ক্যাকটাস? পর্ব ০৫

0
2217

ক্যাকটাস?
পর্ব ০৫
Writer Taniya sheikh -Tanishq

রাফসান যা ভেবেছিল তাই হলো। রইস চৌধুরী রাফসানকে এখানে ডেকেছে তার ডান হাত বাবলুর জামিনের ব্যাপারে। রাফসান তৎক্ষণাৎ হা না কিছু বলে নি। স্থানীয় থানায় খোঁজ নিতে এসে জানতে পেরেছে বাবলু দাগী আসামী। তার নামে খুন, বলপ্রয়োগ,ভাঙচুর সহ কয়েকটি মামলা রয়েছে। রাফসান চুপচাপ থানার বাইরে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে একপ্রকার ঠান নিয়েছে আজই চলে যাবে চট্টগ্রাম। রইস চৌধুরী বা তার পরিবারকে রাফসানের কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। আজ তো নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। কেন সে এলো এখানে। মায়ের কথায় এখানে আসা উচিত হয় নি তার। থানার ডান দিকে দৃষ্টি সরাতেই অদূরে একটা মেয়ের উপর চোখ পড়ে। মেয়েটা ক্ষিপ্ত মেজাজে কনস্টেবলের সাথে তর্ক করছে। তাদেরকে ঘিরে উৎসুক জনতার ভীর। রাফসান এগিয়ে যায় সেদিকে। যতো এগোয় ততই মেয়েটির কথা স্পষ্ট শুনতে পায়।

” দেখুন সহজভাবে বলছি মেয়েটির ঠিকানা আমাকে দিন।” মেয়েটি তর্জনী তুলে বলে

” আমি কোনো মাইয়্যা,টাইয়্যা চিনি না। যান তো। হুদাই ডেলি ডেলি আইয়্যা ক্যাচাল করে।” কনস্টেবল বিরক্ত প্রকাশ করে।

” তাহলে আপনি দেবেন না ঠিকানা? ” মেয়েটি বললো

” বললাম তো কার কথা কন চিনি না আমি। থানার সামনে এমনে গ্যাঞ্জাম করলে জেলে ভরে দেব।” কনস্টেবল রেগে গিয়ে বললো। মেয়েটি তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে সে রাগ মোটেও পাত্তা দিল না। দ্বিগুন তেজে বললো,

” কাকে ভয় দেখান আপনি? জানেন আমি কে? সাংবাদিক। লুক। ” গলায় ঝুলানো আইডিপ্রুভ দেখিয়ে বলে।গলা চড়িয়ে আবার বলে, “নেক্সট টাইম জেলে ভরার থ্রেট অন্য কাউকে দিয়েন৷ কতবড় শয়তান এইগুলো ভাবা যায়? একটা অসহায় মেয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঠিকানা লুকিয়ে আপনার ঐ বাপ গুলো বাঁচতে পারবে আইনের হাত থেকে? নো ওয়ে। এই মেহের সবকটাকে খুঁজে কোটে তুলবে। মেয়েদের ভোগবিলাসের বস্তু ভাবা তাই না? তিন দিন! এই তিনদিনের মধ্যে খুঁজে বের করবো ঐ মেয়েকে আমি। তারপর দেখবেন কী করি আপনাদের? ” মেয়েটা তুড়ি বাজিয়ে বলে। এমন মারকুটে সাহসী মেয়ে জীবনে প্রথম দেখলো রাফসান। মেয়েটির পার্সোনালিটি বেশ মুগ্ধ করল তাকে। মেয়েটি রাস্তার উল্টো পাশে রাখা বাইকে চড়ে বসলো। জিন্স,টপস আর গলায় ঝুলানো ওড়না পরিহিতা মেয়েটি হেলমেট, কালো সানগ্লাস পড়ে বাইক ছুটিয়ে চলে গেল দৃষ্টি সীমানার বাইরে।

রাফসান এ বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করবে ভেবে একটা চায়ের টংএ গিয়ে বসল। চায়ের টংটা থানার মুখোমুখি। রাফসানকে কিছু জিজ্ঞেস করা লাগল না আগ বাড়িয়ে। সে চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনলো সেই ঘটনা। একজন মুরুব্বি গোছের লোক টংএ বসে সবাইকে উদ্দেশ্যে করে ঘটনাটা এভাবে বর্ণনা করল,” পাশ্ববর্তী মহল্লার এক স্কুল মাস্টারের মেয়েকে গত মাসে তুলে নিয়ে যায় কিছু গুণ্ডারা। গুণ্ডা বলতে ঐ মহল্লার প্রভাবশালীর পুত্র। মেয়েটাকে বেশ ক’মাস ধরে নাকি উত্ত্যক্ত করে আসছিল ছেলেটা। মেয়েটা একদিন ধৈর্য হারা হয়ে চড় বসিয়ে দেয় গালে। ব্যস হয়ে গেল মহাভারত অশুদ্ধ ছেলেটার জন্য। একটা চড় খেয়ে তার জাত গেল, জাত গেল অবস্থা। জাত কী করে ফিরাবে? মেয়েটাকে রেপ করে? ভালোবাসার এই নমুনা। এই নাকি ভালোবাসা বুঝছ তোমরা? আমাদের জামানায় ভালোবাসা মানেই চোখাচোখি, মুচকি হাসা,প্রত্যাখ্যানেও মধুর বেদনা ছিল। আর এখন মুখেও আনা যায় না এদের কথা। যাক যেটা বলছিলাম,মেয়েটা ধর্ষণ হলো তো হলো আবার সমাজের যত লাঞ্ছনা সব তার মাথায় ঢালা হলো। মেয়েটার বাবা শিক্ষক হয়েও সম্মান বাঁচাতে হাতে পায়ে ধরে ঐ পশুদের কাছেই মেয়েকে দিয়ে এলো। প্রভাবশালী লোক বলে ভয় দেখিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে রেখেছে। এসব আমার শোনা কথা। তবে সত্য একশ ভাগ। এই যে সাংবাদিক মেয়ে দেখলে। এরা গোপনে খবর পেয়েছিল মেয়েটার ব্যাপারে। কিন্তু সত্যিটা উৎঘাটনের আগেই মেয়েটা গায়েব৷ মেয়েটাকে যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে না তাই আসল অপরাধীও আড়ালে। সব মানুষ স্বার্থ পর না বুঝলা মিয়ারা। সব যদি স্বার্থ পর হবে তাহলে এই মেয়েটা কেন এতোদূর থেকে ছুটে এলো? রেপ হওয়া মেয়েটাকে তো ও চেনেও না। তবুও দেখ কত মায়া। আর আমরা সব চেয়ে চেয়ে ভবের লীলাখেলা দেখছি।” বয়স্ক লোকটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রাফসান আরও কিছুক্ষণ নিরবে বসে তাদের কথা শোনে। কেউ মেয়েটার সঠিক ঠিকানা বলতে পারল না। সবাই বলছে এর কাছে শুনেছি ওর কাছে শুনেছি। হতাশ হয়ে চলে আসে সেখান থেকে রাফসান। তার নিজেরও যথেষ্ট খারাপ লাগছে মেয়েটির জন্য। মেয়েটি কী অবস্থায় আছে কে জানে?

সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে মসজিদের মাইকে। চারপাশে ধীরে ধীরে নামছে আঁধার আগমনের নিস্তব্ধতা। রান্নাঘরে বসে আছি জ্বলন্ত চুলার সামনে। গতকাল রাতের পর শরীরটা বুঝি চলছেই না আমার। আহনাফের সাথে দুপুরে দেখা হয় খাবার টেবিলে। হাবভাবে বুঝাল রাতের ঘটনার জন্য সে অনুতপ্ত। আমি মনে মনে হাসলাম। তার এসব উতলে ওঠা ভালোবাসা দেখলে ঘৃণা হয় আমার, প্রচন্ড ঘৃণা। কিন্তু বলতে পারি না নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে। গত রাতে যে পাশবিকতা দেখিয়েছিল, তা পশুতেও করে না সমগোত্রীয় কারো সাথে। অথচ তার দাবী আমি তার স্ত্রী। স্বামী স্ত্রী তো একে অপরের আভূষণ! তবে আমাকে বার বার লাঞ্ছনায় বিবস্ত্র করতে তার কেন লজ্জা হয় না। মনে মনে ক্ষিপ্ত হলেও বাহ্যিক ভাবে ঠান্ডা টমমলে জল হয়ে রইলাম। দুপুরে তার ভাই ছিল না বাসায়। মামিও রুমে বসেছিল শ্বাশুড়ির সাথে। আর আমার শ্বশুর তো সারাদিন বাড়িতে তেমন থাকেন না। সেই রাতে আসেন। আহনাফ এই সুযোগে খাবার টেবিলে ডেকেছিল তার অনুতপ্ততা বোঝাতে। আমিও জাহির করলাম বুঝেছি, ক্ষমাও করেছি। নিজ হাতে খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় আমার হাতটা ধরে সে। দয়াপরবশ হয়ে বলে,

” অনেক শুকিয়ে গেছিস রে তুই নীরা। কষ্ট মনে হয় বেশিই দিয়ে ফেলেছি। কী করব বল? তোর অতীত ব্যবহার মনে পড়লে মাথা ঠিক থাকে না। বুঝিসই তো কেন এমন করি?”

আমি ঘাড় নাড়ালাম। বললাম,” জি!”

আহনাফ বললো,” তাহলে আমার ব্যবহারে কষ্ট নিস না প্লীজ। যা হয়েছে ভুলে যা।এই তিনমাস কেন? পুরোটা জীবন আমি তোকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে কাছে রাখব। আব্বার সাথে কথা হয়েছে আমার। আব্বাও তোকে মন থেকে মেনে নিয়েছে। অতীত ভুলে যাওয়াটাই আমাদের জন্য ভালো হবে। কী বলিস?”

” আমার দেওয়া সামান্য একটা চড় ভুলতে পারেনি আজপর্যন্ত আপনি আহনাফ। আর আমি তো আপনার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত ভিতর বাহির। এতো সহজে ভুলে যাব সব? কী করে বলে দিন সে উপায়? এতো অসম্মান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা কী করে ভুলব?”

” কী রে চুপ করে আছিস যে? মন থেকে মেনে নিবি তো সব?”

” জি!” আমি শুকনো হাসি হেঁসে জবাব দিলাম। আহনাফ তা দেখে স্বস্তি ফেলল। বললো,” ছোটবেলা থেকেই রাগ আমার বেশি বুঝলি নীরা? তোকে কিন্তু মন থেকে চেয়েছিলাম আমি। এখনও চাই। তোর একটা ভুল আমাদের সবকিছু উলট পালট করে দিল। সেদিন যদি এমন করেই চুপচাপ সব মেনে নিতি। তবে এতোকিছু হতো না।”

আহনাফের কথা শুনে স্থির চোখে চেয়ে রইলাম নিচে। ভাবলাম সব দোষ কী আমার তবে? সেদিন কী প্রতিবাদ করে ভুল করেছিলাম? নাকি আজ ভুল করলাম সব নিরবে মেনে । কোনটা সঠিক? আহনাফ অনেক কিছু বলতে থাকল। তার সবই ছিল আমাকে আর তাকে ঘিরে। আমি নিরবে শুনছিলাম আর নিভৃতে জল মুছছিলাম চোখের। খাবার শেষে বাইরে যাওয়ার আগে তার তথাকথিত ভালোবাসা দিল আমাকে৷ দু’বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বললো বিকেলে আমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এখন। না তার আছে তার খবর, না তার কথার।

দুর্বল শরীরে রাতের রান্না শেষ করে টেবিলে সাজিয়ে রাখছিলাম সেসব। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে উঠলো। পড়েই যেতাম আহনাফের মামি না ধরলে। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,

” এই মেয়ে পড়েই তো যেতে না ধরলে। অসুস্থ নাকি?”

আমি বললাম,” না।”

” মিথ্যা বলো কেন? তোমাকে দেখলে যে কেউ বলবে তুমি অসুস্থ।” তিনি বললেন

” না আমি ঠিক আছি। আমি আসি।”

” এই দাঁড়াও। কথার মাঝখানে যাও কই? জরিনার মতোই বেয়াদব দেখছি তুমি। এদিকে আসো।”

আহনাফের মামির ধমকে চুপচাপ তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তিনি সূক্ষ্ম চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে বললেন,” এসব রান্না তুমি করেছ?”

” জি!”

” সকাল এবং দুপুরের রান্নাও?”

” জি!” আমার দিকে ভ্রুকুটি তাকিয়ে বসলেন চেয়ারে। কপালে ভাঁজ ফেলে কিছু ভেবে ফের বললেন,

” তোমার নামই নীরা তাহলে?”

” জি!’

” এতো জি হুজুর, জি হুজুর করছ কেন? অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ জানো তো?”

এবার আর কিছুই বললাম না আমি৷ মাথা নিচু করে রইলাম। আহনাফের মামি সামনে রাখা খাবারের বাটি থেকে কিছু খাবার টেস্ট করলেন। খাবার মুখে দিতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিগলিত গলায় বললেন,

” বাহ! রান্নার হাত তো দারুন তোমার। কার কাছে শিখেছ?”

” আম্মুর কাছ থেকে।”

” তুমি নাকি এতিম? ওহ বুঝেছি! অনেক আগে থেকেই এসব শিখেছ তাই না?”

” আমি এতিম না,তেমন গরিবও না। মেয়েরা এতিম, গরিব হলেই কী রান্না আগেভাগে শেখে?” আমাকে এতিম বলায় রেগে গেলাম আমি। কী বললাম হুশও নেই। এতিম শব্দটা শুনে কান্নায় এলো। ফুঁপাতে লাগলাম। আমার ব্যবহারে জ্বলে উঠলেন তিনি। বললেন,

” আবার মিথ্যা বলো? সকালেই শুনলাম তুমি এতিম আর এখন বলছ তুমি এতিম নও। মিথ্যা শুনেছি আমি তাহলে?”

” হ্যাঁ! ” আমি জোর গলায় জবাব দিলাম। কষ্ট, ক্ষোভ সমস্ত আমার চোখে টলমল করছে। আমার চোখের ভাষা বুঝল কিনা জানি না। চুপ করে গেলেন তিনি ৷ কিছু সময় বাদে নরম সুরে বললেন,

” তাহলে তুমি এতিম নও?”

” না!”

” জরিনা তোমার কী হয়?”

” খালা।”

” আপন খালা?”

” না তো!” কপাল কুঞ্চিত করে জবাব দিলাম। আহনাফের মামি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি তার নিরবতা দেখে বললাম,” আমি কী যেতে পারি?”

” যাও!” দু’কদম এগোতেই আবার ডাকলেন তিনি। শীতল গলায় ডেকে বললেন,

” তুমি কী রাগ করেছ আমার উপর নীরা?”

” আমি এখন কারো উপর রাগ করি না। রাগ করার অধিকার আমার আর নেই।” কথাটা বলে চলে এলাম রুমে। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। সবাই এমন কেন করে আমার সাথে? আমিও যে একটা মানুষ কেন সবাই ভুলে যায়? আমার কষ্ট কেউ দেখে না। কেউ না।

দরজায় খট আওয়াজে পাশ ফিরে চোখ খুললাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়ালই নেই। খালাকে দেখে ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত শরীরে উঠে বসলাম। খালাকে এই মুহূর্তে দেখাচ্ছে ঝড়ে বিধ্বস্ত পালতোলা নৌকার মতো। শাড়ির আঁচল শরীরে এলোমেলো প্যাঁচানো, চুলের অবস্থাও উশকোখুষকো। চোখের তারাদুটো স্থির খালার। আমার পাশে বসে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো। অশরীরী ভর করলে যেমন ভয়ংকর হাসি হাসে মানুষ,ঠিক তেমন করে হাসছে খালা। আমার লোম দাঁড়িয়ে গেল তার সে হাসি দেখে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” কী হয়েছে খালা? কই ছিলে সকাল থেকে?”

” অনেক কিছু হইছে রে নীরা? শুনবি কী কী হইছে?” থমথমে গলায় বললো খালা। মনে মনে ভয় পেলাম কিন্তু খালাকে বুঝতে দিলাম না। বললাম,

“বলো! তার আগে কিছু খেয়ে নাও। সারাদিন তো কিছুই খাও নি তুমি। বসো খাবার নিয়ে আসছি।” আমি উঠতে পারলাম না। খালা শক্ত করে আমার শীর্ণ হাতের কব্জা ধরে রেখেছে। ব্যথা লাগছে তবুও হাসলাম। বললাম,

” কী হয়েছে খালা? কিছু বলবে?”

” হ! তুই না শুনতে চাইলি কী কী হইছে? শোন!” খালা চাপা স্বরে বললো

” খেয়ে নাও তারপর শুনি।” আমি বললাম

” কী খামু?” চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল খালা।

” ভাত, মাছ, মাংসের তরকারিও আছে। যা বলবে এনে দেব। বলো কী খাবে?”

” রক্ত খামু। আহনাফের রক্ত খামু। আইনা দিবি? দিবি আইনা?” অপ্রকৃতিস্থের মতো হাত বাড়ায় খালা। ভয়ে দূরে সরে যায় আমি। একটু উঁচু গলায় বলি,

” এসব কী বলো খালা? ভয় দেখাচ্ছ কেন? আমার কিন্তু এসব ভাললাগছে না। সরো তুমি।”

খালা খিকখিক করে হাসে। আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,

” মোর জ্বালা! ভয় কিসের লো এতো? তোর তো সব শেষ করে দিছে এই শুয়ারের বাচ্চা। তাও ভয় পাস? কী হারানোর ভয় তোর? জীবন? হা! হা! হা! মরবি না কোনোদিন? মরতে তো হইবোই একদিন তাইলে ভয় পাস ক্যান লো ছেরি? আমারে দ্যাখ! আমিও তো আরেকটা নীরা। তয় তোর মতো ভীতু না। ওঁৎ পাইত্তা আছি। শিকার নাগাল মতো আইলেই ছিঁইড়া রক্ত বাইর কইরা খাইয়ালামু। রক্ত খামু কেন জানোস?”

খালা ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে প্রশ্ন করে। খালার আচরণ আর কথা শুনে ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে এতোটুকু৷ ফ্যাকাসে মুখে আতঙ্কিত চোখে ঘাড় নাড়ালাম। খালার ভয়ংকর চেহারা হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে গেল। নাক টেনে টেনে কাঁদছে খালা। আমি অবাক চোখে চেয়ে আছি। অনেক্ষণ কেঁদে খালা রক্তবর্ণ চোখে ফের আমার দিকে তাকায়। রাগমিশ্রিত স্বরে বলে,

” আমি কাওরে ছাড়ুম না। কাওরে না। আমার ওট্টুকুনি দুধের পোলাডারে পানিতে চুবাইয়া মারল এরা। আমারে কী কয় ঐ শুয়ার বুইড়া খাটাশ জানোস? তুই কেমনে জানবি? তুই তো ছিলি না। আমার শরীলডা খুবলাইয়া খাইছে ই কুত্তার বাচ্চা। আমার এই পেডে একটা পোলা আইল ওর কারনে। ” খালা আঁচল সরিয়ে পেটে হাত বুলাতে লাগল। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পুনরায় বললো,” আমি কী ইচ্ছা কইরা আনছি পোলাডারে ক নীরা?”

আমার কান্না আসছে খালার কান্না দেখে। কাঁদতে কাঁদতে আমি আবার ঘাড় নাড়ালাম। খালা খেঁকিয়ে উঠলো। বললো,” আমারে দিনরাত খাডাইয়া খাডাইয়া যখন পোলাডা মারতে পারল না জামাই বউ। তখন আরেক ফন্দি করল। আমার চান্দের লাহান পোলাডা। কী যে সুন্দর সুরৎ আল্লাহ দিছিল! তিনডা বছর যাইতে না যাইতে পানিতে ফালাইয়া চুবাইয়া মারল। সবাইরে কইল একলা একলা ডুইব্যা মরছে। পোলারে আমি ঘরে দরজা বন্ধ করে রাইখ্যা গেছিলাম। তাইলে পানিতে ডুববো কেমনে তুই ক? আমার পোলা আমারে কইছে। কী কইছে জানোস? কইছে ও মা, এরাই আমারে ডুবাইয়া মারছে গো। এরাই আমারে মারছে। এগো তুমি ছাড়বা না। শাস্তি দিবা। কঠিন শাস্তি। আমি আমার পোলারা কথা দিছি বুঝলি? কী কথা দিছি তোরে কমু না আমি। আমার পোলা মানা করছে কাওরে কইতে।”

খালা ঘর কাঁপিয়ে হাসছে। শুধু তার ঠোঁট দু’টোই হাসছে। চোখে বানের জল। বাঁধ ভাঙা বানের জল। কতকিছু ভাসিয়ে নেবে এ’ বানের জল তার আন্দাজ করা ভার!

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে