কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৪

0
494

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৪ (ক)

‘ধন্যবাদ’

ছোট্ট এই শব্দটা মাত্রই এসেছে কাঙ্ক্ষিত পুরুষের পক্ষ থেকে। কেন এই ধন্যবাদ! জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ নুপুরের। শেষ বিকেলের নিভু আলোয় যে মুখটা দেখেছিল গম্ভীর এখন সেই মুখটা কি একটু নরম, কোমল ঘাসের মতন হয়ে আছে? ধন্যবাদ লিখতে কি অনুভূতি খরচ করেনি লোকটা? অর্নিতাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ভীষণ মন খারাপ ছিল কিন্তু বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটুও মন খারাপ থাকেনি নুপুরের। কত সাধ করে সে রান্না করেছিল আর তারও বেশি আগ্রহ নিয়ে লোকটাকে মেসেজ করেছিল। মিনিট গড়িয়ে ঘন্টা যখন পার হলো তখন মনে হলো হয়ত ব্যস্ত আছে তাই মেসেজ দেখেনি ওই মানুষটা। তার ধারণা ভুল হয় যখন দু ঘন্টা পরও কোন পাল্টা জবাব এলো না। একটা অতি মাত্রায় ব্যস্ত মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন না দেখে থাকতে পারে! হয়ত পারে তবুও নুপুরের মন মানলো না। তার বিশ্বাস লোকটা ইচ্ছে করেই তার মেসেজ দেখেনি। এড়িয়ে গেল তাকে যেমনটা আগেও করেছে। মন খারাপ হলো লজ্জাও লাগলো ভীষণ তার। নিজেকে বেহায়ার ঠিক নিম্মস্তরের মনে হতেই সে বাড়ি ফেরার তাড়া দেখালো। অর্নিতা আর দাদী কেউই তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলো না। দাদী তো নুপুরকে বলেই বসলো, ‘তোমার আব্বার সাথে কথা বলায়া দেও বুবু। আমি বলে দিতাছি আইজ তুমি থাকবা এইখানে সকালে আমার দাদায় দিয়া আসব তোমারে।’

নুপুর শোনেনি সেকথা সে তৈরি হয়ে বের হচ্ছিলো তখনই তো এলো অর্ণব৷ আর এখন তার থেকে আসা ধন্যবাদটা আবার নুপুরকে বেহায়া করে তুলছে৷ বাড়ি ফেরার পর থেকেই ছোট মা মুখ চালাচ্ছেন এখনো চলছেই। জাকির ভাই আজ আবারও একটা বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন সেই নিয়েই ঘ্যানরঘ্যানর। বাবাও চুপ করাতে পারছেন না মানুষটাকে। নুপুর ভেবে পায় না সে কি এমন খায়, পরে যার জন্য ছোট মার সংসারে অভাব হবে! এত কেন অপছন্দ করেন তিনি তাকে? সৎ মা হলেই কি খারাপ আচরণ থাকতে হবে মানুষের চরিত্রে! ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো। গত কয়েকদিনে অনেক গাফিলতি ছিল পড়াশোনায়। আজ সবটা পুষিয়ে নেবে বলে মনস্থির করেই বই নিয়ে বসলো। খিদে না পেলে সে আজ আর ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না।
_________

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আছে। হাতের মুঠোয় একটা রূপোর আংটি, তার বাবার আংটি। কত তখন বয়স তার নয় নাকি দশ! মায়ের তখনও দ্বিতীয় বিয়ে হয়নি তবে তারা তখন আলাদাই থাকেন৷ বাবার সাথে কি নিয়ে এক ঝগড়া হলো তারপরই মা ব্যাগপত্র গুছিয়ে অর্নিতা আর তাকে নিয়ে চলে গেলেন বাবার বাড়ি। অর্নিতা তখন টুকুর টুকুর হাঁটতে শিখেছে। মামা-মামী আর নানা-নানি তখন অর্নিতা, অর্ণবকে বেশ আদরই করতেন। প্রথম এক সপ্তাহ তাদের সেখানে কাটলো প্রচণ্ড আদর আহ্লাদে এরপর একদিন বাবা গেলেন তাদের আনার জন্য ঠিক সেদিন থেকেই শুরু হলো জীবনের বিভীষিকাময়। মা ফিরলেন না বাবার সাথে তাদের দু ভাই বোনকেও দিলেন না। মা কিসব যেন অভিযোগ তুললেন বাবার নামে তাই সেদিন দুই মামা মিলে মারধোর করলেন বাবাকে। চোখের সামনে বাবার অমন দশা অর্ণব সইতে পারলো না। দৌড়ে গেল বাবার কাছে মা জোর করে তাকে দোতলার ঘরে আটকে রাখলেন। উপায় না পেয়ে অর্ণব জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো বাবার কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। ছোট্ট অর্নিতা তার ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো বাবার কোলে৷ নির্দয় তাদের মা রক্তাক্ত বাবার কোল থেকেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো বাবার সেই পুতুল কন্যাকে। সেই ছোট্ট পুতুলটা বাবার আঙ্গুল জড়িয়ে সেকি কান্না! সেদিনই হয়েছিল অর্নিতার সাথে বাবার বিচ্ছেদ রয়ে গিয়েছিল বাবার আঙ্গুলের আংটিখানা ছোট হাতটার মাঝে। বাবা সেদিন অচেতন প্রায় কোনমতে নানার বাড়ির গেইট পেরিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ছাড়া পেয়েছিল অর্ণব৷ আর সে সময়েই দেখতে পেল মা অর্নিতার হাতে বাবার আংটিটা দেখতে পেয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল আঙিনার ঘাসের ওপর। অর্ণব খুঁজে বের করে যত্নে রেখেছিল সেটা। আজ সেটা চোখে পড়ায় হাতে নিয়ে বসে ভাবছিল পুরনো সেই সময়টার কথা। সেদিনের ঘটনা এখনও তার মনে পড়ে খুব। চোখের জল এবার কার্নিশ ছুঁয়ে টুপ করে পড়ে গেল নিচে। তখনই কানে এলো বোনটার ডাক, ভাইয়া খেতে আসো।

-আসছি।

দু হাতে চোখ-মুখ মুছে অর্ণব নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচে গেল। দাদী আর অর্নিতা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।

-আমাকে ছাড়াই শুরু করে দিলে তোমরা?

– অপেক্ষা করনের কারণ আছে নাকি!
দাদীর কথায় সুক্ষ্ম খোঁচা। হাসলো অর্ণব। দুপুরে খেতে না আসার জন্যই এটা পাওয়া কিন্তু সেই মেয়েটা কেন এমন করে কিছু বলল না! বললেই পারত।

-আরও দেব?

প্লেটের দিকে অমনোযোগী ভাইকে দেখে অর্নিতা ইচ্ছে করেই বলল। প্লেটে দু চামচ দুপুরের রান্না করা ভুনা খিচুড়ি দিয়েছে সে। অর্ণব বোনের ডাকে সেদিকে তাকিয়ে বলল, এইটুকুতে কি হবে আমার! তার পাশেই দাদী বসেছিলেন। খিচুড়ির ডিশটা ঠেলে তার দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘নিয়া নে যত লাগে। তুই বস বুবু অরে নিজে নিয়া খাইতে দে।’

অর্নিতাও তাই করল। অর্ণব এবার পুরো টেবিলে এক পলক তাকিয়ে বুঝলো আজ রান্নাবান্না ভালোই হয়েছিল। ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, মুরগির ঝাল মাংস সাথে আবার টক আমের আচারও।

-আম তো আজই আনলাম আজকেই আচার বানানো হয়ে গেল?

অর্ণবের প্রশ্নে দাদী বিরক্তির চোখে তাকালেন। আজ বারংবার তিনি নাতির দিকে রুষ্ট দৃষ্টি ফেলছেন মানে কোন কারণে ভীষণ রেগেই আছেন। অর্ণবও তা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, কি করলাম আমি?

-বৃষ্টিরে নিয়া কই যাবি তুই?

-মানে?

একই সাথে দু ভাইবোন প্রশ্ন করলো। বৃষ্টিকে নিয়ে কোথায় যাওয়ার ছিল মনে করতে পারলো না অর্ণব।

-তোর খালায় বলছে শুক্কুরবার নাকি অর মাইয়া বন্ধুবান্ধব নিয়া চিটাগাং যাইব লগে তুই যাবি। ক্যান অর দুই দুইডা ভাই আছে কি ঘাস কাটতে তোর ক্যন যাওন লাগব?

দাদী কোন এক কারণে বৃষ্টিকে খুব একটা পছন্দ করেন না এ কথা অর্নিতা-অর্ণব দুজনেই জানে। কিন্তু কেন করেন না তা আজও জানতে পারেনি। আর বৃষ্টিকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান কে করল আর করলোই তো তাকে না জানিয়ে কেন! অর্ণব কিছু বলতে চাইলো তার আগেই দাদী বলল, ‘তোমার যাওয়া লাগব না কোন জায়গায়। আমি রায়নারে না করে দিছি আর শোনো দাদাভাই অর্নিতারে এইখানেই রাখো।’

দাদীর কথার অর্থ দু ভাই বোনেরই জানা। আগেও অনেকবার বলেছেন, আমাগো মাইয়া বড় হইছে অগো বাড়িতেও বড় বড় পোলা আছে ভালা দেখায় না ওই বাড়িতে মাইয়ারে রাখা। আমিই দেইখাশুইনা রাখতে পারমু অরে।

অর্ণব শোনেনি সে কথা। যতই বলুক দাদী খেয়াল রাখবে তার মাথা থেকে চিন্তা দূর হবে না। ওখানে খালামনি আছক বৃষ্টি আছে আর রিদওয়ান, রিমনও তাকে কেয়ার করে৷ খালুজান নিজেও বৃষ্টির মতই অর্নিতাকে ভালোবাসেন। ভয় হয় না তার অর্নিকে সেখানে রাখতে উল্টো মন বলে সে ওখানেই সবচেয়ে নিরাপদ। কথাবার্তার ফাঁকেই খাওয়া শেষ হয়েছে অর্ণবের। সে আবারও ঘরে ঢুকে কাজ নিয়ে বসলো। এবার আর মনযোগে বিঘ্ন ঘটেনি একটিবারও। প্রায় মধ্যরাতে কাজ শেষ হলে ফোনটা হাতে নিলো। বিছনা ঝেড়ে গা এলিয়ে ফোনের স্ক্রীণে নজর ফেলেই চমকে গেল সে। বৃষ্টির নম্বর থেকে সাতটা কল। সময় দেখলো তখন রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ। কল এসেছে এগারোটার দিকে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে বৃষ্টি। সকালে উঠে কল করবে বলে ভেবে এবার মেসেজ অপশনে নজর ফেলল। নাহ, ধন্যবাদের বিপরীতে কোন জবাব দেয়নি মেয়েটা। হয়ত রাগ করেছে! কিন্তু প্রথম ধন্যবাদটা ছিল আমের শরবতের জন্য। বাড়ি আসার পর দাদী শরবত দিয়েছিল পরেই জানলো নুপুর বানিয়েছে। কিন্তু এখন যে সে মজা করে খিচুড়ির সাথে মুরগির মাংস খেল সেটার জন্যও আরেকটা ধন্যবাদ প্রাপ্য মেয়েটার। ভবতেই ঠোঁটে হাসির ফোয়ারা। হাজারো বিষাদে আকণ্ঠ ডুবে থাকা ছেলেটা এখন সময়ে অসময়ে হেসে উঠে ওই শ্যামকন্যার কান্ড- কারখানায়। এজন্যে হলেও মেয়েটা অনেকগুলো ধন্যবাদ পায়।ভরা বর্ষায়, নিরদ ঢাকা আকাশটাতে হুট করে সূর্যের উঁকি এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তো ওই পাগল মেয়েরই। রাতের সময়টা হিসেবে রেখেই অর্ণব আবারও একটা ধন্যবাদ লিখে মেসেজ করল। সামান্য একটা মেসেজ টোনে নিশ্চয়ই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না তার!

_______

ভর সন্ধ্যেতে মন খারাপের পাহাড় মাথায় নিয়ে বসে আছে রিদওয়ান। রায়না বেগম করুণ চোখে দেখছেন ছেলের মুখখানা। একটু আগেই বাশার সাহেবকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনা হয়েছে। কাল রিমন বাড়ি এসে বড্ড স্থিরতার সাথে জানিয়েছিল বাবার অসুস্থতার কথা। রায়না বেগম প্রথমেই উতলা হননি পরে অবশ্য হাসপাতালে পৌঁছে অসুস্থ স্বামীর চেয়ে বড় ছেলের চেহারা দেখেই বেশি ভেঙে পড়েন৷ রিদওয়ানের চোখমুখ দেখে মনে হলো তার বাবা অনেক বেশিই অসুস্থ কিংবা হয়ত হার্ট অ্যাটাকই করেছেন। রিমন বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন আর খুবই প্র্যাকটিক্যাল সে। ডাক্তারের সাথে কথা বলিয়ে মাকে আশ্বস্ত করেছে বাবার শারীরিক অবস্থা। রাত আর দিনের পুরো সময় বাশার সাহেবকে অবজারভেশনে রেখে একটু আগেই বাড়ি আনতে পেরেছেন। এরই মাঝে আত্মীয় স্বজন অনেকেই এসেছেন। অর্ণব খবর পেয়েছিল আজ সকালেই। সেও অর্নিতাকে নিয়ে চলে এসেছিল তখন। সারাদিন অর্নি এ বাড়িতেই ছিল আর অর্ণব ছিল রিদওয়ানের পাশেই। বয়সে বছর দুইয়ের বড় রিদওয়ান সবসময়ই অর্ণবের জন্য ছিল বন্ধু। তার মানসিক অবস্থা টের পেয়েই সে একটু আগ পর্যন্তও ছিল৷ কিন্তু একটু আগেই ম্যানেজার আঙ্কেল কল জরুরিভাবে অফিসে দেখা করতে চাইলেন। আঙ্কেলের কণ্ঠ শুনেই অর্ণবের মনে হলো বড় কোন অঘটন ঘটেছে নইলে এভাবে উনি তাকে ডাকতেন না। তাই আর দেরি না করে সে বেরিয়ে পড়লো। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডাকছে যেন, সইবার মত কোন ঘটনা হয়৷ এমনিতেই চারপাশের এত বিপদশঙ্কুল আবহাওয়া তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আজকাল এমনিতেই মনে হয় বোনটাকে দ্রুত একটা নিরাপদ হাতে দিতে পারলে কোথাও হারিয়ে যেত সে। এই পৃথিবী তার বসবাসযোগ্য নয়।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৪(খ)

অর্ণবের ধারণা ভুল করে তার মেসেজের জবাবটা রাতেই এসেছিল৷ নুপুর তৎক্ষনাৎ লিখেছিল, ‘লাগবে না আমার আদিখ্যেতা দেখানো ধন্যবাদ। ধন্যবাদ নিয়ে যারটা সে লুডু খেলুক।’

পাল্টা জবাব এমন আজব হবে ধারণা ছিল না অর্ণবের তবুও রাত বেশি হওয়ায় আর কোন মেসেজও সে দিল না। ভেবেছিল পরের দিন কিছু একটা বলবে কিন্তু সেই সুযোগটাও হয়নি। সকালেই খবর পেল খালুজানের অবস্থা এরপরই অর্নিতাকে নিয়ে ছুটলো সে বাড়ি আর তারপর হাসপাতাল থেকে আবার নিজের কারখানায়। ম্যানেজার আঙ্কেল আর অফিসের দারোয়ান মিলে সন্দেহভাজন একজনকে আটকে রেখেছিলেন। কয়েক দিন ধরে অর্ণবকে কেউ ফলো করে এ ব্যাপারে তাদের বলেছিল অর্ণব কিন্তু তারা যে গাঁজাখোর দেখলেও সন্দেহে আটকে রাখবে তা কে জানত! অর্ণব সেদিন আটকে রাখা ছেলেটাকে আটকে রেখে অনেকটা জেরা করে ছেড়ে দিল। সে যেমন দেখেছিল ফলোকারীকে এই ছেলের সাথে তার মিল নেই। সামনাসামনি না দেখলেও মোটামুটি কাছ থেকেই দেখেছিল লোকটা বয়সে তারচেয়েও বড় আর স্বাস্থ্যের দিক থেকেও কিছুটা পেটানো শরীর। এদিকে দারোয়ান যাকে আটক করেছে সেই ছেলেটা নেহায়তই এলাকার পাতি মাস্তান, গাঁজাখোর। চোখ, মুখ চেহারা দেখেই বোঝা যায় নেশায় বুদ থাকে সারাক্ষণ। সেদিন ওই ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেও চিন্তা শেষ হয়নি মাথা থেকে। তারওপর খালুজানের অবস্থাও খুব বেশি উন্নত হচ্ছিলো না। এসবের মাঝে প্রায় একটা সপ্তাহ কাটতেই মেজো খালামনি ফোন করে বললেন, অর্নিতা আর শিবলীর বিয়েটা তিনি অতি দ্রুত রাখতে চাইছেন। অর্ণব মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে যেন আজকাল। বারংবার মন বলছে থাক মাতাল থাক নেশাড়ু তবুও বাবাটা বেঁচে থাকলে বোধহয় ভাল হত। বাবার জিন্দাদশার অযুহাতে কি দায়িত্বটাকে সে এড়িয়ে যেতে পারতোনা! কিন্তু এখন? বোনটার ভবিষ্যতের ভাবনাটা না থাকলে সে অনায়েসে নিজেকে মুক্ত পাখির মত উড়িয়ে দিতো কোন এক অজানা হাওয়ায়। চোখ বুঁজে মাথা উঁচিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো অর্ণব। চোখ মেলে তাকালো রাস্তার ওপাশে ঝোলা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামা কন্যাটির দিকে৷ কয়েকটা দিন ধরেই তার মনে হয় ওই যে ওই মেয়েটির ছটফটে কিছু কথা তাকে একটুক্ষণের জন্য হলেও রিলিফ দেয় তার দমবন্ধ দুনিয়া থেকে। এমন নয় মেয়েটির কণ্ঠস্বর সে শোনে। শুধুই দু চারটে মেসেজ পাল্টা মেসেজেই মেলে স্বস্তির দেখা। নিজের গাম্ভীর্যের খোলস থেকে বেরিয়ে কখনো সে সহজ হয়ে কথা বলতে পারেনি তাই প্রযুক্তির চমৎকার দানের একটি মুঠোফোন আর তার মাধ্যমে পাওয়া মেসেজ অপশনই অর্ণবের মাধ্যম৷ এর বাইরে যা করে তা হল মনের অজান্তেই সে গত চারদিন ধরে ঠিক গৌধূলিলগ্নে এসে এখানটায় দাঁড়ায়। কপাল কুঁচকে, চোয়াল শক্ত করে শুধু মিনিট কয়েক দেখে রাস্তার ওপাশের মেয়েটিকে। তারপরই আবার ফিরে যায় নিজ গন্তব্যে। যতটুকু সময় সে ওই মুখটি দেখে ততটুকু সময়ে পৃথিবীর এ প্রান্তের গৌধূলি রঙ মাখিয়ে যায় অর্ণবের পাথরঘষা দিলে। এখনো তাই হচ্ছে তবে আজ রঙ মাখেনি অন্তরের কোথাও। বরং তার ঠিক পেছনে বসা কয়েকটা ছেলের কথোপকথন তার কর্ণকুহরে গরম সীসার মত ঢুকে ঝলসে দিল ভেতরটা। না চাইতেও ঘাঢ় ফিরিয়ে সে পেছনে চায়ের দোকানটায় একপলক তাকালো। বয়স কত হবে ছেলেগুলোর সতেরো কি আঠারো! দেখেই বোঝা যাচ্ছে কলেজ পড়ুয়া সবগুলো কিন্তু মুখের ভাষা ঠিক কিছু গাঞ্জা টানা ছাগলদের মত। অর্ণব চুপচাপ আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলো ততক্ষণে রাস্তার ওপাশে থাকা নুপুর রিকশায় উঠে চলে গেছে। এবার অর্ণব হাতের ফোন আর কানের ব্লুটুথটাও পকেটে পুরে নিলো। ফুল স্লিভ শার্টের স্লিভ দুটোই ছিল বোতাম লাগানো ছিল সেগুলো দ্রুতই গুটিয়ে নিলো। চারপাশে কিছু একটার খোঁজ করলেও চোখে কিছু না পড়ায় খালি হাতেই এগিয়ে গেল ছেলে গুলোর সামনে। দিক বিদিক না দেখেই সে সামনে থাকা ছেলেটার টি শার্ট ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে কষে থাপ্পড় লাগায় দুটো। আকস্মিক ঘটনায় দোকানে থাকা প্রত্যেকেই চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। থাপ্পড় খাওয়া ছেলেটির বাকি বন্ধুরা অর্ণবের দিকে তেড়ে এলে সে প্রত্যেকটাকেই কলার চেপে ধরে থাপ্পড় লাগায়। থাপ্পড়ের সাথে সাথে তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় মাত্র কয়েকটা বাক্য, ‘সে*ক্সি লাগো! ফিগার মাপতে তোর হাতই যথেষ্ট তাই না! দেখি কোন হাতে মাপবি? বিছানায় নিতে চামড়া সাদা দরকার আছে বলেও সাজেশন দিচ্ছিলো কে যেন বল?’

অর্ণব কথাগুলো বলতে বলতেই এলোপাথারি থাপ্পড় লাগাচ্ছিল চারটে ছেলেকে। দোকানটাতে আরও দু তিনজন যারা ছিল তারা হকচকিয়ে গেল কিন্তু কেউই মুখ খুলল না অথবা সাহস পায়নি কিছু বলার। হতে পারে অর্ণবের দেহাবয়বের বিশেষত্বয় ঠিক কারো সাহস হয়ে উঠেনি৷ এদিকে দোকানদারসহ অন্য কাস্টমাররা ততক্ষণে বুঝে গেছে আকস্মিক আক্রমণের কারণ।

-এই নাম বল তোদের সাথে বাবার নাম আর ঠিকানা।

প্রত্যেকটা ছেলেই এবার ভড়কালো। তবে কি বাড়িতে নালিশ যাবে এখন! ছেলেগুলো ভয় পাওয়া চেহারায় তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের সাথে যে আরও একজন ছিল এবং এমন কথাগুলোর শুরুটাই যক করেছিল সে এখান থেকে অর্ণব ঘাঢ় ফিরিয়ে দেখার আগেই পগারপার হয়ে গেছে তা আর জানা হলো না অর্ণবের। শেষ পর্যন্ত কারো বাবার নাম, ঠিকানা না নিলেও প্রত্যেকের একটা ছবি তুলে নিলো সে। আপাতত এদের জন্য এইটুকুই ভয়ের ছিল। মাগরিবের আজান কানে যেতেই অর্ণব সেখান থেকে চলে গেল৷
___________
বাশার শেখ এখন কিছুটা সুস্থ আছেন। এই সুস্থতায় আছে সাবধানতার আদেশ ডাক্তার কতৃক। টোটাল বেড রেস্ট না থাকলেও ছুটোছুটি আর অতিরিক্ত চিন্তার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। বাধ্য হয়েই এক সপ্তাহের মাঝে একবারও বাড়ির বাইরে যেতে পারেননি। কোটি টাকার ব্যবসা এখন পড়ে আছে দুই ছেলের অপরিপক্ক কাঁধে। উহু, দুজনই না একজন অপরিপক্ক ব্যবসায়িক ব্যাপারে অন্যজন এতোদিনে পাকা ব্যবসায়ীই হয়ে উঠেছে বলা যায়। জীবনের অর্ধেকটা সময় ব্যবসার যাতাকলে পিষতে থাকা মানুষ হঠাৎ করেই অবসরে পড়ে সময়টা ঠিকঠাক উপভোগ করতে পারেন না বোধহয়। অন্তত বাশার শেখকে দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে রায়না বেগমের। রান্নাঘরে গ্রিন টি আর এক প্যাকেট নোনতা বিস্কিট ট্রে তে রাখতে রাখতে ভাবছিলেন এই একটা সপ্তাহের কথা। মানুষটা বোধহয় আচরণে একটু নরম হচ্ছেন। গত সপ্তাহেও যে মানুষটা তাঁকে রুক্ষ স্বরে ডাকতেন, নিজের প্রয়োজনগুলোতে আদেশ করতেন সে মানুষটা হাসপাতাল থেকে আসার পর থেকেই নরম হয়ে কথা বলেন। কিছু প্রয়োজন পড়লে সরাসরি আদেশ নয় বরং আবদার অথবা আহ্লাদে বলেন। আর তাই রায়না বেগম এখন মনে মনে গুছিয়ে নিলেন বড় ছেলে সম্পর্কিত কিছু কথা যা খুব শিগগিরই বাশার শেখের সামনে পেশ করবেন। । তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না তাঁর ভাবনার সুতোও অচিরেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লেগে সবটা ঝলসে যেতে পারে। আজ বিকেলটা ঘরে বসে কাটাতে চাচ্ছিলেন না বাশার শেখ তাই মেয়েকে ডেকে বললেন বাইরে যাবেন। বৃষ্টিও তৎক্ষনাৎ আব্বুকে হাত ধরে নিয়ে এলো বাগানের দিকটায়। অর্নিতাও আজ এ সময়ে একদমই ফ্রী থাকায় সেও যুক্ত হলো খালুজান আর বৃষ্টি আপুর সাথে। তিনজনে বসে কথা বলছিল বাগানের গাছপালা আর ফুল, ফল নিয়ে৷ ঠিক তখনই রায়না বেগম এলেন চা নিয়ে সাথে বাশার শেখের মোবাইলটা নিয়ে।

‘আপনি কি একটু কথা বলতে পারবেন?’
রায়না বেগম কথাটা বলেই ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন স্বামীর দিকে।

-কার কল?

-শিবলীর বাবা।

‘শিবলীর বাবা’ কথাটা শুনতেই অর্নিতার হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলকে উঠল যেন। মনে মনে যতই চাইছে মাথা থেকে বিয়ে আর শিবলীকে সরিয়ে রাখতে ততই যেন সময়টা এগিয়েছিল যাচাই সেদিকেই। বাশার শেখ স্ত্রীর হাত থেকে ফোন নিয়ে ধীরে ধীরে কথা বললেন ভায়রা ভাইয়ের সাথে। সল্পবাক্যে কথা শেষ করে বললেন এ সপ্তাহেই তারা আকদ করতে চাইছেন। অর্ণবকে জানানোর আগে বাশার শেখকেই অর্নিতার অভিভাবক মনে করেন তারা আর তাই প্রথমে বাশার সাহেবের কাছেই রাখলপন প্রস্তাব। বাশার শেখ সম্মতি দিয়ে দিয়েছেন৷ অর্নি পাশে বসেই খালুজানের কথা শুনেছে। বুঝেও নিয়েছে কি হতে চলেছে শিগগিরই। না চাইতেও তার বিষন্নতার ঘরটাতে একঝাঁক কষ্ট আবারও এসে জমা হলো। খুব বেশি কিছু তো চাই না তার শুধুই একটা স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া। জীবনটা কি তাকে সেই সুযোগটা দেবে না! খালামনি, খালুজান কিংবা বৃষ্টি আপুর সামনে নিজের অনুভূতি স্পষ্ট না হয়ে যায় সেই ভয়ে বসা থেকে উঠে গেল অর্নিতা। চোখের চশমাটা এতক্ষণ ঝাপসা চোখে বৃষ্টি ভেজা জানালার শার্সির মত ঘোলা লাগছে তার। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে অশ্রুকণাদের মুক্ত করে দিল। চশমা খুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে চোখটা মুছতেই দেখতে পেল সামনে রিদওয়ান ভাই। চশমা চোখে দিলো আবারও, সে কি ভুল দেখছে! নাহ চশমা চোখে দিতেই সামনের মানুষটার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার দৃষ্টি সীমানায়। রিদওয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্নিতার দিকে। হলদে ফর্সা মুখের ভরাট গালদুটোয় নোনা জলের সরু রেখা ঠোঁট দুটো কুঁচকে আছে। মুহূর্তেই রিদওয়ান আনমনে আঙ্গুলে ছুঁয়ে আলতো করে মুছে দিলো অর্নিতার ডান গালটা আর ঠিক তখনি ছিটকে সরে গেল অর্নিতা। এতেই বুঝি হুঁশ ফিরল রিদওয়ানের। কি করতে যাচ্ছিলো সে! অর্নিতার মুখের দিকে আবার তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উল্টো ঘুরে দ্রুত পায়ে উঠে গেল দোতলায়। অর্নিতা খেয়াল করেছিল রিদওয়ান ভাইয়ের সাদা শার্টের ইন খোলা একপাশ, গলার ওপর লাল টাইটা আলগা হয়ে আছে, থুতুনির দিকে কিছুটা লাল রঙ নাকি রক্ত ছিল! এবার টনক নড়লো যেন অর্নির। রিদওয়ান ভাই কি মারামারি করেছে কারো সাথে? শার্টের কলারের ঠিক নিচেই একটু ছেঁড়াও ছিল বোধহয়। অর্নি চটপটে হয়ে কখনোই কিছু করতে পারে না এখনো পারলো না।খুব ধীরেই সে দোতলায় উঠে রিদওয়ানের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজার পর্দা ছড়ানো কিন্তু দরজার কপাট খোলাই আছে। অর্নি ইতস্তত করছিল ভেতরে ঢুকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি করবে না তখনই কানে এলো রিদওয়ানের কথা।

-হ্যাঁ মেরেছি। ওর সাহস কি করে হয় এমন ডবল গেম খেলার?
রিদওয়ান এটুকু বলেই থামলো হয়তো ওপাশের ব্যক্তিটি কিছু বলছে। মুহূর্তেই আবার রিদওয়ানের গলা, ‘ খু’ন করিনি সেই তো তার ভাগ্য। সকল প্রমাণ আমার হাতে থাকার পরও ভন্ডামি করছিল। ওর যে কলিজা খুলে হাতে নেইনি সেই তো অনেক।

…….

-বড় ভাই মাই ফুট! ওর মত এমন খালাতো ভাইকে আমি বালের দামও দেই না। যার চরিত্রের ঠিক নেই সে মানুষের কাতারে পড়ে নাকি। ও আসুক অর্নিকে বিয়ে করতে আমি যদি ওর দেহ থেকে মাথা আলাদা না করছি তো আমার নামও রিদওয়ান শেখ না৷

প্রচণ্ডরকম রেগে আছে রিদওয়ান৷ গলার টাইটা খুলে ছুঁড়ে মারলো বিছানায়। শার্টের বোতামগুলোর যেন একটু ধৈর্য্যও নেই তাই জোরে টানলো আর ঝরঝর করে ছিঁড়ে পড়লো বোতাম একটা একটা করে। কলটা কেটে ফোনটা বিছানায় ফেলতেই রিদওয়ানের মনে হলো দরজার সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা সরাতে দেখলো কেউ নেই সেখানে। অর্নিতা আগেই সরে পাশেই রিমনের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। ভেতরের রাগটা ঠিকঠাক শীতল করা খুব প্রয়োজন ভেবে রিদওয়ান এবার ঢুকে গেল বাথরুমে৷ আজ বোধহয় একটা খুনোখুনি হতে হতেই আর হলো না। তবে অতিসত্বর কিছু একটা হবে আর তা যে রিদওয়ানের মাধ্যমে তা আন্দাজ করে নিলো দরজার বাইরে থাকা অর্নিতা।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে