#কানামাছি
#পার্টঃ৮
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
সাঁঝ অনেকক্ষন ধরে চেষ্টা করেও শাড়ির কুঁচিটা ঠিক মতো করতে পারছে না। আজকের শাড়িটা হাত থেকে বারবার পিছলে যাচ্ছে। পাঁচবারের মতো চেষ্টা করে কুঁচি করতে না পেরে শাড়িটা ফেলে দিলো। যেটুকু পরা ছিলো সেটুকু পরে বিছানায় বসে পড়লো।
দরজা খুলে কেউ এসেছে বুঝতে পেরেও পিছনে তাকালো না। নিশ্চয় তার সৎবোন লামিসা এসেছে। তার বিয়ে উপলক্ষে মা আর সৎবোন এই বাড়িতেই আছে। সে মানা করেছিলো কিন্তু মা জোর করে থেকে গেছে। কারণ একসময় এটা তার স্বামীর বাড়ি ছিলো! সাঁঝ অবাক হয় মায়ের স্বামী কেন মানা এই বাড়িতে থাকতে? কেন? তার মা যেমনই হোক এই সৎবোনটা বেশ ভালো। ক্লাস নাইনে পড়ে। তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। সারাদিন লাফালাফি আর বকবক করার এক অশেষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে লামিসা। সারাদিন আপু আপু করে মাথা খায়। আপু তোমাকে এভাবে সাজাবো, আপু তোমাকে এটা পরাবো, আপু তুমি এটা খাও তাহলে স্কিন ভালো হবে, আপু এটা মাখো দেখতে ভালো লাগবে, এতো এক্সাইটমেন্ট মনে হয়ে যেন লামিসা নিজেই বিয়ের কনে। ধমক দিলে মন খারাপ করে চলে যায় কিন্তু কিছুক্ষন পরে এসে আবার শুরু হয়ে যায়।
এখন আবার না জানি কি বলতে এসেছে। সাঁঝ বিরক্তি নিয়ে বলল,
—” লামিসা তুমি যদি নতুন কোন রূপচর্চার টিপস নিয়ে এসে থাকো তাহলে চলে যাও। এখন ভালো লাগছে না তোমার বকবক শুনতে।”
সাঁঝ একটু থেমে আবার বলল,
—” একটু পরেই ইহানরা চলে আসবে। আমি শাড়ির কুচি ঠিক করতে পারছি না। তুমি যদি পারো তাহলে এসে আমার কুচি ধরো”
কোন উত্তর না পাওয়ায় সাঁঝ ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” এটা কি ধরনের বেয়াদবি লামিসা? কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
সাঁঝ পিছনে ঘুরে দেখলো লামিসা না নাহিদ এসেছে তার ঘরে! দেয়াল হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। গায়ে আঁচল থাকলেও কোমড়ের কাছে শাড়ি এলোমেলো হয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সাঁঝ কোনরকমে শাড়িটা গুছিয়ে নিজের হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—” এটা কি ধরনের বেয়াদবি? না বলে আপনি আমার ঘরে কেন ঢুকেছেন? আপনার সাহস তো কম না! এতো কিছুর পরেও আবার এসেছেন?”
নাহিদ কিছু না বলে হায় তুললো। কিন্তু যাওয়ার কোন লক্ষন দেখালো না। বরং আরো আয়েশ করে দাঁড়ালো। নাহিদ ইচ্ছা করে এরকম সময়ে এসেছে। সাঁঝ শাড়ি পরে মারামারি করতে পারবে না তার সাথে। এখন নড়তেও পারবে না। সাঁঝ বলল,
—” বের হন আমার ঘর থেকে। নাহলে মেরে পঙ্গু বানিয়ে দিবো”
নাহিদ হায় তুলতে তুলতে বলল,
—” আগে ওখান থেকে হেঁটে আসো তো আমার কাছে! আমি একটু দেখি তোমাকে চোখ ভরে!”
সাঁঝের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। জোরে চিৎকার দিলো,
—” লামিসা? ফুফু? একটু এখানে আসো তো”
—” আরে এতো জোরে চিল্লাচ্ছো কেন? বিয়ের কনের গলা খারাপ হলে বিষয়টা ভালো হবে না। বাড়ির সবাই ছাদে গেছে। তোমার গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান ওখানে হবে কিনা দেখতে। এই দোতালা থেকে চিৎকার দিলে পাঁচ তালার উপরে শুনতে পাবে না”
সাঁঝ বিপাকে পড়লো। না কুচি ঠিক করতে পারছে, না শাড়িটা ছেড়ে দিতে পারছে আর না নাহিদকে গিয়ে মারতে পারছে। ফোনটাও নাহিদের পিছনে টেবিলের উপর রাখা। কিছুটা সময় পার করার জন্য সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,
—” কেন এসেছেন এখন এই ঘরে?”
নাহিদ দুইপা এগিয়ে দেয়ালের সাথে আবার হেলান দিয়ে বলল,
—” আমার নিজের কিছু ইচ্ছা,আকাঙ্খা আছে সেগুলো পূরণ করতে হবে আর তোমার সাথে তো পুরানো হিসাব বাদ আছে। ওগুলো মেলাতে হবে না?”
সাঁঝ বুঝতে পারলো আজ পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে। জানালা থেকে একটু দূরেই ছিলো সাঁঝ। একটু এগিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দেখলো ইহান নামছে গাড়ি থেকে। একমুহূর্তের জন্য ইহানকে দেখে নিজের ভিতরে একটা প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেলো। মনে হলো ইনাকেই তো দরকার ছিলো। সাঁঝ ডাক দিলো,
—” ইহান”
সাঁঝের রুম রাস্তা থেকে একটু সাইডে হওয়ায় ইহান প্রথমে তাকে খুঁজে না পেলেও এদিক ওদিক তাকানোর পরে জানালার ধারে সাঁঝকে দেখতে পেলো। হাত তুলে বলল,
—” আরে সাঁঝ! আমি ভিতরে আসছি”
ইহানের গলার আওয়াজ নাহিদের কান পর্যন্ত গেলো। নাহিদ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো। সাঁঝ তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ফুফুকে ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলল। সবাই নিচে নেমে আসলে সাঁঝ লামিসাকে ডেকে শাড়ির কুচি ঠিক করে নিলো। বসার ঘরে সবাই আছে। আজ বিয়ের শপিংয়ে যাবে তাই এতো আয়োজন। সাঁঝে কিছুটা বিরক্ত লেগেছে। এতো কেন করতে হবে? কিন্তু ইহান একমাত্র ছেলে তাই ওর পরিবারের সবার অনেক ইচ্ছা ছেলের বিয়েতে আনন্দ করবে।
আজ ইহানে মা আর বোনের সাথে বড় চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাইও এসেছে। ইহানের বড় চাচাকে দেখে সাঁঝের মনে একটু খটকা লাগলো। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে বড় চাচাকে। কিন্তু মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে। আবার গলা শুনে অপরিচিত গলা মনে হলো। সাঁঝ মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় দেখেছে বা কি চেনা চেনা লাগছে।
এরপর সবাই নিচে চলে আসলো। ইহান, সাঁঝ, লামিসা আর ইশিতা একগাড়িতে। আর অন্য গাড়িতে ইহানের মা, বড় চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাই। চাচাতো ভাইয়ের নাম রিফাত। ইহানের সাথে খুব ক্লোজ দেখেই বোঝা যায়। সবসময় দুজন ফুসুরফুসুর করতেই থাকে।
গাড়ি চালাতে চালাতে ইহান জিজ্ঞেস করলো,
—” তুমি কি আজ শুধু শপিংয়ে যাওয়ার জন্য শাড়ি পরেছো না অন্য কোন কাজ আছে?”
সাঁঝ ইহানের দিকে ঘুরে বলল,
—” না আজ ভার্সিটিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টে একটা ছোট প্রোগ্রাম আছে। সেজন্যও পরেছি”
—” প্রোগ্রাম কখন? আমারও তো ক্লাস আছে। তাহলে শপিং শেষ করে একসাথে যেতে পারবো”
—” প্রোগ্রাম তো বিকালে কিন্তু দুপুরে গিয়ে কাজ করতে হবে”
—” আচ্ছা”
সাঁঝ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। একটু পরে ইহান বললো,
—” শাড়ি পরে ভার্সিটিতে যাওয়া ঠিক হবে না”
সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” কেন?”
ইহান সাঁঝের দিকে না তাকিয়ে বলল,
—” তুমি বোধহয় জানো না তোমাকে শাড়ি পরে অনেক সুন্দর লাগে”
হঠাৎ করে সাঁঝ চমকে উঠলো। একটা ভালো লাগার পরশ যেনো তাকে ছুয়ে গেলো। গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে মাঝে মাঝে ইহানের দুই একটা কথায় এমন অনুভূতি হচ্ছে। সাঁঝ বুঝতে পারছে এটা ঠিক হচ্ছে না। নিজেই নিজেকে বলল, “সাঁঝ নিজেকে আটকাও। তোমার কিছু কাজ,কিছু উদ্দেশ্য আছে। সেগুলোর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু না। অন্য কোন জিনিসে এখন মন দিবে না।”
ইহানের দিকে তাকিয়েই নিজের ভাবনার জগতে ডুবে গিয়েছিলো সাঁঝ। হঠাৎ সামনের আয়নায় তাকিয়ে দেখলো ইশিতা আর লামিসা হাসছে। সাঁঝ খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।
মার্কেটে গিয়ে সাঁঝ কোন কিছুতে তেমন মন দিতে পারলো না। ঘুরে ফিরে চোখ শুধু ইহানের চাচার উপর গিয়েই পড়ছে। সাঁঝের চিন্তা ভাবনা উনাকে ঘিরেই ঘুরছে। কেমন যেন একটা বিষন্নতা রয়েছে উনার চেহারার মধ্যে। অনেক ঘোরাঘুরি করে কিছু জিনিস কিনে আর কিছু জিনিসের অর্ডার দিয়ে সাঁঝ আর ইহান চলে আসলো। বাকি যা কেনাকাটা তা বাড়ির লোকজন করবে। ওদের দুজনকেই এখন যেতে হবে ভার্সিটিতে। দুজনে একজায়গায় বসে লাঞ্চ করে ভার্সিটিতে চলে গেলো।
,
,
,
🌿
ভার্সিটিতে নেমে সাঁঝ নিজের মতো ক্লাসের দিকে চললো আর ইহান অফিসরুমে। সাঁঝ ঘড়িতে দেখলো এখনো অনেক সময় আছে প্রোগ্রামের। এতো তাড়াতাড়ি গিয়ে কোন কাজ করা যাবে না। এর মধ্যে নিজের গ্রুপের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে। দুপুরবেলা হওয়ায় মাঠে কেউ নেই। সাঁঝ ক্যান্টিনের দিকে চললো। দূর থেকে দেখতে পেলো তার গ্রুপের সবাই বসে আছে। আরো অনেক ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
সাঁঝ ক্যান্টিনের ভেতরে পা রাখতেই তার গ্রুপের সবাই ঘুরে তাকালো। এমনভাবে সবাই তাকাচ্ছে যেন কোন ভূতকে দেখছে। একটু খেয়াল করে দেখলো শুধু তার গ্রুপই না ক্যান্টিনের মোটামুটি সবাই তাকে ঘুরে দেখছে। সে কাছে আসতেই ইরা বলল,
—” সাঁঝ তুই শাড়ি পরেছিস?”
—” হ্যা কেন?”
দীপ বলল,
—”যেই সাঁঝ নবীনবরণের দিনে শাড়ি পরবে না এটা নিয়ে সব সিনিয়রদের সাথে ঝামেলা করেছে সে আজ কোন উপলক্ষ ছাড়া শাড়ি পরে ভার্সিটিতে এসেছে?”
শাওন বললো,
—” কি ব্যাপার বলতো? আজ পর্যন্ত তো তুই কখনো শাড়ি পরিসনি আজ কি মনে করে?”
সাঁঝ বিরক্ত হয়ে বলল,
—” Guys relax! সামান্য একটা শাড়িই। এমন কিছু না। আজ আমার ডিপার্টমেন্টে প্রোগ্রাম আছে তাই পরেছি”
রুনা বলল,
—” মোটেই সামান্য না। তুই এই শাড়ি পরা নিয়ে ভার্সিটিতে কম ঝামেলা করিসনি। ম্যাডামদের পর্যন্ত বলেছিস। তাই আজ অবাক লাগছে”
সাঁঝ বললো,
—” আমি নিজে যা চাই তাই করতে পছন্দ করি। বাধ্যবাধকতা আমার এতো ভালো লাগে না। আর শাড়ি নিয়ে বাধ্যবাধকতা আমার কাছে খুবই হাস্যকর লেগেছিলো। তাই সেই সময়ে বলেছিলাম যত যাই হোক আমি শাড়ি পরবো না। কিন্তু এখন ইচ্ছা হয়েছে তাই পরেছি।”
আর কেউ কিছু বললো না। সাঁঝ নিজের ব্যাগ থেকে ছয়টা কার্ড বের করলো। ওদের সামনে দিয়ে বলল,
—” নে”
সামি জিজ্ঞেস করলো,
—” কিসের কার্ড?”
—” আমার বিয়ের কার্ড।”
সবাই আবার হা করে তাকালো তার দিকে।।ইরা কোনমতে বলল,
—” সাঁঝ তুই বিয়ে করছিস? কবে?”
সাঁঝ হায় তুলয়ে তুলতে বলল,
—” সামনের শুক্রবার। ছয়দিন পরে। বর হলো তোদের ইহান স্যার। এবার তোরা স্বাভাবিক হয়ে যা। নাহলে আমি উঠে যাবো।”
ওরা কার্ডটা পড়া শুরু করলো। আর কিছুক্ষণ পরে নিজেদের প্ল্যানিংও শুরু হয়ে গেলো কে কি করবে। আর সাঁঝ শুধু বসে ওদের এই কান্ড দেখতে থাকলো। সাঁঝের চোখ হঠাৎ ইহানের উপর পড়লো। দূর থেকে দেখতে পেলো ইহান ফোনে কথা বলছে। সাঁঝ চাপাস্বরে আশিককে ডাকলো। সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত তাই তাদের কথা কেউ শুনছে না। সাঁঝ বলল,
—” একটা কাজ করে দিতে পারবি?”
—” হুম বল”
—” ইহান সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। অনিকের সাথে ইহানের কোন সম্পর্ক আছে কিনা খোঁজ নিবি তো। মানে ক্লাসমেট, বন্ধু বা দুজনের মধ্যে কোন সংযোগ আছে কিনা একটু খোঁজ নিস”
আশিক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
—” ইহান স্যারের সাথে তোর বিয়ে আর তুই উনাকে সন্দেহ করছিস?”
—” আরে না না ইহান অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি ওই অমানুষটার সাথে ইনার কোন যোগাযোগ আছে কিনা? আমি চাইনা অনিকের কোন ছায়া আমাদের জীবনে পড়ুক”
—” আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো”
—” হুম”
সাঁঝ মুখে অনিকের ছায়া না পড়ুক বললেও অনিকের ছায়া পড়লেও তার কিছু যায় আসে না। অনিক আর ইহানের কোন সম্পর্ক আছে কিনা এটা জানা দরকার। যদিও অনিকে চরিত্রের সাথে মিল আছে এমন কিছু দেখেনি ইহানের মধ্যে তাও কেন যেন এটা মনে হচ্ছে। (চলবে)