#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:১২
লিখা:জাহান আরা
ফাইলটি তালাবন্ধ করা দেখে আরেকটু সন্দেহ হলো।কী এমন আছে এই ফাইলে যে অভ্র তালা নেরে রেখেছে।তাও আবার যেখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই?
অনেক খুঁজে ও চাবি পেলাম না কোথাও।ভিতরে একটা রোখ চেপে গেলো আমার। এটা খুলে দেখতেই হবে।
ড্রেসিং টেবিল থেকে চুলের কাঁটা এনে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করতেই ক্লিক করে মৃদু একটা শব্দ পেলাম।তাকিয়ে দেখি তালা খুলে গেছে।
চুলের কাঁটা দিয়ে তালা খোলার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম।
ভিতরে একটা প্রেসক্রিপশন লিখা।কোনো এক রোগীর নাম,ঠিকানা দেওয়া।অন্য এক কোণে লিখা ডাক্তার আবিদ হাসান।
একজন মহিলা রোগীর নাম,ঠিকানা এরকম ফাইলে রাখার কি কারণ হতে পারে অভ্রর?
এই রোগী কে?
বিশেষ কেউ?
যার জন্য এভাবে তার বিষয়টা আলাদাভাবে মাথায় রাখার জন্য অভ্র এরকম ফাইল করে রেখেছে?
তারপর আবার মনে হলো,এককোনায় যখন ডাক্তার আবিদ হাসানের নাম লিখা আছে তবে হতে পারে আবিদ হাসানের চেনা কেউ,অথবা আত্মীয়।কিংবা হতে পারে তার স্ত্রী হয়তো।
ভালো করে দেখে নিলাম নামটা আবার;”রিপা হক”
রিপা হকের নামটা বারকয়েক আওড়াবার পর মনে পড়লো ভাবীর নাম রূপা হক।মুহূর্তে আমি চমকে উঠলাম এই সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়ায়।নিজে নিজে আমি যেই হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি,তা কি সত্যি হয়ে যাবে?
তবে কি ভাবী ই আসল কালপ্রিট?
হাসপাতালে ফোন করে ডাক্তার আবিদ হাসান কে চাইতেই রিসিপশন থেকে জানালো আবিদ হাসান মারা গেছেন আজ থেকে ৮ মাস আগে।
খবর টা শুনে আমার ভ্রু কুঁচকে গেলো।ফোন কেটে দিলাম আমি।
ডাক্তার আবিদ হাসান ও মারা গেছেন?
বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার।আকাশে ঘন ঘন বজ্রপাত। বজ্রপাতের শব্দ আমার সহ্য হয় না।বুক কেঁপে ওঠে কেনো জানি শুনলেই।
কিন্তু আজকে কোনোরকম অনুভূতি হচ্ছে না। আজ কেনো জানি ভয় পাচ্ছি না।রুমের ভিতর পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলাম কোথাও একটা অসামঞ্জস্য আছে।
তারপর আবার হাসপাতালে ফোন দিলাম,ডাক্তার আবিদ হাসানের বাসার এড্রেস চাইলাম।৫ মিনিটের
মধ্যে এড্রেস পেয়ে গেলাম।
আমার কেনো জানি দেরি সহ্য হচ্ছে না।নেহাল কে কল দিলাম এক্ষুনি আসার জন্য।
কল দিতেই নেহাল সাথে সাথে রিসিভ করলো।যেনো ফোন হাতে নিয়ে আমার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছে সে।
“তুই কোথায়?এক্ষুনি আসতে পারবি?”
ওপাশ থেকে নেহাল জবাব দিলো,”আমি তোর বসার সামনে,বসে আছি গাড়িতে।”
“আমাকে নিয়ে এক জায়গায় যেতে হবে তোকে,এখনই।”
“এখন রাত কয়টা তোর হয়তো সেই খবর নেই,এখন ১১টা বাজে।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হলাম।কখন ১১টা বেজে গেছে আমি বুঝতেই পারি নি।এখন বের হওয়া মোটেও উচিৎ হবে না।
পরক্ষণেই মনে হলো,নেহাল এখনো এখানে কেনো?
নেহাল কে জিজ্ঞেস করতেই নেহাল মুচকি হেসে জবাব দিলো,”দেশে ফেরার পর থেকে আমি এখানেই থাকি রাতে,তোকে পাহারা দিই। ”
আমি ফোন কেটে দিলাম।আমি চাই না আমার মন এই মুহূর্তে অন্যকিছু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করুক অভ্র হত্যার সূত্র ছাড়া।
সকালে উঠতে হবে ভেবে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম কি আর ছেলের হাতের মোয়া?
চাইলেই তো পাওয়া যায় না।বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ২টা বেজে গেলো। তারপর কখন যেনো ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো সকাল ৮টায়।আজ আর বৃষ্টি হচ্ছে না।কি জানি কখন আবার শুরু হয় বৃষ্টি!
বৈশাখ আসতেই এখন জোর বৃষ্টি শুরু হয়,বর্ষা লাগে না।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম।কলেজে ক্লাস আছে সাড়ে দশটায়।
ড্রয়িংরুমে দেখি আব্বা আম্মা চুপ করে বসে আছে।ওনাদের কি মন খারাপ?
আমার বুক কেঁপে উঠলো। ওনারা এভাবে বসে আছে কেনো!
আব্বা কে সেই কথা জিজ্ঞেস করতেই আব্বা বললো,”কাল নেহাল ছেলেটা এলো,আমার তোমার শাশুড়ীর খুব ভালো লেগেছিলো। কিন্তু আজকে ছেলেটা আসে নি।ভেবেছিলাম ঘুম থেকে উঠবো কলিং বেলের শব্দ শুনে,অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছি।কিন্তু ও আসছে না আজ।”
আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। আমার কাছে সান্ত্বনা দেবার মতো কিছু নেই।পুত্রশোকে কাতর এক দম্পতি অন্য কারো মাঝে তাদের ছেলের ছায়া খুঁজে পেয়েছে। তাদের নিরাশ করার সাহস আমার নেই।আমি এতোটা নিষ্ঠুর নই।
কোনো জবাব না দিয়ে কিচেনে চলে গেলাম।দ্রুত রুটি বানাতে লেগে গেলাম চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে।
রুটি,ডিম ভাজি,চা টেবিলে নিয়ে আব্বা আম্মাকে নিয়ে খেতে বসলাম। কিন্তু দুজনে মনমরা হয়ে বসে আছে। খাচ্ছে না কেউ।আমি কি করবো?
নেহাল কে কি বলবো বাসায় আসতে?
মাথায় কিছু ঢুকছে না আমার।
দ্রুত কয়েক চুমুকে চা খেয়ে উঠে গেলাম। ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে।
ক্লাস শেষে বাসায় এসে দেখি আব্বা আম্মার মুখ হাসিখুশি। জিজ্ঞেস না করেই বুঝতে পারলাম নেহাল এসেছে,কিচেন থেকে শব্দ আসছে।আব্বা কে দেখলাম বিপুল উৎসাহে ফ্রিজ খুলে কি যেনো নিয়ে যাচ্ছে কিচেনের দিকে।
আম্মা আমাকে বললো,”তুই চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নে,বাবু সব রান্না করছে। আজ আর তোর রাঁধতে হবে না।তুই ফ্রেশ হতে হতে সব রেডি করে ফেলবে বাবু।”
বাবু?
বাবু কে?
আম্মা’কে জিজ্ঞেস করতেই উনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,”,আরে তুই এটাও জানিস না,নেহালের কথা বলছি।”
আর কিছু না বলে রুমে চলে গেলাম।অভ্র স্নার ছোট ছিলো বলে আব্বা আম্মা ওকে বাবু বলে ডাকতো। অথচ আজ নেহাল কে বাবু বলে ডাকছে।সন্তান বাবা মায়ের কাছে কি আদরের আবার বুঝতে পারলাম।
আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো হঠাৎ করে। কতোদিন মায়ের কোলে মাথা রাখি না।
আমার মা ও তো আমার জন্য এরকম কষ্ট পাচ্ছে।
আমি তো বেঁচে থেকে ও মৃতর মতো আছি।আমার বাবা মা কিভাবে সেটা সহ্য করছে?
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি খাবার রেডি। সবাই মিলে খেতে বসলাম।খাওয়া শেষ করে আমি নেহালকে বললাম আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।নেহাল তাৎক্ষণিক উঠে দাঁড়ালো। আব্বা আম্মাকে বলে বের হতে যাবো, তখনই আম্মা নেহাল কে ডেকে বললেন,”সাবধানে গাড়ি চালাস বাবু,বাহিরে বেশীক্ষণ থাকিস না,বাসায় ফিরে আসিস শীঘ্রই।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে নেহাল জবাব দিলো,”আচ্ছা মা।চিন্তা করো না।”
নেহালের এরকম ব্যবহারে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম।ও মা বলছে কেনো আম্মাকে?
ও কি ওনাদের এই ভালোবাসা কে দুর্বলতা ভাবছে?
ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”তুই আম্মা কে মা বলে ডাকলি কেনো নিজের মা থাকতে?
ওনাদের পুত্রস্নেহের সুযোগ নিচ্ছিস না-কি? ”
আমার প্রশ্নের জবাবে নেহাল আমার দিকে ১০ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো।তারপর বিড়বিড় করে বললো,”তুই জানিস না লতা,মা মারা গেছে ১ বছর আগে।”
আমার মাথায় বজ্রপাত হলেও আমি এতটা অবাক হতাম না নেহালের কথা শুনে যতো অবাক হলাম।কাকী মারা গেছেন?
তাও ১ বছর হয়েছে?
অথচ আমরা কেউ জানি ই না।
আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে নেহাল কেঁদে উঠে বললো,”মা মারা যাবার পর আমি আসতে পারি নি দেশে,আমার একটা এক্সাম ছিলো। তারপর যখন সিদ্ধান্ত নিই দেশে ফিরার,শুনতে পাই বাবা আবার বিয়ে করেছে।
কিছুটা অভিমান হয় বাবার উপর। মা মারা যাবার ১মাস না পেরুতেই বাবা বিয়ে করলো সেটা বড় কথা না,বাবা আমাকে অথবা ভাইয়া আপাদের কে ও জানালো না।লোকে বলে মা মারা গেলে বাবা হয় তালুই,আসলেই ঠিক বলে।
দেশে আসার পর বাবাকে আর আগের মতো পাই না।কেমন যেনো দূরত্ব বজায় রেখে চলেন উনি।আমাদের সাথে খেতে বসেন না,কথাও খুব একটা বলেন না।নতুন মা ও কথা বলেন না।
আমি আসার ৫ দিন পর বাবা ডাইনিং টেবিলে এসে ঘোষণা দিলেন উনি আর এই বাড়িতে থাকবেন না,নতুন মা কে নিয়ে আলাদা থাকবেন,নতুন বাসা নিয়েছেন,আজকেই সেখানে শিফট করবেন।
আমার,ভাইয়া,ভাবীর কিছুই বলার ছিলো না।বাবা চলে গেলেন।
ভাইয়া ব্যস্ত ভাবী,বাচ্চাদের নিয়ে,আপারা ব্যস্ত যার যার সংসারে,মায়ের মৃত্যুর পর ওরা আর আসে না।সবাই খুব ব্যস্ত লতা,আমি ছাড়া।
আমার দিন কাটে না,আমার খবর নেয়ার ও কেউ নেই।প্রতি রাতে আমি গাড়িতে থাকি তোর বাসার সামনে,ফজরের আজান হলে চলে যাই বাসায়।কেউ আর আমার জন্য অপেক্ষা করে না লতা।কেউ জিজ্ঞেস ও করে না কই ছিলাম এতো রাত অবদি,অথবা খেয়েছি কি-না। আমার কেউ রইলো না।শাসন করার জন্য অথবা ভালোবাসার জন্য।
এতো বড় পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে একা।ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি বেহায়া,কাঙাল হয়ে গেছি।তোর বাসায় আসার পর মনে হয়েছে আমি আমার বাবা মা পেয়েছি। বিশ্বাস কর,আমি কারো সুযোগ নিচ্ছি না।আমি ওনাদের খুশি করতেও কিছু করছি না,আমি তো আমার জন্য করছি।এই যে মা আছে,বাবা আছে,ওনারা আমার জন্য ভাবে,আমার জন্য অপেক্ষা করে,আমার মনে হয় আমার আর অপ্রাপ্তি কিছু নেই।সব আছে আমার এখন।”
আমার কান্না আর বাঁধা মানলো না।নেহালের এসব কথা শুনে কেঁদে উঠলাম।আমাকে শান্ত হওয়ার সময় দিয়ে নেহাল বললো,”আমরা এসে গেছি লতা।”
চোখ মুছে গাড়ি থেকে নামলাম।আবিদ হাসানের মৃত্যুর কারণ আমাকে জানতে হবে।
চলবে……???