কি ছিলে আমার পর্ব-২১+২২

0
1932

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-২১

ইরিন যখন বাপের বাড়ি এলো তখন বসার ঘরে বসে ছিলেন আবরার খন্দকার। তাঁর পাশেই তাঁর কাঁধে মাথা রেখে বসেছিল মেহের। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ, মাথার চুল এলোমেলো আর চোখ দুটি ভীষণ ফোলা। ইরিনরা কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলেছিল জরিনা, ময়ূখ তখনও ঘুমে। এমনিতেও মেহেরের সে ঘটনার পর এ কদিন আর রাতে ঘুমায়নি সে। মনে আ-ত-ঙ্ক ঢুকে গেছে ছোট বোনটিকে নিয়ে। আব্বু তো হার্টের রো-গী চাইলেও তিনি রাত জাগতে পারেন না। মেয়ের অবস্থা দেখে মেহেরের মা’ও স্ট্রো-ক করেছেন। বাড়ি ভর্তি কাজের লোকের মাঝে জরিনা খালা বিশ্বস্ত তবুও ময়ূখ কেন জানি কাউকেই ভরসা করতে পারছে না। নিজেই রাতে বোনকে খেয়াল রাখার নামে পাহারা দিচ্ছে চারদিন ধরে। তাই সকালের সময়টা ঘুমে কা-টা-য় সে। ইরিন যকন মেহেরের চোখ, মুখ আর হাত দেখে আঁতকে উঠলেন তখন আবরার খন্দকার বোনকে দেখে খুশি আর বিষ্ময়ের মিশ্র অনুভূতিতে ভাসছেন৷ ফখরুল সাহেব বড় অস্বস্তির সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইরিনেরই পাশে। ময়ূখের বাবা মেহেরকে ছেড়ে উঠে এগিয়ে বোনের মাথায় হাত রাখতেই তার পাশে নোরাও এসে দাঁড়ালো। তিনি একে একে তিনজনের সাথেই কথা বলতেন লাগলেন। মেহের তখনো নিশ্চুপ বসে আছে। ফখরুল সাহেবই প্রথমে প্রশ্ন করলেন, “তোমার কি হয়েছে মামনি? অসুস্থ দেখাচ্ছে কেন?”

বোন জামাইর কথা শুনে আবরার খন্দকার মেয়ের দিকে তাকালেন। কিছুটা ভণিতা করেই বললেন, “ব্যথা পেয়েছে স্কুলে গিয়ে হাত কে-টে-ছে, জ্বরও আছে৷”

ইরিন অ-স্থি-র হয়ে নোরার কাছে গেলেন। মেহেরের মা নিজের ঘরের বিছানায় শুয়েই অনেকের গলার আওয়াজ পেলেন। তার অবস্থা বিশেষ ভালো নয় বলে ডক্টর হসপিটালে রাখার পরামর্শ দিলেও তিনি কাল জো-র করেই বাড়ি এসেছেন। সাবধান থাকলেও চি-ন্তামুক্ত থাকতে পারছেন না মেয়ের জন্য। জরিনা উপরে গিয়ে মেহেরের মাকে জানালো বড় আপা আজকেই চলে আসছে৷ তিনি হাঁটাচলা করতে পারেন তাই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে চাইলেন। জরিনা কিছু বলবে তার আগেই দরজার বাইরে থেকে ময়ূখ বলে উঠলো, আপনি বাইরে যাবেন না আম্মা উপরে আসবেই।

সাবধানী কণ্ঠ; ছেলেটার সাথে যত দূরত্বই থাক না কেন দূর থেকেই সে মানবিক দিক থেকে চমৎকার মানুষ। মেহেরের মা শাহনাজ আর নামলেন না অপেক্ষা করলেন ননদের। ময়ূখ নিচ থেকে আসা আব্বুর উচ্চস্বর, আনন্দের সহিত কথা শুনেই তার কাঁচা গুম ভেঙে গেছে। নিচে গিয়ে আম্মাকে দেখতেই তার বুকের ভেতর ঝ-ড় শুরু হলো। নোরার মুখে শোনা কথাটা তার ভেতর এক থম ধরা তুফা-নের সৃষ্টি করেছিল। সেই তু-ফা-ন এখন তাকে তলিয়ে নিতে চাইছে তার একমাত্র আশ্রয়স্থল কাছে পেয়ে৷ মনে হচ্ছে মায়ের বুকেই সে তার সকল দুঃখ, য-ন্ত্রণা-কে প্রকাশ করতে পারে৷ এখনই সে আম্মাকে জাপটে ধরে বলবে, “আম্মা আমার ক-ষ্ট হবে মৈত্রীকে হারালে। আমি ভালোবেসে ফেলেছি ওই পেঁচিমুখী, গম্ভীর, শান্ত মেয়েটাকে। তাকে কি করে ভাইয়ের বউ হিসেবে দেখব আমি!”

তেমন কিছুই করলো না ময়ূখ। যা ভাবা যায় তা করা হয়ে ওঠে না৷ সে হাসিমুখে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলো৷

“কেমন আছো আম্মা?”

ইরিন কথার জবাব না দিয়ে ময়ূখকে সরিয়ে দাঁড় করালেন। মনোযোগে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, “কি হয়েছে তোর চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?”

“ক ক কই কেমন লাগছে! ঘুম থেকে উঠলাম মাত্র।”

আবরার খন্দকার পাশ থেকে বলে উঠলেন, “মেহেরের খেয়াল তো রাতে ওই রাখছে তাই খাওয়া-ঘুম সবই ন-ষ্ট হয়ে গেছে ওর।”

ইরিনের মন মানতে চাইলো না কথাটা। ময়ূখের চোখ মুখ বলছে সে ভালো নেই। মেহেরের চেয়ে মা-রা-ত্মক অসুস্থ ছিল ইরিন বছর দুই আগে। রাত দিন এক করে ছেলেটা তার পাশে পড়েছিল তখন। ইরশাদ আর তার বাবা কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকতো বলে ময়ূখই তার সার্বক্ষণিক সেবায় ছিল কই তখন তো এমন লাগেনি! কিন্তু এই মুহুর্তে এ নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না ভেবে ইরিন ফিরে চাইলেন মেহেরের দিকে।

” ঘটেছিল কি বলতো মেহের।”

“আমি বলি আম্মা, ওর ক্লাসে জানালার কাঁ-চ ভাঙা ছিল সেখানেই বেখেয়ালে হাত রেখেছে। তাতেই হাত কে-টে রক্তার-ক্তি কান্ড। স্কুল থেকে কল এলে আমিই গিয়েছিলাম আনতে দেখেছি আসলে কাঁ-চ-টাই এমন যে, একটুতেই কে-টে যাবে।”

নোরা অনেকক্ষণ ধরে নিষ্পলক ময়ূখকে দেখছিল৷ ময়ূখের চোখের তারা আর তার ঠোঁট লক্ষ্য করতে করতে সে আন্দাজ করলো সে একসাথে অনেকগুলো মিথ্যে বলছে। চোখের তারা আর ঠোঁটের নড়চড় দুটোতে কোন মিল নেই৷ তারপরই নোরা তাকালো মেহেরের দিকে৷ কিছু সময় তাকেও পর্যবেক্ষণ করলো। এবার মনে হলো ঘটনাটা ঠিক এমন নয় যেমনটা ময়ূখ বলল৷ সারাটা দিন সবার ইরশাদ আর মৈত্রীর বিয়ের আলোচনাতেই কা-ট-লো। ফখরুল সাহেব কাল চলে যাবেন রাজশাহী তাই মৌখিক ভাবে ময়ূখের বাবাকে অগ্রিম দাওয়াত করে ফেললেন আগামী সপ্তাহে যাওয়ার জন্য। কাল নিজের বাড়িতেও বড় ভাইকে বলে আসবেন। তারপর মৈত্রীর পরিবার আর নিজেদের সবাই মিলে একটু আয়োজন করে বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন৷ রাতে মেহেরের ঘরে আজ আর ময়ূখকে পাহারা দিতে হবে না বলে সে নিজ ঘরে গেল ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। মেহের বিছানায় তার পাশে বসে আছে নোরা ফোন হাতে। ইরিন একই প্লেটে ভাত নিয়ে দুই ভাতিজিকেই খাইয়ে দিলেন। তাদের খাওয়া শেষ হতেই বললেন, “নোরা তুই তো পাশের ঘরেই ঘুমাবি মা একা ঘুমাতে পারবি না! আমি আজ মেহেরের পাশে থাকি।”

“শিওর!”

“আচ্ছা, আমি একটু বাবুকে দেখে আসি ঘুমালো কিনা।”

ময়ূখকে ফুপির এই বাবু ডাকা নিয়ে নোরা মেহের বড়ই হাসিঠাট্টা করে। কিন্তু আজ দুজনের কেউই কোন কথা বলল না এ নিয়ে৷ ইরিন চলে যেতেই নোরা মুখোমুখি বসলো মেহেরের।

“হাতে ঠিক তিন মিনিট সময় তার মাঝেই পুরো ঘটনা বলবে।”

“কি বলছো আপু?”

মেহের বুঝতে পারলো না নোরা কি বলছে।

“এই হাত কা-টার কারণ এবং কবে, কি দিয়ে কা-ট-লে?”

কাঠ কাঠ গলায় বলল নোরা। মেহের লুকাতে চাইলো কিন্তু নোরার চোখের দিকে তাকাতেই কি হলো সে জানে না। ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, “ইরশাদ ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনতেই আমার ক-ষ্ট হচ্ছিলো৷ বিকেল থেকে মনে মনে অনেক ভেবেছি এমন তো হওয়ারই ছিল৷ ভাইয়া অনেক বড় তার তো এখন বিয়ের বয়স। আমি খুব ছোট আমাকে কিছুতেই পছন্দ করবে না ইরশাদ ভাইয়া। সে তো দেখতেও খুব সুন্দর৷ আমি তো সুন্দর নই তাই আমি তাকে পাবো না সেটাই তো স্বাভাবিক । কিন্তু রাত হতেই আমি আর স-হ্য করতে পারছিলাম না। আমার খুব কান্না পেল, বুকে কষ্ট হতে লাগলো ভাইয়ার বিয়ে হবে ভেবেই৷ আমি খুব ভালোবাসি ইরশাদ ভাইয়াকে। সেই ক্লাস এইট থেকে তার প্রতি আমার ভালোলাগা। আমি কিছুতেই মানতে পারবো না ভাইয়ার বিয়েটা তাই একবার ফোনও করেছি ভাইয়ার নম্বরে৷ ভাইয়া রিসিভও করেছিলো আর তখনই ইরশাদ ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আমি পা-গ-ল হয়ে গেছি। ভাইয়াকে আমি মনের কথাও বলে দিয়েছি সব৷”

নোরার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ শাদ ব্রো’কে মেহের তার মনের কথা বলেছে! কই ভাইয়া তো বাড়িতে কাউকে কিছুই বলেনি৷ নোরার এবার মনে হলো এটাই ম্যাচিউরিটি। সে আবার মেহেরকে প্রশ্ন করলো, “ব্রো কি বলল? ”

“ইরশাদ ভাইয়া আমাকে প্রথমে বললেন ভাই বোনের মাঝে তো ভালোবাসা থাকবেই৷ আমি বোঝাতে চাইলাম এই ভালোবাসা অন্যরকম৷ ভাইয়া বলল, এটা মোহ-আকর্ষণ। আমি ভাইয়াকে আরও বোঝাতে চাইলাম। অনেক রাত পর্যন্ত সেদিন ভাইয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ভাইয়া আর শুনতে চাইলেন না উল্টো আমাকে ধ-ম-কা-লেন, বকলেন আর বললেন, মাথা থেকে এসব না সরালে আমাকে থাপ্পড় দিয়ে মাথা থেকে ভালোবাসার ভূত নামিয়ে দেবেন।”

মেহের যতোটা সময়ে কথাগুলো বলল পুরোটা সময় নোরা তাকিয়ে রইলো ঠিক মেহেরের চোখের দিকে৷ মেহের থেমে যেতেই নোরা প্রশ্ন করলো, “তুমি ব্রো’কে এক্সাক্টলি কোন যুক্তিটা দিয়ে বোঝাতে চাইছিলো?”

“সায়রার সাথে তো ভাইয়ার সেই কলেজ থেকেই প্রেম ছিল। আমিও আর কয়েক দিন পর কলেজে উঠবো তাহলে আমাকে ভালোবাসতে পারবে না কেন?”

মেহেরের কথা শুনে নোরা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে দরজার দিকে তাকালো। ফুপি তখনও ময়ূখের ঘরেই ছিল। নোরা বিছানা ছেড়ে উঠে বলল, ” আজ থেকে ঠিক বছরখানেক পর তোমার আজকের এই সময়টা মনে পড়লেই তুমি ভীষণ লজ্জায় পড়বে মেহের। বয়সটা এখনও অনেক কম তোমার। আবেগ ভালোবাসা এখন ঋতুর মত বদলাতে থাকবে। এই যে বললে ক্লাস এইট থেকে তুমি শাদ ব্রোকে ভালোবাসো একটু ভেবে বলো তো, এরই তোমার আর কাউকেই ভালো লাগেনি? কোন টিচার, কোন সিনিয়র ভাইয়া কিংবা পথেঘাটে, শপে কোথাও কাউকে আর মনে ধরেনি? আর হ্যাঁ তুমি ভীষণ সুন্দর দেখতে। যখন তুমি আরেকটু বড় হবে তখন তোমার পেছনে ছেলেদের লাইন পড়বে। শাদ ব্রো ততদিনে বয়স্ক হয়ে যাবে তোমার পাশে ব্রোকে একদমই মানাবে না৷ ”

মেহের কিছু সময় চুপ থেকে ভাবলো সত্যিই তো তার তো স্কুলের সেই ফিজিক্সের টিচারকেও ভালো লাগে। পরক্ষণেই নিজেকে শুধালো, সেটা ভালো লাগে কিন্তু ভাইয়ার মত কাউকেই না। আর ভাইয়া বুড়ো হলেও সে ভাইয়াকেই ভালোবাসবে। ভাইয়াকে তো সে বিয়েও করতে চায়। নোরা তাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল, “অন্যদেরও তোমার ভালো লাগে হয়তো ভাবছো ব্রো’র ক্ষেত্রে তা বেশি। আসলে ব্যাপারটা হলো ব্রো তোমার আপনজন তাই তোমার ভাবনা ব্রোকে চাইলেই তাকে পাওয়াও যাবে৷ সে সবসময়ই পাশে থাকবে কিন্তু ওই পথেঘাটে হঠাৎ দেখা, স্কুল টিচার কিংবা অন্যকোথাও যাদের ভালো লাগে তাদের সাথে যোগাযোগ খুব হালকা সেজন্য অতোটা ভাবো না তাদের নিয়ে৷ আমার মন বলছে তুমি অতি শিগগিরই আবেগ কাটিয়ে উঠবে। অন্তত ব্রো’র বিয়ে হতেই তোমার মো-হ শেষ হয়ে যাবে।”

নোরা মুখে এ কথা বললেও মনে মনে শঙ্কিত রইলো। অল্পবয়সী আবেগ আসলে ভ-য়-ঙ্কর হয় খুব। মেহের তার ক্ষতি তো কিছুটা করেই নিয়েছে। নোরার কথার মাঝেই ইরিন ফিরে এলো। ইরিনকে দেখে নোরা ঘুমানোর জন্য চলে গেল৷

দু দিনের মাঝেই ইরিন ফিরে গেল রাজশাহী নোরাকে নিয়ে৷ ময়ূখ পরীক্ষা আছে বলে যেতে পারলো না আবার তার মনও চাইছিলো না সেখানে ফিরতে। মন বলছিল সে ফিরে গেলেই কিছু অ-ন্যা-য় আবদার না করে বসে আম্মার কাছে। মনের কুঠিতে সে যে কথা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল সে কথাই না বলে দেয় মৈত্রীকে৷ তার হাসির আড়ালে ডুবে থাকা যন্ত্র-ণা ভাইয়ের জীবনে আঁধার না আনুক সেই ভয়েই সে থেকে যাবে এবার অচেনা জীবনে৷ এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে তাকে মনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে খুব৷ তবুও সে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে৷ মেহেরের মত কেঁদে বুক ভাসানোর সাধ্য তো তার নেই। অশ্রুজল বড় শত্রুর মত আচরণ করছে তার সাথে। ঘাপটি মে-রে বুকের জমিনের ওজন বাড়িয়ে দিচ্ছে তার প্রতিনিয়ত। ইরিন যাওয়ার আগে ময়ূখ আর নোরাকে সঙ্গে নিয়েই বিয়ের জন্য লেহেঙ্গা কিনেছে। গয়না কিনেছে কিছু নিজে আর কিছু দিয়েছে ইরশাদের দুই মামা। ইরিন যাওয়ার আগ মুহূর্তে দু ভাইয়ের দীর্ঘদিনের বিবাদ বি-চ্ছে-দ শেষ করেই গেছেন। দেখতে দেখতে সময় পেরোলো সাত দিন। একমাত্র ভাগ্নের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করবে বলে আবরার, আফছার দুই ভাই-ই হাজির হলেন রাজশাহী বোনের বাড়িতে৷ হাজির হলো ইরশাদের বড় চাচা আর মেজো চাচাও। মুজিব সাহেব নিজের বাড়িতেই খাবারের আয়োজন করলেন, দাওয়াত করলেন মৈত্রীর নানী বাড়ির আত্মীয়দেরও। তারা কেউ এলো না সেদিন। বাধ্য হয়েই সব কাজের দ্বায়িত্ব নিলেন রোকসানা নিজের ওপর। শিপলুর মা এসে কাজে হাত লাগাতেই ইরিনও এসে হাজির হলেন। রোকসানা তাকে বারণ করলে সে বলে দিলো, “আত্মীয় হওয়ার আগে আমাদের মাঝে আন্তরিকতার একটা সম্পর্ক আছে তাই না ভাবি?”

রোকসানা আর কিছুই বললেন না। হাতে হাত মিলিয়ে সবাই মিলে কাজ করলেন৷ দুপুরপ জম্পেশ খাওয়া হলে পুরুষরা সবাই মিলে বিয়ের তারিখ ঠিক করলেন৷ এক ফাঁকে ইরশাদকেও ফোন করে জিজ্ঞেস করা হলো কোন তারিখটা দেওয়া যায়! তার এক কথা আম্মু যেদিন বলবে সেদিনই হবে তবে তার আবদার বড় কোন অনুষ্ঠান যেন না হয় । ইরিন বললেন মৈত্রীর পরিবার যা বলে তাই হবে। সকলের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, খুব বড় অথবা খুব ছোট নয়৷ মোটামুটি আয়োজন হলেই ভালো হয় যেহেতু ছেলে বেশি কিছু চাইছে না। আর বিয়ের তারিখও পড়ে গেল পনেরোদিন বাদে। এত সব আলাপ আলোচনায় ময়ূখের বাবা বলে উঠলেন, “আমরা কি আমাদের বউমা দেখে যাবো না!”

আবরার খন্দকার এর কথা শুনে ইরিনই নিয়ে এলো নিজের বউমা দেখাতে। মৈত্রীকে দেখে একে একে ইরশাদের মামা, চাচারা অনেকগুলে সালামি গুঁজে দিলো তার হাতে। সন্ধ্যে নাগাদ সব আয়োজন সাঙ্গ করে সবাই যখন চলে গেল নিচতলায় ইরশাদ তখন ফোন করলো মৈত্রীকে। গত কয়েকদিনে তাদের মাঝে কথা হয়েছে। মোটামুটি দুজনে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাদের সে সম্পর্ক কোন হবু দম্পতি কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার মত নয় নিছকই পরিচিতের মত কথপোকথন। তবে আজ ইরশাদ সে থেকে বের হয়ে একটু ভিন্ন গলায় বলল, ” কাল আমি ট্রিট পাচ্ছি তাইনা!”

“জ্বী!”

“শুনলাম তোমার হবু মামা, চাচা শ্বশুররা মোটা অংকের সালামি দিলো! তো আমি সেখান থেকে ট্রিট পাবো না?”

মৈত্রী বুঝতে পারলো ইরশাদ মজা করছে৷ কিন্তু সে তো ওরকম ভাবে জবাব দিতে জানে না! তবুও চেষ্টা করলো, “আপনি কেন পাবেন? সালামি তো আমার শ্বশুররা দিলো।”

“তোমার শ্বশুররা দিলো বলেই তো আমাকে দেবে।”

“কেন? আপনি কে হোন!”

মৈত্রী কথাটা বলেই জ্বিভ কা-ম-ড়ে ধরলো৷ এ কি বলে দিলো! ইরশাদ হেসে উঠলো তার নিঃশব্দ হাসি৷ মৈত্রী মজার ছলে যে প্রশ্ন করে বসলো তার উত্তরে কি বলবে একটু ভাবতে হলো ইরশাদকে তারপরই সে বলল, ” কে হই আমি? তুমিই বলো।”

মৈত্রী বললো না সে কথা। বেলকোনিতে ছিলো সে কথা বলার সময়। রাতের তারা ভরা আকাশে তাকিয়ে থেকে অতি সন্তর্পণে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলল মৈত্রী। আজ মা’কে খুব মনে পড়ছে। ইরশাদ তার জীবনের নতুন এক অধ্যায়। তার জীবনে প্রথম এক চাওয়া যা সে চাইতেই কেমন করে যেন পূরণ হয়ে গেল। আজকাল নামাজে সে উপরওয়ালার খুব করে শোকর আদায় করে। ইরশাদ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন হাতেই ঘর ছেড়ে বেলকোনিতে এলো৷ যা ভেবেছিল তাই। মৈত্রী বেলকোনিতেই আছে, এখনও সে কলেই আছে। ইরশাদ ধীরে ধীরে বলল, “আমি তোমার সেই মানুষ যে তোমার প্রতি মুহূর্তের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবো। বলতে পারো আপন মানুষ কিংবা তোমার মনের মানুষ।”

“মনের মানুষ!” অতি অল্প আওয়াজে উচ্চারণ করলো মৈত্রী।

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-২২

মুজিব সাহেবের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে কিন্তু আপন বলতে খুব একটা আত্মীয় স্বজন উপস্থিত নেই। তাঁর একটি মাত্র মেয়ের বিয়েতে নিজের জ্ঞাতিগুষ্টি কেউ আসছে না। শর্ট নোটিশে দাওয়াত দেশের কয়েকজনই গ্রহণ করেছে আর বেশিরভাগই তো বিদেশে আছেন৷ মৈত্রীর নানীর বাড়ির আত্মীয় বলতে তার প্রবাসে থাকা খালা সাথে নানী আসছে। মামী তো রে-গে চলে গেছেন তিনি আর এ মুখো হবেন না সেটা মুজিব সাহেব ভালো করেই জানেন৷ বিয়ের আর মাত্র দু দিন বাকি । ইরশাদরা কাল চলে গেছে সবাই নিজ বাড়িতে। ইরিনের এক কথা বউ সে তুলবে নিজ বাড়িতে। ইরশাদ দোনোমোনা করছিলো তিনি তা কানে তোলেননি। ইরশাদের মনে যে সায়রা কে নিয়েই রা-গ, ক্ষোভ আর দ্বিধার দেয়াল তা তিনি খুব ভালো করেই জানেন কিন্তু তিনি এও চান ছেলে স্বাভাবিক হোক সবদিক থেকেই। একটা মেয়েকে জীবনে জড়াতে চাচ্ছে তাকে নিয়ে স্বাভাবিক সুন্দর জীবন গঠন করুক প্রাক্তনের ছায়া দেখে তাকে কেন মু-ষ-ড়ে যেতে হবে! তাই ইরশাদের কোন কথাই না শুনে ইরিন ফখরুল সাহেব কে নিজেদের ফ্ল্যাট ভেতর থেকে রঙ করতে বলেছিলেন। দিন সাতেকের মধ্যে পুরো ঘর চকচকে ঝকঝকে বিশেষ করে ইরশাদ আর ময়ূখের ঘরের পেইন্ট, ফার্নিচার সব হয়ে গেছে। মনে মনে তিনি এও ঠিক করেছেন ইরশাদের বউ ঘরে তুলতেই ময়ূখের জন্য মেয়ে দেখবেন। এ নিয়ে বড় ভাইকেও সে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। ইরশাদ কাল বাড়ি গিয়ে প্রথমেই নিজের ঘর গোছানোতে ব্যস্ত হলো। মূলত, সায়রা কিংবা সায়েম যেন চোখে না পড়ে সেজন্যই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে ইরশাদ। এদিকে ময়ূখ আর বড় মামারাও এখনও এসে পৌঁছাননি৷ তারা পৌঁছুতেই আবার এক টে-ন-শন মেহেরকে নিয়ে৷ মেহের অসু-স্থ এবং সে কোন দূর্গ-টনায় পড়েছে সেটা আম্মু বলেছিল৷ কিন্তু তার সন্দে-হ মেহের দূর্ঘট-নায় পড়েনি নিজেই তৈরি করেছে। নিশ্চয়ই সে রাতে তার বকাঝকা সইতে না পেরেই অমন অবুঝপনা করেছে। মাথা গরম হয়ে আছে তার সকাল থেকেই ; কে বলেছিল বাড়ি ফিরতে? ভাড়াটেদের কি বিয়ে হয় না! বিয়ে করে বউকে তার বাড়িতেই ভাড়াটে হিসেবে তুলতে সম্মানে কেন লাগবে বুঝে পায় না ইরশাদ। দু দিন পর তো ফিরতেই হবে সে বাড়িতে তবে এখন কেন এই ফরমালিটি করছে আম্মু! মন মেজা-জের অবস্থা নেহায়েত খা-রা-পের দিকেই যাচ্ছে বলে ইরশাদ ফোন হাতে তার ঘরের বারান্দায় গেল৷ বহুদিন, নাকি বছর! বছরই তো হয়েছে ইরশাদ এ ঘরে থাকে না, এ বারান্দায় পা রাখেনি। আজ সেখানে দাঁড়াতেই মনে হলো এ বারান্দাটা মৈত্রীদের বাড়ির বারান্দার মত সুন্দর নয়। এ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ তো দেখা যায় তবে সেটা গাছের আড়ালে উঁকি দেওয়ার মত৷ অথচ সেখানে খোলা বারান্দা অনেকটা জায়গা নিয়ে৷ উপরে খোলা আকাশ, বায়ে দোতলার বেলকোনি সেখানে দাঁড়ানো নির্জীব এক যুবতী কন্যা। যার আগাগোড়া পুরোটাই বি-ষা-দে মোড়ানো। যার নীরব চাহনিতে মায়া হয় ভীষণ৷ এটাই সত্যি, ইরশাদ মৈত্রীকে ভালোবাসা নয় মায়া আর সহানুভূতির খাতিরে আপন করতে চাইছে। নিজের ভোগ করা আপনহারানোর যন্ত্র-ণা যেন চোখের সামনে মৈত্রী না পায় তাই এমন হুট করে হ-ঠ-কারি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে৷ কিন্তু মন বলে সে অযত্ন করবে না মেয়েটার, নিজের অতীতের দোহাই দিয়ে ক-ষ্ট দেবে না সে মৈত্রীকে৷ গাছের পাতার ফাঁকে উঁকি দেওয়া সূর্যরশ্মি ছোট ছোট বিন্দুর মত ছড়িয়ে আছে ইরশাদের গায়ে, মুখে, চোখে। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে মৈত্রীর নম্বরে ডায়াল করলো। প্রথম কল বাজলো, কে-টেও গেল কিন্তু ধরলো না। পরের বার কল বাজতেই শেলি ধরলো, “দুঃখিত দুলাভাই আপায় এট্টু ব্যস্ত আছে পরে কথা কন।”

“কি করছে তোমার আপা?”

“আপায় তো শাড়ির কুঁচি…” অর্ধেক বলেই থেমে গেছে শেলি। ইরশাদ বুঝতে পারলো মৈত্রী পাশেই আছে আর নিশ্চয়ই সে ইশারা দিয়ে চুপ করিয়েছে। কিন্তু ইরশাদের তো এখন সে অর্ধেক কথাটাই শুনতে ইচ্ছে করছে। সে শেলিকে বলল, “যে কথা অর্ধেক বললে সেটা পুরো বলো ”

“উহু কওন যাইবো না।”

ইরশাদ এবার বলল, “কাল তোমাকে আর তোমার আপাকে তোমার সেই বিশেষ হটডাগ খেতে নিয়ে যাব। বলে ফেলো কথাটা।”

“আমি কইতে পারমু না আপারেই জিগান। আর ঘুষ কিন্তু আমি খাই না তাই লাগবোও না আপনার হটডাগ এই লন আপারে মোবাইল দিতাছি।” শেলি সত্যিই মৈত্রীকে ধরিয়ে দিলো ফোনটা। মৈত্রী পুরনো একটা সুতির শাড়ি নিয়ে নিজে নিজে পরার চেষ্টা করছিল অনেকক্ষণ ধরে। শেলিও তাকে সহযোগিতা করতে এসেছিলো কিন্তু কিছুতেই দুজনে মিলে শাড়িটা ঠিকঠাক পরতে পারলো না। যতবারই কুঁচি তুলল প্রতিবারই তা গোঁজার আগেই এলোমেলো হয়ে গেল। ইরশাদ যখন ফোন দিলো তখনও তেমন হলো আর শেলি তো বোকার মত সেটাই বলতে যাচ্ছিলো৷ তাই সে ইশারায় বা-র-ণ করেছে কিন্তু এখন কি বলবে! ইরশাদ ওপাশে অপেক্ষায় আছে কিন্তু মৈত্রী জবাব দিচ্ছে না তার কথার। সে বার দুয়েক প্রশ্ন করেছে, “কি করছিলে শাড়ির কুঁচিতে?”

মৈত্রীর গাল রক্তিম হলো, সে লজ্জা পাচ্ছে। তার ঠোঁটের কোণ চওড়া হয়েছে একটুখানি৷ ইরশাদের দিন পনেরোর পরিশ্রমের ফল এই প্রকাশ্য হাসি। যে মেয়েটা কারো সামনে হাসতে, কাঁ-দতে জানতো না সেই মেয়েটিই এখন কাঁদতে শিখেছে। যে মেয়েটির বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে গেল সে স্বাভাবিক নয় এই অপ-বাদে সেই মেয়েটিই এখন লজ্জা পায়, হেসে ওঠে আর সবটাই হচ্ছে ইরশাদের জন্য।

“কুঁচি করা শিখছিলাম।” বড় লাজুক স্বরে বলল মৈত্রী। ইরশাদেরও ভালো লাগলো শুনে তবুও কোথাও একটু অতীত এসে কড়া নাড়লো মনে। সায়রার সাথেও জুড়ে আছে এই শাড়ি পরা আর কুঁচি করা নিয়ে কত খুনসু-টি। বিগত বছর গুলোতে যে স্মৃতিগুলো ফিকে হয়ে আসছিলো তা যেন এখন মৈত্রীর সাথে জুড়ে তাজা হয়ে উঠছে। ঘুরেফিরে একই ঘটনা কি আবারও ঘটবে?

নাহ! নিজ মনেই স্বগোতক্তি করে উঠলো ইরশাদ। মৈত্রীর সাথে সে আর এভাবে কথাই বলবে না। প্রেম প্রেম কিছুই চাই না তার। একেবারে বিয়ে করে তবেই তার সাথে কথা বলবে। প্রেমিকার মত মৈত্রী তার চাই না কিছুতেই। ইরশাদ ফোন কে-টে দিলো৷ মৈত্রী প্রথমে অবাক হলো পরে চলে চি-ন্তিত। এরপর সে নিজেই বারংবার কল করলো ইরশাদ ধরলো সে না ফোন। আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করবে না করবে না করেও ইরশাদের চাচা- ফুপু সবার শ্বশুরবাড়ি, এলাকার মানুষজন নিয়ে প্রায় চারশোর বেশি বৌভাতের মেহওয়াত করা হয়েছে। মামারা খুব বেশি নয় হাত গুণে মোটে সাতজন এসেছে। মেহের এসে অবধি ইরশাদের সামনে পড়েনি। সেই যে এক ঘরে ঢুকেছে দিন -রাত সেখানেই কাটলো তার। রাতে হলুদ এর ছোট্ট আয়োজন ছাঁদে করা হয়েছে। ময়ূখ নিজেই ডেকোরেশন এর লোক এনে চমৎকার সাজিয়েছে। ইরশাদকে শ্বশুর বাড়ি থেকে পাঞ্জাবী পাজামা আরও অনেক কিছুই পাঠানো হয়েছে। ইরশাদ সেই পাঞ্জাবী পরে বসে আছে বরের আসনে। কাল সেই যে কল কেটেছে এখন পর্যন্ত আর কথা বলেনি মৈত্রীর সাথে। মৈত্রী নিজে থেকে দু বার কল করেছিল রাতে তারপর আর কোন কল, মেসেজ কিছুই আসেনি। ইরশাদ টুকটাক কথা গল্পে মৈত্রীকে যতটুকু চিনেছে মেয়েটি এতোই অন্তর্মুখী স্বভাবের যে, চাইলেও সে নিজে থেকে ইরশাদকে কল করবে না, বলবে না তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে, বলবে না ইরশাদের জন্য চিন্তায় অ-স্থির হচ্ছে৷ কিন্তু সব বুঝেও যে সে আজ তাকে কল করবে না। আর তো মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপর চিরজীবন পাশেই থাকবে সে তার। একটু না হয় কষ্ট করুক আজ৷ হলুদ পর্ব শুরু হতেই ময়ূখ এলো হন্তদন্ত হয়ে পাশেই তার নোরা আর মেহের। ইরশাদ একে একে তিনটি ভাইবোনকেই দেখলো। তবে নজরজোড়া তার বেশি গভীর হয়ে দেখলো মেহের। বাচ্চা মেয়েটা এখনোও কি ক-ষ্ট পাচ্ছে তার জন্য! মন বলল একটুও না পাক কষ্ট মেহের। অতিসত্বর কে-টে যাক তার সকল মোহ। ইরশাদ তো তাকে আর নোরা ছোট্ট বোনের মতই ভালোবেসেছে তবে কেন মেহের মন বদলে গেল! এত বছর বয়সে এসেও বোকার মত ভাবনা ভাবছে ইরশাদ।

“ভাই একটু হাসো তো।” ময়ূখের কণ্ঠে ধ্যান ভা-ঙলো ইরশাদের। তার দু পাশে ময়ূখ আর নোরা, নোরার পাশে মেহের বসেছে। ময়ূখ ফোন হাতে ছবি তুলতেই ডাকছে তাকে। মেহেরকে যখন বলা হলো ভাইকে হলুদ লাগা তকন মেহের শুধু একবার তাকিয়ে ছিল ইরশাদের দিকে। হলুদ ছোঁয়ায়নি উল্টো চোখ নিচু করে বলে গেল, “আমি আর কখনো তোমার সামনে আসবো না তোমার সাথে জীবনেও কথা বলবো না।”

মামা, মামী, চাচা-চাচীরা সকলেই কমবেশি হলুদ লাগিয়ে দিলো ইরশাদকে। পাশাপাশি ফটোগ্রাফিও হলো অনেক। হঠাৎই কানে এলো বড় ভাবীর কণ্ঠ। তিনি জোরে জোরে বলছেন, সায়রা এদিকে আয় আমরা সব ভাবী মিলে ছবি তুলবো না দেবরের সাথে? বড় চাচীর পুত্রবধূ জুয়েনা ডাকতেই চমকে উঠলো তিনজন মানুষ। প্রথমজন ইরশাদই চমকেছে, তার ধারণায় ছিলো সায়রা এসেছে ছাঁদে। মনে মনে সে চাইছিলোই যেন সামনে না আসে ওই প্র-তারক মেয়েটি। দ্বিতীয়জন সায়রা নিজেই যে কিনা বসেছিলো ইমরানের পাশে ছাঁদের এককোণে। শুধু মাত্র আত্মীয়স্বজনরা ডাকাডাকি করবে বলেই ইমরান তাকে নিয়ে উপরে এসেছিল আর তৃতীয়জন ইরিন৷ জুয়েনা ডেকেই ক্ষান্ত হয়নি সে এক প্রকার টেনেই সায়রা আর অন্তুর বউকে নিয়ে গেল স্টেজের কাছে। ইরিন চুপচাপ ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো লক্ষ্য করছেন ছেলের প্রতিক্রিয়া। ইমরান কঠিন দৃষ্টিতে দেখছে সায়রাকে। জুয়েনা গিয়ে বসলো ইরশাদের পাশে তার অপর পাশে ঠেলে বসিয়ে দিলো সায়রাকে। অন্তুর বউ অবশ্য ভাসুরের পাশে বসতে সংকোচ বোধ করছে তাই সে বড় জায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তুই বাড়ির এবং বংশের ছোট ছেলে কিন্তু বিয়ে সে ইরশাদের আগেই করেছে। ইরশাদের বা পাশে বসে আছে সায়রা। বড় ভাবী এটা সেটা বলতে বলতেই ইরশাদকে হলুদ ছুঁইয়ে সে হাতেই সে সায়রাকে লাগিয়ে দিলো৷ তিনি যে কাজটা ইচ্ছে করে তার পুরনো ঘা-য়ে খোঁচা মা-রতেই করেছেন তা সায়রা বেশ বুঝতে পারলো। বাড়ির তো প্রায় সকলেরই জানা তাদের পুরনে সম্পর্কটার কথা কিন্তু ইরশাদ দাঁতে দাঁত চে-পে আছে। মনে মনে সে মৈত্রীকেই কল্পনা করতে চাইলো। হাতের মুঠোয় ফোনটাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে কল্পনা করতে চাই উদাস একজোড়া মেঘাচ্ছন্ন চোখ। ভুলে যেতে চাইলো পাশে বসা বাসন্তীরঙা শাড়ির অপরূপ সুন্দরী নারীটিকে৷ সায়রাও যেন বুঝে গেল ইরশাদের মনের ব্যথা। সে এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল, “সায়েমকে নিচে রেখে এসেছি ভাবি আমি পরে আসব।”

“পরে এসে কি হবে দেবরের হলুদ কি বসে থাকবে?” কথাটা বলেই জুয়েনা আবার ইরশাদকে বিভিন্নরকম প্রশ্ন করতে লাগলো। তার সকল প্রশ্ন মৈত্রীকে নিয়েই তৈরি হলো একের পর এক। হলুদের রাতটা বিচ্ছিরিই মনে হলো ইরশাদের কাছে।

মৈত্রীর আত্মীয়রা যে ক’জন আসার ছিলো এসে গেছে। ইরিন তার বউমার জন্য শাড়ি কেনেনি গায়ে হলুদের৷ হলুদ আর গোলাপির কম্বিনেশনের লেহেঙ্গা কিনেছে সাথে পাঠিয়েছে কাঁচা ফুলের খুব সাধারণ গয়না। বিয়ের জন্য প্রথমে শাড়িই কিনেছিলেন তিনি হঠাৎ করেই ময়ূখ বলল শাড়ি সামলানো হয়ত কঠিন হবে লেহেঙ্গা দিলেই ভালো হয়। ইরিন তাই করলো আবারও একটা লেহেঙ্গা কিনলো লাল টুকটুকে দেখে। একসাথে দুটোই পাঠিয়েছেন এও বলেছেন মৈত্রীর যা ভালো লাগবে তাই যেন পরে৷ কিন্তু এতসবের পরও যে মৈত্রী খুশি নেই একটুও তা চোখ এড়ায়নি রোকসানা বেগমের। মেয়েটিকে তিনি হাতে তুলে খাওয়াননি কোনদিন, তার অসুস্থতায় রাত জেগে সেবাও করেননি তবুও ছিলো চোখের সামনেই৷ মেয়েটির শৈশব, কৈশোর আর যৌবনে পা দেওয়া সবটাই তার সম্মুখে৷ বুঝতে ভুল করেননি তিনি মৈত্রী কোন কারণে চিন্তিত কিংবা ভয়ার্ত৷ হলুদের অনুষ্ঠান জুড়ে মৈত্রীর পাশে মৈত্রীর নানী আর খালার আধিপত্য ঠিক এতখানিই ছিলো যার দরুণ, অরুণিমাও তার পাশ ঘেঁষেনি৷ শেলিও ভীষণ কষ্ট পেলো মৈত্রীর কাছে থাকতে না পেরে৷ একটা সময় বড্ড আনমনা আর উদাস হয়ে মৈত্রী হলুদের আসর ছেড়ে নিচে চলে গেল৷ তখনই একটুখানি ফাঁকা পেয়ে রোকসানা গেল তার রুমে।

“তুমি ঠিক আছো? ”

“জ্বী… মামনি!”

হঠাৎ ডেকে উঠলে মৈত্রী। রোকসানা বেগম বিষ্মিত হয়ে তাকালেন। তাঁর সেই তাকানোতে ছিলো বোধহয় কিছু একটা। মৈত্রী কা-ত-র হলো ভীষণ৷

“মামনি আমি কখনোই আপনাকে মায়ের মত সম্মান করিনি, কখনো আপন মানুষের মত শ্রদ্ধা দেখিয়ে কথা বলিনি সত্যি বলতে আপন বলে ভাবতেই পারিনি৷ কাল থেকে আমি আর থাকব না এখানে কিন্তু আমার বাবাটা থাকবে। প্লিজ আমার কোন রকম অন্যায়, ভুল ত্রুটি থাকলে আমায় ক্ষমা করে আমার বাবাটকে যত্নে রাখবেন প্লিজ।”

রোকসানা বেগম চুপচাপ শুনে গেলেন মৈত্রীর কথা। সেই যে ছোট্ট একটা মেয়েকে পেয়েছিলেন বিয়ের পর সেই মেয়েটারই আজ বাদে কাল বিয়ে। এই মেয়েটাকে তিনি নিজেও কোনদিন স্নেহের পরশে বুকে জড়িয়ে নেননি কিন্তু তার অবহেলাও করেননি কোনদিন। মৈত্রীর এখনকার কথাটা শুনে খা-রা-প
লাগলো আবার ভালোও লাগল খুব। মেয়েটা বদলেছে। মনের কথা মুখে আনতে শিখে গেছে সে। তিনি এগিয়ে এসে মৈত্রীর মাথায় হাত রাখতেই আচমকা মৈত্রী তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো। নারীর মমতা কি বরফের ন্যায় উষ্ণতা পেলেই তা গলে যায়! রোকসানার চোখে জল জমলো, মমতায় তার কোমল মন মৈত্রীর জন্য গলে একাকার হলো। তিনি নিজেও দু হাতে আবদ্ধ করে নিলেন মৈত্রীকে। ধীরে ধীরে আশ্বস্ত করলেন, তিনি কারো অযত্ন করবেন না। মৈত্রী বাবা, স্বামী আর তার শ্বশুর বাড়ি কোথাও কোন অযত্নের ছাফ ফেলবেন না তিনি। সাথে ফিরিয়ে দিলেন মৈত্রীর কথাও, “তুমি আমাকে মায়ের স্থান না দিলেও অসম্মান কিংবা অশ্রদ্ধাও করোনি কোনদিন৷”

সৎ মা-মেয়ের সঙ্গাও বদলে গেল তাদের বেলায়। হলুদের রাতে ইরশাদকে নিয়ে করা মন খা-রা-প ভাবটাও কখন যেন বাষ্পীভূত হয়ে গেছে টের পায়নি মৈত্রী৷ না চাইতেও রাতটা কাটলো তার খালা আর নানীর মাঝে শুয়ে৷ সকাল হতেই মৈত্রীকে পার্লারে নিয়ে গেল তার দুই বান্ধবী। তারা কাল হলুদে একজনও আসতে পারেনি বলে রা-গ করেছিল মৈত্রী। সে না হয় চাপা স্বভাবের বলে মন খুলে কখনো তাদের বলতে পারেনি তারা কতোটা আপন তারা কিন্তু তারা তো মৈত্রীকে এতদিন আপন বলেই জেনে এসেছে। অথচ তার এমন আনন্দময় মুহূর্তেই তারা পিছিয়ে রইলো! রোকসানা ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, জোর করেই নিয়ে যাও তাকে পার্লারে। নিয়ে গেল বান্ধবীরা মৈত্রীকে, পিছু নিলো শেলিও। জুম্মার নামাজেরও ঘন্টাখানেক পর এসে উপস্থিত হলো বরযাত্রী। এর মাঝেও মেত্রী একবার কল দিয়েছিল ইরশাদকে কিন্তু মানুষটা ফোন তো ধরলোই না উল্টো কে-টে দিলো! মৈত্রীর কান্না পেলো এবার। কাল থেকে চেপে রাখা কান্নাটা আর বাঁধ মানলো না৷ বান্ধবীরা যখন গেইটে দাঁড়িয়ে ইরশাদকে থামিয়ে দিলো টাকার জন্য মৈত্রী তখন সবার অলক্ষ্যে বসার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো। কালো শেরোয়ানি, লাল পাগরী পরা লম্বা-চওড়া মানুষটাকে দেখতেই মৈত্রীর কান্না থেমে গেল। চোখে পড়লো পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল দিচ্ছে । তার পাশেই দাঁড়িয়ে ময়ূখ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কত কি বলছে তার বান্ধবীদের৷ শেলিও কম যায় না এসবে সে তো ট্রেতে করে পাঁচ গ্লাস শরবত নিয়ে গেল নতুন বরকে খাওয়াবে বলে৷ মৈত্রী জানে সেখানে একটি শরবতও ঠিকঠাক নেই। কোনটাতে মরিচ দেওয়া কেনটাতে লবণ কোনোটা আবার মিষ্টি ব্লেন্ড করা৷ মৈত্রীর ফোন বেজে উঠলো। সে কান্নামাখা মুখে তখনো জানালা দিয়ে তাকিয়ে ইরশাদকেই দেখছে। ফোনে তাকাতেই দেখলো কলটা ইরশাদ করেছে। আজ দু দিন পর মনে পড়লো তাকে কল করার কথা! রা-গ হলো তার কিন্তু কলটা কি না ধরে পারা যায়! রিসিভ করে কানে তুলেই সে ইরশাদকে দেখলো। ফোন লাউড স্পিকারে রেখে উঁচু স্বরে বলে উঠলো, ” এখানেই দাঁড়িয়ে বিয়ে করতে আপত্তি আছে তোমার?”

“কিহ!”
মৈত্রী কিহ বললেও তার আওয়াজ কেউ শোনেনি তার আগেই তার বান্ধবীরা, অরুণিমা, শেলি সবাই একত্রে বলছে, “হ্যাঁ পারলে এখান থেকেই করেন৷ টাকা ছাড়া আমরা তো ভেতরে যেতেই দেব না।”

“কিছু বলছো না কেন? আমি তো বউ ছাড়া যাব না তাই জলদি বলো কি করবে৷ হয় এখানে দাঁড়িয়েই কবুল বলব তুমিও বলবে আর না হয় তোমার বান্ধবীদেরই ধরে নিয়ে যাই। আমি অত টাকা পয়সা দিতে পারবো না।”

“ইশ, একজনকে নেওয়ার টাকাই দিতে পারছেন না আবার অন্যদের চাইছেন?”

ময়ূখ বলে উঠলো, “সামনে আছে না নিলে চলবেই না৷ ভাই কি বলো আমরাও দু একটা নিয়ে নেই।”

অন্তুও তাল মিলিয়ে বলল, “আসলেই ভাই ভাবির সাথে দু একটা তো ফ্রী পাবোই আমরা নেই ভাগাভাগি করে।”

“শালা তোর বউ পিছে সে কথা কি ভুলে গেছিস?” অন্তুর কানে ফিসফিসিয়ে ময়ূখ কথাটা বলতেই বেচারা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো পেছনে৷ আসলেই তার বউ তাকিয়ে আছে কটমট করে। সবাই মিলে আরো অনেকক্ষণ টাকা নিয়ে হৈ হল্লা হলো কিন্তু ইরশাদ কিছুতেই বিশ হাজার দিবে না। মৈত্রী এবার ধীরে ধীরে বলে উঠলো, ” বিশ না হোক দশই দিন।”

“কি বললে?” ইরশাদ প্রশ্ন করলো৷ সকল হৈ চৈ মৈত্রীর আওয়াজ শুনেই চুপ হয়েছিল। ইরশাদ আবারও প্রশ্ন করায় মৈত্রী বলল, “বউয়ের মূল্য এতোটাও কম নয় নিশ্চয়ই!” বলতে বলতেই যে মৈত্রী লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে তা যেন এখান থেকেই বুঝতে পারলো ইরশাদ। সে চোখ উঁচিয়ে ওপরে তাকাতেই দেখতে পেল লাল টুকটুকে এক কন্যা দাঁড়িয়ে আছে জানালার সামনে।

“দিয়ে দে ময়ূখ যত আছে সবটাই। তোর ভাবী যেভাবে অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে কখন না নিজেই চলে আসে!”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে