কি ছিলে আমার পর্ব-৭+৮

0
2331

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব -৭

আবারও অ-স্থির লাগছে ভেতরে ভেতরে উ-ত্তে-জনা কাবু করছে মৈত্রীকে। সে তার পুরনো পন্থা আবারও বিড়বিড় করতে লাগলো, এক, দুই, তিন, চার…..

ইরশাদ এবার সরাসরি তাকালো মেয়েটার দিকে। আজ প্রথম নয় আরও কয়েকবার সে লক্ষ্য করেছে মেয়েটার সাথে দেখা হওয়ার কয়েক সেকেন্ড এর মাঝেই সে এমন ঠোঁট নাড়ে। কি বলে মেয়েটা অমন করে! তাকেই কি কিছু বলে নাকি অন্য কোন ব্যাপার, হতে পারে মেয়েটার কোন সমস্যা আছে। ইরশাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই শেলিকে বলল, “কি কিনছো শেলি?”

ইরশাদ প্রশ্ন করছে তাকে! তার ক্রাশ জানতে চাইছে কি কিনছে! ব্যস তাকে আর পায় কে? লজ্জায় ওড়নার আঁচল টেনে মুখের সামনে ধরে বলল, “বার্গার আর হটডাগ কিনমু আমরা।”

“ওহ আচ্ছা। ওটা হটডগ হবে।”

“জ্বে ভাইয়া আমি জানি ওইটার নাম৷ আপায় আমারে শুদ্ধটাই শিখাইছে কিন্তু ডগ অর্থ কুত্তা বইলা আমি ওই খাওনরে হটডাগ কই।”

একটু হেসে ইরশাদ বলল, “আচ্ছা বুঝলাম। এখানকার বার্গারগুলো বেশি ভালো। আচ্ছা চলি, আমি আবার এক জায়গায় যাব৷… এতোটা অস্থিরতা কি স্বাভাবিক! ”
একটু থেমে শেষের বাক্যটা মৈত্রীর একদম কাছ ঘেঁষে যাওয়ার সময় বড় ধীরে আর ফিসফিসিয়ে বলে গেল ইরশাদ যেন, মৈত্রী ছাড়া আর কেউ না শুনতে পারে৷ মৈত্রী শুনেছে এবং বুঝতেও পেরেছে কথাটা যে তার উদ্দেশ্যে। সে ভ-ড়কে গেছে এ কথা শুনে৷ সত্যিই তো এতোটা অ-স্থিরতা কি আদৌ স্বাভাবিক! সে কেন এমন অ-স্থি-র হয়ে উঠে? ইরশাদ চলে যেতেই স্বস্তির শ্বাস নিতে পেরেছে মৈত্রী। শেলিকে বলল, “এখানে বসে খাবি তুই?”

এই প্রশ্নে শেলি দারুণ খুশি হয়েছে। সে তো এমনটাই চাইছিল। এখানে খেলে মৈত্রী আপা তাকে শুধু হটডাগ না সাথে কোকও কিনে দিবে কিন্তু বাড়িতে নিয়ে গেলে তো তখন সে যেচে কোক চাইবে না। এমনিতেই আজকে জুতার সাথে চুড়ি আর একটা লিপস্টিকও কিনেছে। মৈত্রী আপার সাথে মার্কেটে এলে তো শেলির কপাল খু-লে যায় সবসময়।

সকালের রৌদ্রজ্বল ওয়েদার দেখে ভেবেছিল সুন্দর দিন। মেহের আজ প্ল্যান করেছে বিকেলে ভাইকে নিয়ে পছন্দের এক রুফটপ রেস্টুরেন্ট যাবে উত্তরায়। সাথে যাবে তার দুই বান্ধবী যার মধ্যে একজন আবার ময়ূখকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু দুপুর গড়াতেই আবহাওয়া আমূল বদলে গেছে। ঈশান কোণে কালো মেঘ জমেছে, সূর্যের আলোটাও ম্লান এখন। এদিকে ময়ূখও সেই যে সকালে ঘুমিয়েছে এখনো ঘুমেই আছে সে। রাতভর নাকি গাড়িতে ঘুম আসেনি তাই ক্লান্তিতে শরীর ভে-ঙে আসছে। মেহের আজ স্কুলে যায়নি এজন্য আব্বুকে দিয়ে স্কুলে কথা বলিয়েছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে ছুটি নেওয়া তাই বোধহয় সফল হবে না। মন খারাপ করে সে নিজের বিছানায় হাত পা মেলে শুয়েছিল। জরিনা খালা তার ঘরে ঢুকে বলল, “ওই লুই-চ্চা ছেড়াডা কয়দিন থাকব গো মেহের?”

“জরিনা খালা আমার ভাইকে লু-ইচ্চা বলবা না একদম।”
ক্রো-ধান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলো মেহের। এই জগলু সবসময় এভাবেই কথা বলে আর ভাইও যে কেন মহিলার সাথে ফা-জলামো করে বুঝে পায় না। ভাই না তার! তার ভাইকে কেউ লু-চ্চা, ছেড়া বলে ডাকলে কি সে সহ্য করতে পারে? জরিনা খালা মেহের ধ-মকে কিছুটা চমকে গেলেও থামলো না। সে আবারও বলল, “আমি ভুল কি কইলাম৷ ময়ূরডা তো সকল সমায় কেমুন কইরা কথা কয়, হুনলে লুই-চ্চা লু-ইচ্চা লাগে।”

“উফ জগলুওওওও বোঝো না কেন ভাই মজা করে তোমার সাথে। আর ভাইয়ের নাম ময়ূর না ময়ূখ কতদিন বলতে হবে তোমায়!”
এ পর্যায়ে মেহের বির-ক্ত হয়ে বোঝাতে চাইলো জরিনা খালাকে। জরিনাও এবার ভয় পেলো মেহের ক্ষে-পে গেলে তাকে দৌঁড়াতে হবে।

“আইচ্ছা আইচ্ছা আর কমু না কিছু।”

হাতে ঝাড়ু, মুখে পান সুতি শাড়িটা কোমরের ডান দিকে অনেকটা উঁচু করে গুঁজে রাখা জরিনার। সে মেহেরের ঘর থেকে বেরিয়ে নিচতলায় নামার জন্য পা বাড়াতেই দেখলো ময়ূখ দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরের দরজায়। উদোম গা, থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট আর উসকোখুসকো চুলের ময়ূখ ঘুম কা-টেনি অবস্থায় আধখোলা চোখে তাকালো জরিনার দিকে। বরাবরের মতোই জরিনাকে দেখে মাথায় তার দু-ষ্টু বুদ্ধি এলো। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় ডাকলো, “জগলুওওওও, শোনো তো। আজকেও তোমায় চমৎকার লাগছে।”

“হ্যায়!”

“বলছি শাড়ি এমন উঁচু নিচু কেন গো তোমার একদম বলিউড হিরোইনদের লেগ ওপেন গাউনের মত!” ময়ূখের মুখে মিটমিটিয়ে হাসির ছটা দেখতেই জরিনা ভীতু হলো। তার মনে হলো আবারও এই লুই-চ্চা তার দিকে কু-দৃষ্টি দিয়েছে তাই আত-ঙ্কিত চোখে তাকে দেখে বিড়বিড় করতে লাগলো, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা…. আর কে পায় জরিনাকে। জরিনার দৌঁড় দেখে দরজায় দাঁড়ানো ময়ূখ হো হো করে হেসে উঠলো তখনি কানে এলো অপ্রিয় কণ্ঠস্বর।

“কেন শুধু শুধু ওকে নিয়ে মজা করো এ নিয়ে সে বা*জে কথা বলে বেড়ায়।”

ময়ূখ কথাটা শুনে সিঁড়ি গোড়ায় দাঁড়ানো মানুষটিকে এক পলক দেখলো৷ কিন্তু জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করলো না সে। দরজা থেকে সরে ঘরে ফিরতে যাচ্ছিলো তখনই মানুষটি উদগ্রীব কণ্ঠে বলল, অনেক বেলা হয়েছে খাবার খেয়ে নাও নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে।

ময়ূখ সে কথায় তো-য়াক্কা না করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। আপাতত তার কাজ আম্মাকে ফোন করা। পৌছানোর পর ইরশাদকে জানানো হয়েছিল আর কথা হয়নি বাসায়। কিন্তু আগে গোসল জরুরি ভেবে ময়ূখ বাথরুমে ঢুকে সোজা গোসল সারল। জামা কাপড় বদলে আম্মাকে ফোন দিয়ে কথা বলল কিছুক্ষণ । ইরশাদ আর বাবার কথা জানতে চাইলে ইরিন বলল দুজনেই বাইরে আছে। সে নিজেও এখন ঘরে নেই দোতলায় এসেছেন মৈত্রীর কাছে। ‘মৈত্রী’ নামটা শুনতেই ময়ূখের চোখ দুটো কেমন জ্বল জ্বল করে উঠলো। মনে পড়ে গেল দিনমণির অস্তাচলে ভূলোকের রঙটা যেমন রক্তিম হয় তেমনি র*ক্ত-রঙা লাগে বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই স্বল্পভাষী মিত্রকে। ‘মিত্র!’ নিজ মনেই হেসে উঠলো ময়ূখ। এ কি ভাবছে সে, ওই মেয়েটা হবে মিত্র? অসম্ভব! যে মুখ খুলে দুটো কথার জবাব কাউকে দেয় না দিলেও যার কথার সুরে কোমলতার রেশ মাত্র নেই সে কি করে হবে কারো মিত্র! মেয়েটার নামের অর্থ বন্ধুত্ব হলেও নামের অর্থের ছিটেফোঁটা আভাসও নেই তার স্বভাবে ভেবে ভেবে মুচকি হাসলো। হু এই প্রথম ময়ূখ শব্দহীন হাসিতে ঠোঁট প্রশস্ত করলো। ফোনের ওপাশে ইরিন ডেকে চলছে, “বাবু কথা বলিস না কেন, তুই খাবার খাসনি কেন?”

মৈত্রী হাত পা তুলে বসেছিল সোফায়। তার পাশেই শেলি একটা বাটিতে করে কাজু আর পেস্তাবাদাম এনেছে গোটা কয়েক। দুজনে একসাথে বসে সেগুলোই মুখে পুরছিল। কিন্তু ইরিনের মুখে ‘বাবু’ ডাক শুনতেই মৈত্রী বি-ষ-ম খেলো, শেলির মুখ থেকেও একটা বাদাম পড়ে গেল নিচে। মৈত্রী মুখে কিছু না বললেও শেলি ঠিকই বিড়বিড় করলো, “বুইড়া ছেমরা হেরে কয় বাবু! আল্লাহগো হেই ছেমরা যদি বাবু হয় তাইলে আমরা তো অহনও মা’র পেডেই আছি।”

মৈত্রীর বি-ষ-ম দেখে ইরিন কান থেকে ফোন সরালো, ব্যস্ত কণ্ঠে শেলিকে বলল, “ওকে একটু পানি দাও শেলি।”

রোকসানা বেগম ততক্ষণে চা নিয়ে চলে এসেছেন সোফার রুমে। তিনি চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে নিজেই পানি এনে মৈত্রীর মুখের কাছে ধরল। কাশি থেমেছে, একটু স্থির হয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে মৈত্রী পানির গ্লাসটা ধরলো। কৃতজ্ঞতার চোখে একবার তাকালো রোকসানা বেগমের দিকে। মৈত্রীকে কিছুটা ধাতস্ত দেখতেই ইরিন আবার ফোন কানে তুলে বললেন, বাবু তুই খাওয়া দাওয়া করে নে আমি আবার রাতে কল দেব।

দুপুরের পর প্রায় প্রতিদিনই ইরিন এক ঘন্টা ভাতঘুম দেন। কিন্তু আজ আর সে সুযোগ হয়নি বলা চলে রোকসানার প্রয়োজনেই সে না ঘুমিয়ে দোতলায় এসেছেন। রোকসানা কখনো হাতে তৈরি কাঁচা সেমাই রান্না করেননি। চালের গুঁড়ো দিয়ে নকশি পিঠা বানিয়েছেন কিন্তু কখনো সেমাই তৈরি করেননি৷ ইরিনের ঘরেই মিশু খেয়েছিল সেই সেমাই সেই থেকেই তার আবদার৷ আজ চালের গুঁড়ো, নারকেল, গুড় সবই ঘরে থাকায় তিনি ইরিনের কাছে শিখতে চেয়েছেন। ইরিনও সোৎসাহে চলে এসেছেন সেমাই তৈরি করা শেখাতে। আগ্রহ নিয়ে মৈত্রী আর শেলিও বসে আছে তা দেখার জন্য কিন্তু এখনও তা শুরুই করতে পারছে না তারা৷ প্রথমে ময়ূখ ফোন দিলো, তারপর চালের গুঁড়ো নিয়ে বসতেই কল দিলো ইরশাদ। ইরিনের হাত ফ্রী নেই এদিকে শেলি নারকেল কুরানোতে ব্যস্ত। রোকসানাও রান্নাঘরে বিধায় মৈত্রীকেই তুলতে হলো কলটা। সে ফোন তুলে ইরিনের কানে ধরতেই ইরশাদ বলল, “আম্মু কোথায় তুমি জলদি আসো মাছ এনেছি।”

“মাছ!”

“এমন রিয়াক্ট করছো কেন! আব্বু কিনে পাঠিয়েছেন এগুলো।”

“উফ্ তোর আব্বু এমন কেন করে আমার সাথে? আমি ব্যস্ত দোতলায় মৈত্রীদের ঘরে। আমি চাবি পাঠাচ্ছি তুই মাছগুলো রান্নাঘরে রেখে দিস আমি পরে কে-টে নেব।”

কল কা-টতেই ইরিন তাকালেন মৈত্রীর দিকে। কোমরে ছোট্ট একটা চাবির গোছা সেটা দেখিয়ে মৈত্রীকে বললেন, ” মামনি চাবিটা একটু তোমার ইরশাদ ভাইয়াকে দিয়ে আসো তো।”

‘ইরশাদ ভাইয়া!’ এই সম্মোধনটা শুনলেই মৈত্রী ভীষণরকম অপ্রস্তুত হয়। তার ভেতরটা চঞ্চল হয়ে তাকে আ-জব সব ভাবনায় ঠেলে দেয়। এখনও ব্যতিক্রম নয় কিন্তু তার তো পুরনো অভ্যাস সে কখনোই নিজের ভেতরকার প্র-তিক্রিয়া বাহিরে প্রকাশ করতে পারে না। এখনও তাই হলো, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে চাবিটা হাতে নিলো৷ বসা থেকে উঠে দরজার কাছাকাছি তাকিয়ে দেখলো মিশুকে পাওয়া যায় কিনা! নাহ, কোথাও মিশুর টিকিটাও নেই। হাত মুঠো করে আঙ্গুল মুচড়ে আবারও তা শিথিল করে অ-স্থির-তাকে কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে চালাতেই সে নেমে এলো নিচতলায়। সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রেখেই তাকালো সামনে দাঁড়ানো যুবা পুরুষটির দিকে। সাদা, কালোর ফরমাল পোষাকে সবসময় পরিপাটি এক সাজের মধ্যে অবস্থান এই ব্যক্তির। দু হাতে দুটো মোটামুটি রকম পলি ব্যাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুটোতেই মাছ আছে৷ লোকটার বয়সটা ত্রিশ ছুঁই ছুঁই কিংবা তারও বেশি অথবা কম মৈত্রী জানে না। সত্যি বলতে সে চেষ্টা করেও আন্দাজ করতে পারে না বয়সটা কেমন হবে এই লোকের শুধু মনে হয় সব দিকে থেকে সে জেন্টেলম্যান।

“তুমি চাবি নিয়ে এসেছো?”

“জ্বী”

ছোট শব্দে জবাব মৈত্রীর।

“আচ্ছা , খুলে দাও ক’ষ্ট করে” কথাটা বলতে গিয়ে দু হাত উঁচিয়ে ব্যাগ দুটো দেখালো ইরশাদ। কথার সাথে ঠোঁটে মিশে আছে তার নির্মল হাসি। পুরুষ মানুষকে বোধহয় গ*ম্ভীরতার মাঝে কখনো সখনো হাসতে দেখলেই ভালো লাগে। সারাক্ষণ ক্যা-বলার মত হাসতে থাকা পুরুষ একদমই ভালো লাগে না মৈত্রীর। ইরশাদের এই ভদ্রতাসূচক হঠাৎ হাসিটাই কেমন যেন মনের ভেতর টুপ করে গেঁ-থে যায়। সে ইরশাদের কথা মতই দরজা খুলে দিলো। ইরশাদ ভেতরে ঢুকে মাছ নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে হাত ধুতে ধুতে মৈত্রীকেই বলল, “চলে যেওনা।”

মৈত্রী বুঝলো না কথাটা৷ সে কেন আর থাকবে দাঁড়িয়ে? ইরশাদই আবার বলল, আমি এক্ষুনি আবার বের হবো তুমি একটুখানি ক-ষ্ট আবারও করো, ঘরটা লক করে চাবিটা নিয়ে যাও সাথে আম্মুকে দিও।”

একনাগাড়ে কথা বলতে বলতে ইরশাদ হাত ধুয়ে নিয়েছে। ন্যাপকিনে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সে যাওয়ার সময় আবারও পিছু ফিরে বলল, থ্যাংকস মৈত্রী।

ইরশাদের সেই পিছু ফিরে তাকানোটাই যথেষ্ট ছিল মৈত্রীর উ-ত্তেজনায় সংখ্যা গণনার কারণ। বুক ধড়ফড় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে গুনতে লাগলো, এক, দুই,তিন,চার……..

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৮

শীতের আহবান নিয়ে প্রকৃতি চ-র-ম উদ্বেগ প্রকাশ করতেই হয়ত আজ মেঘমল্লার তুমুল হর্ষণ। ‘মেঘমল্লার’ শব্দযোগ হয়ত ভাবাচ্ছে কেন হেমন্তের শেষে বর্ষার শব্দ ব্যবহার করা! আজ আকাশ কালো হয়ে রাত্রির দ্বিপ্রহরে যে মেঘের বর্ষণ তা নিঃসন্দেহে বর্ষার রূপ ধরেছে। নিকষ কালো রাতে মেঘের কৃষ্ণ রঙ দেখে মৈত্রীর সেই শব্দটাকেই সঠিক বলে মনে হলো। ঝড়ো হাওয়া আর ভারি বর্ষণে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে আছে। কেঁপে কেঁপে শরীর জানান দিচ্ছে শীত অনুভূতি। ঘরের জানালাটা আজও লাগায়নি বিছানায় আসার সময়। খোলা জানালার পর্দা দা-পুটে হাওয়ায় সরে গিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে চোখে মুখে তবুও উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। বিছানার চাদরটাও ছিটে আসা বৃষ্টিতে ভিজে উঠছে দেখেও কেমন অলসতায় জেঁকে আছে শরীরটা! আকাশের উত্তর -পশ্চিম কোণে হঠাৎ চলকে উঠলো সরু আলোর রেখা মন বলল এখনি জোরে বা-জ পড়বে। ঠিক তাই হলো তৎক্ষনাৎ। প্রকাণ্ড এক বজ্রপাতের আওয়াজে বুকটা ধ-ড়ফ-ড়িয়ে উঠলো মৈত্রীর৷ এবার আর শুয়ে থাকা হলো না। দ্রুত পায়ে উঠে সে পর্দা সরিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল। বেলকোনির দরজাটা লক করা কিনা দেখতে গিয়েই মনে হলো একটু কি বেলকোনিতে যাবে! মনের ভেতর থেকেই যেন জবাব এলো, ‘যা’।

মৈত্রী পা রাখলো বেলকোনিতে। বাতাসের তো-ড়ে তার খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চোখেমুখ উপচে এসে ঢেকে দিল পানপাতার মত মুখটা। মনের নীরব অনুভূতিগুলো সেই বাতাসমিশ্রিত বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে উঠলো কয়েক সেকেন্ডেই। গ্রিলে হাত দুটো রেখে একপলকে দেখে নিলো নারকেল গাছটা যেখানে বসবাস করে একজোড়া টিয়া দম্পতি। মৈত্রীর হঠাৎই চিন্তা হলো তাদের জন্য । তারা কি ভিজে যাচ্ছে এই বৃষ্টিতে! গাছের ফা-ট-লে তাদের যে সাজানো সংসারটা সেটা কি ভিজে যাচ্ছে না এই ছন্ন-ছাড়া ঝ’ড়ে? মৈত্রীর ভাবনা যখন টিয়াজোড়া নিয়ে তখনি চোখের কার্নিশে উঁকি দিলো নিচতলার বেলকোনির দৃশ্যটা। আঁধারঘেরা বেলকোনিতে এক ব্যস্ত পুরুষ তার পাখির খাঁচাটা দু হাতে উঠিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড এর সেই আবছা দৃশ্য মৈত্রীর চোখে মধুর এক অনুভূতি ছড়িয়ে দিলো। সেই অনুভূতির বৃষ্টিতে ভিজে সে টের পেলো না প্রকৃতির ব-র্ষণ তাকে কতোটা ভিজিয়ে দিয়েছে। যখন হুঁশ এলো তখন তার সারা অঙ্গ ভিজে চুপসে গেছে। গায়ে এবার ঠান্ডাটা কাঁ-টা দিয়ে উঠলো। আর থাকা গেল না বেলকোনিটাতে। ব্যস্ত পায়ে ওয়্যারড্রব থেকে জামা নিয়ে ঢুকে পড়লো বাথরুমে। ঝ-ড়তু-ফান শুরু হওয়ার পরও অনেকটা সময় বিদ্যুৎ ছিল কিন্তু এখনই অ-ঘ-টনটা ঘটে গেল। জামা পরার জন্য হাতে নিতেই গেল কারেন্ট। মুহূর্তেই চোখের সামনে আঁধারে ঢেকে ভুবনটা। কোনমতে জামা-পায়জামা পরে চুল মুছলো। মনে মনে ভয় হতে লাগলো এই বৃষ্টিতে আধভেজা শরীরে জ্বর না আসে আবার! জ্বরের ভ-য়টা নিয়েই সে বিছানায় শুয়ে কাঁথা জড়িয়ে নিলো। চোখ দুটো বুজতেই ভেসে উঠলো কয়েকটা দৃশ্য। লুঙ্গি পরা ইরশাদ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে বল নিক্ষেপ করছে মিশুর দিকে৷ আর ময়ূখ চেঁচিয়ে বলছিলো, “ভাই লুঙ্গি কি খুলে যাবে তেমার? এভাবে কেন কোমরে হাত দিচ্ছ বারবার? বলটা ঠিক করে মা-রো না!”

মনে পড়ছে আরও এমনই অনেকগুলো হাস্যকর দৃশ্য। এসব কল্পনা করতে করতেই চোখে নিদ্রার পাহাড় চে-পে বসলো কখন কে জানে! ঘুমটা যখন ভা-ঙলো তখন প্রকৃতি বড় শান্ত। নীলাম্বরের হলদে সূর্যটার চমৎকার হাসি ছড়িয়ে আছে চরাচরে৷ মৈত্রীর ঘুম আলগা হয়েছে মিশুর ঘরের ভেতর ফুটবল খেলার আওয়াজে। সে বোধহয় বারবার বলটাকে লা-থি মে-রে তার টেবিল কিংবা দেয়ালে লাগাচ্ছে। তাইতো অমন দুপ দাপ শব্দ হচ্ছে৷ আর শব্দটা যতবার হচ্ছে ততোবারই বুকটা ধ-ড়ফ-ড়িয়ে উঠছে। আর চোখ বুঁজে থাকা সম্ভব নয় এমন শব্দে। এতে করে কখন যে তার হৃদপিণ্ডটাই ব-ন্ধ হয়ে যাবে টের পাবে না৷ গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছাড়লো মৈত্রী। প্রথমেই ব্রাশ হাতে বেলকোনিতে গেল টিয়া দম্পতিকে দেখতে। গাছের দিকে চোখ দিয়েই আঁতকে উঠল সে। গাছের ফাঁকা জায়গাটাতে একটা টিয়া অন্যটা কোথায়! বুকটা ধ্ক করে উঠলো, তবে কি একটা পাখির কিছু হয়ে গেল! না চাইতেও মনটা বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে মৈত্রীর। কোনমতে ব্রাশ করতে করতে চারপাশে উ-দা-স দৃষ্টি মেলে দেখতে দেখতে নিচের বেলকোনিতে চোখ গেল। ভালো নেক কালো টি শার্ট, কালো ট্রাউজার অপরিপাটি চুল হাতে একটা বাটি তাতে টুকরো করা কোন ফল খুব সম্ভবত পেয়ারা। ইরশাদ বাটি থেকে সেগুলো একটা করে নিচ্ছে আর গ্রিলে বসে থাকা একটা টিয়াপাখি তার হাত থেকে ঠোকর মে-রে খেয়ে নিচ্ছে। কি আশ্চর্য কারবার! মৈত্রীর ব্রাশ করা বন্ধ হয়ে গেল। সে হা হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগল। এও কি সম্ভব! মানে কোনো পোষা পাখি না হয়েও এভাবে কারো হাত থেকে খাবার খেতে আসে! মৈত্রীর বিষ্ময় তাকে অনেকটা সময় স্ত-ব্ধ করে রাখলো। আজকের সকালটা তার এত সুন্দর মনে হলো আর সেই বেলকোনির মানুষটাকেও। আজ অবধি সাদা, ব্লু, আকাশি আর বিস্কিট কালারের পোশাকেই বোধহয় দেখেছিলো ইরশাদকে সে। কালো শার্টেও দেখেছিল কিন্তু তখন কালো প্যান্ট পরা ছিল না। কিন্তু আজ আগাগোড়া সবটাই যখন কালোতে মোড়ানো দেখল তখন কেমন ভিন্ন লাগল খুব। এতটা ভিন্ন যা চোখ দুটোকে চুম্বকের মত প্রগাঢ় আকর্ষণে জড়িয়ে নিলো। মৈত্রীর যখন হুঁশ হলো সে সম্মোহিত হচ্ছে আবারও এই লোকের মোহে তখনি বেলকোনি ছাড়লো। সকালের নাশতা শেষে ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হতেই কানে এলো বাবা বাড়িতে এসেছে। মৈত্রীর মনে হলো জরুরি কোন ব্যপার নয়ত আব্বু কখনো অফিস টাইমে বাড়ি আসে না। মনে মনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই সে নিজের ঘর থেকে বের হলো। বসার ঘরের কাছাকাছি আসতেই কানে এলো মামনির গলা, “এটা কেমন ধরনের দেখা সাক্ষাৎ বলেন তো! মেয়ে কি আমাদের যুগের যে, হুট করে বললেন পাত্রপক্ষ আসবে তৈরি হও আর সেও চুপচাপ সেজেগুজে বসে যাবে মেহমানের সামনে! বয়স হলো আপনার কিন্তু বুদ্ধি আর বাড়লো না। মেয়ের নিজেরও তো পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে আগে তা জেনে নেন। তাকে পাত্রের ফটো, বায়ো দেখান সে হ্যা বললে তবেই তাদের বাড়িতে ডাকেন তা না!”

কিছুটা রাগত্ব স্বরে বলল রোকসানা। মৈত্রীর বোঝা হয়ে গেল তার আব্বুর বাড়ি আসার হেতু। যতোটা প্রফুল্লচিত্তে আজ সকালটা তার শুরু হলো ঠিক ততোটা যে দিন থাকবে না তা বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু এই মুহুর্তে আর বাড়ি থাকতে একটুও ইচ্ছে করছে না তার। প্রয়োজন হলে তারা কল করেই জানাবে তাকে কথাটা ভেবে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে দরজা খুলে। বসার ঘরের মানুষ দুটো তার সেই বের হয়ে যাওয়া দেখলো কিনা কে জানে!

রাতভর ঝ-ড়ের তান্ডব শহর জীবনে খুব একটা আ-ঘা-ত না আনতে পারলেও বৃষ্টির পানি প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে উজ্জ্বল করেছে গেছে। পথঘাটের নোং-রা -আবর্জনা সবই ভেসে গিয়ে পড়েছে গলির ড্রেনে। রোদের ঝলমলে হাসিতে গোটা শহর হেসে উঠছে আর তাতে পথচারীও যেন হাসিমাখা মুখ নিয়ে চলতে ফিরতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। ইরশাদ আজ সকালে নাশতা বানানোর সময় ভেবে রেখেছিল নতুন এক জোড়া টিয়া কিনবে। আগের পাখি দুটোকে এখানে আসার পরই ছেড়ে দিয়েছিলো অথচ সেই পাখি দুটো বসত গেড়েছে সে বাড়ির নারকেল গাছে। মেয়ে পাখিটা তো ঘুরে ফিরে এসে বসে ইরশাদের বেলকোনিতে, কখনোবা তার টেবিলের ওপর আবার তার ঘর জুড়েই পায়চারী করে সে বাড়িতে থাকলেই। কিছুতেই এদের দূর করা গেল না বলেই ভাবছে আবার নতুন একজোড়া কিনবে। হতে পারে নতুনদের দেখে ভুল বুঝে অভিমানেই চলে যাবে তাকে ছেড়ে । যেমনটা ছেড়ে গেছে তার সায়রা। ফুরফুরে মনে কত কি ভাবতে ভাবতে রিকশায় বসেছিল ইরশাদ অথচ কলেজ পর্যন্ত আসার আগেই ফুরফুরে মনটা তার বি-ক্ষি-প্ত হয়ে উঠলো অতীতের সুতোয় টান পড়ায়। কলেজে ঢুকতেই মন মে-জা-জ আরও চড়াও হলো দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীদের জন্য; এক সপ্তাহ ধরে টিউশন পড়ার জন্য পেছনে পড়ে আছে। নতুন কলেজ, নতুন এলাকা এখানে ব্যাচ পড়ানোর মত জায়গার ব্যবস্থা নেই তার ওপর সে বিভিন্ন জায়গায় জবের জন্য এপ্লাই করে রেখেছে। সুবিধামত একটা জব হয়ে গেলেই সে কলেজ ছাড়বে। কিন্তু মেয়েগুলো নাছোড়বান্দা বিশেষ করে তিন্নি নামের মেয়েটা। গেইটের কাছেই জেঁকে ধরলো মেয়েগুলো। আজও ইরশাদের জবাব তার পক্ষে সম্ভব না অন্য কোন টিচারের কাছে যাও। দূর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা দেখল প্রিন্সিপাল স্যার। ইরশাদ অফিসরুমের কাছে যেতেই ডাকলেন, “ইরশাদ স্যার শুনুন।”

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

প্রিন্সিপাল সালামের জবাব দিয়ে জানতে চাইলেন এত অনীহা কেন টিউশনে? এটা তো প্রাইভেট কলেজ, নির্দিষ্ট অল্প বেতনের বাইরে টিউশন ছাড়া কি করে চলবে? ইরশাদও স্যারের প্রশ্নের জবাবটা নম্র সুরে দিল, “স্যার আমি এখানে জয়েন করার সময়ই আপনাকে বলেছিলাম একটা জব করতে চাই তবে সেটা টিচিং এর বাইরে। কিন্তু চাকরির বাজার কেমন তা আমিও জানি আর আপনিও৷ আব্বু কিছুটা জোর করেই আপনার কথা রাখতে আমাকে বাধ্য করেছে এখানে আসতে। তাই বলে আমি সব চেষ্টা বন্ধ করিনি। কয়েক জায়গায় এপ্লাই করা আছে তারমধ্যে ঢাকা আর সিলেটের দুটো মেডিসিন কোম্পানিতে আশি পার্সেন্ট সম্ভাবনা আছে চাকরিটা হয়ে যাওয়ার। হয়ে গেলেই আমি এখানে রেজিগনেশন দেব সেটা আপনিও জানেন তাই এখন একদল স্টুডেন্ট নিয়ে তাদের আধা অর্ধেক সিলেবাস রেখে চলে যাওয়াটা অ-ন্যায় হবে।”

প্রিন্সিপাল গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলেটার দিকে। পরিচিত ছেলেটা হুট করেই অপরিচিত হয়ে উঠেছে তাদের কাছে শুধু মাত্র তার বোনের পরিবারের জন্য৷ কত সাধ ছিল ছেলেটাকে নিজেদের একজন হিসেবে দেখার এখন সেই ছেলেটাকেই অচেনা হিসেবে দেখতে হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিন্সিপাল স্যার চলে গেলেন সামনে থেকে।

“তুই আজও স্কুলে যাসনি?”

“স্কুলে যাব কেন আজ তো তুমি আমাদের নিয়ে ঘুরতে যাবে। বসুন্ধরায় মুভি দেখব সেই প্ল্যান তো আগেই করে রেখেছি আজ আর ছাড় নয় ভাই।”

ভুনা খিচুড়ির প্লেটে মাংস দিয়ে সবে এক লোকমা মুখে পুরতে উদ্যত হয়েছিল ময়ূখ। বোনের কথায় সেটা প্লেটেই রেখে সে উঠার জন্য দাঁড়ালো। মেহের তা দেখে হায় হায় করতেই ময়ূখ বলল, “এই খাবার তুই ঘু-ষ হিসেবে আমাকে দিয়েছিস তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। এখন বুঝলাম সকাল সকাল পরোটা ভাজি ছেড়ে কেন তুই আমাকে আমার পছন্দের নাশতা বানিয়ে দিবি বলেছিস। এই ছিল তোর মনে! তোর ওই ইঁচড়েপাকা সব ন্যাদা বান্ধবীর দলকে আমার ঘাড়ে বসিয়ে ঘুরতে যাবি। খাবো না তোর রান্না।”

“আরে আরে ভাই আমি রান্না করিনি এসব। তুমি খাও এগুলো তো সব তোমার জগলু রেঁধেছে।আর আমার বান্ধবীরা একা না তাদের সুন্দরী বড় আপুরাও যাবে সাথে।”

“সিরিয়াসলি!” ময়ূখ উল্টো ফিরে মেহেরকে কথাটা বলতেই মেহেরও বুঝলো এখন এই এক সুযোগ। সেও মাথা নেড়ে বলল’হ্যা’

ব্যস, আরকি! সুন্দরী বড় আপুরা মানে ময়ূখের জন্য পারফেক্ট হবে তারা। সেও দ্রুত খাবার খেয়ে তৈরি হয়ে নিলো। মেহেরও তার সব বান্ধবীদের ফোন করে জানিয়ে দিল তৈরি হতে। মিনিট ত্রিশেক পার করেই দু ভাই বোন একদম তৈরি হয়ে গেলো। বাড়ির গাড়ি নিতে হবে বলে ময়ূখ বোনকে ডেকে বলল, গাড়ির চাবি কার কাছে জেনে আয় আমি নিচে যাচ্ছি। সে দোতলায় নামতেই সিঁড়ির শেষ মাথায় দেখতে পেলো জরিনা৷ মুখে দুষ্টু হাসি মাথায় তার শ-য়তানি নেচে উঠলো। ময়ূখকে দেখতেই জরিনা সিঁড়ি থেকে সরে যাচ্ছিল তখনই ময়ূখ ডাকলো, “জগলু আজ ভুনা খিচুড়িটা যা হেব্বি হয়েছে না! ইচ্ছে করছে রাঁধুনির হাতে একটা চুমু খেয়ে আসি।”

“তওবা তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ্, আল্লাহ র-ক্ষা করো এই লুইচ্চা ছেমড়ার হাত থাইকা।” বিড়বিড় করতে করতে জরিনা উল্টো পায়ে ছুট লাগালো রান্নাঘরের দিকে আর তার কান্ড দেখে ময়ূখ দ-ম ফাটিয়ে হাসতে লাগল। মেহের চাবি নিয়ে আসতেই দু জনে মিলে রওনা দিলো। মেহের একে একে তার সব বান্ধবীকে তাদের সবার বাড়ির গেইট থেকে নিয়ে গেল বসুন্ধরায়। পুরো সময় ময়ূখ ফিসফিস করে বকে গেল মেহেরকে, পে-ত্নী, শাক-চু-ন্নি এই তোর বান্ধবীদের সিনিয়র সিস্টারস! আমি আরও ভাবলাম যাই দু একটা দেখি পছন্দ হয় কিনা এবার অন্তত একটা প্রেম তো হয়েই যাবে তা না! আমি তোদের পেছনে এক টাকাও খরচ করব না মনে রাখিস। সবগুলো নিজের টাকায় আমাকে খাওয়াবি নইলে সবগুলোকে বেচে দিয়ে বাড়ি ফিরব আমি।”

ইরিনের হাতে ফল ভর্তি ঝুড়ি। সব রকম প্রায় বিদেশি ফল ভর্তি ঝুড়ির প্রতিটা ফল কা-টা হবে মেহমানদের জন্য । ইরিনই কাটবে সেগুলো। রোকসানা বসে শাড়ি দেখছেন এক এক করে কোনটা আজকের প্রথম দেখাদেখিতে মৈত্রীকে পরানো যায় বুঝে উঠতে পারছে না সে। শেলি বসে সেমাইয়ের জন্য দুধ, বাদাম, কিশমিশ সব গুছিয়ে রাখছে রান্নাঘরে। শিপলুর মা তার ছোট বাচ্চাকে কোলে রেখেই মৈত্রীকে কল দিচ্ছে বাড়ি আসার জন্য৷ হুট করেই আজ পাত্রপক্ষ আসবে শুনে রোকসানা প্রথমে ভড়কে গেলেন কিভাবে কি করবে ভেবে। নিজের বুদ্ধিতে কুলাতে না পারায় ইরিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, বিকেলের দেখাদেখি মানে নাশতার আয়োজন করা উচিত। রাত কিংবা দুপুরের হলে ভারী খাবারের আয়োজন লাগতো কিন্তু এটা তো আর তেমন না। প্রথম সাক্ষাৎ তাও বিকেলে। শিপলুর মা এসেছিল ছেলেকে খুঁজতে তখনি জানতে পেরে সেও বলে দিচ্ছে কি কি করা যায়। মৈত্রী এখনও ভার্সিটিতে শুনে সে নিজেই ফোন করে মৈত্রীকে জানালো মেহমানের কথা। রোকসানা মনে মনে বড় স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তার বরাবরই ভয় মৈত্রীকে নিয়ে কিছু করতে বা ভাবতে। একটু কিছু ভুল হলেই তো সবাই আঙ্গুল তুলে বলবে সৎ মা তো তাই ক্ষ-তি করেছে, অ-ন্যায় করেছে। শিপলুর মায়ের ফোন পেয়ে মৈত্রী বাড়ির পথে রওনা দিলো। মনে মনে সে প্রস্তুত ছিল এমন একটা ফোন কলের। সকালে আব্বুর কথা তো সে শুনেছেই তাই আর নতুন করে ভাবার কিছু নেই। বাসে উঠে বসতেই মৈত্রীর মনে হলো ব্যাগে দুটো বই আছে আজ লাইব্রেরীতে জমা দিতে হবে তখনই মনে পড়ল লাইব্রেরীর পাশেই কলেজটা আর সেখানেই আছে বিড়ালচোখা সেই মানুষটা। সতেজ, স্নিগ্ধ দুপুরটা আচমকায়ই বিষন্ন হয়ে গেল সেই মানুষটার কথা মনে পড়ে। এমন কেন হয় তার সাথে! ওই লোকটার কথা মনে পড়লেই মন চঞ্চল হয়, অ-স্থির হয় কখনোবা মন কেমন করা এক ভিন্নরকম উদাসীনতা ভর করে আর শেলি যখন আমার কেরাশ বলে এটা সেটা শোনায় তখন শেলিকে তার ভীষণ অ-সহ্য লাগে। ইচ্ছে করে চ-টাস করে এক থা-প্পড় লাগিয়ে দেয় শেলির গালে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে