#কান্তা_মনি
#পর্ব_১২
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
হাওলাদার বাড়ি থেকে আজ জমিদার বাড়ি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে উঠোনে আসতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় কান্তা মনির। ঘোড়ারগাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন ও মারজান সরদারের বেগম। তাদের উপস্থিতি খানিকটা বিচলিত করে তোলে কান্তা মনিকে। সে নিজেও জানে না কেন যেন সরদার পরিবারের সদস্যদের দেখে তার বুক দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। তার আব্বা যে শেষ সরদার বাড়িতেই গিয়েছিল কাজের জন্য। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। তারপর ও তার আব্বা নাকি বাড়ি ফেরেনি সেদিন। ভোর হতেই একদল পথিক ঝোপের মাঝে তার আব্বার নিথর দেহ খুজে পায়। ঠোট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে কান্তা মনি।
-কান্তা মনি চলো। (সামনে মেহরিন ও তার আম্মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভ্রু কুচকালো নিয়াজ)
-কেমন আছো বাবা? (মারজান সরদারের বেগম)
-বোঝা তো উচিত কেমন আছি। (নিয়াজ মির্জা)
-এভাবে কথা কেন বলছো নিয়াজ? (মেহরিন)
-তার কৈফিয়ত তোমাকে দিতে রাজি নই আমি। তোমাকে আমি শেষবারের মতো সতর্ক করছি আমার সাথে কোনো প্রকার কথা বলার চেষ্টাও করবেনা তুমি। আর রটা ভেবো না যে তোমাদের কাজকর্মের ব্যাপারে কোনো প্রকার তথ্য আমার কানে আসেনি। (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজের কথায় মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে যায় মেহরিনের।
-কি করেছে মেহরিন? (মারজান সরদারের বেগম)
-তা আপনার কন্যাকেই না হয় জিজ্ঞাসা করে নেবেন। তা হঠাত হাওলাদার বাড়িতে এলেন যে? (নিয়াজ মির্জা)
-রমিজ ভাইজানের পরিবারের খোজ-খবর নিতে এসেছি। রমিজ ভাইজান তো আমাদের বাড়ির একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। বড্ড খারাপ লাগে তার জন্য। শুনেছি তাকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। (মারজান সরদারে বেগম)
-ওহ বুঝলাম। কিন্তু আমার যে সন্দেহ হচ্ছে আপনাদের সেই অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীকে আপনারাই হত্যা করে ফেলেছে। (চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজ মির্জার কথা শুনেই বিস্ফোরিত নয়নে মেহরিন এবং তার আম্মার দিকে তাকায় কান্তা মনি। তার মস্তিষ্কে এবার কোনো একটা বিষয় নাড়া দিয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে মেহরিন এবং তার আম্মার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
-এ এসব কি বলছো তুমি নিয়াজ? (মারজান সরদারের বেগম)
-কিছুনা। আপনারা ভেতরে যান। (নিয়াজ মির্জা)
মেহরিন আর তার আম্মা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই নিয়াজ বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে কান্তা মনির হাত ধরে বলেন,
-চলো আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে কান্তা মনি।
ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে উঠতে একবার পেছনে ফিরে হাওলাদার বাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান্তা মনি। রাহেলা এবং রজনীকে নিতে রাহেলার বড় ভাই এসেছেন। চিন্তার সাগরে ডুব দেয় কান্তা মনি। তার মনের ভেতরটা যে খাঁ খাঁ করছে। তার বাবাকে একা রেখে চলে যাচ্ছে সে। তার বাবার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। কান্নারা দলা পাকিয়ে গলায় এসে বাধায় গলা বিষ ব্যথা করছে কান্তা মনির। ক্ষানিক বাদে বাদে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। কান্তা মনির অবস্থা বুঝতে পেরে নিয়াজ একহাত দিয়ে তার কাধ আকড়ে ধরে রাখে।
ভোজনশালায় দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত জমিদার বাড়ির সবাই। খাবার গলা থেকে নামবেনা জেনেও মেহেরুন্নেছার বারবার বলার কারণে এবং স্বয়ং জমিদার খাবারের জন্য ডেকেছে শুনে সৌজন্যতার খাতিরে ভোজনশালায় উপস্থিত হয়েছে কান্তা মনি। মাথানিচু করে খাবার খেতে খেতেই হঠাত খাবার গলায় বেধে যাওয়ায় দম যায় যায় অবস্থা হয়ে পড়ে কান্তামনির। মেহেরুনেচ্ছা,হেতিজা মাথায় আর পিঠে হন্তদন্ত হয়ে হাত বুলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মুখের সামনে কেউ পানপাত্র ধরেছে দেখেই চোখ বন্ধ করে ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নেয় কান্তা মনি। কিছুটা শান্ত হওয়ার পরেই পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় কান্তা মনি। রেহানা পানপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে তার চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এই চিন্তাটা কি তার জন্য? ভাবতে তাকে কান্তা মনি।
-তুমি ঠিক আছো তো কান্তা মনি? (রেহানা)
চোখ ছলছল করে ওঠে কান্তা মনি। মাথা ঝুলিয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয় সে। নিয়াজ কান্তা মনিকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে।
পালঙ্কের ওপর বালিশের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে কান্তা মনি। জানালা গলে বাইরে থেকে আসা চাঁদের আলোয় তার মলিন মুখখানা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হারিকেনের পিটপিট আলোয় কক্ষের আসবাবপত্রগুলো ঝাপসা দৃশ্যমান। দ্বার খুলে পানপাত্রে করে দুধ নিয়ে হাজির হয় রেহানা। মুখে কারো হাতের শীতল স্পর্শ পেতেই পাশ ফিরে তাকায় কান্তা মনি।
-শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে তোমার? দুপুরে কিছুই খেতে পারোনি। এই দুখটুকু ঢকঢক করে আমার সামনে বসে খাও তো ভাবিজান। রেহানা)
রেহানার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রেহানা। রেহানার এমন পরিবর্তন বেশ ভাবিয়ে তুলছে কান্তা মনিকে।
চৌপায়ার ওপর পানপাত্রটি রেখে ধপ করে কান্তা মনির পাশে বসে পড়েন রেহানা।
-কি অবাক লাগছে ভাবিজানের ব্যবহারের এমন পরিবর্তনে? (রেহানা)
এখনো কোনো প্রকার কথা কান্তা মনির মুখ থেকে বের হতে চাইছে না।
কান্তামনির দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রেহানা বলে ওঠেন,
-আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমাকে অন্যরা যেমন ধারণা তোমার সম্পর্কে দিয়ে এসেছে আমিও তোমাকে তেমনই ভেবেছিলাম। মা আর মেহরিনের পরিকল্পনার সাথে হাত মিলিয়েছিলাম তোমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি, আমি তোমাকে যেমন ভেবেছিলাম তুমি তেমন নও। নিয়াজ ভাইজান ও আমার সাথে কথা বলেনা। তার কানে আমাদের কার্যকলাপের কথা চলে গেছে। কান্তা মনি আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি।
-আহা ভাবিজান এমন বলছো কেন? আমিতো তোমার বোনের মতোই তাইনা? ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করোনা একদম। (কান্তা মনি)
কান্তা মনিকে বাহুডোরে আগলে নেয় রেহানা।
-আমাকে কেউ ভালোবাছেনা। (রোদেলা)
পিটপিট করে চোখের পলক ফেলছে রোদেলা। কান্তা মনি তা দেখে হালকা হেসে রোদেলাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে ওঠে,
-ইশ পাকা বুড়িরে। কে বলেছে তোমাকে,যে আমরা তোমাকে ভালোবাসিনা? তোমাকে কত ভালোবাসি তুমি তা জানো? (কান্তা মনি)
-হিহিহি। চাচিমা জানো তুমি না অনেক সুন্দল। (হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হেসে কুটিকুটি হয়ে যায় রোদেলা)
-তাই? তা তুমি জানো তুমি আমার থেকেও অনেক সুন্দর? (কান্তা মনি।
দুই গালে দুহাত রেখে অবাক হয়ে রোদেলা বলে ওঠে,
-সত্যি!
-হুম সত্যি আমার পাকা বুড়িটা। (রোদেলার গাল টেনে দিয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-কিগো বাঘিনী মনটা কি ভিষণ খারাপ? (নওশাদ)
পুরুষালী কন্ঠ পেয়েই আলমারী আটকে পেছনে ঘুরে তাকায় কান্তা মনি। নওশাদকে কক্ষে দেখে আতকে ওঠে কান্তা মনি। নিজেকে শক্ত করে নেয় সে।
-আপনি এখানে? অনুমতি ছাড়া কক্ষে প্রবেশ করেছেন কেন? উনি জানতে পারলে আপনাকে শেষ করে ফেলবেন বলে দিলাম। সেদিনের কথা আমি কিছু বলিনি। সাবধান করে দিলাম আজকে আগে থেকে। বের হয়ে যান বলছি। (একটানে বলে ওঠে কান্তা মনি)
নওশাদ বাকা হেসে আচমকা শক্ত হাতে কোমর আকড়ে ধরে কান্তা মনির। অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে কান্তা মনি।
-আমাকে পুড়িয়ে তুমি কিভাবে খুশিতে থাকবে কান্তা মনি? সেদিনের থাপ্পড়রের কথা মনে আছে তোমার? দুইটা থাপ্পড়ের জন্য আজকে নিজের অতি প্রিয় একটা জিনিসকে হারালে। ভেবে নাও তাহলে, শান্ত না থাকলে আর কি কি হতে পারে। (ধাক্কা মেরে পালঙ্কের ওপর কান্তা মনিকে ফেলে দিয়ে কক্ষ থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায় নওশাদ)
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় কান্তা মনি। এসব কি বলে গেল নওশাদ? তার মানে কি তার আব্বার হত্যাকারীদের মধ্যে নওশাদ একজন? মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে কান্তা মনির।
শীতের সকাল। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার বিদ্যমান। কুয়াশার কারণে যেন আলো এসে আকাশকে রাঙানোর সুযোগই পাচ্ছেনা। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে ওঠে কান্তা মনি। বিছানা ছেড়ে উঠতে নিতেই আচলে টান বাধায় পেছন ঘুরে তাকায় সে। নিয়াজের বলিষ্ঠ হাতের নিচে চাপা পড়ে আছে তার শাড়ির আছল। মৃদু হাতে তা ছাড়িয়ে নেয় কান্তা মনি। নিয়াজের মুখপানে তাকাতেই থমকে যায় কান্তা মনি। কি স্নিগ্ধতা বিচরণ করছে নিয়াজের মুখে। নিয়াজের ঘুমানোর ভঙ্গিমা দেখে আনমনে হেসে ওঠে কান্তা মনি। এ যেন কোনো ছোট শিশু ঘুমিয়ে আছে। দ্বারে হালকা ঠকঠক শব্দ হতেই নড়েচড়ে ওঠে কান্তামনি। আলমারি থেকে মোটা শাল বের করে গায়ে পেচিয়ে দ্বার খুলে দেয় কান্তা মনি। দাসী তানিয়াকে দেখে স্বস্তিরে স্বাস ফেলে সে। দ্বার হালকা চাপিয়ে দিয়েই দুজনে বেরিয়ে পড়ে অজানা কোনো গন্তব্যের পথে। সকলে উঠে পড়ার আগেই যে আবার ফিরে আসতে হবে তাদের।
জমিদার বাড়ি ছেড়ে বেরোতেই মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতিও এখনো ঘুমিয়ে আছে। কিছুদূর যেতেই এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটানো বাড়ি-ঘর চোখে পড়ছে কান্তা মনি। স্নিগ্ধ এই আবছা আলোয় রাঙা ভোরে শরীর ও মন যেন বেশ সতেজ সতেজ লাগছে তার। শীতের মৃদু হাওয়াও যেন শরীরে হালকা কাপুনি উঠিয়ে দেয়।
ছোট একখানা চৌকি পেতে বসে আছে কান্তা মনি। তার বরাবরই মেঝেতে বসে আছে এক পয়তাল্লিশ কি ছেচল্লিশ বছর একজন মহিলা। উসকোখুশকো চুলগুলো যেন কত বছর কাঁকুইয়ের ছোঁয়া পায়না। গায়ে ময়লাযুক্ত বহু তালিযুক্ত কাপড়। স্বচ্ছল চোখ জোড়ায় মায়া স্পষ্ট। কিন্তু মানুষটার মুখ দেখে যেন বোঝাই যায়না মাথায় গন্ডগোল আছে।
চলবে…