শানজানা আলম
কেন আমি ডাকি তারে-১
-নিতু, অপেক্ষা করতে পারবে না আর একটা বছর? তুহিনের কথা হোয়াটসঅ্যাপে ভেঙে ভেঙে আসে। নিতু যেন বুঝতে পারে না তুহিন কী বলতে চাইছে বুকের ভেতর কেমন একটা উথাল পাঠাল করে ওঠে। একটা বছর! তুহিন বুঝতে পারছে না আব্বা হার্টঅ্যাটাক করার পর থেকে নিতুর বিয়ে নিয়ে কেমন অস্থির হয়ে গেছেন।
সেই অনার্সের শুরু থেকে সম্পর্ক তুহিনের সাথে। কিন্তু
তুহিনের পক্ষে এই মুহুর্তে বিয়ে করা সম্ভব নয়। পরিবারকে ম্যানেজ করে স্টুডেন্ট ভিসায় ইউকে গিয়েছে বছর পার হয় নি! আরো এক বছর পরে আসবে বলছে, সেটাও অনিশ্চিত মনে হয় নিতুর! তবে তুহিন বলেছে যখন, নিশ্চয়ই আসবে!
নিতু অনিশ্চিত এই অপেক্ষায় থেকে লাইনটা কেটে দেয়!
পাঁচ বছরের সম্পর্ক, তুহিন এনগেজমেন্ট করে গেলেও হতো। তখন নানা ঝামেলায় নিতু প্রেশার দিতে চায় নি।
নিতুর ভাবী সিমি বিষয়টা জানতো, সে বারবার বলেছিল, নিতু এভাবে ছেড়ে দিও না৷ মন ঘুরতে সময় লাগে না৷ আকদ হয়ে থাক! কিন্তু নিতু আসলে তুহিনের এত ঝামেলার মধ্যে বিয়ের প্রেশার দিতে চায় নি।
নিতু, নিতু- বলে ভাবী ডাকছেন।
নিতু উঠে গিয়ে দাঁড়ালো। ভাবী কথা বলছেন আব্বার সাথে। নাকে নল জড়ানো আব্বাকে দেখলে নিতুর কেমন একটা লাগে! না পারতে এ ঘরে আসতে চায় না নিতু।
নিতু, রেহানকে মনে আছে তোমার? আমাদের বিয়েতে এসেছিল, আমার কাজিন!- ভাবী এক নাগারে বলে যায়।
-না, মনে নেই৷ সংক্ষেপ করে নিতু।
-আচ্ছা মনে থাকার কথাও না৷ তখন তো তেমন কেউ পরিচিত ছিলও না৷ একবারই হয়তো দেখেছ, ও অবশ্য গান গেয়েছিল হলুদে, মনে থাকার কথা।
-হুম।
-রেহানের জন্য মেয়ে খুজছিল খালামনি। আমার মায়ের খালাতো বোন হয় উনি।
-আচ্ছা।
-আমি তোমার কথা বলেছি খালামণিকে, মানে রেহানকে।
নিতু বুঝতে পারছে কি বলতে চাইছে ভাবী।
-আমি বলি কি, তুমি একটু দেখা করো। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নিও!
নিতু বাবার সামনে সরাসরি “না” বলতে পারে না।
ভাবী হাত টেনে নিয়ে যায় নিতুকে।
নিতু শোনো, তোমার কথা আমি জানি। তোমার ভাইয়া বলেছে, তোমার তো কমপক্ষে এক দেড় বছর সময় লাগবে। আর রেহানেরও একটা ইস্যু আছে।
নিতু অবাক হয়ে বলল, কি ইস্যু?
ওর গার্লফ্রেন্ডকে ওর মা মানতে চাইছে না। রেহানকে জোর করছে বিয়ে করার জন্য। তাই ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মায়ের পছন্দে বিয়ে করে বছরখানেক পরে ডিভোর্স নিয়ে নিবে!মাকে বোঝাবে সায়রা ছাড়া কেউ ওকে সুখী করতে পারবে না।
-তুমি কীভাবে জানলে ভাবী!
-রেহানই বলেছে।
-এমন কি সত্যি হয়! ওর গার্লফ্রেন্ড কেন অপেক্ষা করবে, এটা মেনে নিবে?
-সেটা ওর ইস্যু! তুমি ভেবে দেখো! এর চাইতে ভালো সমাধান আর হয় না তোমার জন্য!
নিতু আকাশ-পাতাল ভাবনায় পড়ে যায়! এটা কী নাটক সিনেমা! জীবন কী এমন হয়! পরিস্থিতি সামাল দিতে এটা বেশ ভালো সমাধান কিন্তু তুহিন কি রাজী হবে! যদি রাজী না হয়! তাহলে কি হবে!
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, তুহিন সহজেই রাজী হয়ে গেল।
নিতু, আমি জানি কোন পরিস্থিতিতে তুমি এটা বলছ। আমি এত দূরে, চাইলেই তোমার পাশে দাঁড়াতে পারব না৷ তুমি একটু ম্যানেজ করো। আমি ফিরেই সব ঠিকঠাক করে নেব। আর আমাদের যোগাযোগ একদম বন্ধ হবে না।
এক অদ্ভুত শর্তে রেহান আর নিতুর বিয়ে হয়ে গেল খুবই অনাড়ম্বর ভাবে।
চলবে
কেন আমি ডাকি তারে-২
রেহানের সাথে নিতুর দেখা হলো গভীর রাতে৷
রেহান ঘরে ঢুকে বালিশ নিয়ে ডিভানে শুয়ে পড়ল। নিতুকে কিছু না বলেই৷ বোঝা যাচ্ছে এই ডিভান কাম বেড রেহান রিসেন্ট কিনেছে৷ হয়তো বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেই। শুয়ে পড়ে আবার উঠে বসল একটু পরেই।
-নিতু তোমার সাথে কিছু কথা বলা দরকার। এখন বলব? নাকি সকালে?
নিতু বলল, বলুন।
-তুমি তো জানোই, তোমাকে তোমার ভাবী বলেছে না সায়রার কথা?
-হ্যা বলেছে।
– ভীষণ অদ্ভুত পরিস্থিতি। আমার মায়ের সায়রাকে পছন্দ হয় নি, তিনি সরাসরি বলেছেন, সায়রাকে তিনি মেনে নিবেন না৷ আমি তো জানি, সায়রা আমার জন্য কতটুকু, তাই আমি অনেক ভেবে ঠিক করেছি, বছরখানেকের জন্য একটা বিয়ে করে মাকে বোঝাব, সায়রা ছাড়া কেউ আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তুমি আমার ফ্যামিলির কারো সাথে ভালো ব্যবহার করবে না।
নিতু বলল, এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আপনার একবছর প্রয়োজন, আমারও। তাই বলে অকারণে আমি কেন খারাপ ব্যবহার করব সবার সাথে!
-বিয়ের শর্ত তো এটাই ছিল।
-বিয়ের শর্ত আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক তৈরি হবে না। দুজনের পছন্দের মানুষের সাথে যোগাযোগ ঠিক থাকবে। এক বছর পরে সেপারেশন নিয়ে নিব।
এর মধ্যে কোথাও খারাপ ব্যবহারের কথা ছিল না।
-তাহলে আমার বাড়ির লোক তোমাকে খারাপ ভাববে কিভাবে! কেন আমাদের ডিভোর্স হবে!
নিতু হাই তুলে বলল, অনেক কারণ আছে, আপনি ইম্পোটেন্ট, এটা বলেও হতে পারে!
রেহান নড়েচড়ে বসল, এটা কেমন কথা!
আপনি যেমন আমাকে বললেন, এটা সেরকম একটা কথা। আমার ঘুম পাচ্ছে রেহান৷ চিন্তা করবেন না, আমি কোনোভাবেই আপনার সাথে একবছরের বেশি থাকব না।
রেহান উত্তর দিলো না৷ নিতুর ফোন ভাইব্রেট করছে৷
তুহিন! এত রাতে!
নিতু ফোনটা কেটে দিয়ে মেসেজ দিলো, পরে কথা বলছি।
রেহান হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ল। নিতুর কথা শুনেছিল, ভীষণ ভালো মেয়ে। বেশি ভালো হলে তো আবার সমস্যা!
সায়রা একটু চটপটে, আমুদে, ওয়েস্টার্ন পোশাকে কম্ফোর্ট ফিল করে বলে প্যান্ট আর টপস পরেই এসেছিল মায়ের কাছে দেখা করতে! মা বলে দিলেন, এই মেয়ের সেন্স নেই, কোথায় কীভাবে চলতে হয়! এত বড় ফ্যামিলিতে মেয়েটা এসেই আলাদা হতে চাইবে।
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল নিতুর। ভারী গয়না খুলে রেখে একটা সুতির জামা পরে নিলো। তারপর দরজা খুলে বের হয়ে দেখল সবাই চা পর্বে ব্যস্ত।
রেহানের মা আরজুমান বেগম বললেন, এত সকালে উঠে গেছ! এসো মা! কিন্তু তোমার শাড়ি গয়না কই? বউ বউ লাগছে না তো!
নিতু গিয়ে বসল। ওকে চা আর ব্রেড টোস্ট দেওয়া হলো। নিতুর খিদেও পেয়েছিল। অল্প করে খাওয়ার পরে আরজুমান বেগম বললেন, চলে তো তোমার ঘরে, দেখি তোমাকে শাড়ি চুড়ি পরিয়ে নিয়ে আসি।
ঘরে ঢুকে তিনি দেখলেন, রেহান ডিভানে ঘুমাচ্ছে।
তিনি বললেন, ও এখানে কেন? বিছানায় কি সমস্যা?
নিতু বলল, সকালে মনে হয় ওখানে শুয়েছে।
ওহ আচ্ছা আচ্ছা! স্বামীর সাথে কখনো বিছানা আলাদা করবে না। একসাথে থাকতে থাকতেই টান তৈরি হয়। এখন তোমরা নিজেরাই পছন্দ করে বিয়ে করো৷ আগে কী হতো, অচেনা মানুষ ধরে বিয়ে দিয়ে দিতো। তার সাথে থাকতে থাকতে সেই জীবনের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে যেত।দেখি শাড়ি গয়না বের করো, আমি সাজিয়ে দেই।
নিতু লাগেজ খুলল। আরজুমান বেগম নিজেই লাল শাড়িটা বের করে বললেন, এটা পরো, এটা আজকের সকালের জন্য কিনেছিলাম আমি। এটা পরে এসো আমার ঘরে, আমি আরেকসেট গয়না দিচ্ছি। সব সময় পরবে এরকম।
নিতু বলল, সব সময় গোল্ড পরব?
হ্যা, কয়েকদিন তো পরো। তারপর খুলে রেখো।
আরজুমান বেগম বের হয়ে গেলেন। নিতু রেহানের কাছে গিয়ে বলল, শুনছেন, একটু আপনাকে বাইরে যেতে হবে।
রেহান বিরক্ত হয়ে বলল, কেন?
আমি তৈরি হবো। তাই।
রেহান বের হয়ে গেল। নিতু শাড়িটা পরে ঘর থেকে বের হয়ে শাশুড়ীর ঘরে ঢুকল।
রেহান সোফায় শুয়ে ছিল। আঁড়চোখে দেখল, কোনো গয়না পরে নি নিতু, ফর্সা ঘাড়, বাহু, টানা টানা চোখ, মেয়েটা বেশ সুন্দর!
রেহান চোখ নামিয়ে নিলো, নিজেকে নিজে ধিক্কার দিয়ে বলল, সায়রাকে ঠকিয়ে আরেকটা মেয়েকে দেখতে লজ্জা লাগছে না তোর! একবারো নিতুকে অন্য চোখে দেখবি না।
নিতু কিন্তু শর্ত অনুযায়ী তোর আসে পাশেও আসেনি।
নিতুকে আরজুমান বেগম সবসময় পরার মত একসেট গয়না দিলেন। বললেন, এটা আমি গড়িয়েছিলাম, পরা হয় নি। এখন তো অনেক দাম সোনার। তোমার জন্য নতুন বিয়ের গয়না ছাড়া কিনে উঠতে পারি নি। এটা তুমি নাও। সব সময় পরবে।
রেহানের বোন রায়না পাশ থেকে বলল, এটা তো তোমার খুব শখের মা, ভাবীকে আরেকটা দিও।
আরজুমান বেগম বললেন, না। নিতুকে এটাই মানাবে। গয়নাটা নিতুকে খুব মানিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে নিতু দেখল তুহিন ভিডিও কল দিচ্ছে। ও রিসিভ করল।
তুহিন ওকে দেখে বলল, নিতু তোমাকে এমন করে কখনো দেখিনি৷ একদম লাল টুকটুকে বউ লাগছে। আমাদের বিয়ের পরে একদিন এরকম সেজে আমার সামনে বসে থাকবে।
রেহান পেছন থেকে ঘরে ঢুকেছে। তুহিনের কথা গুলে ও শুনে নিলো। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ওর বিষয়টা ভালো লাগল না।মানে মনে হতে লাগল, আমাদের বাড়ির অন্দরমহলে আরেকটা ছেলে ঢুকে পড়ছে।
রেহান বলল, নিতু ফোনে কথা শেষ হলে একটু শোনো।
নিতু ফোন রেখে বলল, বলুন!
বাড়িতে এভাবে ভিডিও কলে কথা বললে কেউ না কেউ ঠিক জেনে যাবে। আমি চাইনা তোমাকে নিয়ে গসিপ তৈরি হোক। ফোনে কথা বললেও, বিষয়টা একটু নিয়ন্ত্রিত রাখবে।
না, তুমি মনে করো না আমি তোমাকে চাপ দিচ্ছি। তোমার সুবিধা মতই তুমি চলো। কিন্তু আরেকটা পরিবারে এসেছ তো, একটু বুঝে শুনে চলো আরকি!
নিতু মনে মনে বলল, ব্যাপারটা কি হলো, রাতেই তো বলল, খারাপ ব্যবহার করতে। সকালে অন্য সুরে কথা বলছে, বিষয়টা কী!
তবে নিতু তর্ক করল না। চুপচাপ মেনে নিয়ে বাইরে চলে গেল। সবার সাথে গল্প করতে ভালোই লাগছিল। অহেতুক এই আজব চিড়িয়ার সাথে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
চলবে
শানজানা আলম