ক্যাকটাস?
পর্ব ০৩
Writer Tanishq Sheikh
এলো এলো বর্ষণ গগন গর্জে
হৃদয় আমার নাহি আজিকে হর্ষে।
মেঘের গর্জনে এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। ঘোর অন্ধকার ফুঁড়ে জ্বলে উঠলো আইপিএসের আলো। বাড়ির সবকটা রুমে সংযোগ নেই আইপিএসের। যে’কটাই আছে সেখানের আলোতেই বাইরে স্পষ্ট দেখা যেত তবে বৃষ্টির কারণে সে দেখায় সমস্যা হচ্ছে। দোতলার করিডোরের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো আমি। এখানে দাঁড়িয়ে পুরো বাড়ির সামনের অংশ অবলোকন করা যায় নিচের উঠোন, বড় গেট, সামনের পিচঢালা সরু রাস্তা, পাশের বিস্তীর্ন সমতলভূমি। অদূরে দিঘী সদৃশ্য মাছের বিশাল খামার। সবটা এই আধার নামা বৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। তবুও দেখছি। মনের চোখ দিয়ে না দেখাকে দেখছি আমি। একটু একটু করে সরে এলাম পাশের পিলারটার কাছে। সম্পূর্ণ ভর দিয়ে একপেশে হয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারচ্ছন্ন ঝুম বৃষ্টি দেখছি। শুধু কী দেখছি? না! মন প্রাণ উজার করে অনুভব করছি এই বাদলধারার প্রশান্তি। একহাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার খেলায় মাততে সাধ জাগল। প্রকৃতির মতোই বর্ষা মানব মনের ভেতরের আবর্জনা দূর করে। দূর করে হীনমন্যতা, জড়তা। বৃষ্টির এই টুপটাপ ঝরে পড়ার মধ্যে যে ছন্দ আছে,তা যেন প্রতিটি ছন্দপতন মনুষ্যের ভাবনা জাগায়। জোর করে ছন্দে ছন্দে বাঁচতে। আমারও ঠিক এই মুহূর্তে তাই ইচ্ছা হলো। ছন্দে ছন্দে কাঁদতে, ছন্দে ছন্দে মনের অব্যক্ত সকল ব্যথা, বেদন জানাতে। দ্বিতীয়টা না পারলেও প্রথমটা পারলাম আমি। নিরবে নিভৃতে বর্ষার ধারার সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদছি। সম্মুখ ভাগ বৃষ্টিতে ভিজে একাএকার আমার। করিডোরে আইপিএসের বাতি জ্বলে নি কোনো কারণবশত। শুধু একটু দূরে আহনাফের ঘর থেকে আলো ছিটকে বেরুচ্ছে। আমি আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম৷ পুরোপুরি অন্ধকারে গা লুকানোর চেষ্টা আমার। আজকাল চোখে আলোর তীব্রতা সহ্য হয় না। জ্বালা করে,বড্ড বেশি জ্বালা করে। চোখ বন্ধ করে শুকনো ঠোঁটে বৃষ্টির সতেজতা মাখছি। মুখমণ্ডল ধুয়ে চিবুক গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। হঠাৎ কারো ঠোঁটের উষ্ণতা অনুভব করলাম সেখানে। চিবুক ছোঁয়ানো জল কিছুতেই নিচে পড়তে দিচ্ছে না সে। বুকের বসন খুলে পড়ে সেই পুরুষের উন্মাদনায়। বৃষ্টির জল আর তার স্পর্শ পাল্লা দিয়ে ছুঁতে ব্যস্ত আমায়। অবশেষে বৃষ্টি হার মানল তার কাছে। ছিনিয়ে নিয়ে এলো কোলে তুলে একান্তই তার করে। এই ঘরে আসার সাধ্য বৃষ্টির নাই। এখানে তো কেবল একজনেরই রাজত্ব। আহনাফের! কেবল আহনাফের।
আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করছি আহনাফকে আমার ভালোবাসা দেওয়ার। কিন্তু মনের উপর জোর খাটানো কী এতোই সহজ? সকল চেষ্টা আমার ব্যর্থ হয় সেই সেদিনের লোমহর্ষক স্মৃতিচারণে।
আমার দু’হাত নিজে থেকে গলায় পেছিয়ে নেয় আহনাফ। আজকাল তার রূঢ়তা এই মিলন মুহূর্তে কিছুটা নরম হয়। আমার ঠোঁটে গভীর চুম্বন শেষে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল সে। নিরবতা ভেঙে একসময় বললো,
” এতো শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন তুই? নিজেকে শেষ করে আমাকে শাস্তি দিতে চাস?”
আহনাফের কথা শুনে তার চোখে চোখ রাখলাম আমি। এই চোখ দেখলে কে বলবে এই মানুষটার অন্তর কতোটা নিষ্ঠুর। কতোটা হিংসা আর উন্মাদ হয়ে ওঠে সামান্য প্রত্যাখ্যানে! দু’চোখ আমার জলে টইটুম্বুর। তা দেখে আহনাফ দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মন বললো,”এতোই নাকি সাহস তার। তবে এ চোখে চোখ রাখতে ভয় কেন?”
আহনাফ আর কথা বাড়াল না। ঘর জুড়ে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ। হঠাৎ দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগল কেউ। আহনাফ বিরক্ত হলো। রেগে গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করল,
” কে?”
” আব্বাজান আমি। তোমার জরিনা খালা।”
” খালা তোমার কী বোধবুদ্ধি একেবারেই কমে গেল? কেন বিরক্ত করছ? যাও বলছি।” আহনাফ ধমকের সুরে বললো।
” আমার ঠেকা পড়ছে তোমারে বিরক্ত করুম। তোমার বাপ কইছে নিচে আইতে তোমারে। তোমার জম,, কথাটা বলেই জিহ্বা কাটে জরিনা। দ্রুত কথা সংশোধন করে বলে,” তোমার মামতো ভাই আইয়া পড়ছে। উপরে আইসা নীরার লগে তোমারে দেখলে কী কইবা তারে?”
মামাতো ভাই আসছে শুনে চট জলদি আমাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নিচে নামল আহনাফ। শর্টস পড়ে দরজা খুলতে গেল। আমি দ্রুত উঠে কাপড় ঠিক করে এককোনে দাঁড়িয়ে রইলাম। আহনাফ দরজা খুলেই খালাকে ঝাড়ির সুরে বললো,
” রাফসান আসছে তো হইছে টা কী? এমন করে দরজা থাবড়াইতে হয় সেজন্য। পাগল ছাগল কোথাকার।” কথাটা বলেই পেছন ফিরে আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিল। দৃষ্টি তার অতৃপ্ততায় ভরা। রুক্ষ স্বরে বললো,
” নীরা শার্ট দে আমলারি থেকে।”
আমি দ্রুততার সাথে শার্টটা দিলাম তাকে। শার্ট নেওয়ার সময়ও তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টিতে। যেন এই শেষ দেখা তার আর আমার বুঝি।
” কই যাও না যে। পরে কিছু হইলে আমারে দুষাইতে পারবা না কইলাম।” আহনাফ দৃষ্টি সরিয়ে খালার মুখের দিকে কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
” তোমারে দোষ দিয়ে মাথা নষ্ট করব কোন ছাগলে। যত্তসব আজাইরা এসে জুটছে এ বাড়ি।” রাগে গজগজ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল আহনাফ। খালা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেঁসে বিড়বিড় করে কী যেন বলে আমার কাছে এলো। বললো,
” অক্ষনও দাঁড়ায় আছোস কেন লো ছেরি। যা কাপড় পত্তর গুছাই চল আমার লগে। বুজি তোরে আমার লগে ঘুমানোর হুকুম দিছে। আইজ থেইক্যা যতদিন রাফসান বাবায় এ বাড়ি আছে তুই আমার লগে থাকবি। চল! চল! দেরি করিস না আর।”
কাপড় গুছিয়ে পুটলি বাঁধতে সাহায্য করলো খালা। নিজের কাছে পুটলিটা নিয়ে আমার হাতটা ধরে নেমে এলো নিচে। নিচের কয়েকধাপ সিঁড়ি ডিঙাতে ডিঙাতে দেখলাম, আহনাফ,আহনাফের বাবা-মার সাথে বসে আছে দুজন নতুন মুখের মানুষ। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা অপরজন হয়ত রাফসান। আহনাফ, রাফসানের মধ্যে দৈহিক গঠনে সাদৃশ্য আছে কিছুটা। দু’জনই লম্বায় হয়তো সেম হবে। চেহারা আহনাফের চেয়ে উজ্জ্বল। চোখে ফ্রেমলেস রেগুলার চশমা পড়া। হেঁসে হেঁসে কথা বলছে সবার সাথে। হাসিটা যেন তারজন্যই মানানসই পুরোপুরি। এই প্রথম ভালো লাগা বলতে যা লাগে তাই লাগল রাফসান নামক মানুষটাকে দেখতে গিয়ে। আমার কেন! মনে হয় সবারই এই সুপুরুষটাকে এক দেখাতেই ভালো লাগবে। কথা বলার একফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করলেন তিনি। চোর ধরা খাওয়ার মতো লজ্জা,ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে মুখ নুয়ে রইলাম।
খালা টেনে ধরে নিয়ে এলেন তার ঘরে। চোখে মনে হয় ধাঁধা দেখেছি এমন লাগছে। রাফসান নামক গোলকধাঁধায় মনকে দুর্বল হতে দিলাম না। নিজের অবস্থান তো জানি আমি। আর তাছাড়া আহনাফের ভাই রাফসান। এখন পুরুষ মানুষকে দেখলে ঘৃণা হয় আমার। রাফসান কে দেখেও এমন হওয়া উচিত। ঘৃণা করা উচিত তাকেও। পুরুষ মাত্রই ভক্ষক। অবলা নারী ভক্ষক। কেন যেন কান্না এলো দু’চোখ ফেটে। পুরুষকে আল্লাহ বলশালী করেছে নারীকে অবলা পেয়ে ভক্ষণ করার জন্য নয়,রক্ষা করার জন্য, নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই পুরুষ যদি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে। তবে সে সর্বোচ্চ ঘৃণার ভাগিদার, অভিশাপের ভাগিদার, চরম শাস্তির ভাগিদার। নারীকে অসম্মান করার দোষে তাকে এই সমাজ কেন শাস্তি দেয় না? কেন তার ঘারেই চাপিয়ে দেয় বৈধ লাঞ্ছনার শিকার হতে? আজ হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠল মনটা। আহনাফের শাস্তির দাবিতে মুখিয়ে উঠল।
হিন্দু শাস্ত্র মতে দূর্গার সংহার রূপ কালি। ভারতীয় উপমহাদেশে এই দেবী দূর্গাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মাতৃরূপে পূজা করে আদিকাল থেকে। মায়ের মমতা,দয়ার রূপ দেবী দূর্গা। এই মমতাময়ীই আবার অত্যাচারীকে দমন করতে হয়ে ওঠে রণচন্ডি কালি। আজ নিজের ভেতর দূর্গার চন্ডিরূপ ধারণ করতে ইচ্ছা হলো। অসূর বদের মতো ত্রিশূলে বিধিঁয়ে মারতে ইচ্ছা করল আহনাফকে। আমার সুন্দর জীবনকে অসুন্দর করার দায়ে, আমার সম্মানের দেহে কলঙ্কের কাটা জন্মানোর দায়ে, আমার উঁচু মুখ লাঞ্ছনা,অপমানে জর্জরিত করে নিচু করার দায়ে আহনাফকে বধ করতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু হায়ঃ আমি হতে পারলাম না দেবী। নিজের অপমানের শাস্তি নিজ হাতে দিতেও পারলাম না। কেন এলে না দেবী আমার মধ্যে তুমি? কেন? কেন এতো দুর্বল আর অসহায় আমি? কেন? কেন? উপুড় হয়ে চাদর খামচে চাপা স্বরে কাঁদতে লাগলাম। খালা চকিত হয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। বললেন,
” এই নীরা! নীরা! কী হইছে তোর? এই ছেরি,কথা কস না কেন?”
আমি কাঁদছি শুধু। খালা একই কথা বার বার শুধাতে লাগলেন আর আমি কাঁদছি। অসহায়ত্বের পীড়নের পীড়ায় কাঁদছি। অসম্মানের অনলে দগ্ধ হয়ে জ্বলে পুড়ে যন্ত্রণায় কাঁদছি।
অতিথিদের রাতের খাবার টেবিলে সাজাতে ব্যস্ত আমি আর জরিনা খালা। কেঁদে কেঁদে চোখদুটো লাল আমার। খালা করুনার দৃষ্টিতে বার বার তাকিয়ে দেখছেন আমাকে। খালার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি আমার মতো কাজ করে যাচ্ছি। নিয়তি মেনে না নিলে যে যন্ত্রণার উদ্রেক হয় তা আর বাড়াতে চাচ্ছি না। প্রতিবাদ করা আমার মতো ভীতু, দরিদ্র মেয়ের সাজে না। আমাদের দাঁত কামড়ে সকল কিছু মেনে নিতে হয়। এটাই নিয়ম এই সমাজের। পাথর সমান কষ্ট বুকে চেঁপে কাজগুলো করে যাচ্ছি। খালা এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে সকরুণ স্বরে বললো,
” তুই ঘরে যা নীরা। বাকিটা আমি সামলে নিমুনে।”
” সমস্যা নেই খালা। আমাকে তো সব শিখতে হবে। এটাই যে আমার নিয়তি। ফাঁকি দিলে পরে আমারি বিপদ।” থমথমে গলায় বললাম আমি। খালাকে অশ্রুসজল হতে দেখে,
এক চিলতে ম্লান হাসি হাসলাম। খালা কিছু বলতে চেয়েও বললো না। থমকে রইল আমার দিকে চেয়ে। খাবার সাজিয়ে শ্বাশুড়ির কথামতো চলে এলাম খালার ঘরে। খালা রয়ে গেলেন সেখানে। রান্নাঘরের সাথেই খালার জন্য বরাদ্দ একটা রুম। রুমের মাঝখানে একটা চৌকি। তার উপর বিছানো পুরোনো একখান ময়লা চাদর। দু’টো তেল চিটচিটে বালিশ। আশেপাশে ময়লা কাপড়ের পুটলি আর একটা ভাঙাচোরা ওয়ারড্রব। দেয়ালের এককোনে জায়গায় জায়গায় ঘুণে খাওয়া একটা টেবিল। টেবিলের উপরে ধুলো ময়লার আস্তরণে পড়ে আছে খালার পানের বাটা, ময়লা চিরুনি,আয়না, আরও কিছু প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস। জানালা দিয়ে বৃষ্টি এসে ভিজে গেছে রুমের অনেকাংশ। আগের চাইতে বৃষ্টির মাত্রা এখন একটু কম। এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগও পুনরায় চালু হয়েছে। আমি চুপচাপ গিয়ে চৌকির উপর বসলাম। তেল চিটচিটে বালিশের উপর মাথা রাখলাম। অথচ এই আমিই একদিন ছিলাম শুচিবায়ু গোছের। সামান্য একটু ধুলো ময়লা গায়ে লাগলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলতাম। ছোট বোনটার সাথে অহরহ ঝগড়া লাগত ঘর অগোছালো দেখলে। আজ কারো সাথে ঝগড়া হলো না। এই দেহটাই ধুলি মলিন তবে অন্য কিছু পরিষ্কার কী করে চাইতে পারি? ঘরময় পুরোনো ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগছে। বেশি পানের পিকের গন্ধটা। পান,সিগারেটের গন্ধ আমি একদমই সহ্য করতে পারতাম না। আহনাফ এটা জেনে আমাকে বেকায়দায় ফেলতে রোজ আমার সামনে সিগারেট খায়। জীবন কতোকিছু মানাতে বাধ্য করে আমাদের! এসব ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এসেছিল ঘুমে। খালার ডাকে ঘুম ভাঙল।
” শোন নীরা, আমি একটু বাইরে যাইতাছি। আমার পানের জর্দা শেষ,বাজারে যামু আনতে। তুই দরজা ভিরায় শুয়ে থাক।” খালা টাকা আঁচলে বেঁধে বললো।
” এতো রাতে বাজারে যাবা? ভয় করবে না তোমার?” আমি শুধালাম।
খালা হাসলো।বললো,” ভয় কেন করব? আমারে ভয় দেখায় এমন সাহস এই তল্লাটে কার ব্যাটার?”
আমি বললাম,”তাই বলে এতো রাতে?”
” এতো রাত কই দেখলি। বাদলা নামছে তাই একটু বেশি রাত লাগতাছে মাত্র তো দশটা বাজে। বুইড়া বেডির আবার রাত আর দিন! টেবিলে খাওন ঢাইক্যা রাখলাম। খাইয়া ঘুমাই যাস। আমি গেলাম ”
খালা শাড়ি ঠিক করতে করতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি বসে বসে ভাবছি। কতো বয়স হবে খালার? আহনাফের মায়ের বয়সী! নাহ! তার চেয়েও কম হবে। গরীব মানুষগুলো খাটাখাটুনিতে আগেভাগেই বুড়িয়ে যায়। আর তারপর যদি মন থেকে তারা ধরেই নেয় তারা বুড়ো হয়ে গেছে তবে কার সাধ্য তাদের জোয়ান বানায়? খালার ময়লা পড়া টেবিলের দিকে তাকালাম। বড় স্টিলের প্লেটে খাবার রেখে অন্য আরেকটা প্লেট দিয়ে ঢাকনা দেওয়া। একটা পানির জগ আর গ্লাসও রেখে গিয়েছে খালা। খেতে ইচ্ছা করলো না। একগ্লাস পানি খেয়ে সিলিং ফ্যানটা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ময়লার ভারে সিলিং ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগছে অল্প। তবুও আজ শান্তির ঘুম হবে ভেবে চোখ বন্ধ করলাম। পুনরায় খালাকে নিয়ে ভাবছি। কত স্বাধীন আর নির্ভীক একটা মেয়েমানুষ খালা। রাত আর দিন তার কাছে আলাদা নয়। যখন মন চায় এভাবে বেরিয়ে যায়। কোনোদিন ফেরে রাতে তো কোনোদিন ফেরে না। গল্প গুজব করতে করতে আশপাশের কারো বাড়ির বারান্দায় আঁচল পেতেই শুয়ে রাত কাটিয়ে দেন। আমি আফসোস করি খালার স্বাধীন এবং নির্ভীক হওয়া দেখে। জরিনা খালা হতে পারলেও বুঝি জীবন আমার সার্থক হতো।
ঘুমিয়েই পড়েছিলাম হঠাৎ কারো ঠোঁটের এলোপাথাড়ি দংশনে চমকে উঠলাম। বাইরের ক্ষীণ আলোয় আমার উপরে যাকে দেখলাম সে আর কেউ নয় আহনাফ। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম,
” আপনি!”
” হ্যাঁ আমিই তো। কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলি নাকি?” আমাকে জবাব দেওয়ার সুযোগ তার ঠোঁট দিল না। আজ আবার হিংসা ভাব এলো তার ভেতরে। ঠোঁটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলাম। আমাকে আতঙ্কিত চোখে তাকানো দেখে আহনাফ বললো,
” রাফসানের দিকে ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছিলি? পছন্দ হয়েছে? ভাগবি ওর সাথে?”
আহনাফের কথা শুনে ঘৃণা হলো আমার। চোখ কুঁচকে মুখ সরিয়ে নিতেই চোয়াল চেঁপে ধরলো আহনাফ। চাপা রাগে বললো,
” আমি চাইলে তিনমাস কেন তিন’শ বছরেও তুই আমারি থাকবি নীরা। শুধুই আমার। তোর চোখ শুধু আমাকে দেখবে, তোর মনে আহনাফ ছাড়া অন্য কারো স্থান হলে শেষ করে ফেলব তোকে আমি। যা আমার, তা কেবল আমারই থাকবে নয়ত কারো নয়।”
আহনাফের কথার ভাবার্থ বুঝে বুক কাঁপছে আমার। কিছু বলার মতো অবস্থায় রাখলো না আমাকে আহনাফ। আবারও আমাকে বিনা দোষে শাস্তি দিল সে আজ। আমি নির্বাক, অপলক সব সহ্য করে গেলাম দু’চোখে জল গড়িয়ে।
চলবে,,,