#সূচনা_পর্ব
#কাছের_মানুষ_দূরে_থুইয়া
#Raiha_Zubair_Ripti
ভালোবাসার মানুষটির খোঁজে তার বাসায় এসে যে তারই বিয়ে দেখবে তা কল্পনাতেও ভাবতে পারি নি তটিনী । গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে এই সুদূর রাজশাহীর শহরে যার ভরসায়, আজ সেই মানুষটির বিয়ে হয়ে গেছে অন্য এক মেয়ের সাথে!
বিয়ে বাড়ির এক পাশে নিস্তেজ বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে জল। সবাই আড়ঁচোখে দেখে চলছে তটিনী কে। এই বিয়ে বাড়িতে হঠাৎ ল্যাগেজ সহকারে এমন সাদামাটা একটা মেয়েকে দেখে। আর সামনেই স্টেজে বসে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আদিলের৷ এই মুহূর্তে তটিনী কে সে তার বাড়িতে আশা করে নি। তটিনী এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো আদিলের দিকে। আদিল বারবার ঢোক গিললো। তটিনী যদি সবার সামনে সিনক্রিয়েট করে তাহলে মানসম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। অপমানিত হবে লোকজনের সামনে। তটিনী আদিলের সামনে আসতেই আদিল বসা থেকে উঠে তটিনীর হাত ধরে সাইডে নিরব জায়গায় নিয়ে যায়।
এতেই যেনো লোকজন কানাঘুঁষা শুরু করে দেয়। লোকজন বলাবলি শুরু করে দিয়েছে আদিল ওভাবে মেয়েটার হাত ধরে নিয়ে গেলো কেনো? আর ঐ মেয়েটাই বা কে? মেয়েটা কাঁদছিল ই বা কেনো? মেয়েটা আর আাদিলের মধ্যে কিসের সম্পর্ক?
আদিল তটিনীর হাত ছেড়ে দিতেই তটিনী আদিলের শেরওয়ানির কলার চেপে ধরে। এতোক্ষণ আঁটকে রাখা কান্নার দলা এবার হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসলো। রাগে শরীর কিলবিল করছে।
-“ তুমি বিয়ে করে নিলে! এই তুমি না আমাকে ভালোবাসতে? তাহলে অন্য মেয়েকে বিয়ে করলে কি করে?
আদিল তটিনীর থেকে শেরওয়ানির কলার ছাড়িয়ে বলে-“ তুমি এখানে কেনো? আর আসবে জানাও নি কেনো?
তটিনী দাঁতে দাঁত চেপে বলে- তোমাকে বলি নি বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে বাবা? বলিনি আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না? বলিনি আমি পালিয়ে চলে আসবো?
আদিল ভ্রু কুঁচকালো। -“ আর ইউ ক্রেজি? বাসা থেকে কেনো পালিয়ে এসেছো? আমি কখনও তোমায় বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি? তুমি এখনই তোমার বাসায় ব্যাক করো।
তটিনি অবাকের শীর্ষে চলে গেলো।-“ ম..মানে ক..কি বললে এটা তুমি? তুমি আমায় ভালোবাসতে না?
আদিল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-“ হ্যাঁ ভালোবাসতাম তাই বলে কি বিয়ে করবো এমন কিছু বলছি? আর তোমাকে কেনো আমি বিয়ে করবো? জাস্ট টাইম পাস ছিলো তোমার সাথে। আর আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে জানো সে কে? এই শহরের ধনীদের কাতারে পড়ে তারা।সেখানে তাকে রেখে আমি তোমায় বিয়ে করবো! কখনও দেখেছো কেউ বিরিয়ানি সামনে রেখে পান্তা ভাত খায়? তুমি প্লিজ তোমার বাসায় চলে যাও। তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করো। আমার বিয়েতে অশান্তি করো না।
সহসা তটিনী কোষে এক চ’ড় বসিয়ে দেয় আদিলের গালে। চোখ মুখ জুড়ে ভাসমান রাগ ঘৃণা। আদিল গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকায় তটিনীর দিকে। -“ তুমি আমাকে থাপ্পড় দিলে!
-“ এই থাপ্পড় টা সেদিন মা’রা উচিত ছিলো যেদিন তুই আমায় প্রপোজ করেছিলি। তোর মত লোভী গিরগিটি কে যে আমি তটিনী ভালোবাসছি সেজন্য নিজের উপর উপহাস হচ্ছে। তুই কি ভেবেছিস তুই বিয়ে করে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবি? অন্যের সুখ হারাম করে থাকতে পারবি সুখে?
-“ একে তো আমায় থাপ্পড় দিয়েছো আবার আমার চিন্তা করছো। আমার চিন্তা তোমার না করলেও চলবে। তুমি প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না,হাত জোড় করে রিকুয়েষ্ট করছি । চলে যাও।
তটিনী রাগী রাগী চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে হনহন করে ল্যাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বিয়ে বাড়ি থেকে। আদিল দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। স্টেজের কাছে আসতেই আদিলের বউ আইরিন জিজ্ঞেস করলো- কে ছিল মেয়েটা? হুট করে এসে আবার হুট করে চলে গেলো?
আদিল হাসার চেষ্টা করে বলে- ও ঐ মেয়েটা আমার ফ্রেন্ড ছিল। আসলে বিয়ে করেছি এতো তাড়াহুড়ো করে ওকে বলিনি সেজন্য রাগ করে চলে গেছে।
আইরিন ওহ্ বলে নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে থাকে তটিনী। এদিকে রাত ও ঘনিয়ে এসেছে। আকাশ টাও মেঘলা মেঘলা করছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো। একদিনেই এত মসিবত না আসলেই কি হতো না? বাসা থেকে যে পালিয়েছে এটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাসার সবাই জেনে গেছে। আর বাবার কানে তো গেছেই কথাটা৷ কোন মুখ নিয়ে এখন বাসায় ফিরবে? পরশু বিয়ে। ছেলের বাড়ির কানে কি চলে গেছে পাত্রী বাসা থেকে পালিয়েছে? বাসায় গেলে চড় থাপ্পড় গালে কয়টা পড়বে হাতের কড় গুনে দেখছে তটিনী। সবার প্রথম তার মা দিবে, তারপর বড় আপু,তারপর বাবা। আর বাবার একটা থাপ্পড় মানে গাল দশ দিনের জন্য লাল হয়ে থাকা। আর ব্যাথার কথা নাই বলা হলো।
পরপর থাপ্পড়ের কথা গুলো মনে পড়ে তটিনীর ইচ্ছে করলো এই রাস্তায় হাত পা ছুঁড়ে কান্না কাটি করতে। লোকজন ঠিকই বলে,,বাবা মায়ের উপর মাতব্বরি করলে কপালে দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই জুটে না। কি দরকার ছিল বাসা থেকে এই ফালতু ছেলের জন্য পালানোর? এখন বাসায় গিয়ে তো মা’র তটিনী কেই খেতে হবে।
কথাগুলো ভেবে একটা রিকশায় উঠে পড়লো তটিনী । স্টেশনে যেতে হবে তারপর ট্রেন ধরে বাসায় ব্যাক করতে হবে। এ ছাড়া তো উপায় নেই।
আদিল ছেলেটার সাথে ছয় মাসের রিলেশন ছিলো তটিনীর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো দু’জনেই। তটিনী বাসা ছেড়ে হলে থাকতো। ছয়মাস আগে আদিল প্রপোজ করে তটিনী কে। তটিনীর ও ভালো লাগতো আদিল কে। কেননা ছেলেটা পুরোই চকলেট বয় ছিল। কিন্তু তটিনী ভুলেই গিয়েছিল চকলেট বয় রা আসলে প্লেবয় হয়।
এই তো সপ্তাহখানেক হয়েছে তটিনী ভার্সিটি থেকে বাসায় চলে গেছে৷ বাড়ি থেকে জরুরি তলব জানিয়েছিল তার মা। তটিনী ইমার্জেন্সি ভেবেই এসেছিল। কিন্তু বাসায় এসেই জানতে পারে তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে তটিনীর বড় বোন তানুর দেবরের সাথে। যার সাথে জীবনে সে কথা বলে দেখে নি। শুধু চোখেই দেখেছে। সবসময় গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকে। মনে হয় হাসি তার ডিকশিনারিতে নেই। এমন এক রোবট কে সে বিয়ে করবে! কথাটা ভেবেই নতুন করে কান্না পাচ্ছে তটিনীর।
স্টেশনে এসে টিকেট কিনে অপেক্ষায় বসে রইলো স্টেশনে ট্রেনের জন্য। না জানি বাসায় কি অপেক্ষা করছে তারজন্য।
———————————
নিকষ কালো আঁধারে ঢেকে আছে পুরো আকাশ। থেকে থেকে আকাশের চাঁদ টা কালো মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়ছে আবার মেঘ সরে যেতেই তার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেলকনিতে গিটার হাতে নিয়ে বসে আছে এব যুবক। গিটারে সুর তুলতে ব্যার্থ। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। ইচ্ছে করলো গিটার টা এই দুতলা থেকে নিচে ফেলে দিতে। এরমধ্যে পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে। যুবক টি গিটার টা সাইডে রেখে ফোন টা রিসিভ করে। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু কথা অস্থির কন্ঠ ভেসে আসলো। যুবকটি ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলল-
-“ ও এখন কোন স্টেশনে?
ওপাশ থেকে হয়তো স্টেশনের নাম ভেসে আসলো। যুবক টি শক্ত মুখ করে বলল-
-“ আমি দেখছি।
কথাটা বল ফোন কেটে দিলো ফোনের ওপাশে থাকা ব্যাক্তির মুখের উপর। তারপর সাইড থেকে গিটার টা নিয়ে সুর ধরলো। সুরের তালে গেয়ে উঠলো-
ওরে নীল দরিয়া
আমায় দেরে, দে ছাড়িয়া
বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া ।।
কাছের মানুষ দূরে থুইয়া,
মরি আমি ধড়-ফড়াইয়া রে ।।
দারুণ জ্বালা দিবানিশি, ।।
অন্তরে অন্তরে
আমার এত সাধের মন বধূয়া হায়রে
কি জানি কি করে…
গান টা গেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গায়ে হুডি জড়িয়ে বের হলো বাসা থেকে এই মধ্য রাতে। গন্তব্য স্টেশনে।
#চলবে?