গল্পঃ কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরি
পর্বঃ ০৬ (শেষ পর্ব)
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
বেশ কয়েকদিন ছুটি থাকায় ঝুমা আপুদের সাথে আমি সিলেটে ঘুরতে আসলাম। ঘুরতে এসে এতো বড় যে সারপ্রাইজ পাবো কখনো ভাবতে পারি নি।
আমি কখনোই কল্পনা করিনি সিলেটে এসে যে তামিমের দেখা পাবো। তামিমকে দেখা মাত্রই আমি উল্টো ঘুরে চলে আসতে নিলে ও আমাকে পেছন থেকে ডাকলো।আমি ওর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম না।কিন্তু ঝুমা আপু বলল, ছেলেটা হয়ত খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু বলতে চায়।যা গিয়ে শুনে আয়।
আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি গেলাম।হাজার হোক তামিম তো আমার এককালের ভালোবাসা ছিল। এতোদিনে ও নিশ্চয় বিয়ে করে সংসার করছে।
আমি তামিমকে জিজ্ঞেস করলাম,
–কি হয়েছে? ডেকেছেন কেনো?যা বলার তাড়াতাড়ি বলবেন দয়া করে।
–এতো তাড়া কিসের নীলা? এতোদিন পর দেখা হলো আমাদের। তুমি জানো গত দেড়টা আমি তোমাকে কীভাবে খুঁজেছি? তোমার আগের ফোন নাম্বার বন্ধ, ফেসবুক আইডিতেও অ্যাক্টিভ না।
–ফেসবুক চালানো তো আমি সেদিনই ছেড়ে দিয়েছি যেদিন আমার ভালোবাসার মানুষটি আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল। আমি ফেসবুকে একমাত্র একজনের ম্যাসেজের অপেক্ষায় থাকতাম, সেই যখন নাই আর ফেসবুক চালিয়ে কি করবো।
এনিওয়ে আমার কাজ আছে আমি এখন আসছি।
–মিথ্যা কাজের ভান করো না,এখানে তুমি ঘুরতে এসেছো।আর সেদিন আমি তোমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম কারন তুমি আমার প্রতি এতোটাই দূর্বল হয়ে পড়ছিলে যে তুমি পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট পর্যন্ত করেছিলে আর এদিকে আমারও মাস্টার্স শেষে গবেষণার জন্য বিদেশে চলে যেতে হয়েছিল।তাই আমি ভেবেছি তুমি আমার অপেক্ষায়,আমার জন্য সময় নষ্ট না করে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে নাও। বুঝতে পারছি সেদিন তোমার সাথে করা ব্যবহারটা খুব খারাপ ছিল কিন্তু তোমার ভালোর জন্যই করেছি।যাইহোক, এখন যেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আমি বলব সেটা হচ্ছে আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। অলরেডি ৩২ হয়ে গেছে আর বাড়িতেও বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছে, আমি আর ওয়েট করতে পারব না।এবার তোমাকে নিজের করে নিব।
আমি তামিমকে কিছুটা অভিমানী কন্ঠে বললাম,
–আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না।
–কেনো কেনো,বিয়ে করতে পারবা না কেনো?
আমার কি তোমার স্বামী হওয়ার যোগ্যতা কোনদিক থেকে কম?হলে বলো তোমার জন্য সব যোগ্যতা অর্জন করতে রাজি। আমি বর্তমানে সিলেটেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রফেসর হিসেবে
আছি পাশাপাশি বাবার বিজনেস সামলাচ্ছি। আর কিছুর প্রয়োজন?
আমি এবারে কেঁদেই দিলাম।চোখ মুছে ওকে বললাম,
— আমার যে আপনার ওয়াইফ হওয়ারই কোন যোগ্যতা নেই কারন আমি যে ধর্ষিতা….
–আমি তোমার অতীতের কোনো কথা জানি না,জানতেও চাই না।আমি এখন তোমাকে বিয়ে করতে চাই এটাই ফাইনাল কথা।
–মানুষ আবেগের বশে অনেক ভুল করে, আপনিও ঠিক তেমনি ভুল করছেন।আবেগ চলে গেলে আপনিও নিজের ভুল বুঝতে পারবেন।
— নীলা আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক। এটা কোন আবেগের বয়স না।আমি যা করছি ভেবে চিন্তে করছি।আমি তোমাকে কথা দিয়ে ছিলাম সারাজীবন তোমার ভালো বন্ধু হয়ে পাশে থাকতে চাই। হাজবেন্ড -ওয়াইফের চাইতে ভালো বন্ধু আর দুনিয়াতে নেই। আমি তোমার কোন কথা এখন শুনতে চাই না।আমি ঝুমা ভাবির সাথে কথা বলে বিয়ের ডেট ফাইনাল করছি।
–ঝুমা ভাবি মানে কি?
— তোমার দুলাভাই আসিফ ভাই আমার ফুপাতো ভাই আর তার স্ত্রী আমার ভাবি।ঝুমা ভাবীর থেকেই তোমার খবর পেয়েছি। এবার তোমার মামার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।তোমার কোনো বারণ শুনব না, তুমি গিয়ে বিয়ের প্রিপারেশন নাও।
সেদিন চারবছরের মান-অভিমানের গল্প শেষ হয়েছিল। একসপ্তাহের মধ্যেই আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছে।আমিও আমার প্রথম ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েছি। সবসময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম যে আমাকে সত্যিকারীর ভালেবাসবে সেই আমার চিরসাথী হয়।
আল্লাহর অনেক অনেক শুকরিয়া। আমার জীবনেও দুঃখের পর সুখ এসেছে। তবে মা-ভাইয়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আমার সুখের দিনে আজ তারা কেউ নেই। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
.
.
.
ইদানীং ডায়েরি লেখার টাইম পাই না। সারাদিন ব্যস্ত থাকি রাতে যতটুকু সময় পাই পরিবারকে সময় দেই। আমার স্বপ্ন ধীরে ধীরে পূর্নতা পাচ্ছে। আমার নিজস্ব একটা ফাউন্ডেশন আছে, “আশালতা”
নাম। আশালতার মূল কাজ অসহায়, ধর্ষিতা নারীদের পড়াশোনা শিখিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এছাড়া দরিদ্র শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা। আজ আমি চিৎকার করে বলতে পারবো যেই সমাজ আমাকে খারাপ মেয়ের স্বীকৃতি দিয়ে সমাজের বোঝা বানাতে চেয়েছিল।আজ আমি সেই সমাজের মানুষের কাছে একজন কাছের মানুষ হয়ে উঠেছি নিজের কঠোর পরিশ্রম ও যোগ্যতা দিয়ে।এখন কেউ আমাকে ধর্ষিতা বলে খোটা দেয় না। সকলে আমাকে ভরসা করে যা আমার জীবনের সবচেয়ে পাওয়া। মামা আমাকে ঠিকই বলেছিলেন,আল্লাহ আমাকে দিয়ে কিছু করাবেন বলেই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।আমি হয়তো মানুষের জন্য বড় কিছু করতে না পারলেও মানুষের প্রয়োজনে কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পেরেছি।।তবে আমার স্বপ্ন পূরনের পুরো আর্থিক – মানসিক সার্পোট পেয়েছি আমার হাজবেন্ডের থেকে। অনেক কপাল গুনে এমন হাজবেন্ড পেয়েছি। মুরব্বিদের কাছে একটা কথা প্রায়ই শুনতাম-
” সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে,
গুনবান পতী যদি থাকে তার সনে।”
.
.
.
আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া মহান আল্লাহর দরবারে।
গতসপ্তাহে আমি মা হয়েছি।আমার জমজ একছেলে এক মেয়ে হয়েছে। এখন বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে, এই সুযোগে আমি অনেকদিন পর ডায়েরি লিখতে বসেছি। এখন সারাদিনই ব্যস্ত থাকি। ভালোবাসার ডায়েরিটির বয়সও প্রায় আট বছর হয়ে গেছে। ডায়েরীটাও প্রায় শেষ। আমার জীবনের সাদা-কালো,রঙিন জীবনের মুহূর্তগুলির সাক্ষী আমার ডায়েরিটা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আমার জীবনের কাহিনি নিয়েই লিখে ফেলি জীবনের গল্প।
_____★★★_____★★★______★★★______
(ডায়েরিরএখানেই কাহিনি শেষ।এখন ডায়েরি পাঠিকার কাহিনি শুরু)
ডায়েরিটা পড়া শেষে আমার নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ডায়েরিটা এতো সুন্দর উপস্থাপন করে লিখা হয়েছে মনে হচ্ছে কোনো রাইটারের লিখা কোনো বই।একটা মেয়ে জীবনের কতোটা সংগ্রাম করে জীবনে এতোটা সফল হয়েছে। নীলা নামের মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।অবশ্য এতোদিনে তিনি হয়ত মধ্যবয়স্ক হয়ে গেছেন।কারন সর্বশেষ ডায়েরি লিখেছিলেন ২০১৫ সালে। তাকে দেখার জন্য নীলা আহমেদ লিখে ফেসবুকে সার্চ দিলাম।কিন্তু অনেক ঘাটাঘাটি করেও খুঁজে পেলাম না।তারপর বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপেও ডায়েরিটার ছবি পোস্ট দিলাম। কিন্তু নীলা আহমেদকে খুঁজে পেলাম না।অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে ডায়েরিটা যত্ন করে আমার কাছে রেখে দিলাম। আমার বিশ্বাস একদিন ডায়েরির মালিককে খুঁজে পেয়ে তার প্রিয় ডায়েরিটিকে তার কাছে ফেরত দিব।
……
ফেসবুকে লিখালিখি বেশ জনপ্রিয় আমি। একটা গল্প শেষ না হতেই পাঠক-পাঠিকারা কমেন্টে-ইনবক্সে নতুন গল্প লিখার অনুরোধ করে।
এবারও তাই হলো।কিন্তু নতুন কোনো গল্পের থিম নির্ধারণ করতে পারছি না।হঠাৎ মনে পড়লো ছয়মাস আগে #কুড়িয়ে_পাওয়া_ডায়েরি তে পড়া কাহিনিটা নিয়ে নতুন গল্প লিখি।সব গল্প তো কাল্পনিকই লিখি।এবার না হয় বাস্তব জীবনের আলোকে গল্প লিখলাম।সবকিছু ভেবে-চিন্তে গল্পের সূচনা পর্ব লিখলাম। গল্পের নাম দিলাম-“কুড়িয়ে_পাওয়া_ডায়েরি”
প্রথম পর্বতেই প্রায় দশ হাজার+ রিয়েক্ট আর এক হাজার + কমেন্ট আসলো।ব্যপারটা বেশ ভালো লাগলো আমার। তিন/চার পর্ব দেওয়ার পর গল্পের কমেন্ট বক্সের কমেন্ট পড়ছিলাম।সেখানে অসাধারণ /নেক্সট /নাইস এরকম কমেন্টের ভীড়ে গিয়ে একটা কমেন্ট দেখে আমার চোখ আটকালো।
“এতো কমেন্টের ভীড়ে হয়ত আমার কমেন্ট পড়বেন না। তবে অনুরোধ রইল আমার প্রিয় ডায়েরিটা ফিরিয়ে দেওয়ার।”
কমেন্টটা পড়ে আইডির নামটা খেয়াল করে দেখলাম নীলা আহমেদ। আমি দ্রুত তার প্রফাইলে ঢুকলাম। এতোদিন যাকে ফেসবুকে খুজে বেড়াচ্ছিলাম আজ সেই আমাকে কমেন্ট করেছে।প্রফাইল পিকচার মিসেস নীলার ফ্যামিলির।তিনি দেখতে এতোটা সুন্দর! অবশ্য শুধু তিনিই না তার হাজবেন্ড, ছেলে-মেয়েরা সবাই সুন্দর। আমি ভেবেছিলাম তিনি এতোদিনে বয়স্ক হয়ে গেছেন।কিন্তু ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে ৩৫/৩৬ বয়সী হবেন।আমি তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষন পর তিনি আমাকে ম্যাসেজ দিলেন- “তোমার সাথে ফোনে কথা বলতে পারি।”
আমিও জ্বি লিখে পাঠালাম। ফোনে আমাদের অনেকক্ষন কথা হলো।কোথায় ডায়েরি পেলাম? তিনি ডায়েরিটার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছেন!তার বাস্তব জীবনী দিয়ে গল্প লেখায় তিনি ভীষণ খুশি হয়েছেন এই ধরনের টুকটাক আরো অনেক কথা বললাম।তিনি আমাকে সামনের শুক্রবারে ডায়েরিটা ফেরত দেওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বললেন।
আমিও দেখা করতে গেলাম সাথে তার প্রিয় ডায়েরিটা নিয়ে। তিনি সপরিবারে এসেছেন। ছবির চাইতে বাস্তবে দেখতে আরো সুন্দরী। একটা নেভি-ব্লু রঙের বোরকার পড়ে এসেছেন। দেখে মনে হচ্ছে বোরকাটা একমাত্র তার জন্যই বানানো। বোরকা পরিহিত হলেও তিনি যথেষ্ট আধুনিক। তার পুরো পরিবারই মাশাআল্লাহ যেমন সুন্দর ব্যবহারও তেমনি সুন্দর।বাচ্চা দুটো পাঁচ বছরের হয়েছে। ডায়েরিটা ফেরত দিতে গিয়ে আমার কেন জানি মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তবে অনেক ভালোলাগাও কাজ করল ডায়েরি ফেরত পেয়ে তার মুখের হাসি দেখে।
আসার সময় তিনি ছোটবোন হিসেবে তিনি আমাকে অনেক সুন্দর সুন্দর উপদেশ দিলেন।তার উপদেশ-ভালোবাসা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
(সমাপ্ত)
অনেকদিন পর ভালো একটা গল্প পড়লাম