কি ছিলে আমার পর্ব-৫+৬

0
2465

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৫

বাইরে আজ চড়া রোদ নেই, নেই শীতল বাতাস। আজকের আবহাওয়া একদম বাংলাদেশের সঠিক জলবায়ু বলেই মনে হচ্ছে ইরশাদের তবুও যে এই মেয়েটা কেন এমন ঘামছে আবার তার হাত দেখে মনে হচ্ছে একটু কাঁপছেও। এত অপ্রস্তুত হওয়ার মত কি কিছু ঘটেছে এখানে! মৈত্রীর অবস্থা দেখে গলা খাঁকড়ি দিলো ইরশাদ।

“তুমি কি অ-সুস্থ বোধ করছো?”

অকস্মাৎ প্রশ্ন শুনে মৈত্রী তৎক্ষনাৎ কোন জবাব দিতে পারলো না অথচ ইরশাদ তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে৷ সে বুঝতে পারলো লোকটা তার জবাবের অপেক্ষা করছে তাই জড়তা ভেঙে জবাব দিলো, “আমি ঠিক আছি।”

“আরও কোন বই নেবে?”

মৈত্রী তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো, “না।”

“ওহ তবে বাড়ি ফেরা যাক!”

এ কথা বলেই ইরশাদ লাইব্রেরি থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। মৈত্রী চমকে তাকিয়ে আছে ইরশাদের যাওয়ার পথে। লোকটা কি তার সাথে যাবে! এতক্ষণের অস্থিরতা এবার পশমের গোঁড়ায় এসে শিউরে উঠলো। এখান থেকে রিকশা করে বাড়ি ফিরবে সে লোকটা যদি তার সাথে রিকশায় উঠে ছিঃ ছিঃ পরিচিত কেউ দেখলে কি ভাববে! আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল লাইব্রেরি থেকে। তাকে আরও এক ধাপ বিষ্মিত করে ইরশাদ রিকশা দাঁড় করিয়ে তাকে বলল, “উঠো।”

“জ্বী!”

“রিকশায় উঠো।”

মৈত্রী এবার একপলক তাকালো ইরশাদের দিকে। পরনে সাদা শার্ট ইন করা কালো প্যান্টে। মাথার চুলগুলো ওই বাঁদ-রটার মত কোঁকড়া কিংবা ঝাঁকড়া নয়। একদম সোজা আর ঝলমলে তার চুল, নাকটা সরু এবং খাঁড়া অনেকটা পাকিস্তানিদের মত৷ গালে দু একদিনের বেড়ে ওঠা দাঁড়ি, ভ্রু দুটো ঘন আর চোখ… ঠিক এখানেই আর ভাবনা চলে না মৈত্রীর। চোখদুটোর সেই ফেনিল র-হস্যম-য়ী দৃষ্টি তাকে ঠিক প্রথম দিন থেকেই আচ্ছন্ন করেছে। কিশোরী বয়সেও কারো প্রতি দূর্বল না হওয়া মনটা আচমকাই এই আগুন্তকের আগমনে কেমন টলে গেল অজান্তেই! ইরশাদের মনে হলো এই মেয়েটি একটু অস্বাভাবিক, একটু ভিন্ন৷ সে আবারও রিকশায় উঠার করতে বলতে যাচ্ছিলো কি মৈত্রী চুপচাপ উঠে বসল। সে রিকশায় উঠেই একপাশে চেপে বসতে বসতে ইরশাদের দিকে তাকাতেই আরও একবার বিষ্মিত হলো। লোকটা রিকশাওয়ালাকে ‘যান’ বলেই অন্য একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে গেল। মৈত্রীর চোখেমুখে কোন প্র-তিক্রিয়ার আভাস না থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে অদৃশ্য সেই প্রতিক্রিয়া। তার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত এই লোকটা। রিকশা চলছে দুজনেরই পাশাপাশি মৈত্রী আঁড়চোখে তাই দেখতে চেষ্টা করলো। নাহ সুযোগ নেই লোকটার মুখে তাকানোর। চলন্ত রিকশাটাতে আজ মৈত্রীর মনে হলো গোটা শহরটাই চলছে তার সাথে। রোদের নিস্তেজ রূপ তাকে উজ্জ্বলতায় কেমন ঘিরে ধরছে আজ এইক্ষণে। মন কি তার বদলে যাচ্ছে কোনভাবে! কেন? কলেজের সেই নয়ন কিংবা ইউনিভার্সিটির সকল মেয়ের ক্রাশ রাহি ভাইয়ার আশপাশে থাকলে তো তার এমন লাগে না কখনো। রিকশা থেমেছে বাড়ির সামনে প্রথমে মৈত্রীরটা পরে ইরশাদেরটা। মৈত্রী ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে ব্যাগে হাত দিতেই রিকশাওয়ালা বলল, “ওই ভাই আগেই দিয়া দিছে।”

মৈত্রী ফিরে ইরশাদের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁট টেনে একটু হেসে বলল, “দিয়ে ফেলেছি তুমি যাও।”

ময়ূখ আজ একটু মার্কেটে গিয়েছিল এখনো ফেরেনি৷ ইরশাদ ঘরে ঢুকে গোসল সেরে মাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “ওর বাবা ফোন করে ওকে ঢাকায় যেতে বলেছে।”

ইরশাদ শুনলো কিন্তু কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না তার এই নিয়ে। সে মাকে বলল, “ভাত বেড়ে দাও আম্মু খিদে পেয়েছে।”

ইরিন বুঝতে পারলেন ময়ূখের ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে ছেলে রা-গ করেছে। তাই নিজে ভাত নিয়ে খাচ্ছে না। তিনি খাবার বেড়ে দিতে দিতে একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এভাবে রাগ করলে চলবে! যার ছেলে সে চাইবে না নিজের কাছে নিয়ে যেতে? তুই তো আমার ম্যাচিউর বাচ্চা এভাবে তোর রা-গ মানায়?”

“আমি তোমার ম্যাচিউর বাচ্চা আর ময়ূখ তো তেমন নয় আম্মু। সারাটা জীবন বুকে আগলে বড় করছি আমরা কি তাকে একসময় ওই শূণ্য ঘরে যেতে দেওয়ার জন্য! ”

ইরিন বেগম লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে দু চোখের পাতা বুঁজে নিলেন। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে গাল বেয়ে। তিনি নিজেও চাননা ছেলেটা ঢাকায় যাক। এতে তাঁর নিজের বুকটাই খাঁ খাঁ করবে যে। কিন্তু কিছু তো করারও নেই৷ ময়ূখ তার বাবার একমাত্র ছেলে আর বাবার ব্যবসা, সম্পত্তি সব তো একা মেয়েকে দিবেন না ছেলের ভাগ ছেলেকেই দিবেন৷ সেসবের জন্য হলেও ময়ূখকে একটা সময় ইরিনের আঁচল ছেড়ে চলে যেতে হবে। ইরশাদ ভাত মুখে পুরে পকেট থেকে ফোন বের করল। ময়ূখকে ফোন করে বলল বাড়ি ফিরে আসতে জলদি কথা আছে। ইরিন বেগমের ভালো লাগলো না ছেলের এই আচরণ। তিনি আর কোন কথা না বলে ছেলের সামনে থেকে সরে গেলেন।

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় শপিংমলটাতে এসেও ময়ূখ কিছু পছন্দ করতে পারল না তার বোনের জন্য। মেহের যা পছন্দ করবে তা বুঝি পুরো শহরটা খুঁজলেও পাবে না। মেহেরের পছন্দ তো ইরশাদের জিনিসগুলো এ কথা মনে হলেই গায়ে কাঁ-টা দেয়। যেখানে ময়ূখ ইরশাদকে আপন ভাই মেনে বড় হয়েছে সেখানে মেহেরটা কিছুতেই তা মানে না। মেহের যে বড় হয়ে গেছে তার মনের ভেতর এখন অনুভূতিদের ভিন্নতা তৈরি হয়েছে তাতো ময়ূখ জানে কিন্তু তবুও ইরশাদ ভাইকে নিয়ে তার অনুভূতি কিছুতেই স্বাভাবিক মনে হবে না। আর ভাইও তো মেহেরকে তার মতই আপন বোন ভাবে তারওপর ওই পুচকির বয়সটাইবা কদ্দুর! বোনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই পুরো শপিংমল চষে বেড়ালো। কিছুই পছন্দ করতে পারলো না বোনটার জন্য; শুধু মন বলছে ভাইয়ের থেকে দুটো পাখি কিংবা একটা ফুলের টব নিলেই কোটি টাকা মূল্যের আনন্দ পাবে পুঁচকিটা। এমনিতে তো ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছে তার একদমই নেই কিন্তু অনেক দিন হলো মেহেরকে দেখে না আর বিসিএসের জন্য তো তাকে আগামী সপ্তাহেই যেতে হতো! এমনিতে যেটুকু মলের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছিলো ইরশাদের ফোন পেয়ে সেটুকুও আর হলো না। তাই দু বক্স চকলেট আর ফেরার পথে নার্সারি থেকে একটা গোলাপ চারা নিয়ে বাড়ি ফিরল ময়ূখ। বেলা গড়িয়ে বিকেল নেমেছে উঠোন জুড়ে৷ আজকে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল ম্যাচ কোনটাই হবে না বুঝতে পেরে মিশু ইরশাদদের কলিংবেল টিপলো। ময়ূখ সবে বাড়ি ফিরে গোসলে ঢুকেছে। ইরিনও হাতে কাজ না থাকায় নিজের ঘরের বেলকোনিতে বসে কাঁথা সেলাই করছিলেন তাই হয়ত বেল বাজার আওয়াজটা খেয়াল করেননি। ইরশাদ একটু আগেই আসর নামাজ পড়ে ঘরে ফিরেছিল তাই ডোর বেলটা তার সজাগ কানেই ঢুকল৷ বসার ঘরে দু দিকে নজর ফেলে কাউকে না পেয়ে নিজেই গিয়ে দরজা খুলল সে।

“আরে চ্যাম্পিয়ন যে এসো ভেতরে এসো।”
হাসিমুখে বলল ইরশাদ। কিন্তু মিশু তার দিকে না তাকিয়েই ঘরের ভেতর নজর বুলাচ্ছে। ইরশাদ তার নজরের ভাবার্থ বুঝতে পেরে বলল, বস তো গোসলে ঢুকেছে। তুমি একটু বসো।

“ইরশাদ ভাইয়া আপনি কি চশমা পরেন?”

ইরশাদ টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়িটা থেকে দুটো কলা নিয়ে একটা মিশুর দিকে ধরল। মিশু কপাল কুঁ-চকে সেদিকে তাকাতেই বলল, “বসে এটা খাও ততক্ষণে তোমার বস গোসল সেরে বের হবে।”
ইরশাদ নিজেও একটা কলা খোসা ছাড়িয়ে খেতে খেতে সোফায় গিয়ে বসল। তাকে অনুসরণ করে মিশুও বসে কলায় কামড় বসালো কিন্তু নিজের করা প্রশ্নের উত্তরটা না পাওয়ায় সে এখনও তাকিয়ে আছে ইরশাদের মুখের দিকে। আরও কয়েক সেকেন্ড ধৈর্য্য দেখিয়ে পরে বিরক্তি ঝাড়লো, “আপনি এত চুপ করে থাকেন কেন? বলেন না চশমা পড়েন কিনা?”

“হু”

“তাহলে এখন চশমা নেই কেন সাথে?”

“এখন লাগবে না তাই।”

“আপনার চোখে কি আধা সমস্যা?”

মিশু বড় কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলে এবারের প্রশ্নটা করলো। কিন্তু ইরশাদ উল্টো প্রশ্ন করল, আধা সমস্যা আবার কি!

“ওমা! আপনি জানেন না এটা?”

“নাতো!”

” এইটুকু কথা জানেন না তাহলে কলেজের শিক্ষক কি করে হলেন?”

মিশুর কথায় এবার মজা পাচ্ছে ইরশাদ তাই হেসে ফেলল। কিন্তু সেই হাসিতেই উচ্চশব্দ নেই, ঝংকার নেই। অথচ তার জায়গায় এখন ময়ূখ হলে তীব্র ঝংকার তুলতো তার মন খোলা হাসি দিয়ে ৷ মৈত্রীর ভাষায় দাঁতখোলা হাসি। আর মিশুর এ কারণেই ইরশাদের চেয়ে ময়ূখকে বেশি ভালোলাগে। মিশু আবার বলল, “আপনি যে চশমা পরেন সে কথা বাড়িতে শুধু আমি জানি আর আমার আপু জানে।”

“তোমরা দুজন কি করে জানলে!” অবাক হলো ইরশাদ। কারণ চশমা সে শুধু ফোন আর ল্যাপটপের কাজেই ব্যবহার করে সেই সুবাদে ঘরের বাইরে কখনও পরা হয় না। তার নিজেদের বাড়ির লোকেরা জানলেও এ বাড়িতে নতুন আসায় কারো জানার কথা নয়৷ কারণ সে এখানে আসার পর আজ অবধি একবারও চশমা পরে বাইরে যায়নি।

তাদের দুজনের কথার ফাঁকেই ময়ূখ বেরিয়ে এলো গোসল সেরে। মিশুকে দেখে জোর আওয়াজে ডেকে উঠলো, “ওই মিশরী কি খবর মিয়া?”

“ময়ূখ ভাইয়া তুমি আবার আমাকে মিশরী বলছো আমি কিন্তু আমার আপুকে বলে দেব।”

মিশুর কথা শুনে ময়ূখ আবার হেসে উঠলো সেই ডা-কা-তিয়া দাঁত কেলানো হাসি৷ মিশুর মতই সেও বলে উঠলো, “তোমার বইনরে কইলে কি হইবো মিয়া সে নিজেই এক পেঁচামুখী।”

ময়ূখ ফাজলামো জারি রাখার চেষ্টায় মিশুকে উ-ত্তে-জিত করতে চাইলো। এ বাড়িতে আসার প্রায় কিছুদিন পর থেকেই সকলের কাছে চাউর হয়ে গেছে এই ছেলেটা মৈত্রীকে পেঁচামুখী বলে সম্মোধন করে। অথচ এই সম্মোধন শুধু দূর থেকেই৷ তাদের সামনা-সামনি যে ক’বার দেখা হয়েছে ময়ূখ প্রতিবার হাস্যকর কোন না কোন ঘটনা ঘটিয়েছে। আর তখন এমন কোন কথা না বলে শুধু বেকুবের মত হি হি হা হা করেই সরে এসেছে। ইরশাদ অবশ্য তাকে অনেকবার বলেছে এভাবে কিছু বলিস না মেয়েটা মন খা-রা-প করতে পারে। ময়ূখ সে কথায় পাত্তা দেয়নি৷ মিশু আরও কিছুক্ষণ বসলো ইরশাদ, ময়ূখের সাথে কিন্তু কোনমতেই খেলার জন্য কাউকে বলতে পারলো না৷ ময়ূখ খাবার খেয়ে ফ্রী হতে হতেই মাগরিবের আজান পড়েছে। ইরশাদ নামাজের জন্য চলে গেছে, ফখরুল সাহেব তখনও অফিস থেকে ফেরেননি আর ময়ূখ বসেছে তার ব্যাগ নিয়ে। কয়েকটা কাপড়চোপড় নিতে হবে সাথে করে৷ কিছু কাগজপত্রও আছে প্রয়োজনীয় আর ল্যাপটপটাও নিবে। ব্যস, এতেই তার গোছগাছ শেষ এদিকে মন খারাপ করে বসে আছে ইরিন৷ ময়ূখকে একা ঢাকায় পাঠাতে গেলেই তার কলিজা মো-চ-ড় দেয়। এই বুঝি ছেলেটা আর ফিরবে না, এই বুঝি সে আর আগের মত আগলে নিতে পারবে না তার সোনার মানিককে। দিন শেষে যদিও ময়ূখকে তার ছেড়ে দিতেই হবে তার ভবিষ্যতের জন্য তবুও মায়ের মন৷ মা হয়ে দু হাতে আগলে নিয়েছিলো সে দু বছরের ময়ূখকে আজ পঁচিশ বছরের ছেলেটাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই বুকে ঘা লাগে।ময়ূখ ব্যাগ গুছিয়ে এক পাশে রেখে বসা থেকে উঠতেই দেখলো আম্মার গাল ভেজা। বুঝতে বাকি নেই কেন এই সিক্ততা তবে সেতো জানে তার আম্মার ভাবনা ভুল। সে কোনদিনও বাবা, আম্মা আর ভাইকে ছেড়ে দূরে যাবে না। তার বসত, তার জনম সব এই আম্মায় পায়েই হবে৷ এইযে বিসিএস দেওয়ার কথা ভাবছে সেটাও আম্মার কথা ভেবে, ভাইয়ের পূরণ না হওয়া স্বপ্নটাকে ভেবেই তো দিচ্ছে। গুছিয়ে রাখা ব্যাগটাকে সরিয়ে আম্মার পাশে বসলো ময়ূখ। দু হাতে গাল মুছিয়ে দিয়ে মাথায় আলতো চুমু খেয়ে বলল, “তুমি এমন করে কা-ন্নাকা-টি করলে আমার লজ্জা লাগে আম্মা৷ মনে হয় আমি বুঝি তোমার মেয়ে আর আমাকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাচ্ছো।”
ইরিন বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন কিন্তু ছেলের কথা শুনে কান্না অবস্থাতেই হো হো করে হেসে দিলেন৷ এই ছেলেটা তাকে এমন করে পা-গ-ল বানিয়ে দিচ্ছে৷ তিনি গাল থেকে ময়ূখের হাত দুটো সরিয়ে তার কান চে-পে ধরলেন এবার।

“ওরে রা-মছাগল তুই যে এসব কি বলিস না! তুই মেয়ে হলেই ভালো হতো রে! তখন না হয় মনকে বুঝ দিতে পারতাম।”

আজ রাতের আকাশে তারার চিহ্ন নেই, নেই চাঁদের অস্তিত্ব। শীত শীত আমেজ পড়ছে প্রকৃতিতে তবুও আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা৷ আজকের আবহাওয়া সন্ধ্যা থেকেই জানান দিচ্ছে শীতের আমেজে বৃষ্টি হবে একদফা। প্রকৃতি ভিজবে শীতল হয়ে জমে যাওয়ার ভয় নিয়ে। মৈত্রীর আজ বইগুলো পড়তে ইচ্ছে করছে না৷ তাই রাতের খাওয়া শেষ হতেই ছাঁদের চাবি নিয়ে চলে এসেছে সে ছাঁদে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল নিচের রাস্তা, বাড়ির গেইট আর বাড়ির আঙিনা। চারপাশ জুড়ে আঁধার নেমেছে সেই আঁধার জমেছে গাছের ফাঁকে, ছাঁদের কার্নিশ আর মৈত্রীর মনেও৷ একাকীত্বের গল্প তার জন্ম থেকেই গাঁথা। অথচ এই একাকীত্বকে সে অনুভব করছে জীবনের একুশটি বছর পার করে৷ জীবনে রঙ বেরঙের সময় আসে, গল্প জমে অথচ জীবন ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলোয় তেমন কিছুই ছিলো না এতদিন৷ হুট করেই এখন সেসব পাতায় দা-গ টানতে ইচ্ছে করছে কোথাও কালো, কোথাও লাল কিংবা কোথাও হলুদ। এত এই পরিবর্তন তাকে বদলে দিতে চাইছে যেন জো-র করেই। ছাঁদের রেলিংয়ে দু হাত ফেলে ভর দিয়ে নিচের পথে চেয়ে থেকে তার কপাল কুঁচকে গেল। বাড়ির উঠোনে ব্যাগ কাঁধে কে দাঁড়িয়ে আছে? উঠোনের বাতির আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে লোকটার মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল৷ তারমানে ওই বাঁদর ছেলেটা যাচ্ছে কোথাও কিন্তু এই রাতের বেলা! তারপরই চোখে পড়লো পাশেই দাঁড়ানো সেই লম্বা মতন বিড়ালচোখা লোকটা। লোকটার পরনে ট্রাউজার আর টি শার্ট তারমানে যাচ্ছে শুধু ওই বাঁদরটাই৷ মৈত্রী খেয়াল করলো ময়ূখের পরনে আজ টি-শার্ট কিংবা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট নেই বরং জিন্স, শার্ট আবার হাতের কব্জিতে চিকচিক করছে কিছু একটা ব্রেসলেট কিংবা প্লাটিনামের সিলভার ঘড়ি। আজ এই প্রথম মৈত্রী খেয়াল করল এই লেকটাকেও ভদ্র সাজে ভালো দেখায়। তবে ওই বিড়ালচোখা লোকটার সাথে খুব একটা মিল নেই হোক তা স্বভাবে কিংবা দেহের গড়নে। নিজের অজান্তেই সে দুজনের মধ্যে তুলনা করতে লাগলো যেন৷ মিনিট কয়েকের মধ্যে দু ভাই গেইটের বাইরে গেলেও ফিরে এলো ইরশাদ একা৷ মৈত্রী তখনো সেদিকেই তাকিয়ে আছে৷ ইরশাদ গেইট দিয়ে ঢুকে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়েও ফিরে এলো আবার। উঠোনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছাঁদের দিকে তাকাতেই মনে হলো মেয়েটা বুঝি তাকে দেখতেই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ নিজের ভাবনাটাতে অবাক হয়ে নিজেকেই ধ-ম-কে উঠলো সে, এ কেমন বে-হু-দা ভাবনা তোর!

চলবে

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৬

গুলশানের তিনতলা খন্দকার হাউজে আজ মেহেরর আনন্দ-উল্লাস চলছে ভোর পাঁচটা থেকে। সকাল দশটায় সে স্কুলে যায় বলে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে লেট করে। এমনিতেও টেস্ট পরীক্ষার পর থেকে তার ক্লাস টাইম কমেছে কোচিংয়েই যা সময় কাটে। কিন্তু আজ সে এলার্ম দিয়ে রেখেছিল ভোরবেলায় ওঠার জন্য। ওঠেই সে আজ ভাইয়ের রুমে ঢুকলো। কাল কাজের লোকদের বলে ঘরখানা পরিষ্কার করিয়েছে সে কিন্তু এখানে ময়ূখের সকল জিনিস গোছানো নেই৷ তাই আজ ভোরে ভাই উপস্থিত হওয়ার আগেই নিজে এসে ভাইয়ের বুকশেলফ আর টেবিল গোছালো । আঙ্গুল চেপে চেপে ঘরের প্রতিটি আসবাব চেক করেছিলো কোথাও একটু ধূলোকণা আছে কিনা দেখার জন্য কিন্তু না সব ঠিকঠাক দেখে বারান্দার দরজা খুলে দিল। জানালার খুলে পর্দাগুলোও সরিয়ে দিল যেন ভোরের সূর্যটা প্রথমেই তার ভাইয়ের ঘরে নি-র্বি-ঘ্নে প্রবেশ করে। প্রায় সাত মাস পর আবার দেখা হবে তাদের আজ। শূন্যতায় খাঁ খাঁ করা বাড়িটা আজ আবার কিছুদিনের জন্য প্রাণবন্ত হবে। ময়ূখের ঘর থেকে বেরিয়ে মেহের এবার গেল বাবা মায়ের ঘরের দরজায়। দরজার কপাট লাগানো তার মানে তারা এখনো ঘুমে! অথচ আজ তার ভাই আসবে আব্বুর একমাত্র ছেলে আসবে এ নিয়ে কি আব্বুর কোন এক্সাইটমেন্ট নেই! গতবারও ভাই এলো আব্বু দেশে না থাকায় তাদের দেখা হয়নি সে কারণেও তো আব্বুর আজ উ-ত্তে-জ-নায় নির্ঘুম থাকার কথা। নাকি সে নিজেই একটু বা-ড়া-বাড়ি ভাবছে! আব্বু আম্মুর প্রতি আর কোন মনোযোগ এলো না মেহেরের সে এবার চলে গেল দোতলায়। রান্নাঘর, বসার ঘর, লাইব্রেরি ঘর এমনকি কাজের লোকদের ঘরগুলোও অন্ধকার। এ বাড়িতে সাতটার আগে কেউ নিজের ঘর ছেড়ে বের হয় না। একা একা বসার ঘরে পায়চারী করে আবার গেল তার সাথে লাগোয়া রুম সমান খোলা বারান্দাটাতে। কাঁচের দরজা পেরিয়ে খোলা বারান্দা তাতে উপর থেকে নিচ অব্ধি লোহার গ্রিল। সে গ্রিলে দু হাত ফেলে দৃষ্টি রাখলো বাড়ির লন পেরিয়ে গেইটের দিকে। কাল রাতে সে তিনটায় যখন ভাইকে কল দিলো তখন বলেছে, “আর তিনটা ঘন্টা লাগবে সোনা তারপরই ভাই তোর কাছে থাকবে।”

রাতের কথা মনে পড়তেই মেহের বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে বসার ঘরের পূব পাশের দেয়ালে লাগানো বড় ঘড়িটার দিকে তাকালো। ছয়ের ঘর পেরিয়ে গেছে পেট মোটা ঘন্টার কাটা।তার মানে ঘন্টা তিনও পেরিয়েছে! ভাই এখন কোথায় হবে কে জানে মেহের আর দাঁড়ালো না সেখানে। সে আজ ভাইয়ের জন্য নিজে ব্রেকফাস্ট তৈরি করবে। কয়েক দিন আগেই তো সে ইউটিউবে একটা চমৎকার নাশতা বানানো দেখেছে সেটাই ট্রাই করবে বলে ঠিক করল।

নারকেল গাছে এক জোড়া টিয়া দম্পতি এসেছে মাস খানেক হয়েছে। তারা রোজ নারকেল গাছটাতে নিয়ম করে সকাল -বিকাল হুটোপুটি করে বাড়িটাকে মাথায় তুলে নেয়। মৈত্রীর ঘরের জানালা, বারান্দার দরজা লাগানো থাকে বলে সে সকালের এই মিষ্টিমধুর খু-নসুটির স্বাক্ষী হতে পারে না৷ কিন্তু কাল অনেকরাত পর্যন্ত ছাঁদ আর বারান্দায় বসে সময় কাটানোর জন্য মনে করে জানালা লাগানো হয়নি আর সে কারণেই আজ ঘুম ভাঙলো ওই জোড়া টিয়ার প্রেমসন্ধির উচ্চরবে। আধখোলা চোখে জানালা দিয়ে অদূর নারকেল গাছে তাকাতেই দেখলো পাখি দুটো মিষ্টি ঝ-গড়ায় মত্ত। একজন আরেকজনকে ঠোঁট আঁকড়ে ধরছে তো পরক্ষণেই ছেড়ে একটু ওড়াল দিচ্ছে৷ বার কয়েক তারা এমনই করে যেন নিজেদের মধ্যে সন্ধি চালিয়ে যাচ্ছে। বালিশের পাশে হাত দিয়ে মোবাইলটা খুঁজলো মৈত্রী। হাতে নিয়ে সময় দেখলো সাতটা বাজে সবে। আজ ক্লাসে যাবে না আগেই ভেবে রেখেছে তবে আজ একটু কেনাকাটা করার ছিল। শীত আসছে তার ঘরে পরার জন্য স্লিপার কিনতে হবে দু একটা জামাও কিনবে বলে ঠিক করেছে। বিছানা ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙে প্রথমেই সে বেলকোনিতে পা দিল৷ শীত পুরোপুরি না পড়তেই মেঝেটা বরফশীতল হয়ে আছে। পায়ের তালু শিরশিরিয়ে ওঠে সেই শীতলস্পর্শে৷ পায়ের পাতা আলগা করে আঙ্গুলে ভর রেখে কোনমতে দাঁড়ালো সে। দু হাত উঁচিয়ে এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপায় গুঁজে আবারও মন দিয়ে পাখি দুটিকে দেখতে লাগল। আকাশ পরিষ্কার সূর্য ওঠেছে পূবাকাশ রাঙিয়ে দিয়ে। ঝলমলে আলোর প্রথম ঝলক এসে পড়লো মৈত্রীর গালে, চোখে আর চুলের মাঝেই৷ মুহূর্তেই তার মুখটা যেন অপার্থিব কোন ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে পূর্ণ হয়ে উঠল। আর সেই পূর্ণতার নীরব স্বাক্ষী হলো নিচতলার বিড়ালচোখা ছেলেটি। নিজের বেলকোনিতে বসে পাখিদের খাবার মুঠো খুলে সে পাত্রে ঢালতে ঢালতে আনমনেই তাকিয়েছিল ওপরতলার বেলকোনিটাতে। কাল অবধি যেই মেয়েটাকে সে নেহায়েত এক বাচ্চা মেয়ে বলে স্নেহের চোখে দেখেছিলো আজ ভোরেই সেই মেয়েটিকে এক অনন্যরূপী মোহময়ী স্নিগ্ধা হিসেবে দেখতে লাগলো। মিনিট কয়েক বুঝি তার সেই মোহের সম্মোহনেই কে-টে গেল। মায়ের ডাকে তার সম্মোহন কা-টতেই সে দৃষ্টি সংযত করল। মনে মনে আওড়ালো ‘ব্যাপারটা ভালো না।’ আজ ময়ূখ নেই বলে সকালের নাশতায় ডিম দিয়ে কোন খাবারই হবে না ইরিনের ঘরে। ছেলেটা ডিম পাগল বলে সে কোথাও গেলেই ইরিন ঘরে ডিম সেদ্ধ, ওমলেট, পোচ কিছুই করেননা। ইরশাদ তাই মায়ের ডাকে রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই নাশতার জন্য সবজি নিলো। পরোটা আজ সবজি দিয়েই খাবে তারা সাথে কোন ডিম ভাজা বা অন্য কিছুও করবে না। ইরশাদ জানে এই কাজটা তার মা আবেগ থেকে করে আর সেও এই আবেগকে সম্মান জানায়। নাশতা তৈরি হওয়ার পরই ইরশাদ গোসল শেষে ময়ূখকে ফোন দিলো। কল রিসিভ হলো না বলে সে এবার ময়ূখের বাবার নাম্বারে কল দিল। খন্দকার সাহেব ধরেননি ফোনটা বাধ্য হয়ে এবার উনার স্ত্রীর নাম্বারে কল দিলেন৷ কলটা বেজে শেষ মুহূর্তে রিসিভ হলো। ইরশাদ কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে লম্বা একটা সালাম এলো। ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে সে সালামের জবাব দিতেই আবার শোনা গেল, “কেমন আছো শাদ ব বব্রো?” ভাই শব্দটা ইরশাদকে বলবে না বলবে না করেও বলতেই হলো ভয়ে।

“আমি ঠিক আছি তুই কেমন আছিস?”

“বলব না অভিমান করেছি।”

“ওররে বাবাহ অভিমান আবার কি জিনিস?”

“আমি কিন্তু এবার রা-গ করব।”

“আচ্ছা এত অভিমান, রাগ এত ভারী ভারী জিনিস কিসের জন্য হচ্ছিস?”

“তোমার জন্য” মুখ ফসকে কথাটা বলেই আবার বলল, তোমার জন্য আমি রেগে আছি।”

“আমি আবার কি করলাম?”

“তুমি নতুন বাড়িতে উঠেছো নতুন, নতুন একজোড়া লাভবার্ডস এনেছো আবার দুটো সাদা গোলাপও অথচ আমাকে জানাওনি।”

অভিমানে, আবেগ মিশিয়েই অভিযোগগুলো শোনাচ্ছে মেহের অথচ ফোনের ওপারে ইরশাদ সেগুলোকে শুধু বাচ্চামো ভেবেই হেসে বলল, “থাক আর মুখ ফুলাতে হবে না। পরীক্ষার পর আসিস তোর জন্যও আনব অনেকগুলো পাখি আর ফুল৷ আচ্ছা শোন, ময়ূখ কি এখনো পৌঁছায়নি? তার ফোনটা তো রিসিভ হচ্ছে না।” শেষের কথাগুলো চিন্তিত শোনালো ইরশাদের৷ ফুরফুরে মেজাজ এবার মেহেরেরও চিন্তাগ্র*স্ত হলো। সেও ভাইকে অনেক সময় ধরে কল করেও পায়নি৷ ইরশাদকে জবাব দিতেই যাচ্ছিলো কি তখন কলিংবেল বাজলো। কাজের বুয়ার আগে মেহেরই দৌড়ে দোতলায় গিয়ে গেইট খুলল। আর তাতেই মুখ জুড়ে তার ছড়িয়ে পড়লো ঝলমলে হাসি। ময়ূখ দাঁড়িয়ে আছে সদরদরজায়। কাঁধে ব্যাগপ্যাক হাতে একটা শপিংব্যাগ। ময়ূখ ভাই এসে গেছে ফোন কানে মেহের জানিয়ে দিলো ইরশাদকে । ইরশাদ ফোন রেখে তার আম্মুকে জানালো এদিকে মেহেরও ভাইকে জড়িয়ে আহ্লাদে কান্না করে দিলো। এটা তার ভাই, তার আপন ভাই , জন্মদাতার ঔরসজাত তারা দুটি ভাইবোন একই গর্ভের না হয়েও বড় আপন তারা। বড় কাছের সম্পর্ক তাদের যদিও তারা ছোট থেকে কখনো একসাথে একটা মাসও কাটায়নি কখনো তবুও তারা আপন৷ মেহেরের কান্না শুনে ময়ূখেরও হাসিমাখা মুখটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। মা,বোনগুলো বুঝি এমনই হয়! সে চলে আসার বেলায় কান্নায় বুক ভাসালো তার আম্মা৷ সে আসার খুশিতে কান্নায় ভাসছে তার ছোট্ট বোনটি। কে বলবে এই জগতসংসারে ময়ূখের জন্মদাত্রী নেই! যারা আছে তারাই তো জন্মদাত্রীর চেয়ে বেশি ভালোবেসে আগলে রাখছে তাকে৷ দু ভাইবোনের আবেঘঘন মুহূর্ত কাটলো আরও অনেকক্ষণ তারপরই তাতে ব্যা-ঘা-ত ঘটিয়ে সামনে এলো তার বাবা। ইব্রাহিম খন্দকার ময়ূখের বাবা মানুষটা বোধহয় আবেগহীন আর দাম্ভিকই হবেন৷ নইলে একমাত্র ছেলে যাকে রোজ চোখের দেখাটাও দেখেন তাকে দীর্ঘ দেড় বছর পর দেখে নির্লিপ্ত কি করে আছেন! ছেলে আর মেয়েকে পাশাপাশি দাঁড়ানো দেখে শুধু একবার প্রশ্ন করলেন, “কেমন আছো?”

“ভালো।” বাবাকে আর ফিরতি প্রশ্ন করলো না ময়ূখ তিনি কেমন আছেন? এ যেন তাদের সম্পর্কেরই নিস্তেজ রূপ। বাবাই আবার বললেন, “তোমার আম্মা, বাবা কেমন আছে?”

“ঠিক আছেন তারা।”

“ইরশাদকে আসতে বলোনি?”

“ভাই নতুন একটা জব জয়েন করেছে নতুন কলেজে৷ ছুটি পাবে না।”

“তুমি বলেছিলে তাকে আসার কথা?”

এ পর্যায়ে জবাব দিলো না ময়ূখ। যিনি এত প্রশ্ন করছেন তিনি নিজে কি কখনও ফোন দিয়ে বলেন তাদের আসতে! তাহলে সে কেন বলবে বরং তার নিজের আসাটাই তো ঠেকে আসতে হয়েছে। নিশ্চয়ই নিজের কোন প্রয়োজনেই ময়ূখকে তিনি আসতে বলেছেন! হয়ত ময়ূখের মায়ের ভাগের সম্পত্তিতে কোন ঝা-মেলা হয়েছে যেখানে ময়ূখকে প্রয়োজন সমাধা করতে। আগেও এমন হয়েছে এসব। ময়ূখের বয়স যখন বাইশ তখন থেকে তার মায়ের ভাগের এবং নানা বাড়ির জমি-জমার কোন ব্যাপার হলেই ময়ূখকে কাজে লাগায় তার বাবা। কথা একটাই এসব নাকি তার ভবিষ্যতের জন্যই রাখা। ময়ূখ চায় না এসকল সম্পদ তার জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ সে রাজশাহীতে রেখে এসেছে। সারাজীবন সেই সম্পদ নিয়েই জীবন কাটাবে সে প্রয়োজনে বিয়ে এমন কাউকেই করবে যে কিনা দু হাতে আগলে রাখবে তার ওই সম্পদদের৷ জীবনের প্রায় আশিভাগ সিদ্ধান্ত ময়ূখ আগেই নিয়ে রেখেছে বাকি বিশ ভাগ সময়ের সাথে নেওয়া হয়ে যাবে। আব্বুর সাথে সে কথা বলতে আর বিন্দু মাত্র আগ্রহী নয় তা যেন এক বাক্যেই বুঝিয়ে দিলো। সে মেহেরকে বলল, “আমি একটু ঘুমাতে চাই রুমটা কি খোলা আছে?”

মেহের তড়িঘড়ি বলল, “রুম একদম ফিটফাট আছে ভাই আমি সকালেই গুছিয়েছি তোমার ঘর।”

ইব্রাহিম খন্দকার চুপচাপ চেয়ে রইলেন ছেলের মুখের দিকে। পাশ কা-টি-য়ে চলে গেছে ময়ূখ। মেহের ভাইকে ফ্রেশ হতে বলে চলে গেল নিজের বানানো নাশতা টেবিলে সাজাতে। ময়ূখ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে অবাক হলো৷ একদম ঝকঝকে তকতকে ঘরের মেঝে, দরজা, জানালা তার পিসির টেবিল, পড়ার টেবিল থেকে আলমারি পর্যন্ত। এমনকি ঘরের, চাদর পর্দাও সব নতুন তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই মেহেরটা সব অর্ডার দিয়ে দিয়ে করিয়েছে! ভাবতেই তার ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে হাসির উদয় হল। এই বাড়িতে আসার পেছনে দুটো জিনিসই হয়ত তাকে টানে এক মেহের দুই তার মায়ের স্মৃতি এই বাড়ি। মায়ের কথা তো তার কিছুই মনে পড়ে না কিন্তু যখন থেকে আম্মার মুখে শুনেছে এই বাড়ি আর বাড়ির পেছনের সুইমিংপুলটা মায়ের পছন্দে এবং মায়ের টাকাতেই তৈরি হয়েছিল। আজ সেসবে একচ্ছত্র অধিকার খাটায় অন্য এক মহিলা। হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ময়ূখ তখনই কানে এলো মেহেরের ডাক। আর শোয়া সম্ভব নয় এখন যদি তার বানানো নাশতা না খায় আজ আর র-ক্ষে নেই। ময়ূখ আবার দোতলায় নামতেই দেখল ডাইনিং টেবিলে মেহেরের তৈরি খাবার সাথে কফি৷ সে চেয়ার টেনে বসতেই জিজ্ঞেস করলো, “তোর জগলু কই আজ?”

জগলু বলতে কাজের বুয়া জরিনা খালাকে বোঝায় ময়ূখ৷ জরিনা খালা সবসময় ময়ূখকে দেখলে হড়বড়িয়ে কাজ করেন। কথায় কথায় বিড়বিড় করে বলেন এই ছেলের নজর ভালো না। কোন একদিন ময়ূখ মশকরা করে জরিনা খালাকে সুন্দরী বলে ডেকেছিলো সেও অনেক কাল আগের কথা সেই থেকেই মহিলা ময়ূখকে দেখলে গুটি পাকিয়ে থাকেন। তার হাবভাব এমন যেন ময়ূখ তার সাথে এখনই কোন অ-সভ্যতা করে বসবে। ময়ূখও এ ব্যাপারে পা-জি স্বভাবের। জরিনা খালাকে দেখলেই দাঁত কেলিয়ে হেসে বলবে, “আজ কি মেখেছো জগলু কি সুন্দর লাগছে তোমায়!”

বাড়ির সকলেই বোঝে ময়ূখের ফা-জ-লা-মো শুধু জরিনা খালাই ভাবে এই ছেলেটা একটা লু-চ্চা। মেহের প্লেটে নাশতা তুলে দিতে দিতে বলল, “জগলু তোমাকে দেখেই রান্নাঘরে ঘাপটি মে-রেছে ভাই।”

“এ্যাই তুই এগুলো কি বানিয়েছিস?”

প্লেটের নাশতায় চোখ পড়তেই আঁ-তকে উঠে প্রশ্ন করলো ময়ূখ৷ পাউরুটির টুকরো সাথে আনার, আঙ্গুর, কাজু, কিশমিশ সব একসাথে ক্রিমে মেশানো। খাবারটা ভালো করে দেখে ফোঁস করে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো ময়ূখ। এদিকে মেহের তাকিয়ে আছে ভাই কি বলে খাবারটা খেয়ে তারওপর সে একটা পোস্ট করবে ফেসবুকে৷ নিজের রান্নার ছবি তো আগেই তুলে রেখেছে এবার শুধু ভাইয়ের থেকে প্রশংসা পেলেই রেটিং’সহ ক্যাপশন দিয়ে পোস্ট করবে।

“ইউটিউব দেখে শিখেছিস?”

“হু” বড় উৎসাহে মাথা নাড়লো মেহের। অ-সহায় চোখে তাকিয়ে চুপচাপ খাবারটা মুখে তুলল ময়ূখ আর মনে মনে ইউটিউবের গু*ষ্টি উদ্ধার করতে লাগল।

গোসল শেষে তড়িঘড়ি চুল মুছে নিলো মৈত্রী। ঘড়ির কা-টা এগারোর ঘরে চলে এসেছে৷ আরও দেরি করলে বাড়িতেও ফিরতে দেরি হবে ভেবে সে দ্রুত ভেজা চুল ড্রায়ারে শুকিয়ে নিচ্ছে সেই সাথে শেলিকেও ডাকছে। তার তৈরি হতে দশ মিনিটই যথেষ্ট কিন্তু ওই নটাঙ্কিবাজই মেকআপ মা-রতে বসে যাবে একঘন্টার জন্য৷ মৈত্রী ভেবে পায় না সামান্য কিছু কেনাকাটার জন্য মেকআপ লাগিয়ে কেন বের হতে হবে! শেলিকে পরপর চারবার ডাক দেওয়ার পর সে এসে হাজির হলো। তাকে দেখতেই মৈত্রীর বি’ষ’ম খাওয়ার অবস্থা। টকটকে লাল থ্রি-পিস পরেছে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল মোটা করে লাগিয়েছে, কানে লম্বা লম্বা দুল। হাতেও সে চমৎকার চুড়ি পরেছে। তার পা থেকে মাথা অবধি সাজ দেখে মৈত্রী যারপরনাই হতাশ কিন্তু কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না শেলিকে। বড্ড উচ্ছাসে সেজেগুজে এসেছে বলে আর ইচ্ছে করলো না মেয়েটার মুড নষ্ট করতে। সে নিজেকে পরিপাটি করে ঠোঁটে আঙ্গুলে ঘষে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে পার্সে ফোন ঢুকিয়ে বের হবার জন্য পা বাড়ালো। তাকে এভাবে বের হতে দেখেই হায় হায় করে উঠলো শেলি।

“মৈত্রী আপা এমনেই যাইবেন আপনে ছি ছি মাইনষে চাইয়া থাকব তো।”

” চোখ আছে তাকাবে তাতে তোর কি সমস্যা?” মৈত্রী রান্নাঘরের সামনে এগিয়ে গেল। কোন সম্মোধন ছাড়াই বলল, “আমি বের হচ্ছি। কিছু কি লাগবে?”

“না” ছোট্ট করে জবাব দিলেন রোকসানা বেগম। মৈত্রী আর না দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে বের হলো। পিছন পিছন শেলিও যাচ্ছে তবে তার মুখ অনবরত চলছে, “আপা এমনে যাইতাম না আপনের লগে। মাইনষে কি কইব কেমুন দেহা যায়! এট্টু তো সাজবেন নাইলে পেস্টিজ থাকব আমার না আমগো!”

মৈত্রী ফিরতি কোন জবাব দিলো না কিন্তু শেলির কথাতে বোঝা যাচ্ছে সে নিজের প্রেস্টিজের চিন্তায় অ-স্থির হয়ে আছে। বাড়ি থেকে বের হলেই গলির মোড় এখানে রিকশা পাওয়া যায় কিন্তু রিলশা দিয়ে অতদূর যাওয়া যাবে না উল্টো কলেজ রোড থেকে আবার অন্য রিকশা ধরতে হব। তাই শপিংমলে যেতে সি এনজি হলেই বেশি ভালো হবে ভেবে গলি থেকে হেঁটেই এগিয়ে গেল মৈত্রী। বড় রাস্তায় এসে সিএনজির অপেক্ষা করল কিছু সময়। মাথার ওপর রোদ চড়েছে ভীষণ। গোসল করে এসেও এখন গরমে একটু একটু ঘাম হচ্ছে। সিএনজি পেতেই দুজনে তাতে উঠে বসল। মলে পৌঁছে প্রথমেই মৈত্রী জুতো কিনল চার জোড়া। নিজের জন্য একজোড়া স্লিপার আর এক জোড়া একটু উঁচু দেখেই নিলো। মামনি লাগবে না বলেছিল তবুও মনে হলো একজোড়া নেওয়া উচিত তাই তার জন্যও একজোড়া আর শেলিকে কিনে দিলো একজোড়া। শেলি অবশ্য নিজের পছন্দে চকমকে সোনালি রঙের উঁচু হিল দেখে কিনেছে যা মৈত্রীর কখনোই পছন্দ না। কিন্তু পরিচ্ছদের ব্যাপারটা প্রত্যেকটা মানুষের ভিন্ন রুচির হয় বলেই মৈত্রী মনে করে এতে কারো স্বাধীনতায় হ-স্ত-ক্ষে-প না করাটাই উচিত। সেও কিছু বলেনি শেলিকে। পরপর নিজের ইচ্ছে মত আরও কিছু জিনিস কিনল। চুড়ি, ঝুমকা, চুল আটকানোর জন্য ক্লিপ, তুলি আর নিজের প্রয়োজনীয় প্রসাধন। কেনাকাটার উছিলায় দুজন দুটো শপিংমলে ঘুরেও বেড়ালো খুব৷ এই ঘোরাঘুরি করার ফাঁকে কখন যে দুটো বেজে গেছে খেয়ালই করেনি তারা। শেলিই হঠাৎ বলল, বাড়ি যাইবেন কহন আমার ক্ষিদা লাগছে আপা।

এতেই মৈত্রীর সময়টা খেয়াল হলো। পার্স থেকে ফোন বের করে দেখলো দু’টো বেজে গেছে খিদে তো লাগবেই। তাই ভাবল শেলিকে এখান থেকেই কিছু খাওয়ানো যাক৷ তারা দুজনে ফাস্টফুডের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলো ভেতরে একজন পরিচিত মানুষ। চারপাশে তাকিয়ে ফুচকা, চটপটি ছাড়া এই একটা দোকানই আছে যেখানে অনেক পদের স্ন্যাক্স পাওয়া যায়। কিন্তু এই মুহুর্তে এই শপটাতে তার একদমই ঢুকতে ইচ্ছে করছে না অন্তত নিজের করা কয়েকদিনের কিছু অযাচিত আচরণের পর তো একদমই নয়। কাল রাতেও সে একাধারে তাকিয়ে ছিলো ওই লোকটার দিকে। আঁধার হলেও লোকটা যে তার চাহনি টের পেয়েই সরে গিয়েছিল উঠোন থেকে তা বুঝতে ভু-ল হয়নি মৈত্রীর। এখন আবার এই শপেই যদি ঢোকে লোকটা কি তাকে স*ন্দেহ করবে না! লোকটিকে ভাববে না সে ইচ্ছে করেই এখানে এসেছে! নিজের মনেই আরও কত কি ভাবছিল মৈত্রী এদিকে শেলি তাকে লক্ষ্য না করেই আগেই কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেছে। ইরশাদ বসে আছে বাইরের দিকে পিঠ দিয়ে কিন্তু তার বিপরীত যে ব্যক্তি বসা তার মুখ দরজার দিকে। লোকটাই খেয়াল করলো বাইরে দাঁড়ানো একটা মেয়ে নিষ্পলক চেয়ে আছে তাদের দিকে। কৌতূহলী হয়েই লোকটা ইরশাদকে ধীর স্বরে বলল, পেছনে তাকাও।

ইরশাদ কথাটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও স্যারের দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকালো। চোখাচোখি হলো মৈত্রী ইরশাদের। তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিল মৈত্রী আর লোকটা তা দেখেই আবার বলল, “তোমার গার্লফ্রেন্ড নাকি!”

“জ্বী! জ্বী না স্যার।”

“পছন্দের ব্যাপার স্যাপার নাকি!”

“এ্যা! না স্যার তেমন কিছুই নয়।”

“পরিচিত?”

এবার একটু চুপ থেকে জবাব দিলো ইরশাদ, “জ্বী স্যার পরিচিত। ওদের বাড়িতেই ভাড়াটে আমরা।”

তাই! না মেয়েটার দৃষ্টি দেখে অন্যমনস্ক, অন্যরকম মনে হচ্ছিলো। ইরশাদ এবার পুনরায় ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। মৈত্রী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছে। শেলি খাবারের আইটেম দেখছে কাঁচের শোকেসটা জুড়ে। সে এখনও ইরশাদকে দেখেনি দেখলে নিশ্চয়ই বকবক শুরু করে দিতো। এমনিতেই সে দিনরাত ইরশাদ নামের জপ করে মৈত্রীর কানের কাছে। কথায় কথায় বলে, “আপাগো আমার কেরাশে আজকা কালা কুচকুচা শাট পিনছে, আজকা কেরাশে ছাঁদে কাপড় দিতে আইছে, আজকা কেরাশে লুঙ্গি পিন্দা গলির দোকানে গেছে।”

এমনি আরও হাজারটা কথা ইরশাদকে নিয়ে বলতে বলতেই মৈত্রীর মস্তিষ্ক ভরে দিয়েছে ইরশাদ নামে৷ এখন তাই বড্ড অস্বস্তি হয় মৈত্রীর লোকটাকে দেখলেই। শেলি হট ডগ দেখিয়ে মৈত্রীকে বলল সে এটাই খাবে মৈত্রী তড়িঘড়ি করে এখান থেকে বেরুতে চায় বলে পার্সেল দিতে বলল, শেলির জন্য হটডগ আর মিশু আর শিপলুর জন্য বার্গার। ইরশাদের মিটিংটুকু শেষ হতেই সে এগিয়ে এসে বলল, “কেনাকাটা করতে এসেছিলে তোমরা!”

কানে পরিচিত কণ্ঠ বাজতেই শেলি পেছনে না ফিরেই মৈত্রীর হাত খা-মচে ধরল। ফিসফিস করে বলে উঠলো, “আপাগো আমার কেরাশ এনে আইছে।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে