কাছের মানুষ দূরে থুইয়া পর্ব-০৩

0
429

#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#পর্ব৩
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ আমি কি করতাম? তোমরা আমাকে বলার সুযোগ দিছো? আমি যে এক ছেলেকে পছন্দ করতাম সেটা বলার? যখনই বলতে চাইছি তুমি আমার মুখের কথা নিয়ে নিছো আর তা না হলে আব্বার সামনে থেকে সরায় দিছো।

রেগে বলে উঠে কথাটা তটিনী। তানু ভ্রু কুঁচকায়।
-“ তোর ভালোর জন্যই তো করছি সব। তুই জানিস না বাবা এসব প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক মানে না? তুই যদি বলে দিতি তোর কি মনে হয় বাবা তোকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত?
-“ এর জন্যই তো ভাগ্যে নেই ঐ ছেলে। খোদাও বুঝে গেছিল পাবো না ঐ ফ্রট টাকে।
-“ মানে? অবাক হয়ে কথাটা বলল তানু। তটিনী তপ্ত শ্বাস ফেলে সব বলল। তানু মনে মনে হেসে নিলো প্রচুর।
-“ দেখছিস বাবা মায়ের কথা না শোনার ফল? আরো করবি প্রেম? এখন আব্বা যে তোর উপর রেগে আছে রাগ ভাঙাবি কি করে?
-“ বিয়ে ভাঙবে না?
তানু চোখ রাঙিয়ে তাকায়। তটিনী মিইয়ে যায়।
-“ আব্বা আমার সাথে কথা বলবে না আপু তাই না?
-“ তোর সাথে কথা বলার জন্য আব্বা বসে আছে গিয়ে কথা বলে আয়।
-“ সত্যি! বিস্ময় হয়ে কথাটা বলে তটিনী। তানু তটিনীর মাথায় গাট্টা মেরে বলে-
-“ বুদ্ধি হবে কবে তোর? খারাপ লাগছে না এমন টা করার জন্য? আব্বা ভীষণ হার্ট হয়েছে তটু৷ বারবার আশঙ্কায় মিইয়ে যাচ্ছিল আব্বা অপমান হওয়ার ভয়ে। জানিস তো আব্বার কাছে মানসম্মান টা আগে। এটা জেনেও কি করে এমন ভুল করলি?

তটিনীর গিল্টি ফিল হচ্ছে। তখন মাথায় এসব কাজ করছিল না তার। শুধু মাথায় এসেছিল পালাতে হবে। একজন কে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করা যায় নাকি? মানুষ টা সঠিক হলে এই গিল্টি ফিল টা কখনই করতো না তটিনী। কিন্তু এখন হচ্ছে। ভুল মানুষের জন্য বাবা মা,বোনকে এতো টা কষ্ট দিয়ে।

-“ ভুল করছি আপু। ট্রাস্ট মি এমন ভুল আর কখনও করবো না। শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। ভুল থেকেই তো শিক্ষা নেয় সবাই। আমিও নিলাম। তোমাদের কথার বাহিরে কিচ্ছু করবো না। আব্বুকে একটু বলো না রাগ কমাতে। আমি কথা বলবো। আব্বুর পা ধরে ক্ষমা চাইবো।
-“ ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা পাবি মনে হয়?
-“ পাবো পাবো। জানি আমি আব্বু রাগ করে থাকতেই পারবে না আমার উপর।
-“ এতই যখন জানতে তাহলে গেলে কেনো পালিয়ে?
-“ রিজন টা তো বললাম আপু। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল তটিনী।

তানু তপ্ত শ্বাস ফেললো। -“ বিয়েতে আপত্তি আছে এখনও?
-“ আপত্তি থাকলেও তো দিবে তোমরা বিয়ে। আর বিয়ে না করতে চাইলে আবার আব্বু আমার উপর ক্ষেপে যাবে। আমি মোটেও আর ঝামেলা পাকাতে চাই না। তোমাদের ডিসিশন আমি মেনে নিব।
-“ চল তাহলে। কথাটা বলে তানু তটিনীর হাত ধরে। সোজা বাবার রুমে যায়। তরিকুল ইসলাম কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। তার মেয়ে আজ ভীষণ বাড়াবাড়ি করেছে। সামান্য পড়ালেখার জন্য সে বিয়ে করতে চায় নি! সে তো বাঁধা দেয় নি। যখন জিজ্ঞেস করলো বিয়ে নিয়ে আপত্তি আছে কি না তখন একটু মুখ ফুটে বলতো। তাহলে তো আর এই বিয়ে নিয়ে এগোতো না।
-“ বাবা আসবো?
বড় মেয়ের কথায় ঘোর ভাঙে তরিকুলের।
-“ ওকে আমার সামনে এনো না তানু। আমি ওর মুখ দেখতে চাই না। একই ভঙ্গিতে থেকে কথাটা বলে তরিকুল ইসলাম। সে জানে তানু একা আসে নি। ছোট টাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে।
তটিনী অসহায় হয়ে বোনের দিকে তাকালো।
-“ বাবা ও ভুল করে ফেলছে তাই বলে তুমিও রাগ পুষে রাখবা?
-“ এটাকে ভুল বলে না তানু। আমরা ওকে ফোর্স করি নি বিয়ের জন্য।
তানু ইশারায় তটিনী কে রুমের ভেতর বাবার কাছে যেতে বলে। তটিনী ভয়ে ভয়ে গুটিগুটি পায়ে বাবার কাছে হেঁটে যায়। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে অপরাধীর ন্যায় বলে-
-“ সরি আব্বু আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বিয়েটা করবো। প্লিজ তুমি আমায় শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দাও। আমি জীবনেও তোমার কথার অবাধ্য হবো না।
তরিকুল ইসলাম চুপ রইলো। তটিনী বাবার দিকে একবার তাকায়৷ একটু রাগ ভাঙেনি। সহাসা পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
-“ বাবা প্লিজ এবারের মত ক্ষমা করো। কথা দিচ্ছি আমি আর জীবনেও তোমার কথার অবাধ্য হবো না।

তরিকুল ইসলাম সহসা উঠে বসলেন। তটিনীর থেকে পা ছাড়িয়ে তানির দিকে তাকিয়ে শক্ত মুখে বলে-
-“ ওকে আমি নিয়ে যেতে বলছি তানু। নিয়ে যাও।
তানু এবার রুমে ঢুকলো। তার বাবার মন এতো সহজে গলবে না। তটিনী কে ধরে রুম থেকে বের হয়।

-“ বললাম না গলবে না আব্বা। অনেক হার্ট করছিস।
-“ কি করবো এখন?
-“ আব্বা কে আব্বার মত থাকতে দে।

——————————-

সকাল থেকেই আত্মীয় এক এক করে আসছে তটিনী দের বাসায়। আজ গায়ে হলুদ। তরিকুল ইসলামের বোন তানিয়া বেগম পানের বাটা নিয়ে বসে আছে ড্রয়িং রুমে। লায়লা বেগম রান্না ঘরে শরবত বানাচ্ছে।
-“ তানুর মা শরবত টা হইলো নি?
-“ হ্যাঁ হয়ে গেছে আপা। শরবতের গ্লাস নিয়ে আসতে আসতে বলেন। তানিয়া বেগম শরবত টা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে বলে-
-“ যা গরম পরছে আজকে এক্কেরে মাথার চান্দি গরম তাওয়ার মতো হয়ে আছে। একটুকরো বরফ ফ্রিজে থাকলে দেও তো।
লায়লা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এই মহিলা আসলেই তার ফরমায়েশ খাটতে খাটতে জীবন শেষ হয়ে যায় । ফ্রিজ থেকে এক বাটিতে কয়েক টুকরা বরফ এনে দেয়৷ তানিয়া বেগম টকটকে লাল দাত গুলে বের হেঁসে বলে-
-“ বরফ টা চান্দিতে মাখিয়ে দাও৷ একটু আরাম পাই।
লায়লা বেগম বরফ ডলতে শুরু করলেন।
তটিনী ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ড্রয়িং রুমে আসে। তানিয়া বেগম সেদিকে চেয়ে বলে-
-“ ঐ ছ্যামড়ি তোর না আজকে গায়ে হলুদ পার্লারে যাস নাই ক্যা?
তটিনী ফোনে টাইম দেখলো। -“ এখন বাজে কেবল ৯ টা ফুপি।
-“ তাতে কি? পার্লারে কত ভীড় হয় জানস তুই?
-“ তুমি জানো?
-“ হ তাসলিমা কয়েক দিন পর পর পার্লারে যায়। চার পাঁচ ঘন্টা পরে আসে বাড়িতে। সামান্য ব্রু ফ্লাক করতেই নাকি চার ঘন্টা লাগে।

তানু নিচে নামতে নামতে কথাটা শুনলো। তটিনীর পাশে বসে ফিসফিস করে বলল-
-“ ফুপি যদি শুনে তার মেয়ে পার্লারের নাম করে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যায় তাহলে কি হবে ধারনা করেছিস?
-“ মাইর একটাও মাটিতে পরবে না।
-“ হুমম। মেয়েটাকে বুঝাতে হবে। ভালোবাসা টা অপরাধ না। তবে প্রেম হারাম। এই হারাম প্রেম আমাদের ফ্যামিলির মেম্বার দের জন্য না।
তটিনী চুপ রইলো। আর তখনই সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো তটিনীর খালা লাবন্য। কোলে দু বছরের মেয়ে। তটিনী এগিয়ে গেলো। বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে- কেমন আছো খালামুনি?
লাবন্য তটিনীর গাল টেনে বলে- ভালো আছি। তুই?
-“ আমিও ভালো আছি।
তানু লাবন্যর ল্যাগেজ টা নিলো। লাবন্য সোফায় গিয়ে বসলো।-“ কেমন আছেন আপা?
তানিয়া বেগম মুচকি হেঁসে বলল- “ ভালোই আছি। তোমার জামাই আইলো না যে?
-“ ও কাল আসবে। আসলে অফিস থেকে ছুটি দেয় নি তো।
-“ ওহ্ আচ্ছা। এই তটু মাইয়া টারে আমার কোলে দে। দেহি একটু।
তটিনী বাচ্চা টাকে তানিয়া বেগমের কোল দিলো।
-“ যা মুখ ধুইয়া আয়। সেই কতক্ষণ ধইরা ব্রাশ করতাছোস।

তটিনি বেসিনে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো। খাবার টেবিলে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মা ক্ষুধা পাইছে।
লায়লা মেয়ের পানে চেয়ে বলল-
-“ তো আমি কি করবো?
-“ খাবার দাও।
-“ খাবার কি আমি ধরে নিয়ে বসে আছি? টেবিলে নেই খাবার?

তটিনীর মুখ চুপসে যায়। তটিনী চাচ্ছে স্বাভাবিক হতে কিন্তু তার মা বাবা হতে দিচ্ছে না। একটা ভুলের মাশুল তাকে অনেক দিন বয়ে যেতে হবে।
তটিনী খাবার বাড়ার জন্য চামিচে হাত দিতেই সেটা তানু হাতে নিয়ে খাবার বেড়ে দেয়।
-“ ক্ষিদে লেগেছে,ক্ষুধা পেটে জমিয়ে রেখে কি হবে? আম্মু বেড়ে দিতে হবে কেনো?
-“ আম্মুর রাগ এখন ও তো কমলো না আপু।
-“ কমবে কমবে এখন চুপচাপ খা।
তটিনী চুপচাপ খেলো। খাবার গুলো বারবার গলায় আঁটকে যাচ্ছিল। একটা ছোট্ট ভুল তাকে বেশ দূরে নিয়ে গেলো কাছের মানুষ গুলোর থেকে।

———————————-

পার্লার থেকে সেজে এসেছে তটিনী তানুর সাথে। শরীর গাঢ় হলুদের লাল পাড় দেওয়া শাড়ি। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তটিনী। আর তখনই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে তটিনীর মামা তো বোন ঐশি। এবার একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।
-“ আপু হয়েছে?
-“ হুম। ছোট্ট করে জবাবা দিলো তটিনী।
-“ চলো সবাই অপেক্ষা করছে।
ঐশি তটিনী কে নিয়ে ছাঁদে যায়। ছাঁদে আসতেই তানু এগিয়ে যায় বোন কে নিতে। স্টেজে বসিয়ে কয়েক টা ছবি তুলে। তানুর হাজবেন্ড তাজদিদ কে ফোন দিয়ে তটিনীর সাথে ডুয়েট পিক তুলে। তাজদিদ এসেছে সন্ধ্যায়। সাথে তাজদিদের কিছু কাজিন আর তাসফির ফ্রেন্ড।

তানু গিয়ে তার বাবা আর মা কে ডেকে আনে হলুদ ছুঁইয়ে দেওয়ার জন্য। তরিকুল ইসলাম আর লায়লা বেগম একত্রে আসে। তটিনী তাকায়,অনুশোচনায় দগ্ধ সে। কালই তো চলে যাবে ঐ বাড়ি। তার বাবা মা এখনও রেগে থাকবে! তরিকুল ইসলাম হলুদ ছোঁয়াতেই তটিনী ছলছল নয়নে বলে উঠে –
-“ এখনও রেগে আছো আব্বু? একটু কি ক্ষমা করা যায় না? কাল তো চলেই যাবো। করে দাও না ক্ষমা। ইচ্ছে হলে হাজার টা থাপ্পড় মারো। তবুও ক্ষমা করে দাও। ভুল করেছি স্বীকার করছি৷ প্লিজ ক্ষমা করো।
তরিকুল ইসলাম গালে হলুদ ছুঁইয়ে চলে আসলো। আর থাকলো না সেখান টায়। তটিনী অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। লায়লা বেগম শীতল কন্ঠে বলল-
-“ সময় দে ঠিক হয়ে যাবে।
তটিনী মায়ের হাত জড়িয়ে ধরলো।
-“ মা আমি আর জীবনেও তোমাদের কথার অবাধ্য হবো না।
লায়লা বেগম কিছু বললো না। একএক করে সবাই হলুদ ছোঁয়ালো।

ওদিকে তাসফি বসে আছে রুমে। শরীরে তার সাদা পাঞ্জাবি। ফোন স্ক্রোল করছে। তাজদিদ তটিনীদের ওখানে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলেই বাসায় ব্যাক করে। তাসফির ফ্রেন্ড তুহিন রুমে ঢুক তাসফির পিঠে থাপ্পড় মেরে বলে-
-“ কাজ টা কি ঠিক করলি ভাই? মাইয়া টা আদিল রে ভালোবেসে ফেলছিল।
তাসফি ভ্রু কুঁচকালো। -“ দরদ লাগছে তোর আদিল তটিনীর জন্য? আমার জন্য হচ্ছে না?
-“ আরে ব্যাটা হবে না কেনো দরদ। আদিল ও তো তটিনী রে ভালোবাসতো।
তাসফি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে-
-“ সিরিয়াসলি ও ভালোবাসতো তটিনী কে? যদি ভালোই বাসতো তাহলে আমার কথার জন্য সে তটিনীর হাত ছাড়তো না। বুক ফুলিয়ে বলতো সে তটিনী কে ছাড়বে না।
-“ তুই যেই থ্রেট দিছিস সেখনে কোনো ছেলের সাধ্যি ছিল না তার প্রেমিকা কে ধরে রাখার।
-“ আমাকে কেউ থ্রেট দিয়ে দেখুক তটিনী কে ছেড়ে দেওয়ার তার অবস্থা বারো টা বাজিয়ে দিব। এক বছর ধরে মেয়েটাকে মন কুটিরেতে জায়গা দিয়ে রেখেছি ছয় মাসের পরিচিত হওয়া এ ছেলেকে দিয়ে দেওয়ার জন্য নাকি?
-“ তটিনী বিয়ের ওর জানলে কি হবে?
-“ যা হওয়ার তাই হবে। বিয়ে হয়ে যাবে ডিভোর্স হবে না। সো সে আমারই থাকবে।
তাসফি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথাটা বলে উঠল। সাথে সাথে মেসেজ আসলো। তাসফি ওপেন করো। মুহুর্তে ভেসে উঠলো তটিনীর গায়ে হলুদের ছবি। এক চিলতে হাসি ফুটলো গম্ভীর মুখটায়। বিরবির করে বলল মাশা-আল্লাহ।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে