#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৮
রাত বারোটার প্রায় কাছাকাছি চলছে। নোরা বসে আছে এখনও মৈত্রীর ঘরে এমনকি আজ আর সে নিচে যাবে না বলে দিয়েছে ফুপিকে। রাতের খাবার ইরশাদ, ফখরুল সাহেব আর নোরা এখানেই খেয়েছে শুধু মাত্র ইরিন মাথাব্যথার বা-হা-না করে চলে গেছে না খেয়ে। রোকসানা অবশ্য অনেক ভেবে বাক্স ভর্তি খাবার দাবার পাঠিয়ে দিয়েছে ইরশাদদের ঘরে। ইরশাদ আর তার মা বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মৈত্রী বসে আছে নিজের ঘরে। তার যেন নিজের মাঝে কোন চেতনাশক্তিই নেই। সেই যে বসেছে বেলকোনির মেঝেতে সেই বসাতেই শেলি এসে জোর করে চাদর জড়িয়ে দিয়েছে নোরা এসে শেলিকে দিয়ে মোটা কাঁথা দিতে বলেছে। শেলি কাঁথা দিতেই নোরা সেটা বেলকোনির মেঝেতে বিছিয়ে জোর করে সেখানে বসালো মৈত্রীকে। কয়েক মিনিট কেটে গেল নীরবতায়। শীতগন্ধী হাওয়ায় কোথা থেকে ভেসে এলো রজনীগন্ধার ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণে আঁধার ঢাকা বেলকোনির নীরবতাকে ভেঙে নোরাই মুখ খুলল, “এভাবে স্ত-ব্ধ হয়ে আছো কেন মৈত্রী? তোমার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা উচিত আজকের জন্য।”
“কেমন ভাবে প্রকাশ করতে হয় প্রতিক্রিয়া!” অবুঝের মত জানতে চাইলো মৈত্রী৷
“মৈত্রী! স্যরি ভাবী। এখন থেকে ভাবীই বলবো তেমাকে। আমার ভাইকে তুমি সত্যিই ভালোবাসো তো?”
নোরার এই একটা প্রশ্নেই যেন মৈত্রীর চেতনা ফিরে এলো। ধীরে ধীরে তার ভেতরটা সরব হয়ে উঠলো সে ক্ষণে। এ কি হয়ে গেল এমনটা কেন হলো! ইরশাদই’বা কেন তার কথাগুলো শুনতেই তাকে নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করলো? বাবা কি তার ওপর রেগে আছে? মামী কি রাত করেই ঢাকা ফিরে গেল! আর ইরিন আন্টি, এক সঙ্গেই তিনি বা উনার পরিবার কি ভাবছে? মৈত্রীকে দেখে নোরা তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি বলল, এটাই রিয়াকশন। ওকে এখন সুযোগ দিতে হবে নিজেকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরার। নোরা বলল, “আমি চলে যাচ্ছি ফুপির কাছেই আজ তোমার সাথে ঘুমাব বলে প্ল্যান তো করেছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিচে যাওয়া উচিত।”
“না না থাকো তুমি, শেলি বিছানা ঠিক করে দে নোরা আপুকে।”
“নো, ইউ নিড স্পেস নাও। আমি কাল আসব তোমার কাছে৷ শেলি দরজা লাগিয়ে যাও এসে।” নোরা সত্যিই চলে গেল সে সময়। মৈত্রীর মনে হলো তার এখন বাবাকে দরকার। সন্ধ্যের পর যা হয়েছে সবটাতে মৈত্রী ঘোরে ছিল যেন। সে তো খেয়ালই করেনি বাবার অবস্থা, ইরশাদ কেন তার এক কথাতেই এত বড় স্টেপ নিলো! আর তাদের পরিবারই কেন এত সহজে মেনে নিলো সবটা? মৈত্রী এলোমেলো পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো বাবার ঘরের দরজায়।
ময়ূখ কত কতবার কল করলো আম্মাকে তার হিসেব নেই। ভাইকে করেছে, বাবাকেও করেছে কেউ ফোন তোলেনি। কি হয়েছে সবার তার ফোন কি কেউ খেয়াল করেনি নাকি বাড়িতে কোন সমস্যা হলো! কয়েকটা ঘন্টা পেরিয়ে গেছে কেউ ফোন ধরেনি আর না কল ব্যাক করেছে৷ ভ-য়ে এবার হৃদয় কাঁপছে তার। হঠাৎই মনে হলো নোরাকে কল করছে না কেন? তাকেও কল করে দেখা যাক। ময়ূখ এবার নোরার নাম্বারে কল দিলো আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “আল্লাহ! সব যেন ঠিক থাকে।”
নোরা মাত্রই এসে ঘরে ঢুকেছে। ইরশাদ বাড়ি নেই আজ, কোথায় গেছে তাও জানা নেই৷ ইরিন সোফায় কুশনে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে আছে কপালে হাত ফেলে। নোরার মনে হলো এখন ফুপিকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। সে ময়ূখের ঘরে বর্তমান যেটা তার ঘর সেটাতে ঢুকে বিছানায় বসতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের পর্দায় ময়ূখের নাম ভাসছে। এত রাতে ময়ূখ কল দিচ্ছে! নোরার বাবা এখনও ঢাকাতেই আছে তবে তিনি এক বন্ধুর বাড়িতে। অবচেতন মন বলল কোন বি-প-দ হয়নি তো! সে চিন্তায় অ-স্থির হয়ে ফোন ধরতেই ময়ূখ বলল, “কি হয়েছে সবার ফোন ধরে না কেন? আম্মা কই আম্মাকে ফোন দাও জলদি।”
কণ্ঠস্বরে আত-ঙ্ক স্পষ্ট ; কতক্ষণ ধরে কেউ তার ফোন ধরছে না! ময়ূখকে রিল্যাক্স হতে বলল নোরা।
“বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটে গেছে তাই কারো নজর ফোনে পড়েনি৷ তুমি শান্ত হও একটা গুড নিউজ আছে।”
“গুড নিউজ!” তখনও আতঙ্ক কমেনি ময়ূখের। নোরা বুঝতে পেরে তাকে বলল, “তোমার আশেপাশে পানি আছে থাকলে আগে এক গ্লাস পানি খাও। তোমার নার্ভ শান্ত করো আগে।”
“আমি ঠিক আছি তুমি নিউজ বলো।”
নোরা বসা থেকে এবার লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মনে মনে বলল, “আমার যা ধারণা মৈত্রীকে তুমি যে চোখে দেখো তা যদি সত্যি হয় তাহলে ময়ূখ তুমি ঠিক থাকবে না।”
ময়ূখ তাড়া দিতে লাগল এবার তাই নোরা বলেই দিলো, “শাদ ব্রো’র এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”
“কি বলছো!”
“ঠিকই বলছি। আজ সন্ধ্যার পর ব্রো আর মৈত্রীর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”
“ভাইয়ের সাথে কার!” ফোনের ওপাশে মানুষটা যেন চেঁচিয়েই উঠলো। নোরা টের পেল তার নিজের কান্না পাচ্ছে। ময়ূখ কষ্ট পাচ্ছে বলে নয় বরং তার ধারণা সত্যি হয়েছে বলে। ময়ূখের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করছে মৈত্রীকে নিয়ে তার মনে অন্যকিছুই ছিল যা নোরা তার চোখে আগেই দেখেছে।
“মৈত্রী শাদ ব্রোকে ভালোবাসে ময়ূখ। সে নিজেই ব্রো’কে আজ তার মনের কথা বলে দিয়েছিল। ব্রো তো নিজেই একজন ব্রো-কে-ন মানুষ হয়তো তাই চায়নি মৈত্রী মেয়েটা কষ্ট পাক। আর তাই দু পরিবারকে একসাথে ডেকে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে।”
“আম্মা কই? আমার ফোন ধরছে না কেন?” নোরাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো ময়ূখ।
নোরা এবার আর কিছু না বলে ফোন নিয়ে গেল ফুপির ঘরের সামনে। বাইরে থেকে ডাকলো, “ফুপি ময়ূখ কল দিচ্ছে তোমাকে।”
“আমি এখানে নোরা, এদিকে আসো।”
পেছনে সোফা থেকে আওয়াজ শুনে পেছনে ফিরলো সে। ফুপি আধশোয়া হয়ে এখনও সোফায় তারমানে ফুপি কোন কারণে আপসেট। নোরা ফোন এগিয়ে দিলো ফুপিকে, “ময়ূখ লাইনে আছে।”
ইরিন ফোন কানে ধরলো, “হু বল, খাবার খেয়েছিস?”
“রাত সাড়ে বারোটা বাজে আম্মা এ সময় কে খাবার খায়?”
ইরিনের হঠাৎই জগৎ-সংসারের খেয়াল হলো। আজ সে রাতে ময়ূখকে কল দেয়নি খাওয়ার আগে। প্রতি বেলায় খেতে বসে আগে ছেলেটাকে কল দেয় কিন্তু আজ তো খাওয়া হয়নি তার। এ ঘরের সবাই নতুন আত্মীয়ের ঘরে খেয়ে এসেছে। ইরিনের এবার অপ-রাধ-বোধ হতে লাগল। মৈত্রীকে নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে সে ভুলেই গেছে তার সংসারের বাকিদের কথা। ইরিন সোজা হয়ে বসে নোরাকে বলল এক গ্লাস পানি দাও তো! নোরা পানি দিতেই সেটা খেয়ে সে কথা বলল কিছুক্ষণ৷ ময়ূখ একবারও প্রশ্ন করেনি ইরশাদের এনগেজমেন্ট নিয়ে ইরিনও অন্যমনস্কতায় অল্প কথায় কল কাটলো। সে রাতে ইরশাদ বাড়ি ফিরলো না। ইরিনও কোন খোঁজ নেয়নি ছেলের। এমনটা এর আগে শুধু একবার হয়েছিল আর সেটা ইমরান আর সায়রার বিয়ের রাতে। ভোরে নামাজ পড়ে ইরিন নিজ বিছানায় গেলেন। ফখরুল সাহেব নামাজ পড়ে ছেলেকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ইরশাদ সারারাত মসজিদেই ছিল আজ। এখানে বন্ধু বান্ধব নেই তার তাই সে নিজেকে সময় দিতে মসজিদেই গিয়েছিল। এখানে আছে প্রায় বছর হয়ে আসছে। ইরশাদ রোজ নামাজে যায় সেজন্যই ইমাম সাহেবের সাথে তার পরিচয়৷ কাল তাকে অত রাতে মসজিদের দরজায় দেখে তিনি ভীষণ অবাকই হয়েছিলেন। ইরশাদকে যখন প্রশ্ন করলেন, এত রাতে এখানে কেন তুমি?
ইরশাদ বিনা দ্বিধায় জানিয়ে দিলো মনের ভেতর চলা অস্থিরতা। বলে দিলো কোন কিছু না ভেবেই সে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বাবা মাকে জানিয়ে বাগদানও করেছে। ইমাম সাহেব সব শুনে তাকে আশ্বস্ত করলেন এটা অতি উত্তম সিদ্ধান্ত তবে কেন সে অ-স্থি-র এত! ইরশাদ থম মে-রে গেছে সে প্রশ্নের জবাবে। সত্যিই তো সে কেন এত দ্বিধাগ্রস্ত! বিয়ে তো তাকে করতেই হতো এক না একদিন। তবে যে মানুষ তাকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করতে স-ম-স্যা কোথায়? পরে মনে হলো সমস্যা আছে একটা আর তা হলো কাল সে শুধু নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বাবা- মায়ের সিদ্ধান্ত জানতে চায়নি। তারা তো চুপচাপ শুধু তার কথা রাখতে মৈত্রীকে আম্মু তার নিজের আংটি দিয়ে বরণ করে নিলেন অথচ আম্মুর মুখে হাসি ছিল না। তিনি সেদিন তার স্বভাবের সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করেছিলেন। রাতভর নিজেকে হাজারো প্রশ্নত্তোরে ব্যস্ত রেখে ভোরে ফজর পড়লো। আব্বুর সাথে মসজিদেই দেখা হলো নামাজ শেষে তাই আর বসে না থেকে বাড়ি ফিরলো। গেইট খুলে দিলো নোরা। ইরশাদকে দেখে গুড মর্ণিং উইশ করলো। ইরশাদও জবাব দিয়ে জানতে চাইলো, “আম্মু কোথায়?”
নোরা বলল, একটু আগেই ঘুমাতে গেছে।
ইরশাদ আর কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢুকলো। নোরা আবার ঘুমিয়ে পড়বে তা জানে ইরশাদ তাই সে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে চা দিব আব্বু?”
“না আমি আবার একটু শুয়ে থাকব। তুই নিজের জন্যই বানা।”
ইরশাদ রান্নাঘরে ঢুকে, কফি বানিয়ে আগে সেটা খেয়ে নিলো। শীত শীত ভোরে গরম ধোঁয়া ওঠা কফিটা সারারাতের নির্ঘুম দেহটাকে ফুরফুরে করে দিলো নিমেষেই। তারপর ফ্রিজ খুলে যে ক’রকম সবজি ছিলো সেগুলো কেটে ধুয়ে সবজি খিচুড়ি বসিয়ে দিলো। নিজের ঘরে ঢুকে সে কাল বিকেল থেকে গায়ে থাকা জ্যাকেটটা খুলে রাখলো। কাল তার অনুপস্থিতিতে পাখির খাঁচাটা বাইরেই ছিলো বলে বেলকোনির দরজা খুলে প্রথমে তাদের দেখলো। না খাঁচার ওপর কম্বল আছে তারমানে, রাতে এতকিছুর মাঝেও আম্মু পাখিগুলোকে যত্নে রেখেছে। বাইরে এখনো রোদ উঠেনি, কুয়াশায় আবছা চারপাশ। ইরশাদ খাবারের বক্স খুলে পাখিগুলোকে খাবার আর পানি দিয়ে আবারও ঢেকে দিলো কম্বলে। হঠাৎ মনে পড়লো মৈত্রীর কথা তাতেই চোখ তুলে তাকালো উপরের বেলকোনিতে। মেরুন রঙের সুতি জামা গায়ে ওড়না জড়ানো ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে মৈত্রী। চ-ম-কে গেল ইরশাদ, মেয়েটা কি সারারাত ঘুমায়নি? তার কি শীত লাগছে না? ওভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছে এত সকালে! গরম কাপড়ও পরেনি মেয়েটি! ইরশাদ এবার নিজেকেই প্রশ্ন করলো, ভুল করলাম কি মেয়েটিকে এভাবে নিজের জীবনে জড়িয়ে!
মৈত্রী এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই ডান পাশে নিচে তাকালো। চোখাচোখি হলো মৈত্রী, ইরশাদের। আকস্মিক দৃষ্টি মিলনে অপ্রস্তুত হাসি দিলো ইরশাদ কিন্তু মৈত্রী হাসলো না। সে নিষ্পলক চেয়েই রইলো। তা দেখে ইরশাদই হঠাৎ একটু উঁচু শব্দে প্রশ্ন করে বসলো, “কি হয়েছে?”
চলবে
#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৯
মৈত্রী কাল রাতে প্রথমবার তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। মুজিব সাহেব মেয়ের জড়তা কে-টে-ছে বুঝতে পেরেই মনে মনে ভীষণ খুশি হলেন। কতগুলো বছর পর দেখলেন মেয়ের চোখে পানি! মনে পড়ে না মৈত্রী কবে শেষবার হেসেছিল, কবে কেঁদেছিল আর এ নিয়েই তো লোকে বলে, আপনার মেয়ে স্বাভাবিক নয়। কে বলবে আর এমন এই যে, তার মেয়ে কত হাসছে। তার মেয়ে অস্বাভাবিক নয় সে মুখচো-রা কেউ কেন বুঝতে পারে না! মৈত্রী বাবার সাথে কথা বলে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে নিজের ঘরে ফেরে। বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুঝতেই চোখে ভাসে বিড়ালচোখা মানুষটির প্রথমবার দেখা মুখটা। তখনও বিশ্বাস হচ্ছিলো না সন্ধ্যায় কি ঘটে গেল! নোরা বলছিলো প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত মৈত্রী বুঝে পায় না প্রতিক্রিয়া করাটাই কি সব? মৈত্রী এও জানে তাকে সবাই মানসিকভাবে অ-সু-স্থ ভাবে। রাতভর ঘুম এলো না চোখে তার। ঠিক ভোরেই কানে এসেছে সেই পুরনো টিয়া দম্পতির কলরব৷ তা শুনে আর বিছানায় থাকতে পারেনি মৈত্রী। সে এলোমেলো হয়েই বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা সময় তারপরই চোখের কোণে স্পষ্ট হয় নিচ তলার বেলকোনিতে মানুষটা। না চাইতেও ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মৈত্রী। কয়েক সেকেন্ড তারপরই ওপাশের মানুষটি কেমন ফ্যাকাশে হাসলো আবার প্রশ্নও করলো, কি হয়েছে?
আকস্মিক এমন প্রশ্নে জবাব দিতেও ভুলে গেছে মৈত্রী। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তা দেখে ইরশাদই বোকা বনে গেল। চারপাশে কুয়াশার মেঘের মতন ভেসে বেড়ানো, আর বাতাসে কাঁ-টা-র মত শীত গায়ে বাঁধছিল। নতুন সকাল, নতুন সম্পর্কের উদ্বোধন তাদের এমনই হতচকিত করে হলো।উহুম, উদ্বোধন শব্দটা বোধহয় ঠিকঠাক হলো না। নতুন সূচনা বললেই বেশ লাগবে। মৈত্রী বিনা জবাবেই বেলকোনি ছেড়ে চলে গেল। ইরশাদ তখনও বোকার মত তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। নোরা আবারও ঘুমাবে বলে রুমে ঢুকেও তার ঘুমও হলো না। সে টি শার্ট আর লেগিংসের ওপরই শাল জড়িয়ে এলো ইরশাদের ঘরে। দরজা খোলা, বিছানা খালি দেখেই সে বুঝতে পারলো ব্রো বেলকোনিতে আছে৷
“রাতটা সবে পার হয়েছে ব্রো এখনই নজর ফেলে বসে আছো?”
পেছনে ফিরে ইরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো নোরার দিকে। মুখ গম্ভীর করে বলল, “এদিকে আয় বোন তোকেই তো খুঁজছিলাম। সত্যি করে বলতো এমন মগজ ধোলাই কেন করলি?”
নোরা থতমত খেয়ে গেছে এই প্রশ্নে। এত কাঁচা কাজ সে আগে কখনো করেনি। সাইকোলজির পড়াশোনায় তার প্রশংসায় বরাবরই পঞ্চমুখ তার প্রফেসররা। তার এডুকেশন শেষ না হতেই সে অনেকরকম প্রয়াকটিসিংয়ে জড়িয়ে ছিল। এবারও দেশে আসার আগে তার প্রফেসর হেনরির এক পেশেন্টের সামনে বসে সে কিছু ট্রিকস ট্রাই করেছিল অবশ্যই তা প্রফেসরের অনুমতি সাপেক্ষে ছিল কিন্তু সেখানে তার যথেষ্ট উন্নতি দেখেছে হেনরি। এরপরও কয়েকটা ডিপ্রেশনের পেশেন্টকে ডিল করেছিল। তবে এমন মগজ ধোলাই ব্যপারটা সে দেশে এসেই প্রথম করলো ইরশাদের৷ শাদ ব্রো’র ডি-প্রে-শন নেই এখন তবে সে মানসিকভাবে কোন সম্পর্কে জড়ানোর জন্যও প্রস্তুত ছিলো না। নোরা কথা বলেছিল প্রফেসরের সাথে তিনি সব শুনে বলেছিলেন, “তোমাকে দুজন মানুষের ভেতরকার নিস্তব্ধতাকে কথার জালেই বের করে আনতে হবে। দুজনের সমস্যা এক নয় তোমাকে প্রতি স্টেপ খুব ভেবে চিন্তে নিতে হবে।”
নোরা তাই করেছে; শুধুমাত্র কথাতেই বের করেছে মৈত্রীর অনুভূতিদের কিন্তু ইরশাদকে নিয়ে তার পরিশ্রম হয়নি একটুও। শুধু ভগ্ন হৃদয়কে একটু খুঁ-চি-য়ে দিতে হয়েছে এই যা! তারপরের উপলব্ধি ইরশাদের নিজের ছিল। সে নিজের মত মৈত্রীর কষ্ট হয়তো উপলব্ধি করেই আকস্মিক এমন সিদ্ধান্ত নিলো। ইরশাদ নোরার জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে থেকেও জবাব না পেয়ে আবার ডাকলো, “কি হলো?”
“ভাবছি।”
“কি ভাবছো?”
“মৈত্রী কতোটা লাকি!”
“সিরিয়াসলি! মৈত্রী লাকি?”
“অফ কোর্স ব্রো। শি ইজ আ লাকি গার্ল এন্ড ইউ অলসো লাকি ম্যান টু।”
“কিভাবে!”
“সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে গেছে আর তুমি তাকে পেয়েছো যে তোমাকে ভালোবাসে।”
ইরশাদ শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। এবার সে নিজেও ভাবনায় ডুব দিলো। কোন এক মহেন্দ্রক্ষণে সায়রা এমনই তো বলেছিল, আপন তাকে করো যে তোমাকে ভালোবাসে তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে নয়।” কথাটা সায়রা যেমন বলেছিলো ঠিক তাই তো করেছে সে করেছে। উফ, প্রতিটি ক্ষণ কেন তাকেই মনে পড়তে হবে! অ-স-হ্যবোধ লাগছে এখন ইরশাদের নিজেরই৷ খিচুড়ি কতটুকু হলো চেক করার বাহানায় নিজের অভিব্যক্তি লুকাতেই চলে গেল ইরশাদ। নোরাও আন্দাজ করলো ভাইয়ের অবস্থা সেও চুপচাপ চলে গেল। আবারও কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়৷ চোখ বুঁজে লম্বা করে শ্বাস টেনে নিলো সে। যেন নিঃশ্বাসে ময়ূখের গায়ের ঘ্রাণকেও টেনে নিচ্ছে নিজের ভেতর। আজ প্রায় বারো দিন তার এ বাড়িতে অবস্থান। প্রথম রাতটা শুধু তারা ইরশাদের ঘরে ঘুমিয়েছিল তারপর থেকে সে এ ঘরে। এ বিছানা, বালাপোশ সবটাতেই যেন ময়ূখ মিশে আছে। নোরার জীবনে প্রেমিক পুরুষ তো কম আসেনি অথচ এই একটা পুরুষ তাকে আমূল বদলে দিয়েছে। বছর খানেক আগেও সে এসেছিল তখন থেকেই না ময়ূখ নামের ঝড় তাকে উথাল-পাতাল করে দিয়েছে৷ তার ব্রিটিশ মনকে কখন যে বাঙালিয়ানায় এক্সচেঞ্জ হয়ে এসেছে তা টের পায়নি নোরা। অথচ যখন বুঝলো নিজের মনের তোলপাড় তখন থেকেই তো কোন রাখঢাক ছাড়া সে কতবার বলেছে ময়ূখকে সে কথা। কিন্তু ছেলেটা সে কথাকে কানেই তোলেনি উল্টো হাসি ঠাট্টায় উড়িয়ে দিয়েছে। নোরা সেসব ভাবতে ভাবতেই আবারও ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুলের জন্য চলে গিয়েছিলো মেহের। দুপুরে বাড়ি এসে ময়ূখের সাথে দেখা হয়নি। বিকেলে যখন মেহের ছাঁদে থাকা দোলনায় বসে দুলে দুলে পড়ছিলো তখন জরিনা খালা তার জন্য পাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলো। কথায় কথায় সে জানিয়ে দিলো, “ইরশাদ মামার তো বিয়া ঠিক হইছে মেহের। আফায় নাকি এইবার ঢাহা(ঢাকা) আইবো। ছোট ভাইজানের লগেও মীমাংসা হইবো এইবার আমার মন কয়।”
“কি বললেন জরিনা খালা।”
মেহেরের হাত ফসকে বই পড়ে গেল। পা দিয়ে দোলনার দুলুনি থামিয়ে সে বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো জবাবের আশায়।ময়ূখ সবে বাড়ি ফিরেছে বাইরে থেকে। মেহেরকে খুঁজতে খুঁজতেই সে ছাঁদে এসেছিলো। জরিনার বলা কথা শুনতেই আত-ঙ্কিত বোধ করলো। মেহের যে অনেক আগেই তাকে জানিয়েছিল নিজের আবেগি মনের ভাবনা। ইরশাদ ভাইয়ের প্রতি তার বোনের কিশোরী ভাবনা কতোটা যে প্রকট তা ময়ূখের অজানা নয়। সে ইচ্ছে করেই দুপুরে বাড়ি ফেরেনি, বাবাকেও জানায়নি ভাইয়ের বাগদান সম্পর্কে। নিজেকেও তো সময় দেওয়ার ছিলো তার।
“জরিনা খালা আপনি নিচে যান তো।”
ময়ূখকে দেখেই জরিনা ছাঁদ থেকে নেমে গেল। ময়ূখ বোনের পাশে এসে দোলনায় বসে মাথায় হাত রাখলো। তার আবেগ নিয়ে কথা শুরু করার আগে সে কিছুক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে চাইলো। মেহের সুযোগ দিলো না উল্টো ভাইয়ের এক হাত জড়িয়ে কেঁ-দে ফেলল শব্দ করে। ময়ূখ ভাবছে কি বলবে সে? মেহের কি বলবে কিন্তু না মেহের কাঁদলো তো অনেকটা সময় কিন্তু কিছু বলল না। রাতে খাবার টেবিলেও পেলো না তাকে কেউ। অনেক রাত পর্যন্ত ময়ূখ পায়চারী করলো নিজের ঘরে৷ সে প্রাপ্তবয়স্ক অল্পতেই অনুভূতির করা-ঘাতে ভেঙে পড়বে না কিন্তু মেহের! চিন্তিত হলো ময়ূখ এবার। ঘর থেকে বেরিয়ে বোনকে একবার দেখার জন্য এগিয়ে গেল তার ঘরের কাছে। দরজায় নক করার জন্য হাত তুলতেই দেখলো ভেতরে বাতি জ্বলছে।
“মেহের ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
কোন জবাব এলো না। ময়ূখ আরও কয়েকবার ডাকলো জবাব পেলো না। বাতি জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো তখনই কানে গো-ঙা-নির আওয়াজ এলো। অবচেতন মন তাকে ঋ-ণা-ত্মক সংকেত দিতেই আ-ত-ঙ্কে দরজায় ধা-ক্কা-তে লাগলো ময়ূখ।
চলবে
#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব- ২০
আংটি পরানোর পাঁচ দিন পেরিয়ে গেছে। বিয়ে নিয়ে কোন আলোচনাতেই আসেনি ইরিন আর ফখরুল তা নিয়ে বড় চি-ন্তি-ত মুজিব। যতোই হোক মেয়ের বাবা হয়ে তার পক্ষে তো আর বিয়ে নিয়ে কথা শুরু করাটা শোভনীয় লাগে না। এদিকে মৈত্রীর মামী ফিরে গিয়ে কিসব বলেছে কে জানে তার মামা ফোন করে যা নয় তা শুনিয়েছে। মুজিব সাহেব তাতে ভ্রুক্ষেপহীন কিন্তু টেনশন তো এখন ছেলে পক্ষের নির্লিপ্ততা। যতই হোক বন্ধুর ছেলে বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষ মানেই একটু উঁচু স্তরে থাকবে এটাই বোধহয় আমাদের দেশের রীতি। এমনটাই তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু রোকসানা একটু অন্য ধাচের। সে দু দিন ধরেই মুজিবকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে নিজে থেকে কথা বলতে। যত জড়তা মুজিবের মাঝেই সেক্ষেত্রে রোকসানাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে পাটছে না৷ তার বরাবরই সৎ মা হওয়ার দো-ষা-রোপ পাওয়ার ভয়। পাঁচ দিনের মাঝে একদিন ইরশাদ এসেছিলো তবে সেটাও নিজের কথা বলতে। ছেলেটা কি কখনো প্রেম টেম করেনি নাকি বুঝে পায় না রোকসানা৷ একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে এসে তার বাগদত্তা ফোন নম্বর চাইতে পারতো, মেয়েটির সাথে বাইরে যেতে কিংবা ঘরেই আলাদা কথার অনুমতি চাইতে পারতো তা না করে এসে বলল, “আন্টি আমি আজ রাতে সিলেট যাচ্ছি তিন দিনের জন্য মৈত্রীকে জানাবেন।”
রোকসানা হা করে তাকিয়েছিল আর ভাবছিলো এখনই কাঁচুমাচু করে বলবে, “মৈত্রীর সাথে কথা আছে কিংবা আন্টি ওর ফোন নম্বরটা দিন৷ তা না হাভাতের মত ওইটুকু বলেই চলে গেল৷ এটুকুই বলার কি দরকার ছিল তার! কিন্তু আজ বিকেলে মৈত্রী, নোরা আর শেলি যখন ফুচকা খেতে গেল তখন ইরিন বলেছিল সন্ধ্যের আগেই যেন ফেরা হয়। কথাটা কার উদ্দেশ্যে বিশেষ ছিলো কেউ বুঝতে পারেনি৷ এখন বাড়ি ফিরে অবধি ঘটে বসে আছে মেয়েটা। রোকসানা দু কাপ চা নিয়ে মৈত্রীর ঘরে গেলেন। উনাকে দেখতেই বিছানায় আধশোয়া মৈত্রী সোজা হয়ে বসলো৷
” চায়ের জন্য আমাকে ডাকলেই হতো।”
নিচু শব্দে বলল মৈত্রী। রোকসানা একবার ভালো করে তাকে দেখে বললেন, “কথা ছিল তাই নিজেই এসেছি।”
“জ্বী!”
“ইরশাদের সাথে কথা হয় তোমার?”
প্রশ্ন শুনে সরাসরি তাকালো মৈত্রী। তারপর নিঃশব্দে মাতা নাড়লো ‘না’ তার কথা হয় না। রোকসানা আবার বললেন,
“তার ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে?”
“জ্বী, নোরা সেভ করেছিলো।”
নোরা আর মৈত্রীর সম্পর্ক এখন অনেকটা প্রিয় বন্ধুর মত। দুজনে গল্প হয় কিছু, আড্ডায় বসে নোরা কত কি বলে আর মুখচোরা মৈত্রী তা বিনাবাক্যে শুনে যায়। রোকসানাও তাই এখন ভেবে নিয়েছেন নোরাকে দিয়েই করাতে হবে কাজটা৷ তিনি মৈত্রীকে বললেন, “সবসময় চুপ থাকতে নেই। কখনও কখনও প্রয়োজন বুঝে মুখ খুলতে হয়। সেদিন যেমন ইরশাদকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মুখ খুলেছিলে এখন আবার খুলবে তবে এবার তাকে দ্রুত নিজের করে পাওয়ার জন্য, বুঝলে! অনেকের মত ভেবোনা মামনি তোমাকে কু-বু-দ্ধি দিচ্ছে। অবশ্যই এটা তোমার এবং নতুন সম্পর্কটার জন্য জরুরি।”
রোকসানা কথা শেষ করে চায়ে চুমুক দিলেন৷ মৈত্রীও চুমুক দিলো চায়ে কিন্তু তার মস্তিষ্ক ব্যস্ত রইলো রোকসানার কথার অর্থ বুঝতে। রোকসানা ঘর ছেড়ে যেতেই দেখলো নোরা এসেছে। নোরার হাতে ছোট্ট বক্স সে এগিয়ে দিলো রোকসানার দিকে।
“এটা কি?”
“ফুপি নাড়ু বানিয়েছিল ময়ূখের জন্য তাই মৈত্রী, মিশুর জন্যও পাঠালো।”
ইরিন ভাবী পাঠিয়েছে! তারমানে কি তার মনের মেঘ বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! রোকসানা বক্স হাতে নিয়ে নোরাকে প্রশ্ন করলো, ময়ূখ কবে আসবে? সে তো ভাইয়ের এনগেজমেন্ট দেখতে পেলো না
“ওর তো এ সপ্তাহেই পরীক্ষা আর ফুপি, আমি, ফুপা তিনজনেই আগামী পরশু যাব ঢাকায় তখন একসাথে ফিরব।”
“ওহ আচ্ছা! আর ইরশাদ কবে ফিরছে?”
“আন্টি ব্রো আজ রাতের বাসে ফিরছে।”
“ওহ! আচ্ছা নোরা একটা কথা বলার ছিল তোমাকে। আমি শ্বাশুড়ি টাইপ জড়তা নিতে পারছি না তাই খোলাখুলিই বলি বোসো একটু সোফায়।”
নোরা কৌতূহলী হয়ে তাকালো রোকসানার দিকে। এই মহিলা এতোটা রহস্যময়ী ইঙ্গিতে আগে কখনো কথা বলেনি। সে বসলো সোফায় পাশেই বসলো রোকসানা। মৈত্রীর ঘরের দরজায় আগে নজর ফেলে দেখলো সে এদিকে আসে কিনা তারপর বলল, “তোমার ফুপি কি মৈত্রীকে পছন্দ করছেন না? দেখো এখনো তাদের কিন্তু বিয়ে হয়নি। পরিবারের মানুষগুলোর খুশির বিরুদ্ধে সম্পর্ক তৈরি মানেই নানারকম জটিলতা অবশেষে কোন একটা সম্পর্কের বা-জে পরিণতি। তাই আমি সরাসরিই জানতে চাইলাম।”
“আপনার এমন কেন মনে হলো আন্টি।”
“ইরিন ভাবীর সেদিনের পর থেকে গম্ভীর হয়ে যাওয়া দেখে।”
“আসলে আন্টি, ফুপি একটু শকড আছে তাই। এই যে এখন স্বাভাবিক হতেই এটা দিয়ে পাঠালো। আর ঢাকায় তো ফুপির ইচ্ছেতেই যাচ্ছি আমরা। ফুপি তার ছেলের বউয়ের জন্য কেনাকাটা করবে বলে ঠিক করেছেন। ইউ নো শি ইজ ভেরি এক্সাইটেড ফর দিস ওয়েডিং। এন্ড… ” মুখ ফসকে বলেই দিচ্ছিলো প্রায় তাদের পারিবারিক যে ঝা-মে-লা সেটাও এবার মি-টি-য়ে নিবে তারা।
“আর কি!”
“আর ব্রো কে বলেছে মৈত্রীকেও চাইলে আমাদের সাথে নিবে।” সম্পূর্ণ কথাটাকেই বদলে দিলো নোরা। রোকসানাও বুঝতে পারলেন না এক মিথ্যের আড়ালো কোন সত্যি ঢাকা পড়লো। তিনি মনে মনে স্বস্তি পেলেন তাই এবার অন্য কথায় এলেন, “মৈত্রীর ফোনে ইরশাদের নাম্বার না দিয়ে ইরশাদকে মৈত্রীর ফোন নম্বর দিলেই বেশি ভালো করতে নোরা।”
“কেন আন্টি?”
“মৈত্রী কখনোই নিজে কল দিবে না ছেলেটাকে।”
“ওহ ইয়েস, ডোন্ট ওয়্যারি আন্টি আই হ্যাভ সল্যুশন।” নোরা চোখ টিপে চলে গেল মৈত্রীর ঘরের দিকে।
রাতের তখন সাড়ে এগারোটা৷ ময়ূখ নেই বলেই হয়তো ফ্ল্যাট জুড়ে নীরবতারা আসন গেঁড়েছে পাকাপোক্ত ভাবে। ফখরুল সাহেবই বিছানায় যেতে যেতে একটু মুখ খুললেন, “ইরিন শোনো।”
“বলো।”
“আমি ভাবছি কাল বাড়ি যাব… মানে আমাদের বাড়িতে যাব। বড় ভাইকে ফোন করেছিলাম কাল তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।”
“ওহ!”
বেজায় নি-র্লি-প্ত ইরিনের আচরণ৷ ফখরুল সাহেবের মোটেই ভালো লাগলো না ব্যাপারটা। তিনি প্রশ্ন করলেন, “ওহ কেন?”
“এমনি।”
” আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল ছেলের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। ঠিক পাঁচ দিয়ে ধরেই দেখছি তুমি চুপ হয়ে গেছো। আমাকে কি বলবে সমস্যাটা কোথায়? তুমি তো মৈত্রীকে খুব ভালোবাসতে তবে এখন এমন করছো কেন?”
মনের ভেতর জমে থাকা প্রশ্ন আজ উগড়েই দিলেন ফখরুল সাহেব। ইরিনও বুঝতে পারলো তার এভাবে কথাবার্তা চে-পে রাখাটা সবাইকেই কৌতূহলী করছে। এমনটা তো তার স্বভাবে নেই একদমই৷ স্বামীর প্রশ্নের মুখে তিনিও মুখ খুললেন, “মৈত্রীকে আমি এখনও ভালোবাসি খুব কিন্তু ভেবে দেখো তো মৈত্রীর স্বভাব, আচরণ। তারপর ভাবো আমার ইরশাদটার স্বভাব৷ সে এবং মৈত্রী অনেকটাই একইরকম। ইরশাদ একটা ধা-ক্কা খেয়ে এমন হয়েছে আর মৈত্রী নাকি ছোট থেকেই এমন। সব জেনে আমি কি করে খুশি হবো ছেলের সিদ্ধান্তে! মৈত্রীকে আমি যতটুকু ভালোবাসি সবটাই তার প্রতি সহানুভূতি কিন্তু সহানুভূতি দিতে গিয়ে এমন মেয়েকে ছেলের বউ করার কথা আমি কল্পনাও করি না৷” একনাগাড়ে মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা যেন সবটাই বলে দিলো ইরিন। ইরশাদের বাবাও বুঝতে পারলেন স্ত্রীর ভাবনা কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি স্ত্রীর কথার বি-রো-ধীতা করে বললেন, “জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এ তিনটা তো সম্পূর্ণ আল্লহর হাতে। তিনি ভাগ্যের সকল কাজে মনুষ্য জাতির চেষ্টার ওপর বদলে দিলেও এই তিনটি জিনিস কখনোই বদলাননা। এ তিন নিয়ে মানুষ কিছুই করতে পারে না। উপর থেকেই তো ঠিক হয়ে আসে এই জোড়াবন্ধন।”( আমার লেখায় কোন কিছু ভুল থাকলে অবশ্যই কমেন্টে জানিয়ে দিবেন।)
ইরিন দমে গেলেন এবার। সত্যিই তো বিয়ে তো তাদের হাতে নেই৷ গত পাঁচ বছরে কত চেষ্টাই না করলেন বিয়ে তো দূর ছেলে পাত্রী দেখা নিয়েও কত টালবাহানা করতো। আর সেদিন হুট করেই কি থেকে কি হলো সোজা আংটি পরিয়ে দিলো। অথচ ইরিন শতভাগ শিওর মৈত্রী -ইরশাদের মাঝে কখনোই প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল না। স্বামী-স্ত্রী তে আরও কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা হলো। ইরিনও ভেতর থেকে হালকা বোধ করলেন। পরদিন সকালে হুট করেই বলে বসলেন, ” আজই রওনা দেব ঢাকায়।”
ইরশাদ মাত্রই ফিরেছে সিলেট থেকে। পোশাক বদলে সে গোসল সেরে সোজা ডাইনিংয়ে এসেছিলো নাশতার উদ্দেশ্যে। ফখরুল সাহেবও তৈরি হয়ে নাশতায় বসেছেন। আজ তিনি নিজেদের বাড়িতে যাবেন বলেছেন । ইরিনের কথা শুনে ইরশাদ আর তার বাবা দুজনেই অবাক হলো খুব। ইরশাদ কিছু বলার আগেই ইরিন বলল, মৈত্রীকে বলিস তোর জন্য খাবার পাঠাতে কাল থেকে দু দিন।”
“কেন!” বাবা-ছেলে একত্রেই বিষ্ময়ে প্রশ্ন করলো।
ইরিন মিটিমিটি হেসে বলল, “হবু শ্বশুরবাড়ির আপ্যায়ন নিবি দুদিন। আমরা একদম বিয়ের শপিং সেরেই ফিরব।”
ইরশাদ খাওয়া রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এত তাড়া কিসের! সে তো এখনও দ্বন্দে নিজের করা কাজ নিয়ে। মৈত্রীর সাথে তার মানসিক মিলটা কি আদৌও হয়ে উঠবে! নোরা ঘুম থেকে উঠতেই শুনলো তারা আজই ঢাকায় যাবে। সারা দিনে নোরা অল্পস্বল্প গোছগাছ করেই গেল মৈত্রীর কাছে। তারা বিয়ের শপিং করতে যাচ্ছে তাই মৈত্রীর কাছে জানতে চাইলো বিয়ের জন্য তার কি চাই, শাড়ি-লেহেঙ্গা! মৈত্রী ভেবেই পেলো না সে কি চায় তাই ছোট্ট করে বলল, “তোমাদের যা ইচ্ছে।”
“আমাদের নাকি শাদ ব্রো’র!” ভ্রু উঁচিয়ে রসিকতা করলো নোরা। মৈত্রী সে কথাতেও প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। শুধু মনে মনে বলল, “ইরশাদ যা চায় তাই হোক।”
রাত দশটার বাসে রওনা দিলো ইরিন, ফখরুল আর নোরা। বাড়িতে ইরশাদ একা; সে পুরো ঘরে ভালো করে দেখে দরজা -জানালা সব লক করে নিলো। আম্মু রাতের রান্না আগেই করে রেখেছে বলে ইরশাদকে আর রান্নার ঝা-মে-লা করতে হবে না এমন ভেবেই সে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো ড্রয়িং রুমেই। ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজতে চলল ইরশাদ ইমেইল চেক করে কফি বানাতে উঠে পড়লো। গ্যাস চালু করার সেকেন্ড দুই পরই কানে এলো কলিং বেল এর আওয়াজ৷ সে চলে গেল দরজার কাছে। কি হোলে দেখলো মিশু আর শেলি দাঁড়িয়ে। সে দরজা খুলতেই শেলি কাঁপা হাতে ঢাকনাসহ বাটি এগিয়ে দিলো একটা। মিশুর হাতেও ছিলো একটা বক্স। সেও ইরশাদকে এগিয়ে দিলো বক্সটা।
“এগুলো কি?”
“রাতের খাবার। আম্মু পাঠিয়েছে ভাইয়া।”
মিশু বলল।
“কিন্তু আমার তো ঘরে অনেক খাবার আছে এগুলো কি করে খাব।”
“তবুও এইগুলান রাখতে হইবো দুলাভাই।” অস্পষ্ট স্বরে বলল শেলি। ইরশাদ হাত বাড়িয়ে বক্সগুলো নিলো সাথে ধন্যবাদও দিলো তাদের৷ ইরশাদ বক্স, বাটি নিতেই শেলি হুড়মুড় করে পা-লি-য়ে গেল এক প্রকারে৷ ঘরে ঢুকে খাবার দেখতো দেখতেই তার ফোন বেজে উঠলো। নোরা কল দিয়েছে; রিসিভ করে কানে দিতেই নোরা বলল, “ব্রো, প্রেমটা এবার করেই ফেলো। মৈত্রীর ফোন নম্বর পাঠাচ্ছি আজ রাত আর ঘুমানোর দরকার নেই।”
খাবারের দিকে একবার, একবার ফোনের দিকে তাকালো ইরশাদ। নোরা সত্যিই পাঠিয়েছে মৈত্রীর ফোন নম্বর। সে কল দিলো মৈত্রীকে৷ প্রথম দফাতেই রিসিভ হলো তবে জবাব এলো না সেদিক থেকে৷ ইরশাদ নিজেই মুখ খুলল, “এত খাবার কেন পাঠিয়েছো? ঘরে আগে থেকেই অনেক খাবার আছে।”
“মামনি পাঠিয়েছে।”
ইরশাদ ভেবেছিলো মেয়েটি সহজভাবে কথার জবাব দেবে না। কিন্তু না তেমন হয়নি৷ সে আবারও বলল, ” তুমি তো আটকাওনি।”
“খাবার মামনি দিচ্ছিলো আমি কি করে আটকাবো?”
“তা ঠিক৷ কি করছো?”
” জ্বী! কিছু না।”
“কিছু না কেন?”
“এমনিতেই।”
“এমনিতেই কেন?”
“জানি না।”
“কেন জানো না?”
“আজব!” বড্ড অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল মৈত্রী।
“কি বললে?”
“কিছু না।”
“কিছু বলা উচিত।”
মেহেরের হাতের অবস্থা শোচনীয়। মেহের অ-স্থির চিত্তে বারংবার ইরশাদের কথাই বলে চলছে। ময়ূখের মনে হলো একমাত্র ইরশাদের সাথে কথা বলেই মেহের স্থির হবে। সে দ্রুত ফোনটা নিয়ে ইরশাদকে কল দিলো। কিন্তু একি এতরাতেও ভাইয়ের নম্বর ব্যস্ত! ময়ূখ পরপর তিন চারবার কল দিলো লাভ হলো না। প্রতিবারই যান্ত্রিক শব্দ বলে চলল নাম্বারটি ব্যস্ত।
চলবে