#কানামাছি
#পার্টঃ৬
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
সাঁঝ আংশিক হা করে তাকিয়ে আছে। সামনে ইহান নীল পাঞ্জাবি পরে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। পাশে একটা কম বয়সী ছেলে বসে আছে। ইহান আর সাঁঝ নিজেদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা ছাড়া আর কেউ রুমে নেই। ইহানের পাশের ছেলেটার কাশির শব্দে ওরা দুজনে হুঁশে ফিরে।
সাঁঝের বাসার লোকজনও অবাক হয়ে গেছে কারণ সাঁঝ পাত্রপক্ষের সামনে এসেই একটা না একটা কান্ড করে বসে। আজ চুপ আছে! রোমেসা বেগম ইহানকে বললেন,
—” এটা হলো মেয়ে। সাঁঝ। তুমি তো সাঁঝকে আগে থেকে চিনেই এসেছো তাই আর তেমন কিছু বললাম না”
ইহান একটু হেসে সাঁঝকে বলল,
—” আসসালামু আলাইকুম। আমি ইহান রহমান। তোমার ভার্সিটির লেকচারার। আমাদের তো আগে দেখা হয়েছে ভার্সিটিতে। আর এটা হলো আমার গার্জিয়ান। আমার মামা আবির”
সাঁঝ আড়চোখে ইহান আর পাশের ছেলেটার দিকে তাকালো। যাকে ইহান মামা বলছে সে নিতান্ত একটা বাচ্চা ছেলে। মনে হচ্ছে ফু দিলেই উড়ে যাবে। ইহান খুব আগ্রহ করে তাকে দেখছে। আর ইহানের দিকে তাকিয়ে সাঁঝের সেদিন ভার্সিটিতে ইহানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। পুরানো কথা মনে হতেই সাঁঝ নিজের ফর্মে ফেরত আসলো। সে হাতের সিগারেটটা মুখে চেপে ধরলো। এটা দেখে সাঁঝের পরিবার ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকলো। একটা ভালো ছেলে নিজে থেকে দেখতে এসেছিলো সাঁঝকে, সাঁঝ তাকেও তাড়াবে। নাহিদ অবশ্য মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলে পালিয়ে গেলে তারই সুবিধা।
সাঁঝ মাঝে মাঝে টান দেয়ার ভাণ করছে আর আড়চোখে ইহানকে দেখছে। মনে মনে গুণতে শুরু করেছে ইহান কতক্ষণে উঠে চলে যাবে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও ইহান উঠে গেলো না। বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝের দম বন্ধ হয়ে বমি বমি লাগা শুরু করলো। সিগারেটের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না সাঁঝের। কিছুটা ভয় হলো সবার মাঝে কি বমি করে দিবে নাকি? তারপর মনে হলো করলে ইহানের গায়েই করবে। তাতে সেদিনের ব্যবহারের একটা শাস্তি হবে। ইহান হঠাৎ সাঁঝকে বলল,
—” Can you share that with me?”
সাঁঝসহ তার পুরো পরিবার হা করে ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এমনকি ইহানের মামাও তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইহান আবার বলল,
—” আমাকে দাও”
সাঁঝ একপ্রকার ঘোরের মধ্যে থেকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। ইহান একটু হেসে সিগারেট নিয়ে নিজের ঠোঁটে চেপে ধরলো। আর বাকি সবাই তার দিকে এমন তাকিয়ে থাকলো যেনো সার্কাস হচ্ছে। ইহান বলল,
—” তাহলে কথা শুরু করি?”
রোমেসা বেগম বলল,
—” হ্যা শুরু করি। তোমার বাবা-মা কেউ আসবে না? আজ আসলো না যে!”
—” হ্যা মা-বাবা কাল আসবে। আসলে আমার মা-বাবা আমার পছন্দে বিশ্বাসী। তাই প্রথমে আমিই আসলাম মামাকে নিয়ে। আমার কিন্তু সাঁঝকে পছন্দ হয়েছে”
তারপর মামার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” মামা তোমার কেমন লাগলো মেয়েকে?”
ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল,
—” হ্যা হ্যা মেয়েকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে ভাগ্নের জন্য”
ইহান একটু হেসে সাঁঝের ফুফুর দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আসলে সাঁঝকে আমার প্রথম দিন ভার্সিটিতে দেখেই ভালো লেগেছিলো। তারপর আজ আবার ভালো লাগলো। আজ coincidentally আমাদের জামার রঙও একই”
রোমেসা বেগম আড়চোখে সাঁঝের দিকে তাকালেন। উনি বুঝতে পারছেন না সাঁঝ এরপর কি করবে? সাঁঝের প্রথম প্ল্যান তো মার খেয়ে গেলো।
সাঁঝ ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইহান নিজেও সিগারেট টানছে না কেবল মুখে ধরেছিলো তার মতো। এখন তো ইহানের মুখ লাল হয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে। সাঁঝের বুঝতে কষ্ট হলো না ইহানও তার মতো সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। ইহান জানালা দিয়ে সিগারেটটা ফেলে পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করলো। তারপর বলল,
—” তাহলে আংটি পরিয়ে দিই? মা আসার আগে দিয়ে দিয়েছে যাতে মেয়ে পছন্দ হলে আমি আংটি পরিয়ে আসি”
রোমেসা বেগম সাঁঝের হাত জোর করে এগিয়ে দিলো। ইহান আংটি পরিয়ে দিলো সাঁঝের হাতে। রোমেসা বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অবশেষে এই মেয়ে বিদায় হবে। উনি হেসে বললেন,
—” নাও মিষ্টি মুখ করো”
এরপর বেশ কিছুক্ষণ খাওয়া দাওয়ার পর্ব চললো। সাঁঝ তব্দা মেরে বসে থাকলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এমন কান্ড ঘটানোর পরেও কেউ তাকে আংটি পরিয়ে দিয়েছে! ভাবা যায়! খাওয়া দাওয়া শেষ হলে ইহানের মামা বলল,
—” আজ তাহলে আসি। কাল আপা আর দুলাভাই এসে বিয়ের তারিখসহ সব ঠিক করে যাবে”
সাঁঝের ফুফা বলল,
—” হ্যা হ্যা। কাল সব বিস্তারিতভাবে ঠিক করে নেবো”
ইহানরা উঠে চলে যাওয়ার সময় ফুফুরা তাদের এগিয়ে দিতে গেলেও সাঁঝ বসে থাকলো। সে ভেবে চলেছে বিয়েটা যদি সত্যি ঠিক হয়ে যায় তাহলে ভাঙবে কিভাবে ? অনিকের শাস্তি সম্পূর্ণ হয়নি। অনিকের খোঁজও বের করতে হবে। তাছাড়া ইহানকেও তেমন পছন্দ হয়নি। সাথে ইহানের আচরণ অনেক সন্দেহজনক। কোন মানুষ কেন একটা সিগারেট খাওয়া উগ্র মেয়েকে নিজের বউ বানিয়ে নিয়ে যাবে? কেন? সাঁঝের ভাবনার মধ্যেই ইহান আবার রুমে আসলো। সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,
—” ফোনটা নিতে ভুলে গেছি।”
ফোন নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘুরে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,
—” ভালোই হবে। বিয়ের পরে আমরা দুজন একসাথে সিগারেট খাবো”
এরপর চোখ মেরে চলে গেল। সাঁঝ হা করে ইহানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
নিজের ঘরে এসে চুড়িগুলো খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো। কাঁচের চুড়িগুলো পড়ে ভেঙে গেলো। ইহানের পরিয়ে দেয়া আংটিটাও ফেলে দিলো। রাগে গা হাত পা কাপছে সাঁঝের। মনে হচ্ছে সব ধ্বংস করে দিক। এভাবে তার প্ল্যান ফেইল হবে ভাবতেও পারেনি। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে! বিয়ে নামক সম্পর্কটার উপরও তার ঘৃণা আছে। আজ বিয়ে করবে। কতশত প্রমিস, স্বপ্ন থাকবে তারপর কাল সে মারা গেলে দুদিন যেতে না যেতে বর অন্য কোথাও বিয়ে করে সুখে থাকবে। এসব মিথ্যা সম্পর্কে জড়ানোর কোন মানে হয়না। সাঁঝের মতে, বিয়ের সম্পর্কটাও তার আর অনিকের সম্পর্কের মতো নাটক, মিথ্যা আর ঠুনকো হয়। সাঁঝ শাড়ি পরেই শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো লম্বা শাওয়ার নিয়ে বাইরে আসলো। এরপর ফুফুর কাছে গেলো কথা বলার জন্য
ফুফুকে আজ খুশি খুশি লাগছে। লাগবে নাইবা কেন? তাকে যে বিদায় করতে পারবে। সাঁঝ উঁচু গলায় বলল,
—” ওই ছেলে নাম্বার দিয়ে গেছে কোন?”
—” হ্যা কেন কথা বলবে?”
—” ফোন করে বলো আমি বিয়েতে রাজী না। তুমি না হলে আমাকে দাও আমি ফোন করছি”
—” কেন পছন্দ না? তুমি এতো কান্ড করার পরেও ছেলে তোমাকে পছন্দ করেছে। আংটি দিয়ে গেছে। তাও তোমার অপছন্দ হওয়ার কারণ কি? বয়স তো কম হলো না তোমার!”
—” ওই ছেলে তোমাদের পছন্দ হয়েছে? অবশ্য তোমাদের রুচি নিয়েই বা কি বলতে পারি? সবার সামনে বসে সিগারেট খায়! একটা নেশাখোর ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিবে?”
রোমেসা বেগম একটু হেসে বললেন,
—” ছেলেটাকে কিছু বলার আগে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখো। তুমি কেমন? নেশাখোর মেয়ের সাথে নেশাখোর ছেলেই যায়।”
সাঁঝ চিৎকার দিয়ে বলল,
—” তুমি মানা করবে না তাই তো? ঠিক আছে। কাল আসলে আমিই মানা করে দিবো”
সাঁঝ নিজের রুমে এসে জোরে দরজা বন্ধ করে দিলো। এই এলাকায় সবাই তাকে গুন্ডি বলে জানে। এটা ইহানের কানে তুলতে হবে। তার এলাকার গ্রুপের যে লিডার সাকিব তাকে ফোন করবে বলে ঠিক করলো। সাকিব তার থেকে ছোট। তার সব কথা মেনেই চলে। সাঁঝ ফোন দিলো। ওপাশে ফোন ধরার পরেই সাঁঝ বললো,
—” সাকিব ব্যস্ত আছিস?”
—” না আপু। বলো”
—” একটা কাজ করতে হবে। একটা ফোন নাম্বার দিচ্ছি। যার নাম্বার তার নাম ইহান। তাকে আমার সম্পর্কে বলবি। যে আমি গুন্ডামি করি। চাঁদাবাজি, টিজ সহ অনেক বাজে কাজ করি। যার জীবনে আমি যাবো তার জীবন ভাজা ভাজা করে দেবো। আমার থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো। তুই চাইলে নিজের পরিচয় দিতে পারিস।”
—” বিয়ে ভাঙতে হবে তো? আচ্ছা আমি বলছি”
—” হুম দেখনা। বিয়েটা ভাঙতে পারলে তোদের কাচ্চি খাওয়াবো”
—” আচ্ছা আপু আমি দেখছি”
সাঁঝ ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকলো। এবার নিশ্চয় ইহান নিজেই বিয়ে ভাঙবে? প্রায় আধা ঘন্টা পরে সাকিবের ফোন আসলো। সাঁঝ অনেক উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” কিরে কি বলল?”
—” আপু লোকটা বড্ড ঘাড়ত্যাড়া। আমার বলা কথাগুলো শুনলো। যে তুমি মারধর, চাঁদাবাজি এসব করো। শোনার পরে বলল, সমস্যা নেই। আমার সাঁঝের এই অভ্যাসগুলো আরো পছন্দ হয়েছে। আগে বলেননি কেন? আমার চাকরি না থাকলে চাঁদাবাজির টাকায় তো সংসার চলবে। আর মারধর করতে আমি পারিনা সাঁঝ পারে। ও আমাকে রক্ষা করবে দুষ্ট লোকের হাত থেকে। আর ও হচ্ছে boss lady টাইপের। এমন মেয়েই আমার পছন্দ।”
সাঁঝের মুখটা হা হয়ে গেলো। সাকিব আবার বললো,
—” আরো বলল তোমাদের বিয়েতে যেনো আমি আমার গ্রুপ নিয়ে যাই। ভালো মতো খেয়েদেয়ে আসি।”
—” আচ্ছা আমি রাখছি”
সাঁঝ ফোনটা রেখে শুয়ে পড়লো। মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। একদিকে অনিকের চিন্তা। আহত বাঘ বেশি ভয়ঙ্কর হয়। অনিক সম্পর্ক ভাঙার জন্য তার উপর এটাক করবে না তো? এটাক করলেও সমস্যা নেই তার। নিজের প্রতিশোধ পূরণ করতে পারলেই হলো। কিন্তু অনিক কি আহত না নিহত?
আরেকদিকে এই ইহান। কোথা থেকে টপকে পড়ে তার জীবনে ঝড় আনছে। বিয়ের জন্য একদম পিছে পড়ে গেছে। সাঁঝ দুটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমে তলিয়ে গেলো।
সকালের রোদ চোখে লেগে সাঁঝের ঘুম ভেঙে গেলো। পাশ ফিরে শুয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। সামনেই আশা আফরোজ বসে আছেন। সম্পর্কে ইনি সাঁঝের মা। সাঁঝ একবার ভালো করে তাকালো। যৌবনের সৌন্দর্যের কিছু অংশ এখনো চেহারার মধ্যে বিদ্যমান। চুলে পাক ধরেছে। মিষ্টি কালারের শাড়ি পরে বেশ রাশভারি মনে হচ্ছে। সাঁঝ ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” কি মনে করে সার্কাসের জোকার কে দেখতে এসেছেন?”
উনি বেশ আহত স্বরে বললেন,
—” মা তার মেয়েকে দেখতে আসতে পারে না?”
সাঁঝ বিদ্রুপ করে বলল,
—” মা! মেয়েকে দেখতে এসেছেন? এতোকাল কোথায় ছিলো এই স্নেহ? কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন সেটা বলেন”
—” মা কখনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসে সন্তানের কাছে?”
—” অন্যরা কি করে জানিনা। কিন্তু আপনি নিজেরটা ছাড়া কিছুই বোঝেন না”
—” এভাবে বলতে পারলে?”
—” ভুল কি বললাম? যাকে এতো ভালোবাসি ভালোবাসি করতেন তার মৃত্যুর দুই বছর পরে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিলেন। নিজেকে মা বলে দাবী করছেন তখন তো ঠিকই নিজের ছেলেমেয়েকে রেখে শশুড় বাড়িতে চলে গেলেন। এখম নিজেকে মা বলছেন!”
—” সাঁঝ একটা মানুষ তার অতীতকে নিয়ে থাকতে পারে না। তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। কি লাভ অতীতকে নিয়ে পড়ে থেকে? আমিও তাই সামনে এগিয়েছি”
সাঁঝ হো হো করে হেসে দিলো। তারপর বলল,
—” নিজের সন্তানরা আপনার কাছে অতীত। তাদেরকে পিছে ফেলে নতুন জীবন শুরু করেছেন। বাহ! নিজেকে মা দাবী করেন আবার! ছেলের মৃত্যুর পরে তো দেখতেও আসলেন না একবার। উনি নাকি মা!”
মা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল,
—” যাক বাদ দাও সেসব আমার জীবনের কথা। আমি তোমার জীবনের কথা শুনতে এসেছি। শুনলাম কাল একজন তোমাকে দেখতে এসেছিলো। ছেলেটা নাকি লেকচারার। ভালো ছেলে । তুমি বিয়ে কেন করতে চাচ্ছো না?”
সাঁঝ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
—” আমার জীবন আমার সিদ্ধান্ত। আমার বিয়ে করার ইচ্ছা নেই। বিয়ের উপর বিশ্বাস নেই। আর বিশ্বাস না থাকার কারণটাও আপনি”
সাঁঝের মা একটু অপেক্ষা করে বলল,
—” সকালে তোমার বাবা উনাদের সাথে কথা বলেছে। উনাদেরকে আমাদের ভালো লেগেছে। তুমি প্রাথমিক ভাবে হ্যা বলে দাও। তাহলে আমরা খোঁজ খবর নেবো আজ উনাদের বাসায় ঘুরে আসবো। আর ছেলে ভালো হলে। তুমি এই বিয়েটা করবে”
—” উনি আপনার স্বামী আমার বাবা নয়। আর এখন কি জোরজবরদস্তি করবেন বিয়ের জন্য?”
আশা বেগম মুখ শক্ত করে বললেন,
—” দরকার হলে করবো। কোন মা নিজের সন্তানের খারাপ চায় না। আমিও চাচ্ছি না। তোমার ভালোই হবে এতে”
—” আমার ভালো চান! আমার ভালো চাইলে যেদিন ভাইয়ার লাশের সামনে বসে কাঁদছিলাম সেদিন আমার পাশে বসে নিজের কাঁধটা এগিয়ে দিতেন যাতে আমি মাথা রেখে কান্না করতে পারি। আপনি চান আর না চান I don’t care। আমি বিয়ে করবো না”
সাঁঝ আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাকে পাশ কাটিয়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবলো রাতে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুমালে সকালটা এতো বাজে হতো না। পিছন থেকে মা বলে উঠলো,
—” আমার ঋণটা শোধ করে দাও তাহলে”
সাঁঝ পিছন ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকালো। মা আবার বলল,
—” ঋণদাতা যদি নিজের ঋণ ফেরত না চায় তাহলে সেটা তার মহানুভবতা হয়। আর ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতার কাছে ঋণ ফেরত চায় তাহলে ঋণগ্রহীতাকে সেটা ফেরত দিতেই হয়”
সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” কিসের ঋণের কথা বলছেন আপনি?”
—” মাতৃত্বের ঋণ। আমি তোমাকে নিজের শরীরের মধ্যে বড় করেছি। জন্ম দিয়েছি। একটা সময় পর্যন্ত পালন করেছি। এটাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঋণ”
সাঁঝ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকলো। একজন মা নিজের সন্তানের কাছে জন্ম দেয়ার, বড় করার প্রতিদান চাচ্ছে? এখন সাঁঝের সব কিছু মজার লাগছে। মানে আর কি বাদ আছে তার জীবনে? সাঁঝ কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করলো,
—” কিভাবে আমি আমার জন্মের ঋণ শোধ করবো?”
—” তুমি এখন হ্যা বলে দিবে। আমরা আজ যাবো ওখানে। আরো খোঁজ খবর নেবো। সব ঠিক থাকলে বিয়েটা তুমি করবে। আর সাহেলের ব্যাপারে কিছু বলবে না। সবাই জানবে ও এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সেই ভিডিওর ব্যাপারে কোন কিছু বলবে না।”
—” আমি না বললে বুঝি জানতে পারবে না? অন্য কেউ তো বলে দিতে পারে”
—” এসব ঘটনা যেমন হুট করে আসে তেমন হুট করে চলে যায়। কারোর মনে নেই। সর্বোচ্চ এটা জানতে পারে পুলিশ নিয়ে কিছু হয়েছিলো। সেটা আমি ম্যানেজ করে নেবো। তুমি এগুলোর মধ্যে একদম থাকবে না। অন্য কাউকে দিয়েও কিছু করাবে না”
—” আর যদি ছেলে ঠিক না থাকে তাহলে ঋণের কি হবে?”
—” ছেলে ঠিক না থাকলে বিয়ে বাতিল। অন্য কোন সম্বন্ধ আসলে সেখানে দেখে শুনে সব ঠিক থাকলে তোমার পছন্দ হলে বিয়ে করবে। আর কথা দাও তুমি নিজে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করবে না। এটাই হবে ঋণ শোধ ।”
সাঁঝ বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
—” ঠিক আছে। Deal done। এরপরে আমার কাছে আর কোনদিন মা হিসেবে আসবেন না। সব ঋণ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর কোন দাবী থাকবে না আপনার। সব শোধ করে দিচ্ছি আমি। আর আমি কথা দিচ্ছি নিজে থেকে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করবো না। এবার উনাদের হ্যা বলে আসুন”
সাঁঝ বাথরুমের দিকে হাঁটা ধরলো। একটু থেমে পিছনে না ঘুরেই জিজ্ঞেস করলো,
—” আপনি আমার বিয়ে নিয়ে এতো কেন ব্যস্ত হলেন?”
—” মা হিসেবে সন্তানের ভবিষ্যৎ সিকিউর করা আমার দায়িত্ব ”
সাঁঝ একটু হেসে চলে গেলো।
,
,
,
🌿
বিছানায় শুয়ে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সাঁঝ। ফ্যানটা সবসময় ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে। তার জীবনের মতো। ঘুরছে কিন্তু কোন আদি অন্ত নেই। আজ একটা বড় সিদ্ধান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়েছে। তার মন বলছে এবার বিয়েটা হয়েই যাবে। ভার্সিটিতে ইহানের প্রথম দিন ইহানের দিকে তাকানোই ভূল হয়েছে তার।
ফোনের শব্দ পেয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। অপরিচিত নাম্বার। ফোন তুলে বলল,
—” আসসালামু আলাইকুম ”
ওপাশ থেকে একটা ছেলে কণ্ঠে বলল,
—”ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?”
সাঁঝ কণ্ঠ চিনতে পারলো না। কিন্তু শুনতে ভালো লাগছে আওয়াজটা। বলল,
—” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কে?”
—” ইহান। তুমি তো হ্যা বলেই দিয়েছো। আজ তোমার বাসা থেকে আসছে এখানে। তাই জানাশোনার জন্য ফোন দিলাম”
—” ও আচ্ছা”
সাঁঝ অনুভূতিহীনের মতো কথা বলে যাচ্ছে। বলতে হচ্ছে তাই। ইহান জিজ্ঞেস করলো,
—” তোমার পছন্দের রঙ কি?”
—” কালো”
ইহানে হেসে জিজ্ঞেস করলো
—” আমারটা জিজ্ঞেস করবে না?”
—” আপনার পছন্দের রঙ?”
—” সাদা। তোমার পছন্দের খেলা কি? মানে কি খেলতে পছন্দ করতে বা করো? এই মানে দেশি খেলা যেমন, গোল্লাছুট, কানামাছি, বৌ-চুরি এগুলো মধ্যে?”
—” আমার সবই ভালো লাগে। ছোটবেলাতে সবই খেলতাম। আপনার?”
—” কানামাছি আমার খুব ভালো লাগে। আর যদি সেটা একজনের সাথে হয় তাহলে আরো ভালো। একটা মানুষের চোখ বেঁধে খেলিয়ে নেয়াটা বেশ ভালো লাগে। কোন দিকে আছে বা কোন দিক থেকে আঘার আসবে এটা সেই চোখ বাঁধা মানুষটা বুঝে না। বেশ মজার খেলা”
সাঁঝ মৃদু ঝটকা খেলো। ইহানের কথাগুলো তার কাছে অদ্ভুত,পরিচিত আর নিজের ভাবনার মতো ঠেকলো। (চলবে)