কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০৫

0
1280

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৫
জাহান আরা

নেহাল দেশে ফিরেই আমার সাথে দেখা করে।আমি তখন ক্লাস নিচ্ছিলাম।বাসায় না গিয়ে নেহাল প্রথমে আমার সাথে দেখা করতে চলে আসে আমার ডিপার্টমেন্টে।
আরদালি এসে আমাকে বললো,কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।ডিপার্টমেন্টে বসে আছে।
কিছুটা বিরক্ত হলাম কথাটা শুনে।
মনে পড়ে গেলো কয়েকমাস আগের কাহিনী। অভ্রর মৃত্যুর পর বিভিন্ন টিভি,সংবাদপত্রের লোকজন সারাক্ষণ বাসায় আনাগোনা করতো কিভাবে কি ঘটেছে সেই কাহিনী বিশদ আকারে জানতে।
মানসিকভাবে অসুস্থ আমাকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলতেও তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে নি।
একই প্রশ্ন তারা বিভিন্নভাবে করেছে।সবচেয়ে নির্দয় মনে হয়েছে আমার যখন ওরা জানতে চাইতো,যখন অভ্রকে আমার সামনে টুকরো টুকরো করা হয়েছে তখন আমার কেমন লেগেছে?

কি নিষ্ঠুর,নির্দয় প্রশ্ন!
মানুষ পেশার খাতিরে এতোটা মনুষ্যত্ব বিবর্জিত হয় কিভাবে?
কমন সেন্স থেকে ভাবতে গেলেও তো এরকম সেনসিটিভ প্রশ্ন করতে মানুষ ইতস্তত বোধ করে,অথচ তারা নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করে।

তাদের প্রশ্ন শুনে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তাম।
২ জন তো আরো এক কাঠি উপরে ছিলো।তারা এসেছে অভ্রর মৃত্যুর ৪ দিনের মিলাদের দিন।তারা একটা নাটক বানাতে চায়।তাই আমাদের প্রেম থেকে শুরু করে অভ্রর হত্যা পর্যন্ত সব কাহিনী জানতে চায়।
আমার ইচ্ছে করছিলো সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করি,কিভাবে এরা এতো পাষাণ হয়?
অন্যের ক্ষত কে খুঁচিয়ে তুলে কি পৈশাচিক আনন্দ পায় এরা?
নয়তো আমার স্বামী মৃত্যুর ৪ দিন না যেতেই কিভাবে এরকম একটা প্রস্তাব নিয়ে আসে আমার কাছে?
ভাবতে ও অবাক লাগে আমার।

হঠাৎ করে মনে হলো এবারও নিশ্চয় ওরকম কেউ এসেছে।নিশ্চয় আমার কলেজে জয়েন করার খবর শুনে এসেছে আবার।

বিরক্ত হয়ে আমার রুমের দরজায় আসতেই আমি চমকে উঠি।অভ্র বসে আছে!
কালো শার্ট,নীল জিন্স পরে বসে আছে অভ্র।
আমার পায়ের শব্দ পেতেই নেহাল পিছন ফিরে তাকালো।
নেহাল কে দেখে আমার দুচোখ ভরে জল এলো।এক মুহুর্তে সেই জল দুচোখ ঝাপসা করে দিয়ে,চোখে স্থির না হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

কিন্তু মাটিতে পরার আগেই নেহাল দুহাত দিয়ে আমার গাল মুছে দিলো।নেহাল কিছু বুঝে উঠার আগেই আমক ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম আমি নেহালকে পেয়ে।নেহাল আমাকে সান্ত্বনা দিলো না।কান্না করে হালকা হবার সুযোগ দিলো।
৫ মিনিট পরে নেহাল কথা বলে উঠলো।

“শান্ত হ দোস্ত,এভাবে ভেঙে পড়িস না।চোখের পানি তো তাদের অস্ত্র,যাদের কিছু করার নেই।আমাদের তো অনেক কিছু করার আছে।আমরা কেনো কাঁদবো।
আমরা ওদের ঠিক খুঁজে বের করবো।”

নেহালের কথা শুনে বুকে বল এলো আমার।নেহাল কে ছেড়ে দিয়ে আমার ডেস্কে গিয়ে বসলাম।নেহাল আগের জায়গায় বসলো।

তারপর সোজা কাজের কথায় চলে গেলো।

“তুই এখন পর্যন্ত কোনো ক্লু পেয়েছিস?”

এক মুহুর্ত ভাবনা চিন্তা করে আমি জবাব দিলাম,”ক্লু কিনা জানি না।তবু আমার মনে হচ্ছে ওটা একটা ক্লু হতে পারে।”

আগ্রহী হয়ে উঠে নেহাল আমার কথা শুনে।উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে,”কোন ক্লু?”

“অভ্র হত্যার আগ মুহুর্তে যখন আমার সাথে রুমে ছিলো,তখন ওর একটা কল এসেছে,জানিস তো,তোকে বলেছিলাম আমি।”

এক মুহুর্ত ও না ভেবে নেহাল জবাব দিলো,”হ্যাঁ,ওই যে ওপাশ থেকে একটা লোক বলে উঠেছিলো,সে অভ্র ভাইয়ে পুরোনো পেশেন্ট,নেটওয়ার্ক প্রব্লেমের জন্য কথা বুঝা যাচ্ছে না,অভ্র ভাই যাতে বাহিরে বের হয়ে কথা বলে।তার পরপরই অভ্র ভাই মেইন ডোর খুলে বাগানে বের হয়ে যায়?”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।”হ্যাঁ,ঠিকই বলেছিস তুই।এবার তুই ঠাণ্ডা মাথায় ভাব,যেখানে রুমে ফোর জি এভেইলএভেল,সেখানে ওপাশ থেকে এরকম কথা বলার মানে কি হতে পারে?
নিশ্চয় এটা একটা ট্রিকস ছিলো অভ্রকে ঘর থেকে বের করার।যাতে করে ওদের মধ্য থেকে কেউ ঘরে ঢুকে লুকিয়ে থাকতে পারে।আর আমিও অভ্র বের হওয়ার একটু সময় পরেই বাহিরের রুমে কারো শব্দ পাই।কিন্তু রাইফার বিড়াল ভেবে পাত্তা দিই নি।
এবার দুইয়ে দুইয়ে মিলিয়ে দেখ চার হয়ে যাবে।”

নেহালের মুখ একশো ওয়াটের বাল্বের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে,লাফিয়ে উঠে নেহাল বলে,”দ্যাটস গ্রেট লতা,এবার আমাদের কাজ আরো সহজ হয়ে গেছে।
ওই ফোনটার লোকেশন বের করলেই খুব সহজেই আমরা খুনীদের খুঁজে বের করতে পারবো।”

আমি জবাব দিলাম না।

নিজের দুই ঠোঁটে তর্জনী আঙুল দিয়ে আলতো আঘাত করতে করতে নেহাল আবার আমাকে বললো,”ক্লাস শেষ করে ছুটি নে,আমি তোকে নিয়ে মামার সাথে দেখা করতে যাবো।”

নেহালের কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম।নেহাল অভিমানির মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

নেহাল এখনো আগের মতোই পাগলা রয়ে গেছে ভেবে আমার হাসি পেতে লাগলো।সেই অনেক বছর আগেও যখন আমরা স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি তে পড়তাম,নেহালকে আমি যখন যা বলতাম নেহাল তখনই তা করতে একপায়ে খাঁড়া থাকতো।
ঠিক তেমনি এখনো র‍য়ে গেছে ও।

হাসি থামিয়ে আমি বললাম,”তুই তো মনে হয় এখনো বাসায় ও যাস নি,আগে বাসায় যা,আঙ্কেল আন্টির সাথে মিট কর,এটা নিয়ে কাল ও যাওয়া যাবে।”

কিন্তু নেহাল গোঁ ধরে বসে রইলো।গজগজ করতে করতে বললো,”বাসায় যাওয়ার জন্য অনেক সময় আছে,কিন্তু আগে আমরা মামার সাথে গিয়ে কেসটা নিয়ে কথা বলবো।”

সেই আগের মতো জেদ ধরে রইলো নেহাল।অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠালাম,তবে কথা দিতে হলো আমাকে,২টায় কলেজ ছুটির পর ও এসে আমার জন্য অপেক্ষা করবে কলেজের বাহিরে,তারপর ওর সাথে যেতে হবে,যত দ্রুত সম্ভব ও বাসায় এক নজর দেখা দিয়েই চলে আসবে।

নেহাল বের হয়ে যেতে আমি ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক।এই ছেলেটা কখনোই যেনো বড় হবে না।আজীবন ওকে আমি এরকম জেদি দেখে এসেছি।এখনো তাই আছে।

চলবে……???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে