#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব- ৯
সন্ধ্যাতারাটা আকাশের বুকে আজ জ্বলজ্বল করছে খুব। দক্ষিণ থেকে আসা হিমেল হাওয়া শরীরের প্রতিটি লোমকূপে কা-টা দিচ্ছে মৈত্রীর। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সে পলকহীন তাকিয়ে আছে আকাশের বুকে ওই এক টু-ক-রো তারার পানে। বুক ফে-টে কান্নার জোয়ার উঠে আসছে কণ্ঠদেশে অথচ সে কাঁদে না আজ অনেক গুলো বছর হলো। তার খালা বলে এটা তার একটা মানসিক স-ম-স্যা। বি-প-দ আপদে একজন সুস্থ মানুষ অবশ্যই আবেগী হবে তার চোখে জল আসবে প্রচণ্ড য-ন্ত্র-ণায় কিন্তু তার তেমনটা হয় না। সে কবে শেষ হেসেছিল মুখ খুলে, কবে কেঁ-দেছিল ঠোঁট ফুলিয়ে সেটা তার মনে নেই। মাকে তো হারিয়েছে ছোট বেলাতেই এতদিনে তো কিছুটা পরিবর্তন আসা উচিত তার। কিন্তু না তারমধ্যে কোন পরিবর্তন নেই। এই যে এখন মন কেমনের কা-ন্না আছে ভেতরে ভেতরে সেটা বাহিরে কেন স্পষ্ট হয় না! কেন তার ক-ষ্টগুলো গাল গড়িয়ে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায় না শূন্যে! শিপলুর আম্মু যখন পাত্র আর তাকে তার রুমে দিয়ে গেল কথা বলার জন্য তখন তার হুট করে মনে পড়ল বিড়ালচোখা লোকটার কথা। পাত্রের করা প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিলো, “তোমার কি নিজস্ব কোন পছন্দ আছে? পরিবারের পছন্দে বিয়ে করতে আ-পত্তি নেই তো কোন প্রকার?”
মৈত্রীর তখন ইচ্ছে করছিলো মুখের ওপর বলে দেয়, “আমার পছন্দ আছে কিন্তু কারো সাথে প্রেম নেই। আমার একজনের প্রতি দীর্ঘ পাঁচ মাসের ভালোলাগা আছে কিন্তু তার কোন সু দৃষ্টি কিংবা ভালো লাগা নেই আমার প্রতি। আমি পরিবারের পছন্দে বিয়েতে আপত্তি জানাতে পারব না কিন্তু সেই মানুষটাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের বলেও ভাবতে পারব না।”
তার এই কথাগুলো মন কুঠিতেই ব-ন্দী হয়ে ছটফট করেছে কিন্তু ঠোঁট ভেদ করে উচ্চারিত হতে পারেনি। মেহমান চলে যেতেই সে বেলকোনিতে দাঁড়িয়েছিল। আকাশসম দুঃ-খ নিয়ে তাকিয়েছিল নিচতলার বেলকোনিটাতে। তার মন খা-রাপের পরিমাণ দ্বিগুণ করে দিয়েছে যখন দেখলো বিড়ালচোখা লোকটা ফোনালাপে লেগেছিল আধঘন্টা সময় নিয়ে। সেই থেকেই তার ভেতরে ঝ-ড় বইছে আর বাহিরটা হয়ে আছে শ-ক্ত পাথরের ন্যায়। আকাশে মেঘ নেই, শীতল হাওয়া নেই তার পাশে এক ছাঁদ শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই।
“আকাশে আজ নক্ষত্রের দেখা নেই কি দেখতে ছাঁদে পাঠানো হলো!” সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে পা রেখেই ইরশাদ কাউকে বলে উঠলো কথাটা৷ ঘোর অমানিশায় চোখে পড়েনি ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে কেউ দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ। সে তো শুধু মেহেরের জে-দ ভরা আবদারে বাধ্য হয়ে এখন ছাঁদে উঠে এসেছে কিন্তু তার ফোনালাপের স্বর শুনে ভীষণরকম চমকে গেছে মৈত্রী। রেলিংয়ে দু হাতে ভর রেখে সে তারার দিকেই তো তাকিয়ে ছিল। পেছন থেকে পুরুষ কণ্ঠ শুনে এক মুহূর্ত মনে হয়েছিল কথাটা বুঝি তাকেই বলছে মানুষটা। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখল মানুষটার কানে ফোন, মুখে হাসি৷ কি এত কথা বলছে ফোনে আর কার সাথে! সন্ধ্যার আগেও কতক্ষণ সময় বলল কথা তারপর শুধু নামাজটা পড়তে গেল ওই তো ফিরে আবারও ফোন হাতে৷ উদাস মন জমিনে এবার বিনা মেঘেই ব-র্ষণের প্রস্তুতি চলতে লাগল। ইরশাদ তখনও বোধহয় খেয়াল করেনি ছাঁদে থাকা মানবীকে। সে এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেঁষতেই চোখে পড়ল মৈত্রীকে৷ সে ফোন হাতেই কিছু বলতে চাইছিল মেয়েটিকে কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়েই চঞ্চল পায়ে নেমে গেল মৈত্রী।
“এ্যাই তুই ফোন রাখ বাঁচাল। এত কথা কোথায় শিখলি রে!”
“কোথায় শিখলাম তা বাদ দাও আগে শোনো ভাই আজ কি কি করেছে আমার বান্ধবীদের সাথে। আমার বান্দবী রিয়া ভাইয়াকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলো বলে শপিংমলে সবার সামনে বলে কিনা, ‘এই পুঁচকি দুধের দাঁত তো এখনো পড়েনি এই বয়সেই ছেলেদের দিকে নজর দিচ্ছো! ঠা-টিয়ে লাগাব এক কানের পিছে।’ জানো শাদ ব্রো আমার বান্ধবী খুব ক-ষ্ট পেয়েছে সে আমার সাথে বন্ধুত্ব শে-ষ করে দিয়েছে।”
ভাইয়ের প্রতি ক্ষো-ভ আর ইরশাদের কাছে যেন অ-ভিযোগ প্রকাশ করছে মেহের। এমনটাই মনে হলো ইরশাদের কিন্তু তার তো মনে খচ-খ-চানিও হচ্ছে মৈত্রীর অমন তাকে দেখে নেমে যাওয়াটা। এই মেয়েটা এমন কেন! সবসময়ই উ-দা-স, অ-স্থির, অস্বা-ভাবিক আচরণ! এমন কি শুধু তার সামনেই নাকি সবসময়ই?”
মুজিব সাহেব নিজ ঘরে বসে ব্যক্তিগত ডায়েরিটা বের করলেন। রোকসানাকে ডেকে একে একে মৈত্রীর নানী, বড় মামা আর বড় খালার নাম্বার বের করতে বললেন৷ মেয়ে তার নিজের হলেও মেয়ের জন্য নেওয়া কোন সিদ্ধান্ত তাঁর একার হতে পারে না৷ সুমনা মানে মৈত্রীর মায়ের ভাই বোনের মতের বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নিলে তারা যে মুজিবের গ-র্দা-ন নিতে পিছুপা হবেন না সে কথা তিনি খুব জানেন। তাই পাত্রের ছবিসহ লম্বা বায়োডাটা কপি সেন্ড করেছেন তিনজনের হোয়াটসঅ্যাপে। তাদের জবাব শুনে তবেই না পাত্রপক্ষকে জানানো হবে তারা কবে যাবে। রোকসানা অবশ্য এ নিয়ে কিছুই ভাবছেন না৷ তিনি যাই ভাববেন তাতেই দোষ বের করবে মৈত্রীর খালা রোমানা। মৈত্রীর মায়ের ঘরে সে আসার চেষ্টা করেছিল খুব মৈত্রীর মা হয়ে এ কথা অজানা নেই রোকসানার। মুজিব রোমানাকে নাকি বোন হিসেবেই দেখে এসেছে সবসময় তাই শালিকে বিয়ের প্রস্তাব প্র-ত্যাখান করে রোকসানাকে বিয়ে করেছিলেন। সেই থেকেই মৈত্রীর নানা বাড়ির সবাই মুখ কালো করে আছে আজ অনেকগুলো বছর ধরে। তবে সুমনার মেয়ের ব্যাপারে তারা দূর থেকেই বড় ক-ঠি-ন নজর রেখেছে মুজিব আর রোকসানার দিকে। অর্থের জো-র এ বিষয়ে তাদের খুব সহায়ক। পরপর তিনজনকে বায়োডাটা কপি সেন্ড করে মুজিব প্রথমেই কল দিলেন শ্বাশুড়িকে। বৃদ্ধা দেশে নেই আজ প্রায় আট মাস ধরে। মেয়ে রোমানা প্রবাসে স্যাটেলড সেখানেই আছেন৷ পরপর কয়েকবার কল করেও পাওয়া গেল না ভদ্রমহিলাকে বাধ্য হয়ে কল দিলেন শালির নাম্বারে। রোকসানা এ সময়ে খুব ত-ট-স্থ তার মনে মনে রা-গ হয় রোমানার সাথে যোগাযোগের সময়টুকু। অনেকটা দাঁতে দাঁত চে-পে স*হ্য করেন স্বামীর সাথে ওই নারীর আলাপের মুহূর্ত৷ আজও ব্যতিক্রম নয়৷ রোমানাকে ফোন দিতেই সে প্রথমেই খুঁচিয়ে বলল, “বড় জলদিই মনে পড়ল আমাকে? বউয়ের আঁচল ছেড়ে আমাকে কল দেওয়ার সুযোগ পেলেন আপনি?”
কল রিসিভ করেই বিনা সম্মোধনে এমন বাক্য একদমই কা-ম্য ছিলো না মুজিব সাহেবের। কিন্তু পরিস্থিতি নিজ থেকেই বা-জে হয়ে উঠল। তিনি রোমানার কথাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সরাসরি মৈত্রীর কথা তুললেন। রোকসানা স্বামীর পাশাপাশি বসা আর ফোন স্পিকারও লাউডে থাকায় প্রথম কথাটা শুনেই রে-গে গেলেন। কোন আওয়াজ না করলেও দৃষ্টির ধা-রালো ভাব দিয়েই স্বামীকে রা-গ প্রকাশ করলেন। মুজিব দু দিক থেকেই আ-পসেট হলেন এই নারীদের আচরণে কিন্তু এই মুহুর্তে তার জন্য জরুরি মেয়ের কথা বলা। রেমানাকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি বললেন, “হোয়াটসঅ্যাপে তোমাকে, আম্মাকে আর বড় ভাইকে একটা ছেলের বায়ো পাঠিয়েছি। মৈত্রীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে খুব ভালো এক ফ্যামিলি থেকে। তোমরা বায়ো দেখো ভালো মন্দ যাই লাগে আশা করি শিগ্রই জানাবে যেন আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারি। পাত্রপক্ষ মৈত্রীর ছবি দেখে খুবই পছন্দ করেছে তাই চাইছি সামনাসামনি দেখা সাক্ষাতের আয়োজন করতে।”
অতি সন্তর্পণে লু-কিয়ে গেলেন আজকের সাক্ষাতের ব্যাপারটা। তিনি ভালো করেই জানেন এই নারী যদি জানতে পারে আজই দেখাদেখি হয়ে গেছে তাহলে নিজের মা-ভাইকে উল্টাপাল্টা বোঝাবে। বলে বসবে তাদের ছাড়াই মেয়ে বিয়ে দিয়ে ফেলছে তাই এই লুকানো। রোমানা সব শুনলো আরও কিছুক্ষণ মুজিবকে কথার বা-ণে আ-ঘা-ত করে তবেই ফোন ছাড়লেন৷ এরপরই মৈত্রীর বড় মামার সাথে যোগাযোগ করলেন এবং তিনি বলে বসলেন, নিজে একবার খোঁজ নেবে পাত্রের এরপরই এ বিষয়ে কথা বলবেন। এখানেই শ্বাস টা-ন পড়লো মুজিবের। এই লোক এবার পাত্রের জ্ঞাতিগুষ্টি সব দেখে তবেই কথা আগাবে। কে জানে কতোটা সময় নষ্ট করবে! মুজিব নিজে খোঁজ নিয়েছে এবং ইরশাদের বাবা ফখরুলের চেনাজানা লোক শুনে উনার মাধ্যমেও খোঁজ নিয়েছেন। পাত্র জাপানে যাবে পি এইচডি করতে, ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি সব আছে তারওপর পাত্রও দেখতে মাশাআল্লাহ। মনে মনে এবার ভয় লাগছে মৈত্রীর মামা কোন দোষ না বের করে বলেন এই পাত্র পছন্দ নয়। এসব কথা ভেবেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
“ইরশাদের মা ছেলেটাকে দেখেছো?”
ফখরুল সাহেব রাতের খাবার খেতে বসে প্রশ্নটা করলেন স্ত্রীর উদ্দেশ্যে৷ ইরিন বেগম ইরশাদ আর তার বাবাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন। স্বামী করা প্রশ্ন শুনে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন৷ তাঁর এই শ্বাসের অর্থ ইরশাদের বুঝতে একটুও ভু-ল হয়নি তাই যথা সম্ভব দ্রুত খাবার গি-লতে চেষ্টা করছে। ফখরুল সাহেব বললেন, কি হলো কিছু বলছো না যে!
“পাত্রের বয়স আমার ময়ূখের সমান হবে। এই ছেলেকেই বাবা -মা বিয়ের করার জন্য সুন্দরী মেয়ে দেখে ফেলছেন আর আমার ঘরে তার চেয়েও বড় একটা ছেলে আছে৷ আমি বিয়ে দেব তো দূর এখনও পাত্রী খেঁজারই সুযোগ পাচ্ছি না। ঘরে পুত্রবধূর জায়গায় পাখি আর গাছপালা পালছি।”
ভাতের লোকমায় দৃষ্টি রেখে ইরশাদ বিড়বিড় করলো, “দুনিয়ায় বিয়েটা এত জরুরি কেন?”
“তুমিও খোঁজো আমি বলি কি মুজিব ভাইয়ের মেয়ের যদি এ জায়গায় বিয়ে না হয় তবে আমাদের ছেলের জন্যই প্রস্তাব দিয়ে ফেলো।”
“কিহ!” একসাথে দু দুটো কণ্ঠ একই শব্দ উচ্চারণ করে উঠলো। আর সেই শব্দে খাবার মুখে বিষম খেলেন ফখরুল সাহেব। গলায় ভাত আট-কে গেছে ভদ্রলোকের। কাশতে কাশতে চোখে মুখে পানি চলে এসেছে উনার। ইরশাদ দ্রুত নিজের চেয়ার ছেড়ে গ্লাসে পানি ঢেলে বাবার মুখের কাছে ধরল। ইরিনও স্বামীর পিঠে, বুকে মালিশ করে দিতে লাগলেন৷ কয়েক মুহূর্ত কা-টতেই ফখরুল সাহেব একটু স্থির হয়ে তাকালেন স্ত্রী -পুত্রেদ দিকে। ইরশাদ বাবার দৃষ্টিতে অপ্রস্তুত হয়ে কাঁচুমাচু করে বলল, ওই মেয়েটা ভালো একদম ময়ূখের বিপরীত খুব মানাবে তাদের দুজনকে৷ দেখো ব্যবস্থা করা যায় কিনা এমনিতেও ময়ূখ তো যেখানে যায় সেখানেই সুন্দরী মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করে ওকে বাঁ*ধার ব্যবস্থা করে ফেলো আম্মু নাক কা-টার আগে।”
চলবে
#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১০
“চায়ে কত চামচ চিনি দেব আব্বু?”
ময়ূখের হাতে থাকা টিভির রিমোটটা হাত ফসকে পড়ে গেল নিচে। মেহের বাবা- ভাইয়ের জন্য চা আর কফি বানাচ্ছিল। বাবার চায়ের চিনি কতটুকু প্রশ্ন করতেই ময়ূখ ভ-ড়-কে গেছে। আসলে তার খেলায় মনযোগ দেওয়া থাকলেও চিনি শব্দটা মস্তিষ্ক আলোড়িত হয়েছে। এমনটা তার নতুন হচ্ছে না। সেই যে মিস চিনির কাছে চিনি চাইতে গেল তারপর থেকেই সে চিনি শুনলে, দেখলে এমনকি চায়ে মিশিয়ে খেতে গেলেও অদ্ভুতরকম আচরণ করে। মাঝেমধ্যে মনে হয় তার পক্ষে সম্ভব হলে দুনিয়া থেকে চিনি খাওয়ার রীতিটা বন্ধ করে দিতো।
“কি হলো!” ময়ূখের বাবা প্রশ্ন করলেন।
মেঝে থেকে রিমোটটা তুলতে তুলতে ময়ূখ জবাব দিলো, “কিছু না।”
“তোমাকে যা বলা হলো তা নিয়ে কি ভাবলে?”
খন্দকার সাহেব এবার গ-ম্ভীর দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন কথাটা। ময়ূখের এতে পরিবর্তন নেই সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ” ভাবার তো কিছু নেই। আমি আম্মার কাছে আম্মার সন্তান হয়েই পাশে থাকতে চাই। এসব সম্পত্তি মামাদের পাওনা নানা যা করে গেছেন তা অ-ন্যায়। মেয়ে মা-রা গেছে বলে মেয়ের সন্তানকে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দেওয়া কোথাকার ইনসাফ? আর আপনিই কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন! আপনার কি আরও কিছু দরকার?”
ছেলের মুখের কা-টকা-ট জবাব পছন্দ হলো না আবরার খন্দকার এর। তিনি বিরক্ত চোখে ময়ূখের দিকে তাকালেন। মনে মনে ভাবলেন এই ছেলেকে ব-শে আনতে এখন তার একমাত্র চাবিকাঠি তার বোন। ইরিন ছাড়া ময়ূখ আর কারো কথাই শুনবে না এ ব্যাপারে। কিন্তু ইরিনের সাথে কিভাবে কথা বলবেন! এতগুলো বছর পর নিজ প্রয়োজনে কথা বলতে যাবেন ছোট বোনের সাথে তাতেও মাথা নত করতে হবে ভেবেই অ-স্বস্তি হচ্ছে। ছেলেকে আর আপাতত না ঘাটিয়ে মেহেরের বানানো চায়ে মন দিলেন। চায়ে প্রথম চুমুক দিতেই তিনি মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটা যে এতো ভালো চা বানায় তা তিনি জানতেনই না। এই প্রথম চা বানিয়ে খাওয়ালো মেহের। ততক্ষণে ময়ূখও কফিতে চুমুক দিয়েছে।
“ইয়াখখখ এ কি বানিয়েছিস তুই এ্যা বি-ষ দিলি নাকি কফিতে!” মেহেরকে ক্ষে-পা-নোর সুযোগ কখনোই মিস করে না ময়ূখ। ভাইয়ের এমন রিয়াকশন দেখে সে কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকালো।
“চা কি খুব খারাপ হয়েছে আব্বু?”
“নাতো মামনি তোমার চা খুব ভালো হয়েছে। আমি তো জানতামই না আমার মামনিটা চা বানাতে পারে। আর আনন্দের ব্যাপার হলো তোমার চা একদম ইরিনের চায়ের মত হয়েছে। আদা আর এলাচ দিয়েছো বোধহয় সাথে।” কথাটা বলতে গিয়ে খন্দকার সাহেব কেমন নস্টালজিয়ায় উ-দাস হয়ে পড়লেন। বি-ম-র্ষ মুখে তাকিয়ে রইলেন চায়ের কাপে।
মেহের জানালো দুধ চায়ে মশলা দেওয়া সে ফুপির কাছেই শিখেছে।
ময়ূখ তাকিয়ে আছে বাবার মুখপানে৷ আজ প্রায় কতগুলো বছর হয়ে এলো আম্মা এ বাড়িতে পা রাখে না। আর আব্বুও যায় না একমাত্র বোনের বাড়ি৷ লোক সম্মুখে তাদের দু ভাই বোনের ভেতর ছোট ভাইকে নিয়ে মনো-মা-লিন্যতা। সে কারণেই তো তারা একসাথে হয় না, কেউ কারো সাথে সরাসরি কথা পর্যন্ত বলে না। ‘কেউ’ না কথাটা হবে ইরিন বলেন না। ময়ূখের বাবা তো এটা সেটার উছিলায় মেহেরকে পাঠান রাজশাহীতে যেন কোন রকমে ইরিনকে আনা যায় বাড়িতে। কিন্তু বোনটা বড্ড জে-দি কিছুতেই আর বাপের বাড়িতে পা ফেলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ে মন দিলেন ময়ূখের বাবা আর ময়ূখ ভাবছে আম্মা আর আব্বুকে এবার একসাথে করা উচিত। কখনো যদি মেহের কিংবা ইরশাদ ভাই তার সাথে কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তার তো দমই ব-ন্ধ হয়ে যাবে সেখানে আব্বুদের এত বছরের দূরত্ব কেমন লাগছে তাদের! সে তার বাবাকে খুব বেশি ভালোবাসে না এমনকি শ্রদ্ধার ক্ষেত্রটাও বোধহয় খুব দূর্বল। তবুও জন্মদাতা তো তিনি তা ভেবেই না হয় এবার কিছু করা যাক। ময়ূখ এরপর আরও পাঁচ দিন ঢাকায় থাকলো তারমধ্যে বিসিএস পরীক্ষাটার ডেট পরিবর্তন হয়ে গেছে। ময়ূখের বাবা জো-র করল ছেলে যেন ব্যবসায় মন দেয় কিন্তু ময়ূখের এক কথা তার ভবিষ্যত প্লানিং হয়ে গেছে। সে কিছু একটা তো হবে তবে তা ব্যবসায়ীর বাইরে। আর এ বাড়িতেও থাকার কোন ইচ্ছে নেই। আম্মার কাছেই থাকবে সে আজীবন। বিয়ে করবে আম্মার পছন্দেই বউ বাচ্চা নিয়েও তার জীবন কাটবে সেই ছাদের তলায় যেখানে তার আম্মা-বাবা আর ইরশাদ ভাই থাকবে। আবরার খন্দকার একবার রে-গে গেলেন এই ভেবে তাঁর সন্তান তাঁর বার্ধ্যকে পাশে থাকবে না এ কেমন কথা! পরমুহূর্তেই মনে পড়লো এই সন্তানকে তিনি দু বছর বয়সে রেখে এসেছেন বোনের আঁচলে। কি করে সেই সন্তানের আশা করতে পারেন এখন! ছেলের আর্থিক দিকটা দেখার বাইরে আর কিছুই দেখেননি। মনে পড়ে এখন ময়ূখ ছিল বাবার ন্যাওটা। মায়ের মৃ-ত্যুর পর সে বাবা ছাড়া আর কারো কাছেই থাকতে চাইতো না। কিন্তু সে সময়টাতেই তিনি ছেলেকে কাছে রাখতে পারেননি। এখন কি করে সেই ছেলেকে নিজের কাছে পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন! সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক কোথাও হালকা তো কোথাও ভা-রী হয়েছে। নিঃসন্দেহে তাঁর নিজের দিকেই হালকা হয়ে গেছে। ময়ূখ আজ রাতের বাসে চলে যাবে রাজশাহী। খুব করে বোঝালেন ছেলে যেন একটা গাড়ি নিয়ে যায় প্রয়োজনে নিজ পছন্দে যেন নতুন একটাই নেয় আজ এক্ষুনি তিনি কিনে দেবেন। কিন্তু না ময়ূখ বড় হয়েছে ফখরুল সাহেব এর উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। সেখানে একটা গাড়ি ছিল পুরো পরিবারের জন্য বাধ্য হয়েই সে ছোট থেকে বড় হয়েছে বাস, সিএনজি এবং সুযোগ মিললে পারিবারিক গাড়িতে চড়ে। সেক্ষেত্রে ছেলে এখন বাবার পয়সার গাড়ি নিতে অ-স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ময়ূখ রাতের খাবার খেয়েই বিদায় নিলো। ইরশাদকে ফোনে জানানো হলো সে আজই চলে আসছে বাড়িতে। ব্যস এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল ইরিনের ঘর আনন্দ উল্লাসে ভরিয়ে দিতে।
নিজের ঘরে বসে কিছু আর্ট পেপার আর রঙতুলি নিয়ে মৈত্রী বসে গেল মেঝেতে। একটু আধটু শীত পড়ছে বলে এখন সন্ধ্যার পর মেঝেতে পা ফেললে গা শিরশির করে উঠে। বসার পর গা শিরশিরানি টের পেয়েও সেখানেই বসে রইল সে। হাতে তুলি হলুদ রঙ ছোঁয়ানো। পেপারে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে একটা সূর্যমুখী ফুল। এ বাড়ির ছাঁদে গত পরশু তিনটি ফুল গাছ জায়গা পেয়েছে। ইরশাদ বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের অনুমতি নিয়ে তবেই এনেছে সেগুলো। একটা সূর্যমুখী, একটা সাদা গোলাপ তৃতীয়টি চন্দ্রমল্লিকা। গোলাপে এখনো কোন কলি আসেনি একদমই ছোট কিন্তু চন্দ্রমল্লিকা আর সূর্যমুখীতে কলি ছিল। আজ যখন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ছাঁদে গিয়েছিল তখন চোখে পড়েছে আধ ফুটন্ত সূর্যমুখীটা। সেই থেকেই মনে মনে এঁকে চলছে এই ফুলটাকে আর এখন তা রঙতুলির ছোঁয়ায় কাগজে দৃশ্যমান করল। বাবা সকালে মামনিকে বলছিল তার মেয়েটা কি সত্যিই অসুস্থ! মৈত্রী আজকাল আড়ালে অনেক কথাই শুনে নেয় বাবা-মামনির। এমন তার স্বভাব আগে ছিল না কেন জানি হুট করেই হয়ে গেছে। পাত্রপক্ষ থেকে যখন রিজেকশন এলো বলে ঘরে একটা আনন্দের আভাস পেয়েছিল সে কিন্তু হুট করেই পাত্রপক্ষ আজ মানে দেখে যাওয়ার চারদিন পর কিছু কারণ দর্শিয়ে তাকে রি-জেক্ট করল। এতে করে ঘরে আবার চাপা এক ক-ষ্টের উদ্রেক টের পাচ্ছে সে। বাবা নিশ্চয়ই খুব আশায় ছিলেন মেয়ের বিয়ে দেবেন অথবা পাত্রকে খুব মনে ধরেছিল! মৈত্রী মনে করার চেষ্টা করল পাত্র দেখতে কেমন ছিল৷ অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না সেই লোকটার মুখাবয়ব। বরং তার চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো দুটো শুভ্রমেঘের মত চোখের তারা, হালকা দাঁড়িতে ঢাকা উজ্জল মুখখানা। দিন যত গড়াচ্ছে ততই মন গড়িয়ে পড়ছে নিচতলার সেই বেলকোনিতে। টিয়ার জোড়ার খু-নসুটিময় মুহূর্ত দেখতেই মৈত্রীর উ-ত্তেজনা হয় খু-নসু-টিতে মেতে উঠার জন্য। নারকেল গাছের ডালে বসে একটা টিয়া যখন অন্যটির গা ঘেঁষে বসে থেমে থেমে ঠোঁটের ফাঁকে ঠোঁট গুঁজে দেয়, পাখা নেড়ে রঙ ভঙয়ের সেই প্রেম প্রদর্শন! এসব দেখতেই লজ্জায় রা-ঙা হয় মৈত্রী৷ মনে হয় তারও একজন মানুষ হবে যে প্রেমে পরশে পাশে রবে আ-ম-রণ। আর সেই মানুষটা যদি হয় ওই নিচতলার শুভ্রচোখা, লম্বা-চওড়া সৌম্যদর্শন মানুষটাই! আর ভাবতে পারে না মৈত্রী। তার অনুভূতির অ-তল দরিয়ায় কখনোই সে ইরশাদকে নিজের সাথে ভাসতে বলতে পারবে না। কখনো সে পারবে না ইরশাদের মন জমিনের ফোঁটা পুষ্প হয়ে তাকে সুরভিত করতে। না হোক ইরশাদের সন্ধি অন্তত অন্য কারোও হবে না সে। পড়াশোনা শেষ করতেই পাড়ি জমাবে খালার কাছে সেখানে থেকেই কিছু করে একলা এক ভুবন তৈরি করে নিবে নিজের।
“মৈত্রী কি একটু নিচে যেতে পারবে। ইরিন ভাবীকে একটু হালুয়া দিয়ে আসতে। শুনলাম উনার ছেলেদের খুব পছন্দ গাজরের হালুয়া।”
হাত থেকে তুলিটা মেঝেতেই রাখল মৈত্রী৷ গায়ের ওড়নাটা ঠিক আছে কিনা দেখে সে মামনির হাত থেকে বাটিটা নিলো। আজকাল ইরিন এবং রোকসানার মাঝে যে বন্ধুসুলভ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই কারো। বিশেষ করে, রোকসানা খুব সখ্যতা প্রকাশে সর্বদা খাবার-দাবার আদান প্রদান চালায় খুব। মৈত্রী নিঃশব্দে, উত্তরহীন বাটি নিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে তা দেখে বরাবরের মতই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রোকসানা। মনে মনে বললেন, বলতে তো পারত আমি নিয়ে যাচ্ছি দিন! কিন্তু না মেয়েটা কোন কথাতেই জবাব দেওয়া জরুরি মনে করে না৷
সন্ধ্যের পরমুহূর্তগুলোতে ইরশাদ বাড়িতেই থাকে সবসময়৷ আজও সে নামাজ শেষে ঘরে ফিরেছে সবে। ঘরে ঢুকে প্রধান দরজাটা লাগানোর কয়েক সেকেন্ড পরই তা বেজে উঠলো। ইরিন রান্নাঘরে চায়ের পানি বসাচ্ছিলেন তাই ইরশাদই এগিয়ে গেল দরজা খুলতে। ইরিনও দৃষ্টি ফেলেছেন দরজায় কে এলো দেখার জন্য । ইরশাদ দরজা খুলতেই দেখা মৈত্রীকে দেখে ইরশাদ প্রথমে মাকে বলল, “মৈত্রী এসেছে; ভেতরে এসো মা রান্নাঘরে।” পরের কথাটা মৈত্রীর উদ্দেশ্যে। মৈত্রী চোখ তুলে তাকায়নি একবারও চুপচাপ হেটে চলে গেল রান্নাঘরের সামনে।
“কি নিয়ে এলে!” বড় আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করলেন ইরিন। মৈত্রীর কানে সেই আন্তরিকতা কেমন যেন গদগদ ভাব বলে মনে হলো। সে জবাবে ছোট করে বলল, “গাজরের হালুয়া।”
ইরশাদ দরজা খুলে দিয়েই চলে গেছে নিজের ঘরে। মৈত্রীর হাত – পা হালকা শীতেও কেমন ঘামছে বলে মনে হলো। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখতে ইচ্ছে করল পেছনে কি আছে সেই লোকটা! কিন্তু তাকানো হলো না সেদিকে। ইরিন চায়ে পাত্তি ঢেকে ট্রেতে কাপ সাজালেন তিনটি৷ মৈত্রীকে বললেন সোফায় বসতে। অনয়ান্য সময় সে এখানে এলে ছটফট করে বেরিয়ে যেতে আজ আর তা করছে না। ইরিন কাপে চা ঢেলে পিরিচে করে বিস্কিট নিলেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ট্রে হাতে মৈত্রীকে বললেন, “চলো বেলকোনিতে বসে চা খাই সবাই।”
“সবাই!” আঁতকে উঠল যেন মৈত্রী। সে বলতে চাইলো, “প্লিজ আন্টি সবাই না আপনার ছেলের পাশাপাশি তো একদমই না।” কিন্তু আশ্চর্য গলা দিয়ে আওয়াজটাই তো বের হচ্ছে না৷ ইরিন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ইরশাদের ঘরের দিকে৷ ছেলের ঘরে ঢোকার আগে অবশ্য তিনি আওয়াজ করে ঢুকতে ভুললেন না৷ মৈত্রীর মনে হলো আন্টি ছেলেকে সংকেত দিলেন, “আমরা তোমার ঘরে আসছি।”
কিন্তু আন্টির সংকেত বুঝি কান পর্যন্ত যায়নি ইরশাদের। তাইতো যখন তারা ভেতরে ঢুকলো ইরশাদ তখন হকচকিয়ে একবার তাদের দেখলো। মৈত্রী খেয়াল করেছিলো চেয়ারে বসা ইরশাদের সামনের ল্যাপটপটাকে। হয়ত তার দৃষ্টি দেখেই ইরশাদ তড়িঘড়ি শাটার ডাউন করলো। চোখ মুখের রঙটাও বুঝি একটুখানি বদল হলো ইরশাদের! কি ছিলো স্ক্রীণে! মৈত্রীর ঝাপসা দৃষ্টি বলছে সে স্ক্রীণে কোন মেয়েকে দেখেছে বিয়ের সাজে সেখানে দুটো পুরুষও ছিল। একটা বোধহয় ইরশাদ নিজেই ছিল। মৈত্রীর তেমনভাবে দেখতেই পারেনি ল্যাপটপের স্ক্রীণটা তবুও মনটা বলছে অন্যকিছু। ইরশাদকেও এবার খেয়াল করলো। ধা-রা-লো সৌম্য মুখখানা কেমন মুহূর্তেই বিবর্ণ আর পাণ্ডুর হয়ে গেল! ইরিনের মধ্যেও কিছুটা অস্বস্তি চোখে পড়ল মৈত্রী। মাত্র কয়েক মিনিট তাতেই যেন ঘরের মহলে চা-পা গাম্ভীর্যে ভারী হলো। অথচ মৈত্রীর ধারণায় নেই কোন কারণ৷ ইরশাদ ল্যাপটপ সরিয়ে রেখেছে। একটু হেসে মাকে বলল, ” আব্বু এলো না আজ এখনও? তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো বিছানায়। দেখি আম্মু আমার চা দাও তো।”
হড়বড়িয়ে একসাথে তিনটি বাক্য পূরণ করে ইরশাদ হাত বাড়ালো কাপের দিকে। ইরিনও একটা এগিয়ে দিলো মৈত্রীর দিকে। মৈত্রী আর ইরিন বসেছে পাশাপাশি বিছানায়। ইরশাদ চেয়ার ঘুরিয়ে তাদের মুখোমুখি হলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথা শুরু করল, “তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“জ্বী ভালো।”
“হালুয়া কে বানিয়েছে।”
ইরশাদ প্রশ্ন করতেই এবার ইরিন বলল, “রোকসানা ভাবী হয়ত বানিয়েছে তাইনা মৈত্রী? ”
“জ্বী আন্টি।”
“আম্মু চায়ে আজ চিনি একটু বেশিই মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ রে বুঝতে পারিনি। ও তোকে কি বলেছিলাম ময়ূখ একবার কি করেছে?” ইরিনের স্বতঃস্ফূর্ত এই কথার বিপরীতে মৈত্রীর মনে পড়লো এ বাড়িতে ময়ূখদের প্রথম দিনের কথা। ইরিনও ঠিক সে কথাই বলার জন্য মুখ খুলেছেন। ইরশাদও জানে কিন্তু মায়ের কথায় সে বুঝতে পারেনি কোন ঘটনার কথা তুলছেন তিনি। ইরশাদ কৌতূহলী হয়ে মায়ের দিকে তাকালো।
“এ বাড়িতে প্রথম দিন এসেই ময়ূখকে বলেছিলাম চিনি কিনে নিয়ে আয়। সে চলে গেছে দোতলায়। মৈত্রীকে চেনে না তবুও গিয়ে বলে কিনা একটুখানি চিনি দিতে।”
এবার ইরশাদের মনে পড়লো ঘটনাটা সে বলল, এতো আম্মু বাড়ির কথা। তুমি তো জানো না গত সপ্তাহে আমার কলেজে গিয়েছিল সে। অফিস রুমে দুটো মেয়ে এলো আমার কাছে বলল টিউশন পড়াতে। ময়ূখও তখন সেখানে উপস্থিত। মেয়ে দুটোকে পা থেকে মাথা অবধি একবার দেখে বলে কিনা, “তোমাদের স্যারের বউ রা-গ করে টিউশন পড়ালে তোমরা চাইলে স্যারের ভাইয়ের কাছে পড়তে পারো৷ শুধু পড়া না তখন সময় সুযেগে প্রেমও করবে সে বলো রাজী কিনা!”
এরপরের ঘটনা আমি জানতাম না সে সত্যিই মেয়ে দুটোকে পড়াবে বলে কথা দিয়ে এসেছে। ঢাকায় যাওয়ার দু দিন আগে আবার গেল তখন মেয়ে দুটি তাকে ধরতেই বলে কিনা, ইরশাদ স্যারের বউ বলেছে তার বরের সাথে দেবরও টিউশন পড়াতে পারবে না নইলে বাড়িতে জায়গা জু-ট-বে না। তার ওপর আবার আমার বউয়ের ছবিও দেখিয়ে এসেছে জনাব।
“হ্যায়!” ইরশাদের মুখে ঘটনাগুলো শুনে বিষ্ময়ে বাকহারা হয়ে গেলেন ইরিন। মৈত্রী তো প্রথমে চুপচাপ শুনছিল ঘটনাটা কিন্তু যেই শুনলো বউয়ের ছবি তখনই তার হাত পা আবার শিরশিরিয়ে উঠলো। অ-স্থিরতায় গলা শুকিয়ে কাঠ হলো সেই সাথে শুরু হলো এক, দুই, তিন এর অ-স্পষ্ট গণনা। ইরিন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো, “বউয়ের ছবি কই পেলো! ”
“মেহেরের ছবি দেখিয়ে এসেছে।”
“ওহ তাই বল। বাহ্ দারুণ একটা কাজ করেছে তো এই উছিলায় মেয়েদের ব-দ নজর থেকে বেঁচে যাবি বাবা।” ইরিনের এই কথাটা কেমন যেন কানে লাগল মৈত্রীর। সে চায়ের কাপটা ট্রে তে রেখে কম্পিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো, “আমি এখন যাই আন্টি।” কারো কোন জবাবের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেল সে। মা, ছেলে অবাক চোখে চেয়ে রইলো সেদিকে।
চলবে