কুয়াশার আড়ালে সূর্য পর্ব-০৩

0
395

কুয়াশার আড়ালে সূর্য

৩.
বিয়ে পড়ানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। আর পাঁচটা বিয়ের মতো কুয়াশা ও উদয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। কুয়াশাকে নিয়ে ভেতরে এলো চম্পা খাতুন। কাজির সাথে আলাপনে বসেছে তারা।
‘কাল সকালেই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবেন।’ আব্দুল আহাদ কাজির উদ্দেশ্য করল বলল।
‘জনাব, আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো। আমাকে শুধু কল দিবেন। চলে আসবো।’
‘তাহলে আপনি আসতে পারেন।’ ওসমান মিয়া টাকা এগিয়ে দিয়ে বিদায় দিলেন কাজিকে। আব্দুল হাকিম সাহেব এবার মুখ খুললেন।
‘ওদের বিয়েটা এলাকার মুরুব্বিদের সামনে দিতে চাই।’
ওসমান মিয়ার মুখ শুকিয়ে এলো। বলল,
‘কেন?’
‘এটা আমার শর্ত।’
তিনি চিন্তিত হয়ে মিনমিন স্বরে বলল,
‘ঠিক আছে।’
আব্দুল হাকিম সাহেব এবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল উদয়ের পানে। বলল,
‘তোমার কিছু বলার আছে উদয়?’
‘নাই। তয় যা কওয়ার কাইল কমু নে।’
‘কাল বলতে? আজ বল যা বলবি।’ আব্দুল আহাদ কিছুটা ক্ষোভিত গলায় বলল।
‘থাক। জোর করার প্রয়োজন নেই।’ ওসমান মিয়া ছেলেকে নিষেধ করল।
আব্দুল আহাদ কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে তাকালো উদয়ের পানে। তারপর উদয়কে নিয়ে বাহিরে বের হলো ঘুরার পরিকল্পনা করে। বাহিরে বের হবার পরপরই আব্দুল আহাদ উদয়কে এক প্রকার শাসিয়ে বলল,
‘কুয়াশাকে স্পর্শ করার চিন্তাও করবি না। খু’ন করে ফেলবো।’
‘এতো চেতেন ক্যা। আমি কি কইছি কুয়াশারে ছুঁ মু?’
‘ভুলেও ভাবিস না।’
‘আইচ্ছা।’
‘কথা মনে রাখিস।’
‘মগজে রাখলাম।’
কথাটা শুনে আব্দুল আহাদ বাঁকা চোখে তাকালো। উদয়কে নিয়ে একটা টং দোকানের সামনে এসে দু কাপ চায়ের অর্ডার দিলো। মিনিট বাদে দু কাপ চা এনে দেয় একজন কর্মচারী। আব্দুল আহাদ চায়ে চুমুক বসালেও উদয় সেটি রাস্তার পাশে একজন ভিক্ষুকের হাতে দিলো। আব্দুল আহাদ সেটি দেখে খেঁকিয়ে বলল,
‘তাকে দিলি কেন?’
‘আমার চাইতেও তার খুব দরকার আছিল।’
‘বলছে সে?’
‘মানুষ হইয়া যদি মানুষের দুঃক্ষ না দেহি, তায় আমি কেমন মানুষ।’
‘চা যখন দিয়েছিস তুই সেটার বিল দিবি।’
‘আইচ্ছা।’ বলেই উদয় দু’টি ভন রুটি নিয়ে লোকটিকে দিলো।
কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে বয়স্ক লোকটি উদয়ের পানে চেয়ে রইলো।
কত স্নেহময় সেই দৃষ্টিতে লেপ্টে রয়েছে। ফিরে এসে উদয় বিল মিটিয়ে আব্দুল আহাদের সঙ্গে কুয়াশাদের বাড়ির নিকট হাঁটা ধরলো। ওসমান মিয়া তখনো সেই বাড়িতেই ছিল। রাতে এক সঙ্গে খেয়েদেয়ে বাড়িতে ফিরেছে বাবা-ছেলে।
এগোরটা নাগাদ উদয়কে কুয়াশার রুমে পাঠানো হলো। দরজা বন্ধ করে পেছনে ফিরে পুরো রুমটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বড়ো ও দামী আসবাবপত্রে ঠাসা রুমটি। দেয়ালে রয়েছে কুয়াশার ছোট বেলার কয়েকটি চিত্র।
উদয় সব উপেক্ষা করে কুয়াশাকে খুঁজছে। বেলকনির দরজায় দাঁড়াতেই কুয়াশাকে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে দেখতে পায়। উদয় কোনো প্রকার ইতস্তত বোধ না নিয়ে হালকা গলা খাঁকারি দিলো। পিছনে কারো উপস্থিত টের পেয়ে কুয়াশার ভাবনায় ছেদ পড়ে। শাহাদাত আঙুল দ্বারা চোখ মুছে পিছনে ফিরে উদয়ের পানে চেয়ে অকপটে বলল,
‘আপনি এসেছেন? ডাকলেন না কেন আমায়? ভেতরে আসুন।’ বলতে বলতে কুয়াশা ভেতরে চলে এলো। উদয় দু পা ভেতরে ফেলে কুয়াশার স্বাভাবিক আচরণ দেখছে। বিছানার চাদর ঠিকঠাক করে বাশিল পাশাপাশি রাখলো। কোলবালিশ বাঁ পাশে ফেলে রেখে টেবিল থেকে দুধের গ্লাস হাতে তুলে উদয়ের দিকে তাক করে ধরে মৃদু হেসে বলল,
‘দাদী বলল আপনাকে দিতে।’
উদয়ের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ দেখা গেল। গ্লাস হাতে নিতেই বিছানায় বসল কুয়াশা। উদয়ও ঠিক দু হাত দূরত্ব বজায় রেখে বসে কুয়াশার পানে তাকালো। মুখ খুলে কিছু বলার পূর্বে কুয়াশা তড়িঘড়ি বলল,
‘দূরে কেন? পাশে এসে বসুন। আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে পাশে বসার।’
উদয় মৃদু গম্ভীর গলায় বলল,
‘তুমি আমাকে যা ভাবছো আমি সেরকম নই।’
কুয়াশা যেন অবাক হলো। পরক্ষণেই হেসে জবাব দিলো,
‘আপনাকে নিয়ে ভাবার সময়টুকুও আমার যে নেই। কালই আবার নতুন বউ সাজতে হবে আমায়।’
‘জানি। খেয়েছো?’
‘মাতৃত্বের সমতুল্য দাদী বেঁচে থাকতে না খেয়ে ঘুমাবার উপায় নেই। আচ্ছা আপনি বিয়েতে কেন রাজি হলেন? টাকার জন্য?’
উদয় সেকেন্ড কয়েক চুপ থাকে। কুয়াশার প্রশ্নসূচক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বলল,
‘তোমার স্বপ্ন এবং ইচ্ছে সম্পর্কে জানতে চাই।’
কুয়াশা এবার উঁচুস্বরে হেসে ফেলে। যেন উদয় কোনো মজার গল্প শুনিয়েছে ব্যাপারটা তেমন লেগেছে তার। হেসে হেসে কুয়াশা বলল,
‘বন্দিনী মেয়েদের স্বপ্ন-ইচ্ছে থাকতে নেই।’
‘তবুও জানতে চাই।’ অধিক আগ্রহ নিয়ে বলল।
‘সময় নষ্ট করবেন না। আজ রাতটুকু সময় আছে আপনার কাছে। অধিকার বুঝে নিন।’ গুরুতর মনোভাব নিয়ে বলল কুয়াশা। উদয় দুধটুকু পান করে টেবিলের ওপর গ্লাস রেখে বলল,
‘ঘুমাবো আমি। বাকি কথা কাল বলল।’ বলতে বলতে উদয় বাঁ দিকেই শুয়ে পড়ে কোলবালিশটি মাঝখানে রেখে। কুয়াশা সবিস্ময় নয়নে উদয়ের পিঠের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো। পরপরই লাইট অফ করে বেলকনিতে এসে ইজিচেয়ার বসলো। চাপা কষ্টগুলো চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু হয়ে টুপটাপ ঝড়ছে। উদয় পিছনে ফিরে অপনপ্রান্তে হাত বুলিয়ে দেখে বিছানা শূন্য। উঠে বিমর্ষ নয়নে বেলকনির পানে তাকায়। অপেক্ষা করতে লাগলো কুয়াশার ঘুমানোর। বালিশে মাথা রেখে কপোলে এক হাত রাখে। আঁকিযুগল বন্ধ করে দূরদূরন্তের ভাবনায় ডুব দেয়। কেটে যায় এক ঘন্টা। ফোনের ফ্লাশলাইট অন করে। খাট থেকে নেমে বেলকনিতে এসে কুয়াশাকে পাজলা কোলে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কিছুক্ষণ স্নেহময় নয়নে তাকিয়ে গালে হাত বুলায়, পরপরই আলতো চুমু এঁকে সোফায় শোয়।

সকাল আটটার দিকে আব্দুল হাকিম সাহেব ঘুম থেকে উঠে ড্রইংরুমের সোফায় বসলেন পেপারে নজর বুলাতে। এ যে তার নৃত্যদিনের কাজ। হাঁক ছেড়ে চম্পা খাতুনকে চা নিয়ে আসতে বলতে ভুল হলো না তার। তার হাঁক ছাড়া শেষ হতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ নিয়ে পেপার ছেড়ে দরজার দিকে অগ্রসর হন তিনি। দরজা খুলতেই একজন যুবক তাকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব নিতে নিতে যুবকটিকে আগাগোড়া মেনে নিলো। কালো প্যান্ট ও হাতা ফোল্ড করা সাধা শার্ট পরিধান। এক হাতে তার ল্যাপটপ। অপর হাতে দু’টি কালো রঙের শপিং ব্যাগ। মাপা শেষে ওনি প্রশ্ন করলেন,
‘কাকে চাই?’
যুবকটি বিনয়ী স্বরে উত্তর দিলেন,
‘আমি আলামিন। স্যার আমাকে আসতে বলেছেন।’
‘স্যার কে?’
‘সূর্য এহসান।’
‘এ নামে এখানে কেউ থাকে না।’ বলেই তিনি দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হতেই পিছন থেকে উদয় বাধা দিয়ে বলল,
‘থাকে, এটা তার শ্বশুর বাড়ি।’
তিনি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলো উদয়ের পানে। তাকে আরো বিস্মিত করে দিয়ে আলামিন ব্যাগ এবং ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘স্যার আপনার যাবতীয় সব রয়েছে।’ এগিয়ে দিলো শপিং ব্যাগ সহ ল্যাপটপটি। উদয় সব হাতে নিয়ে আলামিনের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আব্বুকে বলে দিও আমরা আসতেছি।’
‘ওকে স্যার।’ আলামিন চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় আব্দুল আহাদ ও ওসমান মিয়ার সঙ্গে তার চোখাচোখি হলো। গেট বন্ধ করতেই তাদের দেখে উদয় আর বন্ধ করে না। আব্দুল হাকিম সাহেব স্তম্ভিত হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে উদয়কে দেখছে। সে আসলে কাকে দেখছে জানে না, উদয় নাকি সূর্য কোনটা বলে সম্বোধন করবে বুঝতে পারছে না। তিনি এক প্রকার চ্যাঁচিয়ে উঠলেন,
‘তুমি কে? কী পরিচয় তোমার? সূর্য কার নাম?’
উদয়কে তার এরূপ প্রশ্ন করাতে আব্দুল আহাদ ও ওসমান মিয়াও ভারী অবাক হলেন। কপোলে ভাজের রেখা বাপ-ছেলের সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মস্তিষ্ক কার বিগড়েছে প্রশ্নটি তাদের!

চলবে?

®সুমাইয়া মনি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে