত দু’টো দিয়ে বুকের সম্মুখের ছেঁড়া কামড় জড়িয়ে বললো,

” জানোয়ার! একবারে মেরে ফেল।”

” একবারে মারলে তো মজা নাই।” বাবলু এগিয়ে আসতেই নীরা পা টেনে টেনে দূরে সরে। একটু দূরেই ওর নতুন কেনা বার্মিজ চাদরটা পড়া। নীরা চাপা গোঙাতে গোঙাতে এগিয়ে গেল সেখানে। চাদর গায়ে জড়িয়ে দম নিল জোরে জোরে। পেছনে বাবলুর আগানোর পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। নীরা তো হার মেনেই নিয়েছিল, তবুও কেন তাকে ফের বিবস্ত্র করবে এরা? নীরার চোখের জল থেমে যায়। এই ক্ষণে মনে পড়ল বাসে বসে বলা আমরিনের কথা। মনে পড়ল তার বোন শারমিন এবং মেহেরের দেওয়া সাহসের কথা। নিজের দূর্বলতাকে ধিক্কার দিল নীরা। ঘুরে দাঁড়াল টালমাটাল পায়ে। বাবলু থেমে গেল। সে দেখল ভয়ের নাম নিশানাও নেই নীরার মুখে। রক্তাক্ত, ক্ষত বিক্ষত ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটে আছে।
বাবলুও হাসে। বলে,

” পাগল হইয়্যা গেছস গা? মজা পাইলাম। বহুত মজা পাইলাম। এইডাও কমুনে মালিকরে যাইয়্যা।” বাবলু ছুটে আসে ছুরি নিয়ে নীরার দিকে। নীরা নিশ্চল, স্থির।

রাত এগারটা পর্যন্ত লাইট মেরে পুলিশ এবং কিছু স্থানীয় লোক খোঁজাখুজি করল। এরমধ্যে রাফসানও চলে আসল সেখানে। বিধ্বস্ত চেহারা তার। অস্থিরতা তার সবকিছুতে প্রকাশিত। পুলিশদের সাথে নিজেও খুজল। এগারোটা পর্যন্ত খুঁজে শেষে সবাই ক্ষান্ত দিল খোঁজা খুজিতে। রাফসান এবার একাই যাবে বলে স্থির করল। সে আরও গভীরে গিয়ে খুঁজবে নীরাকে। উপস্থিত কেউ তার সিদ্ধান্ত মেনে নিল না। কারন এমনিতেও গভীরে যাওয়াটা রিস্ক তারউপর এখন রাত। পুলিশ বুঝাল সকালে দরকার হলে তারা সেখানে যাবে। রাফসান কারো কথা শুনতে রাজি নয়। এক সেকেন্ড ব্যয় না করে একপ্রকার সবার সাথে ধস্তাধস্তি করে ছুটে গেল জঙ্গলের ভেতর। হাতে টর্চ আর লাইন্সেসকৃত রিভলভার। কিছুদূর যেতেই সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দে থেমে গেল সে। ভালো করে চারপাশে টর্চ মারতেই দেখতে পেল চার/পাঁচ কদম দূরের গর্তে সাপ ঢুকছে। রাফসান বুঝল তাকে কতোটা সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে। রাত হওয়ায় ঘাসে শিশিরকণা জমতে শুরু করেছে। হাঁটুপর্যন্ত ভিজে গেছে ঘাস মাড়িয়ে চলতে চলতে। আশেপাশে বন্য হাতি আছে। রাফসান লাইটটা চাদরের তলে নিল। তাতে আলোটা বেশ ক্ষীণ মনে হচ্ছে এখন। এভাবেই সতর্কে এগিয়ে চললো দিশাহীন পথে। মনের ভেতরে কালবৈশাখীর তান্ডব চলছে। মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে মনোযোগ হারিয়ে রাফসান। নীরার কিছু হয়ে গেলে সে বাঁচবে কী করে? ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে তার অর্ধেক প্রাণ। যতোদূর এসেছে চিহ্ন এঁকে এঁকে এসেছে। ফেরার সময় যেন জলদিই সেই চিহ্ন অনুসরণ করে ফিরতে পারে তাই। বেশকিছুটা পথ অতিক্রম করতেই কোথাও মনুষ্য হাসির শব্দ শুনতে পেল রাফসান। চমকিত চোখে কান খাড়া করে শুনলো সে হাসি। ভালো করে খেয়াল করতেই সে টের পেল হাসির উৎসস্থল কোনদিকে। তীব্র গতিতে ছুটছে সেদিকে রাফসান। এই ক্ষণে ভুলেই গেল এই শ্বাপদসংকুল অরন্যের কথা। যা থাকল মনে তা কেবলই নীরাকে নিয়ে ভাবনা। রাফসান ঠিক পথেই এগিয়েছে। ঘাসের উপর কাউকে হেঁচড়ে নেওয়ার চিহ্ন দেখতে পেল এগিয়ে। টর্চের আলোয় ঘাসের উপর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে থমকে গেল সে। হঠাৎ পাশ থেকে ভেসে এলো আর্তচিৎকার । আবার ছুটছে রাফসান। বুকটা ভার হয়ে আসছে। যতো এগোচ্ছে ততোই ভারী হচ্ছে শ্বাস। রাফসান এসে থামল কাঠ-জ্বলা সেই জায়গাটায়, যেখানে একটু আগে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়েছে নীরার উপর। এক আঙ্গুল ঘাস বিছানো এখানটাজুড়ে। অদূরে ছাই চাপা আগুন। রাফসান নিজেকে সামলে টর্চের আলো ঘুরাতেই দু’কদম দূরে আবার রক্ত দেখল। পা নড়ছে না রাফসানের। বুক ফেটে কান্না আসছে। গাছটার কাছে এসে দাঁড়ায় রাফসান। পুরোটা জায়গার ঘাসে, গাছের গায়ে রক্ত আর রক্ত। অস্পষ্ট স্বরে নীরাকে ডাকে প্রথমে তারপর চিৎকার করে ওঠে নীরার নাম ধরে। হন্যে হয়ে খোঁজে জায়গাটার ঝোপঝাড়। শূন্য হাতে ফিরে আসে সেই রক্তমাখা গাছের কাছে ফের। হাঁটু ভেঙে কান্নায় ভেঙে পড়ে। রাফসানের কান্না থামে কারো টেনে টেনে চলার আওয়াজে। রাফসান ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। কতোক্ষন ওভাবে তাকিয়ে ছিল তার খেয়াল নেই।

নীরা বাঁচবে না জেনেও এই শেষ সময়ে লড়তে চাইল। তাকে এই বাঁধার দেয়াল ভাঙতে হবে, এই কথাটাই শুধু এলো ভাবনায়। কাঠ-খড়ের আলোয় সে ঝাপসা চোখে সামনে খাদ দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে মরবে কিন্তু তার আগে এই মানুষ নামের জানোয়ারটাকে শেষ করতে হবে তাকে। জরিনা খালা নিজের জীবন দিয়ে দিল তারই জন্য। হ্যাঁ তারই জন্যে মরেছে জরিনা খালা। তাকে ঐ যন্ত্রণার জীবন থেকে মুক্তি দিতে নিজেকে শেষ করেছে জালিমের হাতে। তবুও স্বেচ্ছায় নত মস্তকে আবার জালিমের জুলুম সইবে? তাকে বাঁচার আশা যারা দিল তাদের জীবন এই পশুর হাতে শেষ হতে দেবে? না! না! নীরাও জরিনা হবে আজ! নিজ হাতে জালিম বধ করবে। নীরার ভয়, ডর একনিমেষে দূরীভূত হলো। অবিন্যস্ত চুলে, রক্ত মাখা ক্ষত বিক্ষত মুখশ্রীতে ফুটল নির্ভিক হাসি। অত্যাচারী জালিমেরা কখনোই মজলুমের সে হাসি সহ্য করতে পারে না৷ রক্ত গরম হয়ে ওঠে,মাথা খারাপ হয় ওদের। বাবলুরও তাই হলো। ছুটে গেল নীরারকে শেষ করতে। নীরা স্থির দাঁড়িয়ে ছিল বাবলুর সামনে। বাবলুকে ছুটতে দেখে দ্রুত সরে গেল পেছনে নীরা। বাবলুর কোনো খেয়াল নেই সেদিক। সে বদ্ধ উন্মাদের মতো হুঙ্কার দিয়ে ছুটে আসে। পাহাড়ের একদম কোনায় দাঁড়িয়ে রইল নীরা। শেষবারের মতো এইটুকু জীবনে সকল পাওয়া না পাওয়ার স্মৃতি ভেসে উঠল চোখে৷ আজ কোনো দুঃখ নেই ওর। দু’চোখে আনন্দ অশ্রু। জীবনের অর্থ ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকায় নয়, তা যে আজই বুঝেছে সে। আরও কিছুকাল এমন সাহসী হয়ে বাঁচতে পারলে ভালোই হতো হয়তো। নীরা চওড়া হাসি হাসল। বড়ো প্রশান্তির সে হাসি। দেহের ব্যথা সব ধুয়ে গেল সেই আনন্দ অশ্রুর জলে। নীরার পেট ছুঁয়ে ছুরি সমেত নিচের খাদে পড়ে গেল বাবলু। আর্তচিৎকারে মুখরিত এই নিস্তব্ধ গভীর রাত। নীরা উবু হয়ে পড়ে ছিল অনেকক্ষণ। ভেবেছিল সহজে মরে যাবে। কিন্তু মরল না সে। ভীরুতা ঘুচিয়ে বাঁচার সাধ যে এখনো বিদ্যমান। গায়ে চাদর জড়িয়ে পড়ে থাকা ছেঁড়া কাপড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে নেয়। টেনেটুনে এগিয়ে বড় একটা গাছে হেলান দিয়ে অচেতন পড়ে ছিল। রাফসানের গলারস্বরে চেতনা জাগ্রত হয় নীরার। প্রথম দিকে নড়তে পারছিল না। অনেক কষ্টে গাছ ধরে উঠে দাঁড়ায়। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে আসে সমস্ত শক্তি দিয়ে। রাফসান হারানো প্রিয় মানুষটাকে এইরূপে ফিরে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে ছিল কিছুক্ষণ। নীরা আর দু’কদম এগোতেই কোনোকিছুর সাথে বেঁধে হুমড়ে পড়ে ঘাসের উপর। রাফসান “নীরা” বলে ছুটে এসে নীরার দেহটা বুকে টেনে নেয়। নিজ হাতে নীরার মুখের উপর পড়া অবিন্যস্ত চুলগুলোকে সরিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,

” নীরা! কিছুই হবে না তোমার। চোখ খোলো প্লীজ!”

রাফসানের ঝাকুনিতে নীরা টিপটিপ করে তাকায়। রাফসান বার বার অভয় দিচ্ছে তাকে। নীরা অপলক চেয়ে আছে রাফসানে অশ্রুভেজা মুখে। রাফসান কালক্ষেপণ না করে যে পথে এসেছিল সেপথে রওনা হয় নীরাকে কোলে তুলে। নীরা তখনও দূর্বল নেত্র পল্লব তুলে রাফসানকে দেখছিল। মৃদু হাসল নীরা হঠাৎ। ছুটন্ত রাফসান ভ্রুকুটি করে রেগে বললো,

” হাসছ কেন?”

” কী অদ্ভুত আমার জীবন। যেই ভালোবাসাকে এতোকাল চেয়ে আসলাম; আজ তাকে পেলাম আমার এই শেষ সময়ে।” কথাটা অস্ফুটে বললো নীরা। এই টুকু বলতেই তার কষ্ট হচ্ছিল। রাফসান ধমক দিয়ে বললো,

” একদম ফালতু কথা বলবে না। শেষ সময় কী হ্যাঁ? কিছুই হবে না তোমার। আমি কিছু হতেই দেব না।” কাঁদছে রাফসান। কান্নার কারনে শরীরের শক্তি কমে আসছে। থেমে হাঁটু মুড়ে শ্বাস নিল জোরে জোরে। তারপর আবার ছুটতে লাগল। নীরা দূর্বল হাতটা বাড়িয়ে রাফসানের গাল ছুঁয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে। রাফসান সকরুণ স্বরে বলে,

” কষ্ট হচ্ছে খুব? ”

নীরা ঘাড় নাড়িয়ে না বলে। রাফসান বললো,

” মিথ্যা বলছ আমাকে?”

” আপনি এতো কেন ভালোবাসলেন আমাকে? আমি যে এখন মরেও শান্তি পাব না।” নীরা টেনে টেনে বলে।

” চুপ! একদম কথা বলবে না আর। যতোসব ফালতু কথা বলো শুধু। বললাম না কিছু হবে না তোমার।”

রাফসান ছুটতে ছুটতে অনুুভব করল নীরার চুপ হয়ে গেছে। একবার বুকে মাথা রাখা নীরার দিকে তাকাল সে। নীরা চোখ মুদে, নিথর পড়ে আছে তার বুকে। রাফসান কয়েকবার ডাকল নীরাকে কিন্তু সাড়া পেল না। পাগলপ্রায় রাফসান নগ্ন পায়ে ছুটছে সামনে। চোখের চশমাটা কখন পড়ে গেছে খেয়াল নেই। তার সম্মুখ ক্রমশ ঝাপসা হতে লাগল। দেহশক্তি কমে আসছে ধীরে ধীরে। ঝাপসা চোখে অদূরে ক্ষীণ আলো দেখতে পেয়ে অন্ধকারেই ছুটছে শক্তি জুগিয়ে। অল্প কিছুদূর গিয়েই পড়ে গেল রাফসান নীরাকে বুকে নিয়ে। দু’চোখ বন্ধ হওয়ার পূর্বে অশ্রুবিসর্জন হলো নীরার মুখটা দেখে,,,

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে