কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব-০২

0
980

#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________
প্রচন্ড রাগে বশীভূত হয়ে রূপক লা’ত্থি বসাল চেয়ারে। শব্দে হকচকিয়ে ওঠে টুম্পা। চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বারান্দা থেকে রুমে আসে। রূপককে রেগে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,

“ভাইয়া, শব্দ হলো কীসে?”

“আমার কপালে!”

“মজা কোরো না তো। আমি স্পষ্ট একটা শব্দ শুনলাম। তোমার কাপল কি ইট না পাথর, লোহা যে এত শব্দ হবে?”

“টুম্পা, আমাকে দেখে কি তোর মনে হচ্ছে আমি মজা করার মতো মুডে আছি?”

টুম্পা কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল,

“তা অবশ্য মনে হচ্ছে না। কিন্তু শব্দটা…”

টুম্পার মিনমিনে কণ্ঠ শুনে রূপকের মেজাজ আরও চড়ে যায়। সে বিক্ষিপ্ত স্বরে বলে,

“চেয়ারে লা’ত্থি দিয়েছি। তাই শব্দ হয়েছে। শুনেছিস? শান্তি এবার?”

টুম্পা যারপরনাই অবাক হয়ে শুধাল,

“তুমি আমার চেয়ারে লা’ত্থি দিয়েছ? কিন্তু কেন?”

“শখে!”

“বেশ তো! এতই যখন শখ হয়েছে নিজের ঘরের জিনিসপত্রে লা’ত্থি, চ’ড়-থা’প্প’ড় বসাও গিয়ে। আমার জিনিসে ক্ষোভ কেন?”

“আমাকে কোনদিক থেকে পুঁইশাকওয়ালা মনে হয়?”

টুম্পা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। সে তো একবারও রূপককে এরকম কিছু বলেনি। ওকে নিশ্চুপ দেখেই রূপক দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“ঐ ন’ন’সে’ন্স মেয়ে আমাকে পুঁইশাকওয়ালা বলেছে। কত বড়ো সাহস!”

“কোন মেয়ে?”

“নাম জানিনা। তিন তলায় ০৬ নং অ্যাপার্টমেন্টে থাকে।”

“তুমি কি মিতুল আপুর কথা বলছ?”

“নাম জানব কী করে আমি? আব্বু ছাদ থেকে পুঁইশাক তুলে দিয়ে আসতে বলেছিল। তখনই মেয়ে না জেনে-শুনে আমাকে, আব্বুকে শাক বিক্রেতা বানিয়ে বসে আছে।”

“০৬ নং অ্যাপার্টমেন্টে মিতুল আপুরাই থাকে। তুমি শাক নিয়ে গেছ বেচারি তাই তোমাকে শাকওয়ালা ভেবে নিয়েছে। এতে তো আমি দোষের কিছু দেখছি না।”

“তোরা নারীজাতি নিজেদের দোষ দেখিসই বা কবে? পুরুষের দোষ দেখা ছাড়া আর মাথা খাওয়া ছাড়া তোদের কোনো কাজ নাই। অকর্মার ঢেঁকি!”

রূপক রাগে গজরাতে গজরাতে নিজের রুমে চলে গেল। টুম্পা ঠোঁট উলটিয়ে স্বগতোক্তি করে,

“কার রাগ কাকে দেখায়!”

মিতুলরা এই বাড়িতে থাকে মাস ছয়েক হবে। কখনো ও কিংবা ওর পরিবারের কেউ রূপককে দেখেনি। এর হেতুও অবশ্য আছে। রূপক বাংলাদেশে থাকে না। সে চীনে তার বড়ো চাচার কাছে থেকে পড়াশোনা করে। প্রতি বছরে একবার করে বেড়াতে আসে। এ বছরে এবারই প্রথম আসা। দু’দিন হয়েছে সে দেশে ফিরেছে। প্রথমদিন ছাদে মমতা বেগমের সাথে রূপকের দেখা ও আলাপ হয়েছিল। আলাপের এক ফাঁকে মমতা বেগম নিজের পরিবার নিয়ে গল্পগুজবও করেছিলেন। কিন্তু রূপক ধারণা করতে পারেনি যে, এমন মমতাময়ী মাতার এরকম অসভ্য একটা মেয়ে রয়েছে।
__________

দুপুরের তপ্ত রোদ জানালার কাচ গলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করেছে। মৃদু বাতাসে উড়ছিল জানালায় থাকা শুভ্র রঙের পর্দাটি। নওশাদ সেদিকেই দৃষ্টিপাত করে চেয়ারে বসে আছে। বাড়িতে ফেরার পর থেকেই তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার চিন্তার একাংশ জুড়ে রয়েছে মিতুল। হঠাৎ করে যে এত বছর বাদে দেখা হয়ে যাবে এটা কল্পনাতীত ছিল। কিন্তু মিতুল কেন-ই বা এই কলেজে? এখানে কি ভর্তি হয়েছে? নওশাদ জানে নিজেকে, নিজের স্নায়ুকে এত চাপ দিয়ে লাভ নেই। কেননা তার প্রশ্নগুলোর উত্তর ঘরে বসে থেকে সে পাবে না। আপনা-আপনি বুকের গহিন থেকে ভারাক্রান্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ঠোঁটে অস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়,

“মিতুল!”

শামসুন নাহার লেবুর শরবত নিয়ে এলেন ছেলের জন্য। ছেলেকে গালে হাত দিয়ে চিন্তিতচিত্তে বসে থাকতে দেখে শুধালেন,

“কী হয়েছে বাবা?”

নওশাদ মায়ের মুখপানে ফিরে তাকাল। স্মিত হেসে বলল,

“কিছু না তো!”

শরবতের গ্লাস নওশাদের হাতে দিয়ে শামসুন নাহার আঁচল দিয়ে ছেলের কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বললেন,

“মেয়েটার সঙ্গে দেখা করেছিলি?”

“কোন মেয়ে?” গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল নওশাদ।

“যার ছবি দেখিয়েছিলাম। আজ না দেখা করার কথা ছিল? করিসনি?”

আচমকা নওশাদের এই বিষয়টা মনে পড়তেই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কলেজ শেষ করে চৈতি নামে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল আজ। বেশ কয়েকদিন ধরেই বাড়িতে নওশাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। অনেকগুলো মেয়েও দেখা হয়েছে। তাদের মধ্যে চৈতিকে মায়ের বেশ পছন্দ হয়েছে। এই জের ধরে কথা হয়েছিল, আজ দুজনে কোনো একটা ক্যাফেতে দেখা করবে। কিন্তু বিপত্তি বাধল অন্য জায়গায়। মিতুলকে দেখার পর থেকেই নওশাদের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এমনকি মাথা থেকে দেখা করার কথাটিও বেরিয়ে গেছে। কলেজ থেকে আর কোথাও যায়নি তাই। সরাসরি বাসায় চলে এসেছে। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল। ২০+ মিসডকল। ফোন সাইলেন্ট করে থাকায় চৈতির কলও শুনতে পায়নি নওশাদ। মনে মনে সে ভীষণ অনুতপ্ত হলো। তৎক্ষণাৎ চৈতিকে কল করেও কোনো রেসপন্স অবশ্য পায়নি। যতবার কল দিচ্ছে, চৈতি ততবারই কল কেটে দিচ্ছে। হয়তো অভিমান কিংবা রাগের জন্য সে এমনটা করছে।

শামসুন নাহার এতক্ষণ চুপ করে থেকে এবার জিজ্ঞেস করলেন,

“কী হয়েছে?”

নওশাদ আনতমুখে বলল,

“আমি একদম ভুলে গেছিলাম, মা। কলেজ থেকে সরাসরি বাসায় চলে এসেছি।”

“এটা কোনো কথা নওশাদ? তুই তো এরকম কেয়ারলেস নস। কিছু কি হয়েছে?”

নওশাদ বুঝতে পারছে না মাকে কী জবাব দেবে। সে কি মিতুলের কথা বাসায় জানিয়ে দেবে? ঠিক হবে? দোনোমনা ভাব মুখে ফুটে ওঠে তার। একজন মা হয়ে সন্তানের মনোভাব বুঝতে বেগ পেতে হয় না শামসুন নাহারকে। তিনি ছেলের পেলব দু’গালে হাত রেখে বললেন,

“আমায় বল তো বাবা, তুই আমার থেকে কী লুকাচ্ছিস? চৈতিকে কি তোর পছন্দ হয়নি?”

“বিষয়টা ঠিক সেরকম নয় মা। আমার আসলে এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না।”

“কেন? বিয়ের কথাবার্তা তো আরও আগে থেকেই হচ্ছে। মেয়েও দেখলাম আমার কতগুলো। তখন তো তুই অনিহা প্রকাশ করিনি। আজ হঠাৎ কী হলো?”

নওশাদ চুপ করে আছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে মাকে মিতুলের কথা বলে দেবে। এরপর যা হওয়ার হবে। এভাবে মনের মাঝে সত্যিটা চেপে রাখলে সে নিজেও স্বস্তি পাবে না। বাবার থেকে মায়ের সঙ্গে তার সখ্যতা সবচেয়ে বেশি। তার জীবনের প্রথম মেয়ে বেষ্টফ্রেন্ড তার মা শামসুন নাহার। তিনি মিতুলের ব্যাপারেও আদ্যোপান্ত সকল কিছুই জানেন। তাহলে মায়ের কাছে আর সংকোচ কীসের?

উত্তরের অপেক্ষায় শামসুন নাহারও নওশাদের মুখে দৃকপাত করে রেখেছেন। ছেলে কিছু বলতে চায় বুঝতে পেরেছেন তিনি। নওশাদ কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, ঠিক সেই সময়ে বাড়ির কলিংবেল বাজল। বাড়িতে শামসুন নাহার এবং নওশাদ ব্যতীত এখন কেউ নেই। দরজা তাকেই খুলতে হবে। তিনি ছেলেকে আশ্বস্ত করে বললেন,

“তুই এত সংকোচ করিস না বাবা। তোর মনে যা আছে আমাকে তা-ই বল। সত্যিটাই বল। আমি দরজা খুলে দিয়ে আসছি।”

এরপর তিনি গেলেন দরজা খুলতে। নওশাদ স্বাভাবিক হতে পারছে না। কিঞ্চিৎ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। গরমও বোধ হয় বেশি লাগছে এজন্য। ফ্যানের পাওয়ার সম্পূর্ণই দেওয়া। তবুও হয়তো আরেকটু বাড়বে এই আশাতে সে দরজার কাছে থাকা সুইচবোর্ডের নিকট আসে। ঠিক সেই সময়েই ক্রন্দনরত শাড়ি পরিহিতা এক রমনী ঝড়ের বেগে তার প্রশস্ত বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে মেয়েটা। কান্নার গতি আরও বেড়েছে এখন। নওশাদ হতবিহ্বল। অনতিদূরে শামসুন নাহার দণ্ডায়মান। তিনি নিজেও বিস্ময়ের চরম চূড়ায় অবতরণ করেছেন। কেউ-ই কিছু বুঝতে পারছে না। নিজেকে ধাতস্থ করে নওশাদ মেয়েটিকে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। শামসুন নাহার এগিয়ে এসে মেয়েটির হাত ধরে বলেন,

“চৈতি, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? ওকে ছাড়ো। আমাকে বলো কী হয়েছে?”

মেয়েটা চৈতি জেনে আরও বড়োসড়ো ধাক্কা খায় নওশাদ। মেয়েটা সরাসরি বাড়িতে চলে এসেছে? চৈতির কণ্ঠে কান্না ব্যতীত আর কোনো শব্দ নেই। বহু চেষ্টার পর শামসুন নাহার চৈতিকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোফায় বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলেন,

“কী হয়েছে চৈতি?”

চৈতি টলমলে আঁখিদ্বয় মেলে তাকাল নওশাদের দিকে। হাতের উলটোপিঠে চোখের পানি মুছেও লাভ হলো না। চোখের কোটর ফের পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ভীষণ বিষাদিতস্বরে চৈতি নওশাদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,

“কেন এলেন না আপনি?”

নওশাদের কী হয়েছে কে জানে, এমন একটা মুহূর্তেও ক্রন্দসী চৈতির মাঝে সে মিতুলকে দেখতে পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে যেন চৈতি নয়, মিতুল কাঁদছে এভাবে। ঠিক এভাবেই তো মেয়েটা কয়েক বছর আগে কেঁদেছিল। তার মস্তিষ্কে বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,’মিতুল, মিতুল, মিতুল!’
.
.
মিতুল দুপুরের খাবার খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছিল। তার ঘুম ভাঙে বিকেল চারটার পর। প্রায় সাড়ে চারটা বাজতে চলল তখন। সে বিছানা ছেড়ে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চা এনে টিভি দেখতে বসে। হঠাৎ করেই তার নওশাদের কথা মনে পড়ে যায়। বুকে চিনচিনে ব্যথা হওয়ার সঙ্গে মাথাও ঝিমঝিম করছে। কেমন যে একটা অস্বস্তি লাগছে তা বলে বোঝানো যাবে না। অস্থিরতায় ড্রয়িংরুমজুড়ে পায়চারি করা শুরু করে। একটার পর একটা চ্যানেল পালটাচ্ছে। এটা, ওটা দেখছে কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না। কী অদ্ভুত! এত বছর পরও কেন এমন হবে? তার সারা শরীর জ্ব’ল’ছে মনে হয়।

মমতা বেগম রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে ডাকছেন মিতুলকে। মিতুল না গিয়ে ড্রয়িংরুম থেকেই উত্তর নিল। তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। মমতা বেগম বললেন,

“ছাদে শুকনা মরিচ শুকাতে দিয়েছিলাম। নিয়ে আয় তো গিয়ে।”

“যাচ্ছি।”

বলে টিভি বন্ধ করে সে ছাদে চলে যায়। প্রাকৃতিক হাওয়ায় ও পরিবেশে মন বদল ঘটতে পারে এই আশাতেই সে বিশেষ করে ছাদে এসেছে। ছাদে এসে বাড়িওয়ালার নাতি সীমান্তর হাতে টিয়াপাখিটাকে দেখে তার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। সে সীমান্তকে এড়িয়ে শুকনা মরিচ যেখানে রাখা সেখানে গেল। ছাদে টুম্পা এবং ওর বড়ো ভাবি রিমাও ছিল। মিতুলকে দেখে টুম্পা এগিয়ে গেল। পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছো মিতুল আপু?”

মিতুল মুচকি হেসে বলল,

“ভালো। তুমি কেমন আছো?”

“আমিও ভালো আছি। অনেকদিন পর তোমাকে ছাদে দেখলাম।”

“মা পাঠাল তাই এলাম।”

“তুমি এত ঘরকুনো কেন আপু? তোমাকে অপ্রয়োজনে তো বাহিরে দেখিই না। এমনকি ছাদেও আসো না। তুমি কি কোথাও ঘুরতেও যাও না?”

মিতুল হেসে বলে,

“যখন স্কুলে পড়তাম তখন প্রচুর ঘুরেছি। বান্ধবীরা মিলে স্কুল পালিয়ে সারাক্ষণ গ্রামে নয়তো শহরে ঘুরে বেড়াতাম। একবার তো টিউটোরিয়াল পরীক্ষা বাদ দিয়ে বান্ধবীরা মিলে উপশহরে সিনেমা দেখতেও চলে গেছিলাম।”

টুম্পা ভারী অবাক হয়ে শুধাল,

“পরে?”

“পরে আর কী? স্যাররা সবার বাড়িতে বিচার দিয়েছে। আমরাও উত্তম-মধ্যম খেয়েছি কয়েক ঘা।” বলেই শব্দ করে হাসল মিতুল।

টুম্পাও শুকনা মরিচগুলো বোলে তুলতে তুলতে বলল,

“গ্রামে গেলে তাহলে ঘুরতে যাও?”

“না, এখন কি আর আগের সময়গুলো আছে? অধিকাংশ বান্ধবীদেরই বিয়ে হয়ে গেছে। কয়েকজনের তো বাবুও আছে। অন্য দু’জনের বাবু হবে শুনলাম।”

“তাহলে আর কেউ-ই অবিবাহিত নেই?”

“আছে একজন। কিন্তু ওরও বয়ফ্রেন্ড আছে। অবশ্য ও-ই আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী ছিল। গ্রামে গেলে আমাদের বাড়িতে আসে। কিন্তু আগের মতো কোথাও যাওয়া হয় না। ওর বয়ফ্রেন্ড ভীষণ স্ট্রিক্ট।”

“তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই আপু?”

এই পর্যায়ে আবারও মিতুল শব্দ করে হেসে ফেলে। বলে,

“না।”

“ছিল না কখনো?”

মিতুল মুচকি হেসে বলে,

“এই যুগে বয়ফ্রেন্ড থাকে না কার? যার এখন নেই, তার অতীতে হলেও ছিল। আবার যার নেই তার হয়তো পরে হবে। মোট কথা, বিয়ে তাড়াতাড়ি না করলে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড হবেই। সেটা এখন রিয়েল লাভ-ই হোক কিংবা টাইমপাস। আবার এমনও হতে পারে যে, রিলেশন হয়নি। কিন্তু এক তরফাভাবে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে মনে। তবে আমার কী মনে হয় জানো? এক তরফা ভালোবাসার চেয়ে রিলেশন করে ছ্যাকা খাওয়া অথবা ছ্যাকা দেওয়া অধিক ভালো।”

মিতুল শেষের কথাগুলো এমন হাস্যকরভাবে বলল যে টুম্পা খিলখিল করে হাসা শুরু করে। ওর সঙ্গে মিতুলও হাসছে। মরিচ তোলা শেষ। সে ছাদের ট্যাপের কাছে গিয়ে হাত ধুয়ে এলো। টুম্পার সাথে গল্প করতে তার ভালো লাগছে। তাই আরও কিছুক্ষণ গল্প করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। ফিরে এসে বলল,

“তারপর তোমার কথা বলো শুনি। তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?”

টুম্পা তড়িৎগতিতে মাথা নেড়ে বলল,

“না, না! আমি আর বয়ফ্রেন্ড? তাহলেই হলো!”

“কেন?”

“আমার দুই ভাইয়া যেই পরিমাণ স্ট্রিক্ট জানো না তো! রিলেশনের চক্কর জানতে পারলে একদম জানেই মে’রে ফেলবে।”

“বাঙালি ভাইয়েরা বোনেদের জীবনে একেকটা ভিলেন। ওরা নিজেরা প্রেম করবে, ভালোবাসবে। কিন্তু বোনের বেলাতে জারিজুরি। তখন প্রেম-ভালোবাসা ঘোরতর অন্যায় হয়ে যায়। তোমার ভাইদের কথা আর কী বলব? আমার নিজের ভাইও তো এমন।”

“তুমি খুব মজার মানুষ আপু। তোমার কথা শুনলে মন খারাপ ভালো হয়ে যাবে যেকোনো মানুষের।”

“তাই নাকি? একটা কথা কি জানো টুম্পা?”

“কী?”

“যারা অন্যকে হাসাতে পারে কিংবা অন্যের হাসির কারণ হতে পারে, তারা কিন্তু নিজেরা নিজেদের এভাবে হাসাতে পারে না। ভালো রাখতে পারে না।”

“এমনটা কেন হয়?”

“হয়তো প্রকৃতির নিয়মই এটা। সবার ক্ষেত্রে অবশ্য সেইম হয় না। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও অধিকাংশ মানুষই এমন। আচ্ছা ছাড়ো এসব। এত কঠিন, ভারী কথা না বলি আমরা। তুমি যেন এখন কীসে পড়ো?”

“নাইনে।”

“কমার্সে না?”

“হ্যাঁ। আমার ব্যাংকার হওয়ার ভীষণ ইচ্ছে।”

“ভালোমতো পড়াশোনা করো। আল্লাহ্ মনের আশাও পূরণ করবে ইন-শা-আল্লাহ্।”

হঠাৎ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ে গেছে ভেবে টুম্পা এমনভাবে বলল,

“আপু একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“তুমি আমার ভাইয়াকে শাকওয়ালা বলেছ কেন? সে তো এখন ভারী ক্ষেপে আছে।”

মিতুল অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

“আমি তো আর জানতাম না রে বোন! ওরকম লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে হাতে শাক নিয়ে এলে আমার শাকওয়ালা ভাবায় অন্যায়টা কোথায় বলো?”

টুম্পা হাসতে হাসতে বলে,

“আমার ছোটো ভাইয়া লুঙ্গি পরে না কখনো। ওর সবগুলো প্যান্ট মা ধুয়ে দিয়েছে। সব মানে সব! তাই বাধ্য হয়ে বড়ো ভাইয়ার লুঙ্গি পরেছিল। বেচারা বড়ো হওয়ার পর প্রথমবারের মতো লুঙ্গি পরল আর তুমি শাকওয়ালা বানিয়ে দিলে।”

রিমা এগিয়ে আসে তখন দুজনের কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

“দুজনে কী নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে হু?”

গল্প জমার আগে এবং উত্তর দেওয়ার আগেই রূপক এলো ছাদে। এবার আর তার পরনে লুঙ্গি নেই। হাফ কোয়াটার প্যান্ট পরে আছে। টি-শার্ট অবশ্য আগেরটাই। মিতুলকে দেখেই তার স্বাভাবিক মুখাবয়ব পালটে গেল। কী পরিমাণ রেগে আছে তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নাক-মুখ ফুলিয়ে এগিয়ে এসে বলে,

“ভাবি, ভাইয়া এসেছে। ডাকে তোমাকে।”

স্বপন এসেছে শুনে রিমা তড়িঘড়ি করে ছাদ থেকে নেমে গেল। মিতুলের সঙ্গে টুম্পাকে সহ্য হচ্ছে না রূপকের। অপছন্দের মানুষের সাথে নিজের কাছের মানুষদের ঘেঁষাঘেঁষি পছন্দ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে গম্ভীরকণ্ঠে বলল,

“তোর পড়া নেই? এখানে কী করছিস? নিচে চল।”

রূপকের এরকম ব্যবহার মিতুলের ভালো লাগল না। সে যে মিতুলের রাগ-ই টুম্পার ওপর প্রয়োগ করছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না চঞ্চল ও চতুর স্বভাবের মেয়ে মিতুলকে। মিতুল ভেবেছিল সরি বলবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলাল সে। এরকম রগচটা, গম্ভীর, দম্ভওয়ালা কাউকে সে কখনোই সরি বলবে না। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রূপককে দেখছে।

টুম্পা অবশ্য রূপকের রাগ গায়ে মাখল না। সে হেসে হেসেই বলল,

“তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল।”

এ কথা শুনে যারপরনাই অবাক হয়ে যায় রূপক। তাকে নিয়ে গসিপ হচ্ছে? নিশ্চয়ই মেয়েটা উলটা-পালটা কথা বলছে তার নামে। আর তার যেই গুণধর বোন। জীবনে প্রতিবাদ তো করবেই না, উলটো তাল মিলিয়ে হিহি হাহা করবে। ঘরশত্রু বিভীষণ যাকে বলে আরকি!

রূপক পূর্বের ন্যায় গম্ভীরকণ্ঠে বলে উঠল,

“আমাকে নিয়ে কী গসিপ করছিস?”

“তোমার শাকওয়ালা হওয়ার গল্প শুনছি।”

“মজা নিচ্ছিস? এতটাও অধঃপতন হলো যে এখন বাইরের একটা মেয়ের কাছে বড়ো ভাইকে নিয়ে মজা উড়াচ্ছিস। এজন্যই বলি, যার তার সাথে মিশবি না। তুই শুধু এস.এস.সি পরীক্ষাটা দে। তোকে আমি চীনে নিয়ে যাব। এদেশের মানুষ এবং কালচার একদম অপছন্দ আমার।”

মিতুল এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে রূপকের দম্ভ ভাঙতে দু’হাত বগলদাবা করে নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“এইযে বিলেতি মুলা! সরি ভাইয়া, এত কীসের অহংকার আপনার?”

“তুমি আমাকে প্রথমে কী বলে ডাকলে?”

“যা শুনেছেন তা-ই। বিদেশে থেকে পড়াশোনা করেন বলে আকাশে ওড়ার তো কিছু নেই। অবশ্যই বিদেশ উন্নত, ওদের কালচারও উন্নত। তাই বলে আপনি কেন এত বড়াই করবেন? আপনি কি জন্মসূত্রে বিদেশি? বাংলাদেশের কালাচান হয়ে যদি বিলেতি মুলা হওয়ার ভাব ধরেন তাহলে তো সমস্যা।”

রূপক দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“তুমি কিন্তু লিমিট ক্রস করে কথা বলছ।”

“সেই সুযোগটাও তো আপনিই করে দিয়েছেন। আপনার কপাল ভালো যে, আমার গোষ্ঠীর কেউ পুলিশ লাইনে নেই।”

“থাকলে কী করতে তুমি?”

“এতক্ষণে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম। বাংলাদেশের মানুষ হয়ে বাংলাদেশে নিয়ে, এদেশের মানুষ নিয়ে কটুক্তি করার সাধ মিটিয়ে দিতাম। রাজাকার কোথাকার!”

“আমি রাজাকার?”

“অবশ্যই। নিজের কথা দ্বারা বোঝেন না?”

“হাইটে তো এইটুকুন একটা মেয়ে। অথচ কথার ঝাঁঝ বোম্বাই মরিচকেও হার মানায়।”

মিতুল জবাব দিতে পারল না। এর পূর্বেই সীমান্ত টিয়াপাখিটাকে নিয়ে আসে। মিতুল চোখ-মুখ কুঁচকে তাকায়। সীমান্ত বলে,

“মিতুল আন্টি, কয়টা শুকনা মরিচ দাও না রাজকুমারকে খাওয়াব।”

মিতুল বিড়বিড় করে বলে,

“যেই না টিয়াপাখি, তার নাম আবার রাজকুমার। হ’ত’চ্ছা’ড়া, ব’দ পাখি!”

এই টিয়াপাখিটা বাড়িওয়ালির অর্থাৎ টুম্পা, রূপক এবং স্বপনের মা যিনি। তার নামও টিয়া। ভীষণ ডেঞ্জারাস স্বভাবের তিনি। তেমনই পুষেছেনও একটা ব’দ স্বভাবের টিয়া পাখি। এই টিয়া পাখি কথাও বলতে পারে। মিতুলের সমস্যাটাও ঠিক এখানেই। কথা বলতে পারে বলেই রাজকুমারকে তার পছন্দ নয়। এর অবশ্য যথার্থ কারণ এটা নয়। রাজকুমার মিতুলকে যেই নামে সম্বোধন করে সেই নামটাই মিতুলের অপছন্দ। বোধ করি মিতুল নামের কোনো মেয়েরই রাজকুমারের সম্বোধন করা নাম পছন্দ হবে না।

মিতুল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

“এই অ’স’ভ্য পাখিকে আমি মরিচ দেবো না।”

“ওমা! এতক্ষণ তো রাজকুমার তোমাদেরই মরিচ খেয়েছে।”

“সীমান্ত, এই পাখি নিয়ে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”

রাজকুমারের বয়স অনেক। সে মোটামুটি প্রায় অনেক কথাই বলতে পারে। এজন্য ছোটো থেকেই তাকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। তাকে কখনো খাঁচায় আটকেও রাখা হয় না। সে খোলা অবস্থায় থাকে সর্বদা। এবার সে উড়ে গিয়ে মিতুলের পাশে রেলিঙের ওপর দাঁড়াল। আরেকবার উড়াল দিয়ে রূপকের কাঁধে গিয়ে বসে বলল,

“মুতু, মুতু আমার ওপর রাগ করো?”

রূপক সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল। ওর হাসি দেখে মিতুলের আরও মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। রাজকুমারও তখনো বলে চলেছে,

“মুতু, মুতু রাগ করে। মুতু, মুতু রাগ করে।”

মিতুল চেঁচিয়ে বলে,

“সীমান্ত, ওর ভাঙা রেকর্ড বন্ধ করাও। পা’জি টিয়াপাখি!”

মিতুল আর একদণ্ডও দাঁড়াল না। পাটি আর শুকনা মরিচের বোল নিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। রাজকুমারও দ্রুত উড়ে গিয়ে মিতুলের ওড়না কামড়ে ধরে। এতেও সে ক্ষান্ত হলো না। ওড়না মুখে নিয়ে সে রূপকের হাতের ওপর এসে বসে। রূপক অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় মিতুলের ওড়নাতে টান লাগে। বাধ্য হয়ে ওর সঙ্গে সঙ্গে রূপককেও পিছু পিছু যেতে হচ্ছে। সে যে কী বলবে বা কী বলা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না। হাসি বন্ধ হয়ে গেছে তার। অসহায়ের মতো টুম্পা এবং সীমান্তর দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা মুখে হাত চেপে হাসছে। রূপকের অসহায় চাউনি উপেক্ষা করে ওরা অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করল। রূপক তখন মনে মনে বলে,

“দুইটা জা’ত’শ’ত্রু! তোদেরকে তো আমি পরে দেখছি।”

সে প্রাণপণ চেষ্টা করেও রাজকুমারের মুখ থেকে মিতুলের ওড়না ছাড়াতে পারছে না। এতে আরও বেশি টান লাগায় এবার মিতুল পেছনে ফিরে তাকায়। ততক্ষণে ওরা সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেছিল। এবং বলাই বাহুল্য এ ঘটনায় আঁৎকে ওঠে মিতুল। রূপকের হাতের মুঠোয় এবং রাজকুমারের মুখে নিজের ওড়না দেখে বিস্মিত হয়ে বলে,

“দুজন মিলে ওড়না ধরে টানাটানি করছেন কেন? আশ্চর্য! এগুলো কেমন ধরণের বে’য়া’দ’বি? মানুষ এমন হয় জানতাম। তাই বলে পাখিও?”

রূপক বোবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। সে মুখে তো বলতে চাচ্ছে অনেক কিছুই। কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। এরকম ঘটনায় ইতোপূর্বে কখনোই তার সঙ্গে ঘটেনি। সে বারবার প্রবোধ গুণছে, এরকম ঘটনা যদি ঘটার-ই ছিল তাহলে অন্য কোনো মেয়ের সহিত ঘটত। এই দুনিয়ায় কি মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি? মিতুলের গা’ল’ম’ন্দ সে নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে। মনে মনে বলছে,

“আরে মেয়ে, আমাকে তো খুব উপদেশ দিচ্ছিলে তখন। এখন তোমার নিজেরই বা এত কীসের দম্ভ হ্যাঁ? তোমার ওড়না নিয়ে আমি করব কী? গলায় ঝুলিয়ে ‘লাল দোপাট্টা, উড় গায়ি রে বৈরি হাওয়া কে ঝোঁকে সে’ গানে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো কোমর দুলিয়ে নাচব? নাকি শাড়ি বানিয়ে ফ্যাশন শো করব?”

কিন্তু বেচারা মুখে কিছুই বলতে পারল না। কেবলমাত্র অসহায় দৃষ্টিতে মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বকাঝকা হজম করছে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে