কুয়াশার মতো পর্ব-১০

0
442

#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১০

সোহাগ অপ্রস্তুত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। দু’জন কনস্টেবল সোহাগের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, ব্যাপারটা বোধহয় ওর মোটেও পছন্দ হয়নি। মুখটা গম্ভীর করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। রাতুল শক্ত চোখে ওসি সাহবের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কি করবো বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। ওসি সাহেব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য রাতুলর দিকে তাকিয়ে বললো, ” রাতুল সাহেব একটা বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাড়িওয়ালাকে কেন খু”ন করতে গেলেন?”

” আগেই তো বলেছি চৈতীর সঙ্গে অ’বৈ’ধ সম্পর্কে ছিলো, সে-ই রাগ থেকে। আপনার পেশার সাথে এমন প্রশ্ন মানানসই নয়। একজন পুলিশ অফিসারের সূক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী হওয়া জরুরি। ”

ওসি সাহেব বোকা বোকা প্রশ্ন করে ফেলেছেন। রাতুলের জবাবে হাসি পেলো, ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হাসি থামানোর চেষ্টা করছি। ওসি সাহেব এতে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং শান্ত গলায় বললো, ” এ জন্য আপনি উনাকে খু”ন করেননি। যদি এটাই একমাত্র কারণ হতো তাহলে অনেক আগেই উনাকে মে”রে ফেলতেন। এর পিছনে অন্য কিছু রয়েছে। ”

ওসি সাহেবের জবাবে রাতুলের মুখে কালো মেঘ ভীড় করলো। মলিন গলায় বললো,
” বাড়িওয়ালা খুব খারাপ লোক। ওকে ওর পাপের শাস্তি দিয়েছি। ”

” কোন পা”পের শা”স্তি দিয়েছেন? ”

” তাহলে শোনেন। রাতে চৈতীর খু”ন করার পর কিছু সময়ের জন্য অস্বাভাবিক আচরণ করছিলাম। যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। কিছু সময় পর হুশ ফিরলো আমাকে পালাতে হবে। না হলে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাব। তড়িঘড়ি বেরিয়ে যেতে গিয়ে চৈতীর দিকে নজর পড়লো। এই মেয়েটাকে সবকিছু দিয়ে ভালোবেসেছি। ওকে মে”রে ফেলে ওর পা”পের শা”স্তি দিলেও, আমি কি পেলাম? কিচ্ছু পাইনি! ওকে মে”রে পৈ”শা”চি”ক আনন্দ উপভোগ করতে পারিনি। হৃদয় পু’ড়’ছে স্বজন হারানোর বেদনায়।

ঘরের কোণায় টেবিলের উপর চৈতীর ডাইরি পড়ে ছিল। শেষ স্মৃতি হিসাবে ওটা সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কপাল ভালো ছিল, বৃষ্টির কারণে কারেন্ট চলে গেছে। চারদিকে অন্ধকার। চুপিসারে বেরিয়ে গ্রামের বাড়ির দিকে চলে গেলাম। ”

এতটুকু বলে রাতুল থামলো। কৌতুহল সহ্য করতে না পেরে বললাম,

” চৈতীর ডাইরি নিয়ে এসেছিলেন এ কথা আগেও বলেছেন। কিন্তু ডাইরিতে কি লেখা ছিল? তাছাড়া বাড়িওয়ালার সঙ্গে ডাইরির কি সম্পর্ক?”

” বলতে গেলে দম আটকে আসে, আপনিই না হয় পড়ে শোনান। ”

রাতুল আমার দিকে ডাইরিটা এগিয়ে দিল। এতো সময় শার্টের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল বোধহয়। ডাইরির মলাটে দু’জনের ঘনিষ্ঠ একটা ছবি প্রিন্ট করা। দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। ছবির নিচে ছাপা অক্ষরে দুইটি কথা লেখা রয়েছে। ‘ভালোবাসি প্রেয়সী’। মলাট দেখলেই বোঝা যায় অনেক যত্ন নিয়ে ডাইরিটা বানানো হয়েছে। রাতুল অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছিল বোধহয়।

ডাইরির বেশিরভাগ পৃষ্ঠায় লেখায় নানান কথা লেখা রয়েছে। শেষ দিকে কয়েকটা সাদা পাতা, সেখানে কিছু লেখা নেই। চৈতীর হাতের লেখা স্পষ্ট, পড়তে অসুবিধা হচ্ছে না। প্রথম থেকে পড়া শুরু করলে সম্পূর্ণ ডাইরি পড়তে অনেক সময় লেগে যাবে, কোথা থেকে পড়া শুরু করবো বুঝতে না পেরে পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগলাম। রাতুল শেষ দিকের একটা পৃষ্ঠা বের করে দিয়ে বললো, ” এখান থেকে পড়া শুরু করেন। ”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম।

” বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি, বৃষ্টির শব্দে সবকিছু একাকার হয়ে গেছে। খুব সুন্দর পরিবেশ, দারুণ আবহাওয়া! তবে আমার মন ভালো নেই, মনের মাঝে অজানা ভয় বাসা বেঁধে আছে। যদিও ভয়ের কারণটা অজানা নয়।

দুপুরের দিকে বাড়িওয়ালা কাকা এসেছিল, হয়তো টাকার জন্য। মাস শেষ হয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন আগে, বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে পারিনি। রাতুল এখনও টাকা পাঠায়নি, হয়তো কোন সমস্যার মধ্যে আছে। এদিকে আমার হাত শূন্য।
উনি অবশ্য টাকা নিয়ে কিছু বলেনি। কেন এসেছেন জানতে চাইলে আমতাআমতা করে ফিরে চলে গেছে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।
উনি যখন এসেছিলেন তখন কাপড় পরছিলাম। দরজা লাগাতে খেয়াল ছিল না। বাসায় তেমন কেউ আসে না বিধায় দরজার লাগানোর ব্যাপারে অতটা গুরুত্ব দেইনি। তাছাড়া শাড়ি পরতে খুব বেশি সময় লাগে না।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, উনি আমাকে পোশাক পরিবর্তন করতে দেখে ফেলেছে। এজন্য আমায় দেখে অমন আমতাআমতা করে চলে গেলেন।
সে-ই থেকে কোন কিছুতে শান্তি পাচ্ছি না। আল্লাহ রহমত করুক, উনি যেন কিছু না দেখে। এমন কিছু হলে আমি রাতুলকে কি জবাব দেবো? ‘

এতটুকু পড়ে ওসি সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি ইশারায় পড়া চালিয়ে যেতে বললেন। রাতুল চোখ-মুখ খিঁচে বসে আছে। সোহাগ একদম নির্বিকার!

পরের পৃষ্ঠা,
” আমার ধারণাই সত্যি হলো। বাড়িওয়ালা আমাকে কাপড় বদলাতে দেখে ফেলেছেন। শুধু এতটুকুই নয়, উনি সেই দৃশ্য ভিডিও করে রেখেছেন। আজ বিকেলে ছাঁদে গিয়েছিলাম, বিকেলের দিকে ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। রাতুলও ব্যস্ত, ও ফ্রি থাকলে দু’জনে গল্প করে সময় কাটানো যেত। ছাঁদে বাড়িওয়ালার সাথে দেখা, আমায় দেখে বাজে ভঙ্গিতে বললেন, ” আপনার জিনিসপত্র দেখে ফেলেছি। ”

এমন ব্যবহারে কিছুটা অবাক হয়েছি, উনাকে দেখে ভদ্রলোক মনে হতো। মনের ভিতর চেপে রাখা ভয় যেন গলা বেয়ে উপরে উঠে আসছে। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, ” কিসব বলছেন আপনি?”

উনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে আমার সামনে ধরলেন। হাত-পা কাঁপছে। এসব কি দেখছি আমি! নিজের প্রতি রাগ জমতে লাগলো, কেন দরজার ব্যাপারে খেয়াল রাখলাম না। ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখ দেখে উনি খুব মজা পেলেন। ঠোঁট চেটে বললেন, ” কেমন দেখছো সোনা?”

উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। লোকটা আমার বাপের বয়সী। একটা মানুষ কি করে এতটা জঘন্য হতে পারে? উনি আমায় চুপ থাকতে দেখে বললেন, ” এমন ভাব ধরে লাভ নেই সোনা। রসগোল্লার হাঁড়িতে মুখ না ডোবালে শান্তি পাব না। কবে আসবো তোমার ঘরে? ”

” আমি আপনার মেয়ের মতো, এসব কেন বলছেন? আপনার নিজের মেয়ে হলে কি এমন কথা বলতে পারতেন?”

” মিষ্টি কথায় মন গলবে না সোনা। আমার যে মিষ্টি চাই। ”

” আমি আপনার বিরুদ্ধে পু”লিশে জানাবো। বুড়ো বয়সে জে”লের ঘানি টানতে হবে। ”

” তাতে কি তোমার লাভ হবে সোনা? আমার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পৃথিবী তোমায় দেখবে। এটা কি ভালো হবে?”

” এসব কি বলছেন?”

” তোমার ভিডিও ভাইরাল করে দেবো। ভয় দেখাচ্ছি না, সত্যি বলছি। তারপর আমি জে”লে গেলেও আফসোস হবে না। ”

আর কিছু বলতে পারলাম না, এলোমেলো পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে এলাম। মাথায় কাজ করছে না। এখন আমি কি করবো? রাতুলকে বললে অনেক কষ্ট পাবে, হয়তো আমাকে ভুল বুঝবে।
কি হয়ে গেল এসব! সুখের জীবন হারিয়ে ফেলেছি, সামনে সমূহ বিপদ।

পরের দুই পৃষ্ঠা ফাঁকা, কিছু লেখা নেই। রাতুল পাতা উল্টে দেখতে বললো। দুই পৃষ্ঠা ফাঁকা দিয়ে আবার লেখা শুরু করেছে।

কয়েকদিন ধরে বাড়িওয়ালার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। উনার সঙ্গে দেখা হলে বাজে ইঙ্গিত করে। এ ব্যাপারে রাতুলকে কিছু বলতে পারিনি। কিভাবে বলবো এসব কথা? আজ-কাল কোন কাজে মন বসে না, কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। দিনের বেশিরভাগ সময় পিয়াসী ভাবিদের সঙ্গে থাকি। নানান কথায় নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করি। তবে খুব বেশি লাভ হয় না। হঠাৎ করে এসব মাথায় আসলে ভয়ে হাত-পা কাঁপতে থাকে।


আজ-কাল রাতুলের সঙ্গে কথা বলতে গেলে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। কন্ঠ জড়িয়ে আসে। আমার এমন ব্যবহারে রাতুল খুব কষ্ট পাচ্ছে, ওর কষ্ট আমি বুঝতে পারি, কিন্তু কি করবো? ওর কাছে গেলে সবকিছু বলে দিতে ইচ্ছে করে, আবার ভয়ও হয়। যদি ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেয়। পুলিশের কাছে যেতেও ভয় করে, যদি ব’জ্জাত লোকটা বুঝে ফেলে। নিজের মানসম্পন্ন নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। মাথায় কাজ করে না। মনে হয় পা’গ’ল হয়ে যাবো। ”

ডাইরিটা বন্ধ করে রাখলাম। আর পড়তে পারছি না। চৈতীর কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটা এমন বাজে পরিস্থিতিতে ছিল। অথচ দেখে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই, কত সুন্দর হাসিখুশি ভাবে সকলের সাথে কথা বলতো। ওসি সাহেব একজন কনস্টেবলকে ডেকে পানি আনতে বললেন। কনস্টেবল সাহেব মাথা নেড়ে জগ থেকে পানি ঢালতে শুরু করলো। ওসি সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” পিয়াসী দেবী বোধহয় হাঁপিয়ে গেছেন। পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে নিন। মনে হচ্ছে আপনি অনেক আবেগি মানুষ। সামান্য ব্যাপারে একটু বেশি কষ্ট পান।”

সত্যিই আমার গলা শুকিয়ে গেছে। এমন ভ’য়ং’ক’র পরিস্থিতিতে কোন মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারে না। এসব কারণে বোধহয় চৈতী কথার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যেত। তারপর মলিন গলায় বলতো,’ কিছু ভালো লাগে না ভাবি, ম”রে গেলে সবকিছু মিটে যেত। ‘ পরক্ষণেই কথা ঘুরিয়ে ফেলতো।

রাতুলের চোখ কোণা ভিজে উঠেছে, হয়তো নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে