#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
শ্রাবণের ফল্গুধারার মতো চিরাচরিত এক অকৃত্রিম অপরিচিত অনুভূতির প্রবাহ বুকের কোথাও যেন বয়ে গেল রূপকের। মিতুলের প্রাণবন্ত হাসিতে আঁখিদ্বয় তো মুগ্ধ হচ্ছে কিন্তু মনটা কেমন যেন রোষানলে ফেটে পড়ছে। এমন কেন হচ্ছে কে জানে! সে আর বারান্দায় দাঁড়াল না। রুমে চলে এলো।
মিতুল অনেকবার করে বলার পরও অনিক বাসায় এলো না। গেইট থেকেই বিদায় নিয়ে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর মিতুল ভেতরে গেল। তাকে এমন ভেজা অবস্থায় দেখে মমতা বেগমের বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি কথা বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। মিতুল রুম পর্যন্ত যেতে যেতে ড্রয়িংরুমসহ নিজের রুমের ফ্লোর গোসল করিয়ে ফেলেছে। ওয়াশরুমে ঢোকার পর মায়ের বাণী শুরু হলো। তিনি প্রচন্ড রাগারাগি করলেন বৃষ্টিতে ভেজার জন্য। কিন্তু মিতুল তো মিতুলই। সে যেন থোড়াই পরোয়া করল। মমতা বেগম রাগ প্রকাশ করতে করতে রুমের পানি মুছলেন। মিতুলের গোসল শেষ হলে সে রুমে এসে শুয়ে পড়ে। আজ একটা জম্পেশ ঘুম হবে।
খাওয়ার জন্য কয়েকবার ডাকলেও সে উঠল না। আরামের ঘুম এখন আর সে হারাম করবে না। তার নাকচ মা মেনে নিলেও জ্বর মেনে নিল না। জম্পেশ ঘুমের মাঝে এসেই মিতুলকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। ঘুম ভাঙার পর নিজেকে আবিষ্কার করল অন্যভাবে। চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। জ্বরে শরীর কাঁপছে। বার দুয়েক বমি করাও শেষ। মুখের রুচি তুঙ্গে। কোনো খাবারই তিতকুটে স্বাদের জন্য মুখে তুলতে পারছে না। অফিস থেকে ফিরে মেয়ের অবস্থা দেখে যারপরনাই অবাক হন তৈয়ব রহমান। তার ফুলের মতো মেয়েটার একি অবস্থা হলো! একদিনেই যেন শুকিয়ে কাবু হয়ে গেছে। তিনি আর ফ্রেশ হলেন না। ঐ অবস্থাতেই মিতুলকে নিয়ে ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একগাদা ওষুধ দিয়ে দিলেন। বাড়ি ফিরে তিনি নিজেই মেয়েকে জোর করে দু’মুঠো ভাত খাইয়েছিলেন। খাবার খেয়েই মিতুল থম মেরে বসে আছে। পেটের ভেতর থেকে খাবার যেন গলায় এসে আটকে আছে। বমি আসবে নির্ঘাত। টুটুলও অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে দেখে বাবা-মা মিতুলের রুমে। যত ঝগড়া-ঝাঁটি করুক, রাগাক; ভালোবাসে বোনকে তারচেয়েও বহুগুণে। ও অসুস্থ থাকলে বাড়িটাকে তখন আর বাড়ি বলে মনে হয় না। ধ্বংসপুরী লাগে। টুটুল মিতুলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“জ্বর এলো কী করে?”
“বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে।” মলিন মুখে উত্তর দিলেন মমতা বেগম।
আর কিছু বলার অবকাশ পেল না কেউ। মিতুল মুখ ভরে বমি করা শুরু করল। টুটুলের হাত, শার্ট মাখামাখি। মমতা বেগম জলদি এগিয়ে এসে মিতুলকে সরাতে চাইলেন। টুটুল হাতের ইশারায় বারণ করল। মিতুলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। তৈয়ব রহমান অস্থির হয়ে পড়েছেন। বমি করে মিতুল ক্লান্ত। শরীরে অবশিষ্ট শক্তি নেই আর। টুটুল মাকে বলল,
“ওকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দাও।”
তৈয়ব রহমান স্ত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
“কী দরকার ছিল বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটাকে কলেজে পাঠানোর?”
হয়তো কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু মিতুলের পড়াশোনার ব্যাপারে তার-ই তো কঠোরতা সবচেয়ে বেশি। ঠিকমতো ক্লাস না করলে তিনিই রাগ দেখান, বকেন। আর এখন উলটো কথা বলে স্ত্রীর ওপর রাগ দেখাচ্ছেন।আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে দোষটা মিতুলেরই। সে যদি ছাতা নিয়ে যেত কিংবা বৃষ্টিতে না ভিজত তাহলে এই হতচ্ছাড়া জ্বর তাকে পেয়ে বসত না।
টুটুল বাবাকে শান্ত করতে বলল,
“তুমি আম্মুর ওপর রাগ দেখাচ্ছ কেন? আম্মু কি ওকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলেছে?”
“দোষ কারও না। দোষ আমার কপালের।”
“তুমি প্লিজ শাও হও আব্বু। ঠিকমতো মেডিসিন খেলে আর যত্ন নিলেই সুস্থ হয়ে যাবে।”
এরপর টুটুল নিজের রুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। মিতুলের জায়গায় অন্য কেউ বমি করলে কি সে বরদাশত করত?
.
টানা তিনদিন জ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে মিতুলকে। জেদি জ্বর যে একেবারে চলে গেছে ঠিক তাও নয়। আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। শরীর আগের মতোই দুর্বল। রায়া, আর্শি এসেছে আজ। ওরা মিতুলকে দেখে ভীষণ আফসোস করে বলল,
“তিনদিনেই এত শুকিয়ে গেছ!”
“কপাল! তোমরা যদি সেদিন আসতে তাহলে কি আর আমি বৃষ্টিতে ভিজতাম?” কথাগুলো বলতে বেগ পেতে হলো মিতুলকে।
রায়া বলল,
“কী করব বলো বৃষ্টির মধ্যে একদম বের হতে ইচ্ছে করে না।”
“আর এমন হবে না। গেলে তিনজন একসাথেই যাব আর না গেলে কেউ-ই যাব না।” বলল আর্শি।
মিতুল মৃদু হাসল। মমতা বেগম নাস্তা দিয়ে দুজনের সাথেই টুকটাক কথাবার্তা বলে গেছেন। ওরা নাস্তা খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করল। চলে যাওয়ার মুহূর্তে রায়া বলল,
“তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।”
মিতুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। রায়া বলল,
“নওশাদ স্যার গতকাল তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। তোমরা কি পূর্ব পরিচিত?”
“হ্যাঁ। আগে আমি তার কাছেই প্রাইভেট পড়তাম। কী বলেছে?”
“ওহ আচ্ছা। তুমি কলেজে কেন আসো না সেটাই জিজ্ঞেস করল। আর তোমার নাম্বার নিয়েছে।”
“গতকালই?”
“হ্যাঁ, ফোন দেয়নি?”
“না।”
“পরে দিতে পারে। আচ্ছা শোনো, এখন আমাদের উঠতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে। তুমি তো মনে হয় আগামীকালও যাবে না কলেজে?”
“না গো!”
আর্শি বলল,
“দ্রুত সুস্থ হও ডিয়ার। একসাথে এখনো কত চিল করা বাকি আমাদের।”
মিতুল দুর্বোধ্য হাসল। আর্শি আর রায়াও হেসে বলল,
“এখন তাহলে উঠছি। নিজের খেয়াল রেখো। ঠিকমতো মেডিসিন নিও।”
“তোমরা আবার এসো।”
মিতুল ওদেরকে ড্রয়িংরুমের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
.
.
শুভ্র রঙের কাপে বাদামী রঙের পানীয়জলটি হলো চা। নওশাদ একজন তুখোড় চা প্রেমী। দুনিয়ার সমস্ত কিছু একদিকে আর অন্যদিকে চা। চা-কে সে কোনো কিছুর সাথেই কম্পেয়ার করতে পারে না। সে এখন আছে চৈতিদের বাসায়। তার সামনে সুন্দর ডেকোরেশনের কাপে রাখা আছে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। সে চায়ে এখনো চুমুক দেয়নি। ফোনের স্ক্রিনে বারংবার ডায়াল প্যাডে সেইভ করা মিতুলের নাম্বারে কল দিতে গিয়েও ব্যাকে ফিরে আসছে। গতকাল রায়ার থেকে নাম্বার নেওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কল করার মতোন সাহস কেন জানি করে উঠতে পারছে না। কল করে সে বলবেই বা কী? স্বাভাবিক কথোপকথন হয়তো হতে পারে। এই যেমন, মিতুল কলেজে কেন আসছে না, কী হয়েছে, কেমন আছে। যদিও এর বেশিরভাগ উত্তরই তার জানা আছে, তথাপি কথা বলার প্রসঙ্গ এগুলো ছাড়া অন্যকিছু আর নেই।
সংশয়, সংকোচ নামক দুটো শব্দ তার মনে আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছে। কোনোভাবেই জড়োতার সামনে টিকতে পারছে না। নিতে পারছে না মিতুলের কোনো খোঁজও। ভীষণ অস্থিরতার দারস্থ হয়ে সে চায়ে চুমুক দিল। চায়ের স্বাদে সে দু’চোখের পাতা বন্ধ করে বলল,’আহ্!’
চা দিয়ে যাওয়ার সময় চৈতি বলেছিল সে নিজের হাতে বানিয়েছে। খেয়ে যেন জানায় কেমন হয়েছে। বলাই বাহুল্য, নওশাদের মনে হচ্ছে চায়ের স্বাদ অমৃত। সত্যিই মেয়েটা ভালো চা বানায়। সে মূলত চৈতিদের বাড়িতে এসেছে তার মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজ সকালেই শামসুন নাহার চৈতির বাসায় এসেছেন। অবশ্যই চৈতির জোড়াজুড়ির জন্য তাকে আসতে হয়েছে। এছাড়া মা হারা মেয়েটার আবদার তিনি ফেলতে পারেননি। হাজার হোক, তিনিও একজন মা কিনা। দুপুরে ছেলেকে ফোন করে চৈতির বাসায় এসে লাঞ্চ করতে বলেছিলেন। নওশাদ অবশ্য আসেনি। দুপুরের খাবার সে হোটেলেই খেয়ে নিয়েছে। ক্লাস শেষ করে বিকেলে এসেছিল মাকে নেওয়ার জন্য। কিন্তু চৈতি এত জলদি যেতে দিতে রাজি নয়। ডিনার করে তারপরেই এখান থেকে যাওয়া হবে। নওশাদ খেয়াল করে দেখল, মায়েরও এতে সম্মতি রয়েছে। তিনি নিজেও চৈতিকে রেখে এখনই যেতে চাচ্ছেন না। অগত্যা নওশাদকেও থেকে যেতে হলো। এখন সন্ধ্যা। তাকে বিশ্রাম করার জন্য গেস্ট রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে। রাতের রান্নার আয়োজন করছে চৈতি এবং মা। রান্নাঘর থেকে দুজনের উচ্চস্বরে হাসির শব্দও ভেসে আসছে। মেয়ে মানুষ এত অদ্ভুত কেন? এত অল্প সময়েই এতটা আপন করে নেয়! আবার অল্প সময়েই ঘৃণার বাণে জর্জরিত করে ফেলে। শেষের কথাটি হয়তো সে মিতুলকে উৎসর্গ করেই বলেছে।
সেই যে চা এবং নাস্তা দিয়ে গেছিল, এরপর আর চৈতি আসেনি। এমনিতে তার চোখে-মুখে নওশাদের জন্য অপরিসীম চাওয়া-পাওয়া দেখেছে তবে আজ সেটা যেন স্থির। আজ সারাটা সময় শুধুমাত্র মাকে ঘিরেই। এই মেয়েটার যদি মা বেঁচে থাকত তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি একজন সুখী মা হতেন। নওশাদের ভীষণ মায়া, কষ্ট ও আফসোস হয় চৈতির জন্য।
_______
“বিষাদসিন্ধু” উপন্যাসটি রেখে রিনভী চটজলদি তৈরি হয়ে নিল। আয়ান এসে তাড়া দিয়ে বলল,
“হয়েছে আপু?”
“হ্যাঁ। অনিক কোথায়?”
“ভাইয়া তো রুমে। ডেকে আনব?”
“হ্যাঁ।”
আয়ান দৌঁড়ে গিয়ে অনিককে সঙ্গে করে নিয়ে এলো। রিনভী ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হতে হতে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আমাদের নিয়ে মিতুলদের বাড়িতে চল তো।”
“এই সময়ে ঐ বাড়িতে কেন?” জানতে চাইল অনিক।
“মিতুলের ভীষণ জ্বর। ওর ভাই পারে না শুধু ফোন দিয়ে কান্না করে।”
অনিকের একটু খারাপ লাগল। নিশ্চয়ই সেদিন তার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য জ্বরে ভুগছে মেয়েটা। সে খারাপ লাগাকে চেপে গিয়ে বলল,
“তুমি গিয়ে কী করবা?”
“আশ্চর্য! মেয়েটা অসুস্থ। দেখতে যাব না? তোর যেতে আপত্তি থাকলে বল আমি সিএনজি নিয়ে চলে যাচ্ছি।”
“না, না আপত্তি থাকবে কেন? আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। দেখলাম হবু ননোদের প্রতি তোমার দরদ কেমন!”
রিনভী চোখ পাকিয়ে তাকাল। অনিক ফিচেল হেসে বলল,
“নিচে গিয়ে দাঁড়াও। আমি রেডি হয়ে আসছি।”
.
টুটুল আচানক মিতুলের রুমে এসে পাউডার, লিপস্টিক, কাজল নিয়ে বিছানায় বসল। ব্যস্তভাবে বলল,
“এদিকে আয় তো মুতু কন্যা।”
মিতুলের মেজাজ বিগড়ে গেল। এমনিতেই মন, শরীর কোনোটাই ভালো লাগছে না। তার ওপর আবার টুটুলের ফাজলামো। সে বেজায় বিরক্ত হয়ে বলল,
“ভাইয়া, তুমি যাও তো এখান থেকে। আমার ভালো লাগছে না।”
মিতুলের কথাকে পাত্তা না দিয়ে হাতে পাউডার নিয়ে টুটুল এগিয়ে এলো। বলল,
“আয় তোকে একটু সাজিয়ে দেই।”
মিতুল মুখ সরিয়ে নিয়ে চিৎকার করে মাকে ডাকল। মমতা বেগম ভয় পেয়ে দৌঁড়ে এলেন। কোনো কিছু না শুনেই গড়গড় করে বলা শুরু করলেন,
“কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে?”
“তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও। কী শুরু করছে এগুলা?”
তিনি টুটুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে?”
টুটুল নিরপরাধের মতো বলল,
“কিছুই করিনি মা। আমি তো ভালো বুঝে ওকে একটু সাজাতে চেয়েছি।”
মিতুল রেগেই বলল,
“কেন? বিয়ে আমার?”
“তোর না হোক। দু’দিন পর আমার তো বিয়ে হবে। রিনভী আসছে আমার দুই শালাবাবুকে সাথে নিয়ে। ওরা এসে যদি তোর এই শাঁকচুন্নিমার্কা মুখটা দেখে তাহলে ভয় পাবে না? রিনভীর কথাবার্তায় তো গ্রীন সিগন্যাল পাচ্ছি। তাই শর্ত অনুযায়ী আমার একটা শালাবাবু তো তোকে দেবো। এখন ওরা ভয় পেয়ে কেউই যদি তোকে বিয়ে করতে রাজি না হয়?”
নাহ, মিতুল হতাশ। তার ভাইটা এমন কেন? সবসময় কেন তার পেছনে এভাবে লেগে থাকে? সে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল মা মিটিমিটি হাসছে। কার কাছে সে দুঃখের কথা বলবে? তার রাগ করারও আর ভাষা নেই। সে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে বলল,
“তোমরা প্লিজ যাও এখান থেকে।”
কেউ গেল না। বরং রিনভীও এসে উপস্থিত হলো তার দুই ভাইকে নিয়ে। না চাইতেও মিতুলকে তখন স্বাভাবিক হতে হলো। হাসিমাখা মুখে ওদের সঙ্গে কথা বলল। বেশ কিছুক্ষণ সময় রিনভী মিতুলের রুমে থেকে বলল,
“এখন তাহলে তুমি রেস্ট নাও বাবু।”
বাবু ডাক শুনে মিতুল অপ্রস্তুত হয়ে তাকাল সবার দিকে। বিশেষ করে অনিকের জন্যই সে বেশি লজ্জা পাচ্ছে। অনার্স পড়ুয়া মেয়ে বাবু হয় কী করে তার মাথায় ঢোকে না। যদিও রিনভী আপু হয়তো আদর করেই ডেকেছে কিন্তু তবুও! কেমন জানি।
মমতা বেগম ওদেরকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এলেন। আয়ান মিতুলের গাল টেনে বলল,
“দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের বাসায় এসো সুন্দরী আপু।”
মিতুল আয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে দিল। সবার সাথে দরজা পর্যন্ত গিয়ে অনিক একাই ফিরে এলো। প্যান্টের পকেট থেকে দ্রুত হাতে কিছু চকোলেট বের করে মিতুলের কোলের ওপর রাখল। দরজার দিকে তাকিয়ে দু’হাতে কান ধরে বলল,
“আ’ম এক্সট্রিমলি সরি মিতুল। আমার জন্যই এখন তোমাকে এতটা অসুস্থ হতে হলো। সেদিন বাইকে না এসে রিকশায় দিয়ে গেলে বৃষ্টিতে ভিজতে হতো না। প্লিজ ক্ষমা করে দিও। আর নিজের খেয়াল রেখো।”
কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না। বড়ো বড়ো পা ফেলে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। মিতুল পেছন থেকে বলল,
“আমি রাগ করিনি। আর সরি বলারও কিছু নেই। কিন্তু চকোলেটের জন্য থ্যাঙ্কিউ।”
অনিক যাওয়ার পূর্বে পেছনে তাকিয়ে মুচকি হাসল এবং হাত বাড়িয়ে রুমের লাইটটা নিভিয়ে দিল যাতে করে অন্ধকারে রুম ঠান্ডা হয় এবং মিতুলও স্বস্তিতে শুয়ে থাকতে পারে।
.
.
রূপক শুয়ে শুয়ে ফোনে গান শুনছে। গত পরশু তার জ্বর ভালো হয়েছে। এখন সে পুরোপুরি সুস্থ। তিনদিন ধরে মিতুলের কোনো খবর নেই। সে তো হরহামেশা বাইরে যাচ্ছে। একদিনও মিতুলের সঙ্গে দেখা হলো না। কলেজেও কি যায় না? না চাইতেও সে মিতুলের চিন্তায় বুঁদ হয়ে যায় মাঝে মাঝে। টুম্পা এসে সন্ধ্যার নাস্তা টেবিলের ওপর রেখে বলল,
“ভাইয়া, আম্মু বলছে সবগুলা এখানে তোমার পছন্দের খাবার। একটাও যেন না থাকে প্লেটে।”
রূপক ভাবল টুম্পাকে দিয়েই তো মিতুলের খোঁজ নেওয়া যায়। মিতুল স্বার্থপর হতে পারে। কিন্তু সে তো আর তার মতো নয়। সে শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
“টুম্পা শোন।”
টুম্পা চলেই যাচ্ছিল। ফিরে তাকিয়ে বলল,
“খবরদার এখন আর কোনো কাজ দেবে না। আমার অনেক পড়া বাকি আছে। পড়তে বসতে হবে।”
“কোনো কাজ দেবো না। শুনে যা।”
টুম্পা কাছে গিয়ে বলল,
“বলো।”
“মিতুলকে তিনদিন ধরে দেখি না। কী হয়েছে রে ওর?”
টুম্পা সহজ-সরল ধরণের মেয়ে। ওর মধ্যে কোনো প্যাচ নেই। তাই রূপকের হঠাৎ করে মিতুলের খোঁজ নেওয়াটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখল না। তার স্বভাবসুলভ শান্তভঙ্গিতে বলল,
“দেখবে কীভাবে? আপুর তো ভীষণ জ্বর! কলেজেও যায় না এখন।”
“বলিস কী!”
“হ্যাঁ। গতকাল আন্টির সাথে ছাদে দেখা হয়েছিল। তখন আন্টিই বলল।”
“ওহ। আচ্ছা যা পড়তে বোস।”
টুম্পা চলে যাওয়ার পর রূপক দোনোমনায় পড়ল। মিতুল অসুস্থ শুনেও কি তার একবার দেখতে যাওয়া উচিত নয়? আর সে যাওয়ায় বাড়ির মানুষরা যদি অন্যকিছু ভাবে!
.
.
মিতুল শুয়ে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। ঘুম আসছে না। কিছু ভালোও লাগছে না। অনিকরা মাত্রই চলে গেল। টুটুল গেছে এগিয়ে দিতে। কবে যে রিনভীর সাথে ভাইয়ের বিয়েটা হবে শুয়ে শুয়ে সে জল্পনাকল্পনা করছিল। ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে তখন। আননোন নাম্বার। মিতুল রিসিভ করে সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস-সালাম। আমি নওশাদ।”
মিতুল স্তব্ধ হয়ে গেল। বেশ অনেকক্ষণ পর শান্তকণঠে বলল,
“হুম বলেন।”
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি?” ভদ্রতাসূচক সেও জানতে চাইল।
“ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ্। রায়ার কাছে শুনলাম তুমি অসুস্থ। জ্বর কমেনি?”
“কমেছে একটু।”
“মেডিসিন নিচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
“খেয়েছ?”
“না।”
“কখন খাবে?”
“পরে।”
সাধারণ কথাবার্তা শেষ। এরপর আর কী বলা যায়? মিতুল তো সেভাবে কোনো রেসপন্সও করছে না যে নওশাদ কথা আগাবে। আচ্ছা ক্যাফে বসা ছেলেটি কে ছিল জিজ্ঞেস করবে? অনিক-ই বা মিতুলের কী হয়? এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অধিকারও তো তার নেই। মিতুল যদি জিজ্ঞেস করে বসে, কেন সে এসব জানতে চাইছে তখন সে কী উত্তর দেবে? এর যথার্থ উত্তর কি তার কাছে আছে আদৌ?
নওশাদকে নিশ্চুপ হতে দেখে মিতুল বলল,
“কিছু বলবেন?”
“না, এমনিই খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য ফোন করেছিলাম।”
“ঠিকাছে স্যার। আমি তাহলে এখন রাখছি।”
“মিতুল, শোনো?”
“কী?”
“ক্যাফে তোমার সাথে ঐ ছেলেটা কে ছিল?”
মিতুল উত্তর দেওয়ার আগে তার ঘরের দরজায় এক পুরুষ মানবের ছায়া পড়ল। টুটুল তো বাসায় নেই। বাবাও অফিসে। তাহলে এই মানব কে? তার পিছু ছোটো এক বাচ্চারও অবয়ব। মানবটি বলে উঠল,
“মিতুল, আছো?”
রূপক! হাত বাড়িয়ে রূপক-ই লাইট জ্বালাল। ওর সাথে সীমান্ত। রূপক বলল,
“আসব ভেতরে?”
চলবে…