কে আপনি পর্ব-০১

0
8236

#কে_আপনি
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা

একদিনের মধ্যে শ্রেয়ার জীবনটা এমন উল্টাপাল্টা হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি কখনো। সময় আসলেই অদ্ভুত। সময়ের তফাতে এসে কি থেকে কি হয়ে গেল। কল্পনাও করতে পারছেনা শ্রেয়া। দুনিয়াটা যেন ঘুরে গেছে শ্রেয়ার। চোখ বেয়ে কখন যে নোনা জল গরিয়ে পরা শুরু করেছে বুঝতেই পারেনি। শ্রেয়ার ছোট বোন নুসরাতের কথায় শ্রেয়া তার চোখের পানিটা মুছে ফেলল। যেখানে নিজের আপন কেউ শ্রেয়াকে বিশ্বাস করেনা। সেখানে তাদের জন‍্য কষ্ট কখনোই পাবে না। না কখনো না। এসব ভাবতে ভাবতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো শ্রেয়া। চোখ মুখ হাত দিয়ে মুছে নিলো। বেডের উপর থেকে উঠে পরলো সে। নুসরাতের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলো। তার কান্না দেখে মেয়েটার চোখেও পানি চলে এসেছে। যেখানে বাবা মাও বিশ্বাস করতে পারলো না সেখানে এই ছোট্ট দশ বছরের মেয়েটা তাকে এতোটা বুঝে ভেবেই ভালো লাগা কাজ করলো শ্রেয়ার। সে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে রুমের দরজা খুলে বাহিরে বের হলো।

নিজেকে পাথরের মতো শক্ত করে নিলো। এখন থেকে আর নিজেকে কারো কাছে প্রকাশ করবো না। কাউকে কোনো কিছু বোঝাতে যাবে না। অনেক তো চেষ্টা করলো সবাইকে নিজের কথা বোঝানোর।

বসার রুমে রওনা হলো শ্রেয়া। বসার রুমে গিয়ে দেখলো তার বাবা মা আর সবচেয়ে বড় নষ্টের গোড়া তার সেই ফুপু।

শ্রেয়া চোখমুখ শক্ত করে বললো “আমি এই বিয়েতে রাজি। তোমরা ব‍্যবস্থা করো সবকিছু। আজকেই আমি বিয়ে করবো। এখনই বিয়ে করতে চাই আমি।”

শ্রেয়ার কথায় সবার মুখে হাসিফুটলো। কিন্তু শ্রেয়ার মুখে ঝুলে রইলো একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। তার ফুপু তো খুশিতে মিষ্টির পেকেট নিয়ে ভিতরের রুমে ছুটলেন। তার বাবা তার কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন

“মা আমাদের কথাগুলো মনে নিস না রে। আর ছেলেটা ভালো দেখবি তোকে ভালো রাখবে।”

শ্রেয়া একবার শুধু তারদিকে তাকালো। তার মা কিছু বলছেন না খালি ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবার আদেশে তার মা তাকে রুমে নিয়ে গেল রেডি করতে। সে আগের ন‍্যায় শক্ত হয়েই রইলো। এইদিকে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার । খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু সে যে পারছিনা সহ‍্য করতে।

তিন কবুল বলে শ্রেয়ার বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। পারিবারিকভাবে বিয়েটা হয়ে গেল তার । সবার মুখে হাসি বুঝতে পারছে সে। কিন্তু সে পারছেনা হাসতে। বিদায়ের সময় চলে এলো। শ্রেয়ার চোখমুখ আরো গম্ভীর হয়ে এলো। শ্রেয়ার বাবা তার হাতটা সেই ছেলেটা মানে শ্রেয়ার সদ‍্য বিবাহিত বরের হাতে তুলে দিলেন। তার হাতে হাত ছোয়া লাগতেই শ্রেয়ার কেমন যেন একটা কাপুনি অনুভূত হলো। সবার কান্নাভেজা চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে গাড়িতে উঠে পরলো শ্রেয়া। অনেক কষ্টে নিজের কান্না চেপে রেখেছিলো শ্রেয়া।কিন্তু না সে কান্না করবো না। ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে সে কান্না আটকে রেখেছে। গাড়ি চলছে নিজের আপন গতিতে। পাশে বসে আছে তার সদ‍্য বিবাহিত বর। যাকে সে এখনো চেনেনা জানেনা দেখেওনি পযর্ন্ত। কেন যেন ইচ্ছাও করছে না তার সম্পর্কে কিছু জানার। থাক না সে তার মতো। শ্রেয়া গাড়ির জানালা দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকৃতির দিকে তাকালো। ভালো লাগছেনা একদম। মাথাটা প্রচণ্ড ধরেছে তার । একটা লম্বা ঘুম প্রয়োজন তার চোখ বুজে আসছে তার।

চোখ পিটপিট করে খুলে চারপাশে তাকাতেই একটা অচেনা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করল শ্রেয়া। শোয়া থেকে উঠে পরলাম সে। উঠতেই একটা পুরুষালি কন্ঠে চমকে উঠলো সে। চোখের দৃষ্টি পাশে রাখতেই দেখলাম একজন সুদর্শন যুবক ভ্রুকুচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখমুখে তার ক্লান্তির ছাপ। পরনে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা। শ্রেয়া তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো তখন সে কোমল কন্ঠে বলে উঠলো

“শ্রেয়া আপনি এখন ঠিক আছেন তো। ঘুম হয়েছে আপনার।”

শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে হ‍্যাঁবোধক উত্তর বোঝালো। তার হ‍্যাঁবোধক উত্তর পেয়ে ছেলেটির মুখে একটা মুচকি হাসির রেখা যা শ্রেয়ার চোখ এরালো না। শ‍্যামবর্ণ ছেলেটার মুখের মুচকি হাসি দেখে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করলো তার। পরক্ষণেই সবরকম চিন্তা ছেড়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে শ্রেয়া বলল

“আচ্ছা আমি কি অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। এখন কয়টা বাজে।”

ছেলেটি শ্রেয়ার কথা শুনে মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়েই বললেন “মাত্র দুইঘন্টা ঘুমিয়েছ। তুমি করেই বলছি কারণ বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট। সে যাইহোক তুমি যাও ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসো। পরে আবার কথা বলবোনি।”

শ্রেয়া ও বাধ‍্য মেয়ের মতো বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মাঝপথে ছেলেটি শ্রেয়াকে থামিয়ে দিয়ে তার হাতে টাওয়েল আর একটা সাদা সুতির থ্রিপিজ দিয়ে গেল। শুভ্রতা কোনো কথা না বলে ওয়াশরুমে চলে গেল।

দীর্ঘ শাওয়ার নেওয়ার পর এখন একটু ভালো লাগছে তার । সকাল থেকে এতো ধকল যাওয়ায় খারাপ লাগছিল। কিন্তু এখন শাওয়ার নেওয়ায় ভালো লাগছে। ক্ষুধা লেগেছে খুব। সকাল থেকে কিছু পেটে পরেনি। কিন্তু সে কিভাবে খাবারের কথা বলবো বুঝতে পারলো না। এগুলো ভাবতে ভাবতেই চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতেই সে অনেকটা অবাক হলাম কারণ তার সদ‍্য বিবাহিত বর একদম ওয়াশরুমের দরজার বাহিরে দাড়িয়ে আছে।

ছেলেটা শ্রেয়ার হাত থেকে ভেজা টাওয়েল নিয়ে রুমের সাথে থাকা বারান্দায় যেতে যেত বলল

“টেবিলের উপর প্লেটে বিরিয়ানি রাখা আছে। খেয়ে নেও তাছাড়া পরে আবার অসুস্থ হয়ে পরবে।”

শ্রেয়া আর দেড়ি করলাম না সোফায় বসে পরলো। বিরিয়ানি দেখে ক্ষুধাটা যেন আরো বেড়ে গেল তার। ছেলেটি বারান্দা থেকে রুমে আসতে আসতে বলল

“সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। এখন এতো না ভেবে খেয়ে নেও। আমারও অনেক ক্ষুধা লেগেছে।” বলতে বলতে ছেলেটি শ্রেয়ার পাশে বসে পরল। দুইটা প্লেটের মধ্যে একটা প্লেট শ্রেয়ার হাতে তুলে দিলো আর অন‍্যপ্লেটটা নিজে তুলে নিয়ে খেতে লাগল। শ্রেয়া ও একপলক তার দিকে তাকিয়ে খেতে লাগল। খাওয়া শেষে ছেলেটা প্লেট দুটো নিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেল। শ্রেয় রুমে থাকা একটা জানালার পাশে দাড়ালো। একমনে চোখ রাখলো অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে। চারপাশে তেমন কোনো শব্দ নেই। হয়তো সবাই ঘুমের অতলে ডুবে আছে। আকাশে চাঁদের দেখা নেই। শ্রেয়ার মনে পরতে লাগলো সকালের সব ঘটনা। অজান্তেই কখন যে চোখের কোণা বেয়ে নোনা জল গরিয়ে পরলো বুঝতেই পারেনি সে। কাধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেতেই শ্রেয়া চমকিত হয়ে পিছে ফিরলো। পিছু ফিরতেই ছেলেটির শান্ত চেহারা চোখে পরলো শ্রেয়ার। ছেলেটি আলতো হাতে শ্রেয়ার চোখে পানি মুছে দিলেন। তার স্পর্শে একটা শিহরণ খেলে গেল যেন শ্রেয়ার। ছেলেটা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল

“বাড়ির কথা মনে পরছে। এটা স্বাভাবিক সমস্যা নেই আমি তোমাকে কালকেই নিয়ে যাবো ওই বাসায়।”

ওই বাসার কথা শুনতেই শ্রেয়ার মনের কষ্টটা আরো বেড়ে গেল। সে চোখমুখ শক্ত করে ওই বাসায় সে আর যাবোনা বলে জানিয়ে দিলো।

ছেলেটা তার কপালে খানিকটা ভাঁজ ফেলে শ্রেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল “আচ্ছা শ্রেয়া বলো কি হয়েছিল এমন যে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো!”

ছেলেটির কথা শুনে একটা তপ্ত নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো ভিতর থেকে। গলা পরিষ্কার করে শ্রেয়া বলতে লাগল

“উচ্চমাধ‍্যমিক পরীক্ষার পর ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি আমি। কিন্তু কোনো জায়গায় আমার নাম না আসায় ডিপ্রশনে চলে যাই আমি। তারউপর প্রতিবেশী আত্মীয়দের বিভিন্ন কু কথা সহ‍্য হচ্ছিলো না আমার। নিজেকে ঘরকুনো করে ফেলেছিলাম আমি। বাবাও খোটা দেওয়া শুরু করে দিয়েছিলেন। আজ আমার শেষ সুযোগটাও শেষ হয়ে যায়। আমাদের অবস্থাও এমন ছিল না যে প্রাইভেট ভার্সিটিতে বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিবে। আমার পড়াশোনাই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। ভেবেই আমি সেখানেই কান্না করে ফেলি।”…

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে