কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-১৪

0
1331

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব: ১৪
লিখা:জাহান আরা

নেহাল কে সাথে নিয়ে যখন হাসপাতালে পৌঁছাই,তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভিতরে ভিতরে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে আছি।কেনো এরকম হলো?
কেনো অপরাধী ভাবী-ই হলো!
কি ক্ষতি করেছি আমি তার?
যেই ভাবী সবসময় আমাকে বোনের মতো দেখেছে সেই ভাবী কিভাবে এরকম করলো?
কাকে জিজ্ঞেস করবো আমি?
মনে মনে বারবার চাইছি যেনো সব মিথ্যা হয়ে যায়,ভাবীকে যেনো না দেখি ওখানে গিয়ে।

রিসিপশনে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো 36 নাম্বার কেবিন কোন দিকে।
রিসিপশন থেকে দেখিয়ে দিতেই আমি আর নেহাল এগিয়ে গেলাম সেদিকে।কেবিনের সামনে 36 লিখা দেখেই আমার গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলো। ভীষণ তৃষ্ণা পাচ্ছে আমার।
নেহাল আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো।একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ভিতরে ঢুকলাম।

ভাবী বসে আছে বেডের উপর।ভাবীকে দেখে আমার বুকের ভিতর মুচড়ে উঠলো। কেমন শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে ভাবী।ভাবীর কোলে একটা মস্ত এলবাম।
আমাদের দেখে ভাবী এগিয়ে এলো সামনের দিকে।
আলতো হেসে বসতে বললো। আমি আর নেহাল ২টা চেয়ারে বসলাম।
ভাবীর চেহারায় কিছুটা উদভ্রান্তের ছাপ।এলবাম টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ভাবী বললো,”দেখো এটা।”
হাত বাড়িয়ে নেহাল এলবামটা নিলো।তারপর খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।প্রথম ছবিটা দেখেই আমার চোখ আটকে গেলো।
অপূর্ব সুন্দর এক যুবতী তাকিয়ে আছে উদাস ভঙ্গিতে। চোখে মুখে রাজ্যের বিষণ্ণতা।
যেনো বন্দিনী কোনো রাজকন্যা,যাকে রাক্ষসেরা বন্দী করে রেখছে।একঝাঁক কোঁকড়া চুল কাঁধ বেয়ে এসেছে নিচের দিকে।

সাদা একটা ড্রেস পরনে মেয়েটার,যে কেউ এই মেয়ের প্রেমে পড়তে বাধ্য।
ভাবীর সাথে চেহারার কিছুটা মিল থাকলেও মেয়েটা ভাবীর চাইতে ২-৩ শেড ফর্সা।
আমার হঠাৎ করেই যেনো একটু হিংসা হতে লাগলো। নারী চরিত্রের চিরায়ত স্বভাব যেটা।
পুরো এলবামে মেয়েটার বিভিন্ন ছবি,প্রতিটি ছবি বুকে কাঁপন ধরায়।বারবার মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি কতো সুন্দর!

ভাবী বলে উঠলো,”আমার ছোট বোন,রিপা হক।”

রহস্যের একটা ঝট খুললো তাহলে এবার।আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কেনো ভাবী,কেনো দুইজন মানুষ কে খুন করেছো তুমি?”

ভাবী মুচকি হাসলো,তারপর বললো,”বিয়ের কয়েকমাস আগে থেকে রিপার পেটের ডানদিকে ব্যথা হতো।তখন আমরা কেউ বিশেষ আমলে নিই নি।গ্যাস্ট্রিক থেকে এরকম হয়েছে ভেবে ওকে আর ডাক্তার দেখানো হয় নি।
রিপার বিয়ের ৭ দিনের মাথায় প্রচন্ড পেট ব্যথা হয়।ব্যথা এতো অসহনীয় মাত্রায় চলে যায় যে রিপাকে ইমিডিয়েট হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।আবিদ হাসান ছিলো ডাক্তার রিপার।

চোকরা ডাক্তার রিপাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে যায়,সরাসরি রিপার স্বামী কে জিজ্ঞেস করে,পেশেন্ট আপনার কে হয়,ওনার কি বিয়ে হয়েছে।
রিপার স্বামী জবাব দিতেই ডাক্তারের মুখ কালো হয়ে গেলো, যেনো আশাহত হয়েছে।
পরীক্ষা করে জানা গেলো রিপার এটা এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা,যেকোনো সময় এপেন্ডিক্স ফেটে যেতে পারে।

অপারেশন করার জন্য রিপার স্বামী রাহাত তাৎক্ষণিক অনুমতি দিয়ে দেয়।
৭ বছর ধরে ভালোবাসার পর ওদের বিয়ে হয়েছে,রিপা যেনো রাহাতের প্রাণ ভোমরা। ওদের ভালোবাসা দেখেই আমার বিয়ের আগে বাবা মা’কে বুঝিয়ে আমি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলি।

অভ্র ছিলো হাসপাতালের সার্জন।অপারেশন থিয়েটারে অভ্র রিপাকে দেখে চমকে উঠে আবিদের মতো। রিপার সৌন্দর্য রিপার কাল হয়ে উঠে। ভাবতে পারো,অপারেশন থিয়েটারেই ওরা দুজন মিলে রিপাকে ধর্ষণ করে। এবং সেই সময়ের ভিডিও করে রাখে যাতে রিপা কাউকে কিছু না বলে।
অপারেশন করে বাসায় নেয়ার পর রিপা আমাকে জানায় বিষয়টা।সেদিন রাতেই রিপা ছাদ থেকে লাফ দেয়।মারা যায় রিপা ৫ তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কাজল,যেই মানুষকে তুমি হৃদয়ে দেবতার আসনে বসিয়েছিলে সেই মানুষটা তার যোগ্য ছিলো না।সে কোনো দেবতা ছিলো না বরং অমানুষ ছিলো।তোমার বিয়ের আগে আমি জানতাম না এই সেই ডাক্তার। যদি জানতাম কিছুতেই সাপোর্ট পেতে না তুমি আমার।
সব ঠিক হওয়ার পর ওরা যেদিন তোমাকে দেখতে আসে সেদিনই আমি অভ্রকে দেখি।তখন আর কিছুই করার ছিলো না আমার।
তবে তোমার সাথে ওরকম করার প্ল্যান আমার ছিলো না,তুমি কেনো আবিদের বউয়ের সাথে ও না।কিন্তু আমার ভাই আর রিপার জামাই জেদের বশে ওটা করে তোমাদের স্বামীর সামনে,যাতে বুঝতে পারে কতটা কষ্টের হতে পারে এটা কোনো মেয়ের জন্য।
ওরা অভ্রকে খুন করার পর বাসায় গিয়ে আমাকে বলে প্ল্যানের বাহিরে ওরা এরকম করেছে।আমার দুই ভাই আর রিপার স্বামী আর দেবর মিলে আমরা এসব করেছি।এ দেশে এসবের বিচার নেই,তাই আমরা নিজের হাতে ওদের শাস্তি দিয়েছি।জানি পাপ করেছি,তবুও মনে খুব শান্তি এখন।পৃথিবী থেকে দুইজন অমানুষ তো কমাতে পেরেছি।
আমার আর কোনো পিছুটান নেই,কিছু বলার ও নেই।যা করেছি বোন হত্যার প্রতিশোধ নিতে করেছি।যা শাস্তি দিবে মেনে নিতে রাজি আছি।”

আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না।মাথা ঝিমঝিম করছে আমার।কখন যেনো জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম নেহালের গায়ে।

জ্ঞান ফিরতেই দেখি নেহালের কোলে মাথা রেখে আমি শুয়ে আছি।নেহাল অঝোরে কাঁদছে।ভাবী বসে আছে অন্য পাশে।
আমার ভিতরে সব ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে লাগলো।
কেনো এরকম হলো আমি বুঝতে পারছি না।অভ্রকে আমি এতো বিশ্বাস করতাম সেই অভ্র কি-না!
অপাত্রে ভালোবাসা দান করেছি আমি।
ভাবী যা করেছে ভালো করেছে।ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু শুধুমাত্র।
ভাবীর প্রতি আমার তাই কোনো অভিযোগ নেই।আমি উঠে গিয়ে ভাবীর হাত ধরে বললাম,”তোমার প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই ভাবী,যা করেছো তুমি উচিৎ কাজ করেছো।ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু ভাবী।আমার নিজের উপর রাগ হচ্ছে ভাবী এতোদিন ধরে এরকম একজনকে ভালোবেসেছি বলে।তুমি বাসায় চলে যাও।”

আমার কপালে আলতো চুমু খেয়ে ভাবী উঠে গেলো।যাওয়ার সময় বললো,”সব মানুষ খারাপ হয়
না কাজল,তবে আমরা খুঁজে নিতে পারি না,চোখের সামনে সাত রাজার ধন থাকলেও আমরা তা সঠিক সময়ে চিনি না।কেননা অমানুষেরা দেখতেও মানুষের মতো।আমাদের জীবনটাই এরকম সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের সাথে দেখা হয় না,ভুল মানুষের সাথে দেখা হয়।আর যখন ভুল বুঝতে পেরে সঠিক মানুষ খুঁজে পাই তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।সঠিক মানুষকে আর বিশ্বাস করতে পারি না আমরা তখন। ”

ভাবী চলে গেলো।আমি জানি কথাগুলো ভাবী নেহালকে উদ্দেশ্য করে বলেছে।নেহাল কিছু বললো না,আমিও কিছু বললাম না।
কিছুক্ষণ পর আমি উঠে দাঁড়ালাম।নেহাল ও উঠে দাঁড়ালো আমাকে উঠতে দেখে।বাসায় ফিরে দেখি আব্বা আম্মা পুরো বাসা সাজিয়ে রেখেছে। আমার বাবা মা ও আছে।
ঘটনা কী সেটা বুঝতে পারলাম কাজী আসার পর।আমার মা বাবা,শ্বশুর শাশুড়ী সবাই যখন এসে আমাকে ধরলো এভাবে আর থাকা যাবে না আমার।বিয়ে করতেই হবে,আর আজকেই সেটা হবে নেহালের সাথে।নেহাল এখানেই থাকবে বিয়ের পর।

ভাবী এলো ফুল নিয়ে,তখনই বুঝতে পারলাম প্ল্যান আসলে ভাবীর।

নেহালের দিকে তাকালাম,বেচারা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।ঠিক যেভাবে অনেক বছর ধরে তাকাতো।
এই চোখের ভাষা আমি আজ পড়তে পারছি।আমি আর অমত করি নি।
একজন ধর্ষককে ভালোবেসেছি ভাবতেই লজ্জা লাগে,সেখানে সেই ধর্ষকের আশায় বাকি জীবন একা থাকার শপথ নেয়া সবচেয়ে বড় বোকামী।

বিয়ে হয়ে গেছে,আমি আর নেহাল আবারও যাচ্ছি সেই নদীর পাড়ে।
নেহালের চোখেমুখে আনন্দ উপচে পড়ছে যেনো।আনন্দে কথা বলতে পারছে না নেহাল।
ঠিক সেদিনের মতো যেদিন ওর জন্য বাইক এনেছিলো আংকেল ।

ভালো থাকুক সব ভালোবাসা,ভালোবাসা হোক সঠিক মানুষের সাথে।
অমানুষকে ভালোবেসে ভালোবাসার অপমান যাতে না করে কেউ নিজের অজান্তে।
সব সত্যি ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।
পৃথিবী ভালোবাসাময় হোক।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে