#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩
হালকা শীতে পর্দা ভেদ করে আসা কাচরঙা রোদ্দুর গায়ে জ্বা-লা ধরিয়ে দিচ্ছে ইরশাদের। আজ ছুটির দিন আর পারিবারিক নিয়মানুযায়ী আজ সকালের নাশতা ঘুম থেকে উঠে ময়ূখ বানাবে, দুপুরের রান্না ইরশাদ করবে আর রাতেরটা আব্বু। এই নিয়ম ইরশাদদের ঘরে বিগত সাত আট বছর ধরেই চলে আসছে। তবে তারা কেউ বাড়ির বাইরে থাকলে একটু আধটু নিয়মে পরিবর্তন আসে। এমনিতেও সপ্তাহের মাঝেও রান্নাবান্নায় সহযোগিতা করে ইরশাদ আর ময়ূখ নিজেদের সুবিধামত। ইরিন বেগম ছুটির দিনটা আজকাল পার্লারে গিয়ে কিংবা শপিংয়ে কাটান ইরশাদের চাকরি হওয়ার পর থেকে। আজও ছুটির দিন তাই আজকের নাশতা ময়ূখের দ্বায়িত্বে। কাল রাতে পড়াশোনা করারনামে মুভি দেখে কখন যে এসে ইরশাদের পাশেই ঘুমিয়েছে খেয়াল করেনি সে। ভোরে নামাজের জন্য উঠতেই দেখেছিল। রোজকার মর্নিং ওয়াক শেষে আজ আবার একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে ইরশাদ। তখনই মনে পড়ল নাশতা বানাতে হবে। পাশে থাকা ময়ূখকে প্রথমে নাম ধরে ডাকল, আলতো হাতে পিঠে ধা-ক্কা দিলো কিছুতেই কাজ হলো না। আরও বার দুয়েক ডেকে শেষে তার গায়ের কাঁথা সরিয়ে লা*থি মে-রে খাট থেকে ফেলে দিল। কিন্তু একি! এই ছেলের কিছুতেই কিছু হয় না। এবার বির-ক্ত হয়ে বেডসাইড ছোট টেবিল থেকে তার পানির পট খুলে একটুখানি পানি ঢালতেই ধ-ড়ফড়িয়ে উঠে বসল ময়ূখ।
“আহ্ আহ্ ভাই…” বলে চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। বিছানা থেকে পড়ে সে একটুও ব্যথা পায়নি কিন্তু ভাবখানা এমন করলো যেন ব্য-থায় তার দ*ম বন্ধ হয়ে আসছে৷ ইরশাদও তাকে হা-ড়েম-জ্জায় চেনে। এখন রান্না না করার জন্য বাহানা দেখাবে হাজারটা বিশেষ করে আম্মুর সামনে গিয়ে এখন কি যে বলবে তার ঠিক নেই। ইরশাদ বালিশে উপুর হয়ে চোখ বুঁজে রইল। টের পেল সে ময়ূখ ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে এবং সত্যিই তার গলা শোনা গেল, “আম্মা ভাই আমারে খাট থেকে ফে-লে দিছে৷ এই যে দেখো, এখানে, হাঁটুতে ব্যথা পাইছি।”
বালিশেই মুখ চে*পে হাসতে লাগল ইরশাদ। বয়স কম হলো না ছেলেটার তবুও এখনও এমন সব আহ্লাদ করে! কে বলবে এই ছেলে ক’দিন পর বিবিএস দিবে! আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না তার। রাতে টি-শার্ট আর লুঙ্গি পরেই শুয়ে ছিল নামাজে যাওয়ার সময়ও সেভাবেই গিয়েছে। এখন উঠে লুঙ্গি বদলে ট্রাউজার পরে নিল। শীত পরতে শুরু করলেও তাতে এখনও গা শিরশিরানি হয় না। একবার বেলকোনিতে গিয়ে পাখির খাঁচা থেকে মোটা ছোট কম্বলটা সরিয়ে দিল। খাবার আর পানি পাত্রে ঢেলে পাখিগুলোকে একবার একটু হাত নেড়ে এদিক ওদিক সরিয়ে দিল। পাখিগুলোও যেন বুঝলো তার মনিবের মনের কথা তারাও দুয়েকবার করে ডানা ঝাপটে নড়েচড়ে নিজেদের সুস্থতার জানান দিল। তারপরই ইরশাদ ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল। আম্মু আর ময়ূখ একজনও রান্নাঘরে ঢোকেনি! কপালের মধ্যভাগে দুটো রেখার উদয় হল ইরশাদের সে মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই কানে এলো, “বাবা একটু সরে শোও না৷ এত জায়গা একা নিলে আমি কই শোব?”
ময়ূখের কণ্ঠস্বর কানে আসতেই কপাল চাপড়ালো ইরশাদ। এই রামছাগল, হা-ড়ে বল-দ এখন আব্বুর পাশে শুয়ে পড়েছে! অন্যসময় হলে বাবা-মায়ের ঘরে নক করে ঢোকে ইরশাদ কিন্তু এখন তার প্রয়োজন নেই ভেবে সরাসরি রুমে ঢুকল। যা ভেবেছিলো তাই ওই দা-ম-ড়া আব্বুকে ঠেলে খাটের কিনারায় পাঠিয়ে দিয়েছে। আম্মুও সব দেখে হাসছে আর তসবিহ পড়ছেন৷ ইরশাদকে দেখে ইরিন কপাল কুঁচকে বললেন, “তুই বাবুকে ফে-লে দিয়েছিস কেন ইরশাদ?”
ইরশাদ জবাব দিলো না উল্টো গিয়ে ময়ূখের কান চেপে ধরে বলল, “এই ব-ল-দ ওঠ এখন যদি নাশতা না বানাস তবে আজ আমার কাপড়চোপড় তোকে দিয়ে ধোয়াবো।”
“আরে ভাই কান ছাড়ো ধুয়ে দেব সব কাপড়।”
আ-র্তনা-দ করে ইরশাদের থেকে কান ছাড়িয়ে কথাটা বলল ময়ূখ। ফখরুল সাহেবও ইশারা করছিলেন বড় ছেলেকে ছেড়ে দিতে তাই ইরশাদ কান ছাড়ল। ইরিন বললেন আজ উনিই নাশতা বানাবেন কিন্তু ইরশাদ শুনলো না সে কথা। সে নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে প্রথমেই বাবার জন্য চায়ের পানি বসালো। আজ রুটি, পরোটা না বানিয়ে সে সবজি খিচুড়ি সাথে ডিম ভাজা করে নিলো। ঘরে বাবা ছাড়া বাকি তিনজনই কফি খায় বলে খিচুড়ি খাওয়ার একটু পরই ইরশাদ তিনজনের জন্য কফি করল । কাল রাতে পড়াশোনা বাদ দিয়ে আল্ট্রাভায়োলেট মুভি দেখে রাত পার করে আজ সকালে ঠিকঠাক তাকাতেই পারছে না ময়ূখ। ইরিন বেগম দুপুরের মেন্যু জিজ্ঞেস করলেন ছেলেদের। নতুন বাড়িতে উঠেছে তাই ভাবছিলেন বাড়িওয়ালাদের দাওয়াত করবেন আজ। দুপুর প্রায় হয়েই এসেছে এই মুহুর্তে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ ব্যপারটা ভালো নাও লাগতে পারে আবার হতে পারে তাদের রান্নার আয়োজনও হয়ে গেছে । তা ভেবে বললেন, “রাতে খেতে বলি মুজিব ভাইয়ের ফ্যামিলিকে!”
ইরশাদ ফ্রিজ থেকে সবজি বের করে রাখছিল রান্নাঘরে রাখা ছোট টেবিলটাতে। মায়ের কথা শুনে সে সোজাসাপ্টা বলল, “আব্বুকে জিজ্ঞেস করো।”
সোফায় বসে ময়ূখ তখন আধঘুমন্ত। সে কথাটা শুনতেই চোখ না খুলেই বলল, “আম্মা আজ আমার সময় হবে না কাল দাওয়াত করো।”
“এহ্ কি নবাবজাদা রে! তোকে কে জিজ্ঞেস করেছে সময়ের কথা মেহমানদারি কি তুই করবি নাকি!”
ব্যঙ্গ করে বলল ইরশাদ। ময়ূখ আবার চোখ বোজা রেখেই বলল, ” আমি না থাকলে বাড়িওয়ালার পেঁচামুখী মেয়েকে টাইট দিবে কে!”
ছুটির দিন মানেই মৈত্রীর ঘুম আর বই পড়ার দিন। তবে সবই নন একাডেমিক বই পড়া হয় এই দিনে। কিন্তু আজ তার রুটিন পরিবর্তন করতে হলো কাজের মেয়ে শেলির জন্য। বেচারি কাল রাত থেকে জ্বরে পড়ে আছে তাই আজ সে কাপড়চোপড় ধুতে পারবে না। রোকসানা বেগম একবার ডেকে মৈত্রীকে বললেন, “ধুতে হবে এমন কাপড় থাকলে ভিজিয়ে দাও আমি গোসলের সময় ধুয়ে দেব।”
মৈত্রী খুব অল্প বয়স থেকেই বুঝতে শিখেছে রোকসানা বেগম তার নিজের মা নয়। সেই থেকেই সে নিজে থেকে চেষ্টা করে নিজের প্রয়োজন নিজে মিটিয়ে নিতে। কাপড়চোপড় ধোয়া, নিজের ঘর সাফ করা, বইপত্র গুছিয়ে রাখা এসব কাজ কাজের লোকই করতো ছোটবেলার সময়টায়। একটু বড় হতেই কাপড় ধোয়াটা বাদ রেখে বাকিসব নিজে করার অভ্যাস তবে রোকসানা বেগম প্রয়োজনে নিজেও তার কাপড় ধুয়েছেন অনেকবার। সে ব্যপার হয়ত মৈত্রীর নজরে আসেনি তবে আজ যখন মামনি বললেন কাপড় ধোবেন কথাটা ভালো লাগল না তার। সে কাপড় ঠিকই ভিজিয়েছে তবে তা মামনির জন্য রাখেনি। বরং মিশুর অপরিষ্কার কাপড়গুলোও দেখে দেখে ভিজিয়ে দিয়েছে। মামনি রান্নার কাজে ব্যস্ত তখনও মৈত্রী দেখলো বাবা ফিরে এসেছেন বাড়িতে। অথচ আজ বাবার কোন কাজে ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল দুদিনের জন্য। মৈত্রীকে দেখে মুজিব সাহেব বসার ঘরে গিয়ে এক কাপ চা দিতে বললেন।
“বাবা চা চাইছে মামনি।”
“চুলা তো খালি নেই একটু অপেক্ষা করতে বলো। আর কাপড় কি ভিজিয়েছো?”
“জ্বী” মৈত্রী বাবার দিকে ফিরে যেতে যেতে জবাব দিলো ছোট করে। বাবাকে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে বলে সে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল তখনই কানে এলো, “রোকসানা আজ রাতে রান্না কোরো না ফখরুলের ঘরে দাওয়াত আছে।”
“কিসের দাওয়াত!” বিষ্ময়ে প্রশ্ন করলেন রোকসানা।
“বিশেষ কিছু না। এমনিতেই বন্ধু মানুষ এত বছর পর একসাথে হয়েছি তাই হয়ত!”
“আমার তো মনে হচ্ছে আমরা সেদিন খাওয়ালাম সেই ফরমালিটি পূরণ করতে চাইছে।”
“যাই করুক মন্দ তো না। আমার তো ভালো লাগছে এসব। কতগুলো বছর হলো নিজের বলতে আত্মীয়স্বজন সবই দূরে চলে গেছে। এতদিনে মনে হচ্ছে আমার কোন আত্মীয় আছে।”
“মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো আত্মীয়স্বজন অভাব পড়বে না তখন। হ্যাঁ গো সেদিন মিশুর স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারের সাথে কথা হলো তিনি একটা পাত্রের কথা বলেছেন। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি ছেলে নাকি ঢাকা মেডিকেল এর নিউরোলোজিস্ট না সার্জন কি বলে সেই ডাক্তার।”
দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই শুনে মৈত্রীর কপালে সু-ক্ষ্ম রেখার উদয় হলো। বাবার কথা শুনে বির-ক্তি এসেছিল সেই কোঁকড়াচুলো বাঁদরের কথা মনে করে তৎক্ষনাৎ মেজাজ বি-গ-ড়ালো বিয়ের কথা শুনে। সে আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল কাপড় ধোয়ার জন্য।
ইরশাদের রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছে অথচ ময়ূখ এখনো বাথরুমে ঢুকি ঢুকি করছে। ইরিন বেগম একবার জোর করলেন কাপড়গুলো তিনি ধুয়ে দেবেন কিন্তু ছেলেরা তার এ ব্যাপারে ভীষণ সত-র্ক। বছর দুয়েক হলো মেরুদন্ডের হাড় ক্ষ-য় হয়েছে। সেই থেকেই ছেলেরা তাঁকে কাপড় ধোয়া, ঘর মোছার কাজ করতে দেয়না। বাড়িতে থাকাকালীন ছুটা কাজের বুয়া ছিল কিন্তু এখানে সবে এলো। তবুও বাড়িওয়ালিকে বলে রেখেছে যেন কাজের লোকের খোঁজ পেলে জানায়। ময়ূখ ভাইয়ের ধ*ম*ক খেয়ে অবশেষে কাপড় ধুয়ে বের হলো। ইরশাদ রান্না শেষ হয়েছে তাই রান্নাঘর ধুয়েমুছে এবার ঘর মোছার প্রস্তুতি নিলো। ইরিন বেগম খুবই বির-ক্ত হন ছেলেদের কাজকর্ম দেখে মনে মনে খুব রা-গও করেন। এভাবে এ বয়সেই এত আদরযত্ন ভালো লাগে না তার। তারওপর যদি ছেলেগুলো এভাবে খাটে সেটা আরও পছন্দ নয়। এখন সময় হয়েছে ছেলেদের বিয়ে করাবেন বাড়িতে পুত্রবধূ এনে তাকে দিয়ে রান্না করাবেন তা না! ময়ূখ ধোয়া কাপড়ের বালতি হাতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ইরশাদকে ডাকলো, ভাই!
“কি?” জবাব দিয়ে সেও একটা বালতি হাতে বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছে ঘর মোছার পানি নিতে।
“খালি গায়ে কি ছাঁদে যাওয়া ঠিক হবে?”
ময়ূখের প্রশ্ন শুনে ইরশাদ নিজ কাজে চলে গেল। মনে মনে আওড়ালো এই পা-গল ছাগলকে কি খেয়ে দুনিয়ায় আনছিলো আল্লাহ জানে! ফখরুল সাহেব পেপার হাতে নিজের ঘরের বেলকোনিতে বসে আছেন। ময়ূখের কথা তিনি সেখান থেকেই শুনতে পেয়েছেন কিছুটা তাই গলা ছেড়ে বললেন, “বাবা তুই এমনেই যা এই মুহুর্তে তোর জন্য ছাঁদে কোন সুন্দরী দাঁড়িয়ে নেই ।”
কথাটা শেষ করেই তিনি মুখের ওপর পেপার ধরে মিটিমিটি হাসছেন। সেই হাসিতে ঘরের দু প্রান্তে আরও দুজন যুক্ত আছে তা ময়ূখ জানে৷ তাই আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। বালতি নিয়ে সে চলে গেল ছাঁদের উদ্দেশ্যে। কাঁচা হলুদের মত গাঢ় হলুদ রোদে ছাঁদটা যেন ঝলমল করছে। সিঁড়ি পেরিয়ে ছাঁদের দরজা খুলেই চোখ-মুখ কুঁচকে এলো ময়ূখের। এত রোদে হঠাৎ করে তাকানো মুশকিল৷ এখন মনে হচ্ছে ভাইয়ের থেকে চশমাটা ধার নেওয়া দরকার। ডান হাতে বালতি ধরে বাঁ হাতটা চোখের সামনে ফেলে ছাঁদে উঠলো ময়ূখ। আশপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো ছাঁদটার উত্তর দিকে কিছু কাপড় বাকি ছাঁদটা সম্পূর্ণ খালি। সে দক্ষিণ দিকটাতে দাঁড়িয়ে প্রথমেই তার আন্ডারওয়্যার তুলে নিলো রোদে দিতে ঠিক তখনি কানে এলো এক জোড়া পায়ের শব্দ। ছাঁদে কেউ আসছে বুঝতে পেরেই ময়ূখ তার ছোট জিনিসটা বালতিতে রাখতে নিলো ততক্ষণে আগত ব্যক্তিটি উঠে এসেছে ছাঁদের দরজায়। ময়ূখের মত সেও প্রথমে চোখ খোলা রাখতে বে-গ পোহালো। পরক্ষণেই দক্ষিণে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দিকে অপ্রস্তুত হলো। ময়ূখ তার অবস্থা বুঝি টের পেলো কিছুটা। নিজের হাতের বস্তুটিতে বালতিতে ফেলে সে স্বভাবসুলভ দাঁত কেলিয়ে ‘হাই’ জানালো। মৈত্রী বরাবরের মত জবাবহীন৷ ময়ূখ মারবেলের মত তার চোখ দুটো চারপাশে ঘুরিয়ে বলল, “নো আন্স! ওকে, আই ডোন্ট মাইন্ড।”
মৈত্রী সেদিকে পাত্তাই দিলোনা বরং সে উত্তর দিকের বাঁধা দড়ির দিকে এগিয়ে গেল। একে একে মিশুর কাপড় নেড়ে নিজের গুলোতে হাত দিল। কিন্তু সংকোচ হচ্ছে সেগুলো ছড়িয়ে দিতে। তার জামা-পায়জামার সাথে আন্ডারগারমেন্টও আজ সাথে এনেছে। সেকি জানতো এই ফুল পা-গল বাঁদরটাও কাপড় নিয়ে হাজির হবে! সংকোচে সে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। ওই বাঁদরও তাকে এভাবে লুকিয়ে দেখছে কেন! প্রচণ্ড অ-স্বস্তি নিয়ে মৈত্রী আরও একবার তাকালো। এবারও একইরকম চোখাচোখি হলো দুজনে। এতে মৈত্রীর মুখভঙ্গি পরিবর্তন না হলেও ময়ূখের হলো। সে ক্যাবলার মত হি হি করে উঠলো। তারপর নিজের ছোট কাপড়গুলো না নেড়েই নিচে চলে গেল। মৈত্রী এতে হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন! সে এবার ধীরে সুস্থে দারুণ ভাবে ওড়নার আড়াল রেখে নিজের ছোট কাপড়গুলো রোদে দিয়ে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো। বাড়ানো পা তার সিঁড়ির কাছে এসেই থমকে গেল। কালো ট্রাউজার , ঘামে ভেজা সাদা টি শার্ট, এক হাতে বালতিটা যেটা একটু আগেই ময়ূখের হাতে ছিল। এলোমেলো চুল ব্যস্ত পায়ে ছাঁদের দিকে উঠে আসছে মানুষটা। মৈত্রীকে দেখে ঠোঁট টেনে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কি অবস্থা কেমন আছো?”
খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন তবুও কেমন জড়াগ্রস্থ হয়ে পড়লো মৈত্রী প্রশ্নটা শুনে। ঠোঁটে তার হাসি ফুটলো না কপালেও বির-ক্তি নেই অথচ জবাব দিতে সময় লাগল। বড় ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো, ভালো।
ইরশাদ জবাব শুনলো কি শুনলো না বোঝা গেল না। সে মৈত্রীর একপাশ দিয়ে ছাঁদে উঠে এগিয়ে গেল সামনে। মৈত্রীর হঠাৎ মনে হলো, লোকটার ডান গালে হলুদ লেগে আছে৷ সে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো ইরশাদের দিকে। লোকটা নিঃসঙ্কোচে বালতি থেকে আন্ডারওয়্যার, মোজা সব তুলে রোদে দিচ্ছে। কেমন যেন লজ্জায় পায়ের তালু শিরশির করতে লাগলো মৈত্রীর। একবার মনে হয়েছিলো লোকটাকে বলবে তার গালে হলুদ লেগে আছে কিন্তু এখন আর এক মুহূর্ত দাঁড়াতে সা-হ-স হচ্ছে না।
চলবে
#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৪
আকাশটা পূব দিকে মেঘলা অথচ পশ্চিমে কমলাভ সূর্য যেন মুচকি হাসছে৷ মৈত্রী তার বিশাল বেলকোনিটার একদম কিনারায় গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে৷ তার সামনেই বসে আছে শিপলু আর মিশু৷ মিশু তার মায়ের ফোনে আজ গেম খেলার সুযোগ না পেয়েই বোনের ঘরে ঘাপটি মেরেছে আর তার লেজ হয়ে সাথে এসেছে শিপলু। মৈত্রীর হাতে সমরেশ মজুমদার এর অগ্নিরথ বইটা। সে অনেকটা সময় ধরে মনযোগে বইটা পড়ছিলো। সায়নের কলকাতায় গিয়ে রায় বাড়ির ভাঙন দেখে কেমন প্র-তি-ক্রিয়া ছিল তা পড়ার টান টান উ*ত্তে*জনা আর আবেগের অংশটুকুতেই মৈত্রীর মনযোগে বিঘ্ন ঘটালো নিচতলার ডানপাশের বেলকোনিতে কারো উপস্থিতি। বইয়ের ফাঁকে আঁড়চোখে দৃষ্টি রাখলো সেই বেলকোনির আগত ব্যক্তির দিকে। সাদা লুঙ্গি আর টি শার্ট গায়ে একটা ফুলের টব হাতে দাঁড়িয়ে আছে। উপর থেকে চুলগুলো দেখেই আন্দাজ করা গেল এটা সেই বিড়ালচোখা মানুষটি। কিন্তু এখান থেকে লোকটার মুখ একদমই দেখা যাচ্ছে না। মৈত্রী সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনতে চাইলো কিন্তু কিছুতেই হলো না বরং দৃষ্টি আরও গাঢ়ভাবে নিবদ্ধ হলো। লোকটা বেলকোনির মেঝেতে হাঁটু ভেঙে পায়ের সামনের দিকে ভর রেখে বসে আছে৷ হাতের টবটা এক পাশে রেখে বাঁ হাতে এবার চশমা ঠিক করলো। মৈত্রী ভীষণ অবাক হলো , লোকটা কি চশমা পরে! কই যে ক’বার দেখা হয়েছে চশমা তো ছিলো না চোখে। হাতের বই বন্ধ করে এবার ডান হাতে চিবুক রেখে চেয়ে রইল মৈত্রী। ফুলের টব একের পর এক করে তিনটি টব সারি করে রাখা বেলকোনির কর্ণারে তারপর ইরশাদ সেখান থেকে সরে গেলে মৈত্রী বির-ক্ত হলো। কোথায় গেল লোকটা! মাত্র কয়েক সেকেন্ড আবার দেখা গেল তাকে পাখির খাঁচা হাতে। টব তিনটের পাশে পাখির খাঁচা তারপর আরও তিনটে টব। বেলকোনির এর পরের অংশ আর এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। লোকটা পাখি পোষে, ফুল গাছ লাগায় আর কি কি করে! হঠাৎই মন আনচান করছে মৈত্রীর ওই লোকটা সম্পর্কে জানার৷ তার মনের আনচান অ-স্থিরতাকে দূরে হটিয়ে দিলো ময়ূখের আগমন। ঝাঁকড়া চুলের বাঁ-দর ছেলে এসে হাজির বেলকোনির ঠিক সেই টবগুলোর সামনে৷ মৈত্রী আর বসলো না সেখানটায়। হাতের বইটা নিয়ে ঘরে চলে গেল। শিপলু আর মিশু তখনও মোবাইলে গেম খেলায় ব্যস্ত। হেমন্তের শেষ দিক দিন এখন একটু একটু করে রাতের চেয়ে ছোট হয়ে আসছে। সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্তে ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মৈত্রী তখন দু চোখ বুঁজে ঘুমের আয়োজনে ব্যস্ত। আজ বহু বহু দিন পর বুকের ভেতর শূন্যতার ক*ড়াল গ্রাসে হু হু করে কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ এই শূন্যতার কারণ তার ওই নিচ তলার মানুষগুলোই। এসেছে তারা মাস হয়নি এখনো অথচ কয়েকটা দিনেই কেমন আপন হয়ে জড়িয়ে নিচ্ছে কথার মায়ায়। ইরিন আন্টি মানুষটা এত্তো কেন নরম বুঝে পায় না মৈত্রী। রোজ তাকে কোন না কোনভাবে কাছে ডাকেন, পাশে বসান এটা সেটা কথার বাহানায় মাথায় হাত বুলান। রোজ আসেন তাদের বাসায় মামনির সাথে কথা বলতে। অথচ মানুষটা মামনি কম তার সাথেই কথা বলে সময় ব্যয় করে। মামনি কখনো তাকে ডেকে পাশে বসান না। অসুস্থ হলেও কখনো গায়ে, মাথায় হাত ছুঁয়ে দেখেন না। অন্য আর দশজন সৎ মায়ের মত হয়ত কষ্ট দেননি কিন্তু কোনদিন আদর মেখে ছুঁয়েও দেখেননি৷ নিজের মায়ের আদর ভালোবাসা কেমন ছিলো জানে না মৈত্রী কিন্তু ইরিন আন্টি যা দিচ্ছেন তা কি মায়ের আদরসম নয়! আজ হঠাৎ কান্না পাচ্ছে নিচতলার সেই বেলকোনির ওই ঝাঁকড়া চুলের বাঁদর ছেলেটাকে দেখেই। আজ সকালেই সে বাবার মুখে শুনেছে ওই ছেলের মা নেই। ইরিন আন্টি শুধুই বিড়ালচোখা লোকটার মা অথচ তাদের দেখলে কে বলবে ময়ূখ আন্টির ছেলে নয়! মা না থাকাও সত্ত্বেও ময়ূখের মায়ের স্নেহের কমতি নেই জানতেই পেরেই যেন মৈত্রীর মনটা হিংসায় জ্বলে উঠলো। কষ্ট হলো তার সাথে কেন এমন হলো না!
“মাংস হয়ে গেছে আম্মু পোলাও কি এখনই বসাবো?” রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল ইরশাদ। ময়ূখ ইরিন বেগমের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে তার রুমে বসে। মোটামুটি সকল কাজই দু ভাই কলেজ জীবন থেকে রপ্ত করে নিয়েছে। ইরিন বেগম কখনোই পছন্দ করেননা এসব কিন্তু ছেলে দুটোই কেমন করে যেন এত বদলে গেল। হাতে হাতে মায়ের সকল কাজে নিজেদের পারদর্শী করতে লাগল। এই যে, ছেলে দুটো রান্না করে, ঘর মোছে, কাপড় ধোয় আবার মায়ের মাথায় তেলও লাগিয়ে দেয় ব্যাপারগুলো বড় আজব লাগে তাঁর। তিনি চান ছেলেরা এসব কাজ থেকে দূরে থাকুক তারা শুধু বাইরের কাজ করুক তাতেই চলবে। ঘর সামলাতে তো তিনি দুটো মেয়ে আনবে একদম পুতুল পুতুল দেখতে। ময়ূখ তেল দেওয়া শেষ করে দুটো রাবার ব্যান্ড নিয়ে এলো আম্মার ঘর থেকে। ইরিন বেগম তা দেখে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন দুটো তুলি দিয়ে কি হবে!
“তুমি চুপচাপ শুধু দেখে যাও।” কথাটা বলেই ময়ূখ আবার আম্মার পেছনে বসলো। মাথার মাঝখানে সিঁথি টেনে চুলগুলো দু ভাগ করতেই চকিতে তাকালেন ইরিন বেগম।
“কি করবি তুই!” আতংকিত শোনালো কণ্ঠস্বর।
“আম্মা ডিস্টার্ব করবানা একদম বলে দিলাম।” জো-র করে ময়ূখ দু পাশে দুই বেণী করে দিলো ইরিন বেগমের। আঁকাবাঁকা দুই বেণীতে কিশোরী কন্যা সাজানোর বৃথা চেষ্টায় বড় উৎফুল্ল হয়ে গেছে ময়ূখ। এদিকে রান্নাঘর থেকে বার কয়েক ডেকেও যখন কোন জবাব পেলো না তখন রে-গে গিয়ে হাতে খুন্তি নিয়েই এ ঘরে এলো ইরশাদ।
“দুজনেই কি কানের মুখে তুলো বসিয়েছো?” কথাটা বলতে বলতে মায়ের দিকে তাকালো সে। রে-গে কিছু বলার আগেই তার দু’ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। এদিকে ছেলেদের হাসির কারণ টের পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন ইরিন। এ কি বেহুদা কান্ড!
“তোমাকে একদম বাচ্চা মেয়ে লাগছে আম্মু।”
“এসব কি কথা!” লজ্জারুণ হয়ে ছেলেকে ধ-ম-কে উঠলেন ইরিন৷ তাতে লাভ বিশেষ হলো না। ছেলেরা থামার বদলে আরও বেশি করে বলতে লাগলো, “আবার তোমাকে বিয়ে দেওয়া যাবে। ভাবছি ফখরুল সাহেবকে এবার বিদায় করে নতুন একটা জামাই আনব।”
“মা*ইর খাবি কিন্তু এবার তোরা” বলেই মাথায় আঁচল টানলেন ইরিন বেগম। ময়ূখ তার আম্মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় আলতো চুমু খেলো। ইরশাদও হাসিমাখা মুখে এবার জানতে চাইলো, পোলাও কি এখনই করবে! দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে ইরিন বেগম বললেন, বসিয়ে দে আমি আসছি।
পোলাওটা ইরশাদ খুব একটা ভালো রাঁধতে পারে না বলেই এটা মা দেখবে৷ পোলাও হওয়ার আগেই এশারের আজান কানে এলো৷ ইরশাদ তার বাবার সাথে নামাজের জন্য চলে গেলে ময়ূখ এসে ডাইনিং টেবিলটাকে সাফ করে নিল। একটু পরই হয়ত চলে আসবে মৈত্রীরা তাই যতোটা সম্ভব সোফা, ডাইনিং এমনকি তাদের তিনটে রুমই পরিপাটি করে গুছিয়ে নিল। ময়ূখ মনে মনে প্ল্যানও বানিয়ে রেখেছে আজ গানের আসর জমাবে। সব কাজ শেষ হতেই ফটাফট নিজের ঘরে ঢুকে পরনের কাপড়গুলোও বদলে নিলো। সবসময়কার থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট ছেড়ে আজ ছাইরঙা টি শার্ট আর জিন্স পরলো। মাথার এলোমেলো চুল গুলোতে চিরুনি বুলাতে গিয়েও আবার রেখে দিলো। দু হাতের আঙ্গুলে টেনে নিজের মত গুছিয়ে নিলো চুলগুলো। সবসময় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার সাধ হয়না ময়ূখের আজ যেন সেই সাধটাই জেগে উঠলো মনের অগোচরে। নিজের ঘরে তার আয়না নেই আম্মার ঘরে গিয়ে ড্রেসিংটেবিল এর সামনে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড দেখে নিয়েই বেরিয়ে এলো সে ঘর থেকে। আর কতক্ষণ! হঠাৎ করে মনে হলো সে ডে-স্পা-রেট হয়ে উঠছে কিন্তু কেন? কিসের এই অধীরতা! কিসের এত আগ্রহ! তার ভাবনার সুতো কা-ট-ল কলিংবেলের আওয়াজে। দরজা খুলতে ময়ূখই এগিয়ে গেল; তখনও নামাজ শেষ হয়নি ইরিন বেগমের। দরজা খুলতেই দেখা গেল ফখরুল সাহেব আর ইরশাদ দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তাদের পেছনেই সিঁড়ির দিকে দেখা গেল রোকসানা বেগম, মুজিব সাহেব আর মিশু নেমে আসছে। তাদের দেখতেই ইরশাদ আর ময়ূখ দুজনেই সালাম দিলো৷ মিষ্টি হাসিতে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে ঢুকতে দিলো তাদের। মৈত্রী আর শেলীকে না দেখে ইরশাদই মুখ খুলল প্রথমে, “আঙ্কেল মৈত্রী আর শেলীকে কেন রেখে এলেন! আম্মু কিন্তু বারবার করে বলে দিয়েছে সবাই আসবেন।”
ময়ূখ উন্মুখ হয়ে আছে ইরশাদের করা প্রশ্নের জবাব শুনতে কিন্তু মুজিব সাহেব এর জবাব স্বস্তিদায়ক হলো না তার জন্য। মৈত্রীর মাথাব্যথা তাই আসতে পারেনি এটা যেন অহেতুক বাহানা। ময়ূখের অন্তত এমনটাই মনে হয়। সবাই একই সাথে খেতে বসে নানা গল্পে ব্যস্ত হয়ে উঠতেই ময়ূখ ভাইয়ের কানে ফিসফিস করে উঠলো।
“দেখলে ভাই ওই পেঁচামুখ ছেমড়ি ভাব দেখাইয়া আসে নাই। আমার তো এখন মন চাচ্ছে গিয়ে ঠা-ডায়ে দুই চ-ড় মে-রে আসি। মানুষকে দাম দেয় না!”
ইরশাদ সবে এক লোকমা মুখে তুলেছিলো। ময়ূখের কথা শুনে খাবার গলায় আটকে বি-ষ-ম খেলো। ঝাল ঝাল মাংসটা গলধঃকরণ ঠিকঠাক করা গেল না উল্টো ঝালে যেন জ্বলে যাচ্ছে ভেতরটা, চোখের তারায় জল জমছে। তার অবস্থা দেখে টেবিলের প্রায় সবাই অস্থির হয়ে উঠলো। ময়ূখও ভড়কে গেল ভাইয়ের অবস্থা দেখে। সে কি এমন বলে ফেলল! খাবারের আয়োজন জম্পেশ হলেও খাওয়াটা সবার জম্পেশ হতে পারেনি। ইরশাদের সত্যিই বা-জে অবস্থা হয়েছিল এক বিষমেই। খাওয়ার পর সবাই মিলে অল্পসল্প গল্পও জমালো। ঘড়ির কাঁটা দশ পেরোতেই রোকসানা বেগম তাড়া দিলেন ঘরে মেয়ে দুটো একা আছে বলে। শেলীও মৈত্রীর মত যুবতী, অবিবাহিত মেয়ে তাই না চাইতেও মাথায় চিন্তা দুজনের জন্যই আসে রোকসানা বেগমের৷ সে তার ভালোবাসা থেকে মৈত্রীকে বঞ্চিত রাখলেও দ্বায়িত্বের দিকটা ঠিকঠাক পালন করার চেষ্টা করেন। ইরিন বেগমও আর জোর করলেন না তাদের বসার জন্য তবে যাওয়ার সময় বাটিতে করে দুজনের খাবার দিতেও ভুললেন না। ইরশাদও চাইছিলো মাকে একবার বলবে তাদের জন্য খাবার দিতে কিন্তু সে আরও আগেই শুনেছে মা খাবার পাঠাতে চাচ্ছেন মৈত্রীর জন্য। রোকসানা বেগমই তখন থামিয়ে বলেছিলেন, মৈত্রী রাতের খাবার লেট করেই খায়। এ কথা শোনার পর আর তাড়াহুড়ো না করলেও এখন মনে করে ঠিকই দিয়ে দিলেন। রাতের আদর আপ্যায়নের সমাপ্তি টানতেই সবাই সবার ঘরে গিয়ে বিশ্রামের জন্য গা ছেড়ে দিলো বিছানায়। ইরশাদের জন্য আজকের দিনটা ছিল ব্যস্ততম এক দিন। অন্যান্য ছুটির দিনে একবার রান্না করেই তার কাজের সমাপ্তি কিন্তু আজ আর তেমন কিছু হলো না। বিছানায় শুতেই মনে হলো পাখির খাঁচায় কম্বল দেওয়া হয়নি। হেমন্তের শেষের দিক বলেই হয়ত এখন রাতের শেষে হিম হিম হাওয়া লাগে বাইরে। তাই পুরনো অব্যবহৃত এক কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয় পাখিগুলোকে। ঘরের বাতি জ্বালানোই ছিল বলে আর বেলকোনিরটা জ্বালালো না। পাখির খাঁচায় কম্বল ছড়িয়ে দিয়ে রুমে ফিরতে গিয়ে মনে হলো উপরের বেলকোনিতে কেউ আছে। আবছা আঁধারে মুখ উঁচু করে তাকাতেই দেখতে পেল সেখানটাও আঁধার ঘেরা। কারো ওড়নার কোণ বেলকোনির গ্রিলের ফাঁকে বাইরের দিকে ঝুলে আছে৷ ওড়না গায়ে মানবী আঁধারে আকাশপানে মুখ উঁচু করে আছে। কি দেখছে ওই নক্ষত্রবিহীন অম্বরবক্ষে! কি আছে ওই মহাশূন্যের কোল জুড়ে! কি দেখছে সে! অজান্তে, আনমনেই ইরশাদ নিজেই নিজেকে শুধালো যেন কথাটা। মেয়েটাকে সে দেখেছে হাতে গুণে মাত্র কয়েকবার আর প্রতিবারই সে নিজ নিজ কাজে ব্যতিব্যস্ত ছিল। খেয়াল করে দেখা হয়নি ওই মেয়েটির মুখ তবে যতবার দেখেছে প্রতিবারই বড় মলিন আর উদাস মনে হয়েছে। ইরশাদ অনেকটা সময় তাকিয়ে ছিলো মৈত্রীর দিকে। মৈত্রী বোধহয় টের পেল আর তাইতো এদিকে একটিবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েই চলে গেল ঘরের ভেতর।
রাতে যেমন শীত শীত দুপুরটা তেমন গরম। ক্লাস শেষে আজ ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নেমে গেল মৈত্রী কলেজের সামনে। লাইব্রেরিতে গত সপ্তাহে নেওয়া বইগুলো জমা দিয়ে নতুন বই নিয়ে যাবে বলে। ব্যাগ থেকে বই বের করে লাইব্রেরিতে জমা দিয়ে অনেক বেছে হুমায়ূন আহমেদ এর আজ মৃন্ময়ীর মন ভালো নেই বইটি নিলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, ” মেঘ বলেছে যাব যাব বইটা না পড়ে থাকলে সেটাও নাও।”
আধ পরিচিত কণ্ঠটা শুনতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মৈত্রী। আপনাআপনি তার মন গুনতে লাগলো এক, দুই,তিন, চার, পাঁচ….. চলতে থাকলো গোনা কয়েক সেকেন্ড। একটু কি কমলো তার স্না-য়ুবিক উ-ত্তে-জনা!
চলবে