কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব-১১+১২

0
1099

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১১
.
নুসরাতকে সুন্দর করে সাজিয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বিদায় নিল অর্ঘমা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলে নীরদ হন্তদন্ত হয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো। অর্ঘমার সামনে গিয়ে তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও হন্তদন্ত হয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল। আজ খুবই ব্যস্ত সে। অর্ঘমা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে হাতে থাকা খামের দিকে তাকাল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে হুট করে এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে চার তলায় চলে গেল।

নিজের রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে লাফ দিয়ে বসে যত্ন করে খামটা খুলতে লাগল। খামের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল কতগুলো ছবি দেখা যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকাল অর্ঘমা। কিসের ছবি এগুলো? তাড়াতাড়ি করে ছবিগুলো বের করল। বিস্ময়ে হা হয়ে গেল তার মুখটা। নীরদের সাথে যেদিন ঘুরতে গিয়েছিল, সেদিনের ছবি এগুলো। কিছু কিছু ছবি দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এগুলো তার অগোচরে তোলা হয়েছে। আবার কিছু ছবিতে সে নিজে থেকেই পোজ দিয়ে তুলেছে। কয়েকটা ছবি নীরদের সাথেও আছে। এগুলো সব নীরদের ফোনে ছিল। নীরদ তাকে প্রিন্ট করে দিয়েছে। ছবিগুলো দেখে খুশিতে অর্ঘমার পাগলপ্রায় অবস্থা।
___
বিকেলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল অর্ঘমা। আজ সে ঘুমায় নি। বারান্দা থেকে গলির মোড় স্পষ্ট দেখা যায়। নীরদের বন্ধুরা প্রতিদিন এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়। মোড়ের বিল্ডিংয়ে নীরদদের আরেক বন্ধু থাকে। তার কাছ থেকে ক্যারাম বোর্ড নিয়ে ক্যারাম খেলে মাঝে মাঝে। আর নয়তো সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ের আসরে বসে আড্ডা জমায়। এটা তাদের প্রতিদিনের রুটিন। ঝড়বৃষ্টি যা-ই হয়ে যাক না কেন এই রুটিন সবসময়ের জন্য বহাল থাকে।

আজও নীরদের বন্ধুদের দেখা যাচ্ছে। নীরদও আছে সাথে। এদের একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগে অর্ঘমার। এরা কখনো বাইরে অযথা ঘুরে বেড়ায় না। ভার্সিটি যাবে, পড়াশোনা করবে। সেখান থেকে হয়তো সব বন্ধুরা মিলে মাঠে বসে কিছুক্ষণ আড্ডার আসর জমাবে। তারপর সবাই যার যার বাসায় যাবে। মাঝে মাঝে গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবে আর নয়তো এই গলির মাথাতেই তাদের আসর জমবে। অতঃপর রাত আটটার মধ্যে সবাই যে যার বাসায় গিয়ে পড়তে বসবে। এসব নীরদই অর্ঘমাকে বলেছে।

অর্ঘমা খেয়াল করল নীরদ তার বারান্দার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওখান থেকে অবশ্য অর্ঘমার বারান্দার ভেতরটা খুব একটা স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু তবুও নীরদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবল হয়তো নীরদ তাকে খুঁজছে। অর্ঘমা মৃদু হাসল। কিছুক্ষণের মাঝেই তার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নীরদের নাম ভেসে উঠেছে। ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো।
-“তুমি কী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো?”
অবাক হলো অর্ঘমা। মনে মনে এই ছেলের চোখের পাওয়ারের প্রশংসা না করে পারল না।
-“হ্যাঁ, কেন?”
-“না, আমার মনে হলো তুমি দাঁড়িয়ে আছো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
-“ওহ! পড়াতে আসবেন না?”
-“একটু পরে আসব। এখন বন্ধুদের সাথে আছি।”
-“আচ্ছা।”
-“কিছু লাগবে?”
অর্ঘমা মনে মনে বলল, ‘আপনাকে লাগবে।’ কিন্তু মুখে বলল,
-“চিপস লাগবে।”
-“আচ্ছা নিয়ে আসব। এখন ভেতরে গিয়ে পড়া রিভাইস কর। আর তোমার হোয়াটসঅ্যাপে আমি কতগুলো ছবি পাঠিয়েছি হায়ার ম্যাথের। এগুলো সলভ কর বসে বসে। আমি এসে দেখব।”
-“আচ্ছা।”
-“রাখছি তাহলে।”
-“ঠিক আছে।”
কথা শেষ হওয়ার পরও কিছুক্ষণ কলে রইল দু’জন। একদম চুপচাপ। অর্ঘমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে নীরদের দিকে। নীরদও অর্ঘমার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। আসিফ এসে নীরদের মাথায় থাপ্পড় মারতেই কল কেটে দিল নীরদ। হাসল অর্ঘমা। নীরদের বন্ধুরা যে তাকে আর নীরদকে নিয়ে কনফিউজড তা সে জানে। প্রতিদিন বন্ধুরা এর জন্য নীরদের সাথে মজা নেয় তা-ও সে জানে। কিন্তু সবার সামনে দেখায় এমন যে সে কিছুই জানে না।
___
নীরদ এলো হাতে মিষ্টির প্যাকেট আর কিছু চিপস, চকলেট নিয়ে। অভ্র বাসায় নেই, অফিসে গিয়েছে। অর্ঘমা দরজা খুলে নীরদকে দেখে মৃদু হাসল। বিনিময়ে নীরদও হাসল। মিষ্টির প্যাকেটটা অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“আপুর বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে গেছে।”
-“আলহামদুলিল্লাহ্।”
-“আন্টি কোথায়?”
-“আম্মু নিজের রুমে শুয়ে আছে। কোমড় ব্যথাটা বেড়েছে আম্মুর।”
-“মেডিসিন নিয়েছেন?”
-“হ্যাঁ।”
-“আচ্ছা, তুমি এটা রেখে আসো। আমি তোমার রুমে যাচ্ছি।”
-“ওকে।”
মিষ্টির প্যাকেট রেখে চিপস আর চকলেট নিয়ে ঘরে এলো অর্ঘমা। বিছানার পাশে ছোট টেবিলের উপর থাকা ঝুড়িতে সেগুলো রাখল। নীরদ চেয়ারে বসে আছে। অর্ঘমা গিয়ে পাশে বসতেই নীরদ বলল,
-“টেস্ট এক্সাম কবে?”
-“সামনের মাসে।”
-“তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তোমার তো সিলেবাস শেষ। এখন শুধু রিভাইস করবে।”
-“হ্যাঁ, তবুও আমার চিন্তা হচ্ছে।”
-“চিন্তার কিছু নেই। দেখি বই বের কর।”
অর্ঘমা বইখাতা বের করে বসল। নীরদ প্রথমে কিছু এমসিকিউ জিজ্ঞেস করল। অপশন ছাড়াই সব ক’টা এমসিকিউ এর সঠিক উত্তর দিল অর্ঘমা। এরপর একটা প্যারাগ্রাফ ধরলো। পুরো প্যারাগ্রাফটা সঠিকভাবে বলার পর কিছু অংক করতে দিল। অংক করার ফাঁকে ফাঁকে তাকে সূত্র জিজ্ঞেস করতে লাগল নীরদ।
___
গত দু’দিন যাবৎ নিধি ক্লাসে আসছে না। অর্ঘমা প্রথমে চিন্তিত হলেও হুট করে তার মনে পরল নিধি বলেছিল সামনের সপ্তাহে তার বিয়ে। অর্ঘমা আতঙ্কিত হয়ে তারিখ হিসাব করল। তারিখ হিসাব করে বুঝতে পারল বিয়ে আগামী পরশুদিন। অর্ঘমার মনটা বেজায় খারাপ হলো। তার তো করার কিছুই নেই। নিধির ভাগ্যটা এত খারাপ কেন হলো? মন খারাপ করে সেদিনের সবগুলো ক্লাস শেষ করল অর্ঘমা। বাসায় গিয়ে নিধির সৎ মায়ের নাম্বারে কল করলেও ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করল না।

চিন্তা করেই সেদিনটা পার করল অর্ঘমা। পরদিন স্কুলে গিয়েই নিধিকে দেখতে পেল। খুশিতে ব্যাগ নিচে ফেলেই জড়িয়ে ধরলো তাকে। নিধি প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। পরক্ষণেই কিছু একটা আন্দাজ করে ফিসফিস করে বলল,
-“কী ভেবেছিলি, বুড়োকে বিয়ে করে সংসার করছি?”
মাথা নাড়াল অর্ঘমা। নিধি মলিন হেসে বলল,
-“বুড়োর দ্বিতীয় স্ত্রী ইচ্ছাকৃত ভাবে সিঁড়িতে তেল ঢেলে রেখেছিল। সেই তেলে পা পিছলে বুড়োর কোমড়ের বারোটা বেজে গেছে। সে এখন হসপিটালে। কোমড়ের হাড় নড়ে গেছে। খালা আমাকে বিয়ের জন্য আসতে দিচ্ছিলেন না এতদিন। কিন্তু এখন বিয়ের ডেইট পেছানো হয়েছে।”
-“তেল ইচ্ছাকৃত ভাবে ঢালার কারণ কী তোদের বিয়ে আটকানো ছিল?”
-“হ্যাঁ। বুড়োর দ্বিতীয় স্ত্রীর বয়স বেশি না। তেইশ বছর চলছে মাত্র। সে বিয়েতে রাজি ছিল না। তার বাড়ির লোকজন বুড়োর টাকা পয়সা দেখে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। আমি তো তার থেকেও ছোট। তাই তিনি আমার সাহায্য করেছেন। তিনি চান না তার মতো আমার জীবনটাও নষ্ট হোক।”
-“আপুটা তো তাহলে অনেক ভালো।”
-“হ্যাঁ।”
-“তার মানে আপাতত বিয়েটা কয়েকদিনের জন্য পেছানো গেছে তাই তো!”
-“হ্যাঁ।”
-“বাকিটা পরে দেখা যাবে। এখন আপাতত চিল কর।”
-“আর চিল! সামনের মাসে টেস্ট এক্সাম। পড়াশোনা হয়নি আমার কিছুই।”
-“চিন্তা করিস না। আমি তোকে সব বুঝিয়ে দিব।”
-“তুই আমার একমাত্র ভরসা। তুই কোচিং করে সব আমাকে বুঝিয়ে দিস বলেই তো আমি পারি। নাহলে আমার পড়াশোনা কবেই বন্ধ হয়ে যেত।”
-“আজাইরা কথা বলিস না তো। ক্লাস শুরু হতে আরও বিশ মিনিটের মতো বাকি। চল এতক্ষণে তোকে কেমিস্ট্রি পড়া দেখিয়ে দেই।”
-“আচ্ছা।”
___
নুসরাতের বিয়ের ডেইট পরেছে অর্ঘমার টেস্ট এক্সামের সময়। তার ফিজিক্স এক্সামের দিন নুসরাতের বিয়ে। এরপর দু’দিন বন্ধ। আবার পরীক্ষা দু’দিন পর। তাও হায়ার ম্যাথ এক্সাম। অর্ঘমা মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে মনে মনে নীরদকে বকা দেয়া শুরু করল। অবশ্য ও বেচারারই বা কি দোষ! নীরদ তো আর জানত না নুসরাতের বিয়ের দিন অর্ঘমার পরীক্ষা পড়ে যাবে। নীরদ যখন জানতে পারল তখন তারও মাথায় হাত। মনে মনে চিন্তিত হয়ে পরল সে। মিনমিন করে বলল,
-“তোমার যদি বেশি সমস্যা হয় তাহলে যাওয়ার দরকার নেই। পড়াশোনা সবার আগে। তবে আমার মনে হয় না তোমার সমস্যা হবে। কারণ আমি তোমাকে পড়িয়েছি। তাই আমি জানি তোমার সমস্যা হবে কি হবে না।”
-“দেখা যাক। আমি এখনই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমি না গেলেও ভাইয়া আর আম্মু অবশ্যই যাবে।”
নীরদ মিছে হাসার ভান করল।
-“না যেতে পারলে এক হিসেবে ভালোই হবে। বিয়ে বাড়ির আন্টিদের হাত থেকে বেঁচে যাব।”
এবার সত্যি সত্যিই হেসে ফেলল নীরদ। অর্ঘমা নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিল।

অর্ঘমার পড়া প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় তার মায়ের ফোন বেজে উঠল। অর্ঘমার কাছেই ছিল ফোন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিধির সৎ মায়ের নাম্বার দেখে ভড়কে গেল। নীরদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে অর্ঘমা বলল,
-“নিধির ফোন।”
কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নিধির কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। অর্ঘমা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে নিধি? কাঁদছিস কেন?”
-“অর্ঘ বাঁচা আমাকে প্লিজ!”
-“কী হয়েছে?”
-“খালার ভাইয়ের ছেলে এসেছে। তার দৃষ্টি ভালো লাগছিল না বলে আমি আমার ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে ভেতরে বসে ছিলাম। তোকে তো বলেইছি খালার ভাগ্নের চালচলন ভালো না। চরিত্র দোষও আছে। একটু আগে রান্না করতে গিয়ে খালা আর তার ভাগ্নের কথোপকথন কানে এসেছে আমার। খালার ভাগ্নে খালাকে টাকা দিয়েছে অনেকগুলো। বিনিময়ে বুড়োর সাথে আমার বিয়ের আগ পর্যন্ত সে প্রতি রাতে আমার সাথে থাকতে চায়। মানে বুঝতে পারছিস তুই? আমি আর কিছু শোনার মতো অবস্থায় ছিলাম না রে। দোতলা ছাদের পানির ট্যাংকের পাশে লুকিয়ে আছি আমি। আসার সময় খালার ফোনটা লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। ওরা আমাকে খুঁজছে। অর্ঘ প্লিজ কিছু কর। আমি যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে আজ সত্যি সত্যি আমি সুইসাইড করব।”
অর্ঘমা নিজেই ভয় পেয়ে গেছে নিধির কথা শুনে। তাকে কাঁপতে দেখে নীরদ তার মাথায় হাত রাখল। অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল অর্ঘমা। ফোনের ওপাশে নিধি কেঁদেকেটে আকুতি মিনতি করে চলেছে সমানে। নিজেকে শান্ত করে অর্ঘমা নিধির উদ্দেশ্যে বলল,
-“তুই ফোন সাইলেন্ট কর এখুনি। আর লুকিয়ে থাক। যা কিছু হয়ে যাক না কেন বের হবি না। আমি ভাইয়ার সাথে আসছি। যত দ্রুত সম্ভব আসছি আমি।”
কল কেটে দিল অর্ঘমা। অভ্রকে ফোন করতে হলো না। অফিস থেকে ফিরে দরজা দিয়ে সবেমাত্র ঢুকছিল অভ্র তখনই অর্ঘমা হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন নীরদও এলো। সে এখনো কিছুই জানে না। অর্ঘমা ড্রয়িংরুমে এসেই বলল,
-“ভাইয়া আমাদের এখুনি বের হতে হবে?”
-“পাগল তুই! ছেলেটা মাত্র বাসায় ফিরল অর্ঘ।”
মায়ের কথায় পাত্তা দিল না অর্ঘমা। এখন তার কাছে নিধির সেফটি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
-“কী হয়েছে অর্ঘ?”
নিধির সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল অর্ঘমা। মিনা বেগম বললেন,
-“তাহলে আর দেরি করিস না। জলদি বেরিয়ে পড় তোরা। মেয়েটার যেন কোনো বিপদ না হয় এর মাঝে।”
-“আমার মনে হয় সাথে পুলিশ নিয়ে গেলে বেশি ভালো হবে।”
নীরদের কথায় সম্মতি জানিয়ে অভ্র বলল,
-“হ্যাঁ, চলো জলদি।”
অভ্র, নীরদ আর অর্ঘমা বেরিয়ে পরল নিধির বাসার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে পাশের থানায় কল করে পুলিশকেও ব্যাপারটা জানিয়ে দিল।

চলবে…

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১২
.
নিধির বাসায় পৌঁছেই দৌড়ে ওপরে গেল অর্ঘমা। নিধি নেই পানির ট্যাংকের পাশে। আসার সময় বহুবার নিধিকে কল দিয়েও পায়নি অর্ঘমা। চিন্তায় তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর কিছু না ভেবে অভ্র আর নীরদকে নিয়ের নিধির বাসায় ঢুকল। দরজা খোলাই ছিল। অর্ঘমাকে দেখে নিধির সৎ মা যেমন অবাক হলেন তেমন রেগেও গেলেন। কারণ অর্ঘমা শেষবার যখন এখানে এসেছিল সেদিন তিনি সাফ সাফ অর্ঘমাকে বারণ করে দিয়েছিলেন সে যেন এখানে আর না আসে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অর্ঘমা জিজ্ঞেস করল,
-“নিধি কোথায়?”
-“তোকে কেন বলব? তোকে বলছিলাম না তুই আর আমার বাসায় আসবি না! তো আসছিস কেন?”
-“খেতে আসিনি আপনার বাসায়। ভালোভাবে জিজ্ঞেস করছি, বলুন নিধি কোথায়?”
-“ও আছে ওর ঘরে। কিন্তু এখন দেখা করা যাবে না। তুই যা এখন। এত রাতে কারো বাসায় আসাটা কোন ধরনের সভ্যতা?”
অর্ঘমা পেছন ঘুরে নীরদ আর অভ্রর দিকে করুণ চোখে তাকাল। তার চোখ ছলছল করছে। যেন এখনই কেঁদে ফেলবে। অভ্রর ফোনে কল আসায় সে নীরদকে বলে বেরিয়ে গেল। ফিরে এলো মিনিট দুয়েকের মাঝে। সাথে আছে পুলিশ। নিধির মা পুলিশ দেখে চমকালেন, ভড়কালেন। অর্ঘমা বলল,
-“দেখুন স্যার, নিধি আমাকে ওনার ফোন থেকে কল করেছিল। মেয়েটা লুকিয়ে ছিল। এখন ওনার ফোন ওনার হাতে দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওনারা নিধিকে খুঁজে পেয়েছে। প্লিজ নিধিকে নিয়ে আসতে বলুন এখানে।”
অভ্র বোনের পেছনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখল। পুলিশকে পুরো ঘটনা জানানো হয়েছে ফোনেই। তাই তিনি সময় ব্যয় না করে কনস্টেবলকে বললেন,
-“পুরো বাসা সার্চ কর।”
-“আরে আরে যাচ্ছেন কোথায় আপনারা?”
নিধির সৎ মায়ের কথায় অফিসার বললেন,
-“আপনার নামে অভিযোগ আছে।”
আঁতকে উঠলেন নিধির সৎ মা। রাগী চোখে তাকালেন অর্ঘমার পানে। নিধির বাবা বাসায় ঢুকে পুলিশ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে পুলিশ তাকে নিধির ফোন করে জানানো ব্যাপারটা বললেন। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুহূর্তেই। অভ্র আর নীরদ বুঝতে পারল ভদ্রলোক নিজেও এই ঘটনার সাথে জড়িত।

কনস্টেবল ভেতর থেকে একটা ছেলেকে টেনে নিয়ে আসলেন। অর্ঘমা নিধির কথা তাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন ভেতরে মহিলা কনস্টেবলের সাথে আছে। দেরি করল না অর্ঘমা। দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। অভ্র আর নীরদ গেল না পেছনে। নিধি কী অবস্থায় আছে কে জানে! এই অবস্থায় ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না তাদের। তারা দাঁড়িয়ে রইল পুলিশের সাথে।

নিধির ঘরে ঢুকতেই অর্ঘমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল। মেয়েটার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সে নিজেই কেঁপে উঠল। নিধি অর্ঘমাকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কনস্টেবল মহিলা অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-“আপনি কে?”
-“ওর বান্ধবী। ও আমাকেই কল করে জানিয়েছিল এখানের ঘটনা।”
নিধির সারা শরীরে মারের দাগ। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। ক্ষতগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলো তাজা। অর্ঘনা নিধির হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে পানি খুঁজল। নিধিকে পানি খাইয়ে তার পাশে বসে হাত ধরে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছিল সবটা বল আমাকে।”
কান্নার দমকে বারবার কেঁপে উঠছে মেয়েটা। অর্ঘমার পানে তাকাতেই তাকে আশ্বাস দিল অর্ঘমা।
-“ফোন কেটে আমি ছাদেই লুকিয়ে ছিলাম চুপচাপ। ততক্ষণে নিচে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছিল খালা আর তার ভাগ্নে। বিল্ডিংয়ের সবার বাসায় গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। আমি ছাদে আসার সময় চারতলার এক মহিলা আমায় দেখে নিয়েছিলেন। তিনিই ওদের জানিয়েছেন আমার ছাদে আসার কথা। খালা আর তার ভাগ্নে ছাদে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে দোতলা ছাদে আসে। আর আমাকে পানির ট্যাংকের পাশেই পেয়ে যায়। খালা আমাকে সেখানে দাঁড়িয়েই কতগুলো থাপ্পড় মারেন। তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে বাসায় টেনে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটান আমাকে। খালার ভাগ্নেও মেরেছে। আমার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি ছিল না আর মার খাওয়ার। আমাকে সেই অবস্থাতেই এই ঘরে ফেলে রেখে চলে যায় ওরা। কিছুক্ষণ পরে খালার ভাগ্নে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বাবাও এসবের সাথে জড়িত অর্ঘ।”
কেঁপে উঠল অর্ঘমা। ওর নিজের চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পরল। মেয়েটার সাথে কী তবে আরও বাজে কিছু ঘটেছে? কণ্ঠনালি কাঁপছে অর্ঘমার। তবুও সে বলল,
-“সে কী তোর সাথে বাজে কিছু…”
আর বলতে পারল না। নিধি জোরে কেঁদে উঠল। অর্ঘমা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। একসময় শান্ত হলো নিধি। মাথানিচু করে মিনমিনে গলায় বলল,
-“বেশি কিছু করতে পারে নি। তার আগেই পুলিশ এসে গিয়েছিল। তবুও যেখানে যেখানে ওই লোক আমায় স্পর্শ করেছে মনে হচ্ছে সেখানে সেখানে এসিড ঢেলে জ্বালিয়ে দেই। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে অর্ঘ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”
আবারও কেঁদে উঠল নিধি। কাঁদতে কাঁদতে এবার তার অবস্থা প্রায় অচেতনের মতো হয়ে গেল। মুখ থেকে হালকা গোঙানির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না আর। অর্ঘমা বুঝলো না কিছুই। ঘাবড়ে গিয়ে মহিলা কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি নিধির শ্বাসের গতিবিধি দেখে কপালে হাত ছোঁয়ালেন। আঁতকে উঠে বললেন,
-“শরীর তো প্রচন্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
নিধির জামা ঠিকঠাক করে সেভাবেই শুইয়ে রেখে ঘর ছেড়ে বের হলো অর্ঘমা আর মহিলা কনস্টেবল। বাইরের ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেখানে গিয়ে মহিলা কনস্টেবল অফিসারকে জানালেন নিধির বলা কথাগুলো।

অর্ঘমা অভ্রর কাছে গিয়ে বলল,
-“নিধিকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে ভাইয়া। ওর অবস্থা ভালো নয়। সারা শরীরে মারের দাগ আর প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।”
-“ঠিক আছে, নিয়ে যাব।”
নীরদ অফিসারের উদ্দেশ্যে বলল,
-“এনাদের কী শাস্তি দিবেন তা আপনি জানেন। তবে দেখবেন শাস্তি যেন কঠিন হয়।”
-“অবশ্যই।”
অর্ঘমা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“নিধি এই বাড়িতে থাকলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না ভাইয়া। আমি এই মহিলাকে এক বিন্দুও বিশ্বাস করি না। তাছাড়া এই মহিলা নিধির বিয়ে ঠিক করেছেন এক চরিত্রহীন পঞ্চাশোর্ধ বুড়ো লোকের সাথে। আজ বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বুড়ো কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে দেখে বিয়ের তারিখ পেছানো হয়েছে। ওই বুড়োর আবার আরও দুইটা বউ আছে। আমি নিধিকে এখানে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না।”
-“নিধিকে আমাদের সাথে আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।”
-“মা-বাবা!”
-“তাদের আমি বুঝিয়ে বলব।”
নিধির সৎ মা চিল্লিয়ে উঠলেন ওদের কথা শুনে। মহিলা প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়লেন।
-“নিধিকে নিয়ে যাবি মানে! ওকে তোদের সাথে কেন নিবি? তোর ভাইয়ের রক্ষিতা করে রাখার জন্য!”
মহিলার কথা শুনে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল অভ্র, নীরদ আর অর্ঘমা। অভ্র রেগে বলল,
-“মুখ সামলে কথা বলবেন।”
মহিলার সাথে অভ্রর বাকবিতণ্ডতা লেগে গেল। তার কথা হলো তিনি কোনোভাবেই নিধিকে নিয়ে যেতে দিবেন না। তার সাথে সহমত প্রকাশ করছে নিধির বাবা। নীরদ এসব দেখে পুলিশের সাথে কথা বলে ঠিক করল নিধি তাদের সাথেই যাবে। অন্তত পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথেই থাকবে মেয়েটা। কথা শেষ করে নীরদ অভ্রকে শান্ত হতে বলল।
-“নিধিকে নিয়ে এসো অর্ঘমা।”
নীরদের কথায় অর্ঘমা বলল,
-“ওকে হাঁটিয়ে নেওয়া যাবে না। সেন্স নেই ওর।”
-“কোলে নিতে হবে?”
-“হ্যাঁ, এছাড়া উপায় নেই।”
-“ঠিক আছে, চলো।”
নীরদ অন্য মেয়েকে কোলে নিবে শুনতেই অর্ঘমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। রেগে নীরদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেল নীরদ। এভাবে তাকানোর মানে কী? অর্ঘমা দাঁতে দাঁত চেপে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ভাইয়া, তুমি নিধিকে উঠাবে। এসো আমার সাথে।”
অভ্র গিয়ে নিধিকে কোলে তুলে বের হলো। পুলিশ ততক্ষণে বাকিদের নিয়ে চলে গেছে।
___
রাতের খাবার নিয়ে অর্ঘমা ঘরে প্রবেশ করল। নিধি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। চেহারায় অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। গত তিনদিন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত ছিল মেয়েটা। গতকালই হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না বলেই ভর্তি করতে হয়েছিল। এখন একটু সুস্থ আছে বলে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।

খাবারের প্লেট নিধির সামনে রেখে তাকে ধরে ঠিক করে বসতে সাহায্য করল। অর্ঘমা নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিল নিধিকে। খাবার শেষে যত্ন করে মুখ মুছে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিল। প্লেট রান্নাঘরে রেখে এসে নিজেও খেয়ে নিল। হাত ধুয়ে রুমে এসে দেখল নিধি চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। তার পাশে বসে অর্ঘমা জিজ্ঞেস করল,
-“খারাপ লাগছে?”
-“আমার ভাগ্যটা এমন কেন হলো বলতে পারিস? কী পাপ করেছিলাম আমি?”
-“যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমরা তো কিছুই বদলাতে পারব না তাই না! এসব আর ভাবিস না। এখন একটু ঘুমা তো। সপ্তাহখানেক পরে টেস্ট পরীক্ষা। আগামীকাল থেকে পড়তে বসবি। আমি তোদের বাসা থেকে আসার সময় তোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি।”
কিছু বলল না নিধি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
___
নিধিকে বাসায় নিয়ে আসায় কিছুটা নারাজ হয়েছেন অভ্রর মা। এর কারণ হলো তিনি সেদিনের ঘটনা অর্ঘমার কাছ থেকে শোনার পর ভেবেছেন নিধিকে তার সৎ মায়ের ভাগ্নে রেপ করেছে। নিধি ভয় পেয়ে সত্যিটা বলছে না। এর ওপর আবার নিধিকে অভ্রর কোলে দেখে তার মাথা ঘুরে উঠেছেন। তিনি ভয়ে আছেন অভ্রকে নিয়ে। তার এত ভালো ছেলেটা আবার নিধির জালে ফেঁসে না যায়। তার ছেলে অনেক ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করে। তাছাড়া নিধির রেপ না হলেও তিনি এই মেয়েকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না। একে তো মা নেই। থাকে সৎ মায়ের অত্যাচারে। বাপ তো থেকেও না থাকার মতো। এমন একটা পরিবারের মেয়েকে কীভাবে পছন্দ করবেন তিনি!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে