কি ছিলে আমার পর্ব-৩৩+৩৪

0
1861

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৩ (১ম অংশ)

আপনজনের মান অভিমান তো কখনো কখনো বিনা বাক্যেও ঘুচিয়ে দেয়া যায় কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি! দুটো দিন পেরিয়ে গেছে সিলেটে এসে অথচ মৈত্রী ইরশাদের ভেতরকার অদৃশ্য দূরত্বটা একচুলও সরেনি উল্টো ইরশাদ এসেই অফিস জয়েন করায় দুজনের রাতটুকু ছাড়া পাশাপাশি থাকা হচ্ছে না। রাতটাও মৈত্রীর নির্লিপ্ততা দেখে তাকে কাছে টানতেও ইচ্ছে হয় না ইরশাদের। দেহের চাহিদা জাগলেও সঙ্গীর নিরাসক্ততা তাকে মুহূর্তেই চাহিদাবিমুখ করে দেয়। এদিকে দিনভর দুজনেই বাকি সবার সামনে প্রচণ্ডরকম স্বাভাবিক থাকাটা প্রকাশ করে। বাড়ির মানুষ গুলো দু দিনে চা বাগানের প্রায় প্রতিটি কোণা কোণা ঘুরে বেরিয়েছে অবাধ আনন্দের সাথে কেউ কিছুই বলেনি। উল্টো অফিস কতৃপক্ষ ইরশাদের পরিবারকে ডিনারে ইনভাইট করেছে আজ৷ এই একটা ব্যাপারে অফিস আর চা বাগানে রমরমা খবর বের হলো নতুন একাউন্ট ম্যানেজার কোম্পানির মালিকের আত্মীয়। ব্যাপারটাতে বেশ বিব্রত ইরশাদ কিন্তু মালিকের কান্ডটাও চোখে লাগার মত। ইরশাদ খোঁজ নিয়ে জেনেছে আগের অফিসারটা নাকি এত সুবিধা পায়নি। সত্যি বলতে ইরশাদ দু দিনেই কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে সব শুনে। এমন কি কারণ হতে পারে এত ভোগ সুবিধা দেওয়ার! সে কোয়ালিফায়েড পার্সন হওয়ায় কয়েক জায়গায় ভাল পদে চাকরি পেয়েছে কিন্তু সবটা মনঃপুত হয়নি বলে সেগুলো এক্সেপ্ট করেনি কিন্তু এখানে তুলনামূলক কম স্যালারিতেও আসার পেছনে কারণ ছিল এই পরিবেশ৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোন ভুল করলো নাতো! আজ বসের বাড়িতে ডিনার তাও কিনা সপরিবারে৷ পরিবার বলতে শুধু বাবা-মা ভাই-বোন স্ত্রী সন্তান নয় বাড়ি বয়ে এসে বাগানের ম্যানেজার জানালেন ইরশাদের শ্বশুরবাড়ির যে কজন আছে সকলেই যায় যেন। ইরশাদ বাড়ি ফিরতেই সবাই তৈরি হতে গেল। রাত আটটা নাগাদ কেয়ারটেকার হামিদুল এসে বাড়ির উল্টোদিকে বসের বাংলোয় নিয়ে গেল সবাইকে। এ জায়গাটা খুব বেশি উঁচু নয় আবার একদম সমতলেও নয়। বাড়ি বস নিশ্চয়ই খুব শৌখিন মানুষ তা পুরনো বাড়িটা দেখেই আন্দাজ করা যায় তারওপর এই নতুন বাড়িটির আশপাশ দামী সব পাথর আর মোজাইকে চমৎকার হাঁটাপথ সদর দরজা অবধি, গাড়ি বারান্দা সেই সাথে একটা লন তাতে ছোট্ট একটা নীলচে পানির সুইমিংপুল, আশপাশটা গাছের সমারোহপূর্ণ। পাহাড়ি এলাকায় এত চমৎকার এক বাড়ি রাতের কৃত্রিম আলোতেই যেন সকলের চোখ ধাঁধায়। মৈত্রী আজ তাতের শাড়ি পরেছে তার ওপর লং স্লিভ, ফুল নেক মোটা ব্লাউজ ওপরে শাল, চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপায় বাঁধা। লন সাইডের হলদে আলোর আভায় ইরশাদ তাকে এক পলক দেখে আফসোস করল ঘরে কেন একটু খেয়াল করে দেখলো না! এত স্ত্রী যে মোহনীয় রূপময়ী তা যে ইরশাদের আজকের আগে অজানা ছিল বুঝতে পারলো। ফুলশূন্য খোঁপায় তাকিয়ে হাঁড় কাঁপানো শীতেও বুঝি একটু একটু উষ্ণ হচ্ছিলো ইরশাদ। খুব করে মন টানছিলো এই ধোঁয়ার মত কুয়াশাতে লনের একপাশে দোলনা বেঁধে মৈত্রীকে তার বুকের ওমে জড়িয়ে নিয়ে রাতবিলাস করতে।

“আরে আসুন মি. ইরশাদ ভেতরে আসুন আপনারা সবাই।”

সদরে দাঁড়ানো প্রায় ত্রিশোর্ধ লোকটি বেশ হাসি হাসি মুখ করে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে৷ ইরশাদ লোকটিকে চেনে বসের একমাত্র ভাগ্নে জয়। এই লোকটাই মোটামুটি সব কিছু দেখাশোনা করে বলে জেনেছে ইরশাদ। দু দিনের মাঝেই তার সাথে বেশ বন্ধুসুলভ আচরণ দেখিয়েছে লোকটি কিন্তু এত ঘটা করে দাওয়াত করে বস কি নিজে উপস্থিত নেই? ইরশাদের ধারণাই সঠিক বস লোকটা নিজে নেই এখানে। কোন এক অজানা শ-ঙ্কা-য় ভীত রইলো তার মন৷ বসের ভাগ্নে বেশ খাতির যত্নের সাথে ডিনার সম্পন্ন করালো এবং লোকটার স্ত্রী আর একটি সাত বছরের মেয়েও উপস্থিত ছিল সেখানে৷ সবে মিলে বেশ চমৎকার সময় কাটলো তাদের একত্রে৷ ফিরে আসার কথা তুলতেই লোকটার স্ত্রী বিনয়ের সাথে আবদার জুড়লো বাড়িতে একটু ঘুরে নিতে৷ ইরিন আর রোকসানা রাজী হলো সহজেই তারা মূলত পুরুষ আড্ডায় কাজকর্ম আর ব্যবসায়িক আলোচনায় বসতে বি-র-ক্ত বোধ করছিল৷ মৈত্রীও মামনি আর শ্বাশুড়ির সাথে যুক্ত হতে শেলিকে নিয়ে উঠে পড়লো বসার ঘর থেকে৷ তারা দেখলো বাড়ির বাইরেই নয় শুধু ভেতরটা বিভন্ন জাতের প্ল্যান্টে সজ্জিত, সবুজাভ হয়ে আছে বাড়ির প্রায় প্রতিটি দেয়াল৷ এ বাড়ির ভেতরটা ঘুরতে ঘুরতে ইরিনের হঠাৎই মনে পড়লো তার কলেজ জীবনের সময়টা। তার খুব চেনা আরও একটি বাড়ি ঠিক এমন করেই গাছ, লতাপাতায় সজ্জিত ছিল। সারা বছর একটা মানুষ এমন সব নানা জাতের লতাপাতা এনে ভরে ফেলত বাড়ি আর ইরিনের জন্মদিনে তাদের বাড়িতেও সকল উপহারের সাথে একটি করে লতা পাতার টব এসে হাজির হতো বাড়িতে। ভেতরে ভেতরেই একটা দী-র্ঘ-শ্বাস ফেলল ইরিন পুরনো সেই কথাগুলো মনে করে। মনুষ্যজাতি বড়ই আজব। মোহের পেছনে সম্মানের বলি দিতে সদা প্রস্তুত থাকে৷ বাড়ির আনাচকানাচে ঘুরে ফিরে প্রত্যেকরই মনে হলো বাড়ির মালিকটি আসলে শুধু অর্থের মালিকই নয় শৌখিন এক মনেরও অধিকারী। মেয়েমহল ঘোরাঘুরি ইতি টেনে যখন বসার ঘরে উপস্থিত হলো তখন ইরশাদ আর ফখরুল দুজনেই ভিডিও কলে কথা বলছে কারো সাথে। ইরিনের কানে ফোনের ওপাশের ব্যক্তির কণ্ঠ পৌছুতেই কেমন চ-ম-কে গেল সে। ভয়ও বুঝি পেল একটু। ঠিক আটাশ কি তিরিশ বছর আগের ভয়টা এসে হা-না দিল বুকের ভেতর৷ কণ্ঠটি কি ফয়সাল ভাইয়ার? অবচেতন মন যেন তাকে প্রশ্ন করে বসল। তার প্রশ্নের জবাব মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই পেয়ে গেল সে যখন ফয়সাল বলল, “ইরিন কোথায় ও আসেনি?”

“জ্বী আঙ্কেল আম্মুও এসেছে” এটুকু বলেই খেয়াল করলো আম্মু পাশে তাই সে আবার বলল, “আম্মু এখানেই আছে।”

“কথা শুনেও চুপচাপ আছে দেখেছো কেমন স্বার্থপর হয়েছে বড় ভাইয়াদের সাথে কথাও বলতে চায় না দাও তো ওকে ফোনটা।”

হুট করে বলা ফয়সালের কথা শুনে হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে এলো ইরিনের। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডেকে বলল, “ইয়া মাবুদ এ বয়সে এমন কোন বঞ্চনা দিও না যার ভার সইতে পারা অ-স-ম্ভব হয়। ছেলে-বউ, বেয়াই -বেয়াইন সকলের সামনে সম্মান রেখো।”

মনে মনে প্রার্থনা করে ভী-ত হাতে ফোনটা নিলো ইরিন। সালাম দিয়ে কেমন আছে জানতে চাইলে ফয়সাল চমৎকার হেসে খুব স্বাভাবিক আ-চ-র-ণে কত কি প্রশ্ন করে গেল৷ ইরিন ধীরে ধীরে খুব মেপে জবাব দিয়ে গেল। খুব বেশি সময় তাকে আ-ত-ঙ্কিত থাকতে হয়নি ফয়সালই কোন জরুরি কাজের জন্য কল কা-ট-লো। বাড়ি ফিরে সকলে ঠিকঠাক জানতে পারলো ফয়সাল মানে ইরশাদের বস তার বড় মামার বন্ধু৷ আর ইরিনকেও চেনে খুব ছোট থেকে তাই সবদিকেই এত খাতির যত্ন। লোকটা কোন কারণে আজও বিয়ে করেনি তবে একমাত্র ভাগ্নে আর ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা মিলে সকল ব্যবসা বানিজ্য দেখাশোনা করছে৷ সকলে এতে যেন বেশ স্বস্তি পেলেন ইরশাদ মৈত্রীর এখানে থাকার ব্যপারে শুধু এক আকাশ পরিমাণ ভ-য় চে-পে রইলো ইরিনের বুকে। লোকটা কম হয়রানি তো করেনি বয়সকালে এখন কি আবার কিছু করবে!

নোরা ইউ কে’তে যাওয়ার আজ পঞ্চম রাত চলছে। এত দিনে ময়ূখের সাথে তার কথা হয়েছে মোটে পাঁচবার৷ দু’জন চোখের যেমন দূরে আছে মনেরও ঠিক তেমনই তবুও সম্পর্কের দা-য়-বদ্ধতা মনে রেখেছে একমাত্র ময়ূখই৷ আজ রাতে কল আসবে না একটু আগেই জানা গেল ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে৷ নোরা ছোট্ট করে গুড না-ই মেসেজ পাঠিয়েছে সাথে আরও লিখেছে আজ সে ভীষণ ব্যস্ত তাই আর কল দেবে না। সে সত্যিই কল দেয়নি আর ময়ূখেরও ঠিক অভ্যাস গড়েনি তেমন তাই র-ক্ষা৷ আজ রাতে তার বাইরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু এখানকার প্রচণ্ড শীতে তা সম্ভব নয়। তবুও একটুখানি স্পেস তো অবশ্যই চাই তার এই মুহুর্তে তা বুঝতে পেরে ঘর থেকে বের হলো। ফখরুল টের পেয়েছে পাশ থেকে উঠে ময়ূখের বাইরে যাওয়া৷ ছেলেটার কি হলো মাথায় আসছে না তবে তিনি ভীষণ রেগে আছেন নোরা মেয়েটার ওপর। বিয়েটা কি ছেলেখেলা! ছেলেটাকে রেখে কিভাবে চলে গেল মেয়েটা! ইচ্ছে হলো কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিলো আবার কারো অনুমতি না নিয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেল ভীনদেশে।

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৩(শেষাংশ)

বাড়ি ফেরার আগে শেষদিনে খুব ঘুরে বেড়ালেন আজ সকলে৷ ইরশাদ অফিসে তাই তাকে ছাড়াই ঘুরে বেড়ানো হলো তবে আজকের বেড়ানোটা শুধু আশপাশের কিছু সুন্দর জায়গা দর্শন হয়েছে। পরেরবার সকলে প্ল্যান করে সিলেটের সুন্দর সকল এলাকা ঘুরবে এসে এমনটাই সিদ্ধান্ত হলো। রাতে যাওয়া হবে বলে ইরিন আর রোকসানা মিলে সন্ধ্যার রান্না করলেন৷ কাল থেকে এ সংসার হবে মৈত্রীর একার এ নিয়ে দুজনেরই চি-ন্তা-র শেষ নেই। রান্নাবান্না নিয়ে ইরিন নিশ্চিন্ত সে জানে ইরশাদ নিজেই এদিকটা পাকা হাতে সামলে নেবে হয়তো তার স্ত্রীকে শিখিয়ে পরিয়ে নেবে। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য কাজগুলো যখন ইরশাদের অনুপস্থিতিতে করবে আর বাড়িটাতে সে থাকবে একা এখানেই যত দু-শ্চি-ন্তা।
ইরশাদ কেয়ারটেকার সাহেবের স্ত্রীর সাথে কথা বলে দিনের বেলা কাজের জন্য একজন লোক ঠিক করে দিতে বলেছিলেন। ইরশাদ ভোলোনি সামনেই মৈত্রীর পরীক্ষা তাই সে ঘরদোর এর কোন কাজ করতে পারবে না৷ হামিদুর জানিয়েছেন তার প্রতিবেশী একজন গরীব মহিলা আছেন যার কাজ প্রয়োজন। মহিলা মধ্যবয়স্ক তবে কাজে বেশ ভালো এবং বিশ্বস্ত বললে সে সারাদিন এখানেই থাকবে৷ এমনই কাউকে প্রয়োজন মৈত্রীর পাশে। দিনভর একা থাকবে এই বাড়িটিতে সেটাই ইরশাদের মূল চি-ন্তা ছিল৷ রোকসানা বলেছিল মৈত্রীকে আদা-রসুন বাটা, ধনে, জিরা বিভিন্ন মশলা সব কিছুর পেস্ট করে দিয়ে যাবেন আর তাই সন্ধ্যায় লিস্ট দিয়ে ময়ূখ আর কেয়াররেকার কে দিয়ে সব বাজার করালেন। রাতের রান্না বসিয়ে শেলি আর ইরিন মিলে সব কে-টে, বেছে গুছিয়ে দিলে খাওয়ার পর সব ব্লেন্ড করতে করতে মৈত্রীকেও সব শিখিয়ে দিলেন৷ বিয়ের সময় বা তার পর মৈত্রী বাবার বাড়ি কিংবা পরিবারের জন্য হয়ত এতোটাও ক-ষ্ট হয়নি যতোটা আজ হচ্ছে৷ সে চুপচাপ মামনিকে দেখতে থাকলো সারাটা সন্ধ্যা। তাদের যখন যাওয়ার সময় হলো ঠিক তখনই মৈত্রী অকস্মাৎ মামনির বুকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো৷ মা কি এমনই হয়! নিঃশব্দে কা-ন্না করা মেয়েটা আজকাল এত কাঁ-দতে জানে! মুজিবসহ বাকিরা সকলেই চুপচাপ সেই কান্নার দৃশ্য দেখলো৷ ময়ূখও দেখল দূর থেকে আর তখনই সে টের পেল এই মেয়েটাকে সে কখনো ভুলতেই পারবে না। এই যে এখন বুকের পাঁজরে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে তা ওই চোখের গড়িয়ে পড়া জলের জন্যই তো! ময়ূখ মনে মনে যখন এ কথা ভাবল ঠিক তখনই চোখে পড়লো মৈত্রীর একটু পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটিকে৷ বি-ষা-দের জল লুকাতেই দু চোখ বুঁজে নিয়েছে ময়ূখ৷ ওই পুরুষটা তার ভাই তার একমাত্র ভাই যে কিনা তাকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে আদরে, আবেশে বড় করেছে৷ তার পাঁজর ভা-ঙা ব্যথা যে মেয়েটির জন্য সেই মেয়েটিই তারই ভাইয়ের শরিক- ই – হায়াত, শরিয়ত মেনে বিয়ে করা বউ। জীবনের প্রতিটি স্তরে কিছু না কিছু কাঁকর বিছানো থাকে কিন্তু এমন ধা-রা-লো কেন সেই কাঁকর! তার যে পথ চলা বড় য-ন্ত্র-ণা-দা-য়-ক হয়ে উঠছে। ময়ূখ ব্যাগপত্র গাড়িতে তোলার বাহানায় আগেই বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। এখানে থাকলে মৈত্রীর অশ্রুভেজা নয়ন তাকে এলোমেলো করে দেবে। কতোটা সামলে রাখার চেষ্টা সে চালায় রোজ তার মনের ওপর এ খবর কারো জানা নেই। নোরাকে সে নিজের বলে ভাবার চেষ্টায় কত যে ডুবতে চেয়েছে, কখনো শরীরি ভাষায় কখনো কল্পনায় কিন্তু সব ছাপিয়ে মন যে তার এখনো ওই উদাসী মেয়েটাকেই খোঁজে।

মৈত্রীকে থামিয়ে অনেক বুঝিয়ে সকলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। গাড়িটা কাঁচা মাটির পথ ছাড়তেই ইরশাদ মৈত্রীর হাত ধরে তাকে বাড়ি নিয়ে এলো। একটু আগ পর্যন্তও হৈচৈ- এ সরগরম থাকা বাড়িটাতে ঝুপ করেই একরাশ নীরবতা নেমে এল। ইরশাদ বাড়ির গেইটটা লাগিয়ে দিয়ে দোলনার দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে মৈত্রীকে বলল, “এক মগ কফি নিয়ে এসো তো!”

মৈত্রী ঘরের দিকেই যাচ্ছিল। ইরশাদের হঠাৎ এমন আবদারে সে একটু অবাকই হলো। বিয়ের প্রায় মাস হতে চলল এই প্রথম ইরশাদ তাকে কোন কাজের কথা বলল৷ মৈত্রী ঘরে ঢুকে দ্রুত পানি চুলায় বসিয়ে বসার ঘরে গেল। ইরশাদের ফোনটা বাজছে কানে আসছে। ফোন হাতে মৈত্রী শ্বশুরের নম্বর দেখে নিজেই রিসিভ করলো। তিনি জানালেন ইরিনের কানের একটি দুল হারিয়েছে বাড়িতে যেন একটু খুঁজে দেখে৷ মৈত্রী ফোন ছাড়তেই রান্নাঘরে ঢুকে কফি তৈরি করে ফোন আর মগটা নিয়ে বাইরে গেল। শীত শেষের দিকে বলে ইরশাদ ভেবেছিল এখন অতোটা তীব্রতা থাকবে না। কিন্তু এখন এ ক্ষণে দোলনায় বসার পর থেকেই তার মনে হচ্ছে শীতটা এখন জাঁকিয়ে পড়েছে। মৈত্রী সামনে এসে কফি মগ আর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “আম্মুর কানের দুল হারিয়েছে আব্বু ফোন করেছিলেন।”

“ওহ!” বলেই ইরশাদ ফোন নিয়ে পকেটে রাখলো তারপরই মগ হাতে মৈত্রীকে একটানে নিজের পাশে দোলনায় বসিয়ে দিল। হুট করে টেনে ধরায় দোলনাটা দুলে উঠেছে, কফি ছলকে কিছুটা পড়েছে ইরশাদেরই ডান হাতের কব্জিতে৷ সে আহ্ বলে আর্তনাদ করলেও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মৈত্রীর হাত চে-পে রাখলো।

“আপনার হাতে কফি..”

“কিচ্ছু হয়নি।”

“ফোসকা পড়ে যাবে আসুন পানি..”

“বললাম তো কিছু হয়নি। কথা আছে তোমার সাথে। আশা করি আগে সবটা শুনবে তারপর রিয়াক্ট করবে।”

বাগান এবং বাড়ির চারপাশ জুড়েই নিয়ন বাতি অনেকটা ঢাকার রাজপথের মতোই। তবে এখানে অসংখ্য গাছের পাতায়, ডালে কুয়াশার জমাটবাঁধা আস্তরণ ভেদ করে সে আলো বড্ড ফিকে। মৈত্রী পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো ইরশাদের মুখের দিকে। এই মানুষটার চোখে কাঠিন্যতা, চোয়ালের পেশী শক্ত হয়ে কেমন তার চেনা ইরশাদকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। একটু বুঝি ভয়ও হলো মৈত্রীর৷ অবচেতন মন বলল, তার করা অবহেলার জন্যই কি মানুষটা এখন এই ফাঁকা বাড়িতে তাকে শা-স্তি দেবে! কিন্তু না তাকে অবাক করে দিয়ে তাকে চমকে দিয়ে ইরশাদ কথা বলা শুরু করল, “তুমি আজ পাঁচটা দিন হয় আমাকে ইগনোর করছো। যে তুমি আমাকে এক পলক দেখার জন্য মধ্যরাতেও বেলকোনিতে দৃষ্টি মেলতে সেই তুমি এক ঘরে থেকেও আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছো না। কারণটা কি আমি প্রশ্ন করব না আমি নিজেই এ ক’দিন অনেক ভেবে বুঝে গিয়েছি কারণটা সায়রা।

‘সায়রা’ ইরশাদের মুখে নামটা শুনতেই বুকের ভেতর ছু-রি-র আঘাত পরলো যেন। মৈত্রী বসে রইলো শ-ক্ত হয়ে। সে শুনতে চায় ইরশাদ ঠিক কি ভেবে নিয়েছে আর কি বলতে চায়! আবার মন স-ত-র্কও করছে, মানুষটা যদি বলে সত্যিই তার সায়রা ভাবীর সাথে কোন অবৈধ সম্পর্ক ছিল? ইরশাদ তো তাকে ভালোবাসে না বিয়েটা তো করেছিলো তারই স্টুপিড আচরণ আর কা-ন্না করা দেখে। মাঘের পাহাড়ি শীত আর রাতের আধার ইরশাদের ভেতরের জমিয়ে রাখা অতীতকে কাঠ কয়লার উষ্ণতা দিতেই আজ বেরিয়ে আসতে চাইছে ভেতর থেকে। হয়তো এটাই হবে উত্তম তার, তাদের এই নতুন জীবনে। এমনটা ভেবেই ইরশাদ বলতে থাকলো,

” তোমাকে আমি বলেছিলাম বলবো সায়রাকে নিয়ে কিন্তু সময় চাই আমার। আজ বুঝতে পারছি সময় আপনা থেকে আসে না নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়।” এতটুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরশাদ। মৈত্রীর বুক ধড়ফড় করছে এমন কিছু যেন না শুনতে হয় যা শোনার পর সে ইরশাদকে ঘৃণা করবে কিংবা সেই রূপসী নারীটিকে।

“সায়রা আর আমার পরিচয় কলেজ জীবন থেকে৷ কলেজের প্রথম সারির সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে বোধহয় সেই ছিল প্রথম। আর পড়াশোনায় ক্লাসের প্রথম ছেলেটি ছিলাম আমি৷ পড়াশোনার বাইরে কৈশোরের প্রথম প্রথম প্রেমানুভূতি আমার তাকে দেখেই হয়েছিল। কমবয়সী আমি তখন কলেজের সেরা সুন্দরী মেয়েটির প্রেমে পড়ে উ-ন্মা-দ হয়ে কত কি করে ঘুরতাম শুধু মাত্র মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই। একসময় আমার লেখালেখি কাজে এলো। তখনো আমার ঝুলিতে বাচ্চা বাচ্চা হাস্যরসাত্মক গল্প লেখা ছিল কিন্তু সায়রার দৃষ্টি কাড়তে প্রেমময় গল্পও লিখতে শুরু করি। বন্ধুরা সেসব মেয়েটির কাছেও পৌঁছে দেয়। এসবেই একটি বছর পেরিয়ে গেল। সায়রা প্রথম বর্ষে হায়ারম্যাথ খারাপ করলো। আমার সুযোগ বাড়লো যেচে তাকে নিজের মত ম্যাথ বোঝানোর নামে সময় কা-ট-তো আমাদের। কখন, কিভাবে জানি না সায়রাও আমাকে পছন্দ করতে শুরু করল। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার আগেই দুজনের প্রেম হয়ে গেল। তারপর ভার্সিটি এডমিশনের পড়া, এক্সাম সব হলো একসাথে ৷ সৌভাগ্যক্রমে একই ভার্সিটিতে দুজনেরই হয়ে গেল শুধু ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন। প্রেম থামলো না আমাদের ততদিনে আমার বাড়িতে সকলেই জেনে আমার প্রেমের খবর৷ কেউ কেউ প্রেমিকাকেও চিনলো কিন্তু বড় চাচু খুব সাবধান করতেন যেন এ সম্পর্ক গভীর না হয়। প্রেম কি কারো কথা শোনে! হয়ে গেল গভীর প্রেম, কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবো না টাইপ প্রেম হয়ে গেল দুজনের।” এক নাগাড়ে বলে গেল ইরশাদ৷ মৈত্রী চুপচাপ শুনলেও তার শরীর কাঁপছিল ভ-য়ে, প্রেশার ফল-আপ করছিলো অতিরিক্ত টেনশনে ইরশাদ পাশে বসেও যেন তা টের পেল না৷ অথচ শীত বলে মৈত্রীর গায়ে শাল পেঁচানো ইরশাদ বসে আছে শুধুই শার্ট গায়ে।

“ইমরান ভাই আমার মেজো চাচার ছেলে। বয়সে বড় হলেও আমাদের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মত ছিল৷ একই ভার্সিটিতে দুই বছরের সিনিয়র সে সকলেরই খুব পছন্দের। ইমরান আর আমি দুজনেই একই ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। কিন্তু চাল -চলন আর চঞ্চল স্বভাবের ইমরান ইউনিভার্সিটিতে ফেমাস একজন ছিল। ভার্সিটির অসংখ্য নারীর মনপুরুষও ছিল সে কিন্তু তার মনের রাজ্য তো চাইছিল সায়রাকে। বাঁধাহীন প্রেমের সময় আমাদের টানা সাড়ে চারবছর কে-টে যাওয়ার পর এক সন্ধ্যায় ইমরান ক্যাম্পাসে সব বন্ধুদের নিয়ে নিজের বার্থডে পালনের নামে আয়োজন করে ছোট্ট এক অনুষ্ঠানের। আমি তার ভাই সে হিসেবেই প্রত্যেকের আগে আমিই থাকি সে আয়োজনের মেহমান। ইমরান সিনিয়র তার বার্থডে তে তার বন্ধুরা আসা স্বাভাবিক, ভাই হিসেবে আমার উপস্থিতিও স্বাভাবিক কিন্তু অন্যদেরটা! তাই ইমরান আমাকে দিয়েই আমার বন্ধুদের দাওয়াত করায় এবং তাতে সায়রা, নিয়া, রাহী আরও কিছু মেয়ে বান্ধবীও থাকে। ভাইয়ের জন্মদিন চমৎকার আয়োজন তাতে গার্লফ্রেন্ড থাকবে এতে সব ছেলেরই আনন্দিত হবার কথা আমিও হয়ে ছিলাম। কিন্তু সেটাই ছিল আমার বিগত জীবনের শেষবারের আনন্দ। রাত নয়টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান হবে এমনটাই ঠিক করা ছিল কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হলো না। সায়রা তাড়া দিলো তাকে ফিরতে হবে কিন্তু ইমরান হুট করে বলল সে পাশেই তার বন্ধুর বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন করেছে। বন্ধুর বাড়িটা আমি চিনি তাই খুব একটা আপত্তি করিনি তার ওপর গ্রুপের সকল মেয়ে যাচ্ছে। সেখানে পৌছুতেই ইমরানের এক বান্ধবী জুস দিলো আমাকে, সায়রাকে বাকিরা তখনো বিভিন্ন গল্পে মশগুল। সায়রা বলল ওয়াশরুমে যাবে আমি তাকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিতেই ইমরানের বন্ধু নাহিদ আমাকে ডাকলো। কারো হাত কে-টে গেছে তাকে একটু চেক করতে। আমি আবার পড়াশোনার মাঝেই মেডিক্যাল ক্যাম্পের কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় ছুটে গেলাম সেদিকে। আমার কাজ শেষ হতে মাত্র মিনিট পনেরো লেগেছিল।”

ইরশাদ থেমে গেছে এতটুকু বলেই৷ বাইরের কুয়াশা এবার তার চোখেও এসে জমলো। ঝাপসা হয়ে গেল দৃষ্টি৷ মৈত্রী ঘাড় ফিরিয়ে পাশের মানুষটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইলো বোধহয় থেমে যাওয়ার কারণ৷ কিন্তু ইরশাদের চোখ দেখে তার আর বসতে ইচ্ছে করলো না সেখানে। এই মানুষটাকে সে ভালোবেসেছে চোখ দুটি দেখেই কিনা তাই ও চোখে অন্য কারোর জন্য জল তার সহ্য হবে না৷ সে বসা থেকে উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো৷ হাতটান পড়লো, ইরশাদ হাত ধরে রেখেছে৷

“যে ঘরের ওয়াশরুমে সায়রাকে দিয়ে এসেছিলাম সে ঘরেই সায়রা বসেছিল ইমরানের বাহু জড়িয়ে। আমি এসে আধভেজানো দরজা দেখে থেমে গিয়েছিলাম৷ মনে হলো নক করে ঢোকা উচিত কিন্তু বেতর থেকে আসা কণ্ঠস্বর… আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনি মৈত্রী। ইমরান সায়রাকে জড়িয়ে রেখে বারবার বলছিল, আর কিছু দিন সোনা তারপরই আমরা বিয়ে করব। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতেই তোমাকে বাড়িতে তুলব। কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই আমার চোখের সামনে তাদের কিস….”

ইরশাদ একটা কথাও গুছিয়ে বলতে পারেনি। মৈত্রীর পা অসাড় হয়ে গেছে এই অগোছালো কথার মাঝে সায়রা আর ইমরানের কথা জানার পর ৷ ইরশাদ কি বলল সাড়ে চার বছর! এত গুলো বছর একজনের সাথে প্রেম করে তারই ভাইয়ের সাথে বিয়ে, কিস! মৈত্রীর মনে হলো এসব কথা না জানলেই ভালো হতো৷ মৈত্রী পাশে বসলো ইরশাদের। নিজের গায়ের শালে হঠাৎই সে ইরশাদকেও নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। ইরশাদ পরের কাহিনীটুকু বলার জন্য মুখ খুলতেই মৈত্রী ইরশাদের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে খুব ধীরে বলল, “আমার খুব শীত লাগছে একটু জড়িয়ে ধরবেন?”

ইরশাদ জানে মৈত্রী আর শুনতে চাইছে না । হয়ত সইতে পারছে না আর। তবুও এ যে শেষ না করলে চলছে না৷ নতুনের জন্য পুরনোর বিসর্জন জরুরি৷ পুরনো অধ্যায় সরিয়ে নতুন ভোরের আয়োজন হোক।

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩৪

লন্ডন বরাবরই এলিট এডুকেশনের জন্য ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল উভয় স্টুডেন্টদের জন্য উচ্চ আকর্ষণীয়। নোরার ন্যাশনালিটির জন্য এ সুযোগ তার জন্মগতভাবেই পাওয়া হয়েছে। শাইন বরাবরই মেয়েকে ডক্টর হিসেবে দেখতে চাইতো এ নিয়ে আফছারেরও মতবিরোধ ছিল না। তবে তারা কখনোই মেয়েকে এ নিয়ে প্রেশারাইজ তো দূর আগে থেকে কোন সিদ্ধান্তও দেননি৷ নোরা নিজ থেকেই পড়াশোনায় পছন্দসই এগিয়েছে। পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে বিএসসি সাইকোলজি তিন বছরের আন্ডাটগ্রাজুয়েশন প্রোগ্রাম নোরার নিজ পছন্দ এবং পরিশ্রম ছিল৷ এখনো তার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটেনি সে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে প্রচণ্ড এক্সট্রা অর্ডিনারী তা হঠাৎই চোখে পড়েছিল তার প্রফেসরের। সেই থেকেই লোকটা তাকে বিভিন্নভাবে এগিয়ে যেতে সবরকম সাপোর্ট করেছে। কিন্তু তাকে কিছু বিষয়ে স-ত-র্ক-তাও জানিয়েছে। হি-প-নো-টি-জ-ম শব্দটার সাথে যেদিন প্রথম পরিচয় ঘটেছে নোরার সেদিন প্রফেসর এর প্রথম শর্ত ছিল শুধুই চিকিৎসার প্রয়োজনে হবে এর ব্যবহার। কখনো কোনো অ-ন্যা-য়, অ-প-ক-র্মে-র স্বার্থে কাউকে হিপ-নো-টাইজ করা যাবে না করলে সেটা ক্রা-ই-ম হিসেবেই ধরা হবে এর কথিত কিছু শা-স্তিও আছে। নোরা অবগত তার শিক্ষার প্রয়োগ বিস্তারিত তবুও সে করেছে কাজটা। ময়ূখকে সেদিন বিয়ের স্টেপ নিতে সে ঠিক এ কাজের মাধ্যমেই বাধ্য করেছিল। লন্ডনে সে চাইলেই বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে নিতে পারে, দৈহিক চাহিদায় লিভ ইনও খুব সহজেই করতে পারতো। আফটার এইটটিন তার পেরেন্টস তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। যদিও নোরা এদিক থেকে ইউ কে’তে থেকেও কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত ছিল তার পিতার কারণে। তবে দেশে এসে প্রথমবার যখন ময়ূখের সাথে সামনাসামনি পরিচয় হলো তখন সে বুঝতে পারলো এই ছেলেটাকে তার ভালো লাগে। চোখের সামনে যখন ফ্রেন্ডদের ক্লোজ ডেট দেখে অভ্যস্ত সেখানে পছন্দের ছেলেটির হাত ছুঁয়ে দেখতেও তাকে দশবার ভাবতে হতো। দেশে আসার সময় গুলো তার কা-ট-তো ভীষণ সাধারণ আর বাঙালি সংস্কৃতি নিজের মধ্যে ধারণ করে। ময়ূখের প্রতি তার আকর্ষণ দিন দিন বেড়ে গেল তাকে হাতের কাছে পেয়ে না পাওয়ার হতাশায়। কৈশোরের চাহিদা যুবতী বয়সে আ-ক্ষে-প হয়ে উঠলো এক সময়। প্রায় প্রতি বছরই নোরা দেশে আসতে থাকলো আর পুরো সময়টা সে বিভিন্ন বাহানায় ফুপির বাড়ি না হয় ট্যুর দিত তার সঙ্গী হিসেবে মেহের তো থাকতোই সাথে ময়ূখকেও থাকতে হতো। আগে ইম্যাচিউর আইডিয়াস দিয়ে ময়ূখের সঙ্গ পাওয়ার চেষ্টা করলেও এবার ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। ময়ূখের দু চোখের ভাষা পড়তে তার সময় লাগেনি সেই সাথে নির্লিপ্ত মেয়ে মৈত্রীর চোখ দুটোও সে দীর থেকেই পড়তে পেরেছিল। নোরা আপন মানুষদের মাঝে কূ-ট-চাল করার কথা কখনো ভাবেইনি অথচ এবার সে সর্বাধিক নিম্ন কাজগুলোই করেছে দূর্বল মনের মানুষগুলোর সাথে। আর তার চৌকস দৃষ্টির শিকার হয়েছে পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের ময়ূখ আর চাপা স্বভাবের মৈত্রী। তবে নোরা পুরোটা পরিকল্পনায় কায়মনোবাক্যে এক ইরশাদ -মেহেরের ভালোটাই চেয়েছে। নোরার মন যেমন ময়ূখকে পাওয়ার লোভে মৈত্রীর মনের ভেতরটাকে উসকে দিয়েছে ভালোবাসার মানুষের দিকে ছোটার জন্য তেমনি ময়ূখকে করেছে কাছের মানুষগুলো থেকে দূর। মুখচোরা নয় সে তবুও নোরার প্ররোচনায় চুপ হয়ে গেছে। শাইন মা হয়ে ঠিকই মেয়েকে বুঝতে পেরেছিল তাই প্রথম থেকেই সাবধান করে গেছেন নোরাকে। সে শোনেনি কোন কথাই বারবার তাকে ফিরে আসার কথা বলেন। তাতেও ভ্রুক্ষেপহীন ছিল নোরা তারই মাঝে জানতে পারে ইরশাদের এনগেজমেন্ট এবং নোরাই কোনভাবে উগরে দিয়েছিল ময়ূখ যে মেয়েটিকে পছন্দ করে সেই মেয়ের সাথেই ইরশাদের বিয়ে। সন্তান যতোই চতুর হোক, যতোই বুদ্ধিমতি হোক না কেন মা-বাবার সতর্ক নজরে সেসব আড়াল হয় না। নোরারও হয়নি, শাইন তার প্রতিটি পদক্ষেপ, পদাচারণে দৃষ্টিপাত করে আফছারের সাথেও যোগাযোগ করেন। প্রকৃতির হিসেব মানুষের হিসেবের চেয়েও কঠোর হয় তা হয়ত আফছার বয়সের অর্ধেক পেরিয়েও আন্দাজ করতে পারেননি। তাইতো নিজ কন্যার ভুলগুলো জানার পর চুপচাপ গা ঢাকা দিয়ে বসে রইলো ঢাকায়। তার ধারণা মেয়েটি মায়ের পথে হাঁটবে না। আপন ভাতিজার সাথে যদি সত্যিই কিছু হয়ে যায় তবে সে সারাজীবনের জন্য মেয়েকে আ-ট-কে রাখতে পারবেন। নোরা হয়ত অধ-র্মে-র পথ ছেড়ে আসবে ময়ূখের খাতিরে। ভুল ছিল সে ; মেয়েটি তার শুধুই নিজের ইগো স্যাটিসফাই করতেই ময়ূখের সাথে নিজেকে জুড়েছে৷ নোরাকে থামাতে না পেরেই শাইন প্রফেসরের শরণাপন্ন হয়েছিল। সব শুনে প্রফেসর নোরাকে বিভিন্নভাবে শাষন-বারণে দেশে ফিরে আসতে বলেছে এমনকি তার তিন বছরের কোর্সে এখনও একটি বছর বাকি সেই বছরটি এবং ক্যারিয়ার নিয়ে হু-ম-কিও দিয়েছেন। তার ফিরে যাওয়ার সময় অল্প ছিল বলেই সে তার শেষ চাল হিসেবে হিপনোটাইজ করেই রেজিস্ট্রি করিয়েছে৷ তাতে সে লাভবানও হয়েছে সকলে নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে বিয়েটা, ময়ূখ সেও কি বাদ আছে! হয়তো ভালোবাসতে পারছে না কিন্তু নোরাকে ঠিকই মেনে নিয়েছে। এইতো চেয়েছিল নোরা।

“ইউ শ্যুড পে ফর ইউর অল মিসটেইকস এন্ড কন্সপিরেসি। ডু ইউ নো হোয়াট হ্যাভ ইউ ব…” প্রফেসর আজ থার্ডটাইম নোরাকে একই কথা বলতে যাচ্ছিলেন তাই নোরা তাঁকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিল। সে স্বীকার করে নিলো নিজের ভুলগুলো। বিয়েটা নিয়ে সে সিরিয়াস ছিলো না কিন্তু ময়ূখের সাথে থাকতে চায় এ কথা সত্যি। নোরা নিজেই তার করা প্রতিটা কাজের জন্য কৈফিয়ত দিল সব শুনে প্রফেসর বলে দিলেন সাইকোলজি নিয়ে পড়া নয় বরং তার এ মুহূর্তে ট্রিটমেন্ট জরুরি। প্রফেসর আর নোরার কথার মাঝেই নোরার ফোন বাজল। ময়ূখ কল করছে! প্রফেসর কল দেখে নিজের কথা শেষ করে নোরাকে বেরিয়ে যেতে বলল।

“কেমন আছো?”

” ফাইন, তোমার টেক্সট ছিল কল দেওয়ার কথা লিখেছিলে।”

ময়ূখ কথাটা বলেই আবার প্রশ্ন করলো, “কোন প্রয়োজন ছিল?”

“এভাবে বলো কেন ময়ূখ! আ’ম ইউর লিগ্যাল ওয়াইফ নট আ আউটসাইডার।”

“স্যরি, ব্যস্ত ছিলে!”

“নো”

“আন্টি কেমন আছে?”

“আই ডোন্ট নো… ময়ূখ এখানে চলে আসো।”

নোরার কণ্ঠে আবদার ছিল না, আকুলতা ছিল না। ময়ূখ শুনেও কিছু বলল না জবাবে। নোরার সাথে তার কিছুতেই মিলবে না তা সে জানে তবুও জীবনটা তো কা-টা-তে হবে ভেবেই বুঝি সে এ পথে অগ্রসর হচ্ছে। আম্মা চিন্তিত থাকছেন নোরার ফিরে যাওয়ার পর থেকে ময়ূখ তা টের পায়। কিন্তু এ মুহূর্তে তার করণীয় কি সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

রাতটা মৈত্রীর আধ ঘুম আধ জাগরণে কে-টে গেছে কাল। সকালে ঘুম ভেঙেছে বাইরের থেকে কারো হাঁকডাকে। চোখ মেলতেই বিছানার ওপর গুছিয়ে রাখা তার জন্য শাড়ি-ব্লাউজ। ইরশাদ যে রেখেছে তা অজানা নয়। মৈত্রীও আর দেরি না করে গোসলের জন্য উঠে পড়ল। শীতের সকালে ঠান্ডা পানিতে গোসল অসম্ভব তাই গরম পানি করতেই সে রান্নাঘরে গেল। খুশির কথা হলো ইরশাদ পানিটাও চুলায় বসিয়ে আগুনের আচ কমিয়ে রেখে গেছে৷ মৈত্রী গরম পানি নিয়ে গোসল সেরে আবারও রান্নাঘরে এসেছিল৷ আবারও পুলকিত হলো হটপট আর ফ্লাক্স দেখে৷ পরোটা, চা সবটা তৈরি করে রেখে গেছে মানুষটা! এত উদার আর যত্নশীল হতে কে বলেছিল মানুষটাকে? মৈত্রী খুব লজ্জা লাগছে এবার সে স্ত্রী হয়ে কিছুই করেনি অথচ তার বর কত কি করে৷ তীব্র শীতের সকালে ধোঁয়া ওঠা চা আর পরোটা দিয়ে রাতের মাংসের তরকারি। চমৎকার নাশতা হয়ে গেল মৈত্রীর একা একাই। কাজের জন্য যে মহিলাকে রাখা হয়েছে তিনি এসেছেন একটু আগেই। মহিলাটি ঘরদোর ঝাড়পোঁছ শুরু করতেই মৈত্রী গিয়ে বসলো দোলনায়। পূবাকাশে রোদ তখনও উঁকি দিচ্ছে দিচ্ছে অবস্থায়। শাড়ির আঁচল গুটিয়ে গায়ে থাকা শালটি ভালো করে পেঁচিয়ে সে বসে পড়লো দোলনায় আর তাতেই মনে পড়ে গেল রাতের ঘটনা। ইরশাদ জোর করেই বলেছিল পরের কাহিনিটুকু৷ ইমরান ভাইয়ের বার্থডের রাতের সে ঘটনার পর ইরশাদ ভীষণ বাজে রিয়াক্ট করেছিল। সকলের সামনে সায়রাকে থা-প্প-ড় মে-রেছিল, ধাক্কা মেরে দেয়ালে ফেলে দিয়েছে। সায়রার কপালের ডান দিক ফেটে সেলাই পর্যন্ত লেগেছিল। কিছুদিন যেতেই ইরশাদ মাফ করে দিয়ে সায়রাকে আবার নিজের জীবনে সব স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল। সায়রাও ইরশাদের পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়েছিল কিন্তু তারপর মাত্র দু মাসের মাথায় নাকি হুট করে সায়রা বলল সে ইরশাদকে ভালোবাসে না সে তো ইমরানকে ভালোবাসে। জীবন এতোটাও সিনেমেটিক হতে পারে জানা ছিল না কিন্তু সায়রা তার সাথে নাটকীয় ভাবেই সম্পর্ক শেষ করেছিল। একদিন এসে বলল সে প্রে-গন্যান্ট আর ইমরান তার সন্তানের বাবা। এরপর কি হলো! কোন আলাপ আলোচনা ছাড়াই একদিন মেজো চাচী আর চাচা ইমরানকে নিয়ে গেলেন সায়রাদের বাড়ি সেদিনই সায়রা বউ হয়ে এসে পা রাখলো তাদের বাড়িতে৷ ইরশাদ কিছুদিন একদমই মানতে চাইছিলো না এসব কথা সে রোজ রোজ ইমরানদের ঘরে যেত জোর করে সায়রার সাথে কথা বলত, রাগারাগি করত এমনকি একদিন ইমরানের গায়ে হাতও তুলল। এ নিয়ে পুরো বাড়িতে ঝামেলার সৃষ্টি হতেই সকল চাচা মিলে তার বাবাকে ডেকে কথা শোনালেন। তার ঠিক হল তারা বাড়ি ছেড়ে ভাড়া থাকবেন। তাই করা হলো দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় তারা ভাড়াটে জীবন কা-টা-চ্ছে। এর মাঝে আব্বুর সাথে বড় চাচার যোগাযোগ ঠিক থাকলেও মেজো চাচা আর ছোট চাচার সাথে খুব একটা রইলো না। আব্বু ব্যবসা থেকে ইস্তফা নিয়ে চাকরিতে যোগ দিলেন ময়ূখ বছর কয়েক হলে থেকে পড়াশোনা করল আর ইরশাদ তার স্বপ্নের বিসিএস পরীক্ষায় বসতে পারলো না। মৈত্রী সব শুনে গেল কিন্তু তার বারবার মনে হতে লাগল সায়রা এমন কেন করলো? ইরশাদকে এই প্রশ্নটা করতে গিয়েও করেনি মন বলছিল যদি এমন হয় সায়রা কোন বিপদে পড়ে এমন করেছে তখন ইরশাদের মনে কি আবার সায়রার বসতি গাড়বে? যদি গেঁড়ে যায় সায়রা আবারও ইরশাদের মনে! না না তার পক্ষে এটা মানা অসম্ভব হয়ে পড়বে তারচেয়ে ভালো সায়রা ভুল ছিল কি ঠিক সেসব তাদের অজানাই থাক। ইরশাদের জীবন মানেই এখন মৈত্রীর বসবাস আর কারো নয়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে