কি ছিলে আমার পর্ব-১৬+১৭

0
1891

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৬(১ম অংশ)

নোরা ফুপির বাড়িতে আছে আজ পাঁচদিন হয়ে গেল। নোরা থাকবে বলে ময়ূখের ঘরটা তাকে ছা-ড়-তে হলো। মনে মনে এ নিয়ে ভীষণ বি-র-ক্ত সে৷ আর তা হবে নাই-বা কেন! ইরশাদ নিজের ঘর দিতে চাইলে নোরা বলল তার ছোট ঘরটা পছন্দ হয়েছে। ময়ূখের মনে হলো নোরা ইচ্ছে করেই তার ঘরটা কব্জা করল কিন্তু আম্মা সেসবে কান না দিয়ে বলে দিলো, “নোরা ময়ূখের ঘরেই থাকবে।”

এহহ্ বলার ধরণে মনে হচ্ছিল নোরা ময়ূখের বউ তার ঘরেই তো থাকবে। অসহ্য! এদিকে ভাইয়ের কি হয়েছে কে জানে রাত বিরেতে বেলকোনির দরজা খুলে রাখে নয়তোবা নিজেই গিয়ে বসে থাকে সেখানে এই শীতের রাতেও। আজ রাতের খাওয়া শেষ হতেই নোরা বায়না ধরলো গান শুনবে। ময়ূখের পড়াশোনায় আজকাল ঢিলেমি হচ্ছে খুব আর তাতেই মনে হচ্ছে বিসিএসটা তার হবে না। সে টিকবে না কিছুতেই এই পড়াশোনা দিয়ে। কিন্তু না বাড়ির সব একসাথে পা-গ-ল হয়ে গেছে । তাইতো এখন জোর জবরদস্তি টেনে নিয়ে গেল ছাঁদে। ইরশাদ চুপচাপ বসে বসে নোরা আর মায়ের কান্ড দেখলো সে আগে পরে কিছুই বলবে না তবে একটু গান হলে তার মন্দ লাগবে না। ময়ূখ গিটার হাতে ছাঁদে যেতে লাগল পেছনে নোরা মাদুর হাতে। ইরিন বেগমও পেছনে পেছনে বের হলেন। ইরশাদ বাবাকে বিছানায় যেতে দেখে সে বাবাকে বলে গেল বাইরে থেকে দরজা আটকে যাচ্ছে। ফখরুল সাহেব কম্বল গায়ে টেনে বললেন, “তালা মেরে যা বাইটে থেকে নইলে আবার চোর ঢুকে যেতে পারে।”

ইরশাদও তাই করল। ইরিন দোতলায় গিয়ে মৈত্রীদের কলিংবেল বাজালো। শেলি দরজা খুলতেই তিনি জানতে চাইলেন বাকিরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? শেলি বলল এখনও সবাই বসার ঘরে। তখনই ভেতর থেকে রোকসানা জিজ্ঞেস করলেন, কে এলো রে শেলি?

” ইরশাদ ভাইয়ের আম্মা আইছে।”

“ওহ, ভাবী ভেতরে আসেন?” রোকসানা কথাটা বলতে বলতেই বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পেছনে মৈত্রী আর মিশুও এসেছে। ইরিন হাসি মুখে বললেন, “না ভাবী এখন ভেতরে আসবো না আসলে ছেলে মেয়েগুলো গান টান করবে বলছে কিন্তু রাত তো প্রায় নয়টা বেজে গেছে তাই ভাবলাম আপনাকে একটু জানিয়ে নেই আগে।”

“ওহ করুক ভাবী স-ম-স্যা নেই এমনিতেও ছাঁদের আওয়াজ নিচে ফ্ল্যাটে আসে না। আর এখন তো শীত দরজা -জানালা সবই লক করা করুক ওরা৷”

“ইরশাদ ভাইয়ারা ছাঁদে বসছে সবাই? আমরাও যাই মৈত্রী আপা যাইবেন?” শেলি উৎসুক হয়ে কথাটা বলেই পেছনে মৈত্রীর দিকে তাকালো৷ এবার রোকসানা আর ইরিনও তাকিয়েছে তার দিকে সেই সাথে ইরিন বললেন, “হ্যাঁ যেতে পারো তো তোমরাও নোরা আমার ভাতিজিও আছে সেখানে।”

কেউ খেয়াল না করলেও রোকসানা খেয়াল করেছেন মৈত্রীর চোখ মুখের ভাব কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে শেলির কথাতে। এই প্রথম বোধহয় মেয়েটার মুখের রঙ একটুখানি ভিন্ন দেখলো সে। হঠাৎ মনের ভেতর কিছু একটা খামচে ধরলো। সেও তৎক্ষনাৎ বলে বসলো, “হু যাও ভাবীর সাথে একটুখানি বসো হয়তো ভালো লাগবে। এমনিতেও আজ সন্ধ্যে থেকে পড়ার মধ্যে ডুবে আছো এখন বাইরের আবহাওয়া একটু ভালোই লাগবে।”

মৈত্রী মনে মনে অবাক হলো ভীষণ। মামনি আজ তাকে অনেকগুলো কথা বলল না! এমন তো কখনো হয় না তার সাথে। দু জনেই দু এক শব্দে কথা শেষ করে বসে।

ইরিনও তাড়া দিলেন “চলো আমি নিয়ে যাই তোমাদের।”

শেলি তো এক কথাতেই প্রস্তুত আছে। তার কেরাশ আছে সেখানে না গেলে কি করে হবে কিন্তু মৈত্রী একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, না আন্টি ওনারা কাজিনস একসাথে বসেছেন সেখানে আমরা!”

“কিচ্ছু হবে না বরং নোরা খুশি হবে। এমনিতেও সে ঘরে একা থাকে সারাক্ষণ তাই তোমার সাথে আলাপ হলেই ভালো হয়।”

ইরিন আর শেলির জোরাজুরিতে মৈত্রী ঘর থেকে শাল নিয়ে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল। ছাঁদের শেষ সিঁড়িতে পা রেখেই কানে এলো গিটারে টুং টাং আওয়াজ। মনে হচ্ছে গান এখনো শুরু হয়নি। ইরিন ছাঁদে উঠেই নোরার উদ্দেশ্যে বললেন, পরিচয় কি আমি করিয়ে দেব না নিজেরাই হতে পারবে?

ফুপির কথায় ময়ূখের থেকে নজর সরিয়ে নোরা চাইলো মৈত্রী আর শেলির দিকে। মৈত্রীকে দেখতেই সে বুঝে নিলো এটাই সেই বেলকোনির মেয়েটি। কি মনে করে নোরা একবার তাকালো তার পাশে বসা ইরশাদের দিকে তারপর আচমকাই সরে গিয়ে মৈত্রীকে ইশারা করে বলল, “এখানে এসে বসো পরিচিত হই। ফুপি আমরা নিজেরাই পরিচিত হতে পারব।”

ইরিন বললেন, “বেশ ভালো তবে হও পরিচিত৷ আমি নিচে গেলাম ওদিকে তোমার ফুপা ঘরে ঘুমাচ্ছেন দরজা বন্ধ বাইরে থেকে৷ ইরশাদ চাবিটা দে তো!”

ইরশাদ মায়ের দিকে চাবিটা এগিয়ে দিলো। ছাঁদে আলো বলতে চিলেকোঠা থেকে ভেসে আসা হলদে অনুজ্জ্বল আলোটুকুই ভরসা৷ সেই আধ অন্ধকার, আধ আলোতেই ইরশাদের চোখ পড়েছে মৈত্রীর মুখে। শাল পেঁচানো মাথা থেকেই তবুও শালের ফাঁকে সামনের দিকে উঁকি মে-রে আছে একগাছি ছোটো ছোটো চুল। নিষ্প্রভ চোখ দুটোতে নীরবতার গহীন বন। শীতের নিস্তব্ধ হাওয়ার মত মৈত্রীর চোখের দৃষ্টিও নিস্তব্ধতায় ঘেরা। গিটারের বেজে ওঠা সুরের মত স্নিগ্ধ হয়ে আছে মেয়েটির মুখ। ইরশাদের আবারও মনে পড়লো সে মৈত্রীকে নিয়ে ভুল ভাল ভাবছে৷ নোরা কথাগুলো এত গভীরভাবে ম-স্তি-ষ্কে ঢুকিয়ে নেওয়া ঠিক হয়নি৷ জীবনে প্রথম ভু-লের কথাও মনে পড়ে গেল তার এখনই৷ সে নিজেকে সংযত করে ময়ূখের গানে ডু-বে যেতে চাইলো সম্পূর্ণভাবে। নোরা তার চৌকস বুদ্ধিমত্তার দরুণ নজর রাখছে দু দিকেই। ইরশাদের মনোভাব সে অনায়েসেই বুঝে গেল কিন্তু মৈত্রীর সাথে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হলো না। মেয়েটি খুবই কম কথা বলে এবং মুখে তার কোন কিছুতেই প্রতিক্রিয়া শো হয় না৷ তাদের আলাপ পরিচয় পর্যন্তই রইলো সে রাতে। ময়ূখের গান চলল ঘন্টাখানেক এর পর আর শীতের সাথে জোর দেখিয়ে কেউ রইলো না ছাঁদে। তবে মৈত্রী যাওয়ার সময় নোরাকে ডেকে বলল, “আমাদের ঘরে এসো কখনো সময় করে গল্প করা যাবে।”

ময়ূখ পেছন থেকে বলে বসলো, “শুধু কি নোরাই আমন্ত্রিত নাকি আমরাও আসবো?”

“আসতে পারেন।” এটুকু বলেই মৈত্রী চোখ উঠিয়ে ইরশাদকেও দেখেছিল একবার। কিন্তু ইরশাদ ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে গেছে। সেই গান আড্ডার রাতের পর কেটে গেছে আরও দুদিন। মৈত্রীর সাথে ইরশাদের আর দেখা হয়নি তবে মৈত্রী তাকে দেখেছে বেলকোনি থেকে। কাল শেলি এসে বলেছিলো, “মৈত্রী আপা দেখছেন ওই বিদেশীডারে! সারাদিন খালি আমার কেরাশের বারিন্দায় খাড়ায়া থাকে। আমার না এট্টুও ভাল্লাগে না তারে ওইখানে দেখতে। মেজাসটা এক্কেরে খা-রা-প হইয়া যায়।” বলতে বলতে শেলি কেমন মুখটাকে একদম রু-ক্ষ আর উ-দা-স করে নিল। তা দেখে মৈত্রী মনে মনে বলল, “আর যদি ওই বিদেশীর জায়গায় আমি থাকতাম তখন কি আমায় দেখেও তোর মেজাজ খা-রা-প হতো শেলি!” পরক্ষণেই মনে হলো, এসব কেন ভাবে সে? ইরশাদকে নিয়ে এত ভেবে ভেবে নিজেকে অ-স্থির করা বড্ড ভুল হচ্ছে তার। এমন বো-কা-মি করাটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না তার।

নোরার সাথে মৈত্রীর ভাব হয়েছে কিছুটা। তারা এখন রোজ টুকটাক গল্প করে একসাথে বসে। তবে নোরা গল্প করার নামে প্রায়ই বসে বসে শাদ ব্রো সম্পর্কে এটা সেটা বলতে থাকে মৈত্রীর সামনে। নোরা মূলত ইরশাদ সমন্ধে মৈত্রীর সাইকোলজি বুঝার চেষ্টাতেই ইরশাদকে নিয়ে গল্প করে৷ আজও বিকেলে এসে বসেছিল মৈত্রীর ঘরে৷ শেলি, মৈত্রী আর নোরা মিলে নারকেল গাছে থাকা টিয়া দম্পতিকে কথা বলছিল। তাদের কথার মাঝেই রোকসানা বেগম এসে ঢুকলেন ঘরে।

” মৈত্রী তোমার বাবা ফোন করেছেন, তোমার মামা একটা বায়ো পাঠিয়েছেন তোমার ইমেইল এড্রেসে। চেক করতে বলেছেন পাত্রের ছবিও আছে সম্ভবত সেটা দেখে তোমার মামাকে কল করতে বলেছে।”

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৬( শেষাংশ)

সিঁড়ি গোড়ায় দাঁড়িয়ে গ-ম্ভী-র মুখ করে আছে নোরা৷ মাত্রই সে নেমে এসেছে মৈত্রীর ঘর থেকে। একটু আগেই মৈত্রীর ইমেইল বক্সে চমৎকার একটি ছেলের বায়ো এসেছে। ছেলেটি খুব ধনবান এক পরিবারের ব্যবসায়ী ছেলে । মানে পৈতৃক সুত্রে ছেলে ধনবান সাথে নিজের যোগ্যতায় সফল ব্যবসায়ীও। নোরা ছবি দেখেছে ছেলের বলা যায় শ’য়ে আশি ছেলেটা। এমন ছেলে যাচ্ছেতাই ভাবে কোন পরিবারই হাতছাড়া করতে চাইবে না। অন্তত মৈত্রীর মত মেয়ের জন্য যে কিনা লাইফটাকে বড় কোন মোড়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেই রাখে না। গড়পরতা বাঙালি সংসারী টাইপ মেয়ের জন্য এমন পাত্রই উপরের সারিতে থাকে। কিন্তু নোরা অনেক চেষ্টা করেছে বোঝার জন্য তখন মৈত্রীর মনে কি চলে। কিন্তু আফসোস মেয়েটি ছিল নির্বিকার অথচ নোরা স্পষ্ট দেখেছিল সে রাতে মৈত্রীর চোখের পরিবর্তনীয় ভাষা। কোথাও না কোথাও তার মৃ-ত দৃষ্টি ইরশাদের খোঁজে ছিল। নোরার মনে হলো মেয়েটি একটু অস্বাভাবিক তাই সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক দু দিনের মধ্যে মৈত্রীকে তার চিরচেনা রূপ থেকে বের করে আনার। কোথাও তো আ-ঘা-ত লাগলেই খোলস পাল্টাবে। লোহাকে পি-টি-য়ে তবেই না ধাতব তৈরি করে! তার মনটাকেও এখন পে-টা-তে হবে সুন্দর একটা রূ-পে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু কি করা যায়! মৈত্রীকে স্ত-ব্ধ হয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ানো দেখে শিপলুর মা ডেকে উঠলো, “আরেহ নোরা এভাবে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো?”

“ওহ নাথিং বৌদি!”

“তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

অরুণিমার হাতে একটা ঢাকনাসহ বাটি। সে নিচ তলায় ইরশাদদের ঘরেই যাচ্ছিলো কাঁচকলার তরকারি নিয়ে। নোরার সাথে তার সখ্যতা হয়েছে দিন কয়েক ধরেই। ময়ূখ খুব দুষ্টুমি করে বৌদি ডাকে নোরাও তা দেখে বৌদি ডাকা শুরু করেছে। অরুণিমা চতুর স্বভাবের হওয়ায় আর নোরা উন্মুক্তমনা হওয়াতেই হয়তোবা সে টের পেয়ে গেছে নোরার মনোভাব। এ কারণেই আরও অনেকটা বেড়ে গেছে তাদের খু-ন-সু-টিময় আচরণ। নোরার একবার মনে হলো বৌদির সাথে কথাটা শেয়ার করলে ভালো হয় কিন্তু নিজের আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে তাকে জানানোটা কি ঠিক হবে! আপাতত মাথা থেকে এই ভাবনা সরিয়ে সে অরুণিমার সাথে পা বাড়ালো ঘরের দিকে। ময়ূখ আজ আবার ঢাকায় যাবে তার বিসিএস পরীক্ষার ডেট পড়ায়। নিজ ঘরে ঢুকে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গোছাতে ব্যস্ত সে। অরুণিমা তরকারির বাটি এগিয়ে দিতেই ইরিন আপত্তি জানিয়ে বললেন, “কি করেছো অরু এত তরকারি কেন এনেছো?”

“মাসিমা আমার শ্বাশুড়ি মা রান্না করেছে। ওই যে সেদিন আপনি এই তরকারির কথা বললেম তাই আজ ইলিশ মাছ দেখে বেশি করে রাঁধলেন। রোকসানা মাসি আপনার জন্য শ্বাশুড়িমা নিজেই আলাদা করে দিলেন এগুলো।”

“তুমি বোসো অরু আমি একটু ময়ূখকে পিঠার বক্সটা দিয়ে দেই ছেলেটা ঢাকা যাচ্ছে আজ।” মেহেরের জন্য দু রকম পিঠা বানিয়ে বক্সে ভরে দিয়েছে ইরিন৷ অরুণিমা খেয়াল করল এখানে আসার পর সে যখন ইরিনের সামনে তখন নোরা চলে গেছে ময়ূখের কামরায়। মেয়েটা যে ওই পা-গ-লা-টে ছেলের প্রেমে পাগল তা সে খুব ভালো করেই বুঝেছে কিন্তু ছেলেটার চোখের দৃষ্টি অন্য কোথাও ধাবমান সেটাও তো দেখেছে সে৷ মনে মনে রবকে ডেকে ময়ূখ, নোরা দুজনেরই মঙ্গল কামনা করে নিলো অরুণিমা। ইরিনের সাথে সেও ঢুকলো ময়ূখের ঘরে। নোরা খাটে বসে গালে হাত রেখে তাকিয়ে আছে ময়ূখের দিকে। আর ময়ূখ তার ছোট্ট ওয়্যারড্রোব থেকে একটা দুটো করে কিছু কাগজ বের করে ফাইলে ভরছে। সেও বোধহয় অ-স্বস্তি বোধ করছে নোরার চাহনিতে। কাগজের দিকে তাকিয়ে থেকেই সে বিরক্তির স্বরে বলে বসল, “এমন হ্যাংলার মত কেন দেখছো? অন্যদিকে তাকাও।”

“কেন? তুমি লজ্জা পাচ্ছো!”

“কে কাকে এত লজ্জা পাচ্ছে ভাই!” অরুণিমা ঘরে ঢোকার সময়ই বলে উঠলো কথাটা। অরুণিমার কথার পর নোরা, ময়ূখ দুজনেই আরও কিছু কথা বলল হাসি ঠাট্টা করে। ময়ূখ আজ বিকেলের বাসেই রওনা হবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।নোরারও খুব করে মন চাইছিলো সেও যায়। হয়তো বললেই ফুপি ময়ূখকে রাজী করিয়ে নিবে কিন্তু এখন চলে গেলে মৈত্রীর মনের খবর কি করে নেবে! তারওপর ফুপি তো শাদ ব্রো’র জন্য কত কাঁদেন লুকিয়ে সে খবর তো তার অজানা নয়। এই ভাড়াটে জীবনেও তো শুধু মাত্র সায়রা আর ব্রো’র ভেতরকার ভগ্নহৃদয়ের জন্যই। কে জানে এই অস্বাভাবিক মেয়েটার সত্যিকার ভালোবাসা লুকিয়ে আছে তার মনে যা চাইলে ব্রোকে তার দূর্বিষহ অতীত থেকে বের করে আনতে সহায়ক হবে। এ কাজটা হয়তো যে কোন নতুন নারীর সঙ্গেই সম্ভব কিন্তু ব্রোকে নতুন কারো দিকে ভিড়িয়ে দেওয়াটাই তো মুশকিল। চোখের সামনে যখন একজনকে পাওয়া গেল এবং ব্রো’র মনে যখন এই মেয়েটির জন্য সহমর্মিতার অনুভূতি তখন না হয় এই মেয়েকেই বেছে নেওয়া যাক। তার সাইলোলজি বলে এখানে কিছু একটা সম্ভব শুধু ময়ূখের ভাষায় তার একটু কূ-টনৈ-তিক বুদ্ধি খাটাতে হবে।

ময়ূখ চলে যেতেই ইরিনের ঘর কেমন খালি খালি হয়ে গেল। আবারও ছেলেটা চার পাঁচ দিন থাকবে না এতে তার মন খা-রা-প থাকবে এ ক’দিন। প্রতিবার তো এমনই হয়। সন্ধ্যার পর ইরশাদ বাড়ি এসে প্রথমেই মুখ হাত ধুয়ে মায়ের কাছে গেল। আজ সারাদিন সে শহর থেকে একটু দূরে এক জায়গায় ছিল। দারুণ একটা চাকরির সন্ধান পেয়েছে সেখানেই ইন্টারভিউ ছিল। যাতায়াতেই তার প্রায় পাঁচ ঘন্টার বেশি লেগে গেছে৷ এখন বাড়ি ফিরে বড্ড ক্লান্ত লাগছিলো কিন্তু এই মুহুর্তে কফি খেলে তা আর থাকবে না৷ এমনটা ভেবেই আগে মাকে জিজ্ঞেস করলো চা, কফি কোনটা খাবে? ইরিনের মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে মাত্রই, নোরাকেও বসিয়েছেন নামাজ শিক্ষা বই হাতে কিছু সূরা শেখার জন্য । ইরশাদের কথা শুনে নোরাই বলল, ব্রো আমি বানাই কফি! ফুপি তুমি কি খাবে?

ইরিন বললেন কফিই খাবেন তিনিও। নোরা তিন মগ কফি করে ফুপির রুমেই নিয়ে এলো। তিনজনে কফি খেতে খেতে টুকটাক গল্প শুরু করতেই নোরা বিয়ের কথা তুলল ইরশাদের। ইরিনও যেন সুযোগ খুঁজছিল এ বিষয়ে কথা বলার। নোরাই বলল, “ব্রো আমি তো মাস দুয়েকের মধ্যেই চলে যাব বিয়েটা করে ফেলো এবার।”

“আমিও তো তাই বলি কিন্তু মেয়ে তো দেখতেই দিচ্ছে না।”
অভিযোগ ছিল যেন ইরিনের কণ্ঠে।

“কে দেখতে দেয় না ফুপি?”

“আর কে এই যে যার বিয়ে করাতে চাই সেই তো দেয় নারে মা। এইতো গত সপ্তাহে তোর ফুপা এক ঘটকের মাধ্যমে সুন্দরী এক মেয়ের খোঁজ দিলো সে দেখতে যেতেই দিলো না। এখনও দেখ আমার ড্রেসিংটেবিল এ খামটাতে ছবি আছে।”

নোরা খেয়াল করে দেখলো ফুপির ড্রেসিংটেবিল এর ওপর একটা খাকি রঙের খাম। সে উঠে সেটা হাতে নিয়ে দেখলো ভেতরে একটা ছবি আর জীবন বৃত্তান্ত। মিনিট দুয়েক খুঁটিয়ে দেখে সে বলে উঠলো, “এই মেয়ের চেয়ে তো তোমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর। কি দেখছো ফুপি তারচেয়ে ভালো মৈত্রীর জন্যই প্রস্তাব পাঠিয়ে দাও।”

নোরার কথা শুনে বদ্ধ ঘরটাতে যেন ব-জ্র-পাত ঘটে গেল। মা ছেলে দুজনেই হ-ক-চ-কি-য়ে গেছে নোরার কথায়। সে রাতে নোরা আরও অনেকবার এ নিয়ে কথা তুলেছিল কিন্তু কোন প্রকার রেসপন্স পায়নি সে। তবে কাজ তার অর্ধেক সে রাতেই হয়ে গিয়েছিল। ইরশাদের ভা-ঙা-চোরা মনে আবারও বেজেছে নতুন করে মৈত্রী নামক ঘন্টা। সে ভেবেছিল নোরার কারসাজিতে তার মস্তিষ্ক ভুলভাল বুঝেছে কিন্তু না আবারও মন নড়েচড়ে বসেছে। মন বলছে ওই মেয়েটার মাঝে কিছু তো আছে! সত্যি বলতে মৈত্রীকে ভালো লাগার মত কিছু না পেলেও মৈত্রীকে জানার কৌতূহল তার গভীর। মৈত্রীর নিস্পন্দতা, মেয়েটার অস্বাভাবিক চাহনি আর তার নির্লিপ্ত আচরণের পেছনের মূল রহস্য জানার আগ্রহ ইরশাদের বহুদিনের। নোরার কথায় কথায় মৈত্রীকে নিয়ে ইঙ্গিত তার কৌতূহলকে যেন উ-স-কে দিচ্ছে দিনে দিনে। ময়ূখ ঢাকায় যাওয়ার পর কথায় কথায় নোরাকেই সে কয়েকবার মৈত্রী সম্পর্কে কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করতে লাগল। ময়ূখের সেই জিজ্ঞাসা নোরার ভেতরে নীরব ঘা-তকের মত আঘাত করে বসলো যেন। তবে সেতো ইমোশনের বেড়াজালে আটকে পড়ার মত মেয়ে নয়। সে তার চতুরতাকেই জারি রেখে ইরশাদকে আরও জাগিয়ে দিল সেদিন সন্ধ্যায়। যেদিন মৈত্রীকে দেখতে পাত্রপক্ষ এলো সেই সাথে এলো মৈত্রীর মামা-মামীও। পরের ঘটনাটুকু ঠিক এরকম….!

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৭

সেই দিনের ঘটনা,

দিনের দ্বিতীয় প্রহরেই আসার কথা ছিল পাত্র পক্ষের। স্বাভাবিক ভাবেই দেখাসাক্ষাৎ পর্ব হওয়ার কথা থাকলেও পরে শোনা গেল চেইন পরিয়ে যাবে বলছে ছেলের পরিবার। মামা যে পাত্রের বায়ো পাঠিয়েছেন সেই ছেলে ছবির চেয়েও দ্বিগুণ সুন্দর সামনাসামনি । ছেলেটা ছবিতে ফরমাল লুকে ছিল বলেই হয়ত বয়স্ক লাগছিলো কিন্তু সামনে থেকে ইরশাদের চেয়েও ছোট মনে হয়। মানে মৈত্রীর পাশে একদম পারফেক্ট জুটি বলেই মনে হলো নোরার। ফুপি সেদিন যেতে দেয়নি তাকে মৈত্রীদের ঘরে। ফুপির কথা, অল্প সুন্দরী মেয়ের পাশে অতি সুন্দরী মেয়ে থাকলে নাকি লোকের চোখে অল্প সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ হবে না। আর ফুপির ধারণা মতে নোরা অতি সুন্দরী সে গেলে হয়ত পাত্রপক্ষ মৈত্রীকে দেখে পছন্দ করবে না। নোরা হেসেছিলো ফুপির কথায় আর মনে মনে বলছিলো, তাহলে তো আমার অবশ্যই যাওয়া উচিত নইলে তোমার হবু ছেলের বউ অন্যকারো ছেলের বর্তমান বউ হয়ে যাবে।

মৈত্রী অরুণিমার হাতেই সেজেগুজে গিয়েছিল পাত্রপক্ষের সামনে। মৈত্রীর মামী তাকে সেখানে নিজে নিয়ে গিয়ে বসালেন। পাত্র সরাসরি মৈত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো মিনিট খানেক সময় নিয়ে। আর এই সময়টুকুই মৈত্রী না দেখেও টের পেয়েছে সেই দৃষ্টি আর তাতেই ভেতরে ভেতরে অস্ব-স্তি বোধ করেছে। তার মুখে সেই অ-স্বস্তি ভাসলো না একদমই। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার অ-স্বস্তিকে অ-শা-ন্তিতে বদলে দিলো পাত্রের বলা একটা কথা, “আমরা কি একটু কথা বলতে পারি?”

“ওহ শিওর! তোমাদের তো আলাদা একটু সময় দেওয়াই যায় আফটারঅল চেনা জানারও একটা ব্যাপার আছে।” মৈত্রীর মামী অতিমাত্রায় স্মার্টনেস প্রকাশ করতেই যেন ব্যস্ত হলেন। মৈত্রীর মন বলছিলো মুখের ওপর বলে দিতে, “নাহ আমি কোন কথাই বলতে চাই না এই লোকটার সাথে। আমি তো চাই নিচতলার বেলকোনির মানুষটাকে। সেই বিড়ালচোখা, পাখি পোষা শান্ত, স্নিগ্ধ মানুষটার সাথে কথা বলতে। তোমরা কেউ প্লিজ তাকে এনে দাও।”

মনের কথা মুখে আসে না মৈত্রীর এটাই যেন তার জীবনের অভিশাপ। তার গোটা জীবনে সে কাছের মানুষ আপন মানুষদের হারিয়েছে মুখ ফুটে কিছু না বলতে পারায়। মায়ের মৃ-ত্যু-তে ভে-ঙে পড়া ছোট্ট মৈত্রী প্রাণ মায়ের ঘ্রাণ পেয়েছিল ছোট খালার গায়ে৷ খালামনির রাত দিন যখন শুধুই মৈত্রীর নামে বাঁধা তখন বাবা নিজের প্রয়োজন আর মৈত্রীর প্রয়োজনেই বিয়ের তাগিদ দেখালেন। ছোট খালাকে বিয়ের কথা নানীর ছিল কিন্তু বাবা মানেননি। নানী বারবার মৈত্রীকে বুঝিয়েছিলেন বাবাকে বলো তুমি খালামনিকেই মা হিসেবে চাও। নাহ, মৈত্রী পারেনি এ কথা বলতে অথচ এখন বোঝে সে বললেই বাবা তার কথা মেনে নিতো। শুধু মাত্র মুখ খুলতে না পারায় দায়েই বড় ফুপি তার অ-স-ভ্য ছেলের কু-নজর থেকে মৈত্রীকে বাঁচাতে পারেনি। মনে পড়ে আজও কিশোরী মৈত্রীর আপন ফুপাতো ভাইয়ের কাছে মলেস্ট হওয়ার সেই য-ন্ত্র-ণা-দায়ক ঘটনা। সে মুখ খুলতে পারেনি বলেই আজও অপরাধী নির্দ্বিধায় তারই আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় যখন তখন। মুখ খুলতে না পারার দো-ষেই তো হারিয়েছিলো জীবনের প্রথম প্রেম তু-ষা-রকেও। আর এত এত হারানোর য-ন্ত্র-ণা-য় দগ্ধ হয়ে মৈত্রী এখন পাথরের ন্যায়। পাত্রের সঙ্গে যখন নিজের ঘরের বেলকোনিতে দাঁড়ালো মৈত্রী ঠিক তখনই তার বুকের ভেতর মু-চ-ড়ে উঠলো ইরশাদ নামের উষ্ণ হাওয়া। শীতের আদ্র বিকেল এক লহমায় ভিজে উঠলো চোখের কো-ণের উষ্ণ জলে৷ পাত্র খেয়াল করেনি সে জল তবে খেয়াল করেছিল নিচ তলার বেলকোনি থেকে উঁকি দেওয়া শ্বেতাঙ্গ এক নারীকে। সেই উঁকি দেওয়া মুখটা দেখেই মৈত্রীর বেলকোনির আলাপ শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। তারা বসার ঘরে ফিরে যেতেই পাত্রের মা চেইন পরাবেন বলে শোর তুললেন। সে কথা বাড়ির নিচ তলা থেকে উপর তলা সবাই জানলো কিন্তু সন্ধ্যাক্ষণে কি হলো কে জানে চেইন পরানো আর হলো না। পাত্রপক্ষ চলে গেল, চলে গেলেন মৈত্রীর মামাও৷ মামী থেকে গেলেন সেদিনের জন্য এবং সন্ধ্যার পরই জানা গেল পাত্রের পছন্দ হয়নি মৈত্রীকে। কারণ হিসেবে দর্শানো হলো মেয়ের নীরব থাকাটাকে তাদের মানসিক রো-গ বলে মনে হয়েছে। মৈত্রী জানলো সবটা তবুও কষ্ট হয়নি তার কিন্তু ক-ষ্ট হলো মামীর কথায়, “এবার একটু চেঞ্জ হও মৈত্রী৷ এভাবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের ত চোখ কান বন্ধ করে থাকলে কি করে চলবে! বিয়ে দিতে হবে না, এভাবে থাকলে তো হয় না দেখলেই। বাবা, মামাদের যতোই পয়সা থাকুক মেয়ে কিন্তু শতভাগ নিঁখুত না হলে কপালে দূর্গ-তি থাকেই মনে রেখো কথাটা।”

মামীর বলা কথাগুলোতে ভীষণরকম ধা-রা-লো খোঁচা আছে তা সেদিন মৈত্রী ছাড়া আরও একজন বুঝেছিলেন। তাই মৈত্রী যখন মামীর কথায় কষ্ট পেয়ে চুপচাপ ছাঁদে চলে গেল তখন অপর ব্যক্তিটি সামনে এলেন। সেই ব্যক্তিটি ছিলেন রোকসানা বেগম। তিনি মৈত্রীর মামীর জন্য তখন কফি নিয়ে মাত্রই ঢুকেছিলেন গেস্ট রুমে। মৈত্রী যখন মামীর বলা কথাগুলো গিলে নিয়ে বেরিয়ে গেল তখনই রোকসানা বেগম বললেন, “আসলেই মৈত্রী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নইলে কেউ বাপের খেয়ে অন্যের অপমান সহ্য করে! তাও কিনা এমন মানুষের যে কিনা মা ম-রা মেয়েটিকে অসুস্থ অবস্থায় নিজের বাড়ি রাখতে চাইতো না সেবা করতে হবে বলে। এমনও নির্বো-ধ মানুষ আছে যে কিনা নিজের যোগ্যতা আছে জেনে পরের কাছে পয়সার খোঁটা শোনে! মৈত্রী তো মানসিক রোগী তাই এমন আত্মীয়কে জবাব না দিয়ে কান্না করতে বেরিয়ে যায়৷ মৈত্রীর জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে বয়সের হিসেব না করেই ঠা-স করে একটা লাগিয়ে বসতাম যেন জীবনে দ্বিতীয় বার কাউকে জ্ঞান দেওয়ার আগে সেই থা-প্প-ড়ের কথা ভাবে।”

মৈত্রীর মামী ‘থ’ হয়ে গেলেন রোকসানার কথা শুনে৷ কতগুলো বছর ধরে তারা সবাই শা-সি-য়ে রাখছে মৈত্রীর বাবাকে শুধু মাত্র এই বলে, কোনরকম বা-ড়া-বা-ড়ি করলে মৈত্রীকে তারা নিয়ে যাবে নিজেদের কাছে। আইন তো তাদের এখন পকেটে আছে রাজনীতির দাপটে। কিন্তু কে জানতো রোকসানার এই অ-গ্নি-মূর্তি একদিন বেরিয়ে আসবে এমন করে!

মৈত্রী কান্না করতেই ঘর ছেড়ে ছাঁদে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে হিম শীতল হাওয়া গরম কাপড়বিহীন গায়ে কাঁ-টা দিয়ে উঠলো মৈত্রীর। কিন্তু বুকের ভেতর যন্ত্রণার যে পাহাড় চেপেছে সে ভারেই সে বাহ্যিক সেই আবহাওয়াও ভুলে গেছে। গলা ফা-টি-য়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার, কারো কাঁধে মাথা রেখে, কাউকে জা-প-টে ধরে বলতে ইচ্ছে করে, আমি অনুভূতিহীন নই আমারও প্রতিক্রিয়াবোধ আছে শুধু প-রি-স্থি-তি আমাকে বো-বা করে দিয়েছে। মা-হীন জীবনে আমি কাউকে বেশিক্ষণ আঁকড়ে রাখতে পারিনি এই নির্বাক হওয়ার অ-প-রাধেই তো! কিন্তু এই অ-প-রা-ধ আমি জেনে বুঝে করিনি শুধু হয়ে গেছে আমার দ্বারা। আমি ভাবতাম আমি না বললেও আমার আপন মানুষগুলো আমাকে বুঝে নেবে। কিন্তু দিনশেষে প্রমাণ পেলাম মুখ না খুললেই কিছুই পাওয়া যায় না। নানী ঠিক বলেছেন, না কাঁদলে মা’ও নাকি সন্তানকে দুধ দেয় না তবে নির্বাক থাকলে তাকে কেন কেউ ভালোবাসবে? তাকে কেন কেউ নিরবতায় স্বাভাবিক ভাববে! মৈত্রী যখন নীরব কান্নাকে ছাপিয়ে আর্তনাদ করে কাঁদতে চেষ্টা করলো ঠিক তখনই এসে সামনে দাঁড়ালো ইরশাদ। কাকতালীয় নাকি ইচ্ছাকৃত জানে না মৈত্রী তবুও ইরশাদের এই আগমনটাই যেন ছিলো তার প্রতিরো-ধ ভেঙে দেওয়ার মূল মন্ত্র। ইশাদের বলা বাক্যটাই ছিলো নীরব মৈত্রীর কান্নাকে সরব করার চাবিকাঠি৷ ইরশাদ শুধু প্রশ্ন করেছিলো, “এভাবে কাঁদছো কেন মৈত্রী?”

এই এক প্রশ্নই যেন মৈত্রীকে বদলে দিল ঝড়ের বেগে। সে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়েই ইরশাদের কোমর জড়িয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। সে কান্না নির্লিপ্ত মৈত্রী কত কি যে বলে দিয়েছিল এক দমে তা বোধকরি, মৈত্রীর নিজেরও জানা নেই৷ কান্নার দমকে অ-স্প-ষ্ট হলেও ইরশাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি সেই কথাগুলো। তার কি হলো কে জানে সেই মুহূর্তে মৈত্রীর দু গালে হাত রেখে শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলো, “তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? একদম মিথ্যে জবাব দেবে না৷ আমার চোখে চোখ রেখপ সত্যি জবাবটা দিয়ে দেবে। আবারও প্রশ্ন করছি, ভালোবাসে আমাকে?”

মৈত্রীর ঠিক সে মুহূর্তেই মনে হলো জীবনে মুখ না খুলে তো অনেক কিছুই হারালো আজ কি তবে মুখ খুলেই একবার নিজের ভাগ্যকে পরীক্ষা করে নেবে! সত্যিই মৈত্রী সেদিন ভাগ্যকে পরীক্ষা করতে ইরশাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলো, “হ্যাঁ ভালোবাসি।”

“ভেবে বলছো? আমি একবার হাত ধরলে আজীবন বাঁ-ধা থাকতে হবে এই হাতে৷ আমি ভালো বাসতে পারবো কি পারবো না তা জানি না তবে একবার আমার জীবনে জড়িয়ে গেলে আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবে না তাই জবাবটা আরেকবার ভেবে দাও৷ এই হবে তোমার শেষ ভাবনা।”

পৌষের শীতল কুয়াশামাখা আঁধারে সে রাতে কেউ যেন অ-গ্নি বো-মা ছুঁড়েছিলো মৈত্রীর গায়ে৷ কত শীতল, কত গম্ভীর কাঠখোট্টা ছিল সেই প্রশ্নটা তবুও মৈত্রী সকল ভ-য়, অ-স্থিরতা সব ভুলে এক বাক্যে জবাব দিয়েছিলো, “ভেবে নিয়েছি আমি আজীবন ভালোবেসে যাব।”

এ কথার পর আর এক সেকেন্ডও দেরি করেনি ইরশাদ৷ সে মৈত্রীর হাত মুঠোয় পুরে টেনে বিয়ে গিয়েছিল মৈত্রীদের দোতলায়। কলিং বেল বাজাতেই রোকসানা দরজা খুলেছিলেন এবং তিনিই খেয়াল করেছেন ইরশাদের হাতে মৈত্রীর হাত৷ মনে মনে বুঝি একটু হেসেছিলেন তিনি মৈত্রীর মামীর কথা ভেবে। সত্যি বলতে, মৈত্রী সৎ মেয়ে এ নিয়ে কখনোই কোন ক্ষো-ভ ছিলো না রোকসানার। সে বরাবরই নীরব দর্শকের মত মৈত্রীর জীবনে কিন্তু মৈত্রীর নানা বাড়ির কাউকেই তার পছন্দ নয়। সে ইরশাদ মৈত্রীকে একসাথে দেখে ইচ্ছে করেই অনেকটা জোরে বললেন, ” ইরশাদ তুমি! তোমার সাথে মৈত্রী কেন?”

রোকসানা যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটিই হয়েছে। মৈত্রীর মামী বসার ঘর থেকে দৌড়ে এসেছেন প্রায়। ইরশাদ তখনও হাত ছাড়েনি মৈত্রীর। রোকসানার কথার জবাবে ইরশাদ শুধু জানতে চাইলো, আঙ্কেল ঘরে আছেন?

রোকসানা মাথা নেড়ে ‘হ্যা’ বলতেই ইরশাদ ভেতরে ঢুকে সোজা গেল মৈত্রীর বাবার ঘরে। আধশোয়া, কপালে হাত ফেলে রেখেছিলেন মুজিব দুশ্চিন্তায়। মেয়েকে নিয়ে পাত্রপক্ষ থেকে যেসব মন্তব্য আসে তা নিয়ে এবার সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আসলেই কি তার মেয়ের মাঝে অনেক ত্রুটি! কই তার তো কখনো মনে হয়নি তেমন?

ইরশাদ নরম গলায় সালাম দিতেই কপাল থেকে হাত সরিয়ে তাকালেন মুজিব। মিনিট না গড়াতেই টের পেলেন তাঁর শরীরের শিরায় শিরায় এক আ-ত-ঙ্ক। তাঁর মেয়ের হাত ধরে রেখেছে ইরশাদ! কেন?

সব প্রশ্নের উত্তর পেলেন আরও মিনিট দশেক পরে যখন ইরশাদের বাবা-মাও এসপ হাজির হলো মৈত্রীদের ঘরে। ইরশাদ কোন রাখঢাক ছাড়াই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলো মৈত্রীর বাবাকে। সে তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যও সব রকম পন্থা জানিয়ে দিলো। ইরশাদ তার বাবা মায়ের কাছেও একইভাবে অনুমতি চাইলে ফখরুল সাহেবই প্রথমে বললেন, ছেলের খুশির বাইরে আমার কাছে কিছুই নেই।

ইরিনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি দোনোমনা করছিলেন একটু। কিন্তু নোরা কেমন করে যেন ফুপির মগজ ধো-লা-ই করে পাঁচ মিনিটেই জবাব পাল্টে দিলো। মৈত্রীর বাবার কোন আ-প-ত্তি না থাকলেও আপত্তি তুলল মৈত্রীর মামী৷ তিবি তার স্বামীকে ফেন করে কত কি বলতে লাগলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকলো না তার কোন কথা। অবশেষে খুব সাধারণভাবেই মৈত্রী ইরশাদের সম্পর্কের নাম বদল হয়ে গেল। আকস্মিক সবটা ঘটায় ইরিন বাধ্য হয়ে নিজেরই এক আংটি এনে মৈত্রীকে পরিয়ে দিলেন। ইরশাদের অনুরোধ রাখতে বিয়ের জন্য বড় কোন আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ রইলো না। পনেরো দিন পরই ছোটো খাটো আয়োজনে হয়ে যাবে বিয়েটা। ইরিনের কখনোই আত্মকেন্দ্রিক মেয়ে পছন্দ নয় তার ছেলেদের জন্য৷ সে তো মনে মনে ভেবে রেখেছিল ইরশাদ, ময়ূখের জন্য সে বউ আনবে চঞ্চল, দুষ্টুমনা হাসিখুশি মেয়ে। মৈত্রী তো তার পছন্দের কাতারেই ছিলো না কোন দিন৷ বাড়িওয়ালার মেয়ে, স্বামীর মুখে বলা বন্ধুর মেয়ে হিসেবেই যেটুকু আদর সে করতো। এখন কিনা ছেলের বউ হয়ে ঘরে থাকবে এমন মেয়ে! ভাবতেই যেন নিঃশ্বাস আটকে আসে ইরিনের।

ময়ূখ বিকেল থেকে আম্মাকে ফোন করেও লাইনে পায়নি৷ একবার ফোন করলো নোরা ধরে বলল আম্মা আজ মৈত্রীদের ঘরে৷ আজও নাকি কেউ দেখতে এসেছে তাকে৷ আর এ কথা জেনেই তো উ-ন্মা-দ হয়ে উঠেছে ময়ূখ। আম্মার সাথে কথা বলেই তাকে জানতে হবে ঘটনা কতদূর। কিছুদিন আগেও মনে হতো মৈত্রী তার শুধুই মোহ কিন্তু এখন বোঝে এটা শুধুই মোহ না৷ মৈত্রী তার জন্য অন্য কিছু, অনেক কিছু, ভীষণরকম বিশেষ কিছু।

চলবে
(রি-চেক করা হয়নি ভুল থাকলে ক্ষমা করবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে