কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১১.
বেপরোয়া সময়ের সঙ্গে আজ পর্যন্ত কেউ পেরে উঠেছে বলে শোনা যায়নি। সব রকম পরিস্থিতিকে পেছনে ফেলে সে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। পেছন ফিরে তাকানোর সময়টুকুও তার নেই। দেখতে-দেখতে রৌদ্রুপের বাড়িতে নৈঋতার এক মাস কে’টে গেছে। অথচ আজও এই পরিবারের সকলের ভালোবাসা সে পেয়ে উঠতে পারেনি। তার এই একমাস কে’টেছে শুধু সংসারের কাজের মাঝেই। সে কাজ ধরার পর থেকে শাহানা খানম বা নিদ্রা নানা অজুহাতে তেমন কোনো কাজে হাত দেয় না। আর শশী তো কোনো কাজের দিকে ফিরেও তাকায় না। কাজের প্রতি অলসতা তার আগে থেকেই। সহজ ভাষায় অকর্মাও বলা চলে। তাই নৈঋতাকে একাই সব কাজ সামলাতে হয়। রৌদ্রুপ এখনো কোনো ভালো চাকরি পায়নি। আত্মনির্ভরশীল ছেলেটা আজ বাবা-ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল; তবু সে প্রতিটাদিন খুঁজে চলেছে ভালো একটা চাকরি। নিজের চাকরির খোঁজ করতে নেমে সে নসিবের জন্যও কাজ গোছাতে পারেনি। এজন্য অবশ্য সে দুঃখও প্রকাশ করে; তবে সে থেমে থাকে না। হতাশ হওয়া বা হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র সে নয়। তার বিশ্বাস সে খুব দ্রুত নিজের জন্য এবং নসিবের জন্য কাজ ঠিক করতে পারবে। অপরদিকে নৈঋতা তার দায়িত্ব। সারাদিন মেয়েটার খাটাখাটনি সে স্বচক্ষে দেখেও কিছু বলতে বা করতে পারে না। মেয়েটার জন্য বুকের বাঁ পাশটা ব্যথায় টনটন করে উঠলেও চুপ থাকতে হয়। মুখ খুললেই তো মায়ের কটু কথা শুনতে হবে। ফলস্বরূপ হয়তো নৈঋতাকে আবার সেই গ্রামের অভাবের সংসারে রেখে আসতে হবে। একে অপরের দূরত্ব বাড়বে, যা সে বা নৈঋতা কেউই চায় না। মাঝে-মাঝে তার বড়ো ভাই তিহান নৈঋতার পক্ষ টেনে কিছু বলতে গেলে তাকেও শাহানা খানম ধমকিয়ে থামিয়ে রাখেন। এতকিছুর পরও নৈঋতা যখন তার বাবা-মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে, তখন সে হস্যোজ্জ্বল মুখে বলে সে খুব ভালো আছে। পাশে বসে রৌদ্রুপ এ কথা শুনে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার মুখপানে। বরাবরের মতো আজও নৈঋতা এটাই করল। রৌদ্রুপ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। নৈঋতা ফোন রাখতেই তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অ’পরাধীর মতো মুখ করে বলল,
“আমি দুঃখিত, নৈঋ। যেচে তোমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেও, আমি তোমাকে ভালো রাখতে পারছি না।”
নৈঋতা মুচকি হেসে বলল,
“আপনারে কে কইল আমি ভালা নাই? ভালা না থাকলে অহন হাসতাছি ক্যামনে? আপনের মনে হয় আমি মিছামিছি হাসতাছি?”
“না, আমি জানি তোমার হাসি মিথ্যে নয়। আর এটাও জানি যে, আমি তোমার কাছে আছি বলেই তুমি হাসছো। কিন্তু সারাটা দিন তোমার এত খাটাখাটনি দেখতে আমার ভালো লাগে না। নিজের পরিবারকে কিছু বলতেও পারছি না। বললেই হয়তো তোমাকে হারাব। আমার চাকরিটা থাকলে আমি এসব সহ্য করতাম না, নৈঋ। তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে হলেও আমার কাছে রাখতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। নিজেই তো বাপ-ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি।”
রৌদ্রুপের কন্ঠে বিষাদের সুর নৈঋতার মন খারাপ করে। হাতের বাঁধন শক্ত করে বলল,
“এমন কইরা কইতাছেন ক্যান? চাকরিডা তো আর আপনে নিজের ইচ্ছায় ছাড়েননায়। আল্লাহ্ চাইলে খুব তাড়াতাড়ি আপনে আবার চাকরি পাইয়া যাইবেন। আর আমার লাইগা এত দুঃখ কইরেন না তো। আমি ভালা আছি। কাম তো আমি নিজের বাইতও করছি। আমার কাছে এইসব অত কঠিন না। এই যে আমি নিজের হাতে রাইন্ধা-বাইড়া আপনেরে খাওয়াই, আপনে বাহির থিকা ক্লান্ত হইয়া আইলে ঠান্ডা শরবত বানাইয়া খাওয়াই, আপনের থিকা কতকিছু শিখি, আবার রাইতবেলায় আপনের হাতে হাত রাইখা কত কথা কই; এইসব আমার কত বড়ো পাওয়া, জানেন? এতকিছুর পরও আমি খারাপ থাকতে পারি? আপনে থাকতে আমি খারাপ থাকমু না কোনোদিন, তা আমি জানি।”
রৌদ্রুপের ঠোঁটের কোণে এবার স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। নৈঋতার মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলল,
“এই পুঁচকে মেয়ে, এত ধৈর্য কোথায় পাও তুমি?”
“গরীবের ঘরে বড়ো হইছি, ধৈর্য তো থাকতেই হয়। আর অহন আপনের থিকাও তো শিখছি, কোনো পরিস্থিতিতে হতাশ হওয়া চলব না।”
রৌদ্রুপ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“নসিব বেচারা কাজের জন্য কত আশায় বসে আছে। আমি চাকরিটা পেয়ে গেলেই ওর ব্যবস্থা করে ফেলব। কলেজে ভর্তির কার্যক্রম শুরু হতে বেশি দেরী নেই। তোমার ভর্তির আগেই যেন চাকরিটা পেয়ে যাই, সেই আশায় আছি। বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।”
শেষের কথাটা বলতে-বলতে রৌদ্রুপ নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে কয়েকটা চকোলেট বের করে নৈঋতার দিকে বাড়িয়ে ধরল। চকোলেটগুলো দেখে নৈঋতা প্রশস্ত হাসল। রৌদ্রুপের হাত থেকে চকোলেটগুলো নিয়ে বলল,
“টেকা খরচ কইরা প্রতিদিন এইসব আনেন ক্যান? না কইলেও হুনেন না আপনে।”
রৌদ্রুপ হেসে বলল,
“আমার মেঘবতী তো এই সামান্য চকোলেট পেলেই কত খুশি হয়। তার এটুকু খুশির কারণ হওয়ার লোভ সামলাই কী করে?”
নৈঋতা মন খারাপ করে বলল,
“টেকা খরচ হয় আপনের।”
“তাতে কী?”
নৈঋতা একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে নিয়ে প্রশ্ন করল,
“তুলিরে দিছেন?”
“ওরটা তো আলাদাই থাকে। দিয়ে দিয়েছি।”
ক্ষণকাল নীরব থেকে নৈঋতা হঠাৎ অম্লান মুখে বলল,
“প্রত্যেকদিন এমন রাইত-বিরাইতে যে আমরা এত গল্প করি, কেউ জানলে পরে কী হইব?”
“তোমাকে বউ করে নিব,” দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল রৌদ্রুপ।
“মজা কইরেন না। আমার ডর লাগে।”
“ইশ্! একমাস কে’টে গেল, এখন মহারানির ভয় লাগছে। শোনো মেয়ে, এখন যেমন দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে আমার পাশে বসে আছো, এভাবে শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবে। আমি তোমার হাতটা মুঠোবন্দী রেখে সব ভয়কে জয় করব।”
অতঃপর নিজের বুকের বাঁ পাশটা আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলল,
“এখানটায় থাকবে তুমি। আজ, কাল, পরশু, আজীবন। ব্যস, আর কিচ্ছু চাই না তোমার থেকে। তুমি এক জীবন থেকে গেলে আমার সব চাওয়া এমনিতেই পাওয়া হয়ে যাবে। আমি আমার মেঘবতীর এই মায়াবী মুখে চেয়ে কয়েক যুগ কা’টিয়ে দিবো নির্দ্বিধায়।”
নৈঋতা লজ্জাবতী লতার ন্যায় নেতিয়ে পড়ল। দারুণ লজ্জায় মাথা নত করল। লজ্জাবতীর ঠোঁটের কোণে ঠাঁই পেল এক চিলতে লাজুক হাসি। রৌদ্রুপের ভাবনায়, ওই হাসিটুকুর ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলেই সে এই মায়াবতীর ঠোঁটের কোণে ঠাঁই পেয়েছে। ভাগ্য বিধাতা সহায় হলে হয়তো কোনোদিন তার ভাগ্যও সুপ্রসন্ন হবে। বুকের খাঁচায় বন্দী কিছু সুপ্ত স্বপ্নরা তখন প্রজাপতির মতো ডানা মেলবে মুক্ত আকাশে। সেই শুভক্ষণের জন্য প্রয়োজন শুধু সময় এবং অসীম ধৈর্যের। প্রণয়ী পুরুষ তার মেঘবতীর জন্য ধৈর্য আঁকড়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতেও বদ্ধ পরিকর।
বাড়ির সবাই তৃপ্তি সহকারে দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত। নৈঋতা পাশে দাঁড়িয়ে সবার প্লেটে এটা-ওটা তুলে দিচ্ছে। সবার খাওয়া শেষ হলে তবেই সে খেতে বসবে। গত এক মাস ধরে শাহানা খানমের আদেশে এটাই হয়ে আসছে। খাওয়ার ফাঁকে রৌদ্রুপ মাঝে-মাঝে নৈঋতার ক্লান্ত মুখটা পরখ করে নিচ্ছে। অতঃপর খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস চেপে যাচ্ছে। প্রথম দিকে সে প্রতিবাদ করতে চাইত। কিন্তু শাহানা খানমের সোজাসাপ্টা কথা, এসব ভালো না লাগলে নৈঋতাকে যেন গ্রামে রেখে আসে। বারবার এই কথাতে এসেই রৌদ্রুপ আটকে যায়। নৈঋতাও তখন থেকেই তাকে বারণ করে দিয়েছে এসব নিয়ে কথা না বাড়াতে। প্লেটের অর্ধেকটা খাবার বাকি রেখেই রৌদ্রুপ পানি খেয়ে উঠে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গেই নিদ্রা টিটকারি করে বলল,
“রৌদ্র, নৈঋতা যতদিন ধরে এসেছে, ততদিন ধরে দেখছি তোমার খাবারের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে? প্লেটের অর্ধেক খাবার রেখে সবসময় উঠে পড়ো। কী ব্যাপার বলো তো?”
রৌদ্রুপ বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বরং স্বাভাবিকভাবেই চলে যেতে-যেতে বলল,
“সবার পেটে কি আর তোমাদের মতো ক্ষুধা থাকে যে, খাওয়া শেষে হাড়ির তলায় খাবার ফেলে রাখবে?”
নিদ্রার মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। ফুঁসে উঠে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দেখলে, তোমার ভাই ইঙ্গিতে কীভাবে আমাকে অপমান করে গেল? আমার খাওয়া নিয়ে কথা শোনানোর সাহস কে দিয়েছে ওকে?”
তিহান তেতো মুখে বলল,
“যেচে যাও কেন অপমানিত হতে?”
স্বামীর থেকেও উলটো কথা শুনে নিদ্রার মাথাটা দপ করে জ্ব’লে উঠল। রাগে ক্ষোভে সে নিজের আধ খাওয়া খাবার রেখেই উঠে গেল। কারো নিষেধ শুনল না। নৈঋতার দিকে একবার ক্রদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল। ফলস্বরূপ শাহানা খানমের থেকে নৈঋতাকেই মুখ ঝামটা খেতে হলো। সবাই খাওয়া শেষ করে সরে যাওয়ার পর নৈঋতা এগিয়ে গিয়ে রৌদ্রুপ যে চেয়ারে বসেছিল, সেখানটায় বসল। অতঃপর রৌদ্রুপের রেখে যাওয়া খাবারের সাথে আজকের বেঁচে যাওয়া খাবারটুকু মিলিয়ে নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। এ ঘটনা নতুন নয়। গত এক মাস ধরে এটাই নৈঋতার খাবারের রুটিন। সবার খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া খাবার তার ভাগ্যে জোটে। এই নিয়েও প্রথমদিকে রৌদ্রুপ প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু বিশেষ কোনো সুরাহা হয়নি। বরঞ্চ মা, ভাবির কটু’ক্তি শুনতে হয়েছিল। তারপর থেকেই রৌদ্রুপের মাথায় এই বুদ্ধি আসে। সে নিজের খাবার থেকে অর্ধেক খাবার খেয়ে বাকিটা ‘খেতে ইচ্ছে করছে না’ বলে নৈঋতার জন্য রেখে দেয়। এ বাড়িতে কেউ কারো এঁটো খাবার খায় না বলে তার অসুবিধা হয়নি। প্রথম-প্রথম নৈঋতা খুব অবাক হত, রাগ করত। অর্ধেক খাবার খেয়ে রৌদ্রুপের ক্ষুধা মেটে না ভেবে দুঃখ পেত। রৌদ্রুপ হেসে বলত,
“আমার মেঘবতীকে সুস্থ রাখতে পারলেই আমার শান্তি।”
নৈঋতা গাল ফুলিয়ে বলত,
“আর আপনের সুস্থতা? নিজের কতা ভাবা লাগে না?”
“এই তো তুমি কত ভাবছ আমাকে নিয়ে। একটা মানুষকে নিয়ে কত জনের ভাবা লাগে?”
“আপনে এমন করবেন না আর। তাইলে কিন্তু আমি সত্যি-সত্যিই বাইত যামুগা।”
অথচ পরবর্তীতে রৌদ্রুপের ভাগের খাবার খাওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়। কেমন এক অদ্ভুত তৃপ্তি মেলে। মাথার মধ্যে বিভিন্ন ভাবনার তালগোল পাকিয়ে নৈঋতা খাওয়া শেষ করল। তারপর সব এঁটো বাসন ধুয়ে ফেলল। তবু তার বিশ্রাম নেওয়ার ফুরসত নেই। দুপুরের রান্নার আগে দুই বালতি কাপড় ধুয়ে ছাদে শুকাতে দিয়ে এসেছিল। এখন আবার ছাদে যেতে হবে সেগুলো আনতে। কিন্তু অলস দেহটা আজ আর চলতে চাইছে না। ভাতঘুম দেওয়ার জন্য চোখ দুটো বড়ো ব্যাকুল হয়ে আছে। কোনোরকমে একটার পর একটা সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে পা রাখতেই দেখল পাশের দেয়াল ঘেঁষে রৌদ্রুপ দাঁড়িয়ে। নৈঋতাকে দেখে রৌদ্রুপ মৃদু হাসলো। নৈঋতা এগিয়ে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“এইহানে কী করতাছেন?”
“অপেক্ষা।”
“কিসের?”
“মেঘবতীর দর্শনের।”
নৈঋতার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। প্রেয়সীর এক টুকরো হাসি যেন প্রেমিকের বুকের তীব্র খরায় এক ফোঁটা বর্ষনের ছোঁয়া। নৈঋতা ঘুরে দাঁড়িয়ে সরে যেতে চাইতেই অকস্মাৎ রৌদ্রুপ তার এক হাত মুঠোবন্দী করে কাছে টেনে এনে দাঁড় করাল। ঘটনার আকস্মিকতায় নৈঋতা হকচকিয়ে গেল। যদিও রৌদ্রুপ আর তার মধ্যখানে কিছু পরিমাণ দূরত্ব বজায় আছে; তবু সে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ল। রৌদ্রুপকে অপলক দৃষ্টিতে তার মুখপানে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরও লজ্জা বোধ করল। রৌদ্রুপের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে নিচু স্বরে বলল,
“কী হইছে? ছাড়েন। কেউ দেখলে স’র্বনা’শ হইব।”
“সর্বনাশ তো আমার কবেই হয়েছে। এ আর নতুন কী?”
“আপনের আবার স’র্বনা’শ করল কে?”
“নৈঋতা নামক এক মিষ্টি স’র্বনা’শী।”
নৈঋতা মুচকি হেসে বলল,
“কেউ দেখলে কিন্তু সত্যিই খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হইব।”
“হোক। আমার হবু বউয়ের হাত আমি ধরেছি, তাতে কার কী, শুনি?” দায়সারা গোছের উত্তর রৌদ্রুপের।
নৈঋতা ভ্রুকুটি করল। মিনমিনে গলায় বলল,
“শরম নাই আপনের? বিয়ার আগেই বউ, বউ করেন?”
“কিসের শরম? আজ বা কাল আমারই তো বউ হবে।”
“না-ও তো হইতে পারি। কার কপালে আল্লায় কী লেখছে, আল্লায়ই জানে।”
রৌদ্রুপের মুখের চিকচিকে হাসিটুকু হুট করে উবে গেল। সে নৈঋতার ডান হাতটা নিজের বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে গম্ভীর মুখে বলল,
“এইখানটা তোমার জন্য দিন-রাত কত পো’ড়ে, জানো তুমি? এই জ্বা’লাপো’ড়া কমানোর সাধ্য অন্য কারো আছে? থাকলে এই বুকটা তোমাকে আগলে রাখার জন্য অপেক্ষা করত?”
নৈঝতা স্তব্ধ চোখ তুলে তাকিয়ে আছে রৌদ্রুপের গম্ভীর মুখটার দিকে। সে বুঝে উঠতে পারেনি রৌদ্রুপ তার কথাটা এত সিরিয়াসভাবে নিবে। সে নরম কন্ঠে বলল,
“আপনে রাগেন ক্যান? আমি তো এমনেই কইলাম।”
“বলবে কেন? শোনো নৈঋ, আজ হোক বা কাল, যে মেয়েটা একদিন আমার এই বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে মনে করবে, সে শুধুই আমার মেঘবতী।”
অজান্তেই নৈঋতার চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা অশ্রু কণা জমে গেল। আবেগী হয়ে বলল,
“এত সুখ আমার কপালে সইব?”
রৌদ্রুপ দুহাতে আলতো করে নৈঋতার ছোট্ট মুখটা তুলে ধরল। মুচকি হেসে বলল,
“একশো বার সইবে। দরকার পড়লে আমার সব সুখ তোমার নামে লিখে দিবো। তাতেও কি হবে না?”
“খুব হইব।”
“আচ্ছা, এবার একটা সুখবর শোনো। কদিন আগে আমি যে জবের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, ওই জবটা আমি পেয়ে গেছি।”
নৈঋতার চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
“সত্যি?”
রৌদ্রুপ ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। বলল,
“হ্যাঁ, এ সপ্তাহের মধ্যেই জয়েনিং ডেট। আগামী মাসে তোমার ভর্তি। আশা করি এবার সব গুছিয়ে নিতে পারব।”
নৈঋতা গাল থেকে রৌদ্রুপের হাত দুটো আলগোছে সরিয়ে চিন্তিত মুখে বলল,
“ভর্তির কতা হুনলে যদি খালাম্মায় রাইগা যায়?”
রৌদ্রুপ নৈঋতার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলল,
“কিচ্ছু হবে না রে পা’গলি। আমি আছি তো। দেখবে, আস্তে-আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি কলেজে গেলে বাড়ির কাম করব কে?”
“ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার চাকরি ছিল না বলে বাধ্য হয়ে এতদিন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। এরপর আর করব না।”
“আমার অনেক চিন্তা লাগে।”
“ভরসা করো না আমায়?”
“আপনে ছাড়া আর কোনো ভরসার জায়গা আছে আমার?”
“এ ভরসাটুকুই ধৈর্যের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখো। যা হবার ভালোই হবে,” মুচকি হেসে বলল রৌদ্রুপ।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১২.
রৌদ্রুপ নতুন চাকরি পাওয়াতে পরিবারের সবাই যতটা না খুশি হয়েছে, হুট করে রৌদ্রুপের পরিবর্তনে তার চেয়েও বেশি অসন্তুষ্ট হয়েছে। চাকরিতে জয়েন হওয়ার পর থেকে রৌদ্রুপ যেন নৈঋতাকে একটু বেশিই সমর্থন করছে। প্রথমত, সে আজকাল নৈঋতাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাতে দেয় না; বরঞ্চ নৈঋতাকে বেশি হুকুম করলে মুখের ওপর প্রতিবাদ করে বসে। দ্বিতীয়ত, নৈঋতার সুবিধার জন্য সে একজন কাজের মেয়েও রেখেছে, যাকে সে নিজে বেতন দিবে। নিজের বাধ্য ছেলের এ অবাধ্য আচরণে শাহানা খানম প্রতিটা মুহূর্ত গজগজ করে কা’টান, রীতিমতো কথা কা’টাকা’টি করেন; তবু রৌদ্রুপ নিজ সিদ্ধান্তে অটল। তার আচরণে ইতোমধ্যে পরিবারের সদস্যদের মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে এবং তার সত্যতাও সবাই টের পেয়েছে। দেখতে-দেখতে নৈঋতার কলেজে ভর্তির সময় চলে এসেছে। আজ সকালে নাস্তার টেবিলে রৌদ্রুপ কথাটা পাড়তেই যেন তার পরিবারের মাঝে বড়োসড়ো একটা ব’জ্রপা’ত আ’ঘা’ত হা’নল। ফলস্বরূপ রৌদ্রুপের সাথে এই নিয়ে কথা কা’টাকা’টিও শুরু হলো। মা, বোন, ভাবি সবার বিরুদ্ধে একা পালটা জবাব দিতে হলো রৌদ্রুপকে। সরফরাজ চৌধুরী আগাগোড়াই শান্ত মেজাজের মানুষ। ঝামেলা তার পছন্দ নয়। স্ত্রীর স্বভাবের ওপর তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত। নৈঋতার হয়ে তিনি অনেক বুঝিয়েছেন শাহানা খানমকে। কিন্তু শাহানা খানম উলটো তাকেই রাগ দেখিয়েছেন, নৈঋতার পক্ষ নিচ্ছেন বলে আরো এক ঝামেলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছেন। কথায়-কথায় বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হু’মকি দেওয়া তো তার আজন্মের দো’ষ। স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়েও সরফরাজ চৌধুরী বেশ চিন্তিত থাকেন। তাই এই বয়সে আর তার সাথে মোটেও ঝামেলায় জড়ানোর সাহস করেন না। নৈঋতাকে নিয়ে এই ঝামেলা আজকাল পুরোনো হয়ে গেছে। এই নিয়ে তিনি দারুণ বিরক্ত। নিজের স্ত্রীর অকৃতজ্ঞতার জন্য তাকে কথা শোনালেও সে গায়ে মাখে না। নৈঋতা মেয়েটার জন্যও তার মায়া হয়। কিন্তু স্ত্রী, মেয়ে, পুত্রবধূ সবাইকে তো আর তার এই শান্তশিষ্ট মেজাজ দিয়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই আজ অতিরিক্ত বিরক্তিতে বলে বসলেন, হয় রৌদ্রুপ নয় নৈঋতা, যেকোনো একজন থাকবে এ বাড়িতে। রোজ-রোজ এ ঝামেলা আর নেওয়া যাচ্ছে না। এক পর্যায়ে এসে রাগে-ক্ষোভে রৌদ্রুপ বলেই বসল এ বাড়িতে সে বা নৈঝতা, কেউই থাকবে না। প্রয়োজনে সে নৈঋতাকে তার কাছেই রাখবে। ব্যস, সবার ধারণা এবার সত্যি প্রমাণ হলো। ছেলের মুখে এমন কথা শুনেই শাহানা খানম কাটকাট গলায় নৈঋতাকে তিরষ্কার করে বললেন সে যেন এই মুহূর্তে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এমনকি কোনোদিন যেন তার ছেলের সাথে যোগাযোগ করারও চেষ্টা না করে। নৈঋতা কোনো জবাব দিতে পারে না। ওড়নার আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। রৌদ্রুপ ফুঁসে ওঠে। সে কিছুতেই নৈঋতাকে ছাড়বে না। ছেলের এ অদ্ভুত ব্যবহারে কপাল চাপড়ে আহাজারি করে ওঠেন শাহানা খানম। নিদ্রা আর শশী যাচ্ছেতাই কথা শোনায় নৈঋতাকে। রৌদ্রুপ তার কথায় অটল। ছেলের বেপরোয়া স্বভাব মানতে পারলেন না সরফরাজ চৌধুরী। গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ ভেবে তবেই পাকাপোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। চোয়াল শক্ত করে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এ বাড়িতে কিছুতেই আর নৈঋতাকে নিয়ে ঝামেলা করা চলবে না। রৌদ্রুপ যদি নৈঋতাকে রাখতে চায়, তবে সে-ও যেন নৈঋতার সাথে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তার এ সিদ্ধান্তের কোনো নড়চড় হবে না। এবার কী করবে তা রৌদ্রুপের ব্যাপার। রৌদ্রুপের মাথা তখন অতিমাত্রায় গরম। সাতপাঁচ না ভেবে সঙ্গে-সঙ্গেই বলে বসল, সে নৈঋতাকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। মুখের ওপর এ উত্তর পেয়ে সরফরাজ চৌধুরী মাথা দুলিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের ঘরে চলে গেলেন। নিদ্রা আর শশীর ধা’রালো অ’স্ত্রের মতো বাক্যের তি’ক্ততা বাড়ল। শাহানা খানম কেঁদেকে’টে, আহাজারি করে বাড়ি মাথায় তোলেন। ছুটে গিয়ে ছেলেকে নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেন। এমনটাও বলেন যে, রৌদ্রুপ চাইলে নৈঋতাকে ওর বাড়ি ফিরিয়ে দিতে পারে। নিজের ছেলের সাথে এমন অযোগ্য মেয়েকে তারা কেউই মানতে রাজি নন। পরিবারের সিদ্ধান্ত যেমন পালটাল না, তেমনি রৌদ্রুপের সিদ্ধান্তও পালটাল না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে শেষমেষ নৈঋতা ছুটে গিয়ে রৌদ্রুপের পা চেপে ধরল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে ভেজা কন্ঠে বলল,
“আপনার পায়ে পড়ি। আমার জন্য নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করবেন না। আমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসুন। আমি আর এখানে থাকব না। আমি চলে গেলে সব মিটে যাবে।”
রৌদ্রুপ চোয়াল শক্ত করে বলল,
“উঠে দাঁড়াও, নৈঋ।”
নৈঋতা উঠল না। একইভাবে রৌদ্রুপের পা ধরে অনুরোধ করে চলল। রৌদ্রুপ এবার গলায় কিছুটা জোর দিয়েই বলে উঠল,
“উঠতে বলেছি তোমায়।”
নৈঋতা চমকে উঠে মাথা তুলে তাকাল। রৌদ্রুপের কঠিন মুখটা দেখে সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। ইতঃপূর্বে রৌদ্রুপ তার সাথে রেগে কথা বলেনি। চুপসানো মুখে নৈঋতা উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে নিদ্রা ফোড়ন কে’টে বলল,
“এভাবেই বুঝি হাত করেছ আমার দেবরকে? তোমার মতো মেয়েরা ভালোই কৌশল জানে বটে!”
নৈঋতা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নত হয়ে দাঁড়াল। রৌদ্রুপ নিজের রাগটাকে সংবরণ করে একবার অদূরে রাগত মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকাল। তারপর ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নৈঋ, যাও, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।”
নৈঋতা থমকে গেল। অবাক দৃষ্টিতে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকাল। তার মতোই উপস্থিত সবাই বুঝে নিল রৌদ্রুপ নৈঋতাকে তার বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। নৈঋতার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তো পড়ছেই। রৌদ্রুপ আবার তাকে ইশারায় ঘরে যেতে বলতেই সে দ্রুত প্রস্থান করল। শাহানা খানমের মুখে তখন তৃপ্তির হাসি। তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগী কন্ঠে বললেন,
“আমি জানতাম আমার রৌদ্র মায়ের কথা ফেলবে না। যা বাবা, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আয়। শুধু-শুধু নিজের আপনজনদের সাথে ঝামেলা না করাই ভালো।”
রৌদ্রুপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শাহানা খানম তাকে ছেড়ে দিতেই সে চুপচাপ ওপরে চলে গেল।
ওদিকে নৈঋতা রুমে গিয়ে নিজের ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে আর অঝোরে কাঁদছে। বাড়ি ফিরে যাওয়া মানেই রৌদ্রুপকে আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলা, যা তার সহ্যসীমার বাইরে। শুধুমাত্র এই মানুষটার জন্য সে এতদিন সব মুখ বুজে সহ্য করে এ বাড়িতে পড়ে ছিল। আশা ছিল রৌদ্রুপ সব ঠিক করে দিবে, তারপর সে আবার পড়াশোনা করবে, রৌদ্রুপকে নিয়ে নতুন-নতুন স্বপ্ন দেখবে। এসব আশা তো রৌদ্রুপ নিজেই তাকে দিয়েছে। অথচ আজ? তার সব ধৈর্য বিফলে গেল? রৌদ্রুপকে সে চাইলেও ভুলতে পারবে না। আর রৌদ্রুপ? সে কি পারবে ভুলতে? কীভাবে পারল তার মুখের কথায় রাজি হতে? তার কি একটুও কষ্ট হবে না? নৈঋতার বড্ড অভিমান হলো। নিজেকেই নিজে বুঝাতে পারল না, কোনটা সঠিক। ব্যাগপত্র গুছিয়ে আর সে রুম থেকে বেরুল না। ভাবল রওয়ানা হওয়ার সময় হলে তো রৌদ্রুপ ডাকবেই। এখন হয়তো বেরুবে না। কারণ বাস ছাড়বে বারোটায়। এখন বাজে সকাল নয়টা বিশ। করার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে নৈঋতা দরজাটা ভেজিয়ে রেখে বিছানায় হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ল। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে মনে হলো, আজকের পর এই ঘরটা আবার ফাঁকা হয়ে যাবে। এই ঘর তো দূর, এই বাড়িতেই তার ছায়া থাকবে না। এলোমেলো ভাবনায় ডুব দিয়ে কখন যে নৈঋতা ঘুমিয়ে পড়েছে, তা তার নিজেরই খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল রৌদ্রুপের ডাকে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে সে রৌদ্রুপের দিকে তাকাল। কিছু বলতে গিয়েও হুট করে চুপ হয়ে গেল। চোখ নামিয়ে শিয়রের পাশ থেকে রৌদ্রুপের দেওয়া ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখল। বেলা এগারোটা বাজে। বুঝতে পারল রৌদ্রুপ রওয়ানা হওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে। রৌদ্রুপ প্রশ্ন করল,
“সব ঠিকমতো গুছিয়ে নিয়েছ?”
প্রশ্নটা শুনে নৈঋতা পুনরায় রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকাল। লোকটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক আছে। অনুভূতিশূন্য ভাবলেশহীন চাহনি। নৈঋতা মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে ওপর-নিচে মৃদু মাথা ঝাঁকাল। রৌদ্রুপ পকেট থেকে ফোন বের করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
“ফ্রেশ হয়ে এসো, এখনই বেরুব।”
“আপনের কিছু কওয়ার নাই?”
“আপাতত না।”
দ্বিধাহীন উত্তর শুনে নৈঋতা নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে মাথায় হিজাব পরে নিল। তার হিজাব পরা শেষ হওয়ার আগেই রৌদ্রুপ ব্যাগটা হাতে নিয়ে ‘এসো’ বলে বেরিয়ে গেল। কন্ঠনালিতে একরাশ চাপা কান্না নিয়ে সে শেষবারের মতো ঘরটায় নজর বুলিয়ে নিচে চলে গেল। নিচে গিয়ে একটু বেশিই অবাক হলো। বাড়ির কারো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রৌদ্রুপ একা দাঁড়িয়ে আছে। আরও অবাক হলো রৌদ্রুপের বড়োসড়ো দুটো লাগেজ দেখে। মনে হচ্ছে যেন সে বাসা বদল করছে। তবু নৈঋতা এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না। মৃদু স্বরে শুধু জানতে চাইল,
“বাড়ির সবাই কই?”
রৌদ্রুপ উত্তর দিলো,
“যার-যার ঘরে।”
যা-ই হোক। এতদিন যে মানুষগুলোর সাথে ছিল, তাদের সাথে শেষবারের মতো দেখা না করে গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাই নৈঋতা সবার থেকে বিদায় নিতে গেল। শাহানা খানমের ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বারকয়েক ডাকার পরও তার সাড়া পাওয়া গেল না। সরফরাজ চৌধুরী দরজা খুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নিচু স্বরে পরিবারের সদস্যদের খারাপ আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। নৈঋতা তারপর গেল নিদ্রার ঘরের সামনে। সেখানে শশীও ছিল। দরজায় টোকা দিয়ে ডাকতেই শশী ভেতর থেকে তিক্ত কন্ঠে শুধাল,
“কী চাই?”
“আমি চলে যাচ্ছি, ভাবি।”
সঙ্গে-সঙ্গে ভেতর থেকে শশী তাচ্ছিল্যের স্বরে নিদ্রার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“বিদায় নিতে এসেছে। যাও ভাবি, মহারানিকে সসম্মানে বিদায় জানিয়ে এসো।”
আরও কিছু তিক্ত কথা শোনার পর নৈঋতা বলল,
“ভাবি, তুলি ফেরেনি?”
“না।”
নৈঋতা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বলল,
“ভালো থাকবেন আপনারা। আর আমাদের গ্রামে বেড়াতে যাবেন।”
এরপর আবার ফেরত এল লিভিংরুমে। এসে দেখল রৌদ্রুপ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে প্রশ্ন করল,
“দেখা করেছ?”
নৈঋতা ওপর-নিচে মাথা নাড়ল। রৌদ্রুপ নৈঋতার ব্যাগটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে, নিজের লাগেজ দুটো হাতে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“চলো।”
অগত্যা নৈঋতা তার পিছু নিল। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তার চোখের পাতা ভিজে উঠল। রৌদ্রুপ একটা ট্যাক্সি ডেকে নৈঋতাকে নিয়ে উঠে বসল। পথে রৌদ্রুপ পুরোটা সময় ফোনে ডুবে ছিল। নৈঋতার সাথে একটা কথাও বলল না। নৈঋতার তখন ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। নিজেকে সামলে সে মনে-মনে অভিমানের জাল বুনেছে। পথে ট্যাক্সি থামল। রৌদ্রুপ নৈঋতাকে বসতে বলে নেমে পড়ল। নৈঋতা ভেতর থেকে লক্ষ্য করল রৌদ্রুপ তার সমবয়সী এক ছেলের সাথে কথা বলছে। রৌদ্রুপের লাগেজ দুটো ছেলেটার হাতে দিতে দেখে নৈঋতা বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। ঘটনার আপাদমস্তক কিছুই তার বোধগম্য হলো না। দেখল রৌদ্রুপ একটা লাগেজের ভেতর থেকে তার ছোটো ব্যাগটা বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে আবার ট্যাক্সিতে উঠে বসল। নৈঋতার মনে প্রশ্ন জাগলেও অভিমানের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সে কথা বলল না। আবার ট্যাক্সি থামার পর নৈঋতাকে নিয়ে রৌদ্রুপ নেমে পড়ল। ইতোমধ্যেই বাসে লোকজনের ভীড় দেখা যাচ্ছে। সিট পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। ট্যাক্সি ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে নৈঋতাকে নিয়ে রৌদ্রুপ দ্রুত বাসে উঠে গেল। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, একদম পেছনে দুটো সিট খালি পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি তারা সিট দুটো দখল করে নিল। নৈঋতাকে জানালার পাশে বসিয়ে, রৌদ্রুপ তার পাশে বসল। বাস ছাড়ল দশ মিনিট পরেই। নৈঋতা চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। উদাস দৃষ্টি লক্ষ্যভ্রষ্ট। মনে তার হাজারো ব্যথা, অভিমানী কথা। অভিমানী মন তার উন্মুখ হয়ে আছে, কখন মানুষটা একবার বলবে। যা-ই হয়ে যাক, মানুষটা তাকে ছাড়বে না। কিন্তু সে নিরাশ হলো। রৌদ্রুপ না তাকে ডাকল, না তার সাথে কথা বলল। অপেক্ষায়-অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে নৈঋতার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল। আলগোছে সে অশ্রু মুছে ফেলল, আবার ভিজে উঠল কপোল। তবু সে পাশ ফিরে তাকাল না। না তাকিয়েই বুঝতে পারল রৌদ্রুপ এখনও ফোনে ডুবে আছে। এরইমধ্যে রৌদ্রুপের ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করে সে কথা বলতে লাগল। নৈঋতা শুধু শুনল রৌদ্রুপ কাউকে বলছে,
“না, না। আমি কাল-পরশুর মধ্যেই ফিরে আসব। অফিস আছে তো।”
অসহনীয় য’ন্ত্র’ণায় নৈঋতা চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। হঠাৎ-ই এই পথের ওপর প্রচন্ড বিরক্ত লাগল। এই পথ এত দীর্ঘ কেন? শেষ হতে এত সময় কেন নিচ্ছে? জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে অর্ধেক পথে এসে কখন যে নৈঋতা ঘুমিয়ে পড়েছে, তা তার নিজেরও খেয়াল নেই। যখন ঘুম ভাঙল তখন চোখ মেলে নিজের মাথাটা একটা শক্তপোক্ত কাঁধে আবিষ্কার করল। নৈঋতা কপাল কুঁচকে মাথা তুলে তাকাল। রৌদ্রুপের গুরুগম্ভীর মুখটা চোখে পড়তেই ব্যাপারটা বোধগম্য হলো। সঙ্গে-সঙ্গে সে ছিটকে সরে বসতে গিয়ে জানালার সাথে মাথায় এক ভয়ানক বাড়ি খেল। ব্যথাতুর শব্দ করে ডানহাতে মাথা ঘষতে-ঘষতে নৈঋতা আড়চোখে রৌদ্রুপের দিকে তাকাল। রৌদ্রুপ এক পলক তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অসহায় মুখ করে নৈঋতা ঘুরে বসল। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। সে মাথায় এমন ভয়ানক আ’ঘা’ত পেল, তা-ও রৌদ্রুপ একটু জিজ্ঞেস করল না সে ব্যথা পেয়েছে কি না! এ-ও কী মানা যায়? এতটুকু সময়ের মধ্যেই সব ভালোবাসা হাওয়া হয়ে গেল? তার ভালোবাসাটা কি তবে সত্যি নয়? প্রশ্নটা মনে জাগতেই নৈঋতা চমকে উঠল। কারণ সে নিজেও জানে রৌদ্রুপের ভালোবাসায় কখনও খাদ থাকতে পারে না। তখনই হঠাৎ বাসটা থেমে গেল। নৈঋতা খেয়াল করে দেখল তারা পৌঁছে গেছে। সামনের যাত্রীরা নামতে শুরু করার পর রৌদ্রুপ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তাকে উঠতে দেখে নৈঋতাও উঠে পড়ল। বাস থেকে নেমে তারা একটা ভ্যানগাড়িতে চড়ে বসল। নৈঋতাদের বাড়ির সামনের রাস্তা মাটির বলে ওই পর্যন্ত গাড়ি যায় না। তাই মোড়েই তারা নেমে পড়ল। তখন আশেপাশের মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছে। খুব দ্রুতই দিনের আলোকে আবছা কালো আঁধার ঢেকে দিয়ে সন্ধ্যা নামল। রৌদ্রুপ আর নৈঋতা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছে। রৌদ্রুপের কাঁধে তার ব্যাগ আর হাতে নৈঋতার। নৈঋতা খালি হাতে নিজের মনের সাথে যু’দ্ধ করে রৌদ্রুপের পেছন-পেছন পথ চলছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হুট করেই নৈঋতা থমকে দাঁড়াল। তার সঙ্গে রৌদ্রুপও পা থামল। পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?”
নৈঋতা তখন ছলছল দৃষ্টি মেলে রৌদ্রুপের মুখপানে চেয়ে ছিল। এতক্ষণে জমিয়ে রাখা চাপা অভিমান আর কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে নামতেও বেশি সময় লাগল না। রৌদ্রুপ নৈঋতার চোখে পানি দেখে অবাক হলো। দু’পা এগিয়ে এসে নরম গলায় শুধাল,
“কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
তার প্রশ্ন যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। নৈঋতা হঠাৎ মৃদু শব্দ তুলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রৌদ্রুপ পুনরায় বলল,
“কী আশ্চর্য! এভাবে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছো কেন? কী সমস্যা হয়েছে?”
নৈঋতা ভেজা কন্ঠে বলল,
“আপনে এমনে সব শ্যাষ কইরা দিবেন? এতদিনের সবকিছু কি মিছা আছিল?”
“মিথ্যে হবে কেন?” আকাশ থেকে পড়ার মতো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলল রৌদ্রুপ।
“এই যে আমারে রাইখা যাইবেনগা। তারপর তো আর কোনোদিন এই গেরামে আইবেন না। হয়তো আমারে মনেও রাখবেন না। আমার কী হইব?”
রৌদ্রুপ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি নিজেই তো বলেছিলে তোমাকে গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে যেতে। এখানে আমার কী করার আছে, নৈঋ? একদিক তো আমাকে বেছে নিতে হতই।”
“একটা মাস আমারে মিছা আশা দিয়া কষ্ট ক্যান দিলেন? ফিরায়া দেওয়ার হইলে আগেই ফিরায়া দিতেন।”
“তুমি নিজেও কিন্তু ফিরতে চাওনি।”
“না চাওয়ার কারণ আছিল আপনের মিছা আশা।”
“সব দোষ আমার দিকে ঠেলে দিচ্ছ কেন এখন? পরিস্থিতি তো নিজ চোখে দেখেছ। আগে কি আমি বুঝেছি এমন হবে?”
নৈঋতা মাথা নিচু করে হাতের পিঠে চোখ মুছল। নাক টেনে বলল,
“দ্যাখলেন তো? শ্যাষ পর্যন্ত আমার কতাই মিল্লা গেল। কইছিলাম না শ্যাষে এমন কিছুই হইব? আপনেই বিশ্বাস করেননায়। আমার মতো গরিবের মাইয়ার কপালে এত সুখ সহ্য হয় না কি? আপনেরে আর কী কমু? সবই আমার কপালের দোষ।”
রৌদ্রুপ নীরবে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল। পুনরায় হাঁটা ধরে বলল,
“চলো, অন্ধকার বেড়ে যাচ্ছে।”
অগত্যা নৈঋতাও বিধ্বস্ত মুখে রৌদ্রুপের পিছু নিল। প্রকৃতির অন্ধকার যেন তার ভেতরটাও ছুঁয়ে দিতে শুরু করল। একমাস আগে ভালোবাসার ভরসায় বাড়ি থেকে দারুণ আশা নিয়ে অজানায় বেরিয়ে পড়া মেয়েটা আজ বাড়ি ফিরল একবুক হাহাকার নিয়ে।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।