কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৫+১৬

0
532

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৫

শুক্রবার সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন বোধহয় প্রত্যেকটা কর্মজীবী মানুষের জন্য। মুসলিমদের জন্য পবিত্র দিনও বটে! জুম্মার এই দিনে অসংখ্য আনন্দ অনুষ্ঠানেরও কি কমতি হয় আমাদের এ দেশ জুড়ে! অর্নিতার জন্যও তাই এ দিনটিকে শুভ দিন হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলো আপনজনেরা। খালুজানের পর অর্ণবেরও সম্মতি নিয়েছে অর্নিতা আর শিবলীর আকদের জন্য। অর্ণব ছোট দাদীর সাথে আলোচনা করে অর্নিতাকেও জিজ্ঞেস করেছিলো সে কি চায়! বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারেনি তার ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ এর গুরুত্ব তার ভাইয়ের কাছে ঠিক কতখানি। তাইতো দ্বিধায় ডুবে বলেছিল, ‘তোমাদের যা ভালো মনে হয় ভাইয়া তাই করো।’

অর্ণবের মন তখনও মানছিলো না অর্নিতার আকদটা এত দ্রুত করার। তবুও সে ছোট দাদী আর বড় খালামনির যুক্তি মাথায় রেখে ঠিক এক সপ্তাহেই সব আয়োজন করে ফেলল। ছোট দাদী আর খালামনির এক কথা, শুভ কাজে দেরি করা অশুভ লক্ষ্মণ। তখনো কেউ জানতো না অর্নিতার ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি করাটাই অশুভ হবে। বাশার শেখের শরীরের অবস্থা যথেষ্ট ভালো এখন। নিজের বাড়িতেই তিনি আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। অর্ণব বা ছোট দাদী কেউই রাজী হলো না। অর্ণব নিজে খালামনির হাত ধরেছিল দিন তিনেক আগে। আকুল আবেদন এর গলায় বলেছিল, ‘অনেক করেছো খালামনি তুমি। মাথার ওপর ছায়া আমাদের তুমি আর খালুজান সবসময় ছিলে বলেই আমরা দু ভাই বোন অনেক ভালো থাকতে পেরেছি। যে বয়সে মা বাবার সঙ্গ হারিয়েছি সে বয়সে অনেকেই কচুরিপানার মত ভেসে যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতে। আমরা ভাসিনি বরং শক্ত হয়ে গেঁথে গেছি মাটির উপর। এ বড় ঋণ আমার তোমার কাছে যা কখনো শোধ হবার নয়। কিন্তু সেই ছোট্ট বয়স থেকেই আমার সাধ ছিল বোনটার সকল দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেব। পারিনি অনেকটা কিন্তু এখন সুযোগ এসেছে আমাকে এইটুকু দায়িত্ব পালন করতে দাও। নিজ বাড়ি থেকে অর্নিতার বিয়ে, বিদায়ের আয়োজন করতে চাই।’

রায়না বেগম, বাশার সাহেব দুজনেই মেনে নিয়েছিলেন সে কথা। আর তাই আজকেই চৌধুরী বাড়ি সেজে উঠেছে নতুন কনের মত। ধুমধামে আকদ হবে না বলেও কাছের আত্মীয়ই হয়ে গেল জনা পঞ্চাশেক । অর্ণবের দোতলা বাড়ির ছাঁদে শামিয়ানার চারপাশে দিনের বেলায়ও জ্বলছে সাদা আর সোনালি আলো। আকদ হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যায় তাইতো মেহমান সব উপস্থিত হয়েছে গৌধূলি লগ্নে। নানার বাড়ির আত্মীয় বলতে শুধু বড় খালামনির পরিবারটাই আছেন মেজো খালামনি তো এসেছিলেন পাত্রপক্ষ হয়েই এছাড়া আর কাউকেই দাওয়াত করেনি অর্ণব। বাকি সব আত্মীয় বড় দাদারই বিশাল পরিবার। একটু আগেই বৃষ্টি আর নুপুর ফিরেছে অর্নিতাকে নিয়ে। পার্লারে যাবে না যাবে না করেও যেতে হয়েছে কনে সাজের জন্য। অর্ণব জেদ ধরেছে তার একটি মাত্র বোনের আকদ, বউ সাজাতেই হবে বোনকে। এক একটা অনুষ্ঠানের হাজারটা স্মৃতি বাক্সবন্দি করে রাখতে চায় সে। তাইতো আকদ উপলক্ষেই কাল রাতে হলুদ আর মেহেদী এনেছে এক গাদা। অর্নি আর বৃষ্টিকে বলেছিলো, তোরা তোদের সব বান্ধবীদের দাওয়াত কর, খাওয়া-দাওয়ার থেকে যা যা লাগে সবটাই দেব আমি। বৃষ্টি সেই খুশিতে তার তিনজন বান্ধবী আর দুই বন্ধু দাওয়াত করেছে, রিমন করেছে তার দুই বন্ধু আর অর্নিতা করেছিল তার একমাত্র বান্ধবী নুপুরকে। হলুদে আসার অনুমতি পায়নি নুপুর তবে আজ ঠিকই সুযোগ দিয়েছে তার বাবা। তাইতো একটু আগে ভাগেই সে উপস্থিত হতেই যেতে হলো পার্লারে। দিনের আলো ফুরানোর মুহুর্তে বাড়ি ফিরলো তারা। অর্ণব নিচে আঙিনায় দাঁড়িয়ে তদারকি করছিলো বাবুর্চির কাজকর্মের ঠিক সে সময়েই প্রধান গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো নব বধূসাজে শুভ্রকন্যা। সাদা আর গোলাপির মিশ্রণে জামদানী গায়ে বউ সাজে আছে অর্নিতা। বোনের দিকে কয়েক পল তাকিয়েই বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। অর্নিতা…. ছোট বোনটার আজ বিয়ে হয়ে যাবে? আহ! আপন বলতে তার তো ওই একটাই মানুষ এই ভুবনে৷ যতই দাদা,দাদী, খালা, খালু থাকনা কেন বাবা-মা হীন এ জগতে তারা দুটি ভাইবোনই এক সুতোর দুই গিঁট। চোখের দু কোণ ঝাপসা হয়ে গেল অর্ণবের। জল ঝরানোর সময় নয় এখন ভেবেই চোখ ফেলল অর্নিতার পাশের কন্যাটির দিকে। বৃষ্টিও সেজেছে খুব মেরুন রঙা লেহেঙ্গার সাথে গাজরাময় খোঁপায়। ভালো লাগছে দেখতে তাকে। এবার অর্ণবের দৃষ্টি আপনাতেই খুঁজলো তৃতীয় কন্যাটিকে। মেয়েটা তো তাদের সাথেই গিয়েছিল সে কি ফেরেনি! কপালের মধ্যভাগে সৃষ্টি হলো কুঞ্চনরেখা ভাবনায় চলল শ্যামাকন্যার ক্ষণিক তান্ডব আর তার পরই মেয়েটি এসে উপস্থিত হলো দৃষ্টির দোরগোড়ায়। ওই তো দেখা যাচ্ছে এক হাতে গালের পাশের এক গাছি চুল কানের পেছনে গুঁজতে গুঁজতে এসে দাঁড়ালো বাড়ির আঙিনায়। অর্ণবের হঠাৎ মনে হলো ওখানে এক এক টুকরো আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। আকাশরঙা কামিজের শুভ্র ওড়না, খোলা চুলের এক পাশে লাগানো সাদা ফুল। হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা টের পেল অর্ণব। কোথাও বুঝি ধড়াক ধড়াক করে আওয়াজ তৈরি হলো! হয়েছে তো৷ অর্ণবের বুকের ভেতরই হচ্ছে এই আওয়াজ। ওই মেয়েটা নির্ঘাত কোন জাদুকরী নয়তো এমন হবে কেন? মেয়েটার কথা মনে হলেই কেমন এক ভরা ভরা অনুভূতি হয় অন্তরে। আপনাতেই মন বলে আপনের ঘরে নতুন করে এই মেয়েটা যুক্ত হচ্ছে তার জীবনে। আজ যেন তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অর্নিতাকে নিয়ে বৃষ্টি আগেই পৌঁছে গেছে দোতলায়। নুপুর গাড়ি থেকে অর্নিতা আর বৃষ্টির কাপড়ের ব্যাগটা নিতে গিয়ে দেরি হলো ভেতরে ঢুকতে৷ সে এবার সদর দরজায় পা দিতেই শুনতে পেল অর্ণবের ডাক, শোনো।

অর্ণবের ডাক চৈত্র্যের খরায় এক পশলা বৃষ্টির মত শোনালো নুপুরের কানে। গত তিনটা দিন ধরে সে অপেক্ষায় ছিল এই মানুষটার একটা রিপ্লাইয়ের। কিন্তু পায়নি সে রিপ্লাই আর তাইতো ভেবেছিল আসবে না অর্নিতার আকদে। শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে কি সে লোকটার ডাকে জবাব দেবে! উহু, একদমই না। নুপুর থামল কয়েক সেকেন্ডের জন্য তবে ফিরে তাকালো না। যখন দেখলো মিনিট পেরিয়েও অর্ণব কিছু বলছে না তখন সে আবারও পা বাড়ালো সামনে।

-আচ্ছা স্যরি।

-জ্বী!
ফিরে তাকালো নুপুর এবার। এক হাতে তার কাপড়ের ব্যাগ অন্য হাতে ওড়নার একপাশ গুটিয়ে ধরেছে। অর্ণব গম্ভীর মুখটাকে আরও গম্ভীর করে বলল, ‘সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই রিপ্লাই করতে পারিনি।’

-আচ্ছা!

ভাবলেশহীন জবাব দিয়ে নুপুর আবার পা বাড়াতেই অর্ণব অধৈর্য্য গলায় বলে উঠলো, ‘ আসলে ইচ্ছে করেই… ‘

– ইগনোর করেছেন! স্বাভাবিক।

অর্ণবের পছন্দ হলো না নুপুরের আগ বাড়িয়ে দেওয়া জবাব৷ এইটুকুনি মেয়ে অথচ তেজ দেখো! কিন্তু তারও কেন এত কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে? নিজের ওপরই রাগ হলো তার। নুপুর চলে গেল অর্ণব অবাক হয়ে দেখলো সেই প্রস্থান৷ ভাবতে লাগল সে কেন এমন স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে।
_________________

জ্বলন্ত সিগারেটটা এ্যাশ ট্রে তে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চাপলো রিদওয়ান। গুনে গুনে সাঁইত্রিশ নম্বর কলটা এবার ধরবে বলেই মনস্থির করল সেই সাথে গুছিয়ে নিলো এ জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কিছু কথা। যে কথা কখনো মা কিংবা মায়ের বয়সীদের বলা যায় না। ময়না খালামনি সেই দুপুর থেকে একের পর এক কল করেই যাচ্ছেন। অর্নিতার আকদের খবরটা তিনি জেনেছেন রিদওয়ানের কাছ থেকেই। ফলস্বরূপ এখন তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা রিদওয়ানকেই জালাচ্ছেন। কারো কল ধরে দুটো কথার জবাব দেওয়ার মত মন এখন তার একটুও নেই। সেই ভোরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে গাড়ি নিয়ে৷ পরনে ছিল সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর গলায় ছিল কালো টাই। সাজটা তার অফিসারদের মত থাকলেও সে অফিসের ধারেকাছেও যায়নি। ছুটির দিনে তার ছুটিই ছিল কিন্তু বাবার কাছে বলল আজ সে ওভারটাইম করতে চায় তাও আবার কারখানার শ্রমিকদের সাথে। বাউণ্ডুলে ছেলের মতিগতি বাশার শেখ কখনোই ঠিকঠাক বুঝে উঠেননি তবুও ভাবলেন পাগলকে একটু ছাড় দিলে সমস্যা নেই। রায়না বেগম অবশ্য ছেলের মানসিক অবস্থা অনেকটাই অবগত হওয়ায় তরল মনে দোয়া করতে লাগলেন ছেলেটা যেন কোন ভুল না করে। মায়ের দোয়া কবুল হলো রিদওয়ান বাড়ির বাইরে কোন কিছুই করেনি। এমনকি বাবাকে বলল কারখানায় যাবে সেখানেও যায়নি। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছিল রমনায়। একা একমনে বসেছিল মাটিতে পা ছড়িয়ে। দুপুরের পর আবার ফিরে এলো বাড়িতে তখন পুরো বাড়ি শুনশান। আগের রাতেই বৃষ্টি, রিমন চলে গিয়েছিল অর্ণবদের বাড়িতে। সকালে নাশতার পর মা-বাবাও চলে গেছেন। বাড়িতে দারোয়ান আর কাজের দুজন মহিলাই ছিলো উপস্থিত। সন্ধ্যের আগেই রিদওয়ানকে বাড়িতে ফিরতে দেখে একজন এসে জিজ্ঞেস করলেন, রিদওয়ান বাবা কিছু লাগবো?

রিদওয়ান ছোট্ট করে জবাব দিলো, না খালা। সে চলে গেল নিজের ঘরে এরপর আর ঘর থেকে বের হয়নি এক সেকেন্ডের জন্যও৷ একের পর এক সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবছিলো সে। আজ কতগুলো বছর হলো সে ওই পুচকে অর্নিটাকে ভালোবাসে! আম্মু জানে সে খবর। অর্নির ওই হলদেটে মুখখানার চশমার আড়ালে থাকা ভ্রমর কালো চোখদুটোতে রিদওয়ান হারিয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে। তিলে তিলে অনুভূতির মেঘ জমে এখন বৃষ্টি হয়ে ঝরতে চাইছে তার চোখে। আর ঠিক তখন থেকেই অর্ণব, অর্নিতার জন্মদাত্রী একের পর এক কল করে যচ্ছেন রিদওয়ানকে। প্রথম তিন চারটে কল সে কেটে দেওয়ার পরও খালামনির লাগাতার কল আসতেই থাকল। এতেই মেজাজ ঝলসে উঠলো তার আর তাইতো এখন ঠিক করে নিলো কিছু বিশ্রী কথা।

-কেন এতবার কল দিচ্ছো বলো তো! মেয়ের বিয়ের খোঁজ নিতে? এতই যদি ছেলে মেয়ের চিন্তা হয়, কথা মনে পড়ে তবে কেন গিয়েছিলে অন্য পুরুষের কাছে!

এতটুকু বলেই রিদওয়ান থেমে গেল। তার যেন মাত্র হুঁশ ফিরল সে কি বলছে এসব! নিজের অপারগতা আড়াল করতেই কি খালামনিকে কথা শোনাচ্ছে? হ্যা তাই হবে। নিজের চারপাশে হঠাৎই অক্সিজেনের কমতি অনুভব করল সে। অর্নির কি আকদ হয়ে গেছে এতক্ষণে! ফোনের ওপাশ থেকে ফোঁপানোর আওয়াজ পেল রিদওয়ান। আর সহ্য হলো না তার কিছু একটা করতে হবে। এভাবে বসে থেকে অর্নিতাকে হারিয়ে ফেললে যে সে নিজেই বাঁচতে পারবে না। কল কেটে দ্রুত আঙ্গুল চালিয়ে ডায়াল করলো একটা নাম্বার। কলটা রিসিভ হতেই সে বলে দিলো, ‘ যে কয়টা আইডি দিব সে কয়টা আইডি আর যে কয়টা ফোন নম্বর দিব সে কয়টাতে কল দিবি। যেভাবে বলেছিলাম ঠিক সেভবেই বলবি। আর হ্যা,, ভিডিওটা যেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভুল করেও না আসে৷’

কথাটা শেষ করেই রিদওয়ান বসা থকে উঠে দাঁড়ালো৷ তার তর্জনী আর মধ্যমায় এখনো জ্বলছে আরও একটি সিগারেট। ঠোঁটের ভাজে ফুটে উঠলো ক্রুর হাসি আর কপাল থেকে সরে গেল ভয়ের ছাপ।
__________

এশারের আজানের পূর্বেই সারবে বিয়েটা তাই অর্ণব গেল মেজো খালামনির সামনে। সেই মাগরিবের পরপরই এসেছে বরপক্ষ অথচ বর আসেনি৷ শিবলীর নাকি কি জরুরি একটা কাজ পড়ায় সে আসতে পারেনি৷ একটু পরই ফিরবে সে। শায়নার এমন কথা একদমই পছন্দ হলো না ছোট দাদী আর বড় দাদার। অর্ণবদের বংশে মুরুব্বি বলতে এখন এনারাই তো আছেন। তাই অর্ণবও দাদা, দাদীর কথা শুনে খালামনিকে জোর দিলো শিবলীকে বলার জন্য তাড়াতাড়ি আসতে । এরই মাঝে বেজে উঠলো অর্ণবের ফোনখানা। ছাদ ভর্তি মেহমান থাকায় সে ফোনটা নিয়ে নেমে এলো দোতলায়। রিসিভ করতেই কেবল একজন বলে উঠলো, ‘হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও চেক করুন।’

কথাটা বলেই কলটা কেটে দিল ওপাশের মানুষটা। আকস্মিক এমন এক কথায় অর্ণব হকচকিয়ে গেল। কিছু সময় পর ধাতস্থ হলো কি বলল ফোনের ওপাশ থেকে কেউ একজন! কিন্তু কে ছিল? সন্দিগ্ধ মন নিয়ে সে অনলাইন হলেও ঠিক বোধগম্য হলো না কোথায় কি চেক করবে! এর ঠিক মিনিট দুই পরেই তার হোয়াটসঅ্যাপে এসে জমা হলো কিছু ছবি আর ভিডিও। ছবিগুলো দেখে ভিডিও অন করতেই তার চোয়াল শক্ত হলো। মুহূর্তেই যেন সারা শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে থাকলো।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৬

ভরা মজলিশে শিবলীর উপস্থিতি হলো চমকপ্রদ। উহু, না ঠিক তাও নয়। বিস্ময়াভিভূত হওয়ার মত উপস্থিতি ছিল তার অথবা বলা যায় চরম রহস্যজনক। পথিমধ্যে গাড়ি দূর্ঘটনায় পড়েনি সে তবুও হাত ভাঙা, কপাল কাটা আর পায়ের গোড়ালিতে ছিলে যাওয়া চামড়ার রক্তাক্ত অংশ নিয়ে এসেছিল সে রাত দশটার পর। এসেছিলো সে অর্ণব ও রিদওয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে। নতুন দুলহা হাত পায়ে সফেদ ব্যান্ডেজে মুড়ে এসে দাঁড়ায় বিয়ের আসরে। ছাদ জুড়ে প্রতিটি মেহমানের চক্ষু চড়কগাছ বরের বেহালদশা দেখে। অর্ণবের ফোনে যে ভিডিও এসেছিল তা দেখা মাত্রই তার পায়ের রক্ত মাথায় চড়লো। বাড়িভর্তি মানুষের দিকে এক পলক নজর ফেলতেই তার মনে হলো এই জলসা, এই আয়োজন সব বৃথা। অর্নিতার ভাগ্য এত খারাপ কিচুতেই হতে পারে না। তার পদ্মকোমল অর্নিতা থাকবে সদা সূর্যের আলোর মত ঝকঝকে। তার জীবনে কোন দুশ্চরিত্র পুরুষের জায়গা নেই অন্তত তার ভাইয়ের দেহে যতদিন প্রাণ আছে ততদিন। সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বের হয়েই খোঁজ নেয় শিবলীর লোকেশন। ভাগ্যিস লোকটা ফোনটা চালু রেখেছিল! নইলে কোথায় পেতো সেই মুহূর্তে অর্ণব। এদিকে রিদওয়ানও শেষ মুহূর্তে সংযম হারিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় তখন৷ পুনরায় দারস্থ হয় ছোট ভাইয়ের সাহায্যের। রিমনও ভাইয়ের মনস্তাপ টের পেয়ে প্রেমিকার শরণাপন্ন হয়। অর্নিতার বিয়ে নিয়ে ভাইয়ের মাধ্যমে সে বিনোদন নেয়ার অভিপ্রায়েই কাল থেকে উপস্থিত ছিল অর্ণবদের বাড়িতে। কিন্তু ভাই তার গকশন মুভি হিরো হতে চাইলেও ভরা মজলিশে থাকে ছুপা রুস্তম আর তাইতো তিনি নিজ বাড়িতে বসেই সময় গুণছিল কোন পদক্ষেপ নেওয়ার। শেষ মুহূর্তে আবারও তাকেই উত্যক্ত করলো শিবলী ভাই কোথায় আছে জানার জন্য। নাজনীনকে হতে হলো রিমনের হেল্পার। রিমনের কথা মত মেয়েটা কল দিল তার কাজিনকে। ইনিয়ে বিনিয়ে জেনে নিলো শিবলী ভাই কোথায় আছে তার প্রেমিক মানুষটা একটু দেখা করতে চায়, কথা বলতে চায়। রূপাও সরল মনে শিবলীকে ফোন করে জেনে নেয় লোকেশন সেই লোকেশন পৌঁছায় রিদওয়ান অবধি। গুলশানের আশপাশেই এক রেস্তোরাঁয় বসে ছিল শিবলী তার সাথে ছিল তারই এক বন্ধু। পশ এলাকা, বেশ নিরিবিলি রেস্তোরাঁ গা ঢাকা দেওয়ার জন্য বোধহয় উপযুক্ত স্থানই সেটা তবুও শিবলীর জন্য তা ছিল বিপদজনক আর ভয়ংকর স্থান৷ অর্ণব সেখানে পৌঁছুতেই দিক বিদিক ভুলে ঘুষি মেরে বসেছিল শিবলীর নাক বরাবর। আকষ্মিক আক্রমণ বুঝে ওঠার আগেই এসে পৌঁছায় রিদওয়ান। সময়, কাল, স্থান তারও মাথায় ছিল না শুধুই ছিল শিবলীকে রক্তাক্ত করা আর তাইতো মুহূর্তেই এলোপাথাড়ি আঘাত চলল শিবলীর ওপর। মিনিট দশেকের মাঝে লেগে গেল চরম হুলস্থুল কান্ড যা রেস্তোরাঁয় থাকা প্রত্যেকটি মানুষকে ভীত করে তুলল৷ আর এমনটা হওয়ারই কথা বিশেষভাবে বলতে হয় অর্ণবের মুখাবয়বই অর্ধেকটা সংশয় তৈরি করেছিল। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহের গম্ভীর গাঢ় চাহনি, ক্ষুরধার চোয়ালের শক্তভাব আর তার চেচিয়ে বলা কথার সাথে তাল মেলানো আঘাত প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো গভীরভাবে৷ রেস্তোরাঁর ওনার শিবলীরই খুব কাছের বন্ধু ছিল তবুও সে ব্যবসায়ের দূর্নাম এড়াতে পুলিশে খবর দেয়নি। নিজে এগিয়ে এসেছিল কিছু স্টাফসহ রিদওয়ান, অর্ণবকে থামাতে। বিধিবাম! বেচারা নিজেই আহত হয়ে বসে পড়লো একপাশে। শিবলীর অবস্থা বেজায় করুণ হতেই হুঁশ ফেরে অর্ণবের। জ্ঞান থাকলেও সে বেহুশের মত পড়ে রয় মেঝেতে। রিদওয়ানের শেষের আঘাতগুলো বেশ শক্ত হওয়ায় শিবলীর অবস্থা গুরতর হয়। কিছুটা সময় নিয়ে ধাতস্থ হয় অর্ণব, রিদওয়ান দুজনেই তারপর নিজেরাই শিবলীকে নিয়ে রওনা হয় হাসপাতালে। ওদিকে বাড়ি থেকেও একের পর এক কল আসতে থাকে রায়না আর ছোট দাদীর। রাত তখন গড়িয়েছে অনেকটা। আকাশ কালো করে বিজলি চমকাচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণে। বর উপস্থিত নেই, মেয়ের ভাইটাও হঠাৎ উধাও। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে উপস্থিত সকলেই আর শায়না তো ভয়েই মূর্ছা যাচ্ছিলেন। কতগুলো আত্মীয়স্বজন নিয়ে তিনি এসে তো পড়েছেন আর আসতে আসতেই ছেলেকে হুমকিও দিয়েছিলেন যেন যথা সময়ে উপস্থিত হয়। একটা সপ্তাহ ধরে ছেলের সাথে বেশ যুদ্ধই চলছিল তাঁর এই বিয়ে নিয়ে। দোষটা বোধহয় সম্পূর্ণ শিবলীর ওপর দেয়া যায় না অনেকটা বর্তায় তার বাবা-মায়ের ওপরই৷ শিবলী জানিয়েছিল বাবা-মাকে তার মনের কথা তারা সেসবে পাত্তা দেয়নি। বরং তার দাদী মানুষটা বড্ড একরোখা আর জেদী। যেদিন থেকে বলেছেন অর্নিতাকে নাত বউ করবেন সেদিন থেকেই শিবলীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। কোন মতেই প্রণয়ে জড়ানো যাবে না কোথাও। তার এ নিয়েও হয়েছে বেশ সভাসালিশ৷ তাদের বাড়িতে প্রেমের বিয়ের নিয়ম নেই সেই নিয়ম ভঙ্গ করার শাস্তি একমাত্র ত্যাজ্য হওয়া। শিবলী প্রফেশনে প্রতিষ্ঠিত হলেও দিনশেষে মাথার ছাদ তার বাপ- দাদার বাড়িটাই। তাই সহজ মস্তিষ্ক হঠাৎই ক্রুর সিদ্ধান্ত নেয়। বাবা-মায়ের ইচ্ছে পূরণ করে অর্নিতার সাথেই আকদ করবে অথচ রূপাকেও নিজের করবে লুকিয়ে। লুকিয়ে বিয়েটা করার কথা আরও অনেকদিন পর সে পর্যন্ত হয়ত কিচু একটা করে অর্নিতার সাথে বিচ্ছেদ ঘটানো যেতেও পারে এমনটাই অভিলাষ গোপন ছিল। অথচ আজ সকাল থেকে মন মানলো না তাইতো সন্ধ্যায় বরযাত্রী পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই গায়েব হলো গাড়ী নিয়ে। দূর্দশা তার নসীব বরাবর সিলমোহর আগেই টাঙানো ছিল হয়তো। তাই গত সপ্তাহে রিদওয়ানের অত মার খেয়েছে আবার আজকেও একেবারে রিদওয়ান, অর্ণব দু দুটো ছোট ভাইয়ের হাতে চ্যাঙদোলা হতে হলো। ঘটনা তখনো থামেনি চৌধুরী বাড়িতে। দশটার পর শিবলীকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেই অর্ণব ঝামেলা বাঁধালো খালামনির সাথে। এত কাছের, এত আপন হয়েও তার বোনটাকে নিয়ে এই খেলার জন্য সে কাউকে ছেড়ে কথা বলল না। শিবলীর দাদীও উপস্থিত মহলে নাতির শারীরিক অবস্থা দেখতেই তুমুল ঝগড়া করলেন অর্ণবের সাথে। কুঁচকে যাওয়া চামড়ার ওপর মেকাপের আস্তরণ ঠিক বুঝিয়ে দেয় বৃদ্ধার দেমাগ আর সৌখিনতা।পায়ে বেঁধে ঝগড়ায় অর্ণবকে তিনি ভীষণরকম অপমান করতে গিয়ে শাপ শাপান্ত করে বসলো অর্নিতাকে। এক ছাদ মানুষের সামনে বলে বসলেন, ‘এই মেয়ের জীবনে বিয়ে হবে না তিনি বলে দিলেন মুখের ওপর এমনকি এই মুখচোরা মেয়ে, দুশ্চরিত্র মা-বাবার সন্তানকে তারা বলেই নাকি আপন করতে চেয়েছেন অন্যরা তাকে পুছবেও না৷’

মানুষ কত কি বলে কত কি ভাবে তার সবটাই কি পূরন হয়! শিবলীর দাদীর কথাখানা বড্ড লাগলো অর্ণবের গায়ে। সে চোখ মেলে দেখলো একবার সিঁড়িগোড়ায় দাঁড়ানো অশ্রুসজল বোনের মুখশ্রী৷ মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলো সে তার বোনকে বিয়ে দেবে আজ এ ক্ষণেই। বিয়ে কি মুখের কথা! কে বোঝাবে অর্ণবকে? সে উদ্বাস্তু বোনের বিয়ে আজকের এ লগ্নেই হবে। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আত্মীয়ের মাঝে অনাত্মীয় খুব কাছের একজন মানুষই ছিলেন আর তিনি ম্যানেজার আঙ্কেল। অর্ণবের মনে আছে এখনো আঙ্কেলের মাধ্যমে একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল অর্নিতার জন্য। অর্থবিত্তে খুব প্রতাপ না থাকলেও সচ্ছল পরিবার থেকেই এসেছিল। মূলত, পাত্র নিজে অর্নিকে কলেজে এসে দেখেই খোঁজ নিয়ে প্রস্তাব রেখেছিল। অর্ণব তখন সে প্রস্তাবে নজর দেয়নি, দেয়ার কথাও ছিল না কিন্তু আজ এ মুহূর্তে মনে হলো সেই পাত্রের খোঁজ চাই তার। অর্ণব যখন আকুল হয়ে ম্যানেজার আঙ্কেলের কাছে চাইলো ঠিক তখন পাশেই দাঁড়ানো রিদওয়ান টের পেল বুকের ভেতর আর্তচিৎকার। রায়না বেগম আর রিমনটাও কি টের পেল কিছু! পেল বোধহয় তবে মুখ খুলল না তারা। রিমন শুধু বিড়বিড় করে গালি দিতে থাকলো, হাঁদারাম সন্নাসী এ বেলায়ও কি আমি বলব সব! নাকের ডগায় সুযোগ এসে মুখিয়ে আছে এখনও তিনি মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন৷ বলি বিয়েটা কি আমিই করে ফেলব? উফ! রিমনের সত্যিই আর সহ্য হচ্ছিলো না এসব আর। কি ড্রামা লাগিয়ে রেখেছে অর্ণব ভাই আর উপভোগ করছে সকলে। কেউ ভাবছে না ওখানে দাঁড়ানো ওই বাচ্চা মেয়েটার কথা। সে নিজেই এবার এগিয়ে এলো সামনে।

-অর্ণব ভাই!

রিমনের ডাক শুনলেও অর্ণব ফিরে তাকালো না।সে ব্যস্ত ম্যানেজারের থেকে সদ্য নেওয়া পাত্রের ফোন নম্বর ডায়াল করায়। রিমন ধৈর্য্যচূত্য হয়ে কেড়ে নিলো অর্ণবের ফোন। গলা ছেড়ে চেঁচিয়েই বলল প্রায়, ‘ডাকছি কথা কানে যায় না! নাকি ছোট বলে দাম দিতে চাও না? কি সমস্যা বলো তো তোমাদের? একেকজন বাচ্চা মেয়েটার জীবন নিয়ে এত কিসের ড্রামা করছো? কেউ বাচ্চা কালেই নিয়ে ঠিক করে ফেলছো, কেউ প্রেমিকা থাকতেও সেই বিয়েতে মত দিচ্ছো আর কেউ তো বছরের পর বছর ভালোবেসেও মুখে তালা মেরে রাখছো কারণ মেয়েটি তো অন্যকারো বাগদত্তা৷’

বাড়ি ভর্তি মেহমানের কেউ চমকাল, কেউ থমকালো তো কেউ বিনোদন নিতে আগ্রহী চোখে তাকালো রিমনের দিকে। রায়না বেগম ভয়ে ভয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ ফেরালেন স্বামীর দিকে। বড় ছেলের মনের খবর বাড়িতে শুধু তার একার নয় রিমনেরও জানা এ কথা তিনি জানতেন। বাশার শেখ কখনোই অর্নিতাকে ছেলের পাশে দেখতে চান না এ কথা বহু আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন৷ রিমনটা কেন এমন বলছে সবার সামনে!

-কি বললি রিমন?
কৌতূহলী অর্ণবের স্বর। অর্নিতা চোখ বুঁজে মাথা এলিয়ে দিয়েছে নুপুরের কাঁধে শরীরটা তার ভীষণ টলছে। সে জানে রিমন ভাইয়ের কথার অর্থ। সেদিনও তো দেখলো রিদওয়ান ভাইয়ের চোখের তারায় নিজের জন্য অনুভূতির মেলা। সে যে টের পেয়েছে বহু আগেই ওই মানুষটার মনের চাওয়া। তাতে কি! মানুষটা ছন্নছাড়া হলেও কখনো অবাধ নয়। নয়ত সেই কবেই বলে দিতো মনের আগল খুলে জমিয়ে রাখা হৃদয়ের কথাগুলো। অর্নিতার এই সপ্তদশী জীবনে প্রেমের জোয়ার এসেছিল তো ওই একজনের নামেই। হ্যা এটাই তো ধ্রুবসত্য তার নিশ্চুপ জীবনের গোপন এক সত্য। কৈশোরে পা রাখতেই মন চঞ্চল হয়েছিল বাউণ্ডুলে রিদওয়ানের ভাইয়ে তা আবার অচিরেই নিথর হলো শিবলী ভাইয়ের নামে। তখন থেকেই বোধহয় অর্নিতা একেবারেই চুপ হয়ে গেল সব ব্যাপারেই কিন্তু আজ রিমন ভাই কেন পুরনো ঘা খুঁচিয়ে দিলো!

-পাত্র খোঁজাখুঁজির কি আছে? বোনকে বিয়ে তুমি আজই দেবে তাইতো! আমরা দু ভাই কি মরে গেছি যে এদিক ওদিক দেখতে হবে।

অনেক অনেকটা সময় মাথা নিচু করে দম আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো যেন রিদওয়ান। হঠাৎই রিমনের কথায় সে গাঢ় উঁচু করলো, অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে।

-কি বলতে চাস ঠিক করে বল।

-ওর কথা বাদ দাও অর্ণব তুমি কল দাও সেই ছেলেকে।
বাশার শেখ অর্ণবকে তাড়া দিলেন। রায়না বেগম এবার ফুপিয়ে উঠলেন। এমন মুহূর্তেই তাঁর স্বামী যে অর্নিতাটাকে অবজ্ঞা করছেন তা স্পষ্ট। কিন্তু রিমন থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে চতুর ঠিক তার বাবার মতই। বাবা যে কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইছেন তা সে মানবে না। ভাইটা বাবার বাধ্য সন্তান বলেই হয়ত জোর দেখিয়ে কিছু বলছে না কিন্তু আজ এ সময়টাকে লুফে না নিতে পারলে আজীবন আফসোস থেকে যাবে। তাইতো সে বাবার কথায় তোয়াক্কা না করে সরাসরি বলে দিলো, ‘ ভাইয়া খুব অর্নিতাকে ভালোবাসে। অর্নিতার হাত দুটো আমার ভাইয়ের হাতে দাও অর্ণব ভাই আমি কথা দিচ্ছি তোমার বোন কখনো অসুখী হবে না।’

পুরুষরা কি কাঁদে! রিদওয়ানের চোখ জল ছলছল করছে৷ রায়না বেগম অবাক চোখে দেখছেন তার সাহসী ছোট ছেলেটাকে৷ তিনি এবার নিজেই এগিয়ে এলেন, ‘অর্ণব রিমনের কথা সত্যি আমার ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে অর্নিটাকে। শিবলীর সাথে আগেই কথা পাকা হয়ে ছিল বলে ছেলেটা আমার কোনদিনও প্রকাশ করেনি তার ভেতরের খবর। আজ তো সব সামনেই তোর। অর্নিটাকে দিবি আমায়!’

পরিস্থিতি বদলে গেল নাটকীয়ভাবেই। শিবলীর পরিবার আর একটুও দাঁড়ালো না সেখানে। ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন বারোর ঘরে। কাজী সাহেব আগেই এসেছিলেন আবার চলেও গেছেন অনেক আগে। এতরাতে বিয়ের জন্য কাজী কোথায় পাওয়া যাবে এ নিয়ে চিন্তিত সবাই। এ চিন্তা থেকে উদ্ধার করলো বর নিজেই। না চাইতেও সবার সামনে বলেই ফেলল, ‘কাজী একজন জোগাড় করা সম্ভব।’

-বাহ ভাইয়া! তর সইছে না বুঝি?

-তেমন কিছু না সবাই চিন্তা করছিস তাই বললাম।

-আসলেই কি তাই! টিপ্পনী কাটলো রিমন।

রাত বাড়ছে তাই আর মশকরাতে ভিড়লো না কেউ। রিদওয়ানের বন্ধুর বাবাই একজন কাজী সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো। মধ্যরাতেই বন্ধুকে খবর দিতেই সে এলো তার বাবাকে নিয়ে৷ এরই মাঝে অর্ণবের অনুমতি নিয়ে রিদওয়ান কথা বলেছে। সে জানতে চেয়েছিলো অর্নিতার আপত্তি আছে কিনা তাকে বিয়ে করতে। নাহ, অর্নিতা এ নিয়ে কিছুই বলেনি। তার জবাব ছিলো ভাইয়া আর খালামনির ইচ্ছাই তার জবাব৷ এরপর আর কথা থাকে না। রাত ঠিক একটায় সইসাবুদসহ কবুল বলল অর্নিতা, রিদওয়ান৷ প্রতিধ্বনিত হলো আলহামদুলিল্লাহ প্রত্যেকের মুখেই তবে কারোটা আনন্দে আর কারও কারও ছিলো লোক দেখানো উচ্চারণ। বড় দাদা আর তার পরিবারের যে ক’জন ছিলো সকলেই সে রাতেই চলে গেল নিজেদের বাড়ি৷ পাশাপাশি বাড়ি দুরত্ব শুধু গেইট দুটোর। যেতে যেতে আফসোস ঝরলো বড় দাদুর গলায়। অথচ তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে তার বড় ছেলে ভাবলো ভিন্ন কিছু৷ বাড়িতে এখন শেষ এক সুযোগ রয়ে গেছে মারিয়া তারই ছোট কন্যা।

বিয়ের আসর ভেঙেছে অনেক আগেই। দোতলা, নিচতলা মিলিয়ে থাকার ব্যবস্থা হলো সকলের। দাদীর শরীর আজ বেজায় খারাপ সন্ধ্যের ঘটন থেকেই তাই বাধ্য হয়েই ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন তিনি তাঁর পাশেই শুয়েছে বৃষ্টি। নিচতলার সবচেয়ে বড় ঘরটায় আছেন রায়না বেগম আর বাশার শেখ। দোতলায় রিমন নিয়েছে একটা ঘর তাতেই থাকবে রিদওয়ান। বিয়েটা স্বাভাবিক অবস্থায় হলে হয়ত আজ কনের পাশেই থাকতো তার বর। এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় তাদের থাকার চিত্রও ভিন্ন। কথা উঠেছিলো রিদওয়ানের থাকার ব্যবস্থা হবে অর্নিতার ঘর। সে মেনে নেয়নি এ কথা। একবারেই সবটা পেলে কেমন করে চলবে! সে চায় তার ভালোবাসার ঘরটা ধীরে ধীরে কোমল হাতে বুনন করতে। সময় দেবে সে অর্নিকে পূরণ করবে তার প্রতিটা স্বপ্ন ততদিনের এক অদৃশ্য বিচ্ছেদ চলুক দুজনাতে। তাই সুযোগ পেয়েও কাছে চায় না মেয়েটাকে। অর্নিতা থাকবে নিজের ঘরেই সাথে থাকবে নুপুর। রাত বাড়লো বাড়লো বাড়ির নিস্তব্ধতা। প্রত্যেকেই ঘুমের প্রস্তুতি নিয়েছে অথচ ঘুম নেই জনা কয়েক মানুষের চোখেই। অর্নিতা চোখ বুঁজে শুয়ে আছে তার হাতের মুঠোয় একটা একশ টাকার নোট। একটু আগে ঘুমুতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রিদওয়ান এসেছিলো এ ঘরে। নুপুর তাকে দেখেই ঘর ছেড়েছিলো। রিদওয়ান দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় অর্নিতার সামনে। ব্যগ্র গলায় বলে বসলো, কলম দে তো একটা।

অর্নিতা বিষ্মিত চোখে তাকায় সামনের মানুষটার দিকে৷ এত রাতে কলম কি কাজে লাগবে! রিদওয়ান আবারও তাড়া দিলে অর্নিতা একটা কলম এগিয়ে দেয় রিদওয়ানকে। সে ওয়ালেট থেকে একশ টাকার একটি নোট বের করে তাতে ঝটপট কিছু লিখেই তা বাড়িয়ে দেয় অর্নিতার দিকে।

– বিয়ের রাতে নাকি বউকে কিছু উপহার দিতে হয়! আমার সাথে এখন টাকা ছাড়া কিছুই নেই। এটাই তোর উপহার। যেদিন তোকে বাড়ি নেব ইনশাআল্লাহ সেদিন বিশেষ কিছু উপহার দেব, ঘুমিয়ে পড়।

যেমন বেগে এসেছিলো তেমন বেগেই চলে গেল রিদওয়ান৷ অর্নিতা হতবাক, কি হলো এটা! অর্নিতার ভাবনা লম্বা হওয়ার আগেই আবার ঘরে ঢুকলো নুপুর।

-কেন এসেছিলো রে!

-উপহার দিতে।

-কিসের উপহার?

-বিয়ের।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে