কি ছিলে আমার পর্ব-২৩+২৪

0
1967

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-২৩

বিয়ের পর কনের বিদায় পর্ব হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইরশাদ মৈত্রীর ক্ষেত্রে তা হলো না। তারা দুজনে চমৎকার ভাবে গৃহপ্রবেশ করলো উপরতলা থেকে নিচতলায় আর বুদ্ধিটা ছিলো ময়ূখের। সন্ধ্যেলগ্নে ইরশাদের বড় চাচা যখন তাড়া দিলেন বিদায়ের তখন হুট করেই মৈত্রী কান্না করে দিলো। যেন তেন কান্না নয় সবাইকে অবাক করে দিয়ে হেঁচকি তোলা কান্না। ইরশাদকে তখন সবে তার রুমে নিয়ে আসা হয়েছিলো আয়না দেখা আর মিষ্টিমুখ করার রীতি পালন করতে। মৈত্রী এমন কান্না দেখে উপস্থিত প্রত্যেকেই ভ-ড়-কে গিয়েছিল। যে মেয়েকে কেউ হাসি কান্নায় কখনো দেখেনি তার এমন রূপ সত্যিই আশ্চর্যজনক ছিলো পরিচিতদের কাছে। ইরশাদ নিজেও ভীষণরকম চমকেছে যখন দেখলো ঘোমটার আড়ালে মৈত্রী গা কাঁপিয়ে কাঁদছে। সে কপাল কুঁচকে চি-ন্তি-ত চোখে ময়ূখ আর অন্তুর দিকে তাকাতেই অন্তু বলল, “টেনশন নট ভাইয়া মেয়ে মানেই ক্রাইং সিন। দু দিনেই অভ্যাস হয়ে যাবে তোমার মত ফ্যামিলিম্যানের ।”

“তোর খুব অভ্যাস আছে অন্তু!” সন্দেহি চোখে চেয়ে ফিসফিস করে প্রশ্ন করলো ময়ূখ। অন্তু তখন চারপাশে তাকিয়ে তার বউকে দেখলো আছে কিনা। তারপর সেও ফিসফিসিয়ে বলল, “ভীষণ প্যারায় আছি রে ময়ূখ।”

ইরশাদ ঘর ভর্তি মানুষের দিকে একবার তাকিয়ে বলে বসলো, ওকে বোধহয় একটু স্পেস দেওয়া দরকার। কা-ন্না-কা-টির মাঝে আবার ঘরভর্তি মানুষে হয়তো বেশিই অ-স্থি-র হয়ে পড়বে।”

সদ্য বিয়ে হওয়া বরের মুখে এমন কথা শুনে সকলের চোখজোড়া তী-রে-র মত গেঁথে গেল তার দিকে। ইরশাদ অবশ্য শান্ত স্বভাবের হলেও স্পষ্ট কথা বলার অভ্যাসও আছে। লোকচক্ষু দেখে সে এবার কণ্ঠস্বর আগের চেয়ে সরল করে বলল, ” মৈত্রীকে একটু স্বাভাবিক হতে দেওয়া দরকার।”

ইরিন আর তার বড় দুই জায়ের কেউ আসেনি বরযাত্রীতে। শুধু মাত্র ছোট চাচী মানে অন্তুর মা এসেছেন বাড়ীর মহিলাদের মধ্যে আর সাথে এসেছে বাড়ির বড় বউ জুয়েনা, ছোট বউ নিপা। অন্তুর মা এতক্ষণ এখানে ছিলেননা ময়ূখ গিয়ে উনাকে মৈত্রীর কথা বলতেই তিনি আর রোকসানা বেগম উপস্থিত হন সেখানে। তারাও মৈত্রীর কা-ন্না দেখে সবাইকে বুঝিয়ে ঘর খালি করে মৈত্রীকে সামলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না তা দেখে ঘরেই দাঁড়িয়ে থাকা ইরশাদ হঠাৎ ময়ূখকে ডেকে বলল, “ছাঁদে কি অনেক লোকজন?”

“হ্যাঁ ভাই। ছাঁদে প্যান্ডেলে প্রায় অনেক মেহমানই আছে।”

“মৈত্রীকে আমি একটু আলাদা রাখতে চাচ্ছিলাম৷ ওকে থামানো জরুরি।”

মৈত্রীর খালা হঠাৎ করে কোথা থেকে এসে উপস্থিত হলেন রুমে। মৈত্রীকে একহাতে জড়িয়ে রাখা রোকসানাকে দেখে যেন একটু রে-গে গেল। কিছুটা রুক্ষ স্বরেই তিনি রোকসানাকে সরিয়ে নিজে বসতে চাইলো তার পাশে। ইরশাদ, ময়ূখ আর অন্তুর মা তিনজনেরই খুব বাজে লাগলো ব্যাপারটা। ইরশাদ কখনোই হুট করে মেজাজ দেখায় না কারো ওপর কিন্তু মৈত্রীর খালার আচরণ তাকে প্রচণ্ড ক্ষু-ব্ধ করলো। সে এবার অনেকটা জোরেই বলল, “দ্যাখ তো এখনই যাওয়ার ব্যবস্থা হয় কিনা! নয়তো ফালতু কিছু চোখে পড়লে লোক সমাগমেই আমি ভুল কিছু বলে বসবো।”

ইরশাদের কথার অর্থ যেন একমাত্র মৈত্রীর খালারই বোধগম্য হলো। মহিলা ভ্রু জোড়া বক্র করে চেয়ে আছেন ভাগ্নি জামাইর দিকে। ময়ূখ তখনই বলল, “ভাই তোমার কাছে স্পেয়ার চাবি আছে না নিচের ফ্ল্যাটের?”

ইরশাদের কাছে আগে থেকেই চাবি ছিল এক্সট্রা কিন্তু আজ বিয়ের আসরে তো সেসব আনা হয়নি। তখনই মনে পড়লো আব্বুর কাছেও আছে চাবি। সে বলল আছে আব্বুর কাছে। মৈত্রীর কান্না ততক্ষণে থেমে গিয়ে ফোঁপানো চলছে। ইরশাদ কিছুটা অধৈর্য্য হলো এত কান্না দেখে। বিড়বিড় করে বলেই ফেলল, ” এত কান্নার কি আছে ভাই বিয়েই তো হয়েছে খু-ন থোড়াই না করেছি!”

“তুমি একটু বোসো না বাবা।” ইরশাদকে সেই ঘরে ঢোকা অবধি দাঁড়িয়ে থাকা দেখে রোকসানা বলল বসতে। কিন্তু ইরশাদ কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না এত কা-ন্নাকা-টি। সে খুব একটা কান্না-কা-টি কখনোই নিতে পারে না। মনে পড়ে বছর দুই আগে আম্মু কোমরের ব্যথায় সেকি কান্না! ময়ূখ সে কা-ন্না-কাটির জন্য একাই থাকতো আম্মার পাশে আর ইরশাদ অন্যান্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতো যেন কান্নাটুকু এড়ানো যায়। সেদিন মেহেরকে ধম-কানো আর বকাঝকার পেছনে কিছুটা কারণ এই কা-ন্না-ই ছিল। আর আজ মৈত্রীর এমন কান্না! সে ভেবেই পায় না মেয়েরা এমন করে কাঁদে কেন? বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক এখানেও কেন কা-ন্না-র আসর জমাতে হবে!

ময়ূখ চাবি এনে সেটা এগিয়ে দিলো ইরশাদকে, ” ভাই তোমরা নিচে তোমার ঘরে একটু বসতে পারো। কেউ সেখানে ডিস্টার্ব করতে পারবে না।”

ময়ূখের কথা শুনে ইরশাদও ভাবলো এটাই করা উত্তম এই মুহুর্তে।

রোকসানার দিকে তাকিয়ে অনুমতি চেয়ে ইরশাদ বলল, “আন্টি, মিষ্টি খাওয়া আর আয়না নাকি দেখার একটা নিয়ম আছে আমরা কি সেটা স্কিপ করতে পারি? যদি স-ম-স্যা না হয় আমি ওকে নিয়ে নিচে যেতে চাই।”

রোকসানা আবেগী হলেন ইরশাদের আচরণে। ছেলেটা তাকে মৈত্রীর অভিভাবক হিসেবে সম্মান দিচ্ছে এটা সত্যিই আনন্দের। রোকসানা মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ইরশাদ আর এক মুহূর্তও দেরি না করে মৈত্রীর সামনে গেল। চাচী আর শ্বাশুড়ির মাঝে এলিয়ে পড়া মৈত্রীকে প্রায় এক হাতে টেনেই দাঁড় করিয়ে দিলো। ময়ূখ বসার ঘরের সবাইকে খেয়াল রাখছিলো যেন কেউ বর কনেকে মাঝপথে না আটকায়। ইরশাদ মৈত্রীকে নিয়ে সোজা নিচে নিজের ঘরে চলে গেছে। সিঁড়িতে নোরা, নিপা, জুয়েনার সামনে পড়তেই তারা কিছু বলতে শুরু করতেই ময়ূখ উপর থেকে তাদের থামিয়ে দিলো। বলে দিলো একটু ছে-ড়ে দাও তাদের মৈত্রী মোটামুটি অসু-স্থ আছে৷ সত্যিই মৈত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে আকস্মিক কান্না-কাটিতে। ইরশাদ নিজের ঘরে নিয়ে মৈত্রীকে সোজা বেলকোনিতে চেয়ার রেখে বসিয়ে দিলো। শীতের শেষ মুহূর্ত বাতাসে বসন্তের আগমনী বার্তা মিশ্রিত। মৈত্রীর অস্থিরতা কা-টা-তেই বদ্ধঘরের চেয়ে বেলকোনি ঠিক মনে হলো তার। ঘরে ফ্রিজে খুঁজে খুঁজে কোল্ড কিছু না পেয়ে আইস কিউব নিলো সে। মৈত্রীকে কিছুটা ঠান্ডা লাগানোর জন্য ইরশাদ এক গ্লাস শরবত করে তাতে আইস ছেড়ে দিলো৷ চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে নি-স্তে-জ বসেছিল মৈত্রী। ভারী লেহেঙ্গাটাই হয়তো তাকে আরও বেশি অ-সু-স্থ করে দিচ্ছে মনে হতেই ইরশাদ মায়ের ঘরে ঢুকে একটা শাড়ি খুঁজলো। আম্মু শাড়ি খুব একটা পরেন না অনেক সময় হলো তবুও আলমারিতে থাকার কথা শাড়ি। কিন্তু এই মুহূর্তে আলমারির চাবি পাওয়া মু-শ-কি-ল বুঝতে পেরে ইরশাদ পুনরায় ময়ূখকে কল দিলো। বরযাত্রী খুব বেশি ছিলো না তবুও মুরুব্বি যারা ছিলো প্রায় সকলেই মাগরিবের আগে চলে গেছে। ফখরুল সাহেব বিদায়ের সময় হয়তো অভিভাবক হয়ে কথাবার্তা বলবেন সে কারণেই তিনি এবং তাঁর বড় ভাই থেকেছিল। কিন্তু ইরশাদের এই হঠাৎ করা আচরণে তারা বুঝলেন যুগ বদলেছে৷ ছেলেরাও যথেষ্ট সমঝদার তাই তারা আর ছেলে মেয়েদের মাঝে না থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো৷ মৈত্রীর বাবার সাথে সব রকম আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা শেষ করে তারাও চলে গেলেন সকলে। রয়ে গেল বর কনে সাথে ময়ূখ, নোরাও৷ ইরশাদ ময়ূখকে বলল নোরা যেন রোকসানা আন্টির থেকে একটা শাড়ি নিয়ে নিচে যায়৷ দশ মিনিটের মাঝেই নোরা আর অরুণিমা গেল নিচে। ইরশাদ বসার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করলো ততক্ষণে অরুণিমা লেহেঙ্গা বদলে মৈত্রীকে আটপৌরে ভাবে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে৷ এতেই যেন দেহ জুড়ে প্রশান্তি নামলো মৈত্রীর। সময়ের সাথে তার হিঁচকি তোলাও বন্ধ হয়ে এলো। ঘড়ির কাটা যখন রাত আটটা তখন ইরশাদ বলল, এবার তাদের বাড়ি ফেরা উচিত। ময়ূখকে ডাকা হলো ফেরার জন্য ময়ূখ বলল তারা যেন চলে যায় সে একটু পর আসবে৷ ইরশাদ কেমন করে যেন তাকালো একবার ময়ূখের দিকে আর তাতেই ময়ূখের মনে হলো ভাই বুঝি তার ভেতরটা পড়ে নিচ্ছে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে। কিন্তু না ইরশাদ আর কিছু বলেনি৷ মৈত্রীকে এক হাত বাড়িয়ে বলল, “এবার ফেরা যাক আপন নীড়ে!”

ফোলা ফোলা চোখ, লেপ্টানো কাজল, লিপস্টিকহীন ঠোঁট আর লাল হয়ে ওঠা নাকের ডগায় এবার লজ্জারা এসে ভীড় জমালো মৈত্রী। সকল কান্না যেন আগেই শেষ করেছে নিবিড়ে বসে লজ্জায় ডো-বার জন্য। ইরশাদ -মৈত্রী বাড়ির সকলের কাছে বিদায় নিতেই ময়ূখ এসে গাড়ির চাবি এগিয়ে দিলো। সাজিয়ে আনা গাড়িটা ছিলো ইরশাদের বড় চাচার। ড্রাইভারই তো ছিলো গাড়িতে কিন্তু ময়ূখ বলল সে নিজেই ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইরশাদ যেন নিজেই ড্রাইভ করে আর মৈত্রী চাইলে একটু কোথাও ঘুরেও যেতে পারে। বাড়িতে ইরিনকে আগেই সে বিষয়ে জানিয়ে রাখা হয়েছে। ইরশাদ যখন গাড়িতে উঠলো মৈত্রীকে নিয়ে নোরাও তখন উঠে বসলো পেছনের সিটে। ময়ূখ বাইরেই দাঁড়িয়ে জানালো সে আরও পরে যাবে। ইরশাদ হ্যাঁ না কিছুই না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। মিনিট পাঁচেক পরে গাড়ি থামলো নোরা নামলো গাড়ি থেকে৷ ইরশাদ চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে দিলো নোরাকে, “যাও।”

সারাদিনের গমগম করা বাড়িটা তখন নি-স্ত-ব্ধ-তার ভ-য়ংক-র রূপে সজ্জিত। আকাশ জুড়ে অষ্টাদশীর চাঁদের শুভ্র হাসিতে ভূলোক ভাসছে। দোতলায় টুকটাক জিনিসপত্রের টুংটাং আওয়াজ থাকলেও নিচ তলাটা ভূতুরে নীরবতায় ডুবে আছে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক ছিলো না বলেই হয়ত নোরা বিনাশব্দে ভেতরে গেল। আঁধার ঢাকা ফ্ল্যাটে একটুখানি আলো উঁকি দিচ্ছিলো বেলকোনির দরজা দিয়ে। পা টিপে টিপে আলতো পায়ে আলোর রেখায় চোখ রেখেই নোরা ঢুকে পড়লো ইরশাদের ঘরটাতে। পিনপতন নিরবতায় ভেসে এলো কারো মুখ আটকে রাখা কান্নার শব্দ। সে কা-ন্না কারো নিঃ-স্ব হওয়ার, পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলার নীরব য-ন্ত্র-ণা প্রকাশের কান্না, সে কান্না কারো ভেতর বাহির ভে-ঙে চূর্ণ হওয়ার। এ কা-ন্নার আওয়াজ নোরার মত কঠিন মনের মেয়েটাকে ঘরের মাঝে আচমকাই থমকে দিলো। ফিসফিস করে কানের কাছে যেন কেউ স-ত-র্ক করলো, যেওনা ওপাশে। সইতে পারবে না ভা-ঙা-র যন্ত্রণা৷ যেও না তুমি শুনে সইতে পারবে না ভেঙে পড়ার কারণ! মন আর মস্তিষ্কের যে তার আগেই থেকেই মালুম ছিলো ময়ূখের কা-ন্নার কারণ আর তার আ-র্তনা-দের উপলক্ষ। তবুও এখন ভয় হচ্ছে খুব থমকে গেছে পা৷ একটু আগেই ইরশাদ যখন গলির মোড়ে গাড়ি থামিয়ে বলল, “নোরা, তুমি কি একা ফিরতে পারবে বাড়িতে?”

মৈত্রী বলেছিলো রাত হয়েছে ও এখন একা কেন আবার আমাদের বাড়ি যাবে? ইরশাদ সে কথার জবাব না দিয়ে শুধু বলেছিলো, লক্ষী বোন আমার রাগ কোরো না তুমি ফিরে যাও সেখানে৷ ময়ূখের সাথে এসো কেমন!

নোরার মন বলছিলো সে যা ভাবছে সেই একই ভাবনা ইরশাদও ভাবছে। সে এক বাক্যও খরচ না করে নেমে এসেছে গাড়ি থেকে৷ মৈত্রীদের বাড়ি ফিরে যখন দেখলো নিচতলার দরজা খোলা তখনই ভয়টা শুরু হলো। কোন এক অজ্ঞাত কারণে অরুণিমাও তখন নিচে এসেছিলো। সেও যেন ভেবেছিলো নিচে কিছু একটা হবে৷ নোরাকে দেখতেই কেমন স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল।

” মনের ডাক্তারি শিখছো তুমি তাইনা নোরা! আজ তোমার সুযোগ এসেছে নিজের শিক্ষা কাজে লাগানোর।”

“কি বলছো বৌদি!”

“তোমার ওই চা-লা-ক চোখ দুটোকে পড়ে নিয়েছিলাম কিছুদিন আগেই। ময়ূখের যন্ত্রণায় মলম হও শেষটা সুন্দর তোমারই হবে। ভালোবাসলে কখনো কখনো সুযোগ নিতে হয়।” অরুণিমা কথার ছলে ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিল যেন মৈত্রীকে৷ আর সেও তাই সে পথেই পা বাড়িয়েছে। ঘরে ঢুকে যখন ময়ূখের কান্নার আওয়াজ কা-নে এলো তখনই যেন দম ব-ন্ধ হয়ে আসছিলো তার। কিন্তু নোরার মন তো এত দূর্বল নয়! সে বেলকোনিতে যাওয়ার আগেই ময়ূখ টের পেয়ে গেল ঘরে কেউ ঢুকেছে। সে কণ্ঠ রোধ করে রাখলো যেন ঘরে আসা মানুষটি জানতে না পারে এ ঘরে কোন পুরুষের আর্তনা-দ গর্জেছিল। নোরা চুপচাপ যখন বেলকোনির দরজায় এসে দাঁড়ালো তখন ময়ূখ বুঝে গেল কে এসেছে। খুব স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করলো, “যাওনি কেন?”

“তোমাকে দেখতে আর একটু একটু করে শিখতে।”

নোরার কথায় হেয়ালি ছিল।

“কি?”

” ভালোবাসাকে অন্যের হওয়া চোখের সামনে দেখে নিজেকে কেমন করে গুছিয়ে রাখা যায়!”

নোরার কথাটাতে প্রশ্ন ছিলো নাকি নিজেই সে নিজেকে শুধাচ্ছিলো বুঝলো না ময়ূখ তবে তার কথার মাঝে থাকা ছোট্ট ইঙ্গিতটা যেন ঠিকই বুঝলো। তবুও নোরা আরেকটু স্পষ্ট করে বলেই ফেলল, “আজকের তোমার মত আমিও তো একদিন এমন দিন চোখে দেখব। তুমি অন্য কাউকে কবুল বলবে আমি দমব-ন্ধ করে তা দেখে যাব।”

নোরার কথাটা শেষ হতেই দু চোখ বুঁজে নিলো ময়ূখ। আজ প্রায় পৌনে এক মাস ধরে সে নির্ঘুম রাত, স্বস্তিহীন দিন কা-টা-চ্ছে৷ যে অনুভূতিকে সে মোহ ভেবে এড়িয়ে গেছে সে অনুভূতিই তাকে ক-রা-তের মত কে-টে ব্যবচ্ছেদ করে গেছে বিগত দিনগুলোতে৷ যার মুখে হাসি নেই বলে সে পেঁচীমুখী খেতাব দিয়ে মজা করতো সে মুখের হাসিতেই সে এখন নিজের ম-র-ণ দেখে৷ যে ভাইকে সে রক্তের চেয়েও আপন ভাবতো সে ভাইয়ের হাতের মুঠেয় মৈত্রীর বাঁধা হাত দেখে সে আজ বি-ষ বাণে বি-দ্ধ হচ্ছে৷ এ যে নিয়তির চ-র-ম শা-স্তি কি করে বোঝাবে মনকে! নোরা ক্ষণে ক্ষণে যখন নিজের অনুভূতির বিশ্লেষণ করছো ময়ূখের তখন মায়া হলো নিজের জন্য, মায়া হলো নোরার জন্যও। কিন্তু তার কি করার আছে? সে যে আজ বুঝতে পারছে মন তার কতোটা ভুল করে বসেছে! রাত বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে যন্ত্রণার দেয়াল। হঠাৎ আঁধার ঘেরা ঘর আলো করে বেজে উঠলো ইরশাদের ফোন৷ টেবিলের ওপরই ফেলে গেছে সেটা। নিজের পাহাড়সম য-ন্ত্রণা-কে পাত্তা না দিয়ে নোরা, ময়ূখ দুজনেই ঘরে ঢুকলো৷ ময়ূখ হাত বাড়িয়ে ফোনটা দেখতেই হাত মুষ্ঠি করে ঘু-ষি মা-রলো দেখালে। অকস্মাৎ এমন কান্ডে চমকে গেল নোরা। ভয়ার্ত চোখে ময়ূখের দিকে তাকিয়ে আবার ফোনে দেখল।

“মৈত্রী শাহরিয়ার” নামটা জ্বলজ্বল করছে ফোনের পর্দায় তার সাথে ভাসছে তাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার ছবি। নোরা বুঝতে পারলো মৈত্রীর ফোন দিয়ে হয়তো ইরশাদই কল দিচ্ছে৷ সে রিসিভ করতেই ইরশাদ জানতে চাইলো, “ময়ূখ কোথায় স কি ঠিক আছে?”

মনের গোপন চেনা মানুষ গুলোকে মনের ভাবনা থেকে আলাদা করা যে মু-শ-কি-ল তা আজ নোরা প্রমাণ পেল৷

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-২৪

ইরশাদের ফোনে মৈত্রীর নাম মৈত্রী শাহরিয়ার দিয়ে সেভ করা! ব্যাপারটা যেন ময়ূখের জ-খ-মী হৃদয়ে নুন, মরিচের মত লাগলো। একটা কথাই মাথায় এলো , তারা কি তবে আগে থেকেই সম্পর্কে ছিল! মানতে ক-ষ্ট হলো ময়ূখের। ইরশাদ শাহরিয়ার এর ফোনে মৈত্রী নামের পাশে আগে থেকেই শাহরিয়ার যুক্ত৷ এমনি এমনিতেই! কতগুলো দিন বুকের ভেতর এক বদ্ধঘরে মনের অনুভূতিকে চা-পা দিয়ে রেখেছিল কিন্তু আজ যে আর সে সইতে পারছে না। কখন যে ওই মেয়েটা তার ভেতর বাহির সবটা মোহাচ্ছন্ন করেছে বুঝতেই পারেনি। ময়ূখ ফেরেনি আর ইরশাদদের বাড়িতে। নোরাকে ট্যাক্সি করে পাঠিয়ে দিয়ে ময়ূখ সেখান থেকেই ঢাকায় রওনা দিলো৷ নিজেই ইরিনকে ফোন করে বলল কোন এক বন্ধুর বাবা মারা গেছে তাই সে ঢাকা যাচ্ছে। ঘরভর্তি আত্মীয়ের আনাগোনা তারওপর নতুন বউ ঘরে ব্যস্ততায় খুব একটা প্রশ্নোত্তরে গেলেন না ইরিন। তবে মন কেমন অন্য ইশারা দিচ্ছে তার কিছুদিন থেকেই তাই এক ফাঁকে বড় ভাইকে ফোন করে জানালেন কথাটা। ময়ূখের বাবা মেহের আর মেহেরের আম্মুকে নিয়ে মৈত্রীদের বাড়ি থেকেই ঢাকার পথে বেরিয়েছেন। মেহের অসুস্থতা আর পড়ার প্রেশার দু বাহানা একত্র করেই ফুপিকে মানিয়ে নিয়েছে এদিকে মেহেরের মা’ও যে স্ট্রো’ক এর রোগী এতেই যেন মেহেরের চলে যাওয়াটা সহজ হয়েছিল। মেহের, ময়ূখ দু ভাই বোন একই দরিয়ায় একই য-ন্ত্র-ণায় ডুবে গেছে। একই সময় দুজনেই নিজেকে সামলানোর তাগিদে অন্তরের খুব কাছের মানুষগুলো থেকে দূরত্বের প্রয়োজন অনুভব করছে।

বাড়িতে বউ নিয়ে ইরশাদ ফিরেছিলো অনেকটা বিলম্বে। মৈত্রীর কা-ন্না-কাটি থামলেও মন যে ভীষণ খা-রা-প তা বুঝতে পেরেই ইরশাদ তাকে নিয়ে পথেই এক পুলের ওপর গাড়ি থামিয়েছিল। ভাগ্যিস, ড্রাইভারকে না রেখে নিজেই ড্রাইভ করছিলো গাড়ি তাইতো ইচ্ছেমত পথে থামা গেল। পুলের ওপর এবং আশেপাশেও কোথাও কোন বাতি ছিল না। এলাকার খুব কাছাকাছি হওয়াতে বি-প-দমুক্ত জায়গাই ছিলো সেটা। আকাশ জুড়ে অষ্টাদশীর হাস্যজ্জ্বল চাঁদ, প্রকৃতিতে শীতের হাওয়া। আঁধারে জমা পথে নতুন বউকে নিয়ে পুলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাটা ভিন্ন কিছু ছিল ইরশাদের জন্য৷ ভিন্নতা তো মৈত্রীর কাছেও ছিলো কিন্তু সে সকল ভিন্নতাকে গভীর মনযোগে তাকিয়ে ছিলো ইরশাদের দিকে৷ রহস্যময়ী অন্ধকারে শেরওয়ানির রঙটা মিশে গিয়েছিল যেন। গাড়ির হেডলাইটের আলোটাও যে নিভিয়ে রেখেছিল ইরশাদ তাতেই মৈত্রীর সুবিধে হলো ৷ সে সব ভুলে প্রকৃতিতে মিশে গিয়ে ইরশাদকে অনুভব করতে চেষ্টা করলো। তার মনোকামনা যেন ইরশাদের মনেও পৌঁছে গেল নিঃশব্দে। সে হাত বাড়িয়ে মৈত্রীকে টেনে নিলো নিজের পাশে, খুব কাছে যেখানে বাহুতে বাহুর ছোঁয়া লেগে যায় বুঝতে না দিয়ে। মৈত্রী শিউরে ওঠেছিল ক্ষনিকের জন্য। ইরশাদ তা টের পেয়েও জড়িয়ে নিলো নিজের পাশে। ধীরে ধীরে টেনে আনলো বুকের কাছে, একটু সামনে। শীতকে তুচ্ছ করে উষ্ণতায় ছুঁয়ে গেলো নবদম্পতির দুটি দেহ। মৈত্রী চোখ বুঁজে পিঠ এলিয়েছে তার স্বপ্ন মানবের বুকে৷ একটু আগেও ভেতর থেকে যে কান্নার স্রো-ত ঠেলে আসতে চাইছিলো বাইরে তা যেন আচমকাই হাওয়া ভেসে চলে গেল দূর অজানায়। মুহূর্তেই হারাতে চাইলো মৈত্রী অমোঘ আঁধারের বুকে। ইরশাদও সময় দিলো ; মৈত্রীকে জড়িয়ে রাখলো কিছুটা সময় নিজের বুকে। রাস্তা দিয়ে হুট হাট সাঁই চলে যাওয়া দু একটা বাইক, অটোরিকশা আর সি এনজির আলোয় প্রকাশ্য হচ্ছিলো তাদের অস্তিত্ব আর তাই বেশিক্ষণ কা-টানো থাকা সম্ভব হলো না। তবুও মৈত্রীর মনে যে কান্না, বাবাকে ছেড়ে আসার কষ্ট সবটাই যেন লাঘব হলো এই কিয়ৎক্ষণের ভিন্ন আবহে। ইরশাদের মনে হলো রাত বাড়ছে, শীতের তীব্রতা বাড়ছে সেই সাথে অপেক্ষা করছে বাড়ির মানুষজন৷ সে বুকের কাছে থাকা মৈত্রীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কপালে আলতো স্পর্শে চুমু খেলো। প্রথম চুমু, প্রথম স্পর্শ ইরশাদ দিলো নতুন সম্পর্কের মূল্যায়ন করেই তবে মৈত্রীর কাছে তা ভালোবাসার পরশ ছিল। ইরশাদ ফোনে সময় দেখে মৈত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো অনেকটা দেরি করে। ইরিন একবার প্রশ্ন করবে ভেবেও আর করেননি। ইরশাদের ঘর আগে থেকেই ডেকোরেটেড ছিল সবটা ময়ূখই করিয়েছিল। ইরিন মৈত্রীকে সে ঘরেই বসিয়ে দিলেন। সকল মেহমান বৌভাতে আসবে বলেই বাড়িতে ভীড় কিছুটা কম ছিল। ইরশাদের চাচীরাও সকলে অল্প সময়ের মাঝে চলে গেলেন যার যার ফ্ল্যাটে। এরই মাঝে চাচী শ্বাশুড়িরা তিন জনেই মৈত্রীকে দেখে সালামির নামে চেইন, আংটি আর কানের দুলও দিলেন। এ বাড়িতে নাকি এমনটাই হয়ে আসছে৷ জুয়েনা, সায়রা এমনকি নিপাও তার বিয়েতে এগুলো পেয়েছে শ্বাশুড়িদের কাছ থেকে তাই মৈত্রীর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়নি। সকল নিয়মনীতির যখন সমাপ্তি হলো তখন ইরশাদ খেয়াল করলো মৈত্রী একদম ঘরোয়া রূপে। গায়ে সুতি শাড়ি, দু হাতে সোনার চুড়ি, গলায় পাতলা চেইন, কানে ছোট দুল। চোখে-মুখে প্রসাধন নামমাত্রও নেই। সারাদিনে একটুও বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে এখন কেমন নেতিয়ে গেছে মৈত্রী তা দেখে ইরিন রাতের জন্য স্যুপ দিলেন। এমনিতেও মৈত্রী কিছুই খাবে না বলছিল তাই এমন দিলেন। ইরশাদ অবশ্য প্লেটে করে ভাত নিয়ে বেডরুমেই এসেছিল। মৈত্রীকে দু একবার বলে কয়ে নিজের খাওয়া শেষ করলো সাথে তাড়া দিলো মৈত্রী যেন খাওয়া শেষ করে। মৈত্রী স্যুপটুকু শেষ করে বাটি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল তা দেখে ইরশাদ জানতে চাইলো কি হয়েছে?

মৈত্রী তার বাটি দেখাতেই বলল, ” কিচেনে রেখে এসো। আমাদের ফ্ল্যাটে এখন আমাদের পরিবার ছাড়া বাইরের কোন মানুষ নেই। যা কাল দেখবে তা আজই দেখো।” মুচকি হাসছে ইরশাদ। মৈত্রী ভীরু পায়ে সত্যিই গেল বাইরে৷ ঘর থেকে বের হতেই লম্বাটে জায়গা পেরিয়ে বসার ঘরের দরজা। মৈত্রী খেয়াল করলো তাদের বাড়ির মত নয় এ বাড়ির বসার ঘরটা। একসাথে তিনটি বেডরুম হাতের বায়ে এবং ডানে যে দেয়াল সেটার ওপাশে পুরোটাই বসার ঘর। ভেতরে না ঢুকেও মৈত্রী বুঝতে পারছে এই বাড়ির পুরো একেকটা তলায় দুটো ফ্ল্যাট সমান জায়গা মিলে একটা ফ্ল্যাট। এত বড় বসার ঘর তো থাকতেও তারা হলুদ নাকি ছাঁদে করেছে!

“ওমা, বাটি হাতে কোথায় যাচ্ছো মামনি?” ফখরুল সাহেব বসার ঘরের দরজায় মৈত্রীকে দেখে অবাক হলেন খুব। মৈত্রী আওয়াজ শুনে নিজেও চমকে গেছে তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জানালো সে রান্নাঘর খুঁজছে। পুত্রবধূর কথা শুনেই ফখরুল সাহেব জোরে হাঁক ছেড়ে ইরিনকে ডাকলেন৷ মৈত্রীকেও দেখিয়ে দিলেন হাতের ডানে একদম সামনেই রান্নাঘর। মৈত্রী মাথার আঁচল আরেকটু টেনে মাথা নিচু করে সেদিকে গেল। ইরিনও ততক্ষণে চলে গেছেন মৈত্রীর কাছে।

“দেখলে কান্ড ছেলেটার? সারাবছর সব কাজ নিজ হাতে করে আর আজ বউ আসতে না আসতেই তাকে কাজে নামিয়ে দিয়েছে।” বিরক্তির স্বরে বলছেন ইরিন। মৈত্রী নিচু কণ্ঠে বলল, আসলে আন্টি আমিই…

“উহুম সাফাই লাগবে না। আমি চিনি তো শাদকে ও প্র্যাকটিক্যাল প্র্যাকটিক্যাল বলে বলে তোমাকে দিয়ে শুরু থেকেই সব করাবে। বাবু তো তার এই স্বভাবের জন্য আগেই বলেছিল, আম্মা ভাই কিন্তু বউকে দিয়ে বিয়ের দিনই কাজ করাবে। দেখলে মৈত্রী বাবুর কথাই সত্যি হলো!” কথাটা বলতে গিয়ে ইরিনের বুঝি একটু মন খা-রা-প হলো। মৈত্রী সিংকে রাকা দু একটা প্লেটসহ নিজের স্যুপের বাটিটা ধুয়ে রাখলো। রাত অনেক হচ্ছে ভেবে মৈত্রীকে আবার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন ইরিন।

“এক বাটি রাখতেই তো দেখছি রাত অর্ধেক পার করে এলে। আমি তো ভাবছিলাম আমার খাওয়া শেষ হলে এগুলোও নিতে বলব।”

মৈত্রী ঘরে ঢুকতেই ইরশাদ মজা করলো। কিন্তু তাকে দ্বিতীয় বাক্য বলতে না দিয়ে মৈত্রী সেগুলোও নিয়ে গেল কিচেনে৷ এবার আর বেশি সময় লাগেনি সে সব ধুয়ে মুছে রেখে এসেছে। ঘরে ঢুকে দেখলো বেলকোনির দরজা খোলা ইরশাদ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার টি শার্ট আর লুঙ্গি। মৈত্রীর মনে পড়ে গেল তাদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ইরশাদের প্রথম সকাল। বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে খাঁচায় তার পোষা পাখিদের খাবার দেওয়া তখনও এমনই পোশাকে ছিল। মৈত্রী সেদিনই জানলো যুবক বয়সী ছেলেরা শুধু প্যান্ট ট্রাউজার নয় লুঙ্গিও পরে। পুরনো কথা মনে পড়তেই হাসি পেল তার। কত বোকা বোকা ভাবনা ছিলো তার! ঘরে মৈত্রী এসেছে টের পেতেই ইরশাদ ফিরে তাকালো।

“ওখানে দাঁড়িয়ে কেন এখানে এসো।”

মৈত্রী গেল; ইরশাদ তার মুঠো করা ডান হাতটা মৈত্রীর সামনে বাড়িয়ে ধরলো।

“বিয়ে, বাসর, সংসার নিয়ে তো সবারই অনেক চাওয়া পাওয়া থাকে। তোমারও নিশ্চয়ই আছে কিন্তু সময় সল্পতায় আমার সেসব জানা হয়নি। তবে আমি চেষ্টা করবো তোমার জন্য সবটা করতে হয়তো সময় লাগবে তাতে তবুও ইনশাআল্লাহ করব। বড় ভাবী বলেছিল বাসর রাতে তোমাকে গিফট দিতে হবে। মানে প্রত্যেক হাজবেন্ডই সাধ্যমত দেয়৷ আমি আগে থেকেই জানি ব্যপারটা কিন্তু এ কয়েকদিনে মাথাতেই ছিল না কথাটা তাই… আসলে এ উদ্দেশ্যে কিছু কেনা হয়নি।”

এতটুকু বলেই ইরশাদ তার মুঠো খুলে একটা রূপোর ব্রেসলেট বের করলো। ব্রেসলেটের উপর খোদাই করা ইংরেজি অক্ষরে “ইরশাদ” নামটা লেখা। মৈত্রী হাতে তুলে নিলো সেটা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকলো চমৎকার জিনিসটা। কিন্তু হাতের সাইজটা যথেষ্ট বড় হওয়ায় মৈত্রীর কব্জি গলিয়ে বেরিয়ে আসে সেটা।

“আপাতত এটাকেই উপহার ভেবে নাও আমি কাল কিছু একটা নিয়ে আসব।”

“এটা কি একটু ছোট করা যাবে?” ব্রেসলেটটাতে হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলো মৈত্রী।

“হু, স্বর্ণকারের কাছে নিলে করা যাবে। কিন্তু এটা নেহায়েত রূপার তৈরি৷ আমি গোল্ডের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে আসবো।”

“উহুম, আমি এটাকেই আজকের উপহার হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি।”

মৈত্রীর আবেগ স্পষ্ট চোখের তারায়। ইরশাদ হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে আনলো মৈত্রীকে। রাতের আকাশে চাঁদের আলোয় ফকফকা বারান্দার মেঝে। শীতের হাওয়া লেগে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে আছে ইরশাদের, ঠান্ডায় কাবু মৈত্রীও। নবদম্পতিরা বাসর রাত কেমন কাটায় জানা নেই তাদের কিন্তু তারা জেনে নিয়েছে আজ রাতে তাদের হবে চন্দ্রবিলাস, হিমেল হাওয়ায় হবে আজ শীতবিলাস সেই সাথে হবে একে অপরকে নিয়ে নতুন এক অনুভূতিবিলাস। আর তাইতো ইরশাদ ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলো। মোটা এক কম্বল এনে ছড়িয়ে দিলো বারান্দায় তাতে আরও এক কম্বল জড়িয়ে বসলো মৈত্রীকে নিয়ে৷ নিজের সাথে মৈত্রীকে জড়িয়ে কম্বলে আবৃত করে নিয়েছে নিজেদের । ইরশাদের কান্ড কারখানায় মৈত্রীর ভীষণ লজ্জা লাগছিলো তা দেখতেই ইরশাদ আরও এক দুষ্টুমি করে বসল। এক হাতে ফোন বের চাঁদের আবছা আলোয় কম্বল জড়ানোর এক ছবি তুলে নিলো নিজেদের৷ আর মৈত্রী একের পর এক বিষ্ময়ের সাগরে ডুবতে লাগলো।

নোরা রাতে একটুও ঘুমাতে পারেনি কাল। থেকে থেকে ময়ূখের কথাই মনে পড়েছে। একটু পর পর ময়ূখকে কল করে কথা বলার কত চেষ্টা করেছে অথচ ময়ূখ একটিবারও তার কল ধরেনি৷ ভোরের দিকেই একটুখানি চোখ লেগেছিলো কিন্তু এখন এই মুহুর্তে বাইরে থেকে প্রচুর হাসাহাসিতে গাঢ় ঘুমটা ভেঙে গেল তার। টি শার্ট গায়ে ঘুমিয়েছিল সে তার ওপরই জ্যাকেট পরে ঘর থেকে বের হলো। দু পা এগিয়ে সামনে আসতেই বুঝতে পারলো সকলে মিলে ভাইয়ের ঘরে ঘাপটি মে-রে-ছে।

নোরা সে ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই দেখলো ইরশাদ একের পর এক হাঁচি দিয়েই চলছে৷ এদিকে ডিভানে বসে ভাবীরা সকলে মৈত্রীকে কিছু বলছে আর হাসছে।

“এত হাসাহাসি!”

“ওহহ বিদেশিনী আসো, শোনো তুমিও যোগ দাও।” মজা করছে জুয়েনা আর লজ্জায় লাল হচ্ছে মৈত্রী৷

“ভাবী কি শুরু করলেন সকাল সকাল! আমি ভাইয়াকে কিন্তু এখনই ডাকব।”

“ডাকো দেবর সাহেব সেও দেখে একটু শিখুক কিছু। বাসর ঘরে বউকে নিয়ে কত কি বিলাস করা যায় তারও একটু শেখা দরকার।”

নোরা সকলের হাসি আর কথা শুনেই কিছু বুঝতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে নিপার দিকে তাকালো।

“আমি তো কিছু বলবো না নোরা আপু, ভাসুরের বাসর বলে কথা।” ফিসফিসিয়ে বলল নিপা।

“ইরশাদ মৈত্রী বাসর করেছে বেলকোনিতে। আর সেই বাসরে স্বর্দির আসর জমেছে আজ তাদের সকাল থেকে। একজন হাঁচি দিচ্ছে অন্যজন কাশি দিচ্ছে।”

এবার নোরাও খুব হাসি পেল৷ সে তো বলেই বসলো, ” হাও কিউট ব্রো!” নোরা এ-ক্সা-ই-টেড হয়ে বলল ইরশাদকে।

কাল রাতে তারা দুজন কম্বল পেঁচিয়ে অনেকটা সময় গল্প করেছে। গল্প না ঠিক ইরশাদ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছে মৈত্রীও অনেকটা স্বাভাবিক আলোচনা চালিয়ে গেছে। তাদের কথাবার্তার এক পর্যায়ে ইরশাদ বলেছিল, “মনে হচ্ছে আমরা বহু বছরের পুরনো দম্পতি ! মনে হচ্ছে, যেন কত বছর আগেই আমরা সংসার শুরু করেছিলাম।” মৈত্রীরও তেমনই মনে হয়েছিল কাল। দুজনে একসাথে গল্প করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সেখানে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে