#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১০
জাহান আরা
নেহাল আজ গাড়ি নিয়ে এসেছে।গাড়ির সীটে বসে আমি সীট বেল্ট বেঁধে নিলাম।
নেহাল চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে।মৌনতা ভেঙে আমি আগে জিজ্ঞেস করলাম,”তোর সমস্যা কী?”
জবাব না দিয়ে নেহাল চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলো।
আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো,চিৎকার করে বললাম,”মজা নিচ্ছিস তোরা আমার সাথে? আমি বিধবা বলে আমাকে দুর্বল ভাবছিস?
ভাবছিস আমি এখন খুব সস্তা হয়ে গেছি,চাইলেই পেয়ে যাবি?”
আমার এরকম নিষ্ঠুর অভিযোগ শুনে নেহাল হঠাৎ করে গাড়ি ব্রেক কষলো।তারপর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। নেহালের চেহারায় বিস্ময় ভাব ফুটে উঠেছে।
নেহাল কে চুপ করে থাকতে দেখে আমার আরো জেদ চেপে গেলো।চিৎকার করে বললাম,”তোর এরকম ভালোমানুষির উদ্দেশ্য কি আমি ভালো করেই বুঝি নেহাল,আমাকে এতোটাও বোকা ভাবিস না।আমি একটা কলেজের ডিপার্টমেন্ট হেড এতো টা বোকা না যে তোর উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেনা। ”
নেহাল কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।দুচোখ টলমল করছে। আমি না দেখার ভান করে বসে রইলাম।যেতে যেতে বৃষ্টি থেমে গেলো।
বাসায় পৌঁছে দেখি সবাই রেডি।নেহাল কে দেখে বাবা মা ভাইয়া আপুরা সবাই মহাখুশি। অনেক দিন পর নেহাল কে দেখেছে।রিটায়ারমেন্টের পর বাবা অন্য জায়গায় বাসা করে,নেহালের বাবা আরেক জায়গায়।তারমধ্যে নেহাল বিদেশ চলে যাওয়ায় অনেক দিন দেখা হয় নি।
ভাবী নেহাল কে চিনে না যদিও,ভাইয়া বিয়ে করেছে ১ বছর হয়েছে। নেহাল বিদেশ যায় ২ বছর আগে।
সবাই ড্রয়িং রুমে বসে নেহালের সাথে গল্প করছে।আমি উঠে চলে এলাম আমার রুমে।ভাবী এসে আমাকে দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।তারপর বললেন,”আজও তোমার এই সাদা শাড়ি পরতে ইচ্ছে করলো লতা?”
আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম,”আমার জীবনটাই তো এখন সাদা কালো ভাবী,আমার জীবনে এখন কোনো রঙ নেই,রঙের বড় আকাল চলছে।বসন্ত এখন তোমাদের,আমার জীবনে বসন্ত এসেছিলো ৭ দিনের জন্য।তারপর থেকে তো প্রচন্ড খরা ভাবী।তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যায় তবুও তৃষ্ণার জল মেলে না।”
ভাবী বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন,আমি বুঝতে পারলাম না।৫ মিনিটের মধ্যে ভাবী আবারও ফিরে এলেন হাতে একটা লাল রঙের শাড়ি।
আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,”এটা পরে নাও লতা।”
ভাবীর কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক হলাম।কি বলছে ভাবী এটা?
“তুমি কি বলছো ভাবী বুঝতেছো?”
“আমি ঠিকই বুঝতেছি,কিন্তু তুমি কিছু বুঝতেছো না।নিজেকে তুমি কি ভেবেছো?
ভালোবাসার দেবী তুমি?
এরকম ভালোবাসা ভালোবাসা করে কি লাভ হবে?
অভ্র কি ফিরে আসবে?
নাকি ও দেখবে তুমি ওর বিরহে কি রকম জ্বলে পুড়ে যাচ্ছো?”
“ভাবী,তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো?
আমি তো তোমাদের সাথে থাকছি না,তোমরা দেখতেও পাও না আমি বিরহে পুড়ি না-কি সুখে আছি।তবে কেনো এসব বলছো?”
“হ্যাঁ,ঠিকই বলেছো।তুমি আমাদের সাথে থাকো না।কারণ তুমি আমাদের তোমার আপন কেউই ভাবো না।আমরা তো তোমাকে ফেলে দিতে পারি না।প্রতি দিন তোমার জন্য বাবা কান্না করে,মা কান্না করে,তোমার ভাই প্রতি দিন আফসোস করে,বড় আপা মেজো আপা তোমার কথা ভাবলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।আর আমি?
আমি তো তোমার রক্তের কেউ না তাই আমার কথা না জানলেও চলবে।কিন্তু যারা তোমার রক্তের তাদের কথাও তো ভাবো না তুমি।তুমি ভাবো তার কথা যে নাই তোমার কাছে,কখনো ফিরে আসার সম্ভাবনা ও নেই।যার কোনো অস্তিত্ব ও নেই।”
ভাবীর কথাগুলো তীরের মতো আমার কলিজায় লাগছে গিয়ে।ভাবী যদি দেখতো বুকের ভিতর কি পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভাবীর কথার চোটে,তবে বোধহয় একটা কথা ও বলতো না আমাকে এসব নিয়ে।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে ভাবী বললো,”তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম সত্যি জবাব পাই নি,তুমি কি প্রেগন্যান্ট? ”
“কেনো ভাবী,হলে কি সমস্যা?”
ভ্রু কুঁচকে ভাবী আমার দিকে তাকালো।তারপর বললো,”অবুঝের মতো কথা বলো না লতা,কি বলছো তুমি?
যে শিশু দুনিয়ায় আসবে সে কখনো তার বাবাকে চিনবে না,একটা বাচ্চার জন্য এর চাইতে বেশি কষ্টের আর কি হতে পারে?
সারাজীবন কাটবে তার পিতার আদর ছাড়া।তুমি বুঝতে পারো এই অভাববোধ তাকে কি পরিমাণ কষ্ট দিবে।”
ভাবীর কথাগুলো সত্যি কিন্তু তবুও আমার হজম হচ্ছে না।আর আসল কথা আমি প্রেগন্যান্ট নই।আমাকে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে ভাবী আর কিছু না বলে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর সবাই রেডি হয়ে বের হলো।মা সাফ সাফ জানিয়ে দিলো নেহাল ও আমাদের সাথে যাচ্ছে। আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম শুনে।কিন্তু কিছু বললাম না।
নেহালের গাড়িতে বাবা ভাইয়া,দুলাভাই ২ জন বসলো।আমরা ভাইয়ার গাড়িতে।
ভাবীদের বাসায় যেতে ১ ঘন্টার মতো লাগলো। সবার মধ্যে আমাকে কেমন যেনো বেমানান লাগছে।
আমাকে দেখে সবাই কেমন যেনো অতিরিক্ত দরদ দেখাতে লাগলো।এই অতিরিক্ত দরদ আমার সহ্য হচ্ছে না।নেহাল আমার আশেপাশেই থাকছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বসে বসে গল্প করছে,ঘরভর্তি অনেক মেহমান।এক পাশে ৫-৬ জন মহিলা দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারলাম ওরা আমাকে দেখে কি বলছে।আজকে এখানে আসার মূল কারন কি তাও বুঝে গেলাম।
ভাবীর উপর প্রচন্ড রাগ হলো আমার।আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যেতে নিতেই মা এসে আমার হাত ধরে ফেললেন।মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মায়ের দুচোখে নিরব অনুনয় ঝরে পড়ছে।
কিছু না বলে নেহালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।তারপর আস্তে করে বললাম,”আমার এখানে ভালো লাগছে না,আমাকে বের করে নিয়ে যা এখান থেকে।”
নেহাল কোনো প্রশ্ন না করে সোজা মা কে গিয়ে কিছু বললো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা বললো আসার জন্য।আমি ও বের হয়ে এলাম সাথে সাথে।
কি বিশ্রী ষড়যন্ত্র!
আমাকে আবার বিয়ে দেয়ার ভাবনা?
এরা কি কখনো মানুষ হবে না?
যেখানে এখনো আমার স্বামীর হত্যাকারী কে আমি ধরতে পারি নি সেখানে নতুন জীবন শুরু করার কথা আমি ভাবতেই পারি না।
আমাকে গম্ভীর দেখে নেহাল জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে?”
আমি নেহাল কে সত্যি কথাটা বললাম।শুনে নেহালের মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।মুখ ফিরিয়ে নিলো সামনের দিকে।
হঠাৎ আমার মনে পড়লো,নেহাল কি আমাকে পছন্দ করে?
এই পছন্দ কবে থেকে?
না-কি শুধু মাত্র সিমপ্যাথি দেখানোর জন্য নেহাল এসব করছে?
আমি কি নেহাল কে ভুল ভাবছি?
নেহাল তো আগে থেকেই এরকম কেয়ারিং,তবু কেনো হঠাৎ আমার সন্দেহ হয়?
বুঝতে পারছি না।বাহিরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।গাড়ির উইল্ড শিল্ড ব্যস্ত হয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পরিষ্কার করছে।তাকিয়ে দেখতে দেখতে আমি জানালার গ্লাসে হেলান দিলাম।ভাবীর কথাগুলো মাথায় ঘুরছে তখনও।
ভাবতে ভাবতে কখন যেনো ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারলাম,আবারও একটা অসঙ্গতি আমার মাথায় ঘুরছে?
ভাবী কেনো আমার প্রেগন্যান্সি নিয়ে এতোটা চিন্তিত?
আমি প্রেগন্যান্ট কি-না তা জানার জন্য কেনো এতো বার জিজ্ঞেস করছে?
ভাবীর বলা কথাগুলো আবারও ভাবতে লাগলাম।ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুঝতে পারলাম ভাবীর কথাগুলোর মধ্যে একটা খটকা রয়ে গেছে।
পুরো বিষয় টা ভাবতেই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। তবে কি ভাবী কোনোভাবে সন্দেহ করেছে?
ভাবীর এই অনিশ্চয়তার কারণ কি?
বাচ্চার বাবা কে তা নিয়ে ভাবীর মধ্যে এতো প্রশ্ন কেনো?
চলব…..???